ভারতের বাম-শক্তি কতটা প্রাসঙ্গিক
অনির্বাণ কারক
পশ্চিমবঙ্গে এবারের বিধানসভা নির্বাচনে সব থেকে তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়টি হল এই যে, বামেরা কোনও আসন পায়নি এবং মোট ভোটের ৪.৭ শতাংশ পেয়েছে। এই নির্বাচনী বিপর্যয়ের কারণ নিশ্চয়ই বিশ্লেষকরা খতিয়ে দেখবেন। কিন্তু মূল প্রশ্ন হল, আজকের ভারতীয় বাম দলগুলির রাজনীতিতে 'মার্কসবাদ' বা 'মার্কসবাদী' তত্ত্বের অবস্থান কী? ভোটের প্রচারে বাম জোট টিএমসির অপশাসন এবং বিজেপিকে ক্ষমতায় আসতে দেওয়ার বিপদগুলির উপর জোর এবং নির্বাচিত হলে গরিব ও নিপীড়িত মানুষের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। তবে এর কোনওটির জন্যই মার্কসবাদের প্রতি দায়বদ্ধতার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। প্রকৃতপক্ষে, ডানপন্থী জনপ্রিয়তার এক ব্র্যান্ড ব্যবহার করে পশ্চিমবঙ্গে 'pro-poor' তকমাটা এখন টিএমসি-র একচেটিয়া হয়ে গেছে বললে খুব ভুল বলা হবে না।
পশ্চিমবঙ্গের ভোটের প্রচার থেকে যদি কিছু ধারণা করা যায়, তবে এটা বলতেই হয় যে ভারতীয় রাজনীতিতে পুঁজিবাদ থেকে উৎক্রমণের স্বপ্নের কোনও প্রাসঙ্গিকতা আছে কিনা তা নিয়ে গুরুতর চিন্তাভাবনা বাম দলগুলো আর খুব একটা করে না। এ থেকে দুটি সিদ্ধান্ত টানা যেতে পারে: ১) বামেরাও স্বীকার করে নিয়েছে যে পুঁজিবাদকে অতিক্রম করা যায় না এবং বিশ্বব্যাপী পুঁজিবাদের দ্বারা নির্ধারিত গণ্ডির মধ্যেই রাষ্ট্র-পরিচালিত কল্যাণমূলক পদক্ষেপ নেওয়া ছাড়া আর কোনও উপায় নেই; অথবা ২) বামেরা তাত্ত্বিক অসহায়ত্ব দ্বারা জর্জরিত।
বিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগ থেকেই চিরাচরিত মার্কসবাদের সীমাবদ্ধতা ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। চিরাচরিত মার্কসবাদ সর্বদা একজন 'শ্রমিক'এর পরিচয় শুধু 'শ্রমিক' হিসাবেই দেখে এসেছে। এটা ভাবেনি যে মানুষ হিসাবে শ্রমিকদের পরিচয় তাদের 'শ্রমিক'এর পরিচয়কে ছাড়িয়ে যায়। 'কাজ' এবং 'শ্রম' কোনও ব্যক্তির পরিচয়কে ধরে রাখা এবং তাদের জীবনে 'অর্থ' সরবরাহ করার একমাত্র উপাদান হতে পারে না। অর্থবহুল উপাদানের মধ্যে ধর্মীয় সংবেদনশীলতা, বর্ণচেতনা, সাংস্কৃতিক বিশেষত্ব এবং আরও অনেক কিছুই অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে।
