Wednesday, 17 December 2025

ISI'র ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত (২)

খসড়া আইএসআই বিল ২০২৫ কেন?

কেনই বা প্রতিবাদ?

প্রদীপ্ত বন্দ্যোপাধ্যায়


দ্বিতীয় পর্ব

(কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক খসড়া ISI 2025 বিল পেশ হওয়ার পরে পরেই আইএসআই সহ বিদ্বৎ সমাজে এক আলোড়ন ওঠে। কেন এই সারস্বত প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করার উদ্যোগ? এই হঠকারী ও অবাঞ্ছিত সিদ্ধান্তের বিরোধিতায় পথে নেমেছেন আইএসআই'এর শিক্ষক-ছাত্র-কর্মচারীরা। আইএসআই প্রাক্তনী ও বর্তমান অধ্যাপক প্রদীপ্ত বন্দ্যোপাধ্যায় আমাদের বিস্তারিত ভাবে অবহিত করলেন এই বিল ও তার প্রেক্ষাপট সম্পর্কে। দ্বিতীয় পর্বে আমরা  জানব, আইএসআই বিল কতটা ক্ষুণ্ণ করতে চাইছে আইএসআই'এর মর্যাদা ও গরিমাকে।)



খসড়া বিলের মুখবন্ধে ঘোষণা করা হয় যে এর মাধ্যমে ISI-এর উৎকর্ষ, কার্যকরী শাসন, স্বনির্ভরতা ও দায়বদ্ধতা প্রতিষ্ঠিত হবে। সংশোধিত বিলে কিন্তু এই অংশটি বাদ দেওয়া হয়েছে। খসড়া বিল অনুযায়ী, ১৯৫৯ সালের ISI আইন বাতিল করে বর্তমান সমিতি–ভিত্তিক কাঠামো ভেঙে দেওয়া হবে। ISI সরাসরি সংসদের মাধ্যমে গঠিত কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত একটি 'Statutory body corporate'-এ রূপান্তরিত হবে। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, ভারতের অগ্রগণ্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান IISc কিন্তু এখনও Statutory body corporate নয়!

এটা সত্যি যে ISI-এর কাঠামোয় কোনও বড়সড় সংস্কার করতে হলে সমিতির সাধারণ সভায় সেটা পাশ করাতে হয়। বলা হচ্ছে যে প্রায় সহস্রাধিক সদস্যের সভায় আলোচনার মাধ্যমে কিছু করে ওঠা বেশ কঠিন। সুতরাং, সমিতি-নির্ভর ব্যবস্থা বাদ দিতে হবে। কিন্তু ১৯৭৪ সালের কাঠামো পরিবর্তন তো এই সমিতিই করেছিল। তাছাড়া আজকাল ISI-এর পরিচালনায় সমিতি একেবারেই হস্তক্ষেপ করে না। কাউন্সিল ও ডিরেক্টর যথেষ্ট স্বাধীনভাবেই কাজ করেন। তবে সম্প্রতি পরপর দুবার সমিতির সভাপতি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে। প্রথমবার কাউন্সিল তৎকালীন সভাপতিকেই মনোনীত করে, কিন্তু প্রতিদ্বন্দ্বিতার সম্ভাবনায় তিনি সরে দাঁড়ান। দ্বিতীয়বার ভোটাভুটি হয় এবং কাউন্সিল-মনোনীত প্রার্থী পরাজিত হন। এটাই কি সমিতির ওপর খাঁড়া নামার কারণ? প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ISI-এর পরিপ্রেক্ষিতে সমিতির সভাপতি পদটি কিন্তু নিতান্তই আনুষ্ঠানিক, ভারতের রাষ্ট্রপতির মতো। সমিতির সভাপতি প্রতি বছর ISI-এর সমাবর্তনে সভাপতিত্ব করেন এবং তাঁর হাত থেকেই ছাত্র-ছাত্রীরা ডিগ্রি নেয়। এছাড়া তাঁর আর বিশেষ ভূমিকা নেই!

