করোনার কালবেলায়
শোভনলাল চক্রবর্তী
বিজ্ঞান বলতে পথ চলতি মানুষ যা বোঝেন, বিজ্ঞানের পরিসর তা অপেক্ষা অনেক অনেক বড়। সত্যিই বিজ্ঞানের সীমা অসীমে। তবে ভাবতে অবাক লাগে যে 'সীমার মাঝে অসীম' শব্দবন্ধ কোনও বিজ্ঞানীর নয়, আমরা পেয়েছি এক কবির কলমে। বিজ্ঞান আমাদের সীমার মাঝে অসীমের ধারণা দেখিয়েছে গণিতের 'কেওস থিওরি'র মেন্ডেলব্রট সেট-এ, কখ কার্ভে। তবে সে সবই সাধারণের নাগালের বাইরে।
বিজ্ঞান বলতে আজকের বিজ্ঞানীরা যার সাধনা করছেন তা 'বিগ সায়েন্স'-এর অন্তর্গত। যেখানে কর্পোরেট পুঁজি তার বিপুল বৈভব ঢেলে দিয়েছে বিজ্ঞানের গবেষণায়। না, বিজ্ঞানের জন্য নয়, তার নিজ স্বার্থ পূরণে। এই 'বিগ সায়েন্স'-এর বিশাল গবেষণাগারে চলছে ঘোড়দৌড়, কে আগে জিততে পারে রেস। এমনটা আমরা এই করোনা ভ্যাকসিনের ব্যাপারেও দেখলাম। অক্সফোর্ডের সেই মহিলা বিজ্ঞানীর নাম (সারাহ গিলবার্ট) আজ চলে গেছে অন্তরালে। তাঁর জায়গা নিয়েছে কয়েকটি জগৎ বিখ্যাত ওষুধ কোম্পানির নাম। সেইগুলোই আমরা রোজ চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি। এই হচ্ছে 'বিগ সায়েন্স'-এর নীতি। আমরা পয়সা দিয়েছি, তোমাকে গবেষণার পরিবেশ, পরিকাঠামো দিয়েছি, তার বিনিময়ে আমরা ফল চাই, খুব দ্রুত, সবার আগে। তা দিতে পেরেছ, খুব ভালো; এই নাও তোমার টাকার থলে, টা টা বাই বাই, আবার যদি দরকার হয় তোমাকে নিশ্চয় ডেকে আনব।
প্রশ্ন হচ্ছে, এই ভাবে কি বিজ্ঞান পৌঁছতে পারবে তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে? সবাই বলবেন, কেন, ক্ষতিটা কী? এই যে ভ্যাকসিন রেস হল, তাতে মানুষের কাছে ভ্যাকসিন কত তাড়াতাড়ি চলে এল, কত মানুষ দুনিয়া জুড়ে ভ্যাকসিন পেলেন, এসবই তো বিজ্ঞানের দান। আর কী চাই? এরপরেও থেকে যাচ্ছে প্রশ্ন। প্রশ্নটা বিজ্ঞানের একবারে গোড়ার। তা হচ্ছে এই যে- বিজ্ঞানের দর্শন কী হওয়া উচিত?
বিজ্ঞান চর্চার গোড়ার দিকে যদি আমরা একটু পিছন ফিরে তাকাই, তবে দেখব বিভিন্ন দেশের রাজন্যবর্গের অর্থ আনুকূল্যে বিজ্ঞানীরা কাজ করেছেন। সেই কাজ ছিল জনহিতকর। এবং সেই সময়ে যখন যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল দুর্বল, তা সত্ত্বেও বিজ্ঞান অনেকটাই সফলতা পেয়েছিল কোনও নির্দিষ্ট দেশের বেড়াজাল ভেঙে আন্তর্জাতিক হয়ে উঠতে। বিজ্ঞানের সুফল সবাই উপভোগ করবেন, কোনও নির্দিষ্ট কেউ নয়, এটা ছিল প্রায় স্বতঃসিদ্ধ। বিজ্ঞান যখন গুটি গুটি পায়ে এসে উনিশ শতকের গোড়ায় পৌঁছল তখন একটা সমস্যা তৈরি হল। সমস্যাটাকে অনেকে 'বিজ্ঞানের বিস্ফোরণ' (এক্সপ্লোশন অফ সায়েন্স) বলেছেন। উনিশ শতকের প্রথম তিন দশকে বিজ্ঞানের অগ্রগতি ছাপিয়ে গেল বিজ্ঞানের বিগত সাড়ে চারশো বছরের অবদানকে। বিজ্ঞানের এই বিপুল বেগের অগ্রগতি অনেক পুরনো ধ্যান-ধারণাকে তছনছ করে দিল। বিজ্ঞানের অপার সম্ভাবনা এই সময়ে মানুষের মনে বিজ্ঞান সম্বন্ধে ধারণার এক মৌলিক বদল আনতে শুরু করল। এই বদল সম্পর্কে বিজ্ঞানের পুরোধা পুরুষদের অনেকেই অবগত ছিলেন। এই সময়ে বিজ্ঞানের দর্শনের একটা নতুন ভাবনা শুরু হয় যেটা পূর্ববর্তী পাশ্চাত্যের 'আলোকিত কাল' (ওয়েস্টার্ন এনলাইটমেন্ট)-এর দর্শন অপেক্ষা সম্পূর্ণ ভিন্ন।
