মৌলবাদ নিজ লেজ ভক্ষণকারী সাপ
মালবিকা মিত্র
এই রাজ্যের একদা নামকরা আইনজীবী শ্রী গোস্বামী। তাঁর শ্রীরামপুরের চেম্বারে বসেছিলাম। সেটা প্রায় তিরিশ বছর আগের কথা। এক মক্কেল ডিভোর্সের জন্য খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। মামলাটা কত তাড়াতাড়ি সমাধান হবে সেটা জানতে চাইছেন। সেই আইনজীবী মহাশয় মক্কেলকে বললেন, আপনি কি অন্য কোথাও কোনও মহিলার সাথে সম্পর্ক করে ফেলেছেন, তাই এত ব্যস্ততা? মক্কেল সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়লেন। এরপর শ্রী গোস্বামীর দ্বিতীয় প্রশ্ন, আপনার সেই মহিলা কি কনসিভ করেছে, তাই এত ব্যস্ততা? মক্কেল পুনরায় সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়লেন। তখন আইনজীবী বললেন, তাহলে এক কাজ করুন। আপনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করুন, মুসলমান হয়ে গেলে আপনার একাধিক বিয়ের ক্ষেত্রে কোনও বাধা থাকবে না। তিনি অরুণ প্রকাশ চট্টোপাধ্যায়ের উদাহরণ দিলেন।
এরপর মক্কেলের প্রশ্নটি ছিল অসাধারণ উৎসাহব্যঞ্জক-- আচ্ছা স্যার, মুসলমান ছাড়া অন্য কিছু, মানে খ্রিস্টান হলে চলে না? মক্কেল চলে যাবার পর গোস্বামীদা বললেন, দেখলে তো, একেই বলে কলোনিয়াল লিগ্যাসি। খ্রিস্টান যদাপি হয়, মুসলমান কদাপি নয়। এই কলোনিয়াল লিগ্যাসির হাত ধরেই দেখবে, শুধু খ্রিস্টান পাড়া নয়, সমস্ত অলিগলি তস্য গলিতেও ক্রিসমাসের আলোকসজ্জা, বেলুন, এলইডি ল্যাম্প, সান্তা ক্লজের টুপি, আর প্রায় সব দোকানে কেকের সমারোহ, দামী-অদামী নানাবিধ। বহু রাত পর্যন্ত আনন্দ ফুর্তি উন্মাদনা চলে। দরিদ্রতম পাড়াতেও এর পরশ পাওয়া যায়।
এটা তো নিশ্চিতভাবে কাম্য। কারণ, আমরা জানি এবং বিশ্বাস করি, 'ধর্ম যার যার, কিন্তু উৎসব সবাকার'। ক্রিসমাস তো আর ধর্ম নয়, ওটা এখন উৎসব। কিন্তু এখানে যুক্তিতে নিজের গলায় নিজের কথা আটকে যায়। ঈদ, মহরম, নবী দিবস কিন্তু মুসলমান পাড়াতেই সীমাবদ্ধ থাকে। এমনকি পাড়ায় দু' ঘর মুসলমান থাকলেও, রোজার রমজান মাসে আমরা কেউ ফলমূল নিয়ে ইফতার পাঠাই না। ঈদ মহরম কিন্তু সবাকার উৎসব হয়ে ওঠে না। অথচ দুর্গাপুজো লক্ষ্মীপুজো সরস্বতী পুজো জগদ্ধাত্রী পুজো কিন্তু সকলের উৎসব হয়ে থাকে। তাই বলছিলাম, উৎসব সবার বললেও নিজের মধ্যেই কথাটার সত্যতা সম্পর্কে একটা খটকা থেকে যায়।
তবে এসব পোস্ট-কলোনিয়াল বা কলোনিয়াল লিগ্যাসি যাই বলি না কেন, Sandria B. Freitag তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ 'Collective Action and Community'তে দেখিয়েছেন, উত্তরপ্রদেশে গোরক্ষক বাহিনীর হাতে সেই উনিশ শতকেও, শুধু মুসলমানেরা নয়, বিধর্মী খ্রিস্টানরাও আক্রান্ত হয়েছে। তারা ভগবান যীশুর ছবিতে জুতোর মালা পরিয়ে জনসমক্ষে ঘোষণা করে যে, যীশু একজন অপবিত্র ব্যক্তিত্ব কারণ তিনি কুমারী সন্তান; সর্বোপরি খ্রিস্টানরা গো-মাংস ভক্ষক, অতএব ম্লেচ্ছ। মুসলমানদের মতোই খ্রিস্টান সংসর্গ অপবিত্র। ইংরেজ উপনিবেশিক শাসনে খ্রিস্ট ধর্মের উপর এর বেশি বাড়াবাড়ি করা সম্ভব ছিল না। কিন্তু দৃষ্টিভঙ্গিটি এ থেকে স্পষ্ট হয়।
