দিল্লিতে তাণ্ডব
সোমনাথ গুহ
গতকাল খোদ রাজধানীতে দিল্লি পুলিশ সাংবাদিক, লেখক ও রাজনৈতিক নেতানেত্রীদের ওপর বেনজির হামলা চালিয়েছে। চিন থেকে অর্থ সাহায্য পাওয়ার ভুয়ো অভিযোগ খাড়া করে তারা ‘নিউজক্লিক’ সংবাদ সংস্থার সম্পাদক প্রবীর পুরকায়স্থ এবং বরিষ্ঠ সাংবাদিক পরঞ্জয় গুহঠাকুরতা, উর্মিলেশ সহ ৪৬ জন সাংবাদিক ও লেখকদের ঘরবাড়ি, অফিস তল্লাশি করেছে, তাঁদের মোবাইল, ল্যাপটপ বাজেয়াপ্ত করেছে, দীর্ঘক্ষণ ধরে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। পরে থানায় সম্পাদক প্রবীর পুরকায়স্থ ও অমিত চক্রবর্তীকে ইউএপিএ আইনে গ্রেফতার করেছে।
একই দিনে কৃষি ভবনে গ্রামোন্নয়ন দফতরের প্রতিমন্ত্রী সাধ্বী নিরঞ্জন জ্যোতি তৃণমূল কংগ্রেসের প্রতিনিধি দলের সাথে পূর্ব-নির্ধারিত সময়ে দেখা করতে হঠাৎ করে অস্বীকার করেন। তিন ঘন্টা বসিয়ে রাখার পর অভিষেক বান্যার্জি সহ দলের নেতানেত্রীদের পুলিশ কৃষি ভবনের বৈঠক স্থল থেকেই জবরদস্তি টেনে হিঁচড়ে তুলে থানায় নিয়ে যায় ও রাত এগারোটা অবধি আটক করে রাখে।
আজ (৪ অক্টোবর) সাত সকালে ইডি হানা দিয়েছে আপ নেতা সঞ্জয় সিং'এর বাড়ি, যিনি গতকাল আদানি'র চৈনিক অর্থের সংযোগ এবং দিল্লি'র সাংবাদিকদের মিথ্যা অভিযোগে তুলে নিয়ে যাওয়ার বিরুদ্ধে সোচ্চার কন্ঠে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। এই প্রতিবেদন প্রকাশ পাওয়ার মুখে তল্লাশি এখনও চলেছে।
কোনও সংবাদসংস্থার ওপর এরকম বেলাগাম আক্রমণ ও প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলের সাংসদ-মন্ত্রীদের এই ধরনের চরম হেনস্থা ইদানীংকালে দেখা যায়নি। অবশ্যম্ভাবী ভাবে যে প্রশ্ন উঠে আসে তা হল, আমরা কি জরুরি অবস্থার কানাগলিতে ঢুকে পড়লাম?
এনরেগা সহ অন্যান্য প্রকল্পের বকেয়া আদায় করতে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রতিনিধি দল দিল্লিতে গত দু' দিন ধরে কর্মসূচি নিয়েছিল। কেন্দ্রীয় সরকার কোন এক অজানা ভয়ে তাদের এই কর্মসূচি আটকাতে মরীয়া হয়ে ওঠে। প্রথমে তাঁদের দিল্লি যাত্রার ট্রেন বাতিল করে দেওয়া হয়, মন্ত্রী গিরিরাজ সিং ঠিক ঐ সময়েই বিহার চলে যান, প্রতিমন্ত্রী নিরঞ্জন জ্যোতি নির্ধারিত সময়ে দেখা করতে অস্বীকার করেন। তৃণমূলের এই দু' দিন ব্যাপী কর্মসুচি ইডি ও সিবিআই দ্বারা বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতানেত্রীদের হেনস্থা করা এবং রাজ্যের দাবিদাওয়ার দুটি বিষয়কে পুনরায় জনসমক্ষে নিয়ে এসেছে।
সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বিভিন্ন স্তরের নেতানেত্রীরা প্রায় প্রত্যেকেই মনে করেন যে দুর্নীতির ক্ষেত্রে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি অনুসরণ করা উচিত। অথচ ৩৫ বছর আগের বোফর্স কেলেঙ্কারি থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক কালের রাফায়েল বিমান, সারদা, নারদা কোনও ঘোটালাতেই আজ পর্যন্ত দোষীদের শাস্তি তো দূরের কথা, চিহ্নিতও করা যায়নি। প্রায় তিন বছর আগে কয়লা পাচার কেলেঙ্কারির অভিযোগে ইডি, সিবিআই তৃণমূল কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাঁর পরিবারের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে। পরে নিয়োগ দুর্নীতিতেও তাঁদের নাম উঠে আসে। বারবার তাঁদের কেন্দ্রীয় এজেন্সির দফতরে ডাকা হয়েছে, জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে কিন্তু তদন্তে এখনও লক্ষণীয় কোনও অগ্রগতি দেখা যায়নি। তদন্তের শ্লথ গতি দেখে এটা ধারণা হওয়া স্বাভাবিক যে দোষীকে খুঁজে বার করা ও শাস্তি দেওয়া এই এজেন্সিগুলির উদ্দেশ্য নয়, তাঁদের উদ্দেশ্য বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের নানা ভাবে হেনস্থা করা। দেখা যাচ্ছে, বেছে বেছে রাজনৈতিক ভাবে গুরুত্বপূর্ণ দিনগুলিতেই তাঁকে তলব করা হচ্ছে। প্রায় আড়াই মাস আগে ২ এবং ৩ অক্টোবর দিল্লিতে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রতিবাদ কর্মসূচি নির্ধারিত হয়েছিল। ইডি ঠিক ৩ তারিখেই তাঁকে দফতরে ডেকে পাঠায়। এর আগে তাঁকে ১৩ সেপ্টেম্বর তলব করা হয়েছিল- ঐ দিন ছিল নবগঠিত ‘ইন্ডিয়া’ জোটের কো-অর্ডিনেশন কমিটির প্রথম বৈঠক। এর আগে ‘নবজোয়ার যাত্রা’র সময় সিবিআই তাঁকে তলব করেছিল। এতে তো সন্দেহ হওয়া স্বাভাবিক যে অভিষেকের রাজনৈতিক কর্মসূচি ব্যাহত করার জন্য কেন্দ্রীয় এজেন্সিগুলি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে কাজ করছে।
ইডি, সিবিআই দ্বারা হেনস্থা হয়েছে এরকম ব্যক্তিদের তালিকা লম্বা। প্রায় সব বৃহৎ রাজনৈতিক দলগুলির নেতানেত্রীদের নাম এতে আছে। ২০১৫-১৬ সালে ‘ন্যাশনাল হেরাল্ড’ কেসে দিনের পর দিন সনিয়া ও রাহুল গান্ধীকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে, এখন সেই কেস ধামাচাপা পড়ে গেছে। তালিকায় আছেন প্রাক্তন মন্ত্রী পি চিদাম্বরম ও তাঁর পুত্র কার্তি চিদাম্বরম, শিব সেনার সঞ্জয় রাউত, ফারুক আবদুল্লা, তেলেঙ্গানার মুখ্যমন্ত্রী চন্দ্রশেখর রাওয়ের কন্যা কে কবিতা, তামিলনাড়ু মুখ্যমন্ত্রী স্ট্যালিনের কন্যা সেন্থামারাই, লালু যাদব, তেজস্বী, রাবরি দেবী, ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সরেন, অরবিন্দ কেজরিওয়াল, তৃণমূল কংগ্রেসের বিভিন্ন নেতানেত্রী। এমনকি কেরালার বাম সরকারের জনপ্রতিনিধিরাও এদের হাত থেকে রক্ষা পায়নি। শরদ পাওয়ারের এনসিপি দলের কোনও নাম এই তালিকায় দেখা যাচ্ছে না। কী করেই বা থাকবে! জুন মাসে অজিত পাওয়ার যখন দল ভাঙিয়ে একটা বড় অংশ নিয়ে বিজেপি-শিব সেনা (শিন্দে) সরকারে যোগ দেন তখন তাঁদের মধ্যে বেশ কয়েকজন ছিলেন যাঁদের মাথার ওপর ইডির খাঁড়া ঝুলছিল। অভিযোগ, অজিত পাওয়ার, প্রফুল্ল প্যাটেল, ছগন ভুজব্যালরা একেক জন দুর্নীতির শিরোমণি। এঁদের বিরুদ্ধে ইডির বিস্তর সব অভিযোগ দলবদলের সাথে সাথে ধামাচাপা পড়ে যায়।
