রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তি চাই
সোমনাথ গুহ
করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের দাপট জেলবন্দীদের জীবন আরও বিভীষিকাময় করে তুলেছে। এমনিতেই আমাদের দেশের জেলগুলিতে মাত্রাতিরিক্ত ভিড়। ২০১৮'র ‘ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরো’র তথ্য অনুযায়ী, বন্দীর সংখ্যা ৪.৫ লক্ষ যা জেলগুলিতে যত জায়গা আছে তার তুলনায় ১৭.৫ শতাংশ বেশি। যেমন, উত্তরপ্রদেশের জেলে জায়গা আছে ৫৮৯১৪'এর জন্য কিন্তু বাস্তবে আছেন ১০৪০১১। মহারাষ্ট্রে জায়গা আছে ২৪০৩২ জনের কিন্তু বাস্তবে বন্দী আছেন ৩৬১৯৫, দিল্লিতে ১০০০০'এর জায়গায় আছেন ১৮০০০। এই মাত্রাতিরিক্ত ভিড়ে করোনা সুরক্ষা বিধি মেনে চলার কোনও পরিস্থিতিই নেই, তথাকথিত ‘দো গজ কি দুরি’ হাস্যকর। খুব স্বাভাবিক ভাবেই কোভিড দ্রুত ছড়াচ্ছে। বেশির ভাগ বন্দীদেরই কোনও চিকিৎসা হচ্ছে না। ইউএপিএ বা রাষ্ট্রদ্রোহী কোনও আইনে অভিযুক্ত হলে তো সঠিক চিকিৎসা পাওয়ার তাঁর কোনও সুযোগই নেই। একমাত্র আত্মীয়স্বজন, আইনজীবীরা চ্যাঁচামেচি করলে বা মিডিয়ায় হৈচৈ হলে কদাচিৎ কাউকে হাসপাতালে ভর্তি করা হচ্ছে।
গত বছর জুলাই মাসে গুয়াহাটির জেলে কৃষক নেতা অখিল গগৈই কোভিডে আক্রান্ত হয়েছিলেন। তাঁর স্ত্রী ফেসবুকে লেখেন যে তিনি সংবাদপত্রের রিপোর্ট থেকে স্বামীর অসুস্থতার কথা জানতে পারেন কিন্তু তাঁর বিস্তারিত শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে কোনও ধারণা নেই। গগৈ'এর আইনজীবীরা এনআইএ'র আদালতে তাঁদের মক্কেলকে হাসপাতালে ভর্তি করার জন্য পিটিশন করেন। আদালত আদেশ জারি করার পর তাঁকে গুয়াহাটি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়।
তো এই হচ্ছে অবস্থা। কোভিড হলেও চিকিৎসার জন্য বিচারাধীন বন্দীকে আদালতের শরণাপন্ন হতে হচ্ছে। এর সাথে আরও একটা সমস্যা প্রকটভাবে দেখা যাচ্ছে। কোনও বন্দীর বাড়ির লোকজন সংক্রামিত হলে তাঁদের দেখভাল করার জন্য সাময়িক জামিনের জন্য আবেদন করলে হয় তা নাকচ করা হচ্ছে নয় বিলম্বিত হচ্ছে। শাহীনবাগের অন্যতম সংগঠক ও ‘পিঁজরা তোড়’ সংগঠনের অ্যাক্টিভিস্ট নাতাশা নারওয়ালকে দিল্লিতে দাঙ্গা করার ভুয়ো অভিযোগে ইউএপিএ ধারায় ২০২০'র মে মাসে গ্রেফতার করা হয়। ইদানীং তাঁর বাবা ও ভাই কোভিড আক্রান্ত হন। নাতাশা জামিনের আবেদন করেন। শুনানি হওয়ার আগেই তাঁর পিতা ইহলোক ত্যাগ করেন। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে 'পিঁজরা তোড়' একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তি দেয়: 'কোভিডের এই মারাত্মক সময়ে জেলগুলো সব মৃত্যুফাঁদ। অনেকে অসুস্থ, যথাযথ চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত। অনেকের প্রিয়জন অসুস্থ এবং বন্দী থাকার দরুণ তাঁরা তাঁদের শুশ্রূষা করতে পারছেন না। এই অভুতপূর্ব সংকটের সময় রাষ্ট্র অন্তত বিচারাধীন বন্দীদের সাময়িক জামিন দেওয়ার কাজটুকু করতে পারে।'
