... যারে তুমি পর ভাবো সে কি বাম হয়
অনিন্দ্য ভট্টাচার্য
(এ কথা আজ অনস্বীকার্য যে, গত দু-এক দশকে রাজনৈতিক-অর্থনীতির আমূল পরিবর্তনকে সম্যক ভাবে বুঝে উঠতে না পারার কারণেই বাম রাজনীতির পুরনো ও সাবেকি ধারা ক্রমশই ম্লান ও বিপন্ন হয়ে পড়েছে। তাই, গত দু-আড়াই শতকের বাম রাজনীতির মহাতল্লাটে ঢুঁ মেরে লেখক চেষ্টা করেছেন আজকের সময়ের সন্ধিক্ষণে এসে পৌঁছতে। বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের সাম্প্রতিক নির্বাচনে বামেদের নিদারুণ শক্তিহ্রাসের মূল উৎসটিকে সেই আলোকেই তিনি ধরতে চেয়েছেন। 'বামপন্থার সেকাল একাল: তুমি কি কেবলই ছবি!' শীর্ষক একটি নাতিদীর্ঘ নিবন্ধে তিনি গোটা চিত্রপটটিকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন যা 'বিবক্ষিত'র ব্লগে (https://bibokshitowebzine.blogspot.com/2021/05/blog-post_22.html?m=1) প্রকাশ পেয়েছে। সেই নিবন্ধটির একটি ছোট গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যেখানে পশ্চিমবঙ্গের বাম রাজনীতির ঘূর্ণাবর্তকে আলোচনা করা হয়েছে, তা নিচে প্রকাশ করা হল।)
২০০৬ সালের ২৫ মে টাটার এক প্রতিনিধি দলকে নিয়ে সরকারি আধিকারিকরা যখন চুপিসারে দুপুরবেলা সিঙ্গুরে জমি দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলেন, তখন খবর পেয়ে কৃষক রমণীরা হাতে ঝাঁটা-খুন্তি নিয়ে রাস্তায় নেমে এসে সে দলকে তাড়িয়েছিলেন। সে খবর চাউড় হতেই অসুস্থ জ্যোতি বসু জিজ্ঞেস করেছিলেন, ওখানে কৃষক সভাকে না জানিয়ে টাটার দল গেল কেন? প্রশ্নটি খুবই অর্থপূর্ণ। তিনি বলতে চেয়েছিলেন, একটি বামপন্থী দলের স্থানীয় কৃষক সংগঠনের অজান্তেই কৃষিজমি সম্পর্কে নতুন কোনও প্রস্তাবের রূপরেখা কেন ভাবা হয়েছিল? এই মত স্পষ্টতই, একটি বামপন্থী দলের স্বাভাবিক গণভিত্তি যে কৃষক সমাজ, তার গুরুত্বের কথা অনুধাবন করতে বলে। কিন্তু পুঁজিবাদের মায়ামোহে তদানীন্তন বামফ্রন্টের নেতারা এতটাই মশগুল যে নিজ পার্টির শ্রেণি ভিত্তি বা কর্তব্যকর্ম তাঁরা বেমালুম ভুলে মেরে দিয়েছেন। এর পরের ঘটনাবলী আমরা জানি।
সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের কৃষক আন্দোলনের সমর্থনে সারা রাজ্য জুড়ে এক তীব্র গণ আন্দোলন গড়ে ওঠে, যে আন্দোলনের ভাষা তাঁরা পড়ে উঠতে পারেননি। বিরোধী দলনেত্রী তাঁর সংসদীয় রাজনীতির কারুকৌশলে অচিরেই এই আন্দোলনের অন্যতম নেতৃত্বকারী ভূমিকায় চলে আসেন এবং ২০১১ সালের নির্বাচনের রায়ে বামফ্রন্ট সরকারের দীর্ঘকালীন সরকারের পতন ঘটে। বামফ্রন্ট বহির্ভূত অন্যান্য বামপন্থী শক্তি এই আন্দোলনে থাকলেও তাদের নানা ধরনের জড়তা ও মতান্ধ চিন্তাভাবনা থাকার ফলে তারা এই আন্দোলনের দায়ভাগকে শেষাবধি বহন করতে ব্যর্থ হয়। এই ব্যর্থতার অন্যতম কারণ, সংসদীয় রাজনীতির প্রতি তাদের ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ গোছের এক অবিমৃশ্যকারী আচরণ।