প্রচলিত মার্কসবাদ সচেতনতাকে কেবল 'এপিফোনোমেনার' ভূমিকা দেয় এবং অর্থনীতির যে মৌলিক কাঠামো, তার প্রভাবমাত্র বলে ধরে। তদুপরি, ইতিহাসে এমন অনেক উদাহরণ আছে যে, উৎপাদনের পদ্ধতিতে বা অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অন্য কোনও পরিবর্তন এলেও নিপীড়িতদের মধ্যে সচেতনতার রূপগুলিতে কোনও পরিবর্তন আসেনি। বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ক্রমবর্ধমান দুর্দশা সর্বহারাদের বিপ্লব ঘটাতে পারেনি। বরং, ফ্যাসিবাদ এবং তার ভয়ঙ্কর পরিণাম এক দশকেরও বেশি সময় ধরে ইউরোপকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। সাম্প্রতিক কালে, আমাদের দেশে বৈশ্বিক পুঁজিবাদের নানান পরিবর্তনের ফলে যে সংকট আমরা দেখেছি, তার ফলে 'শ্রেণি' চেতনার কোনও পুনরুত্থান হয়নি। বরং, আমরা দক্ষিণপন্থী রাজনীতির চরম জনপ্রিয়তা প্রত্যক্ষ করছি এবং মানুষের মধ্যে ধর্মকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকার মরিয়া চেষ্টা লক্ষ করছি। এই প্রসঙ্গে বলা যেতে পারে যে, ধর্মকে 'জনগণের আফিম' বলার আগে মার্কস আরও বলেছিলেন যে এটি 'নিপীড়িতদের দীর্ঘশ্বাস' এবং 'হৃদয়হীন বিশ্বের হৃদয়'।
মার্কসবাদের প্রচলিত মডেলে এই জাতীয় 'বৈপরীত্য' বোঝার কোনও উপাদান নেই। স্ট্যালিনবাদীরা সর্বদা বলেন যে জনগণের চেতনা সময়ের সাপেক্ষে 'পিছিয়ে' থাকলে, 'পার্টি'কে (যে কোনও আশ্চর্য উপায়ে 'সত্য' টা জানে) রাজনীতিতে 'ভ্যানগার্ড' হিসাবে কাজ করতে হবে। এই ধরনের ব্যাখ্যা অবশ্যই লোভনীয়, কিন্তু অপর্যাপ্ত। এই যুক্তি স্বীকার করার অর্থ, গণতান্ত্রিক পদ্ধতির বদলে আধিপত্যবাদকে প্রশ্রয় দেওয়া। এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে ভারতে বামপন্থীরা চেতনা গঠনের গুরুত্বপূর্ণ কাজটিতে ব্যর্থ হয়েছে। বরং, পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থীদের দ্বারা শুরু করা 'clientism' (অর্থাৎ, কিছু পাইয়ে দিয়ে রাজনৈতিক আনুগত্য আদায় করা) টিএমসি অব্যাহত রেখেছে এবং তাকে অন্য মাত্রা দিয়েছে।
মার্কসের বিকল্প-পাঠ
১৯৬০-এর দশক থেকে জার্মান ভাষার স্কলারশিপে মার্কসের একটি বিকল্প পাঠের প্রচলন শুরু হয়। মার্কস তাঁর লেখা 'Grundrisse' বইটির মেথড অফ পলিটিকাল ইকনমি বলে একটি বিভাগে বলেছিলেন, পণ্য, মূল্য, পুঁজি সবেরই অবজেকটিভ ও সাবজেকটিভ দুটি রূপ আছে; এগুলি মানুষের মাথায় যা চলছে এবং পাশাপাশি বাস্তবে যা হচ্ছে দুটোই বুঝতে সাহায্য করে। এগুলি সংকীর্ণ অর্থনৈতিক 'বিষয়' নয় বরং পুঁজিবাদী সমাজের 'অস্তিত্বের বৈশিষ্ট্য' এবং পাশাপাশি এই সমাজের সত্তার 'রূপ' বা 'অবয়ব' তুলে ধরে।
মূল্য-তত্ত্ব শুরু হয় পণ্যের দ্বৈত রূপ দিয়ে। পণ্যের ব্যবহারিক মূল্য এবং মূল্য উভয়ই থাকে। সুতরাং, পুঁজিবাদে শ্রমেরও একটি 'দ্বৈত চরিত্র' রয়েছে: 'মূর্ত শ্রম' (যা 'ব্যবহারিক মূল্য' গঠন করে) এবং 'বিমূর্ত শ্রম' (যা মূল্য গঠন করে)। 'মূর্ত শ্রম' বলতে বোঝায় সেই শ্রম যা মানুষ এবং প্রকৃতির সম্পর্কের মধ্যস্থতা করে। এই ধরনের শ্রম প্রত্যেক সমাজেই থাকে, কারণ এটি একটি প্রয়োজনীয়তা। 