বিলের শুরুতেই বলা হয়েছে এই বিলের মাধ্যমে ISI-কে 'জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান' হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হল! যে প্রতিষ্ঠান ৬৫ বছর আগে থেকেই 'জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান' হিসেবে স্বীকৃত, তাকে এতদিন পরে আবার এই স্বীকৃতি যেন নতুন করে দেওয়া হচ্ছে! এটা এই প্রতিষ্ঠানকে অপমান করা নয়? এমন ঘটনা ইতিপূর্বে কখনও ঘটেনি।

ISI-এর বর্তমান পরিচালন পর্ষদ অর্থাৎ ISI Council বাতিল করে বোর্ড অফ গভর্নরস বা BoG তৈরি হবে, যা হবে সম্পূর্ণভাবে সরকার বা তার মনোনীত সদস্যদের দ্বারা গঠিত। বর্তমান ISI Council-এর সদস্য সংখ্যা ৩৩। বলা হচ্ছে যে এই সংখ্যাটা নাকি খুবই বেশি। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, Cambridge বা Oxford-এর মতো সুপ্রাচীন ঐতিহ্যমণ্ডিত বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালন সমিতি কিন্তু বিশাল এবং নির্বাচিত প্রতিনিধি নিয়ে গড়া। আরও বলা হচ্ছে যে এর মধ্যে ১৭ জন আভ্যন্তরীণ প্রতিনিধি থাকায় আভ্যন্তরীণ স্বার্থই প্রাধান্য পায়। লক্ষণীয় যে, এর অর্থ কিন্তু বাকী ১৬ জন বাইরের লোক— চেয়ারম্যান ছাড়াও রয়েছেন সরকারের বিভিন্ন দফতরের ৬ জন প্রতিনিধি ও বিভিন্ন বিজ্ঞান সংস্থার মনোনীত ৯ জন সদস্য। আভ্যন্তরীণ সদস্যদের মধ্যে রয়েছেন ডিরেক্টর, ডিন অফ স্টাডিজ, ৭টি বৈজ্ঞানিক বিভাগের বিভাগীয় প্রধান এবং দিল্লী, বেঙ্গালুরু, চেন্নাই-- এই ৩টি কেন্দ্রের প্রধানরা। এই নিয়ে ১২ জন। ডিন এবং ৭ জন বিভাগীয় প্রধান দু' বছর মেয়াদে সংশ্লিষ্ট বিভাগের বৈজ্ঞানিক কর্মীদের দ্বারা নির্বাচিত হন। বাকী ৫ জনের মধ্যে ২ জন শিক্ষক ও অশিক্ষক কর্মীদের দ্বারা নির্বাচিত, বাকী ৩ জন ISI সমিতির নির্বাচিত প্রতিনিধি। বাস্তব ঘটনা এই যে, কাউন্সিল মিটিং'এ বাইরের সদস্যদের অনেকেই অনুপস্থিত থাকেন। এমনকি মন্ত্রকের তরফে প্রতিনিধি হিসেবে যাঁর নাম আছে, তাঁর পরিবর্তে অন্য কেউ মিটিং'এ হাজিরা দেন। তাই যে কোনও মিটিং'এ ভেতরের সদস্যরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ থেকে যান। এই পরিস্থিতি কি নতুন ব্যবস্থায় পাল্টাবে? 

প্রস্তাবিত BoG হবে ১১ সদস্যের। প্রথম খসড়ায় এই ১১ জনের মধ্যে মাত্র তিনজন Instituteএর আভ্যন্তরীণ সদস্য রাখা হয়েছিল— ডিরেক্টর, ডিন এবং কোনও একটি কেন্দ্রের প্রধান। বিভাগীয় প্রধানদেরও স্থান হয়নি। সংশোধিত খসড়ায় একাডেমিক কাউন্সিল থেকে ২ জন সদস্য যোগ করা হয়েছে। তাঁরা অবশ্য নির্বাচিত নন, মনোনীত হবেন। দেখা যাচ্ছে, আসল আপত্তি নির্বাচন ব্যাপারটাতেই! কোন কেন্দ্রের প্রধান BoG-র সদস্য হবেন বা বাকী কেন্দ্রগুলো কেন বঞ্চিত হবে, সে প্রশ্নের উত্তর নেই। 

এই BoG হবে ISI-এর দণ্ডমুণ্ডের কর্তা; সমস্ত একাডেমিক, প্রশাসনিক, আর্থিক ও জনবল সংক্রান্ত সিদ্ধান্তের একচ্ছত্র অধিকার থাকবে তার হাতে। সদর দফতর যে কলকাতাতেই থাকবে তার কোনও আইনি নিশ্চয়তা নেই, ফলে প্রয়োজনে সদর দফতর স্থানান্তরের পথ খোলা থাকবে। কেন্দ্রীয় সরকারই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষে ডিরেক্টর নিয়োগ, মূল্যায়ন ও অপসারণের ক্ষমতা পাবে।

বিলে ISI-এর ঘোষিত লক্ষ্যের তালিকা থেকে 'সমাজকল্যাণ' ও 'জাতীয় উন্নয়ন' ইত্যাদি শব্দগুলি আশ্চর্যজনকভাবে অনুপস্থিত! কিংবা, হয়তো সেটাই স্বাভাবিক!

