করোনা, টিকা ও এক দাম্ভিকের গল্প
শোভনলাল চক্রবর্তী
অবশেষে সব অবরোধ তুলে নিল আমেরিকা। কোভিড যুদ্ধে সারা বিশ্বের স্বার্থে। তবে সব শুরুর একটা শুরু থাকে। এই বছরের ১২ মার্চ আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বিডেন অস্ট্রেলিয়া, ভারত, জাপান ও আমেরিকা নিয়ে সদ্য গঠিত 'কোয়াড'-এর সদস্যদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন করোনার বিরুদ্ধে এই ঐতিহাসিক যুদ্ধে এই চারটি দেশ হাতে হাত মিলিয়ে লড়বে। 'কোয়াড' ভুক্ত দেশগুলি কোভিডের বিরুদ্ধে যত রকম সাহায্যের প্রয়োজন তা করবে। তা সে ওষুধ বা ওষুধ শিল্পের প্রয়োজনীয় কাঁচামালই হোক বা অর্থকরী সাহায্য, এমনকি জরুরি ভিত্তিতে কোনও প্রয়োজন পড়লে তা যেন লাল সুতোর ফাঁসে বিলম্বিত না হয় তাও দেখা হবে- এই প্রতিজ্ঞাপত্র 'দ্য স্পিরিট অফ দ্য কোয়াড' নামে প্রচারিত হয়।
বিজেপির নেতারা এরপর গলা ফাটিয়ে বলে বেড়ালেন যে ভারত এখন আমেরিকা, জাপানের মতোই পৃথিবীর অগ্রণী দেশগুলির মধ্যে একটি। সেদিন হয়তো অলক্ষ্যে বিধাতা হেসেছিলেন। এর ঠিক পরেই ভারতে আছড়ে পড়ল কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউ। আমাদের দেশের নেতারা তখন ব্যস্ত রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচন নিয়ে। দেশের একটা বড় অংশের মানুষ ও নেতারা ব্যস্ত কুম্ভ মেলা নিয়ে, আর বাকিরা ক্রিকেট নিয়ে। আমাদের দেশে হানা দেওয়ার আগে ব্রিটেনকে এই নতুন প্রজাতির কোভিড ছারখার করেছে। তবে আমাদের নেতারা তখন সে সব গায়ে না মেখে কোভিশিল্ড ভ্যাকসিন রফতানি করে হাততালি কুড়োতে ব্যস্ত ছিলেন। ব্যস্ত ছিলেন ভারতকে টিকা রাজধানী হিসাবে পরিচিত করাতে। ভারতই হবে টিকার 'বিশ্বগুরু'- এমনটাই প্রচার শুরু হল।
আমাদের দেশে করোনার দ্বিতীয় দফার ঢেউয়ে প্রথমে মহারাষ্ট্রে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে থাকে, তারপর পাঞ্জাবে, শেষে দিল্লির বুকে তা আছড়ে পড়ে সুনামি হয়ে। ভাইরাসের দুটি নতুন প্রজাতি এই আক্রান্তের হারকে ত্বরান্বিত করে। ইতিমধ্যে 'কোয়াড'-এর প্রতিজ্ঞাপত্রে জল ঢেলে আমেরিকা জানিয়ে দেয় যে ভারতকে তারা টিকার জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল পাঠাতে অক্ষম। অবস্থার অবনতি হতে শুরু করে যখন দেখা যায় নরেন্দ্র মোদি ও তাঁর দোসর অমিত শাহ মাস্কবিহীন হয়ে বড় বড় জনসভায় ভাষণ দিচ্ছেন, ইলেকশন কমিশন পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে দেখছে, অন্যদিকে রাজধানীতে মৃত্যুর হার প্রতিদিন নতুন রেকর্ড স্পর্শ করছে। পাশাপাশি, যে টিকাকরণ প্রক্রিয়া খুঁড়িয়ে হলেও চলছিল, ফ্রন্টলাইন স্বাস্থ্য কর্মীরা টিকা পাচ্ছিলেন, বয়স্ক মানুষেরাও পেতে শুরু করেছিলেন, আচমকা সরকারের মনে হল তাতে গতি আনতে হবে। সেই দুর্বার