Friday 7 May 2021

'মন কি বাত'

আঙুল নামিয়ে কথা বলুন

সঞ্জয় মজুমদার


২০২১'এর পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে একটা দল জিতেছে এবং স্বাভাবিকভাবেই আরেক দল হেরেছে। এ আর এমন কী কথা! নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় এই ঘটনা কোনও ব্যতিক্রমী কিছু নয়। রাজধর্মের ধারকাছ দিয়ে না গিয়ে, রাজার পার্ট কিছুই না বুঝে, শুধু বুলি মুখস্থ করে, এক সচেতন সংবেদনশীল মানসিকতার রাজ্যবাসীকে বোকা ভাবার অপচেষ্টার যোগ্য জবাব গেরুয়া শিবির পেয়ে গেছে। বিধানসভার নির্বাচনী ফলাফলের নিরিখে সেই জবাবে তারা প্রকৃত শিক্ষিত কখনও হতে পারবে কিনা, তার দায়ভার আমাদের অবশ্যই নেই, থাকা উচিতও নয়। শরীরের বদ রক্তের মতো তা বেরিয়ে যাওয়াই ভালো।

প্রায় নিশ্চিহ্ন তৃতীয় শক্তির কথা মাথায় রেখেও জোর দিয়ে বলা যায়, পরবর্তী লোকসভা নির্বাচনের আগে, এই ফলাফলের, এই বাইনারি ডিভিশনের সত্যিই প্রয়োজন ছিল এবং সেটা অনস্বীকার্য। একই সাথে এও স্বীকার্য যে, শুধুমাত্র ক্ষমতা দখলের জন্য অপরিমিত রাষ্ট্রশক্তি, অর্থশক্তি এবং পেশীশক্তির আস্ফালন প্রদর্শন বন্ধ হওয়ার প্রয়োজন আছে আর তা সুস্থ গণতান্ত্রিক বোধবুদ্ধির পক্ষে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় শর্ত।

আসল উদ্দেশ্য কী ছিল 'জয় শ্রীরাম' ধ্বনির নেপথ্যে? মজার কথা হল, এ সম্পর্কে তারা নিজেরাও সম্ভবত সন্দিহান এবং দ্বিধাবিভক্ত। নির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে কোনও সুস্থ রাজনৈতিক মতাদর্শকে তা এগিয়ে নিয়ে গেছে, তাও নয়। কৃষি-বিল, শিক্ষা-বিল এবং এমন অনেক ছোট মেজ সেজ বড় খাল-বিলের চাষ করে তাৎক্ষণিক কিছু প্রতিফল মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার ইজারা নিলে যা হয় আর কি। এরপর সব কিছুই আবর্তিত হয়েছে বা হচ্ছিল সেই ভরকেন্দ্রকে মাথায় রেখেই। 

প্রধান বিরোধী দলের মর্যাদা পেয়ে বুকের ছাতি চওড়া হতেই পারে, কিন্তু সপাটে থাপ্পড় খাওয়ার জ্বালা ভুলতে পারবে কি তারা? পারতেও পারে। কারণ, নাকের বদলে নরুন পেয়ে টাক ডুমাডুম ডুম করার লোকের অভাব বাংলার গেরুয়া শিবিরে অন্তত নেই।

বাংলার ভোট বাক্সে গেরুয়া শিবিরের প্রতি তীব্র ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ কি কোনওরকম কারণ বর্জিত? শুধুমাত্র 'জয় শ্রীরাম' বা 'সুনার বঙ্গাল' বিরোধী? এই স্লোগান দুটির মর্মার্থ বোঝার ক্ষমতা, দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া বিজেপি কর্মী সমর্থকদের মধ্যেও কি ছিল? মনে হয় না। রাজনীতির অঙ্কেও দুটি স্লোগান সম্পূর্ণ ব্যর্থ। উত্তর ভারতের গো-বলয়ের হিন্দু ধর্মের ধ্বজাধারী নেতৃত্ব কেমন করে বাংলা বলেন- এই মশকরা করতেও বাঙালি সভা সমিতিতে, পথসভায় যে ভিড় করতে পারে এটা বোঝার ক্ষমতাও তাদের ছিল না; বা অতি চালাকের গলায় দড়ির মতো, বুঝেও না বোঝার ভান করেছে। বঙ্গ সংস্কৃতির অঙ্গ তো দূরের কথা, বাঙালিকে, বাংলার কৃষ্টি ও সংস্কৃতিকে অল্প আয়াসে চুটকিতে রপ্ত করার নির্বোধ প্রচেষ্টা হাস্যকর। 

