Sunday 2 May 2021

বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি

বাংলাকে জেতালো বাংলার মেয়েরাই

শোভনলাল চক্রবর্তী


নিউজফিডে আছড়ে পড়ছে একের পর এক টাটকা আপডেট, নিউজ চ্যানেলগুলোতে উঠে আসছে চমক লাগানো ব্রেকিং নিউজ, সমাজ মাধ্যমে যথেচ্ছ উদ্গার, কাদা ছোড়াছুড়ি, গালাগাল। এইসব মিলিয়ে যত বেলা বেড়েছে তত স্পষ্ট হয়েছে চিত্র। এবারের ভোটে মানুষের অংশগ্রহণ ছিল অভূতপূর্ব। সারা ভারতের ভোটদানের নিরিখে দেখা যাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের আমজনতাই দেশের মধ্যে সব থেকে প্রখর রাজনীতি সচেতন। মতদানের অধিকার প্রয়োগে সব থেকে সক্রিয় তাঁরাই। বাংলার এবারের বিধানসভা ভোটে মেরুকরণের তত্ত্বকে তুড়ি মেরে এই আমজনতাই, বিশেষ করে বাংলার মহিলা ভোটাররা, তাঁরাই হয়ে উঠেছেন নির্ণায়ক শক্তি। এই ৪৯ শতাংশ মহিলা ভোটারকে কেউ যদি নিছক মতামতহীন পেন্ডুলাম মনে করেন, পুরুষের মতের নির্দেশবাহক মনে করেন, তবে মস্ত ভুল করবেন। 

বিগত কয়েক বছরে মেয়েদের দিকে তাকিয়ে, মেয়েদের জন্য গৃহীত বিভিন্ন প্রকল্প, শিক্ষা ক্ষেত্রে বিভিন্ন স্কলারশিপ ও তার সফল রূপায়ণ বাংলার গ্রামেগঞ্জে নারী প্রগতির এক নতুন অধ্যায় শুরু করেছে। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে, বিশেষত উচ্চশিক্ষায় ছেলে-মেয়েদের ভর্তির আনুপাতিক হার লক্ষ করলেই সেটা টের পাওয়া যাবে। গ্রামীণ বাংলায় সামাজিক ও পারিবারিক কাঠামোয় মেয়েদের এই উত্থানকে যদি বর্তমানের ভোটের ফলে ধর্তব্যের মধ্যে না আনা হয়, তবে হিসেবে বড় গলদ থেকে যাবে। 

ভোটের আগে কলকাতার শহরতলির 'প্রথম ভোটারদের' ওপর একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, মেয়েরা প্রায় সকলেই দ্বিধাহীন ভাবে মমতা সরকারকেই ক্ষমতায় দেখতে চান। এটা একটা খণ্ড চিত্র, কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ। রাজ্য জুড়ে গণতন্ত্রের বৃহৎ উৎসবে অনিবার্যভাবে যে মুখগুলি, যে মুঠো করা হাতগুলো আমরা চ্যানেলে চ্যানেলে দেখেছি, যাঁদের দৃপ্ত কণ্ঠস্বর সংবাদদাতার চিৎকার ম্লান করে দিয়েছে, যাঁদের সমবেত প্রতিরোধের সামনে নিরাপত্তারক্ষী সহ ভোটপ্রার্থী ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা পিছু হঠতে বাধ্য হয়, তাঁদের নিছক জনপিণ্ড ভাবলে ভুল হবে। কাজেই নিছক দাবার ঘুঁটি হিসেবে নয়, মানুষকে তার ওজনে ভাবতে হবে। ওনারা কেউই পুতুল নন যে কারুর প্ররোচনায় দলে দলে হাতা খুন্তি নিয়ে বন্দুকের নলের সামনে দাঁড়িয়ে পড়বেন। 

