মিড ডে মিল নিয়ে ধর্মের রাজনীতি
কেন?
অভিজিৎ রায়
শিশুদের পুষ্টি নিয়ে কোনো ট্র্যাজেডি না ঘটলে সেটি প্রাইম টাইম নিউজ হয় না। মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী
শিবরাজ সিং চৌহান মহাশয়ের মিড ডে মিলে সম্প্রতি সেদ্ধ ডিম দেওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি
করেছেন। অঙ্গনওয়াড়ীর অন্তর্ভুক্ত ইন্টিগ্রেটেড চাইল্ড
ডেভেলপমেন্ট (আইসিডিএস) কর্মসূচির মধ্যে দিয়ে শিশুদের পুষ্টিবৃদ্ধির যে পরিকল্পনা
গ্রহণ করা হয়েছে তাতে পুষ্টি বৃদ্ধিতে মধ্যাহ্ন ভোজনে সেদ্ধ ডিমের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীর এ হেন পদক্ষেপ তার ব্যক্তিগত
রাষ্ট্রনীতি বলেই বোধ করি। অবশ্য এই পদক্ষেপের কোনও ব্যাখাই তিনি নিজে দেননি। তার মুখ্য সচিবের ব্যাখানুযায়ী, ‘নিরামিষভোজন
মুখ্যমন্ত্রীর একটি অনুভূতির বিষয়’; শুধু তাই নয় মুখ্যসচিবের ব্যখানুযায়ী, আমিষ
ভোজনে নাকি শিশুদের ‘সেনসিটিভিটি’ বা ‘সহজে অনুভবনশীল ক্ষমতা নষ্ট হয়’
বলেও মনে করেন মুখ্যমন্ত্রী। অথচ তারই রাজ্যের নারী ও শিশুকল্যাণ মন্ত্রক ৩-৬ বছরের
শিশুদের পুষ্টি বৃদ্ধির জন্য প্রাতরাশে সেদ্ধ ডিম দেওয়ার প্রস্তাব রাখে - বিশেষত মান্ডলা,
আলিরাজপুর ও হোসাঙ্গাবাদের মতো উপজাতি এলাকাগুলিতে পুষ্টির হার বৃদ্ধির জন্য এই
প্রস্তাব খুবই কার্যকরী। আইসিডিএস ও মিড ডে মিল কর্মসূচির প্রধান লক্ষ্যই হল
অন্ত্বঃসত্তা মহিলা ও শিশুদের পুষ্টি বৃদ্ধি করা।
ভারতে ২০০৫-০৬ সালে জাতীয় পরিবার সমীক্ষায় দেখা গেছে, যে শিশুরা মাতৃদুগ্ধ থেকে
বঞ্চিত তাদের শারীরিক গঠন অত্যন্ত দুর্বল এবং গোটা দেশে মাত্র ১০ শতাংশ শিশু
প্রয়োজনীয় পুষ্টি পায়। একটি টিভি চ্যানেলে বিতর্কানুষ্ঠানে বিজেপি মুখপাত্র দুধের
মহিমা কীর্তন করে এটিকে প্রোটিনের উৎকৃষ্ট উৎস বলে ঘোষণা করেন। কিন্তু যে পরিমাণ
ক্যালোরি, প্রোটিন ডিম থেকে মেলে দুধ থেকে তা মেলে না বলেই মনে করেন নিউট্রিশ্যানিষ্টরা। আসলে যতই ডিম অথবা দুধ দেওয়ার
কথা বলা হোক, সরকারি খাতায় মিড ডে মিলের মাধ্যমে একটি শিশুর পুষ্টি বৃদ্ধির জন্য
প্রত্যহ মাত্র ৭ টাকা বরাদ্দ - এই খরচে পুষ্টি সত্যিই কতটা বাড়ানো সম্ভব তা জানা
নেই।
ভারতীয় সংবিধানের ২১ ধারানুসারে জীবনের অধিকারের মধ্য দিয়ে খাদ্যর অধিকার
প্রতিষ্ঠিত। তাছাড়া সুপ্রিম কোর্টের বিভিন্ন রায়েও খাদ্যের অধিকারকে স্বীকৃতি
জানানো হয়েছে। আসলে গলদটা গোড়া থেকেই ছিল। ২০০১ সালে সুপ্রিম কোর্ট রাজ্যগুলিকে
মিড ডে মিল চালু করার যে নির্দেশ দেয় এবং সেটির মেয়াদ ফুরোনোর আগে মাত্র হাতে গোনা
কয়েকটি রাজ্য সেই নির্দেশ কার্যকর করে। ডিম নিয়ে অনীহাটা শুরু থেকেই চলে এসেছে, মূলত
২০০৭ সাল থেকে বিজেপি মিড ডে মিলে ডিম দেওয়ার বিরোধিতা করে আসছে। মধ্যপ্রদেশে ডিমের
নিষিদ্ধকরণের পক্ষে সওয়াল করে রাজ্যের একটি সম্প্রদায়ের দাবি ‘ডিম তো গাছে ফলে না তাই
এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থেকে শিশুদের বাঁচানো দরকার, তাছাড়া ঘোড়া বা হাতির মতো
শক্তিধর প্রাণীও শাকাহারি’।কথাগুলি হাস্যকর শোনালেও এগুলিই তাদের কাছে প্রত্যয়। শিশুদের স্বাস্থ্যের আগে ধর্মীয় আবেগকে স্থান দিয়ে এনারা প্রকৃত কর্তব্য পালন থেকে শুধু বিরতই হন না,
মানবাধিকারও লঙ্ঘন করেন।
এইসব যুক্তি দেখে বলা যায়, আমিষ ভোজনে শিশুদের খুব একটা বেশি বুদ্ধিহীনতা ঘটবে
না কারণ অবস্থাটা আগে থেকেই খারাপ। দেশের শিশুরা ইস্কুলের বেঞ্চির উপর দু'খানি
শীর্ণ খর্ব চরণে দোদুল্যমান, সেই সঙ্গে দেশের ভবিষ্যৎও দুলছে। ইস্কুলে মাস্টারের
বেত হজম করতে করতে, অনাহারে দিন কাটাতে কাটাতে তাদের হজম শক্তি দুর্বল, মানসিক
পাকযন্ত্রটাও পরিণত হয় না, অতএব সেখানে আমিষ ভোজনে তাদের ‘সেনসিটিভিটি’ কমে যাওয়ার
বিশেষ ভয়না নেই।
ভারতে সংস্কৃতিগত পার্থক্যের জন্য মানুষের রুচি, খাওয়া-দাওয়ার ক্ষেএে ভিন্নতা
আছে আর এই ফারাকটাই কোথাও সমস্যার সৃষ্টি করে। এই ধরনের নিষিদ্ধকরণে উচ্চ শ্রেণির
নিরামিষ ভোজন মানসিকতা যেমন গুরুত্ব পায় সরকারি নীতির বদলে, তেমনি বাস্তবকে উপেক্ষা
করে আপন চিন্তাধারা চালানো আর সেখানেই প্রকাশ পায় শ্রেণি-জাতপাত ভেদাভেদের
রাজনীতি। আমাদের দেশে ‘খাদ্যের জাতপাতকরণ’ ব্যাপারটাও অস্বাভাবিক নয়, তাতে শিশুদের
পুষ্টি বৃদ্ধি কমে গেলেও শাসকের নিরামিষ বিধি প্রয়োগ করা ছাড়া গতি নেই। ইউনাইটেড নেশন’এর খাদ্য ও কৃষি সংস্থার
তথ্যানুযায়ী, অপুষ্টির শিকারে প্রতি চারজনের একজন ভারতীয়; যেখানে অপুষ্টির হার
তীব্র সেখানে পুষ্টির বৃদ্ধি প্রাধান্য পাওয়া দরকার নয় কী?।
কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক এবং ছওিশগড়ের শিক্ষা ও সাহিত্য মন্ত্রকের
যৌথ সমীক্ষাতে উঠে এসেছে, মিড ডে মিলে প্রোটিনের জন্য অন্য রাজ্যগুলির তুলনায় ওড়িশায়
সবচেয়ে বেশি ডিমের ব্যবহার হয়, বিশেষত উপজাতি বসতি এলাকাগুলিতে পুষ্টির হার
বৃদ্ধিতে বেশি নজর দেওয়া হয়েছে। ওড়িশা সরকার একটি অভিনব পন্থা নিয়েছে - তিন বছর
বয়স পর্যন্ত শিশুদের মিল বাড়িতে রেশন করে দেওয়া হয়। মিড ডে মিলের মধ্যেও বহুজাতিক সংস্থাগুলি তাদের মুনাফা পেতে চায়। তারা প্রভাব
খাটিয়ে রান্না করা মিলের পরিবর্তে ড্রাই মিলের প্যাকেটের ব্যবস্থা করে যার মেনুতে
নিরামিষ খাবারই থাকে। এতে খাবারের মান নিয়ে সন্দেহ থাকে। পশ্চিমবঙ্গেও মিড
ডে মিলের মান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। শুধু এই বঙ্গ কেন, সম্প্রতি মহারাষ্ট্রেও
অঙ্গনওয়াড়ীর খাদ্য কেনার ক্ষেএে কোটি টাকার দুর্নীতি হয়েছে এবং খাবারের মান নিয়ে
প্রশ্ন উঠেছে। মিড ডে মিলের মাধ্যমে কেবল পুষ্টি নয় ইস্কুলের
প্রতি শিশুদের আকর্ষণ বৃদ্ধিও করা হয়। তথ্যানুযায়ী, ২০১৩-১৪ সালে প্রায়
