Sunday, 29 October 2023

অনন্ত যুদ্ধে ইজরায়েল-প্যালেস্টাইন? (৩)

ধর্মীয় ভাবনায় রাষ্ট্র গঠন আর নয়

সুব্রত হালদার



প্রথম পর্ব:

https://ekakmatra2013.blogspot.com/2023/10/blog-post_27.html

দ্বিতীয় পর্ব:

https://ekakmatra2013.blogspot.com/2023/10/blog-post_28.html


তৃতীয় পর্ব

বর্তমান ইজরায়েল রাষ্ট্র গঠনের প্রেক্ষাপটের দিকে তাকালে আমরা দেখব থিওডর হার্জল (অস্ট্রিয়ান ইহুদি, ১৮৬০-১৯০৪) ১৮৯৭'তে প্রতিষ্ঠা করেন 'The World Zionist Organization'। তার এক বছর আগে ১৮৯৬'তে তিনি এ বিষয়ে একটি ইস্তাহার প্রকাশ করেন যাতে একদিকে ইহুদি ঐক্যের আহ্বান, আর অন্যদিকে তাদের 'প্রমিসড ল্যান্ড'এ ফিরে যাবার আবেদন ছিল। বিংশ শতকের প্রথম দিক থেকেই প্রমিসড ল্যান্ডে ইহুদি অভিবাসন বাড়তে শুরু করে। ইতিমধ্যে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (১৯১৪-১৮), সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব (১৯১৭), অটোমান সাম্রাজ্যের পতন এবং বলকান নীতির অংশ হিসেবে বর্তমান ইজরায়েল ও প্যালেস্টাইন অংশে সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটেনের অনুপ্রবেশ ঘটে এবং তারা 'লিগ অব নেশনস'এর ম্যান্ডেট নিয়ে এই এলাকা সামরিক ও রাজনৈতিভাবে দখল নেয়। 

এই বৃটিশ পর্বে ইহুদি অভিবাসন এই এলাকায় প্রচুর পরিমাণে বেড়ে যায়। গড়ে ওঠে General Federation of Labour। ১৯২০'তে General Federation of Labour'এর ছত্রচ্ছায়ায় গড়ে ওঠে একটি গোপন ইহুদি সামরিক সংগঠন, যার নাম Haganh (হিব্রুতে যার অর্থ: 'Defense')। পরে ১৯২৯ সালে Chaim Weizmann (বৃটিশ ইহুদি) প্রতিষ্ঠা করেন 'Jewish Agency of Israel', যার সদর দফতর করা হয় জেরুজালেম। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, Chaim Weizmann ছিলেন লন্ডনে বৃটিশ সরকারের বিশেষ ঘনিষ্ঠ। এই সংগঠনের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য হিসেবে ঘোষণা করা হয়, আবিশ্ব ইহুদি জনগোষ্ঠীর কাছে ইজরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য সাহায্যের আবেদন জানানো এবং ওই অংশে ইহুদি অভিবাসন ক্রমাগত বাড়ানো হবে। এরপর ১৯৩১'এ গড়ে ওঠে 'Irgun Zvai Leumi' (হিব্রুতে যার মানে: National Military Organization), সংক্ষেপে Itzel, যা নীতির দিক থেকে ছিল সমাজতন্ত্র বিরোধী এবং তীব্রভাবে আরব বিরোধী একটি অতি দক্ষিণপন্থী সশস্ত্র সংগঠন। এদের লক্ষ্য হিসেবে ছিল জর্ডন নদীর দুই পাশকে আরব মুক্ত করে সেখানে ইহুদি জনবসতি স্থাপন এবং এই লক্ষ্য পূরণে প্রয়োজনে সশস্ত্র ক্ষমতার প্রয়োগ।

