জনতার মানসিকতা সরকারের কর্তব্যকর্ম
সঞ্জয় মজুমদার
'খেলা হবে' স্লোগানের ভাব বিশ্লেষণ কি শেষ হয়েছে? মনে হয় না। পাড়ায় পাড়ায়, অলিতে-গলিতে, রাস্তার মোড়ে, গ্রামেগঞ্জে, শহরতলিতে, শহরে, মহানগরীতে সর্বত্র সর্বস্তরের বৈধ-অবৈধ পশ্চিমবঙ্গবাসীর জন্য ২০২১'এর আট দফা নির্বাচনের উন্মাদনা থিতিয়ে এলেও, এই ভীষণ জনপ্রিয় আবহসঙ্গীতের ভাব-সম্প্রসারণ কিন্তু চলছেই।
রাজভবনে শপথগ্রহণ, মন্ত্রীদের দফতর বন্টন ইত্যাদি সব বাধ্যতামূলক সাংবিধানিক ক্রিয়াকলাপ যতটা সম্ভব কোভিড বিধি মেনে সম্পন্ন হওয়ার পর, আমরা ভাবছিলাম, এইবার বুঝি ভোটের রাজনীতিতে সংবিধানের দোহাই দিয়ে ক্লান্তিহীন আকচা-আকচি কিছুটা নেপথ্যে চলে গেল। ভুল ভেবেছিলাম। একদম ভুল। প্রমাণ? প্রথমত নির্বাচন পরবর্তী অনিবার্য রাজনৈতিক হিংসা এবং দ্বিতীয়ত নারদ নারদ। একটু খেয়াল করলেই বোঝা যাবে, দিল্লি, রাজভবন এবং নবান্নের বারমুডা ট্রায়াঙ্গলে অনবরত ঠোক্কর খেতে থাকা, প্রতি মুহূর্তের মুঠো মুঠো নিউজ ফিডগুলো কিন্তু বৃহত্তর অর্থে ওই 'খেলা হবে' শিরোনামেই হার্ড বা সফট্ নিউজ, সম্পাদকীয় এবং বিশ্লেষণাত্মক লেখাজোখা দিয়ে কষিয়ে রান্না করে পরিবেশন করেই যাচ্ছে। কখনও সেই খেলার মধ্যমণি ভোটের রাজনীতি, তো কখনও কোভিড বা সুপার সাইক্লোন 'ইয়াস'। এর সাথে অডিও-ভিডিও, ইলেকট্রনিক এবং সোশ্যাল মিডিয়ারও সক্রিয় অংশগ্রহণ তো আছেই।
সচেতন ভাবেই উপরোক্ত সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর কোনওরকম চুলচেরা বিশ্লেষণে যাব না। বরং অন্যভাবে সচেতন হওয়ার চেষ্টা করব। স্বেচ্ছায় কিছুক্ষণের জন্য রাজনীতি, অতিমারি এবং নানারকম প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের বাস্তবতাকে সরিয়ে রাখছি, জোরালো তিনটি প্রশ্ন নিজেকে করব বলে। তা হল, নাগরিক হিসেবে একটা নির্বাচিত সরকারের কাছে আমি ঠিক কী চাই? কেনই বা চাই? এবং কতটুকু চাই?
