কলাভবনের সেই সব দিনগুলি
অনুপম চক্রবর্তী
ঠিক চৌত্রিশ বছর আগের স্মৃতি। ১৯৮৭ সনে কলাভবনে ভর্তির পরীক্ষা দিতে আরও অনেক পরীক্ষার্থীর সঙ্গে আমিও রং তুলি হাতে নাট্যঘরে হাজির। আমাদের তিনটি বিষয় বলা হয়েছিল, তার মধ্যে যে কোনও একটি কাগজে ফুটিয়ে তুলতে হবে। কলাভবনে পরীক্ষা দেব শুনে আমার আঁকার শিক্ষক গৌতমদা কয়েকটি বিষয় নির্ভর ছবি আঁকতে শিখিয়েছিলেন। এমনই কপাল, নির্দেশিত বিষয় তিনটির একটিও সেগুলির ছায়া মাড়ায়নি! দিশেহারা হয়ে হাতের নখের যখন দফারফা, আলটপকা এক ফন্দি খেলে। আমি মুচির ছবি আঁকব মনস্থ করি। অন্য দুটি বিষয় যে ঠিক কী ছিল, তা আর মনে নেই। মুচির ছবি কেন এঁকেছিলাম, তা খোলসা করে বলি।
খাঁচায় টিয়া পাখি এবং খানকতক খাম সঙ্গে জনৈক গণৎকারকে ফুটপাতে বসে থাকতে বছর কয়েক আগেও দেখা যেত উত্তর ও মধ্য কলকাতায়। ভবিতব্যের খোঁজে আসা পথচারীর উদ্দেশ্যে খাঁচা থেকে বেরিয়ে পাখিটি তার মালিকের নির্দেশানুযায়ী একটি খাম বাছত। সেই খামে রাখা কাগজ দেখে আগুন্তুকের ভবিষ্যৎ বাতলে দিত পাখির মালিক। গৌতমদা আমাকে সেই জ্যোতিষী-টিয়ার ছবি আঁকতে শিখিয়েছিলেন। সেদিন পরীক্ষার কাগজে, খাম আর খাঁচার পরিবর্তে কয়েক পাটি চটিজুতো আর তা সারাইয়ের সরঞ্জাম এঁকে সেই জ্যোতিষীকে মুচিতে রূপান্তরিত করি। আর তার হাত ধরেই আমার কলাভবনের যাত্রা শুরু।
বোলপুর স্টেশনে নেমে লটবহর সহ রিক্সায় চেপে কলাভবন ছাত্রাবাসে পৌঁছলাম। কলকাতায় যৌথ পরিবারের সকলকে ছেড়ে সেই প্রথম দূরে কোথাও একলা চলে আসা। ঝিরঝিরে বৃষ্টি পড়ছে। যেদিকেই দু’ চোখ যায় পরতে পরতে গাছের সারি ডানা মেলে দাঁড়িয়ে। এত রকমারি সবুজ আগে দেখিনি কখনও। একেবারে নিঝুম চারিপাশ। নিকটজনের বড় অভাব বোধ হচ্ছে। একেবারেই অচিন আমি এই ভুবনে। তাই বুঝি সার বাঁধা দালান ঘেরা ছাত্রাবাসের মাঝের ঐ ঝাঁকড়া মাথার অশোক গাছ, কেমন একদৃষ্টে চেয়ে। একটু এগোতেই সহপাঠীদের দেখা পেলাম তার ছায়াতলে। ধরে প্রাণ এল যেন।
কলাভবন ক্যান্টিনের মুখোমুখি জামগাছ তলায় আমরা নবাগতরা আলাপচারিতায় মেতেছি। একদল অগ্রজ ছাত্রছাত্রী গায়ে পড়ে জবরদস্তি সব বায়না জুড়েছে। এক দিদি আমাকে মিষ্টি করে বলল,
'কয়েকটা জাম পেড়ে দাও না
ভাই।'
আমি গদগদ হয়ে তড়াক করে গাছে উঠে প্যান্টের দু’ পকেট ভরে জাম পেড়ে আনা মাত্র সে অবাক চোখে বলে,
'একি, এমন করে দিতে আছে? ক্যান্টিনের লাগোয়া পদ্মপুকুরে ধুয়ে না দিলে এ আমি ছোঁবই না।'
অগত্যা দু’ হাত ভরা জাম ধুতে জলাশয়ের ধারে উবু হয়ে বসেছি, কে যেন পেছন থেকে আলতো করে ঠেলা মারলো।
