Monday, 3 May 2021

বিনাশকালে বুদ্ধিনাশ?

নতুন ইতিহাস নির্মাণের সুযোগ নিন

শিবশংকর পাল

 

২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনে সিপিএম-কংগ্রেস ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গেল। মাঝখান থেকে ভাইজান পোড় খাওয়া সিপিএম-কংগ্রেসের ঘাড়ে পা দিয়ে বিধানসভার মাচায় বসার একটি চেয়ার দখল করে নিয়েছে। সময় সুযোগ এলে বা পেলে সেই ঘাড়দুটোকে লাথি মেরে অচিরেই সরিয়ে দিতে দ্বিধা করবে না আব্বাসের ধর্মের চশমা পরা ঐ দোসর। ঐ আসনটির কার্যত কোনও মূল্যই থাকবে না। তার আর একটা বড় কারণ ৭৫টা আসন পেয়ে বিজেপি এই রাজ্যে প্রধান বিরোধী আসনে গেঁড়ে বসল। অতি সঙ্গত কারণে তাই অনেকেই মনে করছেন, বিধানসভায় মানুষের দাবিদাওয়া নিয়ে কথা বলার কেউ রইল না। 

বামেদের এই সর্বাত্মক শ্মশানযাত্রায় মুহ্যমান হয়ে বোধবুদ্ধি বিনাশপ্রাপ্ত বামপন্থী কর্মী সমর্থকদের কেউ কেউ এই বিপর্যয়ের কারণ খুঁজতে গিয়ে মনে করছেন, তীব্র দ্বি-মেরুকরণের ফলেই তাঁদের কোল্যাটারাল ড্যামেজ হয়েছে। অনেকেই হা-হুতাশ করছেন। অনেকেই অস্বস্তিবোধ করছেন। নতুন মুখগুলো নিয়ে যাঁরা খুব লাফালাফি করছিলেন, তাঁরাও নির্বাচনে বিফলে মূল্য ফেরত হয় না বলে মুষড়ে পড়েছেন। 

তাঁরা একবারও ভেবে দেখলেন না, মুখ নতুন হলেও পেছনের মাথাগুলো কিন্তু সেই পচনশীল, ভোঁমলাগা প্রবৃদ্ধদেরই, যাঁরা বামপন্থী ভাষ্যকে কর্পোরেটের পায়ে জলাঞ্জলি দিয়ে বসে আছেন; যাঁরা স্বপ্ন দেখছিলেন ২১-এ রাম ২৬-এ বাম। স্বপ্নাদেশ পাওয়া মাদুলির মতো পচা মাথাগুলোর নির্দেশে বহু কর্মী-সমর্থক-দরদী বামের বদলে রামে ছাপ মেরে বামের অস্তিত্বকেই ধূলিসাৎ করে দিয়েছেন। বাম জমানায় চাকরি পাওয়া ভোটারদের একটা বিরাট অংশ এবং শিক্ষিত চতুর মধ্যবিত্ত উপরভদ্র স্কুল ও কলেজ শিক্ষকদের মোটা অংশই ঢেলে ভোট দিয়েছেন রামের চরণতলে। পোস্টাল ব্যালটে সিপিএমের অনুপস্থিতি সে কথাই প্রমাণ করে।      