প্রশ্ন যখন আছে, অতএব উত্তর খোঁজার চেষ্টাও করলাম। প্রচুর পত্রপত্রিকা, সরকারি-বেসরকারি বক্তব্য, আন্তর্জাল, বড়সড় ব্যবসায়িক সংস্থার নিয়ন্ত্রণাধীন বেশিরভাগ মূলধারার সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন, প্রায় সম্পাদনাহীন সামাজিক মাধ্যমের অবিশ্রান্ত গল্পগাছায় নিজেকে সমৃদ্ধ করে বুঝলাম- এই তিনটি প্রশ্নের উত্তর খোঁজা আর পরিষ্কার রাতের আকাশে তারা গোনা প্রায় একই ব্যাপার। নাগরিক চাহিদার তালিকাগুলো এক জায়গায় করে মোটামুটি যা বোঝা গেল, সকালে ঘুম থেকে ওঠা তারপর রাত্রে ঘুমোতে যাওয়া পর্যন্ত সবটাই একটা নির্বাচিত সরকার করে দেবে এটাই আমার এবং আমাদের চাহিদা। ব্যক্তিগতভাবে কাউকে প্রশ্ন করে দেখেছি এর বিপক্ষে বলেন। যেমন, '...না না ব্যাপারটা ঠিক তা নয়। একটা ন্যূনতম নাগরিক পরিষেবা এবং ভালোভাবে বেঁচে থাকার জন্য যেটুকু প্রয়োজন সেটুকুই সরকারের কাছে আমার চাওয়ার...'। এই 'ভালোভাবে' শব্দটার মধ্যেই রহস্য ঘনীভূত। 'ভালো' না 'খারাপ', 'ভাব' নাকি আড়ি, এবং তা কতদূর বিস্তৃত তার তল পাওয়া 'মুশকিলই নেহি না মুমকিন হ্যায়'।
পাবলিক বাসে উঠে চাহিদার হিসেব-নিকেশের কিছুটা টের পাওয়া যায়। যেমন, বাস চল্লিশের নীচে গড়ালে 'ড্রাইভার কি হাওয়া খেতে বেরিয়েছে, একটু টেনে চালান দাদা'। এরপর দাদা টেনে চালাতে শুরু করলেই, 'কী শুরু করেছেন আপনারা?' শুধু তাই নয়, সাদা উর্দিধারী ধরলেই তখন আবার জনতার সমবেত রাগ তেনার উপরে গিয়ে পড়ে, 'হপ্তা নেওয়ার আর সময় পেল না...।' এছাড়া, হাতে ঘড়ি পরে একটুও সময় হাতে না রেখে ভেবে নেব পাবলিক বাস আমার সময় ধরেই গন্তব্যে পৌঁছে দেবে, যেখানে নামাতে বলব সেখানেই থামাতে হবে, যেখানে হাত দেখাব সেখানেই তাকে দাঁড়াতে হবে (ভাবটা এমন, যেন আমার জন্যই বাসটা রাস্তায় বেরিয়েছে), একটাও পেট্রল পাম্পে বা আপৎকালীন মেরামতির জন্য না দাঁড়িয়ে সোজা গন্তব্যে যেতে হবে (অবশ্য আমি নেমে যাওয়ার পর বাসটা চলে গেল না দাঁড়িয়ে রইল, কিংবা বোমে উড়ে গেল, তা নিয়ে আমার বিন্দুমাত্র উৎসাহ নেই) এবং যতই নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে আস্তে বা জোরে চালাও না কেন, ট্রাফিক সার্জেন্ট কখনও কোনও কেস দেবেন না।
শেষমেশ একটা মজার জিনিস লক্ষ করেছি বহু বছরের অভিজ্ঞতায়। বাসের চালক, পরিচালক, পেট্রোল পাম্পের লোকজন এবং কর্তব্যরত ট্রাফিক পুলিশ, পাবলিক বাসের প্যাসেঞ্জারদের অন্তহীন চাহিদায় এতটুকুও বিচলিত হন না, কিংবা ভাবলেশহীন হয়ে যাবতীয় অভাব অভিযোগ কানের পাশ দিয়ে বার করে দেন। খারাপ শোনালেও, হয়তো ঠিকই করেন। কারণ এটা তাঁরা বুঝে গেছেন, প্যাসেঞ্জার নিজেদের চাহিদা নিয়েই বাসে ওঠেন, বাস মালিক বা কর্মচারীদের চাহিদা নিয়ে তাঁদের কোনও মাথাব্যথা নেই। তেলের দাম, যন্ত্রপাতির দাম এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক খরচা বাড়লেও যাত্রীরা এসব নিয়ে এতটুকুও বিচলিত নন। এর উপর লকডাউন হলে তো কথাই নেই। পরিষেবা যারা দেন তাদের ভুল থাকতেই পারে, কিন্তু দিনের শেষে আমার মতোই বাস-কন্ডাক্টর একজন সাধারণ খেটে খাওয়া