Sunday, 30 June 2024

ছুঁচোর গায়ের গন্ধ

গোলাপ জলে ধুলেও যাবে না

মালবিকা মিত্র



লোকসভা নির্বাচনের ফল প্রকাশের পর বলেছিলাম, জনগণ এবারের ভোটে কী ভূমিকা নেবে তা সরকার বা বিরোধী পক্ষের নেতারা কেউই বুঝে উঠতে পারেননি। ১৯ এপ্রিল প্রথম দফা নির্বাচনের পর তাদের উভয়ের কাছে স্পষ্ট হয়, কী ঘটতে চলেছে। লিখেছিলাম, জনগণ সরকার পক্ষকে হলুদ কার্ড দেখিয়েছে, সেই সঙ্গে বিরোধী পক্ষকেও হলুদ কার্ড দেখিয়েছে। এতটুকু আত্মতুষ্টির সুযোগ নেই। বিরোধী জোটকে আরও বজ্রকঠিন ও দৃঢ় হতে হবে। 

অন্যদের কথা কী বলব, আমি নিজেও নির্বাচনে ইউপি, বাংলা, হরিয়ানা, পঞ্জাব, মহারাষ্ট্র ও তামিলনাড়ুর ফলাফল দেখে একটু বুঝি আত্মতুষ্টিতে ভুগছিলাম। আরও আত্মতুষ্ট এই কারণে যে, নরেন্দ্র মোদির মতো একজন একনায়ক আর এখন একনায়ক রইল না, নীতিশকুমার ও চন্দ্রবাবুর উপর নির্ভরশীল হল। সকলেই জানি, এই দুই অবলম্বন যথেষ্ট বিশ্বস্ত নয়। আরও উৎসাহ পেলাম, আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবত ও ইন্দ্রেশ কুমার প্রমুখের সমালোচনামূলক ও উপদেশমূলক মন্তব্যে-- বিনয়ী হতে হবে, সবাইকে নিয়ে চলতে শিখতে হবে, নিজেকে সংঘের উপরে স্থাপন করা যাবে না ইত্যাদি। এক কথায় বলা যায়, তৃতীয় বারের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির উপর বেশ কিছু বিধিনিষেধ আরোপিত হল। 

সত্যি বলতে কি, আমি মুহূর্তের জন্য ইতিহাস বিস্তৃত হয়েছিলাম। ইতিহাসে এমন কোনও শাসক দেখানো যাবে না যারা একনায়ক থেকে সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক হয়ে উঠেছেন। একনায়কতন্ত্র সংখ্যা, সাফল্য বা জনাদেশের ওপর নির্ভর করে না। ওটা একটা মানসিকতা। 

একটু ইতিহাসে ফিরে যাই। নেপোলিয়ন বোনাপার্ট স্থলযুদ্ধে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন। তিনি জানেন, জলযুদ্ধে ইংল্যান্ডের একাধিপত্য স্বীকৃত। তিনি বিশ্বাস করতেন এবং ভাই জোসেফকে বলেছিলেন, স্থলযুদ্ধের শ্রেষ্ঠত্ব তাকে জলযুদ্ধে শ্রেষ্ঠত্ব এনে দেবে। ১৮০৬ সালে নেপোলিয়ন'এর ক্ষমতা ছিল মধ্য গগনে। সেই ১৮০৬ সালেই স্পেনে যখন নেপোলিয়ন বিরোধী বিদ্রোহ হয়, সেই বিদ্রোহে ইংল্যান্ড সমর্থন জানিয়ে সৈন্যবাহিনী সহ ওয়েলিংটনকে প্রেরণ করে। নেপোলিয়ন স্পেনের মাটিতে ইংল্যান্ডের উপস্থিতিতে উৎসাহিত হলেন। স্পেনের স্থলভুমিতে তিনি ইংল্যান্ডকে পরাস্ত করার স্বপ্ন দেখলেন। ইংল্যান্ডের অংশগ্রহণ যে স্পেনীয় সমস্যাকে একটা বাড়তি মাত্রা এনে দিয়েছে, তা অবজ্ঞা করলেন। অনিবার্য পরিণতি ভিত্তোরিয়া ও ভিমিয়ার'এর যুদ্ধে ইংল্যান্ডের কাছে নেপোলিয়নের শোচনীয় পরাজয়। ফলে স্থলযুদ্ধে নেপোলিয়নের শ্রেষ্ঠত্বের অপরাজেয়তার মিথ ভেঙে গেল। কার্যত এরপর থেকেই নেপোলিয়ন বোনাপার্ট একের পর এক পরাজয়ের সম্মুখীন হলেন। 

ঐতিহাসিকরা বলবেন, স্পেনের মাটিতে ব্রিটিশ সেনাপতি ওয়েলিংটনের উপস্থিতির পর নেপোলিয়ন একটু ধৈর্য দেখাতে পারতেন। পরিস্থিতির সম্যক বিশ্লেষণ করতে পারতেন। কারণ, পরিস্থিতির গভীরতা ছিল ভিন্নতর। কিন্তু নেপোলিয়ন সেটা না করে দ্বিগুণ উৎসাহে ইংল্যান্ডকে স্পেনের মাটিতে পরাস্ত করার উদ্যোগ নিলেন। একনায়ক কখনও আত্মবিশ্লেষণ করে না। একনায়ক নিজে যেটা ঠিক করে সেটাকে একমাত্র সত্য বলে গ্রহণ করে। তাকে পরিবেষ্টিত পারিষদবর্গ সেই সত্যকে চরম সত্য বলে প্রতিষ্ঠা করে। ফলে, একনায়কের ভেতর মূল্যায়ন, আত্মজিজ্ঞাসা থাকে না। সেই কারণে এরা ভাঙলেও মচকায় না। 

দেখাই যাচ্ছে, একটা সংখ্যালঘু সরকার, যেখানে প্রধান দলের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই! কিন্তু কে বলবে? গরিষ্ঠতা থাকাকালীন যে সমস্ত প্রধান গুরুত্বপূর্ণ দফতরগুলি সেই প্রধান দলের অধিকারে ছিল, সংখ্যালঘু হওয়ার পরেও কোনও দফতরই একনায়ক শরিক দলকে দেয়নি। নিজের নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। এটা কোনও আত্মিক পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয় না। সবাইকে নিয়ে চলার বা জোট ধর্মের ইঙ্গিতও নয়। মুখে বলছে বটে এনডিএ'র কথা, কিন্তু বাস্তবে সে নিজের ইচ্ছাতেই চলে। এই যে এত বড় দেশ জোড়া জাতীয় স্তরে পরীক্ষা দুর্নীতি, শত সহস্র কোটি টাকার স্ক্যাম, যথাপুর্বং প্রধানমন্ত্রী মৌন। কোনও বিচলিত বোধ তাঁর মধ্যে দেখা যাচ্ছে না। খোদ রাম মন্দিরের ছাদ চুঁইয়ে জল পড়ছে, সদ্য নির্মিত রামপথে ধ্বস নেমেছে, মালগাড়ি এক্সপ্রেস'এর মাথায় চাপছে; পাশাপাশি, সবে মাত্র মার্চ মাসে ভোটের আগে লোক দেখানো বিমানবন্দর ও সম্প্রসারণের উদ্বোধন করলেন তিনি, জব্বলপুর বিমানবন্দর ও দিল্লিতে মাত্র দু' মাসের মধ্যে সে সব ভেঙেচুরে অস্থির। 

জনসাধারণের দেখানো হলুদ কার্ড সত্ত্বেও এসব হচ্ছে। প্রথমে ইডি দিয়ে অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে নাজেহাল করানো। অতঃপর রাইস এভিনিউ কোর্টে অরবিন্দের জামিন যেই মঞ্জুর হল, সেই জামিনকে হাইকোর্টে আটকে দেওয়া হল; শেষমেশ জামিন মঞ্জুরের সম্ভাবনায় ইডি'কে ছেড়ে সিবিআইকে দিয়ে তাঁকে গ্রেফতার করানো হল। বিরোধী কণ্ঠকে নির্মূল করার নির্লজ্জতম প্রয়াস। অনেকেই ভেবেছিলেন, চন্দ্রবাবু নাইডু স্পিকার পদটা দাবি করেছেন, হয়তো এটা নিয়ে মোদি একটু বেকায়দায় পড়বেন। কিন্তু বাস্তবে দেখলাম মোদি তার নিজের মনোনীত সেই ওম বিড়লাকেই দ্বিতীয়বারের জন্য স্পিকার করলেন। এমনকি স্পিকার তাঁর ভাষণে বিরোধী পক্ষকে আক্রমণ শানালেন জরুরি অবস্থার ৫০ বছর পূর্তি স্মরণ করিয়ে। 'তোর বাপ-ঠাকুর্দা জল ঘোলা করেছিল'-- সেই চেনা পরিচিত বিরোধীদের আক্রমণের রাস্তায় চললেন। অথচ বলা উচিত ছিল, শক্তিশালী বিরোধী পক্ষ যাতে গণতন্ত্রের প্রধান সৌধ পার্লামেন্টের পবিত্রতা ও মর্যাদা রক্ষায় তাঁকে সাহায্য করেন। সে পথে স্পিকার, অর্থাৎ, বকলমে নরেন্দ্র মোদি হাঁটলেন না। ২৪০ আসনে জিতে হাবেভাবে মনে হচ্ছে '৪০০ পার'। 

যদি কেউ ভেবে থাকেন, মোহন ভাগবত বা ইন্দ্রেশ কুমারের উপদেশ ও সুবচনকে নরেন্দ্র মোদি এতটুকু গুরুত্ব দেবেন, তাহলে তা ভুল। লক্ষ করবেন, একই পথে একই লক্ষ্যে তিনি এখনও অবিচল। তাঁর মন্ত্রিসভায় একজনও সংখ্যালঘু ইসলাম ধর্মের মানুষকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। অর্থাৎ, মূলগতভাবে তিনি তার কট্টর হিন্দুত্বের পথ পরিবর্তন করবেন না। আর সেই কারণেই মোহন ভাগবত সহ আরএসএস নেতারাও জানেন, শতবর্ষের প্রাচীন আরএসএস দলের বাড়বাড়ন্ত গত ১০ বছরের মোদি জমানায়। অতএব, তাকে গিলতে না পারলেও উগরে দেওয়া সম্ভব নয়। 

সুতরাং, মোদি সরকার দুর্বল, মোদি সরকারের চৈতন্যের পরিবর্তন বাধ্যত হবে, প্রধানমন্ত্রী ব্যাকফুটে-- এসব ধারণা বিশ্বাস করার অর্থ নিজেদের অসহায় প্রতিপন্ন করা। কারণ, একনায়ক ভাঙবে তবু মচকাবে না। বরং আত্মাহুতি তার কাছে শ্রেয় পন্থা, আত্মসমর্পণ কদাপি নয়। তাই বিরোধী জোট ইন্ডিয়া যেন কখনই এই সরকারের আয়ু ফুরিয়ে এসেছে, এখন মাত্র সময়ের অপেক্ষা, এমন আত্মতুষ্টিতে না ভোগে। 

আগামী রাজ্য বিধানসভার নির্বাচনগুলি বিরোধী জোটের কাছে এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। যে কোনও মূল্যে ঐক্য রক্ষা করে স্বৈরাচারী মোদি সরকারকে রাজ্যে রাজ্যে রুখে দিতে হবে। অন্যথায় মানুষ লোকসভা নির্বাচনে যে মেজাজ ও স্পিরিট দেখালেন তাকে অমর্যাদা করা হবে। তাঁরা হতাশ হবেন। কে না জানে হতাশা থেকেই প্রতিক্রিয়ার শক্তির প্রত্যাবর্তন হয় নবতর শক্তিতে। মনে রাখতে হবে রজনী পাম দত্তের সেই ঐতিহাসিক উক্তিটি-- ফ্যাসিস্ট শৃগাল কখনই শ্রমিক শ্রেণির সিংহবিক্রমকে আঘাত করতে পারেনি; শ্রমিক শ্রেণি যখন সংসদ-সর্বস্ব কমিউনিস্ট ও সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটদের ভ্রান্ত রাজনীতির শিকার হয়ে আহত ও হতাশ, তখনই ফ্যাসিস্ট শৃগাল সেই আহত সিংহকে আক্রমণ করেছিল।


Friday, 28 June 2024

হকার উচ্ছেদের প্রশ্নই নেই!

সদর দফতরে কামান দাগো?

