Tuesday, 16 December 2025

ISI'র ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত (১)

Indian Statistical Institute

বাংলা ও ভারতের গর্ব

প্রদীপ্ত বন্দ্যোপাধ্যায়



প্রথম পর্ব

(কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক খসড়া ISI 2025 বিল পেশ হওয়ার পরে পরেই আইএসআই সহ বিদ্বৎ সমাজে এক আলোড়ন ওঠে। কেন এই সারস্বত প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করার উদ্যোগ? এই হঠকারী ও অবাঞ্ছিত সিদ্ধান্তের বিরোধিতায় পথে নেমেছেন আইএসআই'এর শিক্ষক-ছাত্র-কর্মচারীরা। আইএসআই প্রাক্তনী ও বর্তমান অধ্যাপক প্রদীপ্ত বন্দ্যোপাধ্যায় আমাদের বিস্তারিত ভাবে অবহিত করলেন এই বিল সম্পর্কে। প্রথম পর্বে আমরা জানব আইএসআই'এর ইতিহাস ও গৌরবোজ্জ্বল মেধাচর্চার কথা।)        


ইদানীং খবরের কাগজে ও সমাজমাধ্যমে ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট (ISI)-কে নিয়ে অনেক লেখালিখি হচ্ছে। আমরা এতদিন খবরের কাগজে ISI-এর নাম দেখেছি তখনই যখন ISI-এর কোনও বিজ্ঞানী বা প্রাক্তনী জাতীয় বা আন্তর্জাতিক কোনও পুরস্কার বা সম্মান পেয়েছেন। এবারে কিন্তু ব্যাপারটা অন্যরকম! এবারের আলোচনার কেন্দ্রে খসড়া ISI 2025 বিল। ISI নাকি ঠিকমতো চলছে না। এতটাই গণ্ডগোল যে, তার খোলনলচে বদলে ফেলতে হবে। সেইজন্যেই এই বিল। অনেকে বলছেন, এই বিল কার্যকর হলে ISI আর ISI'ই থাকবে না! এই নিয়ে বিতর্ক চলছে। বিলের প্রতিবাদে ISI-এর ছাত্র-শিক্ষক-কর্মীরা পথে নেমেছেন। আসুন, একটু ভেতরে ঢোকা যাক।

ISI-এর বয়স ১০০ পূর্ণ হতে আর মাত্র বছর ছয়েক বাকী। ১৯৩১ সালে প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশের হাত ধরে ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট সোসাইটি নামে একটি বিদ্বৎ সমাজ বা সমিতি (learned society) হিসেবে এর পথ চলা শুরু। আজও ISI সেই সমিতি হিসেবেই রয়েছে। সেই সমিতির ছত্রছায়াতেই গড়ে উঠেছে এই গবেষণা ও উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান, যা আজ বাংলা তথা ভারতের গর্ব। প্রেসিডেন্সি কলেজের আঁতুড়ঘর থেকে শুরু করে ৫০'এর দশক থেকে বরাহনগরে মহলানবীশের নিজস্ব জমিতে ধীরে ধীরে শিকড় গেড়েছে ISI; কয়েক দশকের মধ্যে তার প্রতীক সুপ্রাচীন বটগাছটির মতোই শাখাপ্রশাখা মেলতে শুরু করে। দিল্লী, বেঙ্গালুরু, চেন্নাই, হায়দ্রাবাদ, তেজপুর সহ বেশ কয়েকটি শহরে ছড়িয়ে পড়ে। তা সত্ত্বেও প্রাণকেন্দ্র তথা সদর দফতর থেকে গেছে কলকাতাতেই।

১৯৩৩ সাল থেকে ISI কর্তৃক প্রকাশিত আন্তর্জাতিক গবেষণা পত্রিকা 'সংখ্যা'-র দ্বিতীয় খণ্ডের প্রথম সংখ্যার মুখবন্ধ লিখেছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। পদার্থবিদ সত্যেন্দ্রনাথ বসু, জীববিজ্ঞানী জে বি এস হ্যাল্ডেন, পরিসংখ্যানবিদ আর এ ফিশার ছাড়াও বহু আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিজ্ঞানী ও গবেষক এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। 