মুশকিল হল, বামফ্রন্ট বা সিপিএমের তরফে এই বিচ্যুতিটা তারা আজও বুঝে উঠে পারল না। এবারের নির্বাচনের প্রাক্কালে তাদের প্রার্থী সিঙ্গুরে গিয়ে ‘শিল্পের শিলন্যাস’ করে এলেন। আর ভোটের ফলাফলে আবারও তাদের ভরাডুবি হল। সচ্ছল মধ্যবিত্তের দৃষ্টিকোণ থেকে বামপন্থাকে দেখার যে ভয়ঙ্কর পরিণাম, তা তাদের কড়ায়-গণ্ডায় মেটাতে হল। তবুও তাদের হুঁশ নেই। শ্রেণি আন্দোলন থেকে বিচ্যুত তাদের উচ্চবিত্ত-মধ্যবিত্ত নেতৃত্ব নিঃশব্দে নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গিকে আমূল বদলে ফেলেছেন যে! তাঁরা ভাবলেন, একরের পর একর জমি পেয়ে কর্পোরেটরা এসে সুবোধ বালকের মতো শিল্প গড়ে তুলবে আর সেই শিল্পে রাজ্যের বেকার যুবকদের কর্মসংস্থান হবে! কী বিপদ! সাধারণ খবর রাখা একজন সচেতন মানুষও জানেন যে, প্রথমত, সস্তায় জমি পেয়ে কর্পোরেটরা যে সেখানে শিল্প গড়ে তুলবেই তার কোনও নিশ্চয়তা নেই (এ হল বিগ মিডিয়া নির্মিত একটি মিথ); দ্বিতীয়ত, যদিও বা সেখানে শিল্প গড়ে ওঠে তা হবে এতটাই অত্যাধুনিক যে সেখানে খুব সীমিত সংখ্যক দক্ষ বেকারেরই কর্মসংস্থান হতে পারে; আর তৃতীয়ত, সব থেকে মূল্যবান কথাটি হল (যা আমাদের শীর্ষ আদালতও তুলে ধরেছে) যে, উচ্ছেদ করে জমি অধিগ্রহণে যে বিপুল সংখ্যক মানুষের কর্মচ্যুতি হবে, তা নতুন কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা থেকে অনেক অনেক বেশি। অর্থাৎ, নতুন শিল্প, সহায়ক-শিল্প মিলিয়ে সর্বমোট যারা কাজ পাবেন তাঁদের থেকে যারা কাজ হারাবেন তাঁদের সংখ্যাটা পরিমাণে অত্যাধিক।
এও মনে করে দেখুন, সিঙ্গুরে যে জমিটি নিয়ে এত লড়াই, সেই জমির উল্টোদিকে (হাইওয়ের ওপারে) সমপরিমাণ ঈষৎ নিচু একটি প্রায়-পরিত্যক্ত জমি ছিল, যে জমি অধিগ্রহণে স্থানীয় মানুষজনের কোনও আপত্তিও ছিল না, সেখানে টাটাদের প্রস্তাবিত শিল্প গড়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল; কিন্তু তারা সে প্রস্তাবে সম্মত হয়নি। কেন? কারণ, জমিটি যেহেতু অল্প নিচু ছিল, তাই সেখানে কিছু পরিমাণে মাটি ফেলে ভরাট করার দায় পড়েছিল তাদের ওপর। টাটারা সেই সামান্য ব্যয়টুকুও করতে রাজী ছিল না মুনাফার কিয়দংশে ঘাটতি পড়ে যেতে পারে ভেবে। আর বামফ্রন্ট সরকার এমন নির্লজ্জ ভাবে কর্পোরেটদের পক্ষে দাঁড়াল যে, তারা টাটার সামান্য ব্যবসায়িক ব্যয় বৃদ্ধিকে পর্যন্ত কৃষক ও বর্গাদারদের জীবনযাপন ধ্বংস হয়ে যাওয়ার থেকেও বড় করে দেখল।