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য


 

লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল বেরনোর কিছুদিন পরেই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী নবান্নে এক উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক ডাকেন। সেই বৈঠকে কিছু উষ্মা প্রকাশের পর আবারও ২৪ জুন তিনি আরেকটি এমনতর বৈঠক ডেকে প্রায় রুদ্র মূর্তি ধারণ করে নিজ দল, সরকার, আমলা, পুলিশ কাউকেই রেয়াত না করে কতকগুলি অপ্রত্যাশিত কথা বলেন ও নির্দেশ দেন। প্রকারান্তরে, তিনিই বিরোধীপক্ষের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন এবং সরকার-বিরোধীরা যে কথাগুলি প্রায়ই বলে থাকেন, সেগুলির অনেকাংশকে তিনিও অবলীলায় মান্যতা দিয়ে প্রশাসনকে দ্রুত বিহিতের নির্দেশ জারি করেন।

নিঃসন্দেহে এ এক অভিনব ঘটনা এবং বিরোধীরা এমত পরিস্থিতিতে ‘কী কর্তব্যম’ বুঝে উঠতে না উঠতেই পরের পর প্রশাসনিক স্তরে নির্দেশানুযায়ী অ্যাকশন শুরু হয়ে যায়। হাওড়ায় নথিভুক্ত বেআইনি বাড়ি ভাঙার কাজ শুরু হওয়ার পাশাপাশি ডাবগ্রাম-ফুলবাড়িতে সরকারি জমি হস্তগত করে ব্যবসা চালানোর অভিযোগে গ্রেফতার হন তৃণমূলের ব্লক সভাপতি। তারাতলায় সরকারি জমি ও বেহালা ম্যানটনে রাস্তার ওপর যথাক্রমে বিজেপি ও তৃণমূলের পার্টি অফিস বুলডোজার দিয়ে ভেঙে দেওয়া হয়। পাশাপাশি, সারা রাজ্য জুড়েই রাস্তা ও ফুটপাথ দখলমুক্ত করতে ব্যাপক পুলিশি অভিযান শুরু হয়। দেখা যায়, পুলিশ কিছু কিছু জায়গায় বুলডোজার দিয়ে অস্থায়ী দোকান ভেঙে ফুটপাথ ও রাস্তাকে দখলমুক্ত করে। অন্যত্র, হকারি আইন মেনে রাস্তার অংশ দখল না করে ফুটপাথের এক-তৃতীয়াংশে যাতে হকাররা সীমাবদ্ধ থাকেন, তার জন্য পুলিশ মাইকিং ও পুশব্যাক করে। বুলডোজার চালানোর ঘটনা অনভিপ্রেত ছিল এবং তা নিয়ে হকার সংগঠনগুলি সোচ্চার হলে মুখ্যমন্ত্রীও সমস্ত ঘটনাক্রমকে ফের পর্যালোচনার জন্য ২৭ জুন আবার নবান্নে বৈঠক ডাকেন। এবারের বৈঠকে হকার ইউনিয়নের প্রতিনিধিদেরও উপস্থিত থাকতে বলা হয়।

২৭ জুনের বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী স্পষ্ট জানিয়ে দেন, পুলিশ ও নেতারা পয়সা খেয়ে হকার বসাবে তারপর আবার বুলডোজার দিয়ে তাদের উচ্ছেদ করবে, তা চলতে পারে না। তিনি আশ্বাস দেন, কিছু কিছু হকার যারা উচ্ছেদ হয়েছেন তাদের আবারও নিয়ম মেনে বসার অনুমতি দেওয়া হবে। হকার ইউনিয়নগুলির আবেদনে তিনি তাদের ও প্রত্যক হকারকে এক মাস সময় দেন যাতে তারা ফুটপাথে তাদের পসরা নিয়ে আইন মোতাবেক এক-তৃতীয়াংশেই তাদের হকিং’কে সীমাবদ্ধ রাখেন এবং কোনও অবস্থাতেই রাস্তার ওপর নেমে না আসেন। এই বিধি কার্যকর করার জন্য তিনি একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি তৈরি করে দেন যেখানে হকার ইউনিয়নের প্রতিনিধিদেরও রাখা হয়। এক মাস পর তিনি পুরো বিষয়টা আবার পর্যালোচনা করে দেখবেন কোথাকার জল কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে।

ইতিমধ্যে গোদি মিডিয়া ও একশ্রেণির অন্ধ বিরোধীরা অতি উল্লাসে ‘হকারদের উচ্ছেদ করা হচ্ছে’ বলে বাজারে রোমহর্ষক সব বয়ান ছাড়তে শুরু করেন (অল্প কিছু জায়গায় অবশ্য উচ্ছেদ হয়), যা হকারেরাই বিনা দ্বিধায় বাতিল করে দিয়েছেন। পুলিশের অনাবশ্যক অতি-সক্রিয়তায় কিছু জায়গায় বুলডোজার চালানোর ঘটনাকে হাতিয়ার করে তারা এই রব তুলে সর্বত্র যে অতি-নাটক তৈরি করতে চেয়েছিল তা তেমন কাজে আসেনি। যেখানে যেটুকু বুলডোজার চলেছে তা অন্যায় এবং নিঃসন্দেহে বাড়াবাড়ি। ২৭ জুনের বৈঠকে তা পরিষ্কার করে দেওয়া হয় এবং তারপর আর তেমন ঘটনা দেখা যায়নি।

গত তিন-চারদিন তথাকথিত হকার উচ্ছেদের ডামাডোলে ২৪ জুনের বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রীর যে রুদ্র রূপ প্রত্যক্ষ করা গিয়েছিল এবং তিনি যে সমস্ত সমস্যা ও সে সবের নিদানের কথা পেড়েছিলেন, তা যেন কতকটা চাপা পড়ে যায়! তিনি শুধু হকার সমস্যা বা ফুটপাথ ও রাস্তা দখল নিয়ে কথা বলেননি। আরও ভয়ঙ্কর সব সমস্যার কথা বলেছিলেন যা রাজ্যকে জেরবার করে দিচ্ছে। তিনি বলেছিলেন বালি মাফিয়া, কয়লা মাফিয়া, জমি মাফিয়া, পৌরসভার পরিষেবায় ঘাটতি, নেতা ও পুলিশের তোলা আদায়, বেআইনি নির্মাণ, সরকারি জমি দখল, জনপ্রতিনিধিদের উন্নাসিকতা ও টাকা কামানো, কাটমানি ইত্যাদি ইত্যাদি হরেক সমস্যা নিয়ে, যা জনমানসে তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি করছে। মুখ্যমন্ত্রীর দিক থেকে প্রশ্নটা ছিল, জনপ্রকল্পের এত সুবিধা দিয়েও এবং রাজ্যের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নানারকম উন্নতি সত্ত্বেও কেন দুর্নীতি ও নেতাগিরি এবং প্রশাসনিক ব্যর্থতার কালিমা বয়ে বেড়াতে হবে! নিঃসন্দেহে, নিজের সরকার ও দলের প্রতি মুখ্যমন্ত্রীর এই উদ্বেগ, উষ্মা ও প্রতিবাদ, পরিপ্রেক্ষিত ও মতাদর্শগত ভিন্নতা থাকলেও, আমাদের মনে করাতে পারে ১৯৬৬ সালের ‘সাংস্কৃতিক বিপ্লবের’ সেই অমোঘ রণধ্বনিটি: সদর দফতরে কামান দাগো!  

বলাই বাহুল্য, এবারের লোকসভা নির্বাচন তৃণমূল দলের পক্ষে কঠিন লড়াই ছিল। দুর্নীতির অভিযোগে জেরবার, ইডি-সিবিআই’এর খানা তল্লাসি ও নেতাদের গ্রেফতারি বা নিত্য তলব, আদালতে ক্রমাগত হেনস্থা (ইচ্ছাকৃত) বা হার (আইন মোতাবেক), নেতাদের মাস্তানি (সন্দেশখালি), গোদি মিডিয়ার চিল-চীৎকার— এইসব নানাবিধ সাঁড়াশি আক্রমণের বিরুদ্ধে তৃণমূলের পক্ষে লড়াই দেওয়াটা অত্যন্ত কঠিন হয়ে উঠেছিল। কিন্তু তবুও তারা আশাতীত ভাবে উতরে গেল বিশেষ দুটি কারণের জন্য- এক) ‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডার’, ‘স্বাস্থ্যসাথী’, কন্যাশ্রী, রূপশ্রী ইত্যাদি সরকারি জনপ্রকল্পগুলি মানুষের জীবন-জীবিকার পক্ষে ছিল এবং দুই) সরকারের সার্বিক অর্থনৈতিক স্বাস্থ্যও মন্দ কিছু ছিল না। নীতি আয়োগ’এর দারিদ্র্য সংক্রান্ত একটি তালিকায় দেখা যাচ্ছে, multi-dimensional poverty সূচকের (২০২৩) নিচে সারা দেশে বসবাসকারী জনসংখ্যার শতকরা ভাগ যেখানে ১১.২৮, সেখানে পশ্চিমবঙ্গে তা ৮.৬ শতাংশ; উন্নয়নের এত ঢাকঢোল পিটিয়েও গুজরাতে তা ৯.০৩ শতাংশ। অর্থাৎ, পশ্চিমবঙ্গের চেয়ে গুজরাতে দারিদ্র্য বেশি। উপরন্তু, পশ্চিমবঙ্গের জিএসডিপি (বা রাজ্যের আয়) বাড়ছে এবং ঋণ ও আয়ের অনুপাত সহনশীল অবস্থায় এসে পৌঁছেছে, যদিও বিপদ একেবারে কেটে গেছে তা বলা যাবে না।

তবুও, রাজ্যে মোটামুটি শক্তপোক্ত একটা অর্থনৈতিক ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে এবং সৃজনশীল জনপ্রকল্পগুলির কার্যকারিতা ও জনপ্রসার সত্ত্বেও শহরাঞ্চলে তৃণমূলের ভোট তেমন আশাপ্রদ নয় কেন? এই প্রশ্নটি তৃণমূল নেতৃত্বকে ভাবিয়েছে। প্রথমত, ধর্মান্ধগত কারণে উচ্চবিত্ত ও উচ্চবর্ণের ভদ্দরলোকেদের একটা অংশ এবারে বিজেপি’কে ভোট দেওয়ার কথা ভেবেছিল। তা ব্যতিরেকে, দ্বিতীয়ত, শহরাঞ্চলের আরেকটি বড় অংশ এবারে তৃণমূলের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল মূলত দুর্নীতি, নেতাদের দাদাগিরি ও পৌরসভাগুলির নানারকমের ব্যর্থতার কারণে। শিক্ষায় চূড়ান্ত ও ব্যাপ্ত দুর্নীতি এবং নিয়োগের ক্ষেত্রে যোগ্য শিক্ষকদের দিনের পর দিন রাস্তায় বসে থাকা ও হয়রানি, মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তের মানুষের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার করেছে। তার ওপর বহু স্থানীয় নেতাদের আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়া থেকে তাদের ঔদ্ধত্য ও দাদাগিরি সাধারণ মানুষ ভাল ভাবে নেয়নি। সেই সঙ্গে রাস্তাঘাট, আলো, নিকাশি, পানীয় জল সরবরাহ সহ নানারকম পরিষেবায় ঘাটতি এবং প্রোমোটারদের তাণ্ডব ক্রমেই বেড়ে ওঠায় মানুষের একটা বড় অংশ বেশ ক্ষুব্ধ হয়েছেন। দুর্নীতি ও জনপরিষেবায় অবহেলা যে পার্টির বিপুল ক্ষতি করছে তা তৃণমূল নেতৃত্ব দেরিতে হলেও বুঝতে সক্ষম হয়েছেন। আর সেই উপলব্ধি থেকেই মুখ্যমন্ত্রী তাঁর নিজ দল ও সরকারের বিরুদ্ধেই কামান দেগেছেন, যা এক অর্থে হয়তো যথার্থ। তৃণমূলের আরেক নেতা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় আগেই জানিয়ে দিয়েছিলেন-- perform or perish