বাংলার ভোটযুদ্ধে ঝাঁপ দেওয়ার আগে গেরুয়া শিবিরের হোমওয়ার্ক যে অত্যন্ত দুর্বল ছিল তা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট। নানা ভাষা নানা মত এবং বহুত্ববাদের ভাবধারায় সিঞ্চিত ভারতীয় সমাজ ও সংস্কৃতির গভীর চর্চা বাঙালির ইতিহাসে শ্রীচৈতন্য থেকে শুরু করে অদ্যাবধি উজ্জ্বল হয়ে আছে। আর আছে বলেই শুধুমাত্র নিজেদের জাত্যাভিমানে সীমাবদ্ধ না থেকে, বিশ্বের দরবারে দেশের ভাবমূর্তি বাঙালি বরাবর উজ্জ্বল করে এসেছে। এত বড় একটা সর্বভারতীয় রাজনৈতিক দলের কাছে এত গুরুত্বপূর্ণ একটা বিধানসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে এসব ভাবনা-চিন্তার যে লেশমাত্র ছিল না, এই বাস্তব বোধটুকু ছিল না, এটা অত্যন্ত আশ্চর্যের। ধর্ম জাতপাতের অঙ্ক সযত্নে সরিয়ে রেখেও বলা যায়, জাতি হিসেবে বাঙালিকে এত সহজলভ্য ভাবার মূল্য চোকাতে হয়েছে তাদের। দীর্ঘকাল দক্ষিণপন্থী এবং বামপন্থী- দুই রকম রাজনৈতিক সচেতনতার গভীর স্রোতে স্নান করা বাঙালিকে নতুন সমীকরণের রাজনৈতিক পাঠ, তাও আবার কোনওরকম প্রস্তুতি ছাড়া দিতে আসায় হয়ে গেল 'এক ছোবলে ছবি'।

শুধুমাত্র তথাকথিত হিন্দু ভোটের কথাও যদি ধরা যায়, সে অঙ্কেও তারা ব্যর্থ। হিন্দিভাষী গো-বলয়ের হিন্দু ব্রাহ্মণদের নিয়ে ভোটের অঙ্ক কষে এগোলে অন্যান্য ভোট তো দূর অস্ত, দেশের অবশিষ্ট রাজ্যগুলোর হিন্দু ভোট পাওয়াও তাদের কপালে জুটবে না, জুটছেও না। সংকীর্ণ মানসিকতার প্রতিফলন প্রতিদিন তাদের কথায় ও কাজেকর্মে প্রকট হয়ে উঠছে যা কিনা তাদেরই বাণী 'সবকা সাথ সবকা বিকাশ' সম্পূর্ণ উল্টোদিকে দৌড়চ্ছে। এসব কথা বলার মানে কি এই, যারা জিতল বা নিশ্চিহ্ন হল বা দেশের অন্যান্য আঞ্চলিক বা সর্বভারতীয় রাজনৈতিক দলগুলি সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে এবং বাঙালিকে যথাযথ সম্মান দেন? এ নিয়ে তর্ক চলতে থাকবে। উত্তর মোটেই সহজ নয়। কিন্তু দেশের ক্ষমতাসীন সর্ববৃহৎ সর্বভারতীয় একটা রাজনৈতিক দলের মধ্যে চিন্তাভাবনার এই দৈন্য নাগরিক নিরাপত্তাহীনতার একটা বলয় তৈরি করে, মনকে কষ্ট দেয়। 

ক্ষমতাসীন সরকার তাদের সুকৃতির ফল ঝোলায় পুরে কত দূর আলোর দিশারী হয়ে উঠতে পারবে তা এখনই বলা অসম্ভব এবং অবাস্তব। অতিমারি করোনাই এখন মূল চালিকাশক্তি। সে একদিকে যেমন প্রাণ সংশয়ের উৎস, তেমনই সদ্য ক্ষমতাসীন এবং বিরোধী দলের স্বস্তির নিঃশ্বাসের কারণও বটে। স্বাস্থ্য পরিকাঠামোয় একটু আধটু জোড়াতাপ্পি দিয়ে, নিখরচায় ভ্যাকসিন কেন্দ্রিক দাবি-দাওয়াকে সামনে রেখে আপাতত বিকাশ এবং উন্নয়ন দুজনেই ঠাণ্ডা ঘরে সাময়িক দম ফেলতে পারবে। সাম্প্রদায়িক শক্তিকে আপাতত ঠেকিয়ে রাখা আর ভোট পরবর্তী রাজনৈতিক সংঘর্ষের আফিমে মিডিয়া এখন বুঁদ। ফলে, গলিত লাভা কবে বেরবে সে দুশ্চিন্তা এখন না করলেও চলবে। ট্রেনের হকার কি আর দেশ বা রাজ্যের অর্থনৈতিক পরিকাঠামো নিয়ে ভাবে, না ভাবার অবকাশ আছে তার?


2 comments:

  1. অসাধারণ বিশ্লেষণ

    ReplyDelete
  2. ভাবিয়ে তোলার মতো

    ReplyDelete