একবিংশ শতকের ভারত কি তাঁর নাগাল পেয়েছে?
শোভনলাল চক্রবর্তী
রামমোহন রায়ের ২৫০তম জন্মদিনের বর্ষব্যাপী উদযাপনের সূচনা হল ২২ মে ২০২১ থেকে। রামমোহন রায় সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন, 'তিনি ছিলেন একক, তিনি ছিলেন নিন্দিত।' বুকের পাঁজর জ্বালিয়ে অপরকে পথ দেখিয়েছিলেন, যে পথে হেঁটে ধর্ম ও জাতির উর্ধ্বে উঠে এক রাষ্ট্র হয়েছিল ভারত। সেই বিপদসঙ্কুল যাত্রা আজও শেষ হয়নি।
সাধারণত ঐতিহাসিক চরিত্র আলোচনা করতে বসলে যে প্রশ্নটা প্রথমেই উঠে আসে সেটা এই যে, তিনি কি আজও প্রাসঙ্গিক? কিন্তু রামমোহনের ক্ষেত্রে প্রশ্নটা ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে যায়। সন্দেহ জাগে, একবিংশ শতকের ভারত কি এই মহামানবের নাগাল পেয়েছে? তাঁর দৃষ্টির উদারতা, চিন্তার স্বচ্ছতা, তাঁর সহজ মানবিকতা, আপসহীন নৈতিকতা এবং সকল মানুষের প্রতি সমদৃষ্টির দ্বারা পরিচালিত তাঁর ধর্মবোধ- কতটুকু অনুসরণ করতে পেরেছে আধুনিক ভারত? নাগরিকের স্বাধীনতা ও সম্মান প্রতিষ্ঠা করতে তিনি শাসকের সঙ্গে যেমন লাগাতার লড়াই করে গেছেন, আবার তেমনই সমাজের অচলায়তন ভাঙতে রাষ্ট্রশক্তিকে কাজে লাগিয়েছেন। সংস্কারের এমন সার্বিক প্রচেষ্টার উদাহরণ কটাই বা আছে আমাদের সামনে? যে কোনও বড় মাপের মানুষকে বোঝবার চেষ্টাই আসলে অন্ধের হস্তিদর্শনের মতো, বিশেষ করে যখন ওই মানুষটির ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে বহু তথ্য হারিয়ে গেছে। তবু আমরা হাল ছাড়ি না।
রামমোহনের নিজের লেখা বই, পুস্তিকা, প্রচারপত্র, তাঁর বক্তৃতার অনুলিপি ইত্যাদি মিলিয়ে যা রয়েছে, তাতেও কিন্তু মানুষটা সম্পর্কে প্রামাণ্য তথ্য নেহাত কম নয়। সেই সব তথ্যকে হাতিয়ার করে আশা করা যায়, সমাজ তাঁর সম্পর্কে প্রচলিত কাহিনি আর ধারণাগুলোকে অতিক্রম করে তাঁর চিন্তার গভীরতায় প্রবেশের চেষ্টা করবে। সমাজ সংস্কারের চেষ্টার পেছনে তাঁর যুক্তিগুলোকে মানুষ গ্রহণ করবে। এখানে একটা উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা বোঝা যাবে। সতীদাহ প্রথা রোধে রামমোহনের যে উদ্যোগ, সে সম্পর্কে আজও আমাদের মনে ধারণাটা এই যে, কয়েকজন ধর্মান্ধ মানুষের হাত থেকে নারীদের উদ্ধার করাই ছিল রামমোহনের মহত্তম উদ্দেশ্য। এখন যখন সতীপ্রথা, কুলীনপ্রথা ঘুচে গেছে, তখন যেন রামমোহনও চলে গেছেন ইতিহাসের পাতায়। কিন্তু এই ধারণা যে কতটা ভ্রান্ত সেটা যাঁরা রামমোহন পাঠ করেছেন তাঁরা বুঝবেন।
রামমোহন লিখে গেছেন যে, সতীদাহ এবং বহু বিবাহের মূলে রয়েছে উত্তরাধিকারের আইন ও রীতি। তাই নারীর সম্পদ বঞ্চনা যতদিন থাকবে, ততদিন চলবে রামমোহনের যুদ্ধ। আজ প্রাচীন শাস্ত্রের সঙ্গে আধুনিক আইন যুক্ত হয়েছে বটে, কিন্তু ক্ষমতা ও বিত্তের জোর এতটুকু কমেনি। পুরুষতন্ত্রকে নস্যাৎ করার পৌরুষ রামমোহনের মতো আর কার আছে? 'একটি যুদ্ধ চলিতেছে। তাহার এক দিকে যুক্তি, শাস্ত্র এবং সাধারণ বুদ্ধি, অপর দিকে বিত্ত, ক্ষমতা এবং পক্ষপাত'- কথাগুলো রামমোহন রায় বলেছিলেন ১৮৩১ সালে। অথচ পড়লে মনে হয়, আজও তো সেই যুদ্ধ চলছে। তিনি লন্ডনে উদারপন্থী, যুক্তিবাদী 'ইউনিটারিয়ান' খ্রিষ্টানদের সামনে এক ভাষণ দিতে গিয়ে কথাগুলো বলেছিলেন। ওই ভাষণে তিনি আশা প্রকাশ করেছিলেন যে বিবেক ও বিচারের আলোকে উজ্জ্বল ধর্মবুদ্ধির জয় হবে। পরাজিত হবে রহস্য দিয়ে সত্যকে গোপন করে রাখার, মানুষকে ভুলিয়ে রাখার অপচেষ্টা।