এখন প্রশ্ন হল, রোগটাকে তো ধরা গেল! ইলাজ হবে কী? এই প্রশ্নের দুটো পরিপ্রেক্ষিত আছে। বলা ভাল, দুটি বিপরীতধর্মী মত প্রবহমান। প্রথমটি হল, তৃণমূল দল ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে একবারেই না দল, না মনুষ্য পদবাচ্য বলে গণ্য করা। কট্টর একদল স্বঘোষিত পণ্ডিত, বোদ্ধা ও অত্যন্ত ‘নিপাট’ ভদ্দরলোক ধরনের কিছু মানুষ আছেন যারা এই মতে অন্ধ-বিশ্বাসী এবং মমতা কীভাবে তিন মেয়াদের মুখ্যমন্ত্রিত্বের কাল সত্যি সত্যিই পূর্ণ করতে চলেছেন, তা ভেবে ভির্মি যান। তারা শয়নে-স্বপনে মমতা-ফোবিয়াতে ত্রস্ত। এরা ক্রমেই সংখ্যালঘু ও অপাংক্তেয়। কিন্তু দ্বিতীয় মতটি নানারকম। মমতা-ভক্ত একদল আছেন, তাদের কথা সরিয়ে রাখলে এই মতের গোত্রে আরেকটি বেশ জোরালো প্রবাহ আছে যারা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে অত্যন্ত শক্তিশালী ও পরিণত রাজনৈতিক নেত্রী বলে গণ্য করেন। কেউ কেউ বলেন, তিনি এ রাজ্যে শুধু নন, গোটা দেশেই এক নতুন রাজনৈতিক-অর্থনীতির ধারা প্রবর্তন করেছেন। ব্রাত্য বসুর মতো নেতারা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে লাতিন আমেরিকার বাম ঘরানার নেতৃত্বের সঙ্গে তুলনায় রাখতে চান। আজ ‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডার’এর অনুসরণে দেশের অন্যত্র ‘লাডলি বহিন’, ‘মহালক্ষ্মীর ভাণ্ডার’ ইত্যাদির চল হয়েছে। অবশ্য, তার মানে এই নয় যে তিনি সমালোচনার উর্ধ্বে। দেখা গেছে, রাজ্যে গণতন্ত্রের প্রশ্নে বা বিরোধী মতামত প্রকাশের প্রতি তাঁর দল ততটা উদার নয়। এতদিন দুর্নীতির প্রশ্নেও তাঁর দল দায়ে না পড়লে নীরব থাকারই পথ নিয়েছিল। আজ হয়তো নির্বাচনের ফলাফলে কিছুটা ধাক্কা খেয়ে তারা নিজেদের সংশোধন করে নেওয়ার চেষ্টা করছে। সেও ভাল কথা! ভোটের ফলাফল যদি রাজনৈতিক দলগুলিকে সদর্থক করে তুলতে পারে, তার থেকে ভাল জিনিস আর কী হতে পারে!

এখন দেখার, নবান্ন থেকে মুখ্যমন্ত্রী যে কামান দেগেছেন তার গোলাগুলি সত্যি সত্যিই রাজ্যের অনাচার-অপকর্মকে বিধ্বস্ত করতে পারে কিনা! আশা ও নিরাশা দুইই রইল!          

Monday, 17 June 2024

অর্থনীতি চিন্তার অম্লান ধারা

শতবর্ষ ছুঁয়ে

সৌভিক দত্ত


( ১৭ জুন ১৯২৪ - ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১০)

কোনও কোনও অর্থনীতির পড়ুয়া বিজ্ঞানের ডিগ্রিধারী, কেউ বা কলা বিভাগের। কে কোন ডিগ্রি পাবেন তা নির্ভর করে তিনি কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে পাশ করলেন তার ওপর। অর্থাৎ, অর্থনীতি একটি বিজ্ঞান নাকি তার স্থান মানব বিদ্যার অঙ্গনে সেই তর্ক এখন‌ও অমীমাংসীত। তবে অর্থনীতি অধ্যয়ন যত গাণিতিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও মডেল নির্ভর হচ্ছে তত‌ই বোধহয় পোক্ত হচ্ছে একে বিজ্ঞান বলে মনে করবার প্রবণতা। একটি গাণিতিক মডেলের সাহায্যে নিজের মতকে প্রমাণ বা প্রতিষ্ঠা করতে না পারলে  কুলীন অর্থনীতিবিদদের একাডেমিক  সমাজে কল্কে পাওয়া কঠিন। এমনকি বিশ্বের সেরা শিরোপা নোবেল পুরস্কারও 'প্রাইজ অন ইকনমিক সায়েন্সেস' বলে দেওয়া হয়। মূলধারার অর্থনীতি চর্চা এখন অনেক বেশি নৈর্ব্যক্তিক ও টেকনিক্যাল। কিন্তু শাস্ত্র হিসেবে অর্থনীতি যত নৈর্ব্যক্তিক হচ্ছে, তত্ত্ব, মেথডোলজি, পরিসংখ্যান, রাশি বিজ্ঞানের মডেল, সূচকের পরিমাপ ইত্যাদির ওপর যত জোর পড়ছে,  তত তা বড় বেশি যান্ত্রিক হয়ে যাচ্ছে! তত‌ই তার কেন্দ্র থেকে মানুষ সরে যাচ্ছে না তো? এমন একটা শঙ্কার কথা শোনা যাচ্ছে বেশ কিছুকাল। 

তবে সুখের কথা, এমন কিছু কৃতী ও সার্থক অর্থনীতিবিদ আছেন যাঁদের চিন্তার কেন্দ্রস্থলে ব্যক্তি মানবের স্থান অবিচল থেকেছে। মানুষকে তাঁরা অর্থনীতির পরিভাষায় কেবল ইকনমিক এজেন্ট বা উৎপাদনের উপকরণ ভাবেন না, অর্থনীতির অর্থ যাঁদের কাছে কেবল কতকগুলো অপটিমাইজেশন এক্সারসাইজ নয়। মানুষের কল্যাণ চিন্তা অগ্রাধিকার পেয়েছে, এমন একটা অর্থনীতি চর্চার ঐতিহ্যও আমাদের সামনে রয়েছে। এ দেশের অর্থনীতিবিদদের মধ্যেও রয়েছে।

এ বিষয়ে অধ্যাপক অম্লান দত্ত ছিলেন অমর্ত্য সেন, কৌশিক বসু, প্রণব বর্ধন, অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়, জঁ দ্রেজ প্রমুখদের অগ্রজপ্রতিম। কথাটি বিশেষ ভাবে স্মরণযোগ্য এইজন্য যে, এই ১৭ জুন ২০২৪ অম্লান দত্ত শতবর্ষ পূর্ণ করলেন। 

১৯২৪'এ তৎকালীন অবিভক্ত ভারতের কুমিল্লা জেলায় তাঁর জন্ম। স্নাতক স্তরে ভর্তি হ‌ওয়ার প্রাক্কালে তাঁর পিতৃদেব তাঁকে ডেকে জানতে চান সে কোন বিষয় নিয়ে পড়বে, কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছে কিনা। তরুণ পুত্র তাঁর পিতাকে পাল্টা জিজ্ঞাসা করেন, তাঁর কি কোনও পরামর্শ আছে? পিতা বলেন, তোমার কিছু লেখা আমার হাতে এসেছে। তা পড়ে আমার মনে হয়েছে তুমি ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়ার কথা ভাবতে পারো। তুমিও কি তাই ভাবছ? পুত্র বলেন, না আমি অর্থনীতি নিয়ে পড়ব ভাবছি। স্বভাবতই পিতা মন্তব্য করেন, ও, বিষয় হিসেবে ইংরেজির চেয়ে অর্থনীতি তোমার বেশি পছন্দ? পুত্রের জবাব, একেবারেই না। ইংরেজি সাহিত্য আমি নিজে থেকেই পড়ি। ইতিহাস, দর্শন, বাংলা সাহিত্য, ধর্ম এসব বিষয় আমি নিজের প্রাণের টানেই জেনে নেব। কিন্তু বাধ্য না হলে আমি অর্থনীতির পাঠ্যবই  হয়তো হাতে নেব না। অথচ, অর্থনীতি সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা না থাকলে এই সমাজ আর এই সময়কে জানাটা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। তাই আমি অর্থনীতি নিয়েই পড়ব ভেবেছি। 

এই ঘটনা থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে অম্লান-চিন্তায় অর্থনীতি চর্চার তাগিদটা ঠিক কোথায়। তাই অম্লান দত্তের চিন্তাভাবনা অর্থনীতির চেনা পরিসর অতিক্রম করেছে অনবরত। কারণ, অর্থনীতি চর্চা তাঁর কাছে বৃহত্তর মানব চর্চার একটি উপকরণ মাত্র ছিল। অর্থনীতির থিসিস রচনায় তিনি কখনও তেমন আগ্রহ বোধ করেননি। বরং তাঁর পছন্দের কাজ ছিল অর্থনীতি পড়ানো- যেখানে মানুষে মানুষে সংলাপের মধ্য দিয়ে বিষয়টা অনেক জীবন্ত হয়ে ওঠে। উনি শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করতেন ওনার শিক্ষক বিনয় সরকারের পড়ানোর ধরন, যিনি ক্লাসে এসে অনেকটা এইরকম বলতেন- অ্যাডাম স্মিথ এই বলেছেন, রিকার্ডো এই বলেছেন, মার্কস এই বলেছেন, বিনয় সরকার এই বলছেন, এবার অম্লান কী বলবি বল; ছাত্রের মধ্যে প্রশ্নমুখর, জিজ্ঞাসু মন জাগিয়ে তোলা যে শিক্ষণ পদ্ধতির অন্যতম লক্ষ্য। আবার অম্লানবাবু যখন তাঁর স্বভাবসিদ্ধ নীচু স্বরে পড়াতেন, গোটা ক্লাসে পিন পতনের শব্দ‌ও শোনা যেত- ছাত্ররা উৎকর্ণ হয়ে থাকতেন একটি শব্দ‌ও যাতে হারিয়ে না যায়। 

অম্লান দত্তের ছাত্রদের মধ্যে অনেকের‌ই তখন বামপন্থার দিকে ঝোঁক। সময়টাই তাই। আবার প্রাতিষ্ঠানিক বামপন্থীরা তাঁকে মনে করতেন ধনতন্ত্রের ধ্বজাধারী। কেমব্রিজের বিশিষ্ট মার্কসবাদী অর্থনীতিবিদ মরিস ডবের সঙ্গে তাঁর সে আমলে আলোড়ন সৃষ্টিকারী বিতর্ক সেই ধারণায় পাকা সিলমোহর বসিয়ে দিয়েছিল। অম্লান দত্তের প্রথম প্রকাশিত যে গ্রন্থ 'ফর ডেমোক্রেসি' যা পড়ে আইনস্টাইন, রাসেলের মতো বুদ্ধিজীবীরা চিঠি লিখে স্বতংস্ফূর্ত অভিনন্দন জানিয়েছিলেন, তাও ছিল স্তালিনীয় স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে ও গণতন্ত্রের পক্ষে জোরালো সওয়াল। অম্লানবাবু আজীবন সোভিয়েত ব্যবস্থার কঠোর সমালোচক ছিলেন এবং এ ব্যবস্থা দীর্ঘকাল টিকতে পারে না এই মত পোষণ করতেন। অম্লান দত্তের ছাত্র বামপন্থী অর্থনীতিক রতন খাসনবীশ সম্প্রতি স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে জানিয়েছেন যে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাওয়ার অব্যবহিত পরে অম্লানবাবুর বাড়ি গিয়ে জিজ্ঞেস করেন যে বামপন্থার এই বিপর্যয়ে নিশ্চয়‌ই তিনি খুশি হয়েছেন। তাঁকে অবাক করে দিয়ে অম্লানবাবু বলেন যে না, তিনি হননি। অনেক মানুষের মতো তাঁর মনেও একটি সাম্যবাদী স্বপ্ন সযত্নে লালিত ছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের ব্যবস্থায় সেই স্বপ্নের একটি নিপীড়িত প্রতিমূর্তি (অম্লান দত্ত বোধহয় 'tortured embodiment of that dream' কথাটা ব্যবহার করেছিলেন) দেখে তিনি তার বিরোধিতা করতেন মাত্র।

অর্থাৎ, মুনাফা সর্বাধিকীকরণ সর্বস্ব যে মূলধারার ধনতান্ত্রিক অর্থনীতি চর্চা, তাকেই অম্লান দত্ত একমাত্র সত্য বলে মানেননি। বরং তাঁর মনোযোগ বিকল্পের সন্ধানে বারবার আকৃষ্ট হয়েছে গান্ধী ও রবীন্দ্রনাথের চিন্তা ও কর্মধারার দিকে। প্রথাগত অর্থে অর্থনীতির স্বীকৃত তাত্ত্বিক না হলেও এই দুই মনীষীর মানুষের আত্মশক্তি জাগিয়ে তুলে সামাজিক সহযোগের পথে গ্রামীণ উন্নয়ন প্রয়াসকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনার যোগ্য মনে করেছেন‌। এই বিপুল বিশ্বে সর্বত্র এক মাপে প্রযোজ্য এমন দুনিয়া জোড়া একমাত্রিক মতবাদ গড়ে তোলা কতদূর সঙ্গত এ প্রশ্ন তিনি তুলেছিলেন। এই দিক থেকে তাঁর কাছে শান্তিনিকেতনের চেয়ে শ্রীনিকেতনের মূল্য কম নয়। যেমন তাঁকে উজ্জীবিত করে তুলত রবীন্দ্র প্রেরণায় প্রাণিত পান্নালাল দাশগুপ্ত বা নিরঞ্জন সান্যাল বা অশোক ঘোষের স্বকীয় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা। আশু লক্ষ্যে বা কর্মসূচিতে তাঁরা অভিন্ন নয়, কিন্তু সর্বত্র একটা মিল হচ্ছে, যে কোনও অচল বৃহৎ নীতির দাস না হয়ে স্থানীয় সমস্যায় স্থানীয় মানুষকে সামিল করে স্থানীয় সমাধান খোঁজা। এইসব ছোট ছোট স্থানীয় উদ্যোগ নিয়ে তিনি মনে করতেন সেখানে পরীক্ষার পরিসর ছোট বলে ভুল হলেও তাও হবে ছোট মাপের। আর যদি সফল হয়, তাকে ঘিরে তৈরি হবে অনুরূপ উদ্যোগ। 