এই নতুন দর্শন কী হতে পারে তা নিয়ে লেখালেখির শুরু আধুনিক পদার্থবিদ্যার জনক জার্মান বিজ্ঞানী ম্যাক্স প্ল্যাঙ্কের হাত ধরে। তারপর হাইজেনবার্গ, ম্যাক্স বর্ন, শ্রয়ডিংআর এবং সর্বোপরি আইনস্টাইন এই বিষয়ে আলোকপাত করেন। এঁদের সবার আলোচনাতেই প্রকৃতি (নেচার) এক নতুন সমস্যা নিয়ে হাজির হল। প্রকৃতিকে ব্যাখ্যা করাই যে বিজ্ঞানের লক্ষ্য এ বিষয়ে কারও মনে কোনও সংশয় ছিল না। কিন্তু উনিশ শতকের গোড়ায় বিজ্ঞানীরা সংশয় প্রকাশ করে বলছেন যে, বিজ্ঞান যখন প্রকৃতিকে প্রায় পুরোটাই ব্যাখ্যা করে ফেলেছে তখন বিজ্ঞান তার সামনে কী রেখে এগোবে? এই সময়ে অনেকেই তখন বিজ্ঞানকে নিয়ে এনে ফেললেন মনোজগতে, আধ্যাত্মিক জগতে। বিজ্ঞানের মূল যে লক্ষ্য- সত্যের সন্ধান, তা এই সময়ে যুক্ত হয়ে গেল আধ্যাত্মিক সত্যের সঙ্গে। এক ঝাঁক বিজ্ঞানী শুরু করলেন সংস্কৃত চর্চা। পড়ে ফেললেন উপনিষদ, বেদ। অতএব, প্রকৃতি তখন বিজ্ঞানের কাছে আর অদৃশ্যের হাতছানি নয়।
ক্রিস্টোফার কডওয়েল তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ 'দ্য ক্রাইসিস ইন ফিজিক্স' (১৯৩৯) গ্রন্থে প্রথম তুলে ধরলেন একটি মূর্ত সমস্যা। তিনি বললেন, নিলস বোর থেকে শুরু করে আইনস্টাইন হয়ে এডিংটন পর্যন্ত যে বিজ্ঞানীর দল বিজ্ঞানকে প্রকৃতি থেকে বিচ্যুত করে দেখছেন, তাঁরা এক নতুন সমস্যা তৈরি করছেন। কডওয়েল মূলত দুটি গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ উত্থাপন করলেন। প্রথমত, তিনি বললেন যে আধুনিক পদার্থবিদ্যার বিজ্ঞানীরা যে স্বাধীন মুক্তচিন্তা (ফ্রি উইল) এবং পরিণামবাদের (ডিটারমিনিজম) কথা বলছেন, তা নতুন কিছু নয়। ডেকার্ত, লাপ্লার মতো বিজ্ঞানীরা বহু বছর আগে এই সব প্রশ্ন তাঁদের রচনায় তুলেছিলেন। দ্বিতীয়ত, কডওয়েল বললেন যে বিজ্ঞানকে যদি প্রকৃতি থেকে বিচ্যুত করে ফেলা হয়, অচিরেই তা বিজ্ঞানকে বিপথগামী করে তুলবে। হলও তাই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে বিজ্ঞানের সঙ্গে হাত মেলালো প্রযুক্তি। বিশ্বের তাবড় রাষ্ট্রনায়করা ততদিনে অবগত হয়ে গেছেন বিজ্ঞানের শক্তি সম্পর্কে, তাকে চালনা করার দায়িত্ব নিয়ে ফেললেন তাঁরা। দিকে দিকে বিজ্ঞান প্রযুক্তির মেলবন্ধনে তৈরি হতে লাগল মারণাস্ত্র। মানুষের হাতেই তৈরি হতে শুরু হল গণহত্যার জন্য উপযোগী যুদ্ধ সরঞ্জাম। আমেরিকার 'ম্যানহাটন প্রজেক্ট' যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এটম বোমা তৈরি প্রকল্পে এক সঙ্গে যত বিজ্ঞানী, যত প্রযুক্তিবিদ, যত সাধারণ কর্মী কাজ করেছেন, তার তুলনা ইতিহাসে বিরল। ততদিনে রাষ্ট্রনায়করা বিজ্ঞানের ওপর এতটাই অধিকার কায়েম