'নো ভোট টু বিজেপি' কি
মৌলিক সমস্যাগুলির দিকেও তাকাবে?
অশোকেন্দু সেনগুপ্ত
'নো
ভোট টু বিজেপি' নিছক কোনও সংগঠন নয়, একটা আন্দোলনের নাম। এমন আন্দোলন এপার
বাংলার মানুষ দেখেনি বহুকাল, অন্তত প্রায় ১৩-১৪ বছর (সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম
আন্দোলন বিবেচনায় রেখে বলছি)। স্বতঃস্ফূর্তভাবে মানুষ তাদের ডাকে সাড়া
দিয়ে পথে নেমেছে, সভা করেছে নিজের নিজের হাজারও দুঃখ, অভিমান, অভিযোগ বুকে
চেপে।
অন্যদিকে, একই সাথে এই আন্দোলন চোখে আঙুল দিয়ে
দেখিয়ে দিল, আমাদের বহু রকমের সামাজিক দৃষ্টি ও রাজনৈতিক দূরদর্শিতার
সীমাবদ্ধতা। আবার, সমবেত উদ্যোগ আমাদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে যে পৌঁছে দিতে পারে, সে আত্মবিশ্বাসও এই আন্দোলন ফিরিয়ে দিয়েছে।
কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য কী?
দিল্লি-পাঞ্জাব
সীমান্ত অঞ্চল থেকে এসেছিলেন কিছু কৃষক নেতা। তাঁরা এবং আমরা সবাই এক সুরে
বলেছি, এই অপশাসনের অবসান চাই, ফ্যাসিবাদের অবসান চাই, চাই বহুস্বর
গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা। এসবের জন্য চাই 'নো ভোট টু বিজেপি'। ২০১৯-র ভুল যাতে
আমরা আর না করি তারই জন্য এই উদ্যোগ, কোমর বেঁধে আসরে নামা। এই উদ্যোগ মনে করিয়ে দেয় মার্টিন লুথার কিং-এর সেই আন্দোলন। কালো মানুষদের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন।
মুশকিল
বা পার্থক্যও আছে। এ তো কোনও বিশেষ সম্প্রদায়ের অধিকার রক্ষার লড়াই ছিল না,
এই লড়াই ছিল সব শ্রেণির, সব পেশার, সব ধর্মের মানুষের গণতান্ত্রিক
অধিকার ফিরিয়ে আনার লড়াই।
কিন্তু, এই কী শেষ?
ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইতেই কী শেষ হবে এমন আন্দোলন? সেই কি কাঙ্ক্ষিত
লক্ষ্য? একমাত্র লক্ষ্য? সংগঠন যা বলার বলেছিল, আমরা সাধারণ মানুষ কী
তাই চেয়েছিলাম? মনে প্রশ্ন ছিল: কোথায় আমাদের পৌঁছে দেবে এই আন্দোলন? এই
আন্দোলন আমাদের সমাজ জীবনে, রাষ্ট্র জীবনে স্থায়ী ছাপ ফেলবে তো? আন্দোলন শেষে
আমরা সংস্কারমুক্ত হব- হব তো? সাম্প্রদায়িক ভাবনা (ধর্ম, জাতপাত) মুক্ত
সমাজ পাব তো? ফ্যাসিবাদের পতনেই খাদ্য-শিক্ষা-চিকিৎসার সমস্যা মিটবে?
মনে
পড়ছে মিলখা সিং ও তার চোর ধরার গল্পটা। এত জোরে দৌড়লেন তিনি, কখন যে
চোরকে পার হয়ে গেছেন তা খেয়ালেই রইল না। কাল্পনিক এক অবাস্তব গল্প। 'নো ভোট
টু বিজেপি' আন্দোলন যেন তারই সাম্প্রতিক সংস্করণ হয়ে উঠল। সে তো কল্পনা নয়!