বিজ্ঞানের যে কটি শাখায় ভারতীয় বিজ্ঞানীরা আন্তর্জাতিক স্তরে নেতৃত্ব দিয়েছেন, পরিসংখ্যানবিদ্যা তার মধ্যে সবচেয়ে উজ্জ্বল উদাহরণ। এই কৃতিত্বের বড় অংশটাই প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশ তথা ISI-এর। আজকের দিনেও গণিত ও পরিসংখ্যানবিদ্যার বহু শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী এই প্রতিষ্ঠানের অধ্যাপক বা প্রাক্তনী। যে পুরস্কারকে অনেকেই অঙ্কের নোবেল বলেন, সেই আবেল প্রাইজের একমাত্র ভারতীয় প্রাপক S R S Varadhan'ও ISI-এরই প্রাক্তনী।

কিন্তু ISI–র ইতিহাস শুধু মৌলিক গবেষণায় উৎকর্ষের কাহিনী নয়; শিক্ষা ও গবেষণাকে সাধারণ মানুষের জীবনে কাজে লাগানোর এক অনন্য অধ্যায়ও বটে। ISI সমিতির সনদে ISI-এর ঘোষিত লক্ষ্যের অন্যতম— 'সমাজকল্যাণ ও জাতীয় উন্নয়নে পরিসংখ্যানবিদ্যাকে কাজে লাগানো'। স্বাধীনতার পর দেশ যখন পুনর্গঠনের পথে, তখন কৃষি, শিল্প, বাজার, স্বাস্থ্য, শিক্ষা— প্রতিটি ক্ষেত্রেই নীতি প্রণয়ন ও তার মূল্যায়নে ISI–র গবেষকেরা হয়ে উঠেছিলেন সরকারের অন্যতম প্রধান সহায়। ভারতের তথ্যনির্ভর পরিকল্পনা ব্যবস্থার দৃঢ় ভিত গড়ে তোলে এই প্রতিষ্ঠান। দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা থেকে শুরু করে দেশের প্রায় প্রতিটি পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার নকশা থেকে মূল্যায়ন— সব ক্ষেত্রেই ISI–র ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। শুধু ভারতেই নয়, বিশ্বের বহু দেশে তথ্যভিত্তিক নীতি-নির্ধারণের এই ভারতীয় পদ্ধতিকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করা হয়। হো-চি-মিন, চৌ-এন-লাই, চে গ্যেভারা সহ তৃতীয় বিশ্বের বহু জননেতা ISI-এর কাজ দেখতে এসেছিলেন। আজও তৃতীয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকারি কর্মকর্তারা প্রতি বছর ISI–তে এসে প্রশিক্ষণ নেন।

পরিসংখ্যানবিদ্যা ছাড়াও কম্পিউটার বিজ্ঞানের ইতিহাসেও ISI পথপ্রদর্শক। দেশের প্রথম দেশিয় কম্পিউটার তৈরি হয় এখানেই, প্রথম আমদানি হওয়া কম্পিউটারটিও আসে ISI-তে। এর হাত ধরে ব্যাপকভাবে শুরু হয় কম্পিউটার বিজ্ঞানে গবেষণা। বলাই বাহুল্য, আজ ভারতের মানচিত্রে তো বটেই, এমনকি পৃথিবীর মানচিত্রেও কম্পিউটার বিজ্ঞানে ISI-এর গবেষকরা উজ্জ্বল স্থান অধিকার করে আছেন। 

মহলানবীশ বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার পারস্পরিক যোগাযোগের ওপর এবং এই সহযোগিতায় পরিসংখ্যানবিদ্যার কেন্দ্রীয় ভূমিকার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তাঁর সেই দৃষ্টিভঙ্গির ফলশ্রুতিতে ISI-এ পরিসংখ্যানবিদ্যা, গণিত ও কম্পিউটার বিজ্ঞানের পাশাপাশি পদার্থবিদ্যা, ভূতত্ত্ব, জীববিজ্ঞান, নৃতত্ত্ব, অর্থনীতি, সমাজবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, ভাষাবিজ্ঞান, এই সমস্ত বিষয়ই পারস্পরিক সমন্বয় ও সৌহার্দ্যের সঙ্গে বিকশিত হয়ে চলেছে। প্রায় এক শতাব্দী ধরে ISI একসাথে ধরে রেখেছে দুটি অনন্য জায়গা-- মৌলিক গবেষণা এবং সেই জ্ঞানকে সমাজকল্যাণে ব্যবহার। 