আমি সটান পাতালপুরীতে। পুণ্যস্নান সেরে দেখি, একদল সহপাঠী উঠবস করতে করতে টারজান সিনেমার 'জিলে লে, জিলে লে, আয়ও আয়ও জিলে লে' গাইছে। আরেক দল, কানে দোলনচাঁপা গুঁজে, অদ্ভুত অঙ্গ সঞ্চালনে কিমি কাতকারের সেই লাস্যময়ী নাচের দফারফা করে ছাড়ছে। দিন কতক অগ্রজদের অভাবনীয় প্রশ্নমালা এবং উটকো আবদার সামাল দিতে নবাগতদের উপস্থিত বুদ্ধির যেমন পরিচয় পাওয়া গেল, অনেকের সুপ্ত প্রতিভারও উন্মেষ হল। আড়ষ্টতার খোলস ছেড়ে প্রত্যেকে নিজেকে নতুন করে চিনলাম। ক্ষণকালের মধ্যেই অগ্রজ এবং অনুজের প্রকৃত বয়সের ব্যবধান গেল ঘুচে। এক নতুন পরিবারের সদস্য হলাম। আত্মীয় পরিজন ছেড়ে আসার বেদনা আচম্বিতে উবে গেল।
স্নাতক পর্যায়ের প্রথম দুই বছর বিভিন্ন শিল্পমাধ্যমের সঙ্গে পরিচিতি ঘটাতে, পেইন্টিং, স্কাল্পচার, ডিজাইন, পটারি এবং প্রিন্টমেকিং ডিপার্টমেন্টে পালা করে ক্লাস হ’ত। পাশাপাশি চলত শিল্প ইতিহাসের ক্লাস। যতদূর মনে পড়ে, আমাদের প্রথম ক্লাস হয়েছিল ডিজাইন ডিপার্টমেন্টে। অনুপমাদি-র আলপনার ক্লাস। প্রথমে একটি ফুল নানা দিক থেকে পুঙ্খানুপুঙ্খ এঁকে, সেটিকে সযত্নে ছিঁড়ে তার প্রতিটি অংশ আবার আলাদা করে আঁকতে বলা হয়। অর্থাৎ, সেই ফুলটির বাহ্যিক এবং আভ্যন্তরীণ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বুঝে ফেলা চাই। তবেই আলপনার মূল উপাদান, মোটিফ এবং প্যাটার্নে বৈচিত্র আনা যাবে। উৎসের সত্যতা বজায় রাখলে, কল্পনা ও বাস্তবের মিশেলে ডিজাইন প্রাণ পায়। প্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্কস্থাপন করে ডিজাইন গড়ার এই মৌলিক পদ্ধতিটি আজও কাজে লাগে নিজের কর্মক্ষেত্রে বা শিল্পশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ানোর সময়।
ট্রি স্টাডি ক্লাসে, কোনও একটি পেল্লাই আম, জাম বা ছাতিম গাছ দেখে তা হুবহু আঁকতে হ'ত। গাছের কাঠামো এবং পাতার বিন্যাস যথাযথ আঁকা হলে, পেনসিলের সাহায্যে তাতে আলোছায়ার খেলা ফুটিয়ে তোলা চাই। ২০ বাই ৩০ ইঞ্চি কাগজে মহীরূহ কব্জা করতে চোখ ধাঁধিয়ে যাওয়ার উপক্রম। কয়েক গোছা পাতা যে কম আঁকব তারও উপায় নেই। আসল গাছ আর আঁকা গাছের মধ্যে চোখ চালাচালি করে প্রণবদা ঠিক ধরে ফেলতেন। হপ্তা দুই একনাগাড়ে ঐ এক গাছ আঁকতে বিরক্তই লাগত! পরে উপলব্ধি করেছি সেই অনুশীলন, একাগ্রতা ও পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা বাড়ানোর চমৎকার এক পন্থা। সেই ক্লাস চলাকালীন এক মজার ঘটনা ঘটে। এক সহপাঠী ওর গাছ আঁকা কাগজটি কর্মস্থলে রেখে বন্ধুদের আঁকা গাছ পরিদর্শন করে