কবিতা কৃষ্ণন (সিপিআইএমএল-লিবারেশন পলিটব্যুরো সদস্য) ট্যুইট করেন, এটা নির্মম ও এক ধরনের মানসিক বিকৃতি। এই অতিমারির সময় রাজনৈতিক বন্দীদের জেলে রাখা নির্যাতন ছাড়া কিছু নয়; তার ওপর এই সংকটের সময় তাঁদের সংক্রামিত প্রিয়জনদের থেকে দূরে রাখা নিষ্ঠুরতা। অধ্যাপক জিএন সাইবাবার কথা স্মরণ করুন যিনি মাওবাদী যোগের কারণে যাবজ্জীবন কারাবাসে দণ্ডিত। তিনি একজন বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষ, ৯০ শতাংশ শারীরিক ভাবে অক্ষম, হুইলচেয়ারে আবদ্ধ। তাঁর মা ক্যানসারের রুগী ছিলেন। গত জুলাই মাসে তিনি মা'র সাথে দেখা করার জন্য কয়েক দিনের জামিন চান; জামিন অগ্রাহ্য হয়। মা পয়লা আগস্ট প্রয়াত হন। মা'র শেষকৃত্যে উপস্থিত থাকার জন্য ৪ আগস্ট আবার তিনি জামিনের আবেদন করেন, আবার তা নাকচ করা হয়। দু'বারই হায়দ্রাবাদ পুলিশ জানায়, তাঁর কয়েক দিনের জন্য বাইরে আসাটাও বিপদজনক। একজন ৯০ শতাংশ শারীরিক অক্ষম মানুষ, তিনি যত বড় ‘সন্ত্রাসবাদী’ই হোন, আমরা তাঁর সম্পর্কে কথা বলছি! সরকার কত অমানবিক হতে পারে এবং ইউএপিএ আইনের কতটা অপব্যবহার হতে পারে এটা তাঁর উৎকৃষ্ট উদাহরণ।
করোনার প্রথম ঢেউয়ের সময় গত ২৩ মার্চ সুপ্রিম কোর্ট সংক্রমণ ঠেকানোর জন্য জেলগুলি খালি করার আদেশ দিয়েছিল। সেই সময় বিভিন্ন রাজ্যে বেশ কিছু বন্দীকে ব্যক্তিগত বন্ডের ভিত্তিতে জামিন দেওয়া হয়। ১৬ জুন ৩৭৫ জন বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব ভিমা কোরেগাঁও কেসে অভিযুক্তদের মুক্তির দাবি করেন। এঁদের মধ্যে ছিলেন আদুর গোপালকৃষ্ণান, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, নাসিরুদ্দিন শাহ, অমিতাভ ঘোষ, অরুন্ধতি রায়, শাবানা আজমি, হর্ষ মান্দার, জাভেদ আখতার এবং অন্যান্যরা। তখন অন্তত আটজন ষাটোর্ধ্ব এবং নানা ব্যাধিতে আক্রান্ত অধ্যাপক ও সমাজকর্মী মহারাষ্ট্রের জেলে বন্দী। এঁদের আবেদন সত্ত্বেও সুধা ভরদ্বাজ যিনি ডায়েবেটিস এবং হাইপারটেনশনের রুগী, তিনি দুবার স্বাস্থ্যের কারণে জামিনের আবেদন করেন এবং দুবারই তা অগ্রাহ্য করা হয়। সোমা সেন আরথিরাইটিসের রুগী, তাঁরও জামিনের আবেদন নাকচ হয়। উলটে বলা হয়, কোভিডকে অজুহাত করে এঁরা ছাড়া পাওয়ার চেষ্টা করছেন। শাহীনবাগের নেত্রী সফুরা জারগর যখন অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার কারণে জামিনের আবেদন করেছিলেন, তখন সরকারি উকিল যুক্তি দিয়েছিলেন যে এর আগে বহু বন্দিনীর কারাগারে গর্ভপাত হয়েছে, তাতে কোনও অসুবিধা নেই। পরে ওপরতলার কারও অঙ্গুলি হেলনে আদালত করুণা দেখায় এবং সফুরা জামিন পান।
একাশি বছরের বরেণ্য কবি ভারভারা রাও জেলে কোভিড আক্রান্ত হওয়া সত্ত্বেও তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে কর্তৃপক্ষ গড়িমসি করে। এর বিরুদ্ধে জনমত তৈরি হয়, পরিবার আবেদন করেন- কারাগারে ভারভারা রাওকে হত্যা করবেন না। কর্তৃপক্ষের টনক নড়ে। তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয় এবং সুস্থ হওয়ার পর পত্রপাঠ জেলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। কবির স্ত্রী হেমলতা অন্তত আটবার তাঁর জামিনের আবেদন করেছেন এবং প্রতিবারই তা নাকচ হয়েছে। অবশেষে ফেব্রুয়ারি মাসে কবি যখন প্রায় মুমূর্ষু তখন তাঁকে ছয় মাসের জন্য জামিন দেওয়া হয়।