এই ভূমিকার পরিপ্রেক্ষিতেই ১৯৫৯ সালে ভারতীয় সংসদ ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট আইন প্রণয়ন করে, যার মাধ্যমে ISI-কে 'জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান' (Institute of National Importance) হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। বিশ্বভারতী, IIT খড়্গপুর ও AIIMS'এর পর এটি চতুর্থ সংস্থা যে এই স্বীকৃতি পায়। এই আইন ISI-কে ডিগ্রি ও ডিপ্লোমা প্রদান করার ক্ষমতা দেয়। একই সঙ্গে এই আইনটি ISI-কে ISI সমিতির অধীনে একটি গণতান্ত্রিক ও অংশগ্রহণমূলক সাংবিধানিক কাঠামো প্রদান করে। 

ISI-এ পরিসংখ্যানবিদ্যার প্রশিক্ষণ সেই প্রেসিডেন্সি'র Statistical Laboratory'র সময় থেকেই চালু ছিল। ১৯৫৯-এর আইনের বলে ১৯৬১ থেকে শুরু হয় পুরোদস্তুর ডিগ্রি কোর্স-- B Stat-M Stat-- যা এখনও ISI-এর সবচেয়ে পরিচিত ডিগ্রি। ধীরে ধীরে চালু হয় M Tech in Computer Science, MS in Quantitative Economics, B Math-M Math ও আরও অনেক শিক্ষাক্রম। Ph D ডিগ্রি তো আছেই।

১৯৭২ সালে প্রশান্ত মহলানবীশের জীবনাবসানের পর ISI-এর পরিচালন কাঠামোয় বেশ কিছু বড়সড় পরিবর্তন আবশ্যক হয়ে পড়ে এবং ১৯৭৪ সালে সমিতির সাধারণ সভায় একটি নতুন কাঠামো গৃহীত হয়। যেমন, মহলানবীশ কোনওদিনই ISI-এর ডিরেক্টর ছিলেন না, ছিলেন ISI সমিতির সেক্রেটারি। ১৯৭৪-এর পরেই ডিরেক্টর, ডিন ইত্যাদি পদের সূচনা। সামান্য কিছু পরিবর্তন সহ সেই কাঠামোই এখনও চলছে। লক্ষণীয় এই যে, এই রদবদলের সময়ও আইন পরিবর্তনের কোনও প্রয়োজন হয়নি। ১৯৯৫ সালে এই আইনের সামান্য সংশোধন করে ISI-এর ডিগ্রি ও ডিপ্লোমা প্রদান করার পরিধিকে প্রসারিত করা হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান হলেও ISI কোনওদিনই শিক্ষা মন্ত্রকের অধীনে ছিল না, ছিল প্রথমে যোজনা মন্ত্রক ও বর্তমানে তারই উত্তরসূরী, পরিসংখ্যান ও প্রকল্প রূপায়ন মন্ত্রক (MoSPI)-এর অধীনে। 

এই মুহূর্তে ISI-এর কোনও স্থায়ী ডিরেক্টর নেই। সেপ্টেম্বর মাসের শেষে বর্তমান ডিরেক্টর অধ্যাপক সঙ্ঘমিত্রা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। দু-দুবার সর্বোচ্চ পরিচালন পর্ষদ, অর্থাৎ, ISI Council-এর বৈঠক ডেকেও নতুন ডিরেক্টর হিসেবে কোনও নাম ঘোষণা করা সম্ভব হয়নি। এর মধ্যে হঠাৎ বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো কোনও পূর্বাভাস ছাড়াই Council-এর বৈঠকে মন্ত্রকের সচিব এসে ঘোষণা করেন যে সরকার সংসদে ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট আইন বাতিল করে নতুন বিল আনতে চলেছে, যার খসড়া অচিরেই প্রকাশ করা হবে। ISI-এর নেতৃত্বই যখন স্থিতিশীল নয়, এমন এক অনিশ্চিত সময়ে, এর ভবিষ্যৎ আরও অনিশ্চিত করে তোলার এই উদ্যোগ নিতান্তই হঠকারী ও অবাঞ্ছিত। বস্তুত, এই পরিস্থিতিতে বুদ্ধিমান কেউই যে আর ডিরেক্টর হতে রাজী হবেন না তা বলাই বাহুল্য! ফলে, সেই অনিশ্চয়তা এখনও চলছে।

