Tuesday, 11 May 2021

আগডুম বাগডুম

পাঁচ ট্রিলিয়ন ডলার অর্থনীতির ফানুস

মালবিকা মিত্র


প্রধানমন্ত্রীর কেকের সাইজ প্রসঙ্গে প্রথমে সৈয়দ মুজতবা আলীর লেখা স্মরণে এল-

গোয়ালন্দ গামী স্টিমারে ইলিশ মাছের ঝোল আর গরম ভাত! না খেলে নাকি কাউকে বোঝানো যায় না। দাম চার পয়সা। তাও লোকের খাবার ক্ষমতা নেই। তাই শুধু ঝোল আর ভাত, দাম এক পয়সা। এছাড়া আরও একটা রেট আছে। ইলিশ মাছের দেখনাই। দাম দেড় পয়সা। মাছ সমেত ঝোল ভাত দেবে। মাছটা দেখে ঝোল মেখে ভাত খাবার পর মাছটা ফেরত নিয়ে যাবে‌। 

এরপরই মনে এল জিয়াউদ্দিন বারানির লেখা-

সাত-আটশো বছর আগের কথা। আলাউদ্দিন খলজির বাজার দর নিয়ন্ত্রণ প্রসঙ্গে জিয়াউদ্দিন বারানি লিখেছিলেন, কত সস্তায় বাজারে সরকার নির্দিষ্ট দামে পণ্য বিক্রি হত। তিনি সে যুগের একটি মূল্য তালিকাও দিয়েছেন। বাজার দর নিয়ন্ত্রণের মুখ্য শর্ত: চাহিদা আর জোগানের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা। সেই বিষয়েও তিনি সরকারি ব্যবস্থা বর্ণনা করেন। লিখেছেন, মন্বন্তরের দিনেও কোনও মূল্যবৃদ্ধি ঘটেনি। এত সব বলার পরেও একটি গভীর গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুললেন: এক পয়সা দামে একটি উট বাজারে কিনতে পাওয়া গেলেও প্রশ্ন হল, মানুষের পকেটে এক পয়সার সামর্থ্য ছিল কী? প্রশ্ন করেছেন, কাজ ছিল কিনা, থাকলেও মজুরি ছিল কত? চাহিদা জোগান দ্বারা দাম নিয়ন্ত্রণের সাথে মজুর ও মজুরির শর্ত ছাড়া এই দর নিয়ন্ত্রণের সুফল-কুফল বোঝা যাবে না।

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিজি ঘোষণা দিয়েছিলেন, তাঁর লক্ষ্য ২০২৫ সালের মধ্যে দেশকে ৫ ট্রিলিয়ন (৫ লক্ষ কোটি) ডলারের অর্থনীতিতে নিয়ে যাওয়া। বলেছেন, সাইজ অফ দ্য কেক, দ্যাট ম্যাটারস। কেক'টা কত বড় তার ওপর কেমন সাইজের পিস হবে নির্ভর করে। ঠিক কথা মোদিজি, কিন্তু আরও একটা শর্ত আছে: 'হুম আই ওয়ান্ট টু ইনভাইট'। কতজনের খাওয়ার কথা ভাবছি। 

আমরা তো জানি, 

১) বিনিয়োগ আসে ব্যাঙ্ক, বীমা থেকে। বছরের পর বছর ঋণ গ্রহীতা বৃহৎ পুঁজির মালিকরা ২৫ লক্ষ কোটি টাকা ঋণ পরিশোধ করছে না। বরং ঝাঁপ বন্ধ করে ৯ হাজার কোটি, ১৩ হাজার কোটির ঋণ খেলাপির দল পালিয়েছে। আরও বড় রাঘব বোয়ালরা বহাল তবিয়তে দেশেই আছেন। তাহলে? কেকের সাইজ, না কত জন খাবে সেটাই বিচার্য!

২) বিনিয়োগের দ্বিতীয় উৎস প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর সমূহ। যে সরকার ঋণ বা ঋণের সুদ আদায় করতে পারে না, সে সম্পত্তির মালিকদের উপর নয়, মধ্যবিত্ত শ্রেণির ওপর কর বসাতে পারে। আর এভাবে ৫ লক্ষ কোটি ডলারের অর্থনীতি! অসম্ভব। 

৩) বিনিয়োগের তৃতীয় উৎস বিদেশি বিনিয়োগ। মোদিজি এটার কথাই ভাবছেন। বিদেশি প্রভু নিশ্চয়ই জনকল্যাণ, জনস্বাস্থ্য, গণশিক্ষা, কর্মসংস্থানমুখি শ্রম নিবিড় শিল্প গড়তে আসবে না। তার মানে, কেকের টুকরোগুলো অনেক বড় হবে, কিন্তু সকলের জন্য হবে না।

এখানেই প্রধানমন্ত্রীর পাঁচ ট্রিলিয়ন ডলার অর্থনীতির ফানুস। 

বিভূতিভূষণের 'তালনবমী' গল্প মনে পড়ছে। জটি পিসিমার বাড়িতে তালনবমীর আয়োজন নিশ্চিত ভাবেই বড় ছিল। গ্রামের অনেকের নেমন্তন্ন ছিল। কিন্তু হতদরিদ্র দুই ভাই নেপাল আর গোপালের নেমন্তন্ন ছিল না; নিমন্ত্রণের আশায় আশায় ঘুমিয়ে পড়ে, স্বপ্নে দেখে মহাভোজ। কেকের টুকরো যত বড়ই হোক, জীবনানন্দ দাশের কথায়, 'কোটি মানুষের মাঝে সমীচীন সমতায় বিতরিত হবার তা নয়'।


No comments:

Post a Comment