গঙ্গা-যমুনা দিয়ে ভেসে চলেছে
ও কাদের মৃতদেহ?
শোভনলাল চক্রবর্তী
সম্প্রতি একটি হাড় হিম করা দৃশ্য দেখে যানবাহন থমকে যায় উত্তরপ্রদেশের হামিরপুরে যমুনার উপরের সেতুতে। দেখা যায়, একসঙ্গে প্রায় এক ডজন মৃতদেহ ভেসে চলেছে নদীর স্রোতে। দুটি দেহ আটকে রয়েছে পাড়ের কাছে চরে। খবর পেয়ে ছুটে আসেন জেলা প্রশাসনের কর্তারা। ট্রাক্টর দিয়ে দেহগুলিকে টেনে এনে সৎকারের ব্যবস্থা করা হয়।
একই ছবি বিহারের বক্সা জেলায়। সেখানে প্রায় ৪৫টি মৃতদেহ ভেসে যেতে দেখা যায় গঙ্গা দিয়ে। বিহারের মানুষের দাবি, এভাবে মৃতদেহ জলে ভাসিয়ে দেওয়ার রেওয়াজ নেই বিহারে। মৃতদেহগুলি ভেসে আসছে উত্তরপ্রদেশের দিক থেকে। চাপে পড়ে উত্তরপ্রদেশের পুলিশ সুপার স্বীকার করেছেন যে কানপুর এবং কানপুর দেহাতে মৃতদেহ সৎকার না করে তা জলে ভাসিয়ে দিচ্ছেন মানুষ। কারণ, উপচে পড়ছে মর্গ; শ্মশানে, কবরস্থানে কোথাও 'ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই' অবস্থা।
নদীতে ভেসে যাওয়া লাশ ফিরিয়ে আনছে ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের ভয়াবহ স্মৃতি। গত এক বছরে উত্তরপ্রদেশের যোগী আদিত্যনাথের কোভিড পরিষেবার যে ছবি বারবার সামনে এসেছে তা হল, হাসপাতালে ভয়াবহ অরাজকতা। কোভিড ওয়ার্ডে সারি সারি মৃতদেহের পাশে শ্বাসকষ্টে ভোগা রোগীদের কাতরানিতে বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে, কেউ ঘেঁষছে না কাছে। কোভিডের মৃত্যু সংখ্যা যখন আকাশছোঁয়া তখন অবস্থা স্বাভাবিক দেখাতে মৃতদের দেহ সৎকার না করে গোপনে নদীর জলে ভাসিয়ে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। প্রশাসন অবশ্য অন্য কথা বলছে। তাদের দাবি, বাড়িতে যাঁরা মারা যাচ্ছেন, তাঁদের দেহগুলি ভাসিয়ে দেওয়া হচ্ছে জলে। সাধারণ মানুষ বলছেন, এত মানুষের দেহ তাঁদের স্বজনরা জলে ভাসিয়ে দিলে দেহাত অঞ্চলে তা চর্চার বিষয় হয়ে উঠত। কিন্তু তেমন কোনও খবর নেই।
নরেন্দ্র মোদির নিশ্চেষ্টতায় কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউ এ ভাবে ভয়ঙ্কর আকার নিয়েছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। টিকাকরণ থেকে অক্সিজেন বন্টন সর্বত্র কেন্দ্রীয় সরকার 'পরিকল্পনাহীনতা ও অকর্মণ্যতা'র পরিচয় দিচ্ছে বলে উচ্চ আদালত ভর্ৎসনা করেছে। এত কিছুর পরেও কেন্দ্রীয় সরকারের অগ্রাধিকারের এক নম্বরে রয়েছে ২০ হাজার কোটি টাকা খরচ করে নতুন সংসদ ভবন এবং প্রধানমন্ত্রীর প্রাসাদোপম বাসভবন তৈরি। অথচ দেশের মানুষকে বিনা পয়সায় করোনার টিকা দিতে নারাজ কেন্দ্র।