এই পরিস্থিতিতে কয়খান কথা। 

প্রথমত, আমি মনে করি এতে শাপে বর হয়েছে। কারণ, সিপিএম যে সত্যিই একটি বামপন্থী দল নয়-- সেই বিষয়টি ভাবার অবকাশ এবার এনে দিয়েছে। দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে বামপন্থী বলতে সাধারণ মানুষ কেবল সিপিএমকেই (সিপিআই, ফরোয়ার্ড ব্লক, আরএসপি দলগুলি ৩৪-জমানাতেই সাইনবোর্ডে পরিণত হয়েছিল। বড় তরফের লাথিঝাঁটা খেয়েও স্বাধীন হতে পারেনি। তাই এঁদের ধর্তব্যের মধ্যে আনছি না।) বুঝে এসেছেন। এবার তাঁরা ভাববেন, সাম্যবাদের চাদর গায়ে চড়িয়েই বিভিন্ন সময় গণআন্দোলনকে পিটিয়ে ছাতু করেছে যে সিপিএম, প্রাইমারি থেকে ইংরেজি তুলে দিয়ে পরোক্ষে বাংলা ভাষার টুঁটি চেপে ধরেছে যে সিপিএম, ফি-বছর বাস ভাড়া বাড়িয়ে মালিকদের সেবা করেছে যে সিপিএম, গুচ্ছের গণহত্যা করে কংগ্রেসকেও টপকে গিয়েছে যে সিপিএম, দাম্ভিকতার চূড়োয় বসে রাজ্য শাসন করেছে যে সিপিএম, অতি সংগঠিত দুর্নীতির মাধ্যমে কেবলমাত্র পার্টির লোকেদের স্কুল-কলেজের চাকরি দিয়েছে যে সিপিএম, আজকের সঙ্ঘীদের মতো লোকাল কমিটি যেভাবে লোকের হেঁশেলে এবং এমনকি বেডরুমেও হস্তক্ষেপ করে পার্টিতন্ত্র চালু করেছিল যে সিপিএম, ‘কৃষি আমাদের ভিত্তি শিল্প আমাদের ভবিষ্যৎ’ স্বপ্ন দেখিয়ে টাটা-সালেমদের হাতে জোরজবরদস্তি কৃষিজমি তুলে দিয়েছিল, বাধা পেলে সঙ্ঘ-আরএসএস-বিজেপির মতো গণহত্যা করতে পিছ-পা হয়নি যে সিপিএম-- এইবার ভাবতে হবে তাঁদের দেহে সত্যি সত্যি বামপন্থার ডিএনএ আদৌ আছে কিনা।  

দ্বিতীয়ত, ২০১১-য় ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর রাস্তার গণআন্দোলন না করে সিপিএম কী করল? যে কংগ্রেস সিপিএম ও নকশালদের মেরে পাট করে দিয়েছিল, যে কংগ্রেস গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধ করে জরুরি অবস্থা জারি করেছিল, যে কংগ্রেসের নীতির রেলগাড়িতে চড়ে প্রথমে বাজপেয়ী পরে মোদী-অমিত শাহ্‌রা এনআরসি এনপিআর সিএএ করতে উঠে পড়ে লাগল, যে কংগ্রেসের উদারিকরণের হাওয়ায় ভর করে মোদী কর্পোরেটদের হাতে দেশ তুলে দিচ্ছে, সেই কংগ্রেসের সঙ্গেই গাঁটছড়া বাঁধল। আপনাদেরই তকমা দেওয়া সেই ‘আধা ফ্যাসিস্ট’ কংগ্রেস অচ্ছুৎ হল না, অচ্ছুৎ হয়ে গেল এসইউসিআই, সিপিআইএমএল-এর মতো দলগুলি; যাঁরা বামপন্থার ধারাকে ধরে রাখতে রাস্তায় নেমে এখনও মার খেয়ে টিমটিম করে জ্বালিয়ে রেখেছে গণআন্দোলনের ঐতিহ্য। বিহারে সিপিআইএমএল-এর দুই অঙ্কের আসন পাওয়া সত্ত্বেও তাঁদের সঙ্গে জোট করা গেল না কমরেড, তাই না! 

তৃতীয়ত, আপনাদের ক্ষমতান্ধ চোখ দেখতে পেল না, সাম্প্রদায়িকতার সরাসরি সুড়সুড়িতে শহুরে ‘হিন্দু’রা একটু একটু করে সরে যাচ্ছে বিজেপির দিকে। কলকাতা বাদে রাজ্যের বাকি বড় শহরগুলোর ফল সে কথারই সাক্ষ্য বহন করে। ভাবলেন, একটা মোক্ষম চাল দেওয়া যাক। এতে মমতাকেও টাইট দেওয়া যাবে, মুসলিম ভোটেও বামের ঝোলা ভরে উঠবে। সেই নীতি কার্যকর করতে হাত মেলালেন আব্বাস সিদ্দিকির সঙ্গে। এর ফলে কী হল? সাধারণ হিন্দুরা স্পর্শকাতর হয়ে গেল। আর মুসলমানরা মমতার আঁচল আরও চেপে ধরল। সেটাই কি স্বাভাবিক নয়? ২৪/২৫ শতাংশ মুসলিম ভোট কুড়িয়ে জেতার খোয়াব দেখতে এতটাই অন্ধ হয়ে গেলেন যে, আদ্যন্ত মুসলিম মৌলবাদী ভাইজানের সঙ্গে হাত মেলানোর ফলে বেঁচেবর্তে থাকা ৯/১০ শতাংশে কী ধস নামতে পারে সেই ভবিষ্যৎ দেখার চোখটুকুও আর অবশিষ্ট রইল না। একবারও ভাবলেন না, ভাইজানের কোনওরকম আন্দোলনের ইতিহাস নেই, মুখখানাও মৌলবাদী বক্তব্যে পরিপূর্ণ। বরং বিহারে বিজেপি-র গোপন মিত্র ছিল এই ইন্ডিয়ান সেকুলার মজলিস পার্টিই। সেই খাম চিহ্নে বাঙালি মুসলমানরা ভোট ঢেলে দেবে-- এত সহজ ভোটের অঙ্ক? বরং, ভাইজানের ভিডিও দেখে কেবল হিন্দু মেয়েরা নন, মুসলমান মেয়েরাও ভয় পেয়ে আঁকড়ে ধরলেন মমতাকেই। 