আবার যথাস্থানে ফিরে দেখে কাগজটি উধাও। বোর্ডের উপর পেনসিল বক্স দিয়ে সেটি চাপা দেওয়া ছিল, ফলে হাওয়ায় উড়ে যাবার কথা নয়। তাহলে গেল কোথায়? কে লুকিয়ে রাখতে পারে ভেবে সকলেই সন্দেহের চোখে পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করছি। বিত্তহারা বন্ধুটিই খেয়াল করল, খানিক দূরে একটি নধর গাই ওর পরিশ্রমের ফসল নির্লিপ্তে চিবোচ্ছে।
প্রথম বর্ষের মাঝামাঝি আমরা জমায়েত হয়েছি পটারি ডিপার্টমেন্টে। কম্পোজিশনের ক্লাস। একতাল মাটি থেকে দশটি ভিন্নরূপী ও নানা মাপের ত্রিমাত্রিক জ্যামিতিক আকার বানিয়ে সেগুলি এক বর্গফুটের মধ্যে সাজাতে হবে। এমন ভাবে সাজাতে হবে যাতে একটিও অবাঞ্ছিত এবং দলছুট না লাগে। প্রবীরদা-র এমনটাই নির্দেশ। যে যার মতো নানা আকারের দানাদার, কালাকাঁদ, ল্যাংচা গড়ে ফেললাম কিন্তু সেগুলি পরিবেশন করতে গিয়েই যত বিপত্তি। কারও মনে হয় দশটি মিষ্টান্নের জন্যে এক বর্গফুট যথেষ্ট নয়। কেউ আবার পাত থেকে নাড়ু, বরফি সরিয়ে সমস্যার আশু সমাধান খোঁজে। ঢেলাগুলির অবস্থান ক্রমান্বয়ে অদলবদল করতে করতে একসময় যেন মনে হল প্রত্যেকটি একে অপরের পরিপূরক হয়ে ঐ নির্দিষ্ট পরিসরে দিব্যি মিলেমিশে আছে। এখন ভাবতে অবাক লাগে কেমন খেলাচ্ছলে টের পেয়েছিলাম, সাকার এবং তার আশপাশের নিরাকার স্থানের মধ্যে সঠিক যোগসাজশে একটি কম্পোজিশন দানা বাঁধে।
শিল্প ইতিহাসের ক্লাস করতে আমরা মাঝেমধ্যেই জড়ো হ’তাম খোলা আকাশের নীচে। বর্ষার দিনকতক ছাড়া, অরুণদা-র ফার-ইস্টার্ন আর্টের ক্লাস বাঁধা ছিল আর্ট হিষ্ট্রি ডিপার্টমেন্টের সামনে মহানিম গাছতলায়। ইতস্তত গরু ছাগল চড়ছে, পর্যটকদের শশব্যস্ত আনাগোনা, পাখি ডাকছে, অদূরের সঙ্গীত ভবন থেকে মিশ্র সুর ভেসে এল, তারই মাঝে তিনি ক্লাস নিতেন আপন মেজাজে। আমাদের ক্লাস শুরু হ’ত সকাল আটটায়। অনেক রাত পর্যন্ত স্টুডিওতে ছবি এঁকে বা ছাত্রাবাসে গুলতানি মেরে সকালে ঘুম থেকে উঠতে যথারীতি দেরি হ’ত। অনেক ক্লাসেই আমি অবলীলায় স্বপ্নে পাড়ি দিতাম। তবে অরুণদা তাঁর জ্ঞানভাণ্ডার এমনভাবে মেলে ধরতেন যে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনতাম।
কাঞ্চনদা-র ইন্ডিয়ান আর্টের ক্লাসে একদিন এক মজার অভিজ্ঞতা হয়। ক্যান্টিনের পাশে চাতালে বসে উনি অজন্তা গুহাচিত্র বিশ্লেষণ করছেন। খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় থেকে খ্রিষ্টীয় সপ্তম শতাব্দীর মধ্যে আর্থ কালার দিয়ে টেম্পেরা পদ্ধতিতে আঁকা সে’ সব ছবি আমরা মুগ্ধ নয়নে দেখছি। হঠাৎ কোথা হতে এক পাল হনুমান