ইতিহাস সাক্ষী, কেন্দ্রীয় কোনও গ্র্যান্ড এক্সপেরিমেন্টের বড় বেশি মূল্য চোকাতে হয়। সমাজতন্ত্র সরাসরি কেন্দ্রীকরণের ওপর দাঁড়িয়ে। আবার ধনতন্ত্র যত‌ই বাজার নির্ভর প্রতিযোগিতার কথা বলুক, দেশে দেশে অভিজ্ঞতা দেখায় যে মুনাফা বৃদ্ধির দৌড়ের একচেটিয়া কারবারের দিকে ঝোঁকটা স্পষ্ট। এটা তাঁর সময়ে রবীন্দ্রনাথ‌ও লক্ষ করেছিলেন যে কেন্দ্রিকতা ও রাষ্ট্র নির্ভরতা অতি বৃদ্ধির ফলে সমাজের নিজস্ব সৃজন শক্তি ক্ষীণ হয়ে আসে। প্রাচীন সমাজ যখন এত পরনির্ভরশীল হয়ে পড়েনি তখন, তাঁর ভাষায়, 'দেশের রাজা অন্যমনস্ক হ‌ইলে দেশের জল পাত্র একেবারে রিক্ত হ‌ইয়া যাইত না।' সমাজ রাজাকে শুধু পিটিশন লিখে হাত গুটিয়ে বসে না থেকে নিজে কূপ খননে প্রবৃত্ত হত। 

কেন্দ্রীকরণের সমস্যা বোঝাতে গিয়ে অম্লানবাবু ব্যবহার করেছেন আমাদের রাজ্যের উদাহরণ। কলকাতা এ রাজ্যের প্রধান ব্যবসা কেন্দ্র, প্রশাসনিক কেন্দ্র আবার শিক্ষাকেন্দ্রও। এই ত্রহ্যস্পর্শ ভালো হয়নি। এটি অপ্রয়োজনীয় ও অনাকাঙ্ক্ষিত। যেমন আমেরিকায় ব্যবসা কেন্দ্র ন্যুইয়র্ক, রাজধানী ওয়াশিংটন, আর শিক্ষাকেন্দ্র ক্যালিফোর্নিয়া সহ নানা স্থানে বিস্তৃত। ফলে, সব রক্ত সেখানে এক স্থানে এসে জমা হয়নি। এমনকি প্রতিবেশী পাকিস্তানেও লাহোর, করাচি, ইসলামাবাদ তিন ধরনের কেন্দ্র। কিন্তু কলকাতা সব কিছুর কেন্দ্র হয়ে ওঠায় এই অতিস্ফীত মহানগরী নানা সমস্যায় জর্জরিত। এর পরিকাঠামোগত উন্নতি ও রূপসজ্জার জন্য যদি হাজার হাজার কোটি টাকার পরিকল্পনা গ্রহণ করাও হয়, তবু দুটো প্রশ্ন থেকে যায়। 

প্রথমত, সারা বাংলার গ্রামে গ্রামে যেখানে ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধার অভাব সেখানে সরকারের সিংহভাগ সম্পদ শুধু রাজধানীর উন্নতিকল্পে ঢালাটা কতদূর সঙ্গত! দ্বিতীয়ত, রাজ্যের অন্যান্য জায়গার সঙ্গে কলকাতার সমস্ত দিক থেকে ব্যবধান আরও বেড়ে গেলে আরও বেশি বেশি সংখ্যক মানুষ গ্রাম ছেড়ে কলকাতা মুখি হয়ে পড়বে। তাই অম্লানবাবুর পরামর্শ, খুব সচেতন ভাবেই কলকাতা ব্যতিরেকে বাংলার অন্যান্য স্থানে শিক্ষা, প্রশাসনের প্রতিষ্ঠান ধীরে ধীরে সরিয়ে নেওয়া হোক। এতে কলকাতাবাসী মধ্যবিত্ত শ্রেণির অভ্যস্ত ছকে বাঁধা জীবনে কিছু সাময়িক ব্যাঘাত ঘটবে কিন্তু তাঁর মতে সেটাই পশ্চিমবঙ্গের ভবিষ্যতের জন্য সুপথ। তাঁর বক্তব্য, 'কলকাতা উদাহরণ মাত্র। প্রয়োজন পরিকল্পিত বিকেন্দ্রীকরণের। কয়েকটি গ্রামের কেন্দ্রে একটি স্থানীয় বাজার ও ছোট শহর; কয়েকটি ছোট শহরের কেন্দ্রে একটি মাঝারি শহর; এইভাবে পরিকল্পনা অনুযায়ী গ্রাম ও শহরের বিন্যাস ও উন্নয়ন সম্ভব। ...কৃষিতে নিযুক্ত মানুষদের একটা বড় অংশকে গ্রামীণ শিল্পে অথবা কৃষির বাইরে অন্য কোনও উৎপাদক কাজে নিয়ে আসতে হবে তা ন‌ইলে গ্রামের আর্থিক সমস্যা ঘুচবে না। কয়েকটি গ্রামের বাইরে যে ছোট শহর সেখানেও সেই শিল্পের সংস্থান হতে পারে। বিকেন্দ্রীকৃত শিল্পায়নের জন্য ব্যাঙ্কের ঋণ নীতি ও পদ্ধতির যেমন পরিবর্তন চাই তেমনি গবেষণার সংগঠনে ও সমস্যার নির্বাচনে নতুন উদ্দেশ্যের প্রতিফলন থাকা প্রয়োজন। পরিকল্পনার এক একটি বৃত্ত তৈরি হতে পারে কিছু গ্রাম ও বাজার সহ ছোট শহর নিয়ে। এক বৃত্তের সঙ্গে বৃহত্তর বৃত্তের যোগ ঘটিয়ে আমরা এগিয়ে যেতে পারি জাতীয় অর্থনীতির দিকে। আর্থিক ও সামাজিক ক্রিয়াকর্মের এইরকম একটা রূপরেখার ইঙ্গিত ছিল গান্ধীর চিন্তা ও রচনায়। গান্ধী ও রবীন্দ্রনাথ উভয়েই পল্লীকে ভিত্তি হিসেবে মেনে নিয়ে তাঁদের আদর্শ সমাজের সংগঠনের চিত্রটি দেশের সামনে তুলে ধরেছিলেন। এর‌ই সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এঁরা শিক্ষার‌ও রূপায়ণ করেছিলেন। দেশের সঙ্গে নব মধ্যবিত্তের বিচ্ছিন্নতা থেকে উত্তরণের পথ এই।'

এখানে একটা প্রশ্ন উঠতে পারে যে, এই সুপারিশ আমাদের আধুনিক জীবনের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে কতদূর সঙ্গতিপূর্ণ? তাই বোধহয় তিনি বলছেন, 'এইখানে এসে যায় একটা জীবনদর্শনের কথা, যা থেকে অর্থনীতিকে বিচ্ছিন্ন করে দেখলে পরিণামে বিপত্তি ঠেকানো যায় না। আধুনিক অর্থবিজ্ঞানের ভিত্তিতে আছে উপযোগবাদ বা সুখবাদ। উপযোগবাদের প্রধান দুর্বলতা বোধকরি এই যে, সুখ জিনিসটাকে সে খণ্ড খণ্ড করে দেখে। তাতে ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির সুখের প্রতিদ্বন্দ্বিতা বড় হয়ে ওঠে, মানুষে মানুষে আনন্দের পরিপূরকতা তেমন স্বীকৃতি পায় না। অবশেষে সমাজের সংহতি বিপন্ন হয়।'

আজ প্রচলিত পথে হেঁটে জলবায়ু পরিবর্তন, আর্থিক অসাম্য, বেকারত্ব ও আঞ্চলিক বৈষম্য প্রসূত গণ পরিযাণ ইত্যাদি সমস্যায় আমাদের গোটা অস্তিত্ব‌ সত্যিই বিপন্ন তখন অর্থনীতি চিন্তার এই বিকল্প ধারাকে একবার পরীক্ষা করে দেখার সময় এসেছে। গঠনমূলক, কল্যাণকর এই ক্ষীণতণু ভাবনার ঐতিহ্য শতবর্ষ পেরিয়ে চির অম্লান হোক।


Wednesday, 12 June 2024

জনতার হলুদ কার্ড

আগামী লোকসভা নির্বাচন কি নিকটেই?

মালবিকা মিত্র



'আপনারে স্থাপিয়াছো, জগতের দেবতারে নহে।' 

সাধু নরোত্তমের এ হেন কথাকে রাজা 'নাস্তিকের মত কথা কহ' বলে বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন। আমাদের রাজামশাই হলে বলতেন, পাকিস্তানির মতো কথা বলো শুনি; তারপর সোজা পাকিস্তানেই চলে যেতে বলতেন। 

আসলে কবিতার রাজার সঙ্গে আমাদের বর্তমান রাজার বড় পার্থক্য আছে। আমাদের রাজা নিজেই পরমাত্মার অংশ। তিনি পরমাত্মার বাণী বাহক। পুরীর জগন্নাথ প্রভু স্বয়ং আমাদের 'রাজা'র ভক্ত'। আর তাই গল্পটা এখানে একটু ভিন্নতর হল-- রাম মন্দিরের বিগ্রহ খোদ রামলালাই রাজাকে, মানে রাজার দলকে, অযোধ্যা থেকে বিতাড়ন করলেন। এমনকি উত্তরপ্রদেশ রাজ্যেই রাজশক্তির দর্প চূর্ণ হল। অযোধ্যা তার ইতিহাসকে স্মরণ করালো-- বাবরি মসজিদ-রাম জন্মভূমির রাজনৈতিক তরজাই এখানে সব নয়। অলিতে গলিতে ছড়িয়ে আছে কত না দরগা, মাজার। বড়ি বুয়ার দরগা, ন’গজী কিংবা আড়গড়া মাজার। হিন্দু-মুসলিম দু' পক্ষই সেখানে অসুস্থ সন্তানের আরোগ্য কামনায়, বিয়ের পর প্রার্থনা জানাতে হাজির হন। কোনও মসজিদে খাদিম হিন্দু, কোথাও আবার নিরামিষ রান্না। ফলত, সম্প্রীতি ও সহিষ্ণুতার অযোধ্যা রাজশক্তিকেই প্রত্যাখ্যান করল। 

আমাদের রাজা স্বঘোষিত বিশ্বগুরু। ২০১৪ সালের পর বিশ্ববাসী ভারতকে চিনলো, জানলো। এমনকি রিচার্ড অ্যাটেনবরোর 'গান্ধী' ছবির আগে বিশ্ববাসী গান্ধীজীকেও চিনত না। এ হেন পরমাত্মার দূত ১ জুন বিকেলে কন্যাকুমারীর বিবেকানন্দ শিলায় ধ্যান ভঙ্গ করে রাজধানী ফেরার পথে বিমানে বসে দেশবাসীর উদ্দেশ্যে একটি চিঠি লিখলেন। চিঠি তো নয়, যেন বিদায়ী ভাষণ। লিখলেন, ভারতের জাতীয় আন্দোলন সেই কোন যুগ থেকে সমগ্র বিশ্বের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রেরণা হয়ে থেকেছে, সেইসব কথা। সবই আবেগ? না বাবা না, খুব ভেবেচিন্তে হিসেব কষে। রাজামশাই ধরেই নিয়েছিলেন, তিনি আর সিংহাসনে ফিরবেন না। তাই অনেক কথা বলে ফেলেছেন আবেগ ঘন বক্তৃতার ঢঙে। 