শ্রমিক-কৃষক আন্দোলনের সোচ্চার প্রতিধ্বনি হয়ে যে বামপন্থী দলগুলির উত্থান ও বিকাশ, সেই তারাই এইভাবে হাতে লাল পতাকা নিয়ে ও মার্কসবাদের নাম করে প্রকারান্তরে শ্রমিক-কৃষকের বিপক্ষে গিয়ে রাজনীতির অতল জলে ডুবে গেল। অন্যদিকে, ভারতের প্রধান শাসক দল কংগ্রেসের থেকে নিজেদের আলাদা করে যে আঞ্চলিক নতুন দলটি রাজ্যে ১৯৯৮ সালে তৈরি হয়, তারাই কৃষকদের স্বার্থে দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে, সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম ও অন্যত্র কঠিন লড়াই চালিয়ে এক রাজনৈতিক সত্তা হিসেবে রাজ্যের ক্ষমতায় আসীন হল। অথচ, এই দলের তেমন কোনও ঘোষিত মতাদর্শ নেই। দু’ দফায় সরকার চালিয়ে তৃতীয় বারের জন্যও তারা নির্বাচিত হল বেশ প্রবল সংখ্যাধিক্য নিয়ে। তার অর্থ অবশ্য এই নয় যে, তৃণমূল সরকারের কোনও ব্যর্থতা বা অসাফল্য ছিল না। অবশ্যই ছিল। কিন্তু এমন একটা আস্থা তারা রাজ্যের মানুষের থেকে আদায় করতে পেরেছে যে এক বড় সংখ্যক মানুষ বিশ্বাস করেছেন, অন্য সব দলের থেকে শ্রমজীবী ও গরিব মানুষের পাশে তৃণমূল সরকার আছে। দুর্ভাগ্যের হলেও বাস্তবতা এই যে, পশ্চিমবঙ্গের আর পাঁচটা দলের মতোই তৃণমূলও নিজ দলীয় ক্ষমতা জাহির করতে পিছপা হয়নি, স্থানীয় স্তরে আগের জমানাগুলোর মতোই অনেক জায়গাতেই গায়ের জোর দেখিয়েছে। দুর্নীতিও কম করেনি। কিন্তু সব কিছু ছাপিয়ে এমন একটি সামাজিক-অর্থনৈতিক বাতাবরণ তারা নির্মাণ করতে সক্ষম হয়েছে, যার ভিত্তিতে মানুষ তাদের অপকর্মগুলিকে সার্বিক বিচারে কম গ্রাহ্য করে সুকর্মের ভিত্তিতে তাদের ওপরে আস্থা রেখেছে। উপরন্তু, এবারের নির্বাচনে বিজেপি নামক এমন এক ফ্যাসিবাদী শক্তি এ রাজ্যের নির্বাচনে সর্বাত্মক ভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এবং তার বিরোধিতায় তৃণমূলও এক অটল লড়াইয়ের স্বাক্ষর রেখেছিল, তা দেখে মানুষ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যক্তিত্ব ও নেতৃত্বের ওপর কুণ্ঠাহীন আস্থা জ্ঞাপন করেছে।