এসে হাজির। তাদের দেখে আমরা যত না শঙ্কিত, তারা ততোধিক হতভম্ব। আসলে ঐ সময় চাতাল তাদের দখলে থাকে। তারা সেখানে প্রাতরাশ সারে। ক্যান্টিন থেকে খাবার জোগান দেয় তাদের শুভাকাঙ্ক্ষীরা। নিমেষের মধ্যে লাগোয়া বট ও জামগাছের ডালে শুরু হল তাদের তাণ্ডবলীলা। অজন্তা সকলের মাথায় উঠেছে। আমরা যে যার অজন্তা চটিতে পা গুঁজে সটকে পরার তালে। কাঞ্চনদাই ত্রাণকর্তা হয়ে ক্যান্টিন থেকে বিস্কুট আনিয়ে পবন নন্দনদের বিদেয় করলেন। আবার ফিরে গেলাম ১ নম্বর গুহায়। বোধিসত্ত্ব পদ্মপাণির ছবি থেকে চোখ ফেরানো দায়।
শিল্পকলা জগতের দিকপালেরা তো বটেই, সঙ্গীত জগতেরও রথী-মহারথীরা শান্তিনিকেতনে এলে কলাভবনে আসতেন, ঘরোয়া অনুষ্ঠানও করতেন। সেবারের দোল পূর্ণিমার আগের দিন পণ্ডিত রবিশঙ্কর এসেছেন। আমরা জনাকয়েক ওনাকে কলাভবন মিউজিয়াম দেখাতে নিয়ে গিয়েছি। কলাভবনের প্রাক্তনী, প্রবীণ চিত্রকর ধীরেন্দ্র কৃষ্ণ দেববর্মণকে সেখানে দেখা মাত্রই পণ্ডিতজী ওনার পা ছুঁয়ে প্রণাম করলেন। দেববর্মণ মহাশয় পণ্ডিতজীকে চিনতে পেরে একগাল হেসে বললেন,
'আরে, আমাদের রবি না? এখনও বাজাও টাজাও তো?'
রবিশঙ্কর তখন খ্যাতির চূড়ায়। উনি স্মিত হেসে তাঁর ধীরেনদাকে জড়িয়ে ধরলেন। অকৃত্রিম ভালোবাসার বন্ধন বুঝি এমনই হয়, নাম যশের তোয়াক্কা করে না। এমনই স্মরণীয় এক অভিজ্ঞতা হয়েছিল এক গরমের ছুটির আগ দিয়ে। মিউজিয়ামের অডিটোরিয়ামে আলি আকবর খাঁ সাহেব বাজাতে বসেছেন। তখন সেখানে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা ছিল না। জোরে পাখা চালালে সেই আওয়াজে পাছে বাজনায় ব্যাঘাত ঘটে, তাই পাখাও ঢিমেতালে ঘুরছে। অসহ্য গরমে সকলে জেরবার। খাঁ সাহেবও দরদর করে ঘামছেন। তারই মধ্যে সমাহিত হয়ে তিনি ঘণ্টাধিক একটানা বাজিয়েছিলেন। সাধনমার্গে বিচরণ করলে শারীরিক ক্লেশ বুঝি এমন অনায়াসে জয় করা যায়।
তখন থার্ড ইয়ারে পড়ি। পেইন্টিং নিয়ে স্পেশালাইজেশন করছি। আমরা তিন বন্ধু, মানিদাকে (কে জি সুবরামানিয়াম) আমাদের পেইন্টিং দেখাব মনস্থ করেছি। ডিজাইন ডিপার্টমেন্টের দোতলায় ওনার স্টুডিওতে কে আগে ঢুকবে তা নিয়ে জল্পনা চলছে। কোনও সিদ্ধান্তে আসতে না পেরে তিনজনেই একসঙ্গে সিঁড়ি বেয়ে তড়তড় করে উঠে ওনার ঘরের দরজার কাছে পৌঁছেই আবার হুড়মুড়িয়ে নেমে পড়ছি। আসলে এত বড় মাপের একজন শিল্পী আমাদের কাঁচা হাতের ছবি দেখে কী না কী বলবেন সেই ভয়ে ওনার ঘরে ঢুকতে ভরসা পাইনি। ছয়বার সিঁড়ি বেয়ে ওঠানামাই করেছিলাম। তবে পরবর্তীকালে বহুবার তাঁর সংস্পর্শে এসে ঋদ্ধ হয়েছি বৈকি!