চতুর্থত, দীর্ঘ দশ বছর শীতঘুমে কাটিয়ে ভোটের আগে একখানা নবান্ন অভিযান করে ভাবলেন গণআন্দোলনের খরা কেটে গেল। এইবার ঝুপঝুপ করে সব ভোট পড়বে, ঝোলা উপছে উঠবে। এদিকে ব্রিগেডের ভিড়ের ভুল ব্যাখ্যা করলেন-- টুপি-দাড়ির ভিড়কে আন্দোলনের ফসল ভেবে বসলেন। টুম্পাসোনা গেয়ে সাবঅল্টার্ন হওয়ার সাবকনসাসের চাপা পুলকে ও ক্ষমতা ফিরে পাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষায় প্রধান শত্রু ফ্যাসিস্ট বিজেপিকে আড়াল করলেন; কখনও বিজেপির কন্ঠে সুর মিলিয়ে 'মিলে সুর মেরা তুমহারা' করে ভাবলেন তৃণমুলের দফারফা করে ছাড়লেন। আসলে, বিরোধী আসনে থেকে কীভাবে ভোট সংগঠিত করতে হয় তা তো ভুলে গিয়েছেন ৩৪ বছরের মৌতাতেই!   

শুধু কি তাই! উত্তর ভারতে কৃষকদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণআন্দোলনকেও আপনারা ম্যালাইন করতে চেয়েছিলেন ভেতর থেকে। আপনারা তলে তলে কর্পোরেটদের বিশ্বাস অর্জনের খেলা চালাচ্ছেন। আর মনে মনে ভাবছেন লোকে জানতে পারবে না। কর্পোরেটদের বান্দা হওয়ার চুক্তি নবীকরণ করতে দলের সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি কৃষক-সরকার দ্বি-পাক্ষিক বৈঠকে তৃতীয় পক্ষ হিসেবে পুঁজিপতিদেরও আলোচনায় বসার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। ভেবেছিলেন, লোকে অতশত কথা জানতে পারবে না। আসলে আপনারা নিজেরাই নিজেদের প্রকৃত শ্রেণিগত অবস্থান মানুষের কাছে চিনিয়ে দিয়েছেন। সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে এসব আর চাপা থাকে না। 

এহো বাহ্য, একটি সাম্যবাদী দলের মুখপত্রে ফ্যাসিস্ট দলের বদনমণ্ডল সহ প্রধানমন্ত্রীর ভোটভিক্ষার বিজ্ঞাপন ছাপতেও আপনাদের ‘বাম’হৃদয়ে এতটুকু কাঁপন লাগে না! আপনাদের এই ভোটসর্বস্ব ধ্যাস্টামো নীতি সম্প্রীতিতে আস্থাশীল বাঙালি সজোরে প্রত্যাখ্যান করে আপনাদের গালে যে চড়টি মারলেন তার তাৎপর্য এবারে বুঝতে পেরেছেন? ফ্যাসিস্টদের প্রবল আগ্রাসনকে রুখতে যদি কেবল অফবিটের বাম দলগুলোর সঙ্গে জোট করতেন, তাহলে না জিতলেও অন্তত জাতটুকু বজায় থাকত। তা না করে বিজেপির আইটি সেলের মতো আপনারাও ‘নো ভোট টু বিজেপি’ আন্দোলনকারীদের কেবলই কটূক্তি করে গিয়েছেন। তাই আপনাদের আমও গেছে, ছালও গেছে। 

