Sunday, 16 October 2022

হিন্দি উপনিবেশের পথে?

কাগুজে প্রস্তাবগুলি ঠোঙা হয়ে যাক!

প্রশান্ত ভট্টাচার্য 

 

আরএসএস'এর হিন্দুত্বের সঙ্গে পরিপূরক হিন্দি। 'এক দেশ এক ভাষা' স্লোগান 'এক দেশ এক জাতি' ও 'এক দেশ এক ধর্ম' নীতির এক্সটেন্ডেড ফর্ম। সংঘের এই এজেন্ডা এবার রূপায়ণ করতে উঠে পড়ে লেগেছে মোদী-শাহ'র সরকার। দেশের ঐক্য বিপন্ন হওয়ার মুখে। তবে ফ্যাসিস্টরা দেশে দেশে এই ভাষা সন্ত্রাস চালিয়েছে অতীতে। এবার ভারতে সেই সন্ত্রাস চালাবার নান্দীমুখ হচ্ছে। 

পাঠককে মনে করিয়ে দিচ্ছি, ২০১৯ সালে হিন্দি দিবস উপলক্ষে ভাষণ দিতে গিয়ে ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ আবেদনের ছলে জানিয়েছিলেন, যাতে হিন্দিকে ভারতের 'সর্বজনীন' ভাষা করে দেওয়া হয়। একটি টুইটার পোস্টের মাধ্যমে অমিত শাহ বলেন, দেশে এমন একটি সর্বজনীন ভাষার প্রয়োজন যা 'আন্তর্জাতিক স্তরে ভারতের পরিচিতির ছাপ' রেখে যায়। তিনি আরও বলেন, হিন্দির ক্ষমতা আছে 'দেশকে এক সূত্রে ঐক্যবদ্ধ' করার। বহু ভাষাভাষি ভারত ভূখণ্ডে এর চেয়ে বাতুল মন্তব্য আর কিছু হতে পারে না বলে অনেকেই ভেবে বসেছিলেন। কিন্তু মনে রাখতে হবে, আরএসএস'এর ঘরের লোক আর মোদীর ক্যাপ্টেনশিপে সংসদীয় রাজনৈতিক মঞ্চে উঠে আসা অমিত শাহ বাতুল নন বরং সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্যমুখি। আর সেটা এখন বুঝতে পারছেন সকলেই। অতীতে বার বার হিন্দিকে দেশের প্রধান ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চেষ্টা করেছেন অমিত শাহ। 

এরই মধ্যে সরকারি কাজের ভাষা হিন্দি করার কেন্দ্রীয় সরকারের প্রস্তাব নিয়ে নানা স্তরে বিতর্ক শুরু হয়ে গিয়েছে। এই আবহেই এবার তা কার্যকর করতে প্রথম পদক্ষেপ মধ্যপ্রদেশে ডাক্তারি পড়ানোর টেক্সট হিন্দিতে করা। সরকারের হিন্দি নিয়ে এই আগ্রাসী মনোভাব দেশকে এক বিপদের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। ইতিমধ্যে তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী এম কে স্ট্যালিন হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন ১৯৬৫ সালের কথা। স্ট্যালিন বলেন, যদি কেন্দ্রীয় সরকার তামিলনাড়ুর ওপর হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার কথা ভাবে, ডিএমকে'র অর্ধ শতাব্দী পুরনো হিন্দি-বিরোধী আন্দোলনের কথা যেন মাথায় রাখে। কেরালার মুখ্যমন্ত্রী পিনারই বিজয়নও সতর্ক করে দিয়েছেন। নিজস্ব ট্যুইট বার্তায় পিনারই জানান, 'কেন্দ্রীয় সরকারের বলপূর্বক হিন্দি চাপানোর এই পদক্ষেপ ভারতের আদর্শ এবং বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের ওপরে আক্রমণ। এই পদক্ষেপ দেশের অভ্যন্তরে শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে ভারতীয়দের একটি বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। এই নিষ্ঠুর পদক্ষেপ যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিকাঠামোকে অবমাননা করে। তাই ঐক্যবদ্ধভাবে এর বিরোধিতা করতে হবে।'