রামমোহনের জন্মের ২৫০ বছর হয়ে গেল, ভারতের স্বাধীনতার ৭৫ বছর হতে চলল, কিন্তু ক্ষমতাসীন ব্যক্তিরা আজও ধর্মের মহিমায় দেশবাসীকে ভুলিয়ে রেখে রাজনীতি পরিচালনা করতে চায়। ক্ষমতা, বিত্ত এবং ধর্মান্ধতা থেকে মুক্তি পেতে আজও যুদ্ধ করতে হচ্ছে দেশের অগণিত মানুষকে। তাঁদের উপর যে অপমান, পীড়ন ও হিংসা নেমে আসছে তার বেদনা আজ থেকে বহু বছর আগে সর্বপ্রথম অনুভব করেছিলেন রামমোহন রায়। পরিবার, সমাজ থেকে শুরু করে শাসক, যাজক পর্যন্ত- সমস্ত অভিমুখ থেকে তাঁর উপর অবিরাম আঘাত নেমে এসেছিল। কিন্তু তিনি নিজের লক্ষ্য নিজেই স্থির করেছিলেন এবং সেই লক্ষ্য থেকে কখনও নিজেকে বিচ্যুত করেননি।
বিত্ত, ক্ষমতা এবং ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ছাড়াও যে বিষয়টি নিয়ে রামমোহন রায় আজীবন লড়াই করে গেছেন তা হল সংবাদপত্রের স্বাধীনতা। ভারতের সংবাদপত্রের জন্মকালের তিনি একজন প্রাণপুরুষ এবং সংবাদের স্বাধীনতার যুদ্ধেও তিনি পথিকৃৎ। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে কলম ধরার ফলে এক ইংরেজ সম্পাদকের দেশ ছাড়ার হুকুম জারি হলে, রামমোহন রায় সেই হুকুমের প্রতিবাদে কলকাতার টাউন হলে প্রতিবাদ সভার আয়োজন করেন। সেই সভায় উপস্থিত ব্যক্তিবর্গের কাছে বিতরণের জন্য একটি পুস্তিকা পত্রে তিনি লেখেন, 'স্বৈরাচারী শাসক স্বভাবতই বাকস্বাধীনতা হরণ করিতে চাহে। কিন্তু সাম্রাজ্যের কোথায় কী ভ্রান্তি ঘটিতেছে তাহা শাসকের অগোচরে থাকিবে, যদি না ব্যক্তির মতপ্রকাশের বাধাহীন স্বাধীনতা থাকে।' আজকের ভারতে সাংবাদিকরা প্রতিনিয়ত আক্রান্ত হচ্ছেন শাসকের বিরুদ্ধে মুখ খুলে। বিশ্ব জুড়ে সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতার সূচকে ভারত ক্রমেই নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে।
রবীন্দ্রনাথ রামমোহন রায়কে বলেছিলেন 'ভারত পথিক'। কিন্তু ভারত কি তাঁর দেখানো পথে চলছে? এই প্রশ্নের উত্তর হাওয়ায় উড়ে বেড়াচ্ছে। আধুনিক ভারত যদি গড়তে হয়, তবে 'ভারত পথিক'-এর পথে চলা জরুরি। সেই পথ খোঁজার এই এক আদর্শ সময়। আমরা আশা করব তাঁর ২৫০তম জন্মবার্ষিকীর উদযাপন শুধুই ফুলের মালা আর ধূপের ধোঁয়ার আড়ালে হারিয়ে যাবে না। তাঁকে নিয়ে শুরু হবে এক বৌদ্ধিক চর্চা, যা আগামীর দিনে নতুন পথের সন্ধান দেবে অসহায় মানুষকে।
মুগ্ধ হলাম। প্রীত হলাম। কাজটি যে করা অতীব জরুরি যা এখনি শুরু করা দরকার উভয় দেশেই নচেৎ মুখ থুবরে পরবে দেশ ও জাতি রাষ্ট্র তো বটেই কথাটা সুনিশ্চিত।
ReplyDelete