আরও বহু কিছুই বেমানান লাগছে আমাদের কাছে। যে মোদীজী এতদিন তাঁর সমস্ত বাচনে এনডিএ তো ননই, এমনকি বিজেপিও ছিলেন না, সর্বক্ষণ নিজেই নিজেকে 'মোদি' বলে সম্বোধন করে বক্তৃতা দিতেন, সেই ওনার শেষমেশ কী হল? মোদির গ্যারান্টি, এটা মোদি বলছে, মোদি হ্যায় তো মুমকিন হ্যায়, মোদি এসব অন্যায় সহ্য করবে না, মোদি জেলে ঢোকাবে-- এভাবেই উনি কথা বলতেন। উনি আত্ম'কে হারিয়ে মোদিতে মুগ্ধ। উনি কখনও আমি নন, সর্বদাই মোদি। আর সেই মোদিজী কিনা ভোটের ফল প্রকাশের পর সংসদের সেন্ট্রাল হলে দলীয় সাংসদদের সভায় একবারও মোদি বা বিজেপি'র নাম উচ্চারণ করলেন না! সারাক্ষণ এনডিএ আর এনডিএ  ও এনডিএ বলে গেলেন। জহরলাল নেহেরুর পরপর তিনবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার রেকর্ড তিনি স্পর্শ করেছেন; আত্মগর্ব ও অহমিকায় তৃপ্ত। কিন্তু দুই বগলে দুটি ক্র্যাচ-- নাইডু ও নীতিশ। রেকর্ড স্পর্শ করেও রেকর্ড কিন্তু অধরাই থেকে গেল। শুধু কি তাই, কেউ কেউ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন, নীতিশ-নাইডু, একনাথ আর চিরাগের চার কাঁধে তোলা খাটিয়ায় তৃতীয়বারের প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র দামোদর দাস মোদি। 

এবারের এই নির্বাচনী ফল একেবারেই অপ্রত্যাশিত নয়। যোগেন্দ্র যাদব, পরকলা প্রভাকর তো অনেক আগেই বুঝেছিলেন এবারের নির্বাচন ছিল সাধারণ মানুষের। ব্রিজভূষণের বিরুদ্ধে দেশের মহিলা কুস্তিগীরদের প্রতিবাদ যেভাবে দ্রুত গণ চরিত্র নিল, তিন কৃষি আইন বাতিলের দাবিতে যে দীর্ঘায়ত গণঅভ্যুত্থান, সিএএ-এনআরসি নিয়ে যে ব্যাপক গণজমায়েত, সেগুলো কি কিছুই বার্তা দেয়নি? বিনা প্রস্তুতি ও আগাম সর্তকতা ছাড়াই লকডাউন ঘোষণা, লক্ষ লক্ষ মানুষের সীমাহীন দুর্ভোগ ও প্রাণহানি, এসব তো কিছু পূর্বাভাস দিয়েছিল, আমরা শুনতে পাইনি। মনে পড়ছে, 'রক্তকরবী'তে রবীন্দ্রনাথ বিদ্রূপের সুরে বলেছিলেন, ঘোর বর্ষায় প্রেমিক ব্যাঙ তার প্রেমিকাকে সশব্দে চিৎকার করে আহ্বান করে মিলনের আকাঙ্ক্ষায়। দুঃখজনক সত্য হল, প্রেমিকার কানে সেই আহ্বান যথাযথ না পৌঁছলেও ঢোঁড়া সাপের কানে তা বিলক্ষণ পৌঁছয়। দেশের মানুষ ইঙ্গিত দিচ্ছিলেন। সেই ২০১৪ সালের পর থেকে তাঁদের পুঞ্জীভূত অসন্তোষ তাঁরা প্রকাশ করতে পারেননি। ২০১৯'এর ভোট পুলওয়ামা, বালাকোট আর মোমবাতি মিছিলেই উদ্ধার হয়ে গেল। মানুষের ভেতর জমে থাকা বারুদ প্রকাশ পেল না। বরং তা সুদে মূলে বৃদ্ধি পেল। সেই পুঞ্জীভূত অসন্তোষ ২০২৪'এর নির্বাচনে প্রকাশ পাবে এটা জানাই ছিল । 

কিন্তু বিরোধী নেতারা এটা বুঝলেন না। কর্নাটকের নির্বাচনী সাফল্য প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসকে আত্মতুষ্ট করে তুলল। ফলে, পরবর্তী পাঁচটি রাজ্যের নির্বাচনকে মুখে সেমিফাইনাল বলে ঘোষণা করলেও, বাস্তবে এককভাবে কংগ্রেস লড়াই করল ও কার্যত পর্যুদস্ত হল। নেতারা মানুষের ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষা বুঝতে ব্যর্থ হলেন। রাজ্যে রাজ্যে যথাযথ জোট গঠন হল না। অন্যদিকে মোদি সরকার কর্নাটকের বিপর্যয়ের পর পাঁচটি রাজ্যের ভোটে অতিমাত্রায় সতর্ক হল। ভোটের সাফল্যের ফলে আবার অতিমাত্রায় আত্মতুষ্টিতে ভুগলো এবং ৩৭০ ধারা বাতিল, রাম মন্দির নির্মাণ'এর সুফলেই বৈতরণী পার হবার স্বপ্ন দেখল। শাসক মোদি সরকার তবুও দেরিতে হলেও বুঝতে পেরেছিল। প্রথম দফার নির্বাচন ১৯ এপ্রিল সাঙ্গ হবার পরেই ঢোঁড়া সাপের কানে সে বার্তা পৌঁছেছিল। এর ফলে সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত ও দিশাহারা ভাবে মোদি-শাহ এক্স-রে মেশিন দিয়ে সম্পত্তি খুঁজে বের করা, জোড়া মোষের আসন্ন বিপদ, মঙ্গলসূত্র থেকে গো সম্পদ সব মুসলমানরা নিয়ে যাবে, এমন আবোল তাবোল প্রচার শুরু করল যে বোঝাই যাচ্ছিল প্রচারে নিজেদেরই আস্থা নেই। এমনকি নিজেদের পাঁচ ভাইবোনকে ভুলে গিয়ে মোদি বললেন যাদের অনেক বাচ্চাকাচ্চা পয়দা হয়, বলে মুসলমানদের ইঙ্গিত করলেন। নিজেকে পরমাত্মার অংশ বলে নিজেই প্রচার করলেন, সম্বিত পাত্র বললেন জগন্নাথদেব স্বয়ং নাকি মোদিজীর ভক্ত। এই সমস্ত প্রলাপ ও কু-কথায় ভোটের বাজার মুখরিত হল। 

মোদিজীর বডি ল্যাঙ্গুয়েজ থেকেই স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল তিনি বিধ্বস্ত ও আসন্ন বিপদের ইঙ্গিত পাচ্ছেন। কিন্তু তিনি তো তিনি নন। তিনি হলেন মোদি। আর 'মোদি হ্যায় তো মুমকিন হ্যায়'- এই নিজের তৈরি মিথ্যাকে নিজেই বিশ্বাস করতে শুরু করলেন। ফলে, 'না মুমকিন' হওয়া পর্যন্ত এই মিথ বা মিথ্যা চলতে থাকল। অবশেষে এখন সব মিথ ভেঙে এনডিএ জোট সত্য হল। কদিন আগে যদি বিরোধী দলগুলি মানুষের মনোভাবকে অনুভব করতে পারতেন, তাহলে বিজেপি ২৪০ ছুঁতে পারত না। অনেক আগেই থেমে যেত। আমরা রাজনৈতিক নেতারা বহু সময় মানুষের নাড়ির শব্দ শুনতে পাই না। টেবিল-চেয়ারে বসে জোটের অঙ্ক কষি, অফিসে, গৃহে, ঠান্ডা ঘরে সিদ্ধান্ত নিই। টের পাই না মানুষের ইচ্ছা, মানুষের বক্তব্য। মোদিজী, বিজেপি, এমনকি বিরোধীরা কেউ কি ভেবেছিলেন, অযোধ্যা কেন্দ্রে বিজেপির এমন শোচনীয় পরাজয় হবে! 

সুতরাং, ২০২৪'এর লোকসভা নির্বাচনের জনাদেশ সরকারকে হলুদ কার্ড দেখিয়েছে তাই নয়, বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলিকেও হলুদ কার্ড দেখিয়েছে, সাবধান করেছে। বিরোধীরা কি কিছু শিক্ষা নেবেন? মনে তো হয় না। তা না হলে পশ্চিমবাংলায় দলের শোচনীয় পরাজয়ের পর সিপিআইএম পলিটিব্যুরোর নেতা ও রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম কত অবলীলায় বলতে পারেন, আমাদের দলের কেউ 'লক্ষ্মীর ভাণ্ডার' নিয়ে কোনও কটূক্তি করেনি। যারা সারা বছর বলে গেল, ভাতা হল ভিক্ষা, তারাই এখন বলছে আমরা ও কথা বলিনি। একবারও বলার সৎ সাহস দেখালো না, ও কথা বলা আমাদের ভুল হয়েছিল। এআইসিসি এখনও স্বীকার করেনি যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দেওয়া কংগ্রেসকে দুটি আসনের প্রস্তাব নিয়ে আলোচনার টেবিলে বসা উচিত ছিল। আলোচনা করে দুইকে চার করা যেত না এমন নয়। কংগ্রেস আলোচনাই চায়নি, কারণ মহম্মদ সেলিম চায়নি। অনিবার্যভাবেই যা হবার তাই হয়েছে। 

আমি নিজে বিশ্বাস করি, পশ্চিমবাংলায় কংগ্রেস ভেঙে তৃণমূল তৈরি হওয়া ও তৃণমূল দলের হাতে সিপিএম'এর ক্ষমতাচ্যুতি এই ঐতিহাসিক পটভূমিতে নিহিত আছে এই তিন দলের অনৈক্যের ক্ষেত্র। ঐক্য সম্ভব নয়, কাম্যও নয়। কিন্তু কংগ্রেস ও সিপিআইএম'কে প্রধান শত্রুর প্রতি বর্শামুখ নির্দিষ্ট করতে হবে ও তৃণমূল প্রধান বিরোধী দল এই ধারণা ছাড়তে হবে। তৃতীয় বা চতুর্থ স্থানাধিকারীকে আগে দ্বিতীয় স্থানে উঠে আসার চেষ্টা করতে হবে। তা না হলে বাংলার রাজনীতির এক গভীর বিপদ আসন্ন। তৃণমূল সরকারের প্রতি মানুষের যে পরিমাণে মোহমুক্তি ঘটবে ও ঘটছে, তারা বিকল্প হিসেবে সামনে বাম বা কংগ্রেসকে না পেয়ে দ্বিতীয় স্থানাধিকারী বিজেপিকেই বিকল্প হিসেবে খুঁজে নেবে ও নিচ্ছে। কংগ্রেসকেও পুরনো গৌরবময় অতীতকে ভুলে আঞ্চলিক দলগুলিকে সম্মান করতে শিখতে হবে। আরজেডি, সপা, আপ, তৃণমূল, ডিএমকে, জেএমএম, শিবসেনা, এনসিপি, বহু ধারার বাম ও সবাইকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্বীকার করতে হবে। এই নির্বাচনে মানুষ যা বলতে চেয়েছিল তা যথার্থভাবে প্রতিফলিত হবে আগামী লোকসভা নির্বাচনে। কে বলতে পারে সেই নির্বাচন খুব বেশি দেরি নেই।


Thursday, 6 June 2024

সাধু সাবধান!