রামকিঙ্করের তৈরি রবীন্দ্রনাথের আবক্ষ মূর্তিতে আকারগত বিকৃতি বা ডিস্টরশন
ব্যাখ্যা করতে ভাস্কর্যের মাস্টারমশাই অজিতদা, রবার ব্যান্ড-এর উপমা দিয়েছিলেন। একটি রবার ব্যান্ড দুটি বা তিনটি আঙ্গুলে টানলে সকল দিক
থেকে তার প্রসারণ বা সঙ্কোচন ঘটলেও সেটিকে চিনতে অসুবিধে হয় না। তেমনি একটি চেনা মুখে কোনও বিশেষ অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তুলতে
কেবল তার নাক বা কান বিকৃত করলে সেই মুখ অচেনা ঠেকে। মুখমণ্ডলে সম্যক পরিবর্তন আনলে
তবেই কাঙ্ক্ষিত ভাব ফুটে ওঠে, মানুষটিকেও শনাক্ত করা যায়।
|
|
উপরের ছবি দুটি রামকিঙ্করের সেই বিশ্ববন্দিত ভাস্কর্যের। একটিও রবি ঠাকুরের প্রতিকৃতি নয়, কিন্তু কবিকে চিনতে অসুবিধে হয় না।
অজিতদা-র কথার রেশ টেনে একবার যোগেনদা বলেছিলেন, চেনা রূপের বিকল্প রূপ দেখাতে চাইলে কেবল তার বাহ্যিক আকারের বদল ঘটালে হয় না। আকারের সঙ্গে তার রঙ, রেখা, টেক্সচার এবং পারিষদ বর্গকেও এক ছন্দে পাল্টানো জরুরি। তাহলেই প্রকৃত বস্তুটির সাপেক্ষে একটি কাল্পনিক অথচ যুক্তিগ্রাহ্য বাস্তবতার উদ্ভব হয় যা বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে। এই প্রসঙ্গে দুটি ছবির উদাহরণ দিই। নীচে বাঁ দিকের ছবিটি ১৬৫৬ সনে ডিয়েগো ভেলাজকুয়েজের আঁকা 'লাস মেনিনাস'। সেই ছবি থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে পাবলো পিকাসো ১৯৫৭ সনে ডানদিকের ছবিটি এঁকেছিলেন।
|
|
|
|
শীত পড়লেই ছাত্রাবাসের সামনে আমগাছ তলায় মাঝে মধ্যে ক্যাম্প ফায়ার হ’ত। সেখানে ছাত্রদের সঙ্গে মাস্টারমশাইরাও স্বতঃস্ফূর্ত অংশ নিতেন। দুই মাস্টারমশাই, ননীদা আর নন্দদা 'ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দে রে' গানটি যখন ধরতেন, বগার জন্য সত্যি মন কেঁদে উঠত। একবার এক অগ্রজ ছাত্র বাড়তি উদ্দীপনায় হাত-পা ছুঁড়ে 'চারমূর্তি' সিনেমার 'ঘচাং ফু খাবো তোকে' গানটি ধরেছে। নজরে এল বাবা কাকার বয়সী মাস্টারমশাইরাও গানের তালে মাথা দোলাচ্ছেন, মিটিমিটি হাসছেন। তাঁরাও বুঝি তাঁদের ছাত্রজীবনে ফিরে গেছেন। সে’বার দোলে, অবসরপ্রাপ্ত মাস্টারমশাই সুখময়দা, 'ওরে গৃহবাসী খোল দ্বার খোল, লাগলো যে দোল' গানের সঙ্গে আপন মনে নাচ করছিলেন। কে বলবে তাঁর সত্তরের কাছে বয়স?
