Friday 14 May 2021

হন্তারক

পরাজয়-টিকা কপালে নিয়ে কোথায় তিনি!

প্রবুদ্ধ বাগচী


মাত্র কদিন আগেই তাঁর ছবি শোভা পাচ্ছিল পাড়ার মোড়ে মোড়ে। সংবাদপত্রের পাতায়। ওয়েবসাইট খোলার সঙ্গে সঙ্গে লাফিয়ে উঠছিল তাঁর করজোড় ছবি। 'আসল পরিবর্তন'। 'সোনার বাংলা'। নিজের চোখে দেখিনি তবে কানে শুনেছি, বিজ্ঞাপনের লাভের আশায় ‘গণশক্তি’ পত্রিকাও নাকি তাঁর পাতাজোড়া ছবি ছেপে দিয়েছিল। আপাতত এক সবুজ ঝড়ে সেইসব ফ্লেক্স, পোস্টা্‌র, পতাকা সব উড়ে কোথায় চলে গেছে কে জানে! নেট দুনিয়ায় শোনা যাচ্ছে, এখন কোভিডবিধি  ও আংশিক লকডাউনের নিয়ম সব থেকে বেশি নাকি মেনে চলা হচ্ছে তাঁর দলের পার্টি অফিসে। কিন্তু লকডাউনে তাঁর দলের আটকে যাওয়া আমাদের কাছে একদিকে যেমন ভাল অন্যদিকে আশঙ্কার। ভাল, কারণ তাদের ‘ডেলি প্যাসেঞ্জারি’ করা ও কোভিড-ছড়িয়ে-দেওয়া মন্ত্রী-সান্ত্রীরা আপাতত নিজেদের গোয়াল ঘরে গোমূত্র পান করে করোনার বিরুদ্ধে পাঙ্গা নেওয়ায় মশগুল। আপাতত ‘বঙ্গাল’ আর তাদের অগ্রাধিকার নয়, এমনকি রাজ্যের বিরোধী দলনেতার পদটিও তারা তাদের পাঁচ মাসের পুরনো সদস্যের হাতে অর্পণ করে বসে আছে। সাংসদ থেকে বিধায়কে যাদের ‘ডিমোশন’ হয়েছে তাঁরাও ‘মন চলো নিজ নিকেতনে’ বলে নয়া দিল্লির বাসভবনে ফিরে যেতেই আগ্রহী। 

কিন্তু খারাপ কথা এটাই, এই উগ্র আধিপত্যের দাপাদাপিতে তাঁরা এই রাজ্যকে বিপন্ন করেছেন কোভিডের বাড়তি আক্রমণে। অবশ্য বিপন্ন প্রায় সারা দেশ। সোনার উত্তরপ্রদেশে লাশ ভেসে যাচ্ছে যমুনার জলে। ভেসে চলেছে বিহারের গঙ্গায়। সোনার ত্রিপুরায় লকডাউন। কোনও রাজ্য স্বস্তিতে নেই। সারা দেশ জুড়ে মৃত্যুর মিছিল। চিকিৎসার বন্দোবস্ত হচ্ছে না প্রচুর প্রচুর মানুষের। অক্সিজেন পরিষেবা বিপর্যস্ত, ভ্যাক্সিন বাড়ন্ত । কিন্তু এই বিপর্যয়ের আবহে তিনি কই ? 

গত বছর প্রথম লকডাউন অভিজ্ঞতার গোড়া থেকেই তিনি টিভির পর্দা আলো করে উদ্ভাসিত হচ্ছিলেন, আমাদের মনে পড়ে। কোনওদিন হাততালির নিদান দিচ্ছেন, কোনওদিন বলছেন থালা বাজান, কোনওদিন আবার বলছেন ঘর অন্ধকার করে রাখুন। কোভিডের বিরুদ্ধে যুদ্ধ নাকি কুরুক্ষেত্রের মতো জাস্ট আঠারো দিনের মামলা! আপাতত তাঁকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না, তিনি কি নিভৃতবাসে গেছেন? জানা নেই কারওর। কিন্তু পাঁচ রাজ্যে নির্বাচন পর্ব মিটতেই ভ্যাক্সিন প্রাপকের সার্টিফিকেটে তিনি আবার ভেসে উঠেছেন তাঁর আপাতত-ব্যর্থ রবীন্দ্রনাথ-সম দাড়ি নিয়ে। রবীন্দ্রনাথ ধার করে বললে অন্যায় হয় না- তিনি কি শুধুই ছবি ? 