'বিমূর্ত শ্রম' ইঙ্গিত দেয় যে, পুঁজিবাদে শ্রমের একটি অনন্য সামাজিক মাত্রা রয়েছে যা শ্রমসাধ্য কার্যকলাপের অন্তর্নিহিত নয়, এটি সামাজিক আন্তঃনির্ভরতার একটি নতুন, বিমূর্ত রূপের প্রতীক। কেবল পুঁজিবাদেই শ্রম সামাজিক সম্পর্কের মৌলিক গঠনের অঙ্গীভূত হয়ে ওঠে। অন্যান্য সকল সমাজে জাতি, দাসত্ব, পরিবার এবং আত্মীয়তার সম্পর্কের মতো আরও পরোক্ষ সম্পর্কের মাধ্যমে মানব শ্রম সংগঠিত হয়।
মার্কসের 'মুল্য তত্ত্বের' উদ্দেশ্য এটা প্রমাণ করা নয় যে সর্বদা এবং সর্বত্র 'মূর্ত-শ্রম'ই সম্পদের একমাত্র উৎস। বরং, মার্কস 'মুল্য'কে বিশ্লেষণ করেছেন এক ঐতিহাসিকভাবে নির্দিষ্ট ধরনের সম্পদ হিসাবে, যা পুঁজিবাদে শ্রমের ঐতিহাসিকতা এবং তার বিমূর্ত মধ্যস্থতাকারীর অনন্য ভূমিকার সঙ্গে জড়িত। 'মূল্য' সম্পদের একটি নির্দিষ্ট রূপ, কিন্তু এটিকে অবশ্যই 'বৈষয়িক সম্পদ' থেকে আলাদা করা উচিত। পরেরটি উৎপাদিত পণ্যের 'পরিমাণ' দ্বারা মাপ করা যায় এবং এটি শ্রম ছাড়াও বৈজ্ঞানিক জ্ঞান, সামাজিক সংগঠন এবং প্রাকৃতিক অবস্থার মতো নানা জিনিসের উপরও নির্ভর করে। কিন্তু, মার্কসের মতে, 'মূল্য' এককভাবে 'শ্রম-সময়'এর ব্যয় দ্বারা গঠিত হয়। পুঁজিবাদে এই শ্রম-সময়ই বৈষয়িক সম্পদ গঠনে প্রধান ভূমিকা পালন করে।
পুঁজিবাদের অধীনে সম্পত্তির সামাজিক রূপ হিসাবে 'মূল্য' যন্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমে উৎপাদনে সরাসরি শ্রম-সময় কমানোর চেষ্টা করে। এর ফলে, পুঁজিবাদীরা 'উদ্বৃত্ত মূল্য' আরও বেশি করে নিষ্কাশন করতে পারে। কিন্তু এই যান্ত্রিকীকরণ ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির সাথে সাথে 'মূল্য' এবং 'বৈষয়িক সম্পদের' মধ্যে সমানুপাতিক সম্পর্কের বিচ্যুতি ঘটতে শুরু করে। ক্রমবর্ধমান ভাবে আরও বেশি 'বৈষয়িক সম্পদ' প্রতি ঘন্টায় উৎপাদিত হয়, কিন্তু একই ধরনের 'শ্রম-সময়' প্রতি ঘন্টায় একই পরিমাণ 'মূল্য' উৎপাদন করে। এই কারণেই, পুঁজিবাদ যত দীর্ঘমেয়াদী হয়, ততই 'মোট' মূল্যের (এবং তাই উপলব্ধ উদ্বৃত্ত মূল্য) পরিমাণ কমতে থাকার একটা প্রবণতা দেখা যায়, কারণ, ক্রমাগত যান্ত্রিকীকরণের ফলে বৈষয়িক সম্পদ উৎপাদনের জন্য 'জীবিত শ্রম'-এর প্রয়োজনীয়তা ক্রমশ কমে যায়।
তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, সমাজের উৎপাদনশীলতা যত বাড়ে, 'মূল্য' ততই উৎপাদিকা শক্তির সামাজিক সম্পদ উৎপাদনের ক্ষমতার নিরিখে 'সময়ের প্রেক্ষিতে অসামঞ্জস্যপূর্ণ' হয়ে ওঠে, কারণ, উৎপাদনশীলতা তখন আর শুধু বিমূর্ত শ্রমের উপর নির্ভর করে না। এই পরিস্থিতি তৈরি হয় মূল্য দ্বারা গঠিত সমাজের নিজস্ব তাগিদেই। অন্য কথায় বলা যায় যে, পুঁজিবাদ এমন