এই যে নবতর এক সামাজিক-অর্থনৈতিক উদ্যোগের কাণ্ডারী তারা হতে পেরেছে, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে এক আস্থাভাজন আন্দোলনের মুখ হয়ে উঠতে পেরেছে, বহু প্রকল্প ও জনমুখি অনুশীলনের দ্বারা প্রান্তিক মানুষের দুয়ারে কল্যাণমূলক কার্যধারাগুলিকে পৌঁছে দিয়েছে, তা নিঃসন্দেহে মানুষের মধ্যে প্রবল সাড়া ফেলেছে। দেখে মনে হবে, তারা বোধহয় কোনও বাম মতাদর্শ দ্বারা প্রভাবিত, যেখানে তাদের অগ্রাধিকার পিছিয়ে পড়ে মানুষদের প্রতি। লক্ষণীয়, ঘোষিত ভাবে তারা কোনও মতাদর্শের অনুসারী নয়। বামপন্থীদের যে দাবিগুলি চারপাশে বারবার উচ্চারিত হতে শোনা যায়, তারা সেইগুলিকেই রূপায়িত করার চেষ্টা করে। হতে পারে তা জনপ্রিয়তা লাভের জন্য, হতে পারে তা নির্বাচনে জেতার জন্য। এতে সমস্যা কোথায়? বরং, এ তো বেশ ভাল ব্যাপার যে, সংসদীয় নির্বাচনের বাধ্যবাধকতায় জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষাগুলি গুরুত্ব পাচ্ছে ও বহু ক্ষেত্রে বাস্তবায়িত হচ্ছে। আর সে কারণেই সংসদীয় গণতন্ত্রকে আরও পাকাপোক্ত ও উদার করা অতীব জরুরি। আর এইভাবেই তো চাপে পড়ে সংসদীয় গণতন্ত্র উত্তরোত্তর আরও বৈধতা পায় ও মানুষের আস্থা অর্জনে বেশি বেশি করে সক্ষম হয়ে ওঠে। আর যতই তা হয়, সাবেকি ও সনাতন বামপন্থীরা যেন পিছিয়ে পড়তে থাকে। দেখা যায়, নতুন নতুন রাজনৈতিক শক্তি সেই শূন্যস্থানকে পূরণ করে বামপন্থার কর্মসূচিগুলিকেই আরও উন্নত স্তরে ধারণ করে। সে অর্থে বলাই যায়, এ রাজ্যে সংসদীয় ব্যবস্থার দৌড়ে তৃণমূলিরা সাবেকি বামপন্থীদের একেবারে পিছনে ফেলে দিয়েছে। এ এক অভিনব প্যারাডক্স।
বামপন্থাকে অন্তঃস্থ করেই সংসদীয় গণতন্ত্র ও পুঁজিবাদী রাষ্ট্র যেন আরও সবল হয়ে উঠছে। অথচ সেখানে বামপন্থী নামধারীদের কোনও ঠাই নেই। কারণ, তারা চিন্তা-চেতনা ও কর্মে পড়ে আছে কয়েক দশক পিছনে। আর সে জন্যই আজ এই একুশ শতকের বিশের দশকের গোড়ায় এসে আমূল পরিবর্তিত রাজনৈতিক-অর্থনীতির বিকাশধারা কোন পানে এগোচ্ছে আর সংকটের সূত্রগুলি কোথায় আবর্তিত হচ্ছে ও সুপ্ত আছে, তা বোঝার আদৌ কোনও এলেম তাদের নেই। কারণ, বহুদিন হল তারা রাজনৈতিক-অর্থনীতির চর্চাকে সমূলে বিসর্জন দিয়েছে। বামপন্থী নামধারী যাদের বলি (কমিউনিস্ট দর্শনে বিশ্বাসীদেরও সে তালিকায় ফেলে) তাদের আজকের সংকট ঠিক এইখানটাতেই (তবে অবশ্যই অন্য কিছু বামপন্থী শক্তি নতুন ভাবে এগিয়ে আসছে)। অথচ যারা বামপন্থী নামধারী নয়, তারা ঘোর বাস্তবে বেমালুম ধাক্কাটাক্কা খেয়ে বামপন্থীদের সম্ভাব্য ইস্যুগুলিকে নিয়েই বেশ এগিয়ে পড়েছে। এই ‘ধাক্কাটা’ ওই তথাকথিত ‘অ-বাম’পন্থীদের আরও গায়ে লাগে কারণ, সংসদীয় রাজনীতিই তাদের রাজনৈতিক অনুশীলনের অন্যতম প্রধান ক্ষেত্র। তাদের পক্ষে তা বেশ আয়াসসাধ্যও, কারণ তাদের অত মতাদর্শের পিছুটান নেই। তাই বলি, নামে কী বা আসে যায়!