প্রশ্ন
উঠেছিল বিজেপি নয় তা বুঝলাম, তো কাকে দেব ভোটটা? আন্দোলনের উদ্যোক্তাদের
কাছে এর জবাব ছিল না এমন নয়, ছিল, তবে তা নিয়ে মতান্তর বুঝি বেশি ছিল। তাই
যে যার মতো বলেছিলেন। কেউ স্পষ্ট বলেননি কিছু। কৃষক নেতারাও না। হয়তো
উদ্যোক্তাদের ঘোষিত বা অঘোষিত নিষেধ ছিল। সেই সব নেতাদের রাজনৈতিক পরিচয় ঘাঁটলেই বোঝা যায় কেন তারা স্পষ্ট কিছু বলতে পারেননি।
বাংলার
রায় প্রকাশ পেতেই বোঝা গেল, মানুষ যেমন চেয়েছিলেন প্রায় তেমনটাই ঘটেছে।
অন্তত এই রাজ্যে মুখ থুবড়ে পড়েছে ফ্যাসিবাদের ধ্বজা। বিজেপি সংখ্যাগরিষ্ঠতা
থেকে বহু যোজন দূরে রইল। শাসকের আসনে ফের বসল তৃণমূল কংগ্রেস। কিন্তু, কিছু ব্যথাও রইল। বিরোধী দল হয়ে দেখা দিল বিজেপি। প্রধান নয়, তারাই এই বঙ্গে হয়ে উঠল একমাত্র বিরোধী দল। সঙ্গে আইএসএফ!
কেউ
কেউ খুশি হলেও সকলে খুশি হতে পারেন না এই রায়ে। তাদের কেউ কেউ জীবনানন্দীয়
ভাষায় প্রশ্ন করছেন: 'এই রায় চেয়েছিলে বুঝি'। কংগ্রেস নেই, বামেরা নেই। সব
বামই তো 'বাংলা সিপিএম' নয়। সব বামেতেই তো সুজন-সেলিম নেই। সব বামই তো 'আগে রাম পরে বাম' তত্ত্ব বিশ্বাস করে না। কিছু জাতীয়তাবাদী মানুষ তো
কংগ্রেস দলটিকে সমর্থন করে আজও। তারাও তো ফ্যাসিবাদ থেকে মুক্ত হতে চায়। সবার ঘর শূন্য।
গণতন্ত্র
থাকলে, সেখানে শাসকের যা-ইচ্ছে-তাই সামলাতে থাকে বিরোধী পক্ষ। বিরোধী পক্ষ
গণতন্ত্রকে ফ্যাসিবাদের পথে টেনে নিতে বাধা দেবে শাসককে। এ তো সত্য। অন্তত
এই রাজ্যে যে দলগুলি প্রধান বিরোধী আসনে বসেছে গত দশকে, তারা
কার্যত ব্যর্থ। সফল হবার চেষ্টাই করেনি। তারাও সুযোগ এলে হয়তো গণতন্ত্রকে
ফ্যাসিবাদের পথে টেনে নিতে পারে। কিন্তু যে দলকে এবার বিরোধী আসন দিলাম তারা নিজেরাই যে গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে না। আমাদের তা অজানা ছিল না।
কী
হবে? অনেকেই হতাশ। লকডাউন গরিব, অতি নিম্নবিত্তের পেটে লাথি মারে- যিনি এই
কথা অতি সহজে বুঝেছিলেন, তিনি এখন আরেকবার ক্ষমতা হাতে পেয়ে অতি সহজে
আমলাদের কথা শুনে রাজ্য জুড়ে কার্যত লকডাউনের ফাঁস ঝুলিয়েছেন। তাঁরও কিছু
সমস্যা নিশ্চয় আছে। শ্রেণিস্বার্থ? তাও পুরো সত্য নয়। রাজ্য জুড়ে করোনার
দাপট রাষ্ট্রব্যবস্থার অস্তিত্ব বিপন্ন করে তুলেছে যে, ক্ষমতা হাতে পেয়ে
তিনি (এখন ক্ষমতার অংশ) করোনাকে বাগে আনার যুদ্ধ ত্যাগ করতে পারেন না।
তার ওপর 'ইয়াস'এর তাণ্ডব।
এমন
যুদ্ধ হয় নাকি যেখানে প্রাণ যাবে না কারও! কিছু ক্ষতি তো হবেই। তাই এখন