এটা আমরা সবাই জানি, দেশের সংবিধানের অষ্টম তফসিলে বাংলা, তামিল, ওড়িয়া, মালয়ালম, হিন্দি সহ ২২টি ভাষার সমান অধিকারের কথা বলা হয়েছে। সেই অনুসারে, সিপিআইএম পলিটব্যুরোর সদস্য তথা কেরালার মুখ্যমন্ত্রীর প্রস্তাব, কেন্দ্রীয় সরকারি চাকরির প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় অষ্টম তফসিলে থাকা নির্দিষ্ট সমস্ত ভাষায় প্রশ্নপত্র করার। শুধু তাই নয়, আমার ব্যক্তিগত মত, মেডিক্যালের পাঠ্যপুস্তক শুধু হিন্দিতে কেন, অষ্টম তফসিল অন্তর্ভুক্ত ২২টি ভাষাতেই মেডিক্যালে পড়ার ব্যবস্থা হোক। তা ভীষণভাবে বরণীয়। চিৎকার করে বলা হোক, শুধু হিন্দি কেন? সব মাতৃভাষায় চিকিৎসা প্রকৌশল, আইন বিদ্যা শেখানো হোক। কোনও রাষ্ট্রভাষা চাই না। এক দেশ বহু ভাষা বহু ধর্ম বহুত্ববাদী সংস্কৃতি। উলটো আমরা দেখছি, আইআইএম/ আইআইটি সহ সব জায়গায় শিক্ষার মাধ্যম হিন্দি করার জন্য অমিত শাহর নেতৃত্বে সংসদীয় কমিটির সুপারিশ বুঝিয়ে দিল দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসলে কুয়োর ব্যাঙ। তিনি বুঝতে পারছেন না এর পরিণাম কী হতে পারে। ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয়, হিন্দুত্বের চেয়ে অনেক বেশি বিপজ্জনক হিন্দি সন্ত্রাস। কেন না, ধর্মভিত্তিক লড়াই ও সহিংসতা ভারত ভূখণ্ডে গত আড়াই হাজার বছর ধরে হয়ে আসছে এবং ১৯৪৭ সালে ধর্মভিত্তিক দেশভাগের পরও আমরা গুঁতোগুঁতি করে টিকে আছি। ফলে, ধর্ম দিয়ে দেশের সামগ্রিক ক্ষতি করার ক্ষমতা হারিয়ে গিয়েছে ধর্মীয় মৌলবাদের। কিন্তু ভয়ঙ্কর ক্ষতি করবে তাদের হিন্দি চাপানোর মানসিকতা, যা নিম্নমেধাতন্ত্রের প্রতীক। 

যদিও কেরালা ও তামিলনাড়ু সরকার রণং দেহি ভাব ইতিমধ্যে দেখালেও গা ঝাড়া দিয়ে ওঠেনি ওড়িশা বা বাংলা। বাংলা, ওড়িশা কেন ঘুমিয়ে রয়েছে কে জানে! যেখানে, এ আর রহমানের মতো কিংবদন্তি সংগীত শিল্পী নিজের মতো করে প্রতিবাদ জানিয়ে রাখছেন। যেখানে, অভিনেতা-রাজনীতিক কমল হাসন হুঙ্কার দেন, 'কোনও শাহ, সুলতান বা সম্রাটের মর্জিমাফিক দেশ চলবে না। দরকারে জাল্লিকাট্টুর চেয়েও বড় আকারে প্রতিবাদ হবে'। কমল হাসন জাতীয় সংগীতের প্রসঙ্গ তুলে যা বলেছেন, তার তুলনা হয় না। অভিনেতা বলেন, 'দেশের অধিকাংশ মানুষই গর্বের সঙ্গে বাংলায় জাতীয় সংগীত গায় এবং ভবিষ্যতেও গাইবে। তার কারণ, জাতীয় সংগীতের স্রষ্টা প্রত্যেক ভাষা ও সংস্কৃতিকে সম্মান জানিয়ে তা রচনা করেছিলেন। সে জন‌্যই এটি জাতীয় সংগীত হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছিল। তাই যে ভারত সবাইকে আপন করে নেয়, তাকে কোনও একটি ভাষার করতে চেষ্টা করবেন না।' কেন্দ্রের দূরদৃষ্টির অভাবে সবাইকে ভুগতে হবে বলেও হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তিনি। তখন বাংলা কেন ঘুমায়ে রয়! আজও যদি আমরা ঘুরে না দাঁড়াই, তবে এই ভারতভূমিতে বাঙালি বলে কোনও জাতি আর অবশিষ্ট থাকবে না। আগামী প্রজন্মে বাংলা ভাষা বলে কিছু থাকবে না। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ, বিভূতিভূষণ বলে কিছু থাকবে না। ১লা নভেম্বরের ঐতিহাসিক মানভূম ভাষা আন্দোলন, ১৯ মে ভাষা শহিদ দিবসের ইতিহাস মুছে যাবে। ভাষা শহিদদের প্রতি এর চেয়ে বড় অসম্মান আর কী হতে পারে!? তাই এক কবির কথাই মনে পড়ে, যিনি লিখেছিলেন, 'সহসা কে চেঁচিয়ে ওঠে শীতের রাতে/ বরকত বরকত.../ এই ভাষা চেয়েছিলে বুঝি/ রফিক সালাম.../ এই ভাষা রচেছিল বুঝি/ শিলচরে কমলা সুন্দরী...'। 