এই যে আজকের রাজনৈতিক-অর্থনীতি সম্পর্কে সাবেকি বামপন্থীদের অজ্ঞতা, তার আলোকেই নির্বাচনে পর্যুদস্ত হয়ে এখন তাঁরা সামাজিক ন্যায়-প্রকল্পগুলিকে ‘ভিক্ষার ঝুলি’ হিসেবে বক্রোক্তি করছেন। কারণ, তাঁরা জানেন না, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অভিঘাতে আজকের রাজনৈতিক-অর্থনীতিতে যে বহু কথিত ‘গিগ অর্থনীতি’র জমানা শুরু হয়েছে, সেখানে স্থায়ী ও যথেষ্ট কর্মসংস্থানের কোনও আয়োজন নেই। আধুনিক যন্ত্র এখন আয়েসেই বহু মানুষের কায়িক ও মানসিক শ্রম দুইই বেশ দ্রুতগতিতে সম্পন্ন করতে সক্ষম। অতএব, আগামী দিনে ব্যাপক কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা ক্রমেই আরও সংকুচিত হবে। যে কারণে, ‘ইউনিভার্সাল বেসিক ইনকাম’এর আলোচনা এখন কান পাতলেই সর্বত্র শোনা যায়। অর্থাৎ, বহু সংখ্যক মানুষের হাতে টানা কাজ থাকবে না, প্রযুক্তি ও তার আনুষঙ্গিক দক্ষতা বহুল পরিমাণে খুব দ্রুত পরিবর্তিত হতে থাকবে, কাজের বাজারে এক জটিল ও অনিশ্চিত অবস্থার সৃষ্টি হবে। তেমন পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রের তরফ থেকে সমাজকল্যাণ মূলক উদ্যোগের প্রয়োজনীয়তা শত গুনে বেড়ে যাবে। তাই, ‘ভিক্ষার ঝুলি’ বলে সেইসব জনকল্যাণমূলক প্রকল্পকে অবজ্ঞা করাটা আসলে অজ্ঞতার দিকচিহ্ন। শিল্প স্থাপনা ও কর্মসংস্থানের প্রতিশ্রুতির যে বড়াই সাবেকি বামপন্থীরা করে থাকে তা অশ্বডিম্ব বৈ আর কিছু নয়। কারণ, সারা বিশ্ব জুড়ে নতুন করে ম্যানুফ্যাকচারিং বা কারখানা শিল্প আর কোথাও তেমন উল্লেখযোগ্য প্রবণতা নয়, যা কিছু নতুন গড়ে উঠছে তা সব মেঘের আড়ালে (ক্লাউড প্রযুক্তি)। এই নতুন ভার্চুয়াল শিল্পে বিশেষ ধরনের দক্ষ মানবসম্পদের চাহিদা অবশ্যই থাকবে, কিন্তু কাজের অধিকাংশ পরিসরটা চলে যাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার হাতে। এই সামগ্রিক উত্থানটাকে কি বামপন্থীরা বুঝতে পারছেন? বিপদটা সেখানেই।
তাহলে কি বলব যে, পুঁজিবাদী রাষ্ট্র বাধ্যত ক্রমেই বাম-ঘেঁষা হয়ে উঠছে? অর্থাৎ, নতুন রাজনৈতিক-অর্থনীতির অভিসারে তা কি আরও কল্যাণমূলক অবস্থান গ্রহণ করবে? এই প্রশ্নটি গভীর ভাবে খতিয়ে দেখার বিষয়। এর উত্তর এক কথায় ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ বলে কিছু হয় না। আমরা ডোনাল্ড ট্রাম্প, বোলসোনারো, এর্ডোগান, নরেন্দ্র মোদির মতো চরম দক্ষিণপন্থী ও মতান্ধ শক্তিকেও নির্বাচনের ম্যানডেট নিয়ে ক্ষমতায় বসতে দেখছি। তা নিয়ে এ লেখায় বিশেষ কিছু বলার নেই। বরং বলা যাক- যারে তুমি বাম দেখ সে কি বাম নয়/ যারে তুমি পর ভাবো সে কি বাম হয়’। অতএব, এ এক জটিল ধাঁধাঁ।