বিকেল হলেই কলাভবন চত্বরে ছাত্রছাত্রীরা গান বাজনায় মেতে উঠত। কখনও বাসুদেব দাস বাউলও ঘুঙুর পায়ে, একতারা আর ডুপকি হাতে গান ধরতেন। 'তোমায় হৃদ মাঝারে রাখিব ছেড়ে দেব না' এখনও কানে বাজে।
কলাভবন ছাত্রাবাসে নানা প্রদেশের ভিন্ন রুচির বন্ধু সমাগমে হরেক গানবাজনা শোনার সুযোগ হয়েছিল। সন্ধ্যে হলেই কোনও ঘরে টিনা টারনার দাপাতে শুরু করত তো দু’ ঘর ছেড়েই রামকুমারের গলায় নিধুবাবুর টপ্পা। কোনও এক সুহৃদ বারান্দায় বসে ট্রেসি চ্যাপম্যানের ছন্দে পা নাচাচ্ছে, পাশের ঘরেই অন্যজন আলো নিভিয়ে কুমার গন্ধর্ভে বিভোর। কেউ ঘরের কোণায় হিটারে ডিম সেদ্ধ বসিয়ে কান পেতেছে অশেষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের এস্রাজে। কেউ আবার নিবিষ্ট মনে খাটে বসে বেহালার ছড় টানছে। গান ও নাচের মহড়া দেখার নেশায় হামেশাই সঙ্গীত ভবনে ঢুঁ মারতাম। প্রথম বর্ষে ছাত্রাবাসের যে ঘরে থাকতাম তার ঠিক মুখোমুখি, রাস্তার ওপারেই ছিল শান্তিদেব ঘোষের বাসস্থান। ঊষালগ্নে তানপুরা বাজিয়ে তিনি একের পর এক গান ধরতেন। প্রায়শই কাঁচা ঘুম ভাঙত তাঁর গানে। তখন কী নির্মম মনে হত তাঁকে। এখন মুগ্ধ হয়ে শুনি তাঁর গাওয়া 'ঝরা পাতা গো, আমি তোমারই দলে'। মরমী গলায় সুরসপ্তকে এমন অনায়াস বিচরণ মন কেড়ে নেয়। তাঁর জীবনযাত্রায় কোনও আড়ম্বর চোখে পড়েনি। তেমনিই নিরাভরণ তাঁর গান। খুব আফসোস হয় এমন মানুষটির সান্নিধ্য থেকে নিজেকে বঞ্চিত করেছি।
কলাভবনের আরও কত ঘটনাই কালের স্রোতে স্মৃতিপট থেকে বেমালুম মুছে গেছে। পাঁচ বছর ছবি আঁকা যেমন শিখেছি, উজাড় করা প্রকৃতির সম্ভার, আশ্রমিক আচার অনুষ্ঠান, সারল্যমাখা গ্রাম্য জীবনের স্পন্দনও সমানতালে উপভোগ করেছি। কলাভবনের জীবনই কলাভবনের শিক্ষা। সেই জীবনটাকে গড়ে তোলার কাজে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন অসিত হালদার, নন্দলাল বসু, সুরেন কর, বিনোদ বিহারী মুখোপাধ্যায়, রামকিঙ্কর বেইজ এবং আরও অনেক বিশিষ্ট গুণীজন। একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্থান মাহাত্ম্য জন্মায় মূলত সেই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের হাত ধরে। আমি ভাগ্য করে অনেক যত্নশীল শিক্ষকের সংস্পর্শ পেয়েছি।