ধর্মীয় ফ্যাসিবাদকে আপাতত রোখা গেল

সোমনাথ গুহ



ভারতবর্ষের বুকের ওপর যেন একটা ভারী পাথর চাপা দেওয়া ছিল। লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল বেরনোর সাথে সাথে সেই চাপ অনেকটাই মুক্ত হল; দীর্ঘ এক দশক পর মানুষ আবার বুক ভরে শ্বাস নিল, বাবাসাহেব আম্বেদকরের সংবিধান আপাতত রক্ষা পেল, একনায়কতন্ত্রের ভীতিপ্রদ করাল ছায়া অপসারিত হল। প্রতিটি দিনের প্রতিটি মুহূর্তের যে মুখাবয়ব দেশের মানুষের চোখের সামনে দুঃস্বপ্নের মতো বিরাজ করত, তা সকালের সংবাদপত্রে হোক বা ‘এক দেশ, এক রেশন কার্ড’এ, অথবা কোভিড শংসাপত্রে, তা থেকেও মুক্তি পাওয়া গেল। এই রায় আশ্বাস দিল যে ভারতের গণতন্ত্র হাজারও দুর্বলতা সত্ত্বেও এখনও যে কোনও বিপদকে ঠেকিয়ে রাখতে সক্ষম। 

প্রথমেই এই নির্বাচনের কিছু বৈশিষ্ট্য দেখে নেওয়া যাক। অয্যোধ্যা, যা ফৈজাবাদ লোকসভার অন্তর্গত, সেখানে বিজেপির পরাজয় বুঝিয়ে দিয়েছে, মানুষ ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করা সব সময় বরদাস্ত করে না। রাজস্থানের বাঁশওয়াড়া কেন্দ্রে ভারতীয় আদিবাসী পার্টির প্রার্থী তিন লাখের অধিক ভোটে সঙ্ঘী প্রার্থীকে পরাজিত করে এই বার্তাকে আরও জোরালো করেছে। ভেবে দেখুন, ওই কেন্দ্রেই প্রধানমন্ত্রী মোদী সেই চরম বিভাজনকারী মন্তব্য করেছিলেন: কংগ্রেস ক্ষমতায় এলে মহিলাদের মঙ্গলসূত্র ‘অনুপ্রবেশকারী’ কিংবা ‘যাদের অধিক সন্তান আছে’ তাদের দিয়ে দেবে। দ্বিতীয়ত, প্রধান সেবককে কেন্দ্র করে যে দুর্বিষহ ‘পারসোনালিটি কাল্ট’ গড়ে উঠেছিল তা ধাক্কা খেয়েছে। বেনারসে এক ধাক্কায় তাঁর জেতার মার্জিন প্রায় সাড়ে তিন লাখ কমে গেছে। বাংলায় তাঁর তথাকথিত ম্যাজিক কাজে দেয়নি, অনেক কেন্দ্রেই তাঁর প্রচার সত্ত্বেও বিজেপি হেরেছে। 

অপরদিকে ৬০০০ কিমি পদযাত্রা এবং সাম্প্রতিক সময়ে নিজের নানা বক্তব্য ও পদক্ষেপ রাহুল গান্ধীকে একজন নির্ভরযোগ্য রাজনৈতিক নেতা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। এর আগে তিনি ছিলেন একজন অনিচ্ছুক রাজনীতিবিদ, অন্তত তাঁর জনভাবমূর্তি তাই ছিল। মণিপুর, যে রাজ্য গত এক বছর ধরে গৃহযুদ্ধে নিমজ্জিত, সেখানে দুটি কেন্দ্রেই কংগ্রেস জিতেছে। তাৎপর্যপূর্ণ হচ্ছে, ইনার মণিপুর যা মেইতেই অধ্যুষিত সেই কেন্দ্রও বিজেপির বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছে। 

সর্বোপরি, ২০১৪ ও ২০১৯ যদি ফেসবুক, টুইটারের ভোটযুদ্ধ হয়, এবারের নির্বাচনে ইউটিউবার'দের জয়জয়কার। ধ্রুব রাঠি, রাবিশ কুমার, অজিত অঞ্জুম, এবং বাংলার কিছু প্রাজ্ঞ সাংবাদিক, ‘ইনফ্লুয়েন্সার’ মানুষের কাছে গোদি মিডিয়ার এক বিকল্প সংবাদমাধ্যমকে হাজির করেছেন। সরকারি তাঁবেদারদের ‘অল ইজ ওয়েল’ খবরের বিপরীতে মানুষ এই ব্যক্তিদের নাছোড়বান্দা মনোভাবের সৌজন্যে বেকারি, মুল্যবৃদ্ধি, অর্থনৈতিক বৈষম্য ইত্যাদি জ্বলন্ত সমস্যাগুলোর সন্ধান পেয়েছেন।   

এর পাশাপাশি একটা আপসোসও রয়ে গেল। মনে হচ্ছে তীরে এসে তরী ডুবল- আর মাত্র ৩৮টা আসন পেলেই তো কেল্লা ফতে হয়ে গিয়েছিল। মহারাষ্ট্র, পশ্চিমবাংলা, বিশেষ করে উত্তরপ্রদেশে আশাতীত ভালো সাফল্যের পরও কেন নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অধরা রয়ে গেল? কিছু রাজ্যে কংগ্রেস ও সহযোগী দলের ফলাফলের ওপর চোখ রাখা যেতে পারে। মাত্র এক বছর আগে কংগ্রেস ১৩৫ আসন জিতে কর্নাটকে ক্ষমতায় আসে। নিজেদের ইস্তাহারে প্রতিশ্রুত পাঁচটি গ্যারান্টি রূপায়িত করার কারণে আশা করা হয়েছিল যে তারা লোকসভাতেও ভালো ফল করবে। তারা নিজেরাই ২৮টার মধ্যে অন্তত ১৮টা জিতবে আশা করেছিল, কিন্তু জিতেছে মাত্র ৯টা। আসলে জনকল্যাণমূলক প্রকল্প চালু করাই যথেষ্ট নয়, সেটা মানুষের কাছে পৌঁছচ্ছে কিনা নিশ্চিত করতে হয় এবং ভোটবাক্সে তার ফায়দা তোলার জন্য প্রচার করতে হয়। এটা বাংলায় তৃণমূল কংগ্রেস করতে পেরেছে, রাজস্থানে ২০২৩'এর বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেস পারেনি, যদিও মুখ্যমন্ত্রী অশোক গেহলত রান্নার গ্যাসের দাম ৫০০ টাকা করে দিয়েছিলেন, গিগ শ্রমিকদের জন্য বিশেষ প্রকল্প চালু করেছিলেন যা আর কোনও রাজ্যে আজ অবধি হয়নি। এর কিছুটা সুফল অবশ্য কংগ্রেস লোকসভায় পেয়েছে।

বিহারে আসন বন্টনের বৈষম্যের কারণে ইন্ডিয়া জোটের ফল আশানুরূপ হয়নি। আরজেডি ২৩টার মধ্যে মাত্র চারটে আসনে জিতেছে। তাদের নিজেদের কোটা থেকে তারা 'বিকাশশীল ইনসান পার্টি'কে তিনটে আসন ছেড়ে দিয়েছিল, যার একটাতেও তারা জিততে পারেনি। এর বিপরীতে ‘মালে’ (সিপিআইএমএল, লিবারেশন) তিনটে আসনে লড়ে দুটিতে জয়লাভ করেছে। তাদের অবশ্যই আরও বেশি আসন প্রাপ্য ছিল। সাধারণ মানুষের থেকে ২০ টাকা করে চাঁদা তুলে তাঁরা নির্বাচনে লড়েছেন যা এক বিরল নিদর্শন স্থাপন করেছে। 

হিমাচল প্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, উত্তরাখন্ড, দিল্লিতে কংগ্রেস এবং ইন্ডিয়ার ফলাফল শোচনীয়। দিল্লিতে আপ ও কংগ্রেসের মধ্যেকার দীর্ঘদিনের তিক্ততার কারণে নিচু তলায় কর্মীদের মধ্যে কোনও বোঝাপড়া গড়ে ওঠেনি যা আসন জেতার ক্ষেত্রে অন্তরায় হয়েছে। হিমাচলে ক্ষমতায় থাকা সত্ত্বেও কংগ্রেস একটি আসনও জিততে পারেনি, যা সত্যিই বিস্ময়কর। মধ্যপ্রদেশে কংগ্রেস বিজেপির বি টিমে পরিণত হয়েছে। বর্ষীয়ান নেতা কমলনাথ নামে মাত্র কংগ্রেস, গান্ধী পরিবারের সঙ্গে পুরনো সম্পর্কের কারণে তিনি এখনও দলে টিকে আছেন। এঁদের মতো নেতা যতদিন দলে থাকবেন ততদিন ওই রাজ্যে কংগ্রেসের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। এছাড়া গুজরাত, ওড়িশা, অন্ধ্রপ্রদেশে কংগ্রেস মাত্র একটি করে আসন জিতেছে। বলাই বাহুল্য, ইন্ডিয়া জোটকে ক্ষমতায় আসতে হলে কংগ্রেসকে অন্তত ২০০'র কাছাকাছি আসন পেতে হত। তাই কংগ্রেস যেমন ফ্যাসিবাদকে সাময়িক ভাবে ঠেকিয়ে রাখার কৃতিত্বের অন্যতম দাবিদার, তেমনই ম্যাজিক অঙ্কে না পৌঁছনোর সিংহভাগ দায়ও তাদের।        

বিগত ১৭তম লোকসভায় দেশের সংবিধানের বিভিন্ন ধারা বারবার লঙ্ঘন করা হয়েছে। সাড়ে তিনশোর বেশি আসনের সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে ব্যবহার করে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার সংবিধানের বিভিন্ন ধারাকে হেলায় পদদলিত করেছে; যেমন এটা প্রথম লোকসভা যেখানে সংবিধানের ধারা ৯৩ লঙ্ঘন করে কোনও ডেপুটি স্পিকার নির্বাচিত হয়নি। এই বিষয়ে সীমিত শক্তির কংগ্রেস দলের প্রতিবাদ তারা উপেক্ষা করেছে। তারা প্রায় বিনা আলোচনায় একের পর এক আইন প্রণয়ন করেছে যা দেশের সাতাত্তর বছরের ইতিহাসে অভূতপূর্ব। মাত্র ১৬ শতাংশ বিল আলোচনার জন্য সিলেক্ট কমিটিতে পাঠানো হয়েছে, যা ১৫তম লোকসভায় ছিল ৭১ শতাংশ, ১৬তম লোকসভায় ছিল ২৫ শতাংশ। লক্ষণীয়, ২০১৪ থেকে আলোচনার অবকাশ প্রায় বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। প্রায় কোনও আলোচনা-বিতর্ক ছাড়াই তিনটি শ্রম বিল, ডিজিটাল ডেটা প্রোটেকশন বিল, ন্যায় সংহিতা বিল ইত্যাদি আইনে পরিণত করা হয়েছে। 

এসবেরই থেকে সাময়িক মুক্তি। ‘সাময়িক’, ‘আপাতত’ শব্দগুলো ব্যবহার করতে হচ্ছে, কারণ, ১৮তম লোকসভার চরিত্র বহুমাত্রিক এবং তাই কিছুটা টলমল। মানুষের কাছে যেটা স্বস্তির সেটা হল টিডিপি, জনতা দল (ইউ) ইত্যাদির চাপে থাকার কারণে বিজেপি তাদের ধর্মীয় ফ্যাসিবাদের প্রকল্প রূপায়ণ করতে পারবে না, মুসলিম নিপীড়ন, বুলডোজার অভিযান বন্ধ রাখতে হবে। এই দুটি দল রাজনীতির ময়দানে বিশুদ্ধ হাওয়া মোরগ হিসাবে পরিচিত, কখন যে কী করবে একবিংশ শতাব্দীর নব্য অবতারও বুঝে উঠতে পারবেন না। ইতিমধ্যেই তারা সওদা করা শুরু করে দিয়েছে-- ক্যাবিনেট মন্ত্রী চাই, স্পিকার চাই, রাজ্যের জন্য স্পেশ্যাল প্যাকেজ চাই! নানা দাবির কারণে বিজেপি নেতৃত্বের চুল খাড়া হয়ে গেছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বিধানসভা হোক বা লোকসভা, উভয় ক্ষেত্রেই সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে রাজনীতি করতে অভ্যস্ত। তিনি গরিষ্ঠতাকে নির্মম ভাবে ব্যবহার ও নানা ছলচাতুরি করে সহযোগী এবং বিরোধী উভয়কেই চমকে ধমকে দমিয়ে রাখতে অভ্যস্ত। তিনি অটল বিহারি বাজপেয়ী নন যিনি ১৯৯৯ সালে ১৮২টা আসন নিয়েও পুরো পাঁচ বছরের মেয়াদ পূর্ণ করেছিলেন। এছাড়া দলের মধ্যেই তাঁর যে প্রশ্নাতীত আধিপত্য ছিল সেটা আর নেই, বিশেষ করে আরএসএস'এর নিরঙ্কুশ সমর্থন তাঁকে আবার নতুন করে অর্জন করতে হবে। তিনি বর্তমানে মেরুকরণের রাজনীতি বর্জন করবেন, অভিন্ন দেওয়ানি বিধি, সিএএ-এনআরসি, সংবাদমাধ্যমের কন্ঠরোধ করার বিভিন্ন আইন মুলতুবি রাখবেন, ইডি-সিবিআই'এর রাশ টেনে ধরবেন। 

কিন্তু তিনি সব সময় সুযোগ খুঁজবেন কী করে ২৪০ সংখ্যাটাকে ২৭২ করা যায়। এটাই হবে তাঁর পাখির চোখ। আর কে না জানে, এই খেলায় তিনি ও তাঁর ছায়াসঙ্গী অসম্ভব পটু। শুধু মহারাষ্ট্রের দিকে চোখ ফেরালেই সেটা বোঝা যায় যেখানে তারা শরদ পাওয়ার আর উদ্ধব থ্যাকারের মতো পোড়খাওয়া  রাজনীতিবিদদের দলকেও টুকরো করে দিয়েছেন। এছাড়া তাঁদের হাতে আছে বিপুল অর্থভাণ্ডার, দেশের প্রধান দুই কর্পোরেট সংস্থার অকুন্ঠ সমর্থন। আপাতত বিজেপি নেতৃত্ব শ্বেতশুভ্র পায়রার রূপ নিলেও এটা নিশ্চিত যে তারা শুরু থেকেই তলায় তলায় ইন্ডিয়া জোটের বড় দলগুলিতে ভাঙ্গন ধরিয়ে নিজেদের দিকে টানার চেষ্টা করবে। সুতরাং, ইন্ডিয়া জোট এবং সমস্ত গণতান্ত্রিক শক্তিকে অতি সতর্ক থাকতে হবে। সাধু সাবধান!