এই পরিস্থিতিতে শাসক দল ও প্রধানমন্ত্রীর ভাবমূর্তিতে প্রলেপ দিতে মাঠে নেমেছে যোগী আদিত্যনাথের দলবল। উত্তরপ্রদেশের করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে দেখাতে সদা তৎপর এরা। সরকার যখন বলছে, উত্তরপ্রদেশে করোনার ওষুধ বা অক্সিজেনের কোনও অভাব নেই, তখন আদিত্যনাথের নিজের দলের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, বরেলির সাংসদ, মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি লিখে জানাচ্ছেন, হাসপাতালে অক্সিজেন অপ্রতুল, বেড থেকে ভেন্টিলেটর, ওষুধ সবেরই চলছে কালোবাজারি। ওদিকে যোগী সরকার বলছে অক্সিজেন, ওষুধ নেই বলে যাঁরা গুজব ছড়াচ্ছেন তাঁদের গ্রেফতার করে জাতীয় নিরাপত্তা আইনে জেলে পাঠানো হবে, সম্পত্তি ক্রোক করা হবে।
ভাবমূর্তি রক্ষায় মৃতের সংখ্যা কম দেখাতেই কি মৃতদেহ গঙ্গা যমুনায় ভাসিয়ে দেওয়া হচ্ছে? হয়তো না! আসলে নদীর জলে যা ভেসে যাচ্ছে তা হল 'দ্য আইডিয়া অফ ইন্ডিয়া'র মৃতদেহ। ভারতের সংবিধানের মৃতদেহ। ভারতের 'বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য'র মৃতদেহ। রবীন্দ্রনাথের 'ভারততীর্থ'এর মৃতদেহ। ভারতের অগণন মানুষের 'বিবিধের মাঝে দেখ মিলন মহান'এর মৃতদেহ।
আচ্ছা, ভালো করে দেখুন তো ওর মধ্যে গৌরী লংকেশ বা কালবুরগির মৃতদেহ নেই তো; নিশ্চয়ই আছে, আমরা হয়তো চিনতে পারছি না। ওই আধপোড়া মৃতদেহ হাথরাস কন্যার। ওই মৃতদেহের সারির মধ্যে আছেন আখলাক, পেহেলু খান'রা। আপনারা কি অন্ধ হয়ে গেলেন? চিনতে পারছেন না কুকুরে খুবলে খাচ্ছে রোহিত ভেমুলার ভেসে ওঠা মৃতদেহ। যে দলিত ছেলেটিকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হল ঠাকুরদের কুয়ো থেকে জল তোলার অপরাধে, তার মৃতদেহ আজ ভাসছে লাশ হয়ে। তবে আমরা গুনে রাখছি। সযত্নে গুনে রাখছি প্রতিটি মৃতদেহের সংখ্যা। একদিন এরা সবাই জীবিত হয়ে জবাব চাইবে। আমার স্বদেশকে মৃত্যু উপত্যকায় পরিণত করেছে যে জল্লাদরা তাদের জবাব দিতে হবে। যদি মনে করে থাকেন যে করোনা জুজু দেখিয়ে সবাইকে বাড়িতে আটকে রেখে আপৎকালীন কাজ হিসেবে সেন্ট্রাল ভিস্তা তৈরি করে ফেলবেন, তবে ভুল ভেবেছেন। যদি ভেবে থাকেন রাতের অন্ধকারে ভাসিয়ে দেবেন লাশ, তবে মনে রাখবেন রাতের এক নিজস্ব আলো আছে। কিছুই লুকোতে পারবেন না।
