Wednesday 19 May 2021

প্রতিহিংসার রাজনীতি

আইন কি সত্যিই আইনের পথে?

প্রবুদ্ধ বাগচী 


রাজনৈতিক দল, নেতা, চক্রান্ত, ষড়যন্ত্র, প্রতিহিংসা, সমর্থকদের বিক্ষোভ সব ছেড়ে দিন। আইন আইনের পথে চলবে সবাই বলছেন। ঠিকই তো। কিন্তু সত্যিই কি আইন আইনের পথে চলছে ? 

ব্যাঙ্কশাল কোর্টের বিশেষ সিবিআই আদালতে সিবিআই কৌসুলি বললেন, তাঁরা চারজনকে গ্রেফতার করেছেন, তাঁরা চান ভার্চুয়াল শুনানি হোক। অভিযুক্ত পক্ষের আইনজীবীরা তাতে সম্মতি দিয়েছেন। এই যৌথ সম্মতির ভিত্তিতে আদালত শুনানি স্থির করল এবং ভার্চুয়াল শুনানিতে মামলা শুনল। জামিন হল। তখন সন্ধ্যে সাড়ে ছটা। আদেশনামার কপি পেতে আজকাল সময় লাগে না। জামিনের বন্ড তৈরি হল সাতটা পনেরোয়। তারপর ‘আসামী’দের ছেড়ে দেওয়া যেত। অথচ তাদের ছাড়া হল না। কেন? জামিন হয়ে যাওয়া আসামীকে এক মিনিটও কাস্টডিতে রাখা বেআইনি। বলা হল, হাইকোর্টে আপিল করা হচ্ছে। আপিল করা মানে তা অনুমোদন পাওয়া নয়। তাই এই আটক আবারও দেশের আইন লঙ্ঘন। যারা আপিল করলেন তাঁরা জানলেন কী করে আপিল গ্রাহ্য হবে এবং তাদের পক্ষে যাবে? 

আসলে কী হল? ব্যাঙ্কশাল কোর্টের সিবিআই আদালতে যখন শুনানির প্রস্তুতি হচ্ছে তখনই তার পাশাপাশি সিবিআই দিল্লিতে জানিয়ে দিয়েছে তাদের অফিসে মুখ্যমন্ত্রী এসে বসে আছেন, বাইরে সমর্থকরা বিক্ষোভ করছে। এটা হাইকোর্টকে জানানো হোক। আপাত ভাবে হাইকোর্ট জানিয়ে দেয় এটা প্রশাসনিক বিষয়, এখানে তাদের কিছু করার নেই। খেয়াল করতে হবে, ব্যাঙ্কশাল কোর্টে ভার্চুয়াল শুনানির সময় সিবিআই এই বিক্ষোভ বা মুখ্যমন্ত্রীর উপস্থিতির কথা কোর্টকে জানায়নি। তাছাড়া এখানে ভার্চুয়াল শুনানি হওয়ায় কোনটাকে কোর্ট-রুম ধরা হবে? নিজাম প্যালেসের অফিস না ব্যাঙ্কশাল কোর্টের আদালত কক্ষ? সেটা স্পষ্ট নয়। তবে আইন অনুযায়ী শুনানির সময় যে কোনও নাগরিক কোর্ট-রুমে উপস্থিত থাকতে পারেন, যদি না বিচারক কোনও বিশেষ নির্দেশ দেন। এ ক্ষেত্রে মাননীয় বিচারক অনুপম মুখোপাধ্যায় তেমন কোনও নির্দেশ দেননি। 

সমস্যা হল পরে। যখন জামিন পেয়ে গেলেন অভিযুক্তরা। কার্যত নজিরবিহীন ভাবে দুটো কোর্টে প্রায় সমান্তরালভাবে চেষ্টা চালানো হচ্ছিল। নিম্ন আদালতে হারের পর এইবার সক্রিয় হল দিল্লি। হাইকোর্টের বিচারপতিকে ইমেল করে বলা হল, বিক্ষোভ ও মুখ্যমন্ত্রীদের উপস্থিতির কথা এবং আবেদন করা হল এই ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়ার। এটা কোনও আইনি আবেদন নয়। রায় স্থগিত বা পুনরায় বিবেচনার আর্জি জানালে আগের রায়ের কপি ও আবেদনকারীর বক্তব্য হলফনামা হিসেবে দিতে হয়। একটাও দেওয়া হল না। বিক্ষোভ জনিত কারণে যে মামলা চালানো যাচ্ছে না, এই নিয়ে কোনও প্রমাণ বা সাক্ষ্য হাজির করা হল না, শুধু উল্লেখ করা হল মিডিয়ার কথা। এবং এই বিক্ষোভ যে আগের রায়ের ক্ষেত্রে সুবিচার করতে পারেনি, এটাও বলা হল না। বলা হবে কী করে? সেটা তো তাঁরা ব্যাঙ্কশাল কোর্টে বলেইনি। এমনকি পাশাপাশি যে হাইকোর্টে আবেদন করা হচ্ছে, তাও অভিযুক্ত পক্ষকে জানানো হয়নি। উপযুক্ত সময়ে জানালে বিরুদ্ধ পক্ষ তাদের অবস্থান জানানোর সুযোগ পেতেন। জানা যাচ্ছে, হাইকোর্টে এই কেস মেনশন করা হয়েছিল বেলা দুটোয়, শুনানির জন্য সময় দেওয়া হয় ছটায়। সাতটা পঁয়তাল্লিশ অবধি তার শুনানি হয়। রায় হয় দশটা পাঁচে। এই সময় অভিযুক্ত পক্ষকে কিছু জানানো হয়নি। 