এতকাল ISI-এর পঠনপাঠন ও গবেষণা সংক্রান্ত সমস্ত নীতি নির্ধারণ করত একাডেমিক কাউন্সিল। সেখানে সমস্ত অধ্যাপক সরাসরি অংশ নিতেন। এছাড়া নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মারফত মতামত রাখতে পারতেন সহকারী ও সহযোগী অধ্যাপকরা। এই বিলে সেই একাডেমিক কাউন্সিলকে শুধুমাত্র একটি সুপারিশকারী সংস্থায় পরিণত করা হয়েছে। অর্থাৎ, পাঠ্যক্রম, ভর্তি, মূল্যায়ন ইত্যাদি বিষয়ে একাডেমিক কাউন্সিলের স্বতন্ত্র ক্ষমতা প্রায় নেই। এখানেও প্রথম খসড়ায় শুধুমাত্র ডিরেক্টর, ডিন, বিভাগীয় প্রধান ইত্যাদি কিছু পদাধিকারীদেরই স্থান দেওয়া হয়েছিল, যেটা অনুরূপ কোনও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অভূতপূর্ব। সংশোধিত খসড়ায় অবশ্য অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মতোই সমস্ত অধ্যাপকদের স্থান দেওয়া হয়েছে। অবশ্য সহকারী ও সহযোগী অধ্যাপকদের প্রতিনিধিত্ব এখনও অধরা!

IIT, IIM ইত্যাদির বিপরীতে ISI-এর একটা বৈশিষ্ট্য এই যে, প্রথম থেকেই এখানে পড়াশোনা করতে কোনও বেতন দিতে হয় না, বরং প্রতিটি ছাত্র stipend পায়। এতদিন এখানে উচ্চশিক্ষা কিংবা গবেষণায় মেধাবী, প্রান্তিক পড়ুয়াদের ভিড় দেখা যেত পঠনপাঠনের খরচ নাগালের মধ্যে থাকায়। কিন্তু বছরের পর বছর সরকারের চাপ বাড়ছিল— আর্থিক স্বনির্ভরতা চাই। প্রয়োজনে টিউশন ফি চালু করা বা বাড়ানো হোক, এমবিএ-ধাঁচের অর্থকরী কোর্স শুরু হোক ইত্যাদি। পরামর্শমূলক কাজ (consultancy) ও মেধাস্বত্ব (IPR) থেকেও আয় বাড়ানোর কথা বলা হচ্ছিল। বিলে এই চাপকেই প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া হয়েছে। এখন একাডেমিক কাউন্সিলকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে BoG একতরফাভাবে সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে পারে। এর ফলে নতুন করে ফি চালু হবে বা বাড়বে, বাজারমুখী গবেষণা অগ্রাধিকার পাবে এবং প্রান্তিক পড়ুয়াদের জন্য প্রবেশাধিকার সংকুচিত হতে পারে। ISI-এর মৌলিক চরিত্রই এর ফলে পালটে যাবে, এ আশঙ্কা একেবারে অমূলক নয়।

কেন্দ্রগুলির স্বায়ত্তশাসন বাড়ানো একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ হলেও, যেভাবে এটি প্রস্তাবিত হয়েছে তাতে ক্ষমতার অস্বাভাবিক বিন্যাস তৈরি হতে পারে। কেন্দ্রের Management Council-এর Vice-Chair হিসেবে ছাড়া কেন্দ্রের পরিপ্রেক্ষিতে ডিরেক্টরের প্রায় কোনও ভূমিকাই থাকছে না! কেন্দ্রগুলি স্বাধীনভাবে গড়ে উঠতে গেলে যে পরিকাঠামো ও জনবল প্রয়োজন তা কোথা থেকে আসবে, সে প্রশ্নে এই খসড়া বিল কিন্তু নীরব! এর ফলে বহু দশক ধরে গড়ে ওঠা বহুকেন্দ্রিক, ফেডারেল একাডেমিক পরিবেশ নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা।