১০.৪৫ কোটি শিশুকে স্কুলমুখি করা গেছে মিড মিলের মাধ্যমে।
ছওিশগড়ে ২০০৫ সাল থেকে ‘ফুলওয়ারির’ মাধ্যমে উপজাতি এলাকাগুলিতে শিশুদের পুষ্টি
বৃদ্ধির প্রক্রিয়াতে ডিম প্রচলিত হলেও ২০১৩ সাল থেকে তা নিষিদ্ধ হয়। রাজ্যের
মুখ্যমন্ত্রী রামন সিং কিছুদিন আগে সুরগুজাতে প্রকাশ্য জনসভায় বলেন, উপজাতি এলাকার
শিশুদের পুষ্টির জন্য ডিম প্রয়োজন। কিন্ত তিনি এটিকে সরকারি নীতির আওতাভুক্ত
করেননি। কারণটা বোধহয় হিন্দুত্ববাদী বস’দের চোখে অপ্রিয় পাত্র হয়ে পড়বেন। ‘ফুলওয়ারি’
কোনও সরকারি প্রকল্প নয়, এটি প্রতিটি গ্রামের মায়েদের দ্বারা পরিচালিত একটি
প্রকল্প যার অর্থ আসত জেলা প্রশাসনের কাছ থেকে।
মধ্যপ্রদেশ, কর্ণাটক বা ছওিশগড়ে ডিম নিষিদ্ধকরণ শিশুদের স্বাস্থ্যর পরিপন্থী -
এই ধরনের নিয়ন্ত্রণ অবৈজ্ঞানিক পর্যায়ে পড়ে। যেখানে প্রধানমন্ত্রী ‘বেটি বাঁচাও’র
মতো কর্মসূচিতে গুরুত্ব দিচ্ছেন সেখানে শিশুদের পুষ্টির সঙ্গে আপস মেনে নেওয়া হবে
কেন? প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, আইসিডিএস এবং মিড ডে মিল কর্মসূচিতে মেয়েদের স্বাস্থ্যের
উপর বেশি জোর দেওয়া হয়েছিল। ‘মিশন ইন্দ্রধনুশ’ কর্মসূচির সাফল্য পুষ্টির হার
বৃদ্ধির উপর অনেকাংশেই নির্ভরশীল। শিশুদের স্বাস্থ্যের উন্নতি বৃদ্ধিটাই প্রাধান্য পাওয়া দরকার। দেশের স্বাস্থ্যের
হাল নিয়ে বড়াই করা যায় না তবু এই সব সিদ্ধান্ত যারা নেন তাদের উদ্দেশ্য প্রশংসনীয়
তো নয়ই বরং সমাজের পক্ষে যথেষ্ট ক্ষতিকারক। কোনওরকম রাজনৈতিক জটিলতা, জাতপাতের
ভেদাভেদ ও ধর্মীয়তাকে দূরে রেখে শিশুদের পুষ্টি বৃদ্ধিকে অগ্রাধিকার দেওয়া দরকার।
মিড ডে মিলের কর্মসূচির নির্ধারণে মুনাফাখোরেরা নাক গলাতে পারে না তাই মন্ত্রীকে
হাত করে কোটি টাকার টেন্ডার আদায় করে ন্যূনমানের খাবার কিনে দেয়। আখেরে ক্ষতিটা হয়
শিশুদেরই। সহজ কথাটা হল, ‘শিশুরাই দেশের ভবিষ্যৎ’ - কিন্তু এখানে তারাই তো দুর্নীতির শিকার। এখানে শিশুদের স্বাস্থ্য মায় দেশের ভবিষ্যৎ,
অপুষ্টি-হিন্দুত্ববাদী-সংকীর্ণ মানসিকতার মাঝে পথ হারিয়েছে। মিড ডে মিল নিয়ে
রাজনীতির আকচাআকচি বন্ধ হোক এই কামনা করি। শাসক কখনও অন্যের নিষেধ মানবে না, তার
নিষেধ সবাইকে মানতে হবে, এটাই দস্তুর আমাদের সমাজে।
সব শেষে একটা কথাই বলা যায়, শিশুদের স্বাস্থ্যের দিকে নজর
দেওয়া দরকার। মিড ডে মিলে আমিষ বন্ধ করে নিরামিষ খাবার দেওয়ার মধ্যে দিয়ে সমাজের
কোনও কল্যাণ করা যায় না। ধর্ম-জাতপাতের দোহাই দিয়ে শিশুদের খাদ্যের উপর
নিষেধাজ্ঞা আরোপে কোনও বীরত্ব নেই।
ভাল নিবন্ধ ... চালিয়ে যান ... "স্বীকার" বানানটা এডিট করে "শিকার" লিখতে হবে বলে মনে হচ্ছে ... দেখে নেবেন
ReplyDeleteআপনি ঠিক বলেছেন - 'শিকার' হবে। শুধরে নেওয়া হয়েছে। ধন্যবাদ।
Deleteআপনার এই লেখাটা অনেক ভাল লাগলো , লিখে যান, সমাজকে সমৃদ্ধ করুন।
ReplyDelete