একটি সমাজের সম্ভাবনা তৈরি করে যেখানে অনেক সর্বহারাদের পরিশ্রম আর কিছু লোকের সমৃদ্ধির জন্য পূর্বশর্ত থাকে না। তবে, এই সম্ভাবনাকে বাস্তবে উপলব্ধি করা যায় না, কারণ জমে থাকা মানবীয় শ্রম-ক্ষমতাগুলি পুঁজি হিসাবে, কিন্তু উৎপাদিকা শক্তি থেকে 'বিচ্ছিন্ন' অবস্থায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে। মূল্য-তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বলা যায় যে, বর্তমানে অপ্রয়োজনীয় শ্রমের উত্থানকে একটি সম্ভাব্য ভবিষ্যতের প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত হিসাবে দেখা উচিত, যেখানে প্রলেতারীয় শ্রমিকের সংখ্যা প্রচলিত মার্কসবাদের ধারণা অনুযায়ী বৃদ্ধি পাওয়ার বদলে হ্রাস পায়। প্রচলিত মার্কসবাদে বর্তমান 'জীবিত-শ্রম'কে পুঁজিবাদ থেকে মুক্তির উৎস বলে ধরা হয়। কিন্তু মার্কস তার মূল্য-তত্ত্ব দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন যে মুক্তির উৎস আসলে 'অতীতের শ্রম'।
'মূল্য'র বৃদ্ধি না হওয়ার ফলে উদ্বৃত্ত-মূল্যকে একই অবস্থানে রাখার জন্য, পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় আমাদের আরও দ্রুত দৌড়তে হয় বা বেশি কাজ করতে হয়, যাকে পোস্টোন 'ট্রেডমিল গতিশীলতা' বলে অভিহিত করেছেন। অতএব, ঐতিহাসিকভাবে সুনির্দিষ্ট এবং বিমূর্ত এই সামাজিক আধিপত্য হচ্ছে পুঁজিবাদের বৈশিষ্ট্য। মার্কসের লেখায় পুঁজির সংজ্ঞা হল 'স্ব-ক্রমবর্ধমান মূল্য' । পুঁজির কোনও স্থির রূপ নেই, নিজের চক্রাবর্ত পথের বিভিন্ন মুহুর্তে পুঁজি কখনও অর্থ (money) এবং কখনও পণ্য রূপে উপস্থিত হয়। পুঁজি হল মূল্যের স্ব-প্রসারণের একটি অবিরাম প্রক্রিয়া। পুঁজি শুধু অন্ধের মতো উৎপাদন ও ভোগ এবং সৃষ্টি ও ধ্বংসের বৃহৎ আকারের কালচক্র তৈরি করে চলে। সুতরাং, চিরাচরিত মার্কসবাদ অনুসারে 'পুঁজিবাদীদের' সাথে 'পুঁজি'কে গুলিয়ে ফেলা চূড়ান্ত ভুল। কারণ, পুঁজিবাদীরা কেবল পুঁজির বিমূর্ত গতিশীলতার 'মানবরূপ' মাত্র। পুঁজিবাদীরাও পুঁজির অত্যাচার থেকে মুক্ত নয়।
তাত্ত্বিক এবং রাজনৈতিক তাৎপর্য
মূল্য-তত্ত্ব দ্বারা বর্ণিত পুঁজিবাদের যে স্বকীয় দীর্ঘকালীন প্রবণতাগুলি– যেমন, এই ব্যবস্থার বিশ্বব্যাপী সম্প্রসারণ, অর্থনৈতিক সংকটের পুনরাবৃত্তি, পুঁজির সংহতি এবং কেন্দ্রীকরণ এবং ধারাবাহিকভাবে যান্ত্রিকীকরণের ফলে অপ্রয়োজনীয় শ্রমের উত্থান– এ সবই বৈশ্বিক স্তরে কাজ করে এবং গত দুই শতাব্দী ধরে করে চলেছে। যান্ত্রিকীকরণের দিকে প্রবণতা সব সময়ই চালু ছিল, ফলে মার্কসীয় অর্থে 'প্রলেতারিয়ান' শ্রমজীবীদের সংখ্যা আর বৃদ্ধি হচ্ছে না। যেমন, ভারতবর্ষ প্রসঙ্গে প্রয়াত অর্থনীতিবিদ কল্যাণ সান্যাল বলেছিলেন যে, এমন একটি