বিস্ময়টা অন্য জায়গায়। এটা তো বুঝতে অসুবিধে নেই যে যেনতেন প্রকারে অভিযুক্তদের জেলে পাঠানোই ছিল সিবিআই'এর উদ্দেশ্য। কারণ, তদন্ত শেষ হয়ে যাওয়ায় তারা নিজেদের হেফাজতে চায়নি। কিন্তু একটা ইমেলে জানানো আবেদন যার সঙ্গে কোনও হলফনামা নেই, আগের রায়ের কপি নেই, অভিযুক্ত পক্ষের পাল্টা হলফনামা নেই, সেই অবস্থায় সাময়িক একটা স্থগিতাদেশ হয়ে গেল? মাননীয় বিচারপতিরা বিপরীত পক্ষের বক্তব্য শোনাটা দরকার বলে মনে করলেন না? অথচ এই সেদিন অর্ণব গোস্বামী বনাম মহারাষ্ট্র সরকার মামলায় (২০২০) সুপ্রিম কোর্ট পরিষ্কার করে বলে দিয়েছিল, জামিন দেওয়া বা না-দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিটি সাংবিধানিক আদালতকে খুব গভীরভাবে বিবেচনা করে দেখতে হবে অভিযুক্তের জীবন ও স্বাধীনতার অধিকার রক্ষিত হচ্ছে কি না। গভীর রাতের রায় উচ্চতম আদালতের এই পর্যবেক্ষণকেও কি অন্ধকারে ঢেকে দিল?

এবং সেই একই অভিসন্ধিমূলক ধারা বজায় রেখে আজ বুধবারও নানান টালবাহানা করে মামলা অযথা প্রলম্বিত হল এবং অভিযুক্তদের জামিনের আবেদন বিচার পেল না। সিবিআই এখন প্রস্তুতি নিচ্ছে, যাতে অসুস্থ অভিযুক্তরা হাসপাতালেও না যেতে পারেন। সে কারণে তারা আলাদা মেডিকেল বোর্ড গঠনের উদ্যোগ নিচ্ছে। শুধুমাত্র একটি নির্বাচনে বিপুল পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে আরএসএস-বিজেপি যেভাবে সদ্য গঠিত মন্ত্রীসভার গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীদের কাজ করতে না দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের মানুষের বিরুদ্ধে এই করোনা পরিস্থিতিতে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে, তা ইতিহাসের পাতায় একটি নৃশংসতম ঘটনা হিসেবে লিপিবদ্ধ থাকবে। বিজেপি'র নেতা ও সমর্থকেরা কি মানুষের সামনে এবার মুখ দেখাতে পারবে? অবশ্য, ফ্যাসিস্তরা চরিত্রগত ভাবে খুবই নির্বিকার হয়!

আদালতের রায়ের লিঙ্ক দেখুন:

1) https://smallpdf.com/shared#st=35c83b46-452a-4d9f-abf9-f6a0ec510403&fn=bail+order-images.zip&ct=1621355128467&tl=extract&rf=link

2) https://smallpdf.com/shared#st=11781233-4514-41db-a965-634743b16a53&fn=CBI+HC+order-images.zip&ct=1621355224802&tl=extract&rf=link

ঋণ: সুপ্রিম কোর্টের বিশিষ্ট  ইন্দিরা জয়সিংহের নিবন্ধ Raising an Alarm- This is not Procedure Established by Law.

লিঙ্ক: https://www.theleaflet.in/raising-an-alarm-this-is-not-procedure-established-by-law/


4 comments:

  1. এক ঘৃণ্য চক্রান্ত।ইতিহাস ক্ষমা করবেনা

    ReplyDelete
  2. বিজেপি দলটির প্রতি রাগ নয়, ক্ষোভ নয়, মনে বিবমিষা তৈরি হয়। হারের জ্বালা মেটাতে এরা কত নীচে নামতে পারে তার নমুনা।আর আইনের কি অপার রহস্য,সত্যিই বোঝা দায়। সবই আসলে কার্য কারণের সম্পর্ক, এর পর লোকে আইন আইনের পথে চলছে শুনে হাসবেন

    ReplyDelete
  3. খুব ভাল লেখা । 👌🏼

    • হাইকোর্ট এর বিচারপতি যে রায় দিয়েছেন সেটা একেবারে বেআইনি । এর জন্য ওনার শাস্তি হওয়া উচিত । আর সিবিআই হলো "খাঁচার তোতাপাখি"-- এটা একটা মিষ্টি মিষ্টি কথা; তার বদলে বলা উচিত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের পোষা ডোবারম্যান যেন । যে পদ্ধতিতে ওনারা এই কোভিড পরিস্থিতিতে চারজনকে অ্যারেস্ট করতে গিয়েছেন সেই পদ্ধতিটাও ঠিক নয়, বেআইনিভাবে অ্যারেস্ট করেছেন এরা ওই চারজন ঘুষখোর জনপ্রতিনিধিদেরকে । সিবিআই-এর লোকদেরও শাস্তি হওয়া উচিত ।

    ReplyDelete
  4. যথার্থ লিখেছেন।

    ReplyDelete