করে ফেলেছেন যে এটম বোমা তৈরি রদ করার জন্য আমেরিকার প্রেসিডেন্টকে লেখা খোদ আইনস্টাইনের চিঠি চলে গেছে ডাস্টবিনে। এটম বোমার ভয়াবহতা সাধারণ মানুষের মনে বিজ্ঞান সম্পর্কে এমন এক সমীহ জাগিয়ে তুলল যা পরবর্তীতে মানুষকে বিজ্ঞানমনস্কতা থেকে ক্রমশ দূরে ঠেলেছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে (১৯৪৫) মানুষের মনে প্রশ্ন উঠে গেল, বিজ্ঞান আশীর্বাদ না অভিশাপ? তৈরি হয়ে গেল বিজ্ঞানের নতুন দর্শন। অতঃপর, বিজ্ঞানের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়াল প্রকৃতিকে জয় করা। এই সন্ধিক্ষণে বিজ্ঞানের দর্শনে বিরাট ভুল করে ফেলেছিল মানুষ, তা আজ আমরা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। এর পরের দশকগুলি জুড়ে বিজ্ঞান ঝাঁপিয়ে পড়ল প্রকৃতি জয়ের লক্ষ্যে, সঙ্গে রইল তার দোসর প্রযুক্তি। জল, স্থল, অন্তরীক্ষ কোথাও বাদ থাকল না। প্রকৃতিকে নিংড়ে নেওয়ার সমস্ত আয়োজন সম্পূর্ণ হল। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে কেউ কেউ দু-একটি ঘটনার দিকে মানুষের নজর ফেরাবার চেষ্টা করলেন। তাঁরা প্রশ্ন তুললেন, কেন এমন হল যে একটি নদীতে বাঁধ দেওয়ার এক দশক পর দেখা গেল নদী তার গতিপথ বদল করেছে। বাঁধ দাঁড়িয়ে আছে শূন্য বালুচরে। তাহলে কি প্রকৃতির নিজস্ব এক প্রতিরোধ ব্যবস্থা আছে? সেই যে চর্চা শুরু হল, আজ তা শিখরে।
করোনার কালবেলায় আজ বিজ্ঞানী থেকে সাধারণ মানুষ সবাই বলছেন যে এ সবই প্রকৃতির প্রতিশোধ। এক ভাইরাস গৃহবন্দী করে ফেলেছে প্রকৃতির উপর জয় ছিনিয়ে নিতে উদ্যত মানুষকে। এবার কি তাহলে বদলাবে বিজ্ঞানের দর্শন! প্রকৃতিকে জয় নয়, প্রকৃতিকে প্রসারিত হতে সাহায্য করুক বিজ্ঞান। মানুষ তার সুখের সন্ধানে প্রকৃতিকে শোষণ করেছে, মাত্রাহীন করে ফেলেছে দূষণ। আজ সে এক ভীষণ দূষণ চক্রের মধ্যে পড়ে গেছে, যেখান থেকে বেরিয়ে আসা খুব সহজ নয়। জল, স্থল, অন্তরীক্ষ সব জায়গা থেকে এই দূষণের চিন্হ মুছে ফেলে প্রকৃতিকে ফিরিয়ে আনতে হবে তার আগের জায়গায়। প্রকৃতিকে আগে সম্মান করা শিখতে হবে। ভুললে চলবে না, সারা পৃথিবীর মোট ভরে, মানুষের ভরের চেয়ে বেশি ভর পিঁপড়েদের !
চমৎকার লেখা। বহুদিন এমন লেখা পড়ি নি। তবে মার্কসের সমাজ বিজ্ঞানের ইতিহাস ব’লে পুঁজির উদ্ভবের হাত ধরেই আসে পুঁজিবাদি ব্যবস্হা। এই ব্যবস্থা সবকিছুকেই পণ্য হিসাবে দেখে। মুনাফার দিকেই পুঁজিবাদের চলন। বিজ্ঞানের জ্ঞানে বলীয়ান হয়ে প্রযুক্তি মানুষের শ্রম লাঘব করতে গিয়ে মানুষকেই এই পৃথিবীতে উদ্বৃত্ত বর্জ্য করে ফেলেছে। পুঁজিবাদের মোহময় ভোগবাদী দর্শনের বিপরীতে একটি সমাজ-প্রকৃতি-প্রেমী দর্শন নির্মাণ ও তার ফলিত প্রয়োগ ব্যতীত প্রকৃতির ধ্বংস ও সেই সঙ্গে মানব সমাজের ধ্বংস অনিবার্য।
ReplyDeleteখুব সুন্দর একটি লেখা পড়লাম।
ReplyDeleteঅনেক দিন পর এই সুন্দর লেখা পড়লাম. অনেক কিছু জানতে পারলাম.
ReplyDelete