এক অসুরের পতন ও উত্থান
প্রদ্যুম্ন বন্দ্যোপাধ্যায়
কেরালার ওনাম উৎসব অসুররাজ বলির এই ধরাধামে ফিরে আসার বাৎসরিক উদযাপন। এমনিতে বলি উপাখ্যান দেবতাদের হাতে পরাভূত একজন অসুরের বিয়োগান্ত গাথা। রাহুর মতোই বলি উজ্জ্বল বর্ণের দেবতাদের ছলচাতুরির শিকার।
শাস্ত্র সভ্যতার জয়যাত্রার প্রমাণস্বরূপ বামনরূপ ধারী নারায়ণ কর্তৃক বলির ভূগর্ভে প্রক্ষেপণ। এই অন্তর্জলী যাত্রার কাহিনী উপমহাদেশে পরিচিত। বৈদিক শাস্ত্রে, রামায়ণ, মহাভারতে বলি রাজার পাতাল প্রবেশের নানা কাহিনী হাজির। কিন্তু এত ব্যূহচক্র তীর-তীরন্দাজিতে পর্যুদস্ত বলি রাজা কিন্তু ফিরে আসেন উপমহাদেশের নানা প্রান্তে, স্থানীয় আচার অনুষ্ঠানে, উৎসবে, লোকগাথায়। কেরালা ছাড়া মধ্য এবং উত্তর ভারতে বলি প্রতিপদে, অসমে বিহু উৎসবে শস্যশালিনী বলিস্তানেরই জয়গান গাওয়া হয়। প্রাক-বৈদিক এই অসুর রাজার সুশাসন সমৃদ্ধির গল্প কিন্তু থেকেই গেছে লোককথায়।
আধুনিক ভারতে এই বলি উপাখ্যানের রাজনৈতিক উত্থান ঘটতে দেখি মহারাষ্ট্রের র্যাডিকাল সমাজ সংস্কারক জ্যোতিবা ফুলে'র হাতে। আধিপত্যকারী ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির মূলে আঘাত হেনে তিনি প্রাক-বৈদিক দৈত্যরাজ বলির শাসন সমৃদ্ধির অতিকথা তুলে ধরেন। মহারাষ্ট্রের কৃষিজীবী নিম্নকোটির কুনবি জনগোষ্ঠীর জীবনযাপনের পরতে পরতে মিলেমিশে থাকা পাপভ্রষ্ট বলি রাজার সেই হারিয়ে যাওয়া বলিস্থান ফিরে পাবার আকাঙ্ক্ষা মনে হয় এক পাল্টা জাগরণ, রামরাজ্যের বিপরীতে এক ভিন্ন মুক্তির অপেক্ষা। ফুলের রচনা 'গুলামগিরি' ও অন্যান্য লেখায় সংগৃহীত হতে থাকে স্থানীয় নিম্নকোটির কৃষিজীবী মানুষজনের মধ্যে আশ্চর্যরকম ভাবে বেঁচে থাকা বলি রাজার শাসনকাল নিয়ে নানা জনশ্রুতি আর বিশ্বাস। শাস্ত্র নির্দিষ্ট দশেরা ও নবরাত্রির বিপ্রতীপে স্থানীয় অকিঞ্চিৎকর নিতান্তই ছাপোষা দেবদেবীদের ঘিরে পর্যায়ক্রমিক লোক উৎসব চর্চার ওপর জোর পড়ে।
দেবী দুর্গার আরাধনার মতো অসুররাজ বলির মহিষী বিন্ধবতির গরিমা সোচ্চারে তুলে ধরা হয়। কোজাগরী পূর্ণিমা আর দীপাবলী উৎসবের সময়কেই বেছে নিয়ে দলিত বহুজন ভুক্ত কৃষক রমণীরা প্রদীপ জ্বালিয়ে বলিস্থান ফিরে পাবার প্রার্থনা করেন। ফুলের রচনা স্পষ্ট করে, উপমহাদেশে প্রচলিত ধর্ম চর্চার মধ্যেই প্রাচীন যুগ থেকে চলে আসা মীমাংসা না হওয়া দ্বন্দ্ব, আধিপত্য, অধীনতা আর পরাজয়ের হদিশ আছে। ব্রাহ্মণ্য সভ্যতার রমরমার তলায় দুমড়ে মুচড়ে থাকা অনার্য ধর্ম সংস্কৃতির জাগরণ উপমহাদেশে অন্য রাজনীতির পরিসর খুলে দেয়। পৃথিবীতে বিশুদ্ধ সভ্যতা বলে কিছু হয় না। সমস্ত সভ্যতার উজ্জ্বল খতিয়ান একই সঙ্গে হিংসা আর বর্বরতার খতিয়ানও বটে, বলেছিলেন ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুলের দলছুট গভীর মননশীল তাত্ত্বিক ওয়ালটার বেনজামিন। জ্যোতিবা ফুলে জিতে যাওয়া ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতি সভ্যতার পেলবতার আড়ালে রয়ে যাওয়া বর্বরতার কথা তুলে ধরেন।