বিশাল জনগোষ্ঠী এখন ভারতে তৈরি হচ্ছে যাদের প্রচলিত মার্কসবাদী অর্থে 'reserve army of labor' বলা চলে না কারণ তাদের কখনওই পুঁজিবাদী সেক্টরে নিযুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা নেই। এই জনগোষ্ঠীকে পুঁজি পুরোপুরি পরিত্যাগ করেছে এবং তৈরি হয়েছে একটি 'কর্মচ্যুতদদের বর্জ্যভূমি'। সারা পৃথিবীতে যখন বেকারত্বের সমস্যা ভয়ঙ্কর রূপ নিচ্ছে, তখন এটা উপলব্ধি করা একান্ত প্রয়োজন যে, পুঁজিবাদ নিজেকে বিশ্ব-অর্থনীতিতে একটি ব্যবহারিক সত্য হিসাবেই স্থাপন করেছে। পুঁজিবাদ মানব-ইতিহাসে এই প্রথম উদিত হল এমন বিমূর্ত ধারণার কোনও কারণ নেই। পুঁজিবাদ থেকে মুক্তির যে-কোনও রাজনৈতিক উপায় খুঁজতে গেলে এই সত্যকে স্বীকার করতেই হবে।
মূল্য-তত্ত্ব শ্রমকে সমগ্র মানবজীবনের 'অস্তিত্ববাদী সত্য' বা ইতিহাস-নিরপেক্ষ 'মূল বিষয়' হিসাবে দেখে না। সুতরাং, জাতিসত্তা, বর্ণ, লিঙ্গ বা যৌনতার উপর ভিত্তি করা রাজনীতির চেয়ে 'শ্রেণি ভিত্তিক' রাজনীতিটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ কিনা সে বিষয়ে ভাবনার প্রয়োজন আছে। প্রকৃতপক্ষে, মূল্য-তত্ত্ব সামাজিক রূপান্তরের সম্ভাবনার শর্তগুলি বর্ণনা করার দিকে বেশি মনোনিবেশ করে। তাই পুঁজিবাদী ব্যবস্থা থেকে উৎক্রমণের লক্ষ্যে শুধুমাত্র 'শ্রমিক' পরিচিতির মানুষের জন্য রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ভাবনাকে ছাপিয়ে যেতে হবে। সামাজিক স্তরের অপরাপর পরিচিতির মানুষের (জাতি, বর্ণ, ধর্ম, লিঙ্গ ইত্যাদি) রাজনৈতিক পরিসরে ক্ষমতায়ন, যা পুঁজিবাদী ব্যবস্থা মান্যতা দেয় না, সে বিষয়েও চিন্তাভাবনা করতে হবে।
মার্কস বলেছিলেন যে 'বিচ্ছিন্ন-শ্রম'-এর মাধ্যমেই মানুষ উৎপাদিত পণ্য এবং উৎপাদনের উপকরণের উপর এমন ব্যক্তির আধিপত্য তৈরি করে যে নিজেই সেই পণ্য উৎপাদন করে না। 'ব্যক্তিগত সম্পত্তি' তাই আসলে বিচ্ছিন্ন-শ্রমের একটি অনিবার্য পরিণাম। অন্য কথায়, 'শ্রেণি' তৈরি হয় সামাজিক অনুশীলন দ্বারা, আবার এই অনুশীলনই বিচ্ছিন্নতা তৈরি করে। কিন্তু বিচ্ছিন্নতা থেকে শ্রেণির উদ্ভব হয় না। মার্কসের সমালোচনা সামাজিক চর্চা থেকেই কিভাবে 'ব্যক্তিগত সম্পত্তি' এবং মানব শ্রমের মধ্যে বিরোধিতা তৈরি হচ্ছে তা দেখানোর চেষ্টা করে।
সাম্প্রতিক-কালে আমরা যে অর্থনৈতিক সংকট, সামাজিক অবক্ষয় এবং রাজনৈতিক টালমাটাল দেখেছি, তা থেকে বলা যায় যে মার্কসবাদের মৃত্যুর খবর অত্যন্ত অতিরঞ্জিত হয়েছে। তবে সমালোচনামূলক একটি মার্কসীয় রাজনীতি বর্তমানের জন্য পুনরায় কল্পনা করা যায় কিনা তা নির্ভর করে পরম্পরাগত বাম দলগুলি তাদের নিজস্ব অনুশীলনে মার্কসীয় তত্ত্বের তাৎপর্য পুনর্বিবেচনা করতে রাজি হয় কিনা তার উপর।