এসব লঘু প্রশ্ন ছেড়ে বরং চোখ রাখি কিছু ভিন্ন তথ্যে। বলতে পারেন, এও এক ছবি। গত বছর কোভিড মহামারী শুরু হওয়ার পর থেকে বিশ্ব জোড়া একটাই চাহিদা ছিল: ভ্যাক্সিন। তার পথে অন্তরায় থাকলেও বিশ্বের বিজ্ঞানীদের নিরলস চেষ্টায় সেই সোনার হরিণ হাতে এল আমাদের। বলা হল, বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমরাও নেমে পড়েছি জীবনদায়ী এই ভ্যাক্সিনের উৎপাদনে। রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা এর দায় নিতে পারত কি না জানি না, কিন্তু নির্বাচিত হল দুটি ভারতীয় বহুজাতিক। ঘটা করে জানুয়ারি মাস থেকে শুরু হল মানুষকে ভ্যাক্সিন দেওয়ার কাজ। কীভাবে ভ্যাক্সিন দেওয়া হবে, কোন পদ্ধতিতে দেওয়া হবে, গোড়া থেকেই সে নিয়ে গভীর রহস্য। কারণ নভেম্বরে (২০২০) বিহারের ভোটে বলা হয়েছিল, ভোটে জিতে এলে নাকি রাজ্যের সবাই বিনামূল্যে ভ্যাক্সিন পাবেন। কিন্তু এরপরে কোথাও স্পষ্ট করে বলা হয়নি সরকারের ভ্যাক্সিন নীতি ঠিক কী? কেন্দ্রের বাজেটে ভ্যাক্সিনের জন্য একটা অর্থ বরাদ্দ হলেও তার ব্যবহার কীভাবে হবে তার দিশা ছিল না। জানুয়ারিতে যখন ফ্রন্টলাইন কর্মীদের জন্য ভ্যাক্সিন দেওয়া আরম্ভ হল তখনও স্পষ্ট নয় বাকি নাগরিকদের কী হবে। সব মিলিয়ে ধোঁয়াশা। 

কিন্তু আপাত ধোঁয়াশার আড়ালে চলছিল এক গোপন খেলা। যার ভালো নাম ‘ভ্যাক্সিন কূটনীতি’। তিনি বিশ্বভারতীর সমাবর্তনে এসে রবীন্দ্রনাথের স্বদেশ ভাবনার সঙ্গে তাঁর ‘আত্মনির্ভর ভারত’-এর গূঢ় যোগ খুঁজে পেয়েছিলেন। সেই আত্মনির্ভরতার কারণে তিনি বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে একের পর এক চুক্তি করে চলেছিলেন- এতদিন তিনি ছিলেন দেশের যাবতীয় সমস্যার ‘মসীহা’, এবার সেই ইমেজ রফতানি হয়ে গেল বিদেশে। শুধু ইমেজ নয়, সেই সঙ্গে দেশের পক্ষে জীবনদায়ী ভ্যাক্সিন; এখনও অবধি পাওয়া খবর অনুযায়ী তা মোট উৎপাদনের ৬৫ শতাংশ। পরে মরুক গে দেশের লোক! চুলোয় যাক হাড় হাভাতের দল, যারা ক্রমশ তাঁর দলকে নির্বাচনী যুদ্ধে পরাজিত করে চলেছে এখানে ওখানে! 

কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভা বহুদিন ঠুঁটো জগন্নাথ, দেশের স্বাস্থ্য মন্ত্রক স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে গেলে ঢোক গেলে, লোকসভা কার্যত এখন একটা প্রতীকী প্রাসাদ। তিনিই রাখেন তিনিই মারেন। ফলে, দেশের মানুষের জন্য কত ভ্যাক্সিন দরকার, উৎপাদক সংস্থার পরিকাঠামোতে উৎপাদনের হার কেমন, এসব হিসেব-নিকেশ চুলোয় গেল, শুধু তিনি বিশ্বের দরবারে ত্রাতা সাজবেন বলে। অবশ্য এই ত্রাতার ভূমিকাই বা কতটা ? দেশের যে দুটো কোম্পানি ভ্যাক্সিন তৈরি করছে তারা তার প্রযুক্তি জোগাড় করেছে তো বিদেশ থেকেই। আর যারা সেই প্রযুক্তিগত সহায়তা দিচ্ছে তাদের দেশে তো তারা নিজেরাই ভ্যাক্সিন তৈরি করে দেশবাসীকে বিনামূল্যে দিয়ে দিয়েছে। এখানে কার কতটুকু কৃতিত্ব, বোঝা ভার। 