মাত্র কয়েক বছর আগে ওড়িশার পাদ্রী গ্রাহাম স্টেইন'কে পুড়িয়ে মারার ঘটনাও আমরা বিস্মৃত হইনি। আজ যা ইসলাম বিরোধিতা, কাল সেটাই খ্রিস্টান বিরোধিতায় রূপ নেবে এবং নিচ্ছে। বলাই বাহুল্য, আসলে উগ্র হিন্দুত্বের শ্লোগানের মধ্যেই থেকে যায় নিরামিষ ভোজী ও আমিষ ভোজীর দ্বন্দ্ব। বিষ্ণুর অবতার হল মৎস্য। অতএব, মীন সংরক্ষণ সমিতি গড়ে উঠল। কালক্রমে সমস্ত মছলিখোর হয়ে ওঠে উগ্র হিন্দুত্বের শত্রু। ইতিমধ্যেই ২০২৫'এর দুর্গোৎসবে দিল্লিতে ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকার মাছ-মাংসের দোকান বন্ধ রাখার ফতোয়া জারি করেছিল। একইভাবে ব্রিগেডের মাঠে গীতা পাঠের আয়োজনে চিকেন প্যাটিস বিক্রেতা হয়ে ওঠে উগ্র হিন্দুত্বের শত্রু, সেই সঙ্গে বঙ্গভাষীরাও, কারণ, বাংলাদেশি মুসলমানদের মুখের ভাষা বাংলা। কার্যত 'হিন্দু-হিন্দি-হিন্দুস্তান' এক সুরে বাঁধা। এটাই হিন্দু রাষ্ট্রের মেরুদণ্ড।
দিল্লির আপ নেতা ও প্রাক্তন মন্ত্রী সৌরভ ভরদ্বাজ জানিয়েছেন, দিল্লির লাজপত নগরে সান্তা ক্লজের টুপি পরা কিছু মহিলা ও শিশু একটি গির্জার বড়দিনের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের আমন্ত্রণপত্র বিলি করতে গিয়ে উগ্র হিন্দুবাদীদের হাতে আক্রান্ত হয়। মধ্যপ্রদেশের জব্বলপুরে একটি গির্জার প্রায় ৭০ জন দিব্যাঙ্গ ও বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুকে খাওয়ার আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। সেখানে বিজেপি নেতাদের সঙ্গে নিয়ে হিন্দু সংগঠনগুলি গির্জায় পৌঁছে বিক্ষোভ দেখাতে থাকে। একই অভিযোগ শোনা যায় ওড়িশাতে, হিন্দু বিক্রেতারা সান্তা ক্লজের টুপি মুখোশ ও লাল পোশাক বিক্রি করতে পারবে না, এই অজুহাতে বিক্রেতাদের ওপর হিন্দুত্ববাদীদের হামলা। উপরন্তু, অসমের নলবাড়ি ও ছত্তিশগড়ের রায়পুরেও যথাক্রমে একটি স্কুল ও শপিং মলে বড়দিনের অলংকরণ ও আলোকসজ্জা সব তছনছ করে ভেঙে ফেলা হয়।
উল্লেখ্য, গত ২৪ ডিসেম্বর ওড়িশার সম্বলপুরে বাংলা ভাষায় কথা বলার অপরাধে এক বাঙালি যুবককে 'বাংলাদেশি' তকমা দিয়ে পিটিয়ে মারা হয়। মৃত যুবকের নাম জুয়েল শেখ (২০), বাড়ি মুর্শিদাবাদের সুতি থানার আহিরণ এলাকায়। গত সপ্তাহে রাজমিস্ত্রির কাজে সম্বলপুরে গিয়েছিলেন তিনি। একটি মেলায় ঘোরাঘুরির সময় জুয়েলকে বাংলা বলতে শুনে স্থানীয় কিছু দুষ্কৃতী তাকে 'বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী' বলে সন্দেহ করে। এরপরই উন্মত্ত জনতা তার ওপর চড়াও হয়। নৃশংসভাবে মারধর করার ফলে ঘটনাস্থলেই জুয়েলের মৃত্যু ঘটে। অথচ, কী নৃশংস ভাবে গোদি মিডিয়া ও তথাকথিত ভদ্দরজনেরা, যারা প্রায়শই বাংলাদেশে এমনতর অন্যায়ের বিরুদ্ধে নিজেদের উচ্চকন্ঠে জানান দেয় (অবশ্যই সে প্রতিবাদ যথার্থ), সেই তারাই স্বদেশের ভূমিতে বাঙালি নিধনে নিষ্ঠুরতম নীরবতায় প্রকারান্তরে তাকে মদত দিয়ে চলেছে। এই হল ফ্যাসিবাদের মানসিক ভিত্তিভূমি।
উগ্রতা ও মৌলবাদের এটাই স্বাভাবিক চলন। শুরুতে যা ছিল মুসলমান বিরোধিতা, কালক্রমে তা খ্রিস্টান বিরোধিতা, বৌদ্ধ জৈন শিখ বিরোধিতা, একের পর এক ঘটতে থাকে। মৌলত্ব, আরও মৌলিক, ক্রমাগত ক্ষুদ্র হতে থাকে। পরে হিন্দু ধর্মের মধ্যেই উচ্চ-নীচ, অস্পৃশ্য, অশুচি, আমিষ ভোজী, নিরামিষ ভোজী ইত্যাদি বিভাজন গড়ে তুলতে থাকে। বৃত্তের মধ্যেই জন্ম নিতে থাকে আরও ছোট ছোট ক্রমাগত ছোট হতে থাকা বৃত্ত বলয়। বেড়ে চলা বৃত্ত বলয়ের চাপের অন্তিম পরিণতি সে কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। মৌলবাদ হল সেই সাপ যে নিজেরই লেজকে ভক্ষণ করতে শুরু করে এবং গিলতে গিলতে নিজেই নিজের শরীরটাকে গিলে ফেলে অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলে।

কবে সে নিজের লেজ খাবে, সেই অপেক্ষা বড় দীর্ঘ আর শ্বাসরোধকারী
ReplyDelete