দলিত বহুজন সমাজে বলি অপরাজেয়। অনেকটা মেঘনাদ অথবা কর্ণের মতো। রামায়ণের রাক্ষস রাজপুত্র মেঘনাদ জন মিলটন সদৃশ কবিযশ প্রার্থী হতে ব্যর্থ মধুসূদনের হাত ধরে আত্মপ্রকাশ করে অপরাভূত বীরের বেশে। ঔপনিবেশিক শাসনের গনগনে আঁচে অস্বীকৃতির শিকার জগদীশচন্দ্র বন্ধু রবীন্দ্রনাথকে অনুরোধ করেন সুতপুত্র কর্ণকে মহাভারতের অবিসংবাদী বীর হিসেবে তুলে ধরতে। লেখা হয় 'কর্ণকুন্তী সংবাদ'। মহাকাব্য পাঠের চেনা অভ্যেসে লাগে ভাঁটার টান। বাঙালি মধ্যবিত্ত অভিভূত হয়। ফুলেও কিন্তু সুখপাঠ্য ব্রাহ্মণ্য সভ্যতার গোড়া ধরে টান মারেন। বলি রাজার অতিকথার উন্মোচন ঘটান। উপমহাদেশে বিস্তৃত ভিন্ন রাজনীতি-সংস্কৃতির দরজা খুলে দেন।
ইদানীং ভারতে নতুন করে মাথা চাড়া দেওয়া হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির বোলবোলাও'এর মুখোমুখি দলিত বহুজন গোষ্ঠীগুলির উত্থান প্রকাশ পায় তাদের উৎসব, পার্বণ, ভিন্ন রাজনীতি চর্চা আর জনপ্রিয় সিনেমায়। ভারতের নানা জায়গা বলির অধিষ্ঠান ক্ষেত্র বলে দাবি ওঠে। মহারাষ্ট্রের মহাবালেশ্বর, তামিলনাড়ুর মহাবলীপুরম, উত্তরপ্রদেশের বালিয়া আর গুজরাটের ভারুচ বলিরাজ ক্ষেত্র বলে স্থানীয়দের বিশ্বাস। ভিন্ন ধরনের এই রাজনীতি-সংস্কৃতির প্লাবনে কিন্তু বামপন্থীরা দীর্ঘদিন ধরেই গরহাজির। তার কারণটাও খুব একটা অজানা নয়। জীবনানন্দকে স্বচ্ছন্দে ব্যবহার করে বলা যায় যে, হয়তো বা সঠিক শ্রমিক নয় তারা, তাই এই অনীহা। অথচ কপিবুক শ্রমিকদের তুলনায় ঢের বেশি লোক রয়ে গেছে উপমহাদেশের কিনারা আর আনাচে কানাচে।
শেষে ভারতের বাকি অংশ ছেড়ে কলকাতার চেনা পাড়া সিমলে অঞ্চলের কথায় ফেরা যাক। স্বামী বিবেকানন্দের ছোট ভাই মহেন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর অনবদ্য স্মৃতিচারণ 'কলিকাতার পুরাতন কাহিনী ও প্রথা' বইতে লেখেন তাঁদের ঠাকুর দালানে অনেক বাদুর জড়ো হত আর পাড়ার ছেলেরা ঢিল মেরে তাদের তাড়াত। মহেন্দ্রনাথ লিখেছেন, 'এই বিষয়ে নরেন্দ্রনাথ বিশেষ দক্ষ ছিল। পাড়ার বুড়িরা বলত এই বাদুর বড়ো পুণ্যাত্মা, ওদের রাজা বলি পাতালে থাকে। রাজার সম্মানে ওরা হেঁট মাথা করে ঝোলে।' মহেন্দ্রনাথের উক্তি, 'আমরাও সেইজন্য মাঝে মাঝে বাদুর দেখে প্রণাম করতাম।'
খুবই সমৃদ্ধ হলাম লেখাটা পড়ে। এই ধরণের আরো লেখা আসা উচিত যা আমাদের সংস্কৃতিকে জানতে সাহায্য করে। বামপন্থীরা শুধু গরহাজির নয়, তাঁরা এসব নিয়ে চর্চাই করে না।
ReplyDeleteপ্রদ্যুম্ন কম লেখেন,সেটা যে আমাদের লোকসান ওনাকে কে বোঝাবে?
ReplyDeleteঋদ্ধ হলাম।
ReplyDelete