সন্দেহ হয়, এর পেছনে অন্য কাহিনি আছে। বিদেশে যে ভ্যাক্সিন রফতানি হল তার মূল্য কে মেটাল?  কেন্দ্রের সরকার? উত্তর নেই। সঙ্গত অনুমান,  নিজের ‘ইমেজ’ উজ্জ্বল করতে উৎপাদককে বাধ্য করা হয়েছে বিদেশে টিকা পাঠাতে। আর এই ‘ইমেজ উজ্জ্বল করার জনসেবা’ করার বিনিময়েই আজ দেশের মানুষের জন্য সার্বিক বিনামূল্যের টিকাকরণ বন্ধ করে দেওয়া হল। তাছাড়া, সদ্য প্রকাশিত একটা রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, সিরাম ইনস্টিটিউট'এর কর্ণধার তাঁর দলের ভাঁড়ারে বেশ বড় অঙ্কের একটা অনুদান দিয়েছেন- এই বিনিয়োগেরও একটা ফেরত লাভ চাই। তাই স্পষ্ট, উৎপাদক সংস্থাকে বাড়তি মুনাফা করার সুযোগ করে দিয়ে একই দেশে একই টিকার তিনরকম দাম আজ বিস্ময়কর রিয়ালিটি। আর সেই সঙ্গে অনূর্ধ্ব পঁয়তাল্লিশ বছরের নাগরিকের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হল বিনামূল্যের টিকা নেওয়ার সুযোগ, যে বয়সের নাগরিকদের অর্থনীতির বিচারে সব থেকে উৎপাদনশীল বলে বিবেচনা করা হয়। এই বহুল অপরিণামদর্শিতার যোগফল আজকের এই পরিস্থিতি। 

দেশে যখন রোগের প্রকোপ ঊর্ধমুখী তখন টিকা কেন্দ্রে টিকার জোগান নেই। কে কবে ভ্যাক্সিন পাবেন তারও কোনও নিশ্চিতি নেই। বিপন্ন মানুষ ভিড় করছেন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে, হাসপাতালে। ক্ষুব্ধ হচ্ছেন, হতাশ হচ্ছেন। টিকা কবে আসবে তার কোনও ভরসা নেই। অথচ রোগ বাড়ছে। আর এই সময়েই মুখ লুকিয়েছেন তিনি, যে মুখ মাত্র কয়েকদিন আগেই দেখা যাচ্ছিল এখানে ওখানে। 

বলা হয় তাঁর দল নাকি অন্যরকম। পার্টি উইথ এ ডিফারেন্স। ঠিক। দেশের এ যাবৎ মারণরোগের সব টিকাকরণ হয়েছে সরকারি অর্থে, এবার আরও ভয়াবহ রোগের ক্ষেত্রে তা স্থগিত করে দেওয়া হল। এর আগে কেউ দেশের মানুষকে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে বিদেশে জীবনদায়ী ওষুধ রফতানি করে বুক ফোলাননি। এবার তাও দেখলাম আমরা, সেই নোটবন্দির দিনগুলোর মতো। সারা দেশের মানুষ যখন অক্সিজেনের অভাবে শ্বাসরুদ্ধ, তখন বেছে বেছে নিজেদের দলের রাজ্য সরকারকে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে অক্সিজেন। এমনকি সেই মহার্ঘ প্রাণবায়ুও উড়ান দিচ্ছে বিদেশে। পার্থক্য একটাই। মনে পড়ে যাচ্ছে উনিশ বছর আগের কথা। আমেদাবাদের পথে পথে যখন ঘাতক বাহিনী নারী গর্ভ চিরে বের করে আনছে ভ্রূণ তখন সেনাবাহিনীকে বসিয়ে রাখা হয়েছিল নিরাপদ আশ্রয়ে। তাদের পথে বেরনোর অনুমতি মেলেনি যতক্ষণ না পর্যন্ত সমাপন হয় সেই হননপর্ব। 

স্থান-কাল-পাত্র পালটে গেছে, নায়ক পাল্টায়নি। কেন যে আমাদের স্মৃতি মাঝে মাঝে ঘুমিয়ে পড়তে চায়!


2 comments:

  1. একদম সঠিক লিখেছেন। তিনি শুধু নন গোটা সরকারটাই যেন হারিয়ে গেছে। এবার কি কাগজে 'হারানো প্রাপ্তি নিরুদ্দেশ'-বিজ্ঞাপন দিতে হবে আমাদের?

    ReplyDelete
  2. চমৎকার, মননশীল বিশ্লেষণ...

    ReplyDelete