তিনি ডাক দিয়েছেন, পাশে থাকুন। যারা পাশে থাকবেন না তাদের অবস্থা কী হবে? না ঘরকা, না ঘাটকা! কে জানে! অন্তত তাদের জানার উপায় থাকবে না। যেমন বুলেট
জানে না সে কার প্রাণ নিতে ছুটেছে। ওদিকে, যে বা
যারা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে নির্বাচন শেষ হলেই কৃষকের ঘরে ঘরে টাকা ঢেলে
দেবে, তারাও কথা রাখেনি। তাদের অযোগ্যতা ও সংকীর্ণতায় দেখছি মৃত্যু মিছিল।
দেখছি নদীতে ভেসে যায় শব, দেখছি আর অপেক্ষায় আছি সেন্ট্রাল ভিস্তার! যে
টাকা তারা বিধানসভা দখলে ঢেলেছে, তার কিছুটাও যদি ঝড় সামলাতে ব্যয়িত হত
তবে স্বস্তি পেত মানুষ। হায় রে মানুষ! সত্য যে তোর পাশে দাঁড়ায় না।
জানতাম
না এমন তো নয়, জানতাম যে সংসদীয় রাজনীতিতে মত্ত বর্তমান দলগুলি কেউই কথা
রাখে না। তবু, মানুষ- অন্তত শহরাঞ্চলের বহু মানুষ বিত্ত, ধর্ম ভুলে বা
সাম্প্রদায়িক শক্তির আস্ফালন ঠেকাতে, বাংলার ঐতিহ্য তথা সংস্কৃতি বাঁচাতে
খানিক বাধ্য হয়েই 'নোটা' নয়, 'নো ভোট টু বিজেপি' স্লোগানে ভরসা রেখেছে,
বিকল্প সন্ধান করেছে। তাদের অনেকে এখন জবাব চাইছে। জবাব দিতে পারত যারা
তারা অনেকেই নিরুদ্দেশ, এই ভয়ংকর করোনা-কালে বা ঝড়জলের মধ্যে তাদের খুঁজতে
যাওয়ার জন্য যে বেরবে মানুষ তারই বা উপায় কী? আপনি চাইলে মিষ্টি বা গহনা
কেনার জন্য বেরতে পারেন, কিন্তু কাজে বেরনোর 'হুকুম' নেই। 'পাস' চাই।
গাড়ি-ঘোড়াও নেই। অতএব, একা একা খোঁজ, একা হয়ে খোঁজ। পেটে কিল মেরে বসে থাকো
তোমরা যারা নগরে-বন্দরে খেটে খাও, 'ভদ্রলোকের' বাড়ির বাসন মেজে খাও বা লেদ
চালাও বা গেঞ্জি কারখানায় কাজ করো বা বই-বাঁধানোর কাজ করো।
যে
সব রাজ্য থেকে কৃষক নেতারা এসেছিলেন, সে সব রাজ্যে অন্তত বর্তমানে, বামেরা
কার্যত নেই। জাতীয়তাবাদীরা আছেন বটে, তবে তাঁরা আছেন নানা দল-উপদলে ভাগ
হয়ে। তাই 'নো ভোট টু বিজেপি' ভুক্তদের সাময়িক তুষ্ট করতে তাঁদের তেমন
অসুবিধা হয়নি। এখানে 'নো ভোট টু বিজেপি' নেতৃত্ব প্রশ্ন তুলেছেন কৃষক
আন্দোলনের নেতৃত্বে হান্নান মোল্লার উপস্থিতি নিয়ে, চুপ থেকে মেনেছেন
টিকায়েতের উপস্থিতি। কিন্তু বিধানসভায় একমাত্র বিরোধী দল বিজেপি (আইএসএফ'এর
উপস্থিতি নামেই)- তাই বা মানা যায় কী? কে বলবে? এই তো সেদিন এক আলোচনাসভায়
'নো ভোট টু বিজেপি' আন্দোলনের এক নেতা স্পষ্ট জানালেন যে, বিধানসভায়
বিরোধী দল বিজেপি হওয়ায় বা কোনও বামমনস্ক প্রতিনিধি না থাকায় তিনি কোনও
সমস্যা দেখছেন না। তবে কী মানবো যে রজ্জুতে সর্পভ্রম হচ্ছে সাধারণের?