করোনার প্রকোপ শুরু হওয়ার পর কারাগার খালি করার কথা বলা হয়, কিন্তু একই সাথে জানিয়ে দেওয়া হয় যে যাঁরা ইউএপিএ ধরনের বিশেষ আইনে অভিযুক্ত তাঁদের কোনও ছাড় দেওয়া হবে না। এই বছরও ৮ মে পুনরায় তাঁরা এই আদেশ দেন। কিন্তু এই আদেশেও নির্দিষ্ট করে উল্লেখ করা হয় যে ইউএপিএ, এনএসএ, সিডিশন অ্যাক্ট'এ ধৃত অভিযুক্তদের ক্ষেত্রে এই আদেশ প্রযোজ্য নয়। অধ্যাপক হ্যানি বাবু যিনি ভিমা কোরেগাঁও কেসে আরেকজন অভিযুক্ত, গুরুতর সংক্রমণের কারণে বাঁ চোখে প্রায় দৃষ্টি হারিয়ে ফেলেছেন। তাঁর পরিবার বারবার চিকিৎসার আবেদন করলেও কর্তৃপক্ষ তা উপেক্ষা করে। অবশেষে আইনজীবীরা চাপ সৃষ্টি করার পর তাঁকে মুম্বাইয়ের জে জে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
দিল্লি দাঙ্গায় অভিযুক্ত খালিদ সাইফির কোভিডের মতো উপসর্গ থাকা সত্ত্বেও তাঁকে হাসপাতালে নেওয়া দূর অস্ত, টেস্টও করা হয় না। তাঁর পরিবারের অভিযোগ, সময়-উর্ত্তীর্ণ প্যারাসিটামল দিয়ে তাঁর চিকিৎসা হয়। কাপ্পান সিদ্দিকি যিনি হাথরস কাণ্ডর ওপর খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে গ্রেফতার হয়েছিলেন, তাঁকে কোভিডে আক্রান্ত হওয়া সত্ত্বেও জেলে ফেলে রাখা হয়। পরিবার ও আইনজীবীদের চাপের ফলে তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে তাঁর স্ত্রী হাসপাতালে গিয়ে দেখেন তাঁর স্বামীকে বিছানার পায়ার সাথে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে।
হর্ষ মান্দারের অভিযোগ, অসমে ডিটেনশন সেন্টারে যাঁরা রয়েছেন তাঁদেরও কোভিড পরীক্ষা ও চিকিৎসা কিছুই হচ্ছে না। এই পরিস্থিতিতে ভিমা কোরেগাঁও কেসে ধৃতদের পরিবার মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রীর কাছে একটি চিঠিতে কোভিডের এই ভয়ঙ্কর প্রকোপের সময়ে তাঁদের জামিন দেওয়ার জন্য আবেদন করেছেন। মান্দার ইউএপিএ আইনে সাময়িক জামিনের ধারা যুক্ত করার আবেদন করেছেন। উমর খালিদের পিতা এস কিউ আর ইলিয়াস ইউএপিএ আইনটাই বাতিল করার দাবি করেছেন। বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠন কোভিডের এই মারাত্মক সংক্রমণের সময়ে সমস্ত রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তি দেওয়ার দাবি করেছেন। আসুন আমরা এঁদের সাথে গলা মেলাই।
একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অথচ স্বল্প আলোচিত বিষয়ে আপনি আলোকপাত করলেন। ধন্যবাদ আপনাকে। এই দাবি মানবিকতার দাবি, আমরা অবশ্যই থাকব।
ReplyDeleteVery important write up.congratulation to somnath Babu and ekak Matra
ReplyDeleteখুবই সময় উপযোগী লেখা। এ রাজ্যের জেলেগুলোর হাল কি তার উপর আলোকপাত করলে আরো ভাল হত।
ReplyDeleteকারাগারের ওপারের মানুষের সম্পর্কে মেইনস্ট্রিম এবং সোশ্যাল মিডিয়াও বিস্ময়কর রকম উদাসীন। ভাবটা এমন, কারাগারের এপারের আলো হাওয়ায় যারা দিন যাপন করছে মানব সভ্যতা তাদের জন্যই। সোমনাথ বাবু অত্যন্ত যত্নের সাথে রাজনৈতিক বন্দীদের সম্পর্কে তথ্যসমৃদ্ধ যাকিছু পরিবেশন করলেন তা প্রত্যেকের পড়া উচিত। সংবেদনশীলতার সার্চলাইট সর্বত্র পড়বে, এটাই কাম্য, এটাই সভ্যতা । লেখক সেই দিকেই ইঙ্গিত করেছেন।
ReplyDelete