হিংসা রক্তপাত কিংবা হত্যার ভয়াবহতায় আমরা শিক্ষিত মধ্যবিত্তরা ভয়ে কুঁকড়ে যাই, ভোটকেন্দ্রমুখি হওয়ার পরিবর্তে নিরাপদ থাকার অজুহাত খুঁজতে থাকি। রাজনীতির যারা ঘৃণ্য উপাসক, তারা সেটাই চায়, আমাদের মনের মধ্যে ভয়ের বীজ পুঁতে দিতে। যারা খেলা শুরুর আগেই পরাজয় মেনে নেয়, তারা কোনওদিনই নির্ণায়ক হয়ে উঠতে পারে না। নির্ণায়ক হয়ে ওঠে তারাই যারা ভয়কে তুড়ি মেরে নিজেদের ভালোমন্দ বেছে নেওয়ার অধিকার প্রয়োগের জন্য সর্বস্ব দিতে পারেন। ওঁদের সাম্প্রতিক অতীতে আছে দারিদ্র্য অনটন আর কাজ হারানো পরিযায়ী শ্রমিকের ভয়াবহ মৃত্যু মিছিলের স্মৃতি। ওঁদের সামনে ছিল বন্দুকের নল, নাগরিকত্ব হারানোর ভয়, ডি-ভোটার হয়ে যাওয়ার ভ্রূকুটি কিংবা ডিটেনশন ক্যাম্পের রক্তচক্ষু। সংখ্যাগুরু কিংবা সংখ্যালঘু দিয়ে মেয়েদের ভাগ করা যায়নি। উত্তর ভারতীয় ধর্ষকাম, পুরুষতান্ত্রিক সমাজের যে নোংরা ইঙ্গিত, যার নেতৃত্ব দিয়েছেন স্বয়ং দেশের প্রধানমন্ত্রী, সেই তাঁর মুখেও ঝামা ঘসেছেন ওই মেয়েরা। জনাদেশ বলে দিচ্ছে মেয়েদের সম্মান দিতে শিখুক প্রধানমন্ত্রীর দল। ওই মেয়েরাই এবার বাংলাকে জিতিয়েছেন। 

বাংলার তথাকথিত শিক্ষিত রাজনীতি সচেতন মানুষজন যখন 'দোষ কার'-  বর্তমান শাসকের নাকি আগত বর্গী দলের- এই আবর্তে হারিয়ে গেলেন, তখন তাঁরা এর বাইরে যে বিপুল মানুষ তাঁদের দিকে ফিরেই তাকালেন না। যাঁদের উলুখাগড়া বলে ধর্তব্যের মধ্যে আনেননি কেউ, সেই তাঁরাই আজ জয় ছিনিয়ে এনে দিলেন। মেয়েদের পেন্ডুলামের দোলায় দোলায়মান নিছক ক্ষমতার হাতের পুতুল ভাবা উত্তর ভারতীয় রাজনীতির নেতারা এবং তাদের বঙ্গ ব্রিগেড আশা করি এরপর মেয়েদের প্রতি একটু শ্রদ্ধাশীল হবেন। এটা উত্তরপ্রদেশ নয় এটা পশ্চিমবঙ্গ, সবার আগে সেই শিক্ষাটা নিন আপনারা। 

করোনার দ্বিতীয় প্রবাহের মধ্যে ঘটে যাওয়া তিনটে দফায় ভোট পড়েছে ৭৫ শতাংশ। যার মধ্যে ছিলেন বিপুল পরিমাণ মহিলা ভোটার। বিজেপি'র বিরুদ্ধে তাঁদের ভোট বাক্সে ক্ষোভ উগরে দেওয়ার ছিল বলেই অতিমারি কখনই পশ্চিমবঙ্গের মানুষকে গণতন্ত্রের মূলস্রোত থেকে ফিরিয়ে আনতে পারেনি। টিকা সংকট, অক্সিজেন সংকট, গণদাহ- পাহাড় প্রমাণ প্রতিবন্ধকতা সরিয়ে বাংলার মানুষ গণতন্ত্রের জয়ধ্বজা ওড়ালেন। 

২০২১'এর বিধানসভা ভোট হয়ে রইল একটি জল বিভাজিকা, যেখানে দীর্ঘমেয়াদী নির্ঘন্ট, কেন্দ্রীয় বাহিনীর বিপুল উপস্থিতি, তাদের অতি সক্রিয়তা, প্রধানমন্ত্রী-স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সহ একদল কেন্দ্রীয় নেতাদের মাটি কামড়ে পড়ে থাকা, সব কিছুর ঊর্ধ্বে উঠল বাংলা, বিশেষ করে মেয়েরা। এঁরাই পথ দেখাবেন আগামীর ভারতবর্ষের। বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি, চিনে নিক দুর্বৃত্ত।


4 comments:

  1. সারা দেশের সামনে উদাহরণ হল বাংলা। বিজেপির রথের চাকা বসিয়ে দিল। জয় মমতার রাজনীতি।

    ReplyDelete
  2. বিজেপি কে এবার বাংলায় পথের লড়াইতেও হারাতে হবে।NovotetoBjP খুবই কার্যকর হয়েছে!!

    ReplyDelete
  3. ধন্যবাদ।
    সহমত আপনার বিশ্লেষণের সঙ্গে।
    মহিলাদের এই ভূমিকা নিয়ে খুব একটা আলোচনা চোখে পড়ে নি।

    ReplyDelete
  4. বিজেপিকে ভোট না দিয়ে ধর্মীয় মেরুকরণ আটকানোর রিফ্লেকশন যদি এই রেজাল্ট হয়, সেক্ষেত্রে আই এস এফ এর সঙ্গে জোট করা সিপিএমকেও ভোট না দিয়ে কিন্তু একই ইঙ্গিত দিয়েছে মানুষ

    ReplyDelete