গঙ্গায় ভাসমান লাশের ছবি দেখে সমাজ মাধ্যমে অনেকে বলেছেন, ছবিগুলো তাঁদের 'সংবেদনশীলতায় আঘাত করেছে', ছবিগুলো যেন সরিয়ে নেওয়া হয়। এঁরাই সেই সব মানুষ না, যাঁরা মুরগির ঠ্যাং চিবোতে চিবোতে টেলিভিশনে ইরাকের আকাশে আমেরিকার বোমা বর্ষণের লাইভ টেলিকাস্ট দেখতেন। এঁরাই সেই সব মানুষ না, যারা রাজস্থানে বাঙালি শ্রমিককে পিটিয়ে মারার ভিডিওটি ভাইরাল করেছিলেন। মাননীয়, সেইদিন কি ছুটি নিয়েছিল আপনাদের সংবেদনশীলতা? ভুলে যাবেন না, এই লাশগুলি অন্য কারওর নয়, আপনাদের নিকট আত্মীয়দের। আজ যদি মুখ না খোলেন, এই প্রধানমন্ত্রী যে কোনও দিন আপনাদের লাশ করে ছুঁড়ে দেবেন কলকাতার গঙ্গায়। এই প্রধানমন্ত্রী একজন মানসিক ভাবে অসুস্থ মানুষ, যাঁর নিজের বলতে কেউ নেই। তাঁর মা'এর সঙ্গে সম্পর্ক ছবি তোলার, স্ত্রীকে তিনি অস্বীকার করেন, ভাইদের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক নেই। ভাইরা ভয় পান তাঁদের প্রধানমন্ত্রী দাদাকে। ভাই'রাই জানিয়েছেন যে তাঁদের দাদা আরএসএস-এর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন কারণ সেখানে প্রচারক যা বলেন বাকিরা তাই শোনেন। এমন মানসিকতার একজন মানুষ অন্যের কষ্ট বুঝবেন, এ অসম্ভব। তিনি শুধু ভালোবাসেন তাঁর রিমলেস ভেলগরি চশমা, মঁব্ল্যা পেন, হাতের মোভাদো ঘড়ি, তাঁর জেড ব্লু'এর তৈরি জামাকাপড়, আর দিনে দশবার সাবান দিয়ে হাত ধোয়া। সমাজবিজ্ঞানী ও মনোবিদ আশীষ নন্দী এই মানসিকতার মানুষ প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর চিন্তা প্রকাশ করেছিলেন তাঁর কলামে। আজ যখন গঙ্গা যমুনায় লাশের সারি, তিনি নিশ্চয় ঘন ঘন হাত ধুচ্ছেন।
তবে এও জেনে রাখুন, মানুষ আজ প্রশ্ন তুলে দিয়েছেন- রাজা তোর কাপড় কোথায়? এই আওয়াজ ক্রমশ জমাট হবে, সেন্ট্রাল ভিস্তার প্রাসাদে তখন মুখ লুকিয়ে লাভ হবে না। হিটলার, চাইচেস্কু, গদ্দাফি- এঁদের কাউকে প্রাসাদ রক্ষা করতে পারেনি। আপনার পরিণতি লেখা আছে ইতিহাসের পাতায়। রবীন্দ্রনাথের ভারততীর্থ-কে আমরা ব্যর্থ হতে দেব না। আসুন আজ ওই ভেসে যাওয়া লাশের সারির নামে প্রতিজ্ঞা করি।
খুব ভালো লাগল আপনার লেখা। শুভেচ্ছা জানবেন।
ReplyDeleteআপনি ঠিকই বলেছেন, ভারতবর্ষের অন্তরআত্মার লাশ ভেসে যাচ্ছে গঙ্গা যমুনার স্রোতে। একটি অতিমারীতে বিপন্ন ভারতবাসী লাখ লাখ মৃত্যুর বিনিময়ে সম্বিৎ ফিরে পাচ্ছেন। “মোদী হ্যায় তো মুমকিন হ্যায়” যে নিছকই একটি গোয়েবলসীয় প্রচারের অনুষঙ্গ সেটা বুঝতে পারছেন। কিন্তু চিন্তা গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভকে নিয়ে। বিক্রিত এবং ঘৃণিত এই গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের বিবেক কবে সাড়া দেবে?
ReplyDelete