ভালই হল। নীলবর্ণের শেয়ালকে মানুষ স্বরূপে দেখতে পেল। আপনাদের প্রতি মানুষের যেটুকু মোহমায়া ছিল সেটা সম্পূর্ণ কেটে গেল। এর ফল ভালো বৈ খারাপ হবে না। বরং, রাস্তার আন্দোলন আরও জোরদার হয়ে উঠবে। রাস্তায় পড়ে পড়ে মার খাওয়া এই একুশ শতকেও কৌটো বাজিয়ে আন্দোলনের পয়সা তোলা দু' একটি দল এবার চোখের সামনে প্রকট হবে। মানুষ এবার বিকল্প হিসেবে তাঁদের ভাবতে পারবেন। সেরিব্রাল কর্টেক্সে জমে থাকা মেদ ঝরিয়ে আপনারাও সেই পথে নেমে মানুষের কাছে আবার প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠার সুযোগ পাবেন। 

সে অনেক শতাব্দীর মনীষীর কাজ বলে হাত-পা গুটিয়ে বসে না থেকে একবার ভাবুন, আপনার প্রধান শত্রু তৃণমূল নয়। বরং বামপন্থীদের করণীয় কাজগুলো অর্থাৎ সংসদীয় ব্যবস্থায় থেকে যতটুকু সম্ভব রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দরিদ্রদের মধ্যে বন্টন করার কাজটি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যথাসম্ভব করেছেন বলেই গরিব মানুষ উজাড় করে নেত্রীকে সমর্থন দিয়েছেন। তাই অযথা মমতাকে চাঁদমারি না বানিয়ে আরএসএস-বিজেপিকে শ্রেণিশত্রু মনে করুন। ফ্যাসিবিরোধী লড়াইয়ে নেত্রীও আপনার স্বাভাবিক মিত্র হতে পারেন- এমন সম্ভাবনা অচিরেই আসবে। আগামী দিনের ইতিহাস অন্তত তাই মনে করছে। অতএব, সিপিএম নেতৃত্বের আগামী সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করছে তাঁদের সত্যিকারের বাঁচা-মরা।


8 comments:

  1. চমৎকার লিখেছেন। খুব ভাল লাগল। অভিনন্দন। @ প্রবুদ্ধ বাগচী

    ReplyDelete
  2. হাতুড়িটি পেরেকের একদম মাথায় মেরেছেন শিবশংকর বাবু, মোক্ষম।মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করা এই দলটিকে মানুষ সঠিক জায়গা দেখিয়েছেন, ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে। এবার যদি শূন্য থেকে শুরু হয় একটা নতুন ধারার বামপন্থার।

    ReplyDelete
  3. একটি দাম্ভিক জনবিচ্ছিন্ন ভোটবাদী দলের এই পরিণতি অবশ্যম্ভাবী ছিল।আসলে এখনও কিছু মানুষ আশা রাখেন সি পি এম একটি বামপন্থী দল।তাদের সময় এসেছে বিকল্প অনুসন্ধানের।

    ReplyDelete
  4. বলিষ্ঠ বিশ্লেষণ।বাম আন্দোলনের পুনর্জাগরণের প্রকৃত সময় এটাই।এই সুযোগ কাজে লাগাতে না পারলে ভারতবর্ষের বাম আন্দোলন আর ঘুরে দাঁড়াতে পারবেনা।লক্ষ্য একটাই ফ্যাসিবাদী শক্তির বিরুদ্ধে জোরদার ঐক্যবদ্ধ বাম আন্দোলন।

    ReplyDelete
  5. ভালোলাগলো স্যার।

    ReplyDelete
  6. A neutral outlook is what the people want and jethu, that's what your writing holds ...confused minds can get a strong avenue having read this wonderful piece of your work.

    ReplyDelete
  7. দারুন বিশ্লেষণ

    ReplyDelete
  8. পশ্চিমবঙ্গে 2021 সালের ভোটের পর রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্বন্ধে সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করা হয়েছে লেখক কে সাধুবাদ ও ধন্যবাদ জানাই । - নির্মল দাস। জামশেদপুর, ঝড়খান্ড, জেলা- সিংঘভৃম

    ReplyDelete