কিন্তু তৎসত্ত্বেও এই লেখায় শেষ কথাটি হল, যারা নামে ও কাজে বামপন্থী বলে নিজেদের মনে করেন (নানাবিধ কমিউনিস্ট সহ) তাদের আজ সময় হয়েছে একুশ শতকের রাজনৈতিক-অর্থনীতির সম্পূর্ণত নতুন উত্থানকে সম্যক অনুধাবন করে তাকে এমন ভাবে উপলব্ধি করা যাতে একটি যথার্থ সমাজ বদলের (পুঁজিবাদকে অতিক্রম করে) কার্যসূচি আবারও নির্মাণ করা যায়। বলাই বাহুল্য, পুঁজিবাদ তার নিজ জোরেই টিকে থাকছে, দরকার পড়লে সে বামপন্থাকেই যতটা সম্ভব আত্মসাৎ করছে, আর সেই সুবাদে নামধারী বামপন্থীদের অস্তিত্বকেই বিপন্ন করে তুলছে। আজকের রাজনৈতিক-অর্থনীতির কালবেলায় পুঁজিবাদকে অতিক্রমণের মহামন্ত্র নামধারী বামপন্থীদের এখনও জানা নেই, কারণ, তারা রাজনীতির এক গোলকধাঁধায় আপাতত বাঁধা পড়ে আছে।
একদম সঠিক মূল্যায়ন। দিগভ্রান্ত বাম ।
ReplyDeleteদুর্দান্ত লিখেছেন 👑অনিন্দ্যদা । অসাধারণ !!!!!! আমি গত কয়েক বছর ধরে বামপন্থীদের এইযে ক্রমশ ক্ষয় হয়ে যাওয়া, পিছিয়ে যাওয়া সেটা লক্ষ্য করছিলাম এবং কি কি কারণে তাদের এই অধঃপতন সেটাও নিজের মতো করে বোঝার চেষ্টা করছিলাম । তাতে যা যা বুঝেছি আপনার লেখার সাথে অনেকটাই মিলে গিয়েছে । খুব ভালো বিশ্লেষণ করেছেন । খুব, খুব । 👌🏼♥️🌹
ReplyDeleteবামেদের নিরন্ধ্র,নির্মম পতনের পর যে সব লেখা পড়লাম, তার বেশিরভাগই আবেগতাড়িত, অথবা ওই টুম্পা সোনার শাক দিয়ে মাছ ঢাকা যায়না ইত্যাদি। অনিন্দ্যবাবুকে ধন্যবাদ তিনিই প্রথম আমাদের একটি একাডেমিক লেখা উপহার দিলেন।সাবাস
ReplyDeleteলেখা টা ভালো লাগলো। বেশ শক্তিশালী ও বিশ্লেষণ মূলক আলোচনা। অন্ধ গলিতে পথ খুঁজে পাওয়া বেশ কঠিনই। বিশেষত যখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা র দাপটে গতানুগতিক সমাধান এর পর বেশি টাই রুদ্ধ। আলোচনা ও অনুসন্ধান এর পর ছাড়লে আমরা থেমে যাবে। নতুন প্রজন্মের কাছে ও পথের সন্ধান চাইতে হবে। পুরাতন অভিঞ্জ মানুষ জন নিশ্চয়ই মতামত ও অভঞ্জান দিয়ে সহায়তা করবে। প্রিয় অনিন্দ্য কে আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন এমন আলোচনার সূত্র তৈরি র জন্য।
ReplyDeleteপ.বা.য় শিল্পউন্নয়ন হয় না| তাই কর্ম সংস্থানও হয় না|সঠিক জমিঅধিগ্রহণ নীতির অনুপস্থিতি ও SEZ করতে দেবনা - শিল্পউন্নয়ন না হওয়ার দুটো বড় কারণ |বৃহৎ পুঁজি আকর্ষণে রাজ্যগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা রয়েছে; অথচ আমাদের কোন হেলদোল নেই|
ReplyDeleteরাজনৈতিক প্রশাসনিক দীর্ঘমেয়াদী স্থায়ীত্ত- শিল্পন্নয়নে এক জরুরী প্রয়োজন| বাম আমলে সেটা আমরা হারিয়েছি;বর্তমান জমানাতেও হারাচ্ছি|
স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্প,সামাজিক সুরক্ষার উজ্জ্বল নিদর্শন হয়ে উঠতে পারতো,যদি সঠিক ভাবে পরিকল্পিত ও রুপায়িত হোত|
সামাজিক উন্নয়ন এর নামে, ভোটের বছরে যে সব প্রকল্প আনা হয়েছে, সেগুলোর উদ্দেশ্য ছিল সরকারী অর্থে ভোট কেনা| সে উদ্দেশ্য বহুলাংশে সফল|
বামেরা এগুলোর কোনটাকেই প্রতিহত করার চেষ্টা করে নি|
বামেদের নিউজ চ্যানেল খুলতে হবে মাস funding করে টাকা তুলে নাহলে কিছু হবে না। বামেদের কথা মানুষের কাছে পৌঁছাচ্ছে না। আর মানুষের কথা পুঁজিবাদী মিডিয়া একেবারেই বলবে না।
ReplyDelete