একদিকে প্যালেস্টাইনে যখন এইরকম ঘটনাক্রম নির্দিষ্ট আকার নিচ্ছিল তখন ইউরোপে নতুন করে যুদ্ধ প্রস্তুতি চলছিল। ১৯৩৩'এ নাৎসিরা জার্মানিতে ক্ষমতা দখল করে। এরপর সেখানে শুরু হয় ইহুদি বিতারণ ও ১৯৩৯-৪৫ দ্বিতীয় যুদ্ধকালীন পর্যায়ে কুখ্যাত ইহুদি হলোকাস্ট। এর মধ্যেই মে ১৯৪২'এ David Ben Gurion নিউ ইয়র্কের বিল্টিমোর হোটেলে একটি ইহুদি জিওনিস্ট সম্মেলনে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে সমর্থন আদায়ে সক্ষম হন- Unrestricted Jewish Immigration to Palestine, The Creation of a Jewish Army and The Establishment of Palestine as a Jewish Commonwealth। উল্লেখ্য, এই সম্মেলনের পরে জিওনিস্ট ও নন-জিওনিস্ট ইহুদিদের মধ্যে স্পষ্ট বিভাজন হয়ে যায়। ইতিমধ্যেই ১৯৪০'এ Itzel ভেঙে তৈরি হয়েছে চরম দক্ষিণপন্থী Stern Gang বা 'Lohamei Heruf Yisrael' (Fighter for the Freedom of Israel)। ১৯৪৮'এ ব্রিটিশ ম্যান্ডেটে ইজরায়েল রাষ্ট্র গঠন হবার পরে এই সমস্ত গোপন, আধা-গোপন বা খোলাখুলি থাকা সামরিক সংগঠনগুলি দ্রুত ইজরায়েল স্টেট মিলিটারিতে মিশে যায় এবং Haganh'এর সামরিক নেতা Pinhas Sapir নির্বাচিত হন Director General, Ministry of Defence। এই Pinhas Sapir নামটি গুরুত্বপূর্ণ এই কারণে যে, ১৯৬৩'এ অর্থমন্ত্রী হবার পর তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছ প্রয়োজনীয় অর্থনৈতিক ও সামরিক সাহায্যের নিশ্চয়তা আদায়ে চুক্তি করতে সক্ষম হন। ইতোমধ্যে, ১৯৬৭'তে আরব-ইজরায়েল দ্বিতীয় যুদ্ধ হয় এবং তার প্রভাব হয় সুদূরপ্রসারী। সে অন্য আলোচনা।

এখন প্রশ্ন হল, এই সমস্যার সমাধান কিছু আছে কী? থাকলে তা কী? এটা সম্ভবত স্পষ্ট যে ধর্মীয় ভাবনার উপরে ভিত্তি করে নির্মিত রাষ্ট্র, রাষ্ট্রীয় কাঠামো ও রাষ্ট্রভাবনা সমূহ, কিংবা শুধুমাত্র ধর্মীয়-জাতিরাষ্ট্র গঠন এ সমস্যা থেকে বের হতে দেবে না। ফলে, ইসলামি রাষ্ট্রভাবনা, ক্রিস্টানি রাষ্ট্রভাবনা, ইহুদি রাষ্ট্রভাবনা, এমনকী আমাদের দেশের হিন্দু রাষ্ট্রভাবনাকেও বিরোধ করতে হবে। একটি আধুনিক রাষ্ট্রের থাকতে হবে মানবিক দৃষ্টিকোণ, সমতার দৃষ্টিকোণ, ন্যাচারাল জাস্টিসের দৃষ্টিকোণ। এ ছাড়া কোনও বিরোধ মীমাংসা, ধর্মীয় সংকীর্ণতা দিয়ে কোনও বিরোধ মীমাংসা আসলে অসম্ভব, অবাস্তব ও আধুনিক জগতের ক্ষেত্রে অচল। ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়া, উচ্চতর স্তরের ক্রিয়া এবং আরও উচ্চতর স্তরের প্রতিক্রিয়া- এভাবে চলতে চাইলে মানবিক অবক্ষয়, জাতি দাঙ্গা, ধর্মীয় দাঙ্গা, যুদ্ধ ও নানান স্তরের পারস্পরিক হানাহানি থেকে মুক্তি নেই। আমাদের চিন্তন প্রক্রিয়ার অভিমুখ হচ্ছে (প্রায় অধিকাংশ সময়ে তাইই নজরে আসে ) প্রধানত কৌশলগত যা সাময়িক লাভ-ক্ষতির নিরিখে চুলচেরা হিসেবনিকেশের উপরে ভিত্তি করে করা। কৌশলগত হিসেবনিকেশ প্রধান জায়গা নিয়ে নিলে ইতিহাসের নির্দিষ্ট নিয়মে তার মূল্য চোকানোই দস্তুর। আমার নিজের বিশ্বাস, ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে এমন একটি ঐতিহাসিক ভুল ছিল খিলাফৎ আন্দোলনকে সমর্থন করা। ঐতিহাসিক ভুল ছিল ধর্মের ভিত্তিতে জাতিসত্তার স্বীকৃতি। আজকের দিনে কৌশলগত অবস্থানের তুলনায় নীতিগত অবস্থান ক্রমশ দুর্বল থেকে দুর্বলতর হচ্ছে। নীতিগত অবস্থানের উপরে কৌশলগত অবস্থানকে স্থান দেবার মানসিকতা একটি বিপজ্জনক প্রবণতা বলেই মনে করি। 