নাগরিক। তাঁরও চাহিদা আছে, আমি স্বীকার করি বা নাই করি। পারস্পরিক সহমর্মিতা এবং সহিষ্ণুতার পরিসর আর্থ-সামাজিক কারণেই ক্রমশ সংকুচিত হচ্ছে, আর হচ্ছে বলেই আমরা 'জিরো টলারেন্স'-এর দিকে এগোচ্ছি। ঠিক এখানেই খেলাটা জমে উঠছে, কারণ, পরিষেবা প্রদানকারী এবং উপভোক্তা দুজনেই পরস্পরকে প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করছেন, যা একটা সুস্থ সামাজিক পরিবেশের ক্ষেত্রে দুর্ভাগ্যজনক।
কোভিডের দুটি পর্যায়ে লকডাউন নিয়ে বিচিত্র সব পরস্পর বিরোধী মন্তব্য কানে এসেছে। 'সব রাজ্য কত সুন্দর বুঝেশুনে লকডাউন চালু করে দিল, আর আমাদের এখানে দেখ...'। অর্থাৎ, নির্বাচনের পর লকডাউন কবে চালু করবে সরকার, তা নিয়ে রীতিমতো জ্যোতিষ চর্চা শুরু হয়ে গেল। অথচ নির্বাচন কমিশন এই অনমনীয় মনোভাব (অবশ্য এই গোয়ার্তুমির নেপথ্যে আসল চাপ কে বা কারা দিয়েছিলেন সেটা আমার কাছে এখনও প্রশ্নচিহ্ন) থেকে বাস্তব পরিস্থিতি বিচার করে একটু যদি সরে আসত তাহলে পশ্চিমবঙ্গে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের সংক্রমণ এবং মৃত্যুহার দুটোই কমানো যেত। যাই হোক, এরপর এই আমরাই, লকডাউন যখন চালু হয়ে গেল তখন, 'একটু তো সময় দেবে, যখন তখন লকডাউন চালু করে দেওয়া... এ আবার কী? মানুষের রুজি-রোজগারের কথা ভাববে না?...' ইত্যাদি পরস্পর বিরোধী মন্তব্য করে বাজার মাত করে দিলাম।
অপ্রতিরোধ্য রহস্যজনক কারণে প্রতিদিন সন্ধ্যায় টেলিভিশনের পর্দায় ফুল-বেলপাতা নিয়ে মেগা- সিরিয়াল দেখার চাহিদা, কুম্ভ স্নানে লক্ষ লক্ষ মানুষের সাথে পুণ্যার্জনের ভয়ঙ্কর নেশায় টপাটপ গঙ্গায় ডুব দেওয়ার চাহিদা, এত সতর্কীকরণের পরেও স্বেচ্ছায় শতাধিক লোকের সাথে সামাজিকতার দোহাই দিয়ে অনুষ্ঠান বাড়িতে অংশগ্রহণ করার চাহিদা এবং এরকম আরও কত চাহিদা যেন একই সূত্রে গাঁথা রয়েছে যার মধ্যে 'কী? কেন? কতটা?'র কোনও সদুত্তর পাওয়া সম্ভব নয়। নাগরিকদের কাছেই স্পষ্ট নয়। এই কারণেই হয়তো সরকার, প্রশাসন, আইন-আদালত এবং ওই বাসের কন্ডাক্টর ড্রাইভার সকলেই বুঝে গেছেন, পাবলিকের কথায় বেশি পাত্তা দিতে নেই। কী বলে, কী ভাবে নিজেরাই বোঝে না। স্বাভাবিকভাবেই যেখানে সেখানে কয়েকশো ফুট উঁচু মূর্তি তৈরি করা, পুণ্যস্নানের ঢালাও অনুমতি দেওয়া, ধর্মগুরুদের নানান রকম অনুদান দেওয়া, জনগণের করের পয়সায় যথেচ্ছ দান-খয়রাতি করা, আবোল তাবোল কারণে বিপুল অর্থব্যয়ে নতুন নতুন সরকারি ভবন তৈরি করার খেলাটা কেন্দ্র-রাজ্য নির্বিশেষে একটু হলেও সহজ হয়ে যায়।
'আমফান' আর 'ইয়াস'- এক বছরের মাথায় দু-দুটো সুপার সাইক্লোনের দৌলতে আপামর বঙ্গবাসী কত কিছু জেনে গেল। নিম্নচাপ থেকে ঘূর্ণিঝড় কিভাবে তৈরি হয়? আবহাওয়া দফতর তার গতিপথের নির্ণয় কীভাবে করে? তার নাক চোখ কাকে বলে? ল্যান্ডফলের মানে কী? ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট টিমের কাজ কী? কোন কোন যন্ত্রপাতি তাঁরা ব্যবহার করেন? এবং সবশেষে ঝড়ের কাঁধে চেপে কত কোটি টাকার কেন্দ্র-রাজ্য সরকারি লেনদেন হয়? সেটার চাহিদাও আজকাল সচিত্র ধারাবিবরণীতে প্রশাসনিক বৈঠকের মাধ্যমে জানিয়ে দেওয়া হয়। অর্থাৎ, সাইক্লোনের উপর পরীক্ষা নিলে সবাই প্রায় একশোয় একশো পাবে। চাহিদায় কিন্তু এখানেই দাড়ি পরে না। মেগা সিরিয়ালের মতো চলতেই থাকে। কপিল মুনির আশ্রমে বুক সমান জলে ডুবে বা পশ্চিমবঙ্গ-উড়িষ্যার উপকূলে ঝড়ের সাথে সমান্তরালে উড়তে থাকা সাংবাদিকরা অক্লান্ত অমানুষিক পরিশ্রম করে, জীবন বাজি রেখে আমাদের চাহিদার জোগান দেন। এতে চ্যানেলে টিআরপিও সাংঘাতিক চড়া হয় নিঃসন্দেহে। মুখে আহা উহু করলেও, আমরা কিন্তু প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে সচিত্র সংবাদ সংগ্রহ যারা করছেন, তাঁদের চ্যানেল দেখতেই বেশি ভিড় জমাই। সাংবাদিকরা আমাদের অন্তর্যামী হয়ে কলকাতার হাওয়া অফিসে, পূর্বাঞ্চলীয় অধিকর্তাকে এই প্রশ্নও করেন, 'কেন কলকাতায় ইয়াস আছড়ে পড়ল না?' অধিকর্তা বুঝিয়ে বলেও দেন কারণটা। প্রশ্নোত্তর ইত্যাদি সব মিলিয়ে পরিবেশটা এমন হয় যেন কলকাতায় ল্যান্ডফল না হওয়াটাও মারাত্মক প্রশাসনিক গাফিলতি এবং চেষ্টা করা হচ্ছে যত দ্রুত সম্ভব পরবর্তী সুপার সাইক্লোন অবশ্যই যেন কলকাতার বুকে আছড়ে পড়ে।
বলার কথা এই, নির্বাচিত সরকারের কাছে, কেন্দ্র-রাজ্য যাই হোক, নাগরিক চাহিদা যদি সীমাহীন ও অনিয়ন্ত্রিত হয়, যুক্তি-বুদ্ধি রহিত হয়, তবে সরকার ও প্রশাসনিক স্তরের গাফিলতি এবং তা ঢাকতে আরও বড় গাফিলতির জন্ম হয়। ফল কীভাবে ভোগ করতে হয়? সংবিধানের দোহাই দিয়ে আট-দফা নির্বাচন, সঞ্চিত পাপ ধুয়ে ফেলার দোহাই দিয়ে ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান, সামাজিকতার দোহাই দিয়ে নানান জনসমাবেশ, 'মানুষ বড় কাঁদছে'র দোহাই দিয়ে অধিকাংশ অযৌক্তিক সরকারি প্রকল্প- এইভাবে তালিকার ছায়া দীর্ঘ থেকে সুদীর্ঘ হতে থাকে। সব শেষে, আগাপাশতলা গণতন্ত্রের দোহাই দিয়ে একনায়কতন্ত্রের নীরব কিন্তু জোরালো অধিষ্ঠানকে মনে না নিলেও মেনে নিতে হয়।
ঝকঝকে ঝরঝরে লেখা। সম্পূর্ন অন্য আঙ্গিকে। এই রকম আরও লেখার অপেক্ষায়
ReplyDeleteলেখার মাত্রা অসাধারণ। সাময়িক পরিপ্রেক্ষিতে এরকম লেখার প্রয়োজনীয়তা ছিল। চারিদিকে এই শ্লোগান কবে শেষ হবে কে জানে। নাহলে জীবনটাই একটা খেলায় পরিণত হবে।
ReplyDeleteসাম্প্রতিক কালে পড়া খুব ভালো একটি লেখা। লেখক কে আন্তরিক অভিনন্দন।
ReplyDeleteKhub sundor nirmed bhasha. Tathyo bishleshon o chamotkar. Bhalo lage ri dhoroner boudhhik lekha Porte.
ReplyDeleteCudos. Keep it up.
একটি বহুল প্রচলিত স্লোগান যার আবির্ভাব নির্বাচন প্রাক্কালে তার উপযুক্ত উপমা সহ এত সুন্দর বিশ্লেষণ, ভাষার নিখুঁত প্রয়োগ লেখকের গভীর অন্তর্দৃষ্টির পরিচায়ক l আরো এই ধরনের লেখার অপেক্ষায় থাকলাম l
ReplyDeleteসঞ্জয়দার লেখাটা পড়লাম আজকে এইমাত্র, বেশ ভালই আলোচনা করেছেন একটু অন্য ধরনের বিষয় নিয়ে । সত্যিই জনগণের সরকারের কাছে চাওয়ার শেষ নেই । জনগণ সাধারণত বেশি ব্লগ পড়েন না; এ লেখা পড়লে তাদের গোঁসা হবে । 😃🤥
ReplyDeleteখুব ভালো বিশ্লেষণ। সত্যিই একবার নিজেদের দিকে তাকানো দরকার...এমন লেখা আরো পড়তে চাই।
ReplyDelete