আম আদমি পার্টি'র দুজন মন্ত্রী সত্যেন্দ্র জৈন ও মণীশ শিসোদিয়া (যিনি দিল্লি সরকারের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছিলেন) দুর্নীতির অভিযোগে কারাবাস করছেন। যে অভিযোগের ভিত্তিতে এই দুজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে তাতে বিস্তর ফাঁক আছে। জৈনের ক্ষেত্রে অভিযোগ, যে জুয়েলারি কোম্পানিতে তাঁর শেয়ার আছে সেই কোম্পানি কলকাতা থেকে ৪.৮ কোটি টাকা পায়। জৈনের আইনজীবীরা বলছেন, রেজিস্ট্রার অফ কোম্পানির তথ্য অনুযায়ী ঐ অলঙ্কার কোম্পানিতে জৈনের শেয়ার ২ থেকে ১৯ শতাংশ, অর্থাৎ ৫৭ লাখ টাকা। আইন অনুযায়ী এক কোটি বা তার বেশি অংকের দুর্নীতি হলে তবেই ইডি সেই কেসের তদন্ত করতে পারে। পিএমএলএ (প্রিভেনশন অফ মানি লন্ডারিং অ্যাক্ট) অনুযায়ী টাকার অংক এক কোটির কম হলে অভিযুক্ত অবিলম্বে জামিন পাওয়ার যোগ্য। অথচ জৈন গত বছরের মে মাস থেকে বন্দী আছেন। অনেকের মতে, শিসোদিয়ার ক্ষেত্রে অভিযোগ ভুয়ো। যে আবগারি নীতির জন্য তাঁকে অভিযুক্ত করা হয়েছে তা মন্ত্রীসভায় সিদ্ধান্ত সহ অর্থ ও শুল্ক দফতরের সম্মতিতেই নেওয়া হয়েছিল। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, লেফট্যানেন্ট গভর্নর যিনি কেন্দ্রীয় সরকার দ্বারা নিযুক্ত, সেই নীতিতে সই করে সহমত প্রকাশ করেছিলেন।
সাম্প্রতিক কালে সংশোধনের ফলে পিএমএলএ দানবীয় আকার নিয়েছে। কুখ্যাত ইউএপিএ আইনের মতো পিএমএলএ'তেও অভিযুক্তকে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে হয়। এছাড়া সংস্থার ডিরেক্টরের হাতে অভূতপূর্ব ক্ষমতা অর্পণ করা হয়েছে ও তথাকথিত জাতীয় স্বার্থে একজন ডিরেক্টরের মেয়াদ বারবার বাড়ানো হয়েছে। দেখা যাচ্ছে, ২০১৪'র পর থেকে ইডি'র অধীনে তদন্ত চার গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। অভিযুক্তদের ৯৫ শতাংশ বিরোধী দলগুলির নেতানেত্রী। ২০১৮-১৯ থেকে ২০২১-২২ কেসের সংখ্যা ৫০৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে- ১৯৫ থেকে ১১৮০। ইডির দ্বারা তল্লাশি ২০০৪-১৪ থেকে ২০১৪-২২- অভূতপূর্ব ভাবে ২৫৫৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে ('দ্য ওয়ার' – ১৪ এপ্রিল ২০২৩)। ইডির কার্যকলাপে কতিপয় বিচারক বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। গত নভেম্বর মাসে সঞ্জয় রাউতের জামিনের আবেদন মঞ্জুর করে সেশনস জজ এম জি দেশপান্ডে বলেন, যে দ্রুততার সাথে একজন অভিযুক্তকে গ্রেফতার করা হয় তার ছিটেফোঁটা তৎপরতা তার বিচারের সময় দেখা যায় না। জামিনের আবেদনের পর ইডি সেটার উত্তর দিতে তিন-চার সপ্তাহ নেয়, সামান্য আবেদনেরও উত্তর দিতে তারা প্রচুর সময় নেয়। এই বিলম্বের জন্য ইডিকে কি দোষী সাব্যস্ত করা উচিত নয়? বিচারক প্রশ্ন করেন।