এতদিন ISI কাউন্সিলে কর্মীদের প্রতিনিধিত্ব ছিল। এছাড়া প্রশাসন ও কর্মীদের মধ্যে যৌথ আলোচনার মঞ্চ হিসেবে ছিল Joint Consultaive Committee (JCC)। কর্মীদের কর্তব্য তথা কাজের শর্তাবলীতে কোনও পরিবর্তন আনার আগে এই সমস্ত জায়গায় আলোচনা ও মতামত দেওয়ার সু্যোগ থাকত। খসড়া বিল অনুযায়ী, BoG-তে কর্মীদের কোনও প্রতিনিধি থাকবেন না। JCC-র কোনও উল্লেখই নেই। এখন কর্মীদের কর্তব্য তথা কাজের শর্তাবলী নির্ধারণ এবং পদের সংখ্যা ও পারিশ্রমিক নির্দিষ্ট করার একচ্ছত্র ক্ষমতা BoGকে দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে ISI-তে স্বীকৃত ফ্যাকাল্টি পদের প্রায় ৬০টি এবং শিক্ষাকর্মীদের প্রায় ৩৫০টির বেশি পদ খালি রয়েছে। কর্মী সংগঠনের আশঙ্কা, এই ক্ষমতার জোরে BoG একতরফা ভাবে প্রচুর শূন্যপদ বিলুপ্ত করতে পারে।

কর্মী সংগঠনের কাছে সবচেয়ে বেশি উদ্বেগের কারণ হল, বিলে বলা হয়েছে যে বিল পাশ হওয়ার পরে নতুন রেগুলেশন দ্বারা কর্মীদের চাকরির শর্তাবলী পরিবর্তন করা যেতে পারে, এবং যদি কোনও কর্মী পরিবর্তিত শর্ত মানতে রাজী না হন, তবে তাঁর চাকরি চলে যেতে পারে। কর্মী সংগঠনের মতে, যে রেগুলেশন এখনও তৈরিই হয়নি, সেই শর্ত না জেনেই কর্মীদের তা মেনে নিতে বাধ্য করার অর্থ কী?

বিলের প্রতিবাদে ISI-এর ছাত্র-শিক্ষক-কর্মীরা পথে নেমেছেন। তার মানে কি এই যে এতদিন পর্যন্ত ISI-তে 'সব কিছু ঠিকঠাক বেশ চলছে'? এমনকি এই বিলের যাঁরা বিরোধিতা করছেন, তাঁরাও কিন্তু এ কথা মনে করেন না। সমস্যা অবশ্যই আছে। কিন্তু সমস্যার জায়গাগুলো চিহ্নিত করা ও তার সমাধান বের করা নিয়ে বিভিন্ন মহলে ভিন্ন মত আছে এবং সেটা থাকাই স্বাভাবিক। সেই জন্যেই রিভিউ কমিটির কিছু সুপারিশ ISI কাউন্সিলের কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি। চটজলদি সমাধান খুঁজে পাওয়া যাবে না। ওপর থেকে চাপিয়ে দিয়ে কোনও সমাধান আসতে পারে না। চাই আলোচনা। চাই অবাধ মতামত বিনিময়। এই বিল এই রাস্তাটাকেই বন্ধ করতে উদ্যত। অনেক প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায়নি। তৈরি হয়েছে সন্দেহ ও অবিশ্বাসের বাতাবরণ। রিভিউ কমিটি তো মন্ত্রকের তরফেও কিছু পদক্ষেপের সুপারিশ করেছিল, যেগুলোকে ISI কাউন্সিল স্বাগত জানিয়েছিল। যেমন, হঠাৎ করে ২৭৩এ বেঁধে দেওয়া ফ্যাকাল্টি সংখ্যাকে বাড়িয়ে নিঃশর্তে ৩০০ এবং পরবর্তীতে ৪০০তে নিয়ে যাওয়ার সুপারিশ। সেগুলো তো এখনও হয়নি। এই বিল গৃহীত হলেও যে সেগুলো রূপায়িত হবে, এমন আশ্বাসও পাওয়া যায়নি। সেইজন্যেই বিল প্রত্যাহারের দাবি। সুসংবদ্ধ আলোচনার পরিস্থিতি তৈরি করার দাবি। ...(শেষ)

প্রথম পর্ব:

https://ekakmatra2013.blogspot.com/2025/12/isi.html


No comments:

Post a Comment