একটু ফিরে তাকানো যাক। ১৯৬৩ সালে প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু অফিসিয়াল ল্যাঙ্গোয়েজ বিল পেশ করেছিলেন, যেখানে ১৯৬৫ থেকে ইংরেজি এবং হিন্দিকে দেশের একমাত্র সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। কেন্দ্রের এই চেষ্টার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ ওঠে তামিলনাডুতে। প্রচারে নামে ডিএমকে। দলের ক্যাডাররা সংবিধানের ১৭ অধ্যায়ের কপি পোড়ান। কারণ, ওই ১৭ অধ্যায়েই হিন্দিকে সরকারি ভাষার মর্যাদা দেওয়া হয়েছিল। গ্রেফতার হন ডিএমকে প্রধান সিএন আন্নাদুরাই। ১৯৬৪ সালের ২৫ জানুয়ারি চিন্নাস্বামী নামে এক ২৭ বছরের ডিএমকে কর্মী হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার প্রতিবাদে গায়ে আগুন ধরিয়ে শহিদ হন। নেহরু সরকার তখনও নির্বিকার। যেন কিছুই হয়নি। উলটে ঘোষণা করা হয়, ১৯৬৫ সালের ২৬ জানুয়ারি থেকে হিন্দি একমাত্র সরকারি ভাষা হিসেবে চালু হবে। ২৬ জানুয়ারি এম করুণানিধি সহ ডিএমকে'র প্রথম সারির নেতাদের গ্রেফতার করে হেফাজতে নেওয়া হয়। কিন্তু তামিলদের দমাতে পারেনি। একদিকে হাজার হাজার ছাত্রের মিছিল অন্যদিকে, সেদিন ডিএমকে সদস্য টিএম শিবলিঙ্গম শরীরে পেট্রল ঢেলে মাদ্রাজের কোদামবক্কমে আত্মহত্যা করেন। আর, ভিরুগাম্বাক্কাম আরঙ্গনাথম, আয়ানপলায়ম বীরাপ্পান এবং রঙ্গসমুথিরা মুথুর মতো ডিএমকে কর্মীরা গায়ে আগুন লাগিয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। কিরানুর মুথু, ভিরালিমালাই সম্মুগম, পিলামেদু ধান্দাপানি প্রতিবাদের পথে হেঁটে বিষ খান। এমন প্রতিবাদের ভাষায় কেন্দ্রীয় সরকার ভাষা নীতি বাতিল করতে বাধ্য হয়। 

নতুন ইতিহাস, হিন্দুত্ববাদীদের, সংঘীদের ইতিহাস তৈরি করার অঙ্গীকারবদ্ধ মোদী-শাহরা আবার হিন্দি সাম্রাজ্যবাদ প্রতিষ্ঠা করতে উঠে পড়ে লেগেছেন। ওঁদের শুধু স্মরণ করিয়ে দিই, এমন কমিটি করে এমন সিদ্ধান্ত অনেকবারই নেওয়ার চেষ্টা হয়েছে, শেষ পর্যন্ত সাধারণ মানুষের প্রতিবাদ-প্রতিরোধে কাগজগুলো ঠোঙা হয়ে গিয়েছে। তবে আমাদের বিবেচনায় রাখতে হবে, অতীতে ভারতে যতগুলি সরকার হয়েছে সকলেই সংবিধান ও গণতান্ত্রিক রীতিনীতিকে যথাযথ মান্যতা দিয়ে এসেছে। ফলে, মানুষের প্রতিবাদ-প্রতিরোধ মর্যাদা পেয়েছে। ২০১৪ সাল থেকে ভারত রাষ্ট্রটি এমন কয়েকজন নেতার হাতে পড়েছে যাঁরা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ব্যবহার করেই পরিপূর্ণ ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠায় উদ্যত। তার মোকাবিলা না করতে পারলে আমাদের হিন্দি উপনিবেশের অধিবাসী হতেই হবে। আমাদের প্রমাণ করতে হবে, বাঙালি শুধু কবিতা লেখে না, দুর্বৃত্তের বিরুদ্ধে লড়াইও করে।


6 comments:

  1. সঠিক বিশ্লেষণ।

    ReplyDelete
  2. সুন্দর লেখা! তথ্য সম্বলিত আবেদনধর্মী আবার যথাযথভাবেই প্রতিবাদী।👍👍👍👍

    ReplyDelete
  3. হিন্দি চাপিয়ে দেশে আগুন 🔥 ধরানোর ছক ৬০-৭০ বছর ধরে চলছে আর‌এস‌এসের মদতে।
    হিন্দি সাম্র্যবাদের বিরুদ্ধে খুব নিচু তলায় বয়কট করা দরকার। হিন্দি বর্জন খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
    অসিত রায়

    ReplyDelete
  4. যথাযথ বিশ্লেষণ এবং তথ্যসমৃদ্ধ।আমি একমত।

    ReplyDelete
  5. অসাধারণ তথ্যসমৃদ্ধ লেখা। মাঠে ময়দানে নেমে দলমত ( দলিয় পতাকা বাদ দিয়ে) নির্বিশেষে এই মুহূর্তে প্রতিবাদে সামিল হওয়া উচিত।

    ReplyDelete
  6. যথাযথ বিশ্লেষণ। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হওয়া উচিত।

    ReplyDelete