গতির নেশায় কেউ টিকার চাহিদা আর জোগানের হিসাব কষে দেখেননি। অচিরেই সিরাম ইনস্টিটিউট এবং ভারত বায়োটেক দুটি উৎপাদন কেন্দ্রই টিকার জোগান দিতে অক্ষম হয়ে পড়ল। ভারত তখন প্রথমেই রফতানি বন্ধ করল, যার ফলে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন তাদের বকেয়া টিকার জোগান না পেয়ে সিরাম ইনস্টিটিউট-এর বিরুদ্ধে 'ব্রিচ অফ কন্ট্রাক্ট'-এর অভিযোগে আদালতে বিপুল পরিমাণ ক্ষতিপূরণ দাবি করে বসে। এদিকে সিরাম ইনস্টিটিউট বল ঠেলে দেয় আমেরিকার কোর্টে, দাবি করে যে আমেরিকা ওষুধের কাঁচামাল না সরবরাহ করার কারণেই এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
এইবার শুরু হল ভারত আমেরিকার দড়ি টানাটানি। একদিকে আমেরিকার নব নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট, যিনি তাঁর পূর্ববর্তীর সমস্ত অবৈজ্ঞানিক ও জনমোহিনী নীতির বিরুদ্ধে কাজ করবেন বলে দেশের মানুষের কাছে প্রতিজ্ঞা করেছেন। প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পরই তিনি ফিরিয়ে এনেছেন পুরনো ট্রাম্প জমানায় বাতিল হয়ে যাওয়া 'ডিফেন্স প্রোডাকশন অ্যাক্ট' (ডিপিএ), যাতে টিকাকরণের ব্যাপারে সর্বশক্তি নিয়ে তিনি ঝাঁপাতে পারেন। প্রথম ১০০ দিনের আগেই তাঁর ২০০ মিলিয়ন ডোজের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়ে গিয়েছিল। এছাড়াও তিনি দেশের মানুষের জন্য ৩০০ মিলিয়ন অতিরিক্ত ডোজ প্রস্তুত রেখেছেন। টিকা রফতানিতে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে ডিপিএ। ওই আইনে টিকা রফতানি করা যাবে না। তাই কানাডা এবং মেক্সিকোকে আমেরিকা যে টিকা দিয়েছে তা দেখানো হয়েছে লোন হিসাবে।
এর মধ্যেই করোনার নতুন ব্রিটিশ প্রজাতি আমেরিকার ২০ বছর থেকে ৫০ বছরের বয়স্কদের মধ্যে দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। মিনেসোটা থেকে নিউ জার্সি হয়ে নর্থ ক্যারোলিনা পর্যন্ত এক বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে আমেরিকার তরুণ প্রজন্মের মধ্যে বেড়ে যায় করোনার প্রকোপ ও হাসপাতালে ভর্তি হওয়া। এই অবস্থায় আমেরিকা ভারতকে ওষুধের কাঁচামাল পাঠাতে অস্বীকার করে। অন্যদিকে বিজেপি নেতৃত্ব আমেরিকার এই 'না'-কে রাজনৈতিক ফায়দা লোটার উদ্দেশ্যে সম্পূর্ণ ভুল পথে প্রচার করে এবং জনগণকে গেলাতে শুরু করে। ব্যাপারটা এমন জায়গায় চলে যায় যে চিনের ইংরেজি দৈনিক 'গ্লোবাল টাইমস' তাদের সম্পাদকীয় স্তম্ভে ভারতকে আমেরিকার সঙ্গ ত্যাগ করে বেজিং'এর হাত ধরার পরামর্শ দেয়। রাশিয়াও ভারতকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। এরপর ভারতের মৃত্যুর হার লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে- সেই সংবাদ প্রকাশিত হয় আমেরিকান মিডিয়ায়। গণচিতার ছবি প্রকাশিত হলে