এটা ঘটনা যে কিছু বছর অন্তর কেন্দ্রীয় সরকার ISI-এর কার্যকলাপ ও অগ্রগতি পর্যালোচনা করার জন্য উচ্চপর্যায়ের রিভিউ কমিটি গঠন করে। সাম্প্রতিকতম, অর্থাৎ, চতুর্থ রিভিউ কমিটিটি তৈরি হয়েছিল ২০২০ সালে। তারা ISI-এর কাজকর্ম পর্যালোচনা করে ২০২১ সালে একে আরও যুগোপযোগী করে তোলার লক্ষ্যে বেশ কিছু সুপারিশ করেছিল। ISI Council সেইসব সুপারিশ নিয়ে দীর্ঘ আলোচনার পর অধিকাংশ সুপারিশই কার্যকর করেছে। কিছু সুপারিশ নিয়ে ISI Council কিছুটা দ্বিমত পোষণ করে। রিভিউ কমিটির আলোচ্য বিষয়গুলোর মধ্যে ISI আইনটাও ছিল। তারা কিন্তু তাদের সুপারিশে কোথাও ISI আইন বাতিলের কথা বলেনি, দু-একটা সংশোধনের কথা বলেছে। যেমন, যে সমস্ত বিষয়ে ISI নিজস্ব প্রবেশিকা পরীক্ষার মাধ্যমে ছাত্র গবেষক নিয়োগ করে থাকে, সেই সমস্ত বিষয়েই ডিগ্রি প্রদান করার অধিকার ISI-কে দেওয়ার জন্যে আইন সংশোধনের উল্লেখ করেছে। বর্তমান আইনের মধ্যেই তাঁদের সুপারিশগুলি রূপায়ন সম্ভব। অতীতে সমস্ত রিভিউ কমিটির সুপারিশগুলিও এইভাবেই বাস্তবায়িত হয়েছে।

এবার ঠিক কী ঘটল যে নতুন আইনের প্রয়োজন হয়ে পড়ল, তার কোনও ব্যাখ্যা কিন্তু এখনও পাওয়া যায়নি। এই বিল আনার সিদ্ধান্ত সংশ্লিষ্ট মন্ত্রক কোনও প্রকাশ্য কারণ না জানিয়ে এবং ISI নেতৃত্ব, এমনকি ISI Council, বা অন্যান্য অংশীদারদের সঙ্গে কোনওরকম আলোচনা ছাড়াই নিয়েছে। বিলটি ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫-এ প্রকাশিত হয় এবং এক মাসের মধ্যে মতামত দিতে বলা হয়। এই সময়টা ছিল দুর্গাপুজো থেকে দীপাবলী, অর্থাৎ উৎসবের সময়। যদিও পরে সময়সীমা ৩ নভেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছিল, কিন্তু বিভিন্ন অংশীদারদের সঙ্গে কোনও সুসংবদ্ধ আলোচনার পরিস্থিতি তৈরি করা হয়নি। ২৮ নভেম্বর আবার বিশেষ কোনও আলোচনা ছাড়াই একটি সংশোধিত খসড়া বিল প্রকাশিত হয়েছে এবং ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে মতামত দিতে বলা হয়েছে। আশ্চর্যের বিষয়, এবারে প্রেস বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়েছে ১০ ডিসেম্বর। বিভিন্ন মহল থেকে আপত্তি জানানোর পর সময়সীমা ৫ জানুয়ারি পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।

পরবর্তী পর্বে আমরা দেখব খসড়া বিলের মূল বিষয়গুলো ঠিক কীরকম।

ক্রমশ...

দ্বিতীয় পর্ব:

https://ekakmatra2013.blogspot.com/2025/12/isi_17.html


1 comment:

  1. শিক্ষার্থীরা প্রথম থেকেই জলপাণি পায়- এই বিষয়টার উল্লেখ করা দরকার।

    ReplyDelete