কলাভবনের সেই দিনগুলির দিকে ফিরে তাকালে এক মিশ্র অনুভূতি জাগে। সেখানে বহির্জগৎ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে সুরক্ষিত এক কল্পরাজ্যে ছিলাম। ভারতবর্ষের নানা শিল্পধারার সঙ্গে পরিচিতি ঘটে বরোদার ফ্যাকাল্টি অফ ফাইন আর্টস-এ স্নাতকোত্তর পর্যায়ে পড়াকালীন। বিদেশে উচ্চশিক্ষাকালে চাক্ষুষ করি বিশ্বশিল্পের ভাবগতিক। কখনও মনে হয়, শিল্পকে হাতিয়ার করে জীবিকার সম্ভাব্য উপায়সকল বাতলানোর দায় ছিল কি কলাভবনের? কেবলমাত্র ছবি আঁকা বা মূর্তি গড়াই যে শিল্প নয়, প্রাত্যহিক জীবনের সঙ্গেও যে সে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে, তা কলাভবনে না পড়লে অজানা থাকত। কলাভবন যেমন প্রকৃতিকে ভালোবাসতে শিখিয়েছে, তেমনি অসুন্দরের মাঝে সুন্দরকে খুঁজে নেওয়ার চোখও তৈরি করে দিয়েছে। আজও সেই দু’ চোখেই উপলব্ধি করি বিশ্বচরাচর।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার: বাসুকি দাসগুপ্ত
৫
♥️
ReplyDeleteঅসম্ভব সুন্দর একটা লেখা পড়লাম । লেখাটা অনেক বড়, কিন্তু পড়তে গিয়ে একটুও বিরক্ত লাগছিল না শেষ হচ্ছে না বোলে । একক মাত্রা এবং অনুপম চক্রবর্তীকে অসংখ্য ধন্যবাদ এরকম একটা লেখা উপহার দেওয়ার জন্য । চারিদিকে রাজনীতির কচকচানি, চোরচোট্টাদের অভিনয়, প্রতিহিংসাপরায়ণ নোংরা নীতি ইত্যাদির মধ্যে এই লেখাটা যেন এক পশলা বৃষ্টির শেষে মিষ্টি শীতল বাতাস । প্রাণ জুড়িয়ে গেল । লেখককে হামি । এরকম লেখা আরো চাই কিন্তু । 🥳😘
ধন্যবাদ কৌশিক বাবু। ভালো থাকবেন।
DeleteVery good romanticised memory. But truly speaking there were lot of things in reality in Santiniketan and it's surroundings. That is hard reality.
ReplyDeleteThanks for your complement.
Deleteঅনবদ্য। অসম্ভব সুন্দর ও লিরিক্যাল একটি লেখা পড়লাম। রাজনৈতিক কচকচির মধ্যে যেন দখিনা বাতাস। আপনি আরো লিখুন।
ReplyDeleteধন্যবাদ সোমনাথ বাবু। ভালো থাকবেন।
DeleteSmriti shatatai shukhher - ei aaptobaakya smaran kore lekhhaa. Ati chamotkaar kore mul paawaagulo chhnuye gechhe Anupam.
ReplyDeleteধন্যবাদ ইন্দ্র দা। ভালো থেকো।
ReplyDeleteখুব সুন্দর স্মৃতিচারণা। আরো লেখো। ...তন্ময়।
ReplyDeleteধন্যবাদ তন্ময়।
Deleteখুব ভালো লাগলো। ভীষণ প্রানবন্ত।
ReplyDeleteঝুমাদি
ধন্যবাদ ঝুমাদি।
DeleteBah
ReplyDeleteDhonyobad
Deleteস্নাতকোত্তর জীবনে স্বল্প সময়ের জন্য হলেও কলা ভবনের সান্নিধ্য পাওয়ার সৌভাগ্য আমারও হয়েছিল। হয়তো আপনার স্মৃতির সাথে এখনকার কলা ভবন এর তেমন মিল নেই। তবুও এত সহজ, সাবলীলভাবে স্মৃতিচারণা পড়ে সেই সময় টা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি চোখের সামনে। ভালো থাকুক কলা ভবনের এই স্মৃতিগুলো 🌿
ReplyDeleteঅশেষ ধন্যবাদ ☺️
Deleteঅশেষ ধন্যবাদ
Delete