নড়েচড়ে বসে বিডেন প্রশাসন। ভারত সরকার বলতে শুরু করে- আমেরিকা না সাহায্য করার ফলে আজ এই অবস্থা। ভারতের অবস্থান বিশ্বের দরবারে আমেরিকাকে বিপদে ফেলতে পারে বুঝে শেষ পর্যন্ত আমেরিকার নিরাপত্তা সচিব টুইট করে জানান ভারত সাহায্য পাচ্ছে। কাঁচামাল, টেস্ট কিট সহ একাধিক অন্যান্য কোভিডে ব্যবহৃত হয় এমন সামগ্রী আসবে আমেরিকা থেকে। এছাড়াও হায়দ্রাবাদের বায়োলজিক্যাল ই লিমিটেড কোম্পানিতে নতুন টিকা উৎপাদনের জন্য যাবতীয় প্রযুক্তি ও কাঁচামাল জোগাবে আমেরিকা। এই কোম্পানিটি ২০২২ সালের মধ্যে উৎপাদন শুরু করবে। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জানিয়েছেন ভারতের টিকা উৎপাদন সংক্রান্ত প্রযুক্তিতে সব রকম সাহায্য করবে তাঁরা।
এখন প্রশ্ন উঠছে যে, ভারতকে কি বারবার এই মৃতদেহের সারি প্রদর্শন করে বিদেশি সাহায্য পেতে হবে? আমাদের দেশের নেতারা আর কবে জনস্বাস্থ্যের দিকে নজর দেবেন! সারা পৃথিবীর কাছে আজ স্পষ্ট হয়ে গেছে যে মোদি সরকারের নানাবিধ অপরিণামদর্শিতার ফলেই আজ ভারতের কোভিড পরিস্থিতির এত অবনতি। বিশ্বের বেশ কয়েকটি নামকরা সংবাদপত্র এই বিষয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী মোদিকে এই অবস্থার জন্য দায়ী করেছে। তাদের মধ্যে রয়েছে 'কোয়াড' দেশভুক্ত অস্ট্রেলিয়া থেকে প্রকাশিত 'দ্য অস্ট্রেলিয়া'। অবস্থা এমন যে ক্যানবেরায় অবস্থিত ভারতীয় দূতাবাস থেকে প্রতিবাদপত্র পাঠানো হয়েছে পত্রিকার দফতরে।
টিকার 'বিশ্বগুরু'র দেশের প্রধানমন্ত্রী, যখন মানুষের মৃত্যু মিছিল চলছি তখন বিভিন্ন রাজ্যের ভোট প্রচারে নিজেকে ব্যস্ত রেখেছিলেন, লক্ষাধিক মানুষ যখন কুম্ভ মেলায় জড়ো হচ্ছেন তখনও তিনি ছিলেন নির্বিকার। গঙ্গা স্নান করোনা দূর করে দেবে এই ছিল হিন্দুত্ববাদীদের প্রচার। শেষে কুম্ভ মেলায় যখন করোনা হু হু করে বাড়তে শুরু করল তখন তিনি রাশ টানলেন, ভাগ্যিস!
অক্সিজেনের আকাল আর করোনার যুগলবন্দীতে দিল্লি মৃত্যু উপত্যকার চেহারা নিয়েছে। 'টাইম' ম্যাগাজিনে প্রচ্ছদ হয়েছে গণচিতার ছবি। সারা পৃথিবীর মানুষ দেখছেন সেই ছবি। এবার তো আর আমেরিকার ঘাড়ে দোষ দেওয়া যাবে না। কী করবেন এবার টিকার 'বিশ্বগুরু'? কার কোর্টে বল ফেলে পাশ কাটাবেন তিনি? এখনও টনক নড়েনি, এরই মধ্যে চলছে সেন্ট্রাল ভিস্তার কাজ। এতটা অমানবিক হওয়া 'মউত কা সওদাগর'কেই মানায়।
তথ্যসমৃদ্ধ সঠিক দিকনির্দেশক বিশ্লেষণ। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হওয়া আর সত্যিই জনকল্যাণমূলক কাজ করা, দুটোর পার্থক্য চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া হয়েছে।
ReplyDeleteভালো লাগলো,
ReplyDeleteমোদি সরকার জনগণের শত্রু
নানান খেলায় মত্ত এরা
মানুষকে বুঝে নিতে হবে জীবনের বিনিময়ে।
বিশ্বগরু এবার মৌন হবেন
ReplyDelete