এনরেগা প্রকল্পে আমাদের রাজ্যের উপভোক্তারা শেষবার টাকা পেয়েছেন ২৬ ডিসেম্বর ২০২১। এরপর এনরেগা আইনের ২৭ নম্বর ধারা প্রয়োগ করে দুর্নীতির অভিযোগে কেন্দ্রীয় সরকার এই প্রকল্প বাবদ টাকা দেওয়া বন্ধ করে দেয়। ২০২১-২২ সালে পশ্চিমবাংলায় ১,১১,১৯৭৬৫ মানুষ এই প্রকল্প বাবদ টাকা পেয়েছেন, যা দেশে সর্বোচ্চ। এই সময়ে ৩৬.৪১ কোটি শ্রম দিবস সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমানে এই প্রকল্প বাবদ রাজ্যের প্রাপ্য ৭০০০ কোটি টাকা। সেই টাকা না দেওয়ার ফলে ২০২২'এর অক্টোবরে শ্রম দিবসের সংখ্যা নেমে দাঁড়ায় ৩.৬৭ কোটি। সমস্ত রাজ্যের মধ্যে একমাত্র পশ্চিমবাংলার টাকাই আটকে দেওয়া হয়েছে। কেন্দ্রের অভিযোগ, প্রকল্পে ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে, ২৫ লক্ষ ভুয়ো জব কার্ডের মাধ্যমে তৃণমূলি নেতারা টাকা আত্মসাৎ করেছে। রাজ্য সরকারের দাবি, এই অভিযোগ খতিয়ে দেখে তারা কেন্দ্রীয় সরকারের গ্রামোন্নয়ন দফতরে চারটে অ্যাকশন টেকেন রিপোর্ট পাঠিয়েছে, শেষের'টি পাঠানো হয়েছে ২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩। অপর দিকে কেন্দ্র জানিয়েছে, এই রিপোর্টগুলিতে দুর্নীতির অভিযোগের কোনও সন্তোষজনক ব্যাখ্যা তারা পায়নি।
কেন্দ্রীয় মন্ত্রী গিরিরাজ সিং এই দুর্নীতি উন্মোচন করার জন্য সিবিআই তদন্তের হুমকি দিয়েছেন। তাহলে তদন্ত যত দিন চলবে তত দিন মানুষ বঞ্চিত থাকবে? এছাড়া প্রায় দু' বছর হয়ে গেল এখনও কেন সেটা করা হয়নি? আর এও প্রশ্ন, ২৫ লক্ষ কার্ড যদি ভুয়োও হয়, ২০ লক্ষ উপভোক্তাকে কেন তাঁদের প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে? দুর্নীতি কি খালি পশ্চিমবাংলাতেই আছে? অন্যান্য রাজ্য সরকার এবং খোদ কেন্দ্রীয় সরকার কি দুর্নীতিমুক্ত? দেখা যাচ্ছে, আয়ুষ্মান ভারত প্রকল্পে ৩৪৪৬ জন এমন রুগীর পিছনে ৬.৯৭ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে যারা আগেই মৃত ঘোষিত। ক্যাগ রিপোর্টে কেন্দ্রীয় সড়ক প্রকল্পে বিপুল গরমিল ধরা পড়েছে। বরাদ্দ অর্থ ও ব্যয় করা অর্থের মধ্যে পাহাড়প্রমাণ ফারাক! আর বিজেপি নেতাদের কথা বলতে গেলে তো ঠক বাছতে গাঁ উজাড় হয়ে যাবে! অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা, মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ চৌহান, কর্নাটকের রেড্ডি ভাইয়েরা, শুভেন্দু অধিকারী- এঁদের বিরুদ্ধে তো বিস্তর অভিযোগ! এইসব দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে তদন্ত কোথায়? কেন্দ্রের মন্ত্রীদের মুখে আদৌ কি দুর্নীতি-বিরোধী কথাবার্তা মানায়?
শাসকের সন্ত্রাসে দেশ থরথর! সাংবাদিকের ওপর ইউএপিএ প্রয়োগ বিরল। জাতীয় নিরাপত্তার অজুহাত তুলে এখন যে কারও ওপর আক্রমণ হতে পারে। এডিটরস’ গিল্ড, ইন্ডিয়া জোট এই আক্রমণের তীব্র নিন্দা করেছে। সাধারণ মানুষকেও এগিয়ে আসতে হবে।
চমৎকার লেখা ।যেমন তথ্যপূর্ণ তেমন সাবলীল ।মোদী সরকারের এই নির্লজ্জ তৎপরতা দেখে মনে হয় আতঙ্কে হুড়োহুড়ি
ReplyDeleteলাগিয়েছেন ।