আজ এত বছর পরে এসে ইজরায়েল রাষ্ট্র গঠনের বিরোধ করা অর্থহীন। কিন্তু বিরোধ করতেই হবে জিওনিস্ট ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের উদগ্র ইচ্ছেকে। আজ যদি হামাস দাবি করে, পুরো ইজরায়েলকে ইসলামি রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করাই তাদের লক্ষ্য, তবে সে লক্ষ্যকেও বিরোধ করতেই হবে। ফিলিস্তিন, ইসলামি ও ইহুদি সমন্বিত রাষ্ট্রভাবনায় রাষ্ট্র গঠনই বাঞ্ছনীয় বিকল্প হতে পারে। কিন্তু তা কার্যকরীভাবে হতে গেলে দু' পক্ষকেই কট্টরপন্থী জিওনিস্ট ধর্মমুখি রাষ্ট্র গঠনের মনোভাবকে ছাড়তে হবে। সেই আপাত অসম্ভব কাজটি তারা করবে এমন কোনও আশু বা দূরবর্তী সম্ভাবনা যেহেতু দেখা যাচ্ছে না, সুতরাং যা চর্মচক্ষে দেখা যাচ্ছে তার উপরে দাঁড়িয়ে ভাষ্য নির্মাণ করা চলে না। 

ইজরায়েল ও হামাসের ইহুদি ও মুসলিম বিরোধের মাঝখানে থাকা ও ঘটনার বলি হওয়া শান্তিপ্রিয় আধুনিক মননের অধিকারী মানুষরা সেখানে নেই, একেবারেই নেই, স্রেফ শূন্য, এমনটা ভাবা চলে না। এ দেশে যখন খিলাফৎ আন্দোলনের সমর্থন চলছিল তখন তুর্কিতে কামাল আতাতুর্কের উত্থানের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছিল, আমরা নেহাতই কানে খাটো হয়তো, তাই শুনতে পাইনি। তাই মনে হয়, সেই আধুনিক মননের অধিকারী মানুষরাই- তা সে আজ যতই অবরুদ্ধ স্তরে থাকুক না কেন- হতে পারে ভবিষ্যতের সত্যিকারের দিশারী। এমন মানুষ সব দেশে, সব কালেই ছিল। ফিলিস্তিন ও ইজরায়েলেও নিশ্চিতভাবে আছে। তাদের মননগত ঐক্যই বাঞ্ছিত ও কাম্য ঐক্য। সেই ঐক্যের সন্ধানই আজকের রাজনৈতিক দিশা হওয়া উচিত এবং নির্দিষ্ট দিশায় তার প্রয়োগ হতে হবে। ভারতীয় উপমহাদেশের ক্ষেত্রেও আজকের সময়ে বিষয়টা একইরকমভাবে সত্যি।

(শেষ)।


2 comments:

  1. সংক্ষিপ্ত একটা ইতিহাস জানলাম। লেখককে ধন্যবাদ।

    ReplyDelete
  2. তথ্য সুন্দর লেখা, আমাদের দেশেও এরকম যুদ্ধ দাঙ্গার বীজ এ সার জল নিয়মিত দেয়া উচ্ছে

    ReplyDelete