এটা এই দেশের যে কোনও সংগঠনের রীতি। তারা সবেতেই দোষ দেয় মানুষকে বা ভোটারকে। এই সংগঠনও সেই পথ ধরবে?
এই
যে আমরা 'ইয়াস'এর তাণ্ডব দেখলাম, এই তাণ্ডবকালেও কেন্দ্রের অমানবিক
একদর্শিতা বা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কারাগারে নেওয়া নিয়ে বিচারব্যবস্থার
নানা প্যাঁচ-পয়জার বা মুখ্যসচিবকে নিয়ে যে টানাটানি, তাতে স্পষ্ট যে
বিজেপি রাজ্য সরকারকে স্বস্তিতে শাসন করতে দেবে না। বলবে কে? কে বোঝাবে
তাদের যে সাপটা এখনও মরেনি, আহত হয়ে সে আরও শক্তিশালী মাটি খুঁজে লড়তে চায়,
বিষ ঢালতে চায়। আসছে পঞ্জাব, উত্তরপ্রদেশ প্রভৃতি রাজ্যে নির্বাচন। সে সব
রাজ্যের মানুষের কাছেও একই আবেদন 'নো ভোট টু বিজেপি' নিয়ে তাঁরা যাবেন কি? নিশ্চয় যাবেন (তাঁদের ঘোষণা তেমনই ছিল), কিন্তু সফল হবেন কী?
পূর্ণ হবে কী আশা? তাও বুঝি সম্ভব হবে। বিজেপির নখ-দাঁত বিষ অস্ত্রাদি অনেক
অনেক মানুষ দেখেছে, বুঝেছে। বুঝেছে মানুষটা কেবল নাটক করে, মিথ্যা বলে-
দেশের কথা বা দশের কথা ভাবে না। সংস্কৃতি বা ঐতিহ্য নিয়ে তার মাথাব্যথা
নেই। কিন্তু সাধারণ মানুষ তো জানতে চাইবেই একদিন, কেন তোমরা রাষ্ট্রশক্তির
অত্যাচার সইবে, কেন মানবে যে কেবল মোদী থেকে মুকুল রায় বা মমতা
বন্দ্যোপাধ্যায়ের দেওয়া আঘাত সয়ে সয়ে মানুষ সুন্দরবনে, পাহাড়ে, জঙ্গলে
মনুষ্যেতর জীব হয়ে টিকে থাকবে ভোট নামের বিচিত্র উৎসবে যোগ দিতে? স্থায়ী
সমাধান পাবে না? কেন জাতপাতের সমস্যা থাকবে, কেন পাবে না সব মানুষ খাদ্য,
শিক্ষা, স্বাস্থের অধিকার, বাঁচার অধিকার, ভালবাসার অধিকার? গণতন্ত্র অবশ্যই
চাই, কারণ পৃথিবীতে বারবার প্রমাণ হয়েছে যে স্বৈরতন্ত্র নয় গণতন্ত্রই
মানুষকে বাঁচায়, সম্মান দেয়।
'নো ভোট টু বিজেপি' দেখবে
না এই সমস্যাগুলি? তারা কী কেবল ভোট-রাজনীতি নিয়েই মত্ত থাকবে? মানুষের
মৌলিক সমস্যাগুলির দিকে তাকাবে না? মানুষের অন্তরে যে বিষ ঢুকে রয়েছে তা
দূর করার উদ্যোগ নেবে না 'নো ভোট টু বিজেপি' আন্দোলন? মানুষ তবে যাবে কার
দ্বারে?
খুব ভালো লেখা। অত্যন্ত মূল্যবান।
ReplyDeleteনো ভোট টু বিজেপি আন্দোলনের প্রতি মানুষের যে এই দাবি ও প্রত্যাশা, সেটা সম্পর্কে নেতৃত্বকে অবশ্যই অবহিত হতে হবে ও আগামী দিনের কর্মপরিকল্পনা ঠিক করতে হবে।
ReplyDeleteআপনি হঠাৎ 'নো ভোট টু বিজেপি' নিয়ে পড়নেন কেন? আপনার অবস্থান কি? আপনি কি চান? আপনার মতবাদ নিয়ে আপনি কোন আন্দোলন গড়ে তুলুন না। মানুষ তো সেটা পছন্দ করতে পারেন।
ReplyDelete