Wednesday, 5 June 2024

অউর এক ধাক্কা

এক নতুন সম্ভাবনার দিকে

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য


 

ভারতবর্ষ সম্পর্কে উৎসুক রম্যা রল্যাঁ’কে রবীন্দ্রনাথ একবার বলেছিলেন, ‘ভারতকে জানতে হলে বিবেকানন্দকে জানুন।’ কারণ, উনবিংশ ও বিংশ শতকে যে দুজন ব্যক্তিত্ব কার্যত পায়ে হেঁটে প্রায় সমগ্র ভারতবর্ষকে চষে বেড়িয়েছিলেন, তাঁদের অন্যতম ছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ। অন্যজন মহাত্মা গান্ধী। এই বিশাল ভূখণ্ডে কত শত মত, বিশ্বাস-অবিশ্বাস, কুসংস্কার, অন্ধতা, প্রজ্ঞা ও মানবিকতার যে বিবিধ যাপনধারা নানাবিধ ভাষা, ধর্ম ও জাতির সহাবস্থানের মধ্য দিয়ে বহমান, তা এই দুজনই মর্মে মর্মে প্রত্যক্ষত উপলব্ধি করার চেষ্টা করেছিলেন। তাই আমরা বলি, ‘বিবিধের মাঝে দেখ মিলন মহান।’

সেই দেশকে কি ‘এক দেশ এক ধর্ম এক জাতি এক ভাষা’র দাপট দিয়ে রুদ্ধ করা যায়? একটা সময়ের পর এই প্রশ্ন উঠেছিল। সর্বত্র। যে রামমন্দিরের রণহুঙ্কারে এক বিশাল অংশের সহনাগরিকের রাতের ঘুম ছুটে গিয়েছিল, সেই মন্দির এলাকাতেই পর্যুদস্ত হয়েছে ‘এক দেশ এক ধর্মের’ উন্মত্ত মানসিকতা। ফৈজাবাদ লোকসভা কেন্দ্র, যার অন্তর্গত অযোধ্যা ও রামমন্দির, সেখানে পরাজিত হয়েছেন বিজেপি প্রার্থী। এই হল ভারতবর্ষ। যাঁরা রামকে আরাধ্য দেবতা মনে করেন, তাঁরাও রামের নামে মাস্তানিকে মেনে নিতে পারেন না। এই হল ভারতবর্ষ। হিন্দুত্বের স্বঘোষিত আইকন নরেন্দ্র মোদির নিজের কেন্দ্রে (বারাণসী) গতবারের নির্বাচনে তাঁর জয়ের ব্যবধান ৪ লক্ষ থেকে এবারে নেমে এসেছে ১.৫ লক্ষে। এই হল ভারতবর্ষ। যাঁরা মনেপ্রাণে হিন্দু, প্রবল ভাবে ধর্মবিশ্বাসী, তাঁদেরও অধিকাংশজন চান না ‘হিন্দু রাষ্ট্র’ প্রতিষ্ঠার নামে অন্য ধর্মমতে বিশ্বাসীদের ওপর তরবারির কোপ পড়ুক। এই হল ভারতবর্ষ। স্বামী বিবেকানন্দ ও মহাত্মা গান্ধী এই ভারতবর্ষকেই প্রত্যক্ষ করেছিলেন।

এবারের লোকসভা নির্বাচনে জনতা রায় দিয়েছে ভারতবর্ষের বিবিধতা ও বৈচিত্র্যের পক্ষে, ক্রমশ অসহ্য ও নির্মম হয়ে ওঠা এককেন্দ্রিকতার বিপক্ষে। কিন্তু এই রায় সর্বত্র সমান হয়নি। তার কারণও আছে। মানুষের বিচারবুদ্ধি অসীম। তারা একত্রে ভারসাম্য নির্মাণ করতে জানে। তারা শাসক ও বিরোধী, দু’ পক্ষেরই তুল্যমূল্য বিচারে পারদর্শী। কিন্তু কীভাবে করে, কেউ বলতে পারবে না। অতীতে ইন্দিরা গান্ধী জরুরি অবস্থা জারি করে রেহাই পাননি। আবার তার বিপ্রতীপে প্রতিষ্ঠিত জনতা পার্টির সরকারও দু’-আড়াই বছরের বেশি টেকেনি। পরের নির্বাচনে আবারও ইন্দিরা গান্ধী প্রত্যাবর্তন করেন। তাই, নরেন্দ্র মোদি ও তাঁর দল এই নির্বাচনে জোর ধাক্কা খেলেও একেবারে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যায়নি। নতুন সরকার গঠনেও তেমন আঙ্কিক গোলযোগ নেই। কিন্তু সেই সরকারের স্থায়িত্ব ও দাপট কতটা হবে তা নিয়ে সংশয় আছে। বারাণসীতে যথেচ্ছ পুজোপাঠ দিয়ে, নিজেকে পরমাত্মার সরাসরি প্রেরিত দূত হিসেবে চিহ্নিত করে ও নির্বাচনের দিন কন্যাকুমারীতে বিশাল ক্যামেরা সেটিং’এর সামনে ধ্যানের ফটো-শ্যুটিং করেও, দেখা যাচ্ছে, তিনি পরমাত্মার আকাঙ্ক্ষিত ‘আশীর্বাদ’ ও জনগণের কাম্য ভোট, কোনওটাই পাননি।

অতএব, এবারের নির্বাচনের ফলাফল কতকগুলি জোরালো বার্তা দিতে চাইছে। তার গোটা পাঁচেক’কে না হয় খানিক বোঝার চেষ্টা করা যাক:

বার্তা এক: মৌলবাদী ও ঘৃণার রাজনীতি এ দেশে অচল। শাসন ও শোষণের জন্য শাসকেরা মানুষের মধ্যে বিভাজনের বীজ ছড়িয়ে নিজেদের অকুন্ঠ শাসনকে বজায় রাখতে চায়। ধর্মের বিভাজন এ ক্ষেত্রে একেবারে মোক্ষম। আমরা জানি, সমাজের সর্বস্তরে আপস ও দ্বন্দ্ব, অন্য কথায়, সহাবস্থান ও ঠোকাঠুকি, দুইই কতকটা সমভাবে বহমান। কিন্তু ঠোকাঠুকিটাকে যদি কেউ হাতিয়ার করে এবং তৎপ্রসূত রেষারেষি ও হিংসার রাজনীতিকে প্রধান অক্ষ করে রাজনৈতিক ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করতে ও রাখতে চায়, তাহলে তার ভয়ঙ্কর ফলাফল কী হতে পারে আমরা গত কয়েক বছরে প্রত্যক্ষ করেছি। একটি বিশেষ ধর্মীয় সম্প্রদায়ের প্রতি নিয়মিত বিষোদগার, তা ব্যতিরেকে খাওয়া-দাওয়া, পোশাক-আশাক, ব্যক্তিগত জীবন, নারীদের চলাচল, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এইসব নিয়ে যদি ফতোয়া দেওয়া হতে থাকে এবং তা না মানলে তার ভয়ঙ্কর পরিণতির আশঙ্কা থাকে, স্বভাবতই এই মৌলবাদী ও ঘৃণার রাজনীতির বিরুদ্ধে মানুষ এবারের নির্বাচনে অঞ্চল-বিশেষে ইতিবাচক রায় দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। উপরন্তু, অন্যান্য সন্ত্রাসের (যেমন, রাজনৈতিক, জাতপাত ভিত্তিক, গোষ্ঠী ভিত্তিক) বিরুদ্ধেও সতর্কবার্তা এই রায়ে নিহিত আছে। তা একেক রাজ্যে একেকরকম ফল দেখে অনুমান করা যাচ্ছে।

বার্তা দুই: ইদানীং জনকল্যাণের রাজনীতি রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের মূল এজেন্ডায় চলে এলেও এবং তা নিয়ে শত শত প্রকল্প চালু হলেও কোনও সরকার যে শুধুমাত্র সেগুলির ওপর নির্ভর করেই জনতার ইতিবাচক রায় লাগাতার আদায় করে নিতে পারবে, তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। অন্ধ্রপ্রদেশ ও উড়িষ্যায় যথাক্রমে জগন রেড্ডি ও নবীন পট্টনায়েক সরকারের পতন তাহলে হত না। এই দুই সরকারই তাদের মেয়াদকালে যথেষ্ট জনকল্যাণ প্রকল্পের কাজ করেছে কিন্তু তবুও নির্বাচনে হেরেছে মূলত দুটি কারণে: ১) অন্ধ্রে বেহিসেবি টাকা খরচের ফলে সরকারি কোষাগারে সংকট ও ২) উড়িষ্যায় মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণ ও ‘উন্নয়নের’ নামে বিভিন্ন এলাকায় গরিব মানুষের উপর স্টিমরোলার চালানো ও তাদের উচ্ছেদ। ফলে, এই লোকসভা নির্বাচন যদিচ কেন্দ্রে ফ্যাসিবাদী সরকার গঠনের সম্ভাবনাকে নির্মূল করার ভোট, তথাপি স্থানীয় সরকারের অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি বা ব্যর্থতার বিরুদ্ধে রায় দেওয়ারও কিছু বাধ্যবাধকতা ছিল। ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় এই বহুমাত্রিক জটিলতাকে সবসময়েই মাথায় রাখতে হবে।

বার্তা তিন: উত্তরপ্রদেশে যোগী রাজের যে মাহাত্ম্য প্রচার করা হয়, যার অন্যতম উপাদান ‘বুলডোজার রাজ’- তার বিরুদ্ধে প্রবল বিতৃষ্ণায় মানুষ বিরুদ্ধপক্ষকে (ইন্ডিয়া জোট) ঢেলে ভোট দিয়েছে। কার্যত, রাজ্যওয়ারি ফলাফলের বিচারে বিজেপি সেখানে পরাজিত। কারণ, সমগ্র উত্তরপ্রদেশ জুড়েই নারী নিরাপত্তার অভাব, সংখ্যালঘু মানুষের আতঙ্কে দিন কাটানো, বুলডোজারের ভয়ে গরিব মানুষের দৈনিক ত্রাস, ব্রিজভূষণ ধরনের রাজনৈতিক নেতাদের সন্ত্রাস ইত্যাদি বিবিধ কারণে সাধারণ মানুষের প্রাণ ওষ্ঠাগত। পরন্তু, সেখানে বিরোধীরা কার্যত একটি পাকাপোক্ত জোটও গড়ে তুলতে পেরেছিল। এই ধরনের জোট গড়ে উঠলে বিজেপি যে খড়কুটোর মতো উড়ে যেতে পারে তার আরও একবার প্রমাণ পাওয়া গেল।

বার্তা চার: এবারে সোশ্যাল মিডিয়া, বিশেষত ইউটিউব চ্যানেলের সঞ্চালক ও বিশ্লেষকেরা এক মিডিয়া বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়েছেন। লাখে লাখে মানুষ টিভি চ্যানেল ও খবরের কাগজ থেকে মুখ ফিরিয়ে ইউটিউব ও নানা বিকল্প ডিজিটাল মিডিয়ার দিকে মনোনিবেশ করেছে যেখানে সংবাদ ও ঘটনাক্রম বিশ্লেষণের এক যুগান্তকারী বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে। এই প্রবণতা বেশ কিছু বছর ধরেই সংহত হচ্ছিল কিন্তু এবারের লোকসভা নির্বাচনের আগে তা যেন বিস্ফোরণের রূপ নিল। রাভিস কুমার, সাক্ষী মালিক, অজিত অঞ্জুম, আকাশ ব্যানার্জি, ভগৎরাম, বং নিউজ, এনকে ডিজিটাল, এনটিটি ইত্যাদিদের ইউটিউব চ্যানেলগুলি যেন আগুনের মতো গোটা দেশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ল। আর তারই মাঝে হাইড্রোজেন বোমার মতো আছড়ে পড়ল ধ্রুব রাঠি’র ‘মোদি ডিক্টেটর’ শীর্ষক ইউটিউব প্রতিবেদনটি। কোটি কোটি লোকের কাছে মোদিরাজের আসল চেহারা উন্মোচিত হল। মোবাইল থেকে মোবাইলে কোটি কোটি মানুষের কাছে বাহিত হল সে চেহারা। মহল্লায় মহল্লায় স্ক্রিন খাটিয়ে ধ্রুব রাঠি’র প্রতিবেদন হাজার হাজার মানুষকে দেখানো হল। হিন্দি বলয় জুড়ে তা এক তীব্র অভিঘাত তৈরি করল। এরপর আরও আরও এইরকম ইউটিউব ভিডিও দেশ জুড়ে মশাল জ্বাললো। এই প্রবল জনোচ্ছ্বাসের কাছে ভেসে গেল একনায়কের সব ক্ষমতা ও দম্ভ। জনতার এই ‘মিডিয়া ক্ষমতা’ নিঃসন্দেহে এক নতুন রাজনৈতিক যুগের প্রবর্তন। বার্তা হল, এই ধারা আরও শক্তিশালী হয়ে এক উন্নত রাজনৈতিক পরিসর নির্মাণ করবে।

বার্তা পাঁচ: নির্বাচনের ফলাফল বিজেপিকে প্রবল ধাক্কায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের সংখ্যা থেকে অনেকটা নিচে নামিয়ে দিল বটে কিন্তু তাদের জোট এনডিকে’এ সামান্য বেশি আসনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিল। এরকমটাই যেন হওয়ার ছিল। এক প্রবল উচ্চাকাঙ্ক্ষী, মেগালোম্যানিয়াক স্বৈরাচারীকে যখন শাসন চালানোর জন্য নির্ভর করতে হবে ছোট ছোট দলগুলির মতামতের উপরে, তখনই তাঁর আসল যন্ত্রণাপর্ব শুরু হবে। তিনি প্রতিদিন দগ্ধ হবেন, চাপের কাছে অহরহ মাথা নিচু করবেন, তবুও ক্ষমতা ছাড়তে পারবেন না; আশায় থাকবেন, এই বুঝি পরমাত্মা তাঁকে সুযোগ করে দেবেন একচ্ছত্র অধিপতি হওয়ার। কিন্তু ভারতীয় গণতন্ত্রের বনিয়াদ যে বড্ড শক্ত, আর দেশের মানুষগুলোও সাত সেয়ানার এক সেয়ানা; তাঁরা যথার্থই জানেন, কখন ঢিল দিতে হয় আর কখন টান। এই টানাপোড়েনেই সম্ভবত বিশ্বগুরুর বয়সও বাড়তে থাকবে, সঙ্গে ক্লান্তি আর তীব্র হবে হাল ছেড়ে দেওয়ার মানসিকতা। সেই হাল তিনি ধৈর্যচ্যুতিতে ছাড়বেন নাকি শেষবিন্দু অবধি যুঝে, তা আপাতত দেখার।

অন্তত এটুকু আশ্বস্ত হওয়া গেছে, সাধারণ মানুষের ওপর যে ভয়ঙ্কর রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক স্টিমরোলার চলছিল, ব্যক্তিগত জীবনের পছন্দ-অপছন্দ ও যাপনরীতির ওপর হুমকির বাতাবরণ তৈরি হচ্ছিল, মতপ্রকাশের অধিকারের ওপর রাষ্ট্রীয় নিপীড়নে এক অঘোষিত জরুরি অবস্থাকাল বিরাজ করছিল, তার হয়তো কিছুটা বিরতি হবে। কারণ, শাহেনশাহ এখন আর একা সবকিছু করতে পারবেন না। তাঁর হাত-পা বাঁধা। তাঁর দল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি।  

 

                   

Wednesday, 22 May 2024

দৃশ্যের কোলাজ

ছাইচাপা আগুন খুব বিপজ্জনক

মালবিকা মিত্র



কয়েকটি টুকরো ছবি তুলে ধরছি, কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছনো আমার কাজ নয়। কিন্তু ছবিগুলি যথাযথ। 

প্রথম ছবি: আমার এক পুরনো ছাত্র বর্তমানে একটি ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের শিক্ষক, মধ্যবিত্ত পরিবার। ফোনে জানিয়েছিল, সে তার অসুস্থ কাকাকে নিয়ে কলকাতার নামিদামি মাঝারি বেসরকারি হাসপাতালে ঘুরে বেড়িয়েছে। তারপর প্রায় দু' মাস পর তার কাকা শারীরিকভাবে থিতু হয়েছেন। পরে ছাত্রটি বলে, রেশন তোলা হয় না কোনওদিন, তবুও রেশন কার্ড কেন গুরুত্বপূর্ণ এতদিনে বুঝলাম। আমি একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ওর কথা বুঝতে চেষ্টা করলাম। বলল, রেশন কার্ডটা আছে বলে একটা ভরসা আছে, যে যেমন খুশি চালের দাম বাড়াতে পারবে না। কারণ, সাধ্যের বাইরে গেলে আমরা রেশনের চাল খাব। এটাকে বলতে পারেন একটা নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা। ঠিক তেমনি আমাদের স্বাস্থ্যসাথী কার্ড। নানা হাসপাতালে ঘুরেছি, তর্ক করেছি, প্রশ্ন করেছি। কোথায় যেন অধিকারবোধ দিয়েছে এই কার্ড। শেষ পর্যন্ত ভর্তি করতে সমর্থ হয়েছি। আগে হলে অ্যাপোলো বা আমরি'তে গিয়ে এত তর্ক-বিতর্ক করতে পারতাম না। স্বাস্থ্যসাথী কার্ডটা আমাকে সেই ভরসা দিয়েছে।

দ্বিতীয় ছবি: আমার প্রতিবেশী কট্টর সিপিআইএম কর্মী ও পার্টি সদস্য। মধ্যবিত্ত পরিবার, টিউশনি করেন। সাধারণ জীবন যাপন। হঠাৎ শাশুড়ি অসুস্থ হলেন, চিকিৎসকরা বললেন, আইসিইউ আছে এমন নার্সিংহোমে নিয়ে যান। এক কথায় এটা ওই পরিবারের পক্ষে প্রায় অসম্ভব। পরে সেই প্রতিবেশীর মুখেই শোনা, চুঁচুড়া সদর হাসপাতালে আইসিইউ'তে তার শাশুড়ি ভর্তি ছিলেন। জানালো, নিয়মিত সময় অন্তর যেভাবে শাশুড়ি'র চিকিৎসার প্রগ্রেস ও রিগ্রেস রিপোর্ট পেত, যেভাবে সামান্যতম খরচ ছাড়াই ১৬ দিন হাসপাতালে রেখে সুস্থ করে বাড়িতে এনেছে, এক কথায় সে অভিভূত। লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয় করে যে চিকিৎসা আমরি-অ্যাপোলো'তে কিনতে হয়, সরকারি হাসপাতালে সম্পূর্ণ নিখরচায় তা পেয়েছে। 'সত্যিই আমি কৃতজ্ঞ।' আমার প্রতিবেশীর সমগ্র মন্তব্যটি আমি উপস্থাপন করলাম। 

তৃতীয় ছবি: আমেরিকায় ম্যাসাচুসেটস'এ  গবেষণারত এক ছাত্রের কাছে শুনলাম, ওখানে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা করা আর মৃত্যু ডেকে আনা সমার্থক। একটা সাধারণ অপারেশনের দিনক্ষণ ধার্য হয় প্রায় এক মাস পরে। কোনও জরুরিকালীন এমার্জেন্সির জন্য বেসরকারি হাসপাতাল প্রধান ভরসা। সেই ছাত্র বলেছিল, আমাদের পশ্চিমবাংলায় সরকারি হাসপাতালে যে পরিমাণ রোগীর চাপ, সেই বিচারে আমেরিকার সরকারি হাসপাতালের চেয়ে আমাদের বাংলার সরকারি হাসপাতাল ১০ গুণ ভালো; ভাবতে খারাপ লাগে, দেশে থাকতে সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবার অব্যবস্থা নিয়েই বেশি কথা বলেছি। এখন মনে হয়, বড় বেশি ভুল বলেছি। এখানকার তুলনায় আমাদের ব্যবস্থা অনেক বেশি ভালো। 

চতুর্থ ছবি: যাদবপুরে একটি কেন্দ্রীয় বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্র, দেশের অন্যতম বিখ্যাতও বটে। সেখানে পাঠরত এক ছাত্র জানাচ্ছে যে, আমাদের স্কুলগুলোতে এমনিই শিক্ষক কম, তার উপর এত চাকরি বাতিল করলে তো স্কুলগুলোই বন্ধ হয়ে যাবে। Political vendetta পূরণ করার জন‍্য কি সর্বনাশটাই করছে, আর করবেও। আমাদের ইনস্টিটিউটে একটা selfie point খুলেছে। চৌকিদারের বড় কাটআউট লাগানো Research Building'র সামনে। কী চূড়ান্ত অপমানজনক লাগে সেটা। ওই কাটআউটের পেছনে ঢাকা পড়েছে মেঘনাদ সাহার মূর্তি। ইচ্ছে করে, ছিঁড়ে দিই ওই কাটআউট'টা।

একজন অধ‍্যাপক বললেন, আগের ডাইরেক্টর রাজি ছিলেন না এইসবে। ওনাকে পদ থেকে সরিয়ে সাধারণ একটা প্রফেসর পদে (distinguished professor পদও নয়) দিয়ে হায়দরাবাদের এক সেন্ট্রাল ইনস্টিটিউটের প্রফেসরকে তাঁর জায়গায় বসানো হল। এনাকে ঠাণ্ডাঘরের বাইরে দেখা যায় না। ইনি 'ঠিক ঠিক' বলে ওঠা হীরক রাজার পারিষদ। তাই এই কীর্তি। 

গত দু' মাস ইনস্টিটিউট'এ তীব্র আন্দোলন চলেছে। উনি ছাত্রদের সঙ্গে কথা না বলেই একটা বিলে সই করে দিয়েছেন, যাতে বলা ছিল, পাঁচ বছরে PhD শেষ করতে না পারলে fellowship বন্ধ করে দেওয়া হবে। PhD শেষ করতে হবে নিজের খরচায়। যে PhD গবেষকরা এখন 5th yr'এ আছে, তারা ওই extension'এর আশায় ধীরে সুস্থে কাজ করছিল। তীব্র আন্দোলন করা হয়েছিল। ডাইরেক্টরের দেহরক্ষীদের সঙ্গে ধ্বস্তাধস্তি হয়েছিল। স্বৈরাচারী লোকটা সমস্ত প্রফেসরদের হুমকি দিয়ে মেইল করেছেন, নিজের ল‍্যাবের ছেলেদের তুলে নিন, নয়তো আপনাদের ডাকা হবে। কী চরম স্বৈরাচার! আমরাও ক্লাস করিনি ওই দুদিন। কিছু প্রফেসর আমাদের সঙ্গে ছিলেন, ওনারা চূড়ান্ত অসহযোগিতা করেছেন ঐ ডাইরেক্টরের সঙ্গে। অবশেষে গত সপ্তাহের আগের সপ্তাহে ঐ ডাইরেক্টর পদত‍্যাগ করেছেন।

'প্রথমবার কোনও আন্দোলনে প্রত‍্যক্ষ অংশ নিলাম। এবারে ভোট দেবই। আমার বাইরের সেমিনার যাত্রা এক সপ্তাহ পিছিয়ে দিয়েছি। শুধু ভোট দেব বলে বাড়ি ফিরেছি।' 

এদের কথাগুলো ছাই চাপা আগুনের আভাস দিচ্ছে। ছাই চাপা আগুন খুব বিপজ্জনক।


Thursday, 9 May 2024

‘একটু পা চালিয়ে, ভাই…’

দেশান্তরই এখন চালিকাশক্তি!

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য


 

এখনও নাকি ওরা গুলতানি মারে, দীর্ঘশ্বাস ফেলে; সান্ধ্য গোদি-টিভি’র জলসায়, সুখী মধ্যবিত্তের নিরিবিলি গৃহ অবসরে, অলস বৃদ্ধকুলের চায়ে পে চর্চায়, আধ-চোখ বোজা হতাশ যুবকের সোশ্যাল মিডিয়া’র পাতায়। আরও যেন কোথায় কোথায়। বলে, রাজ্যে কর্মসংস্থান কই; শিল্প কই; বিনিয়োগ কই! কে তাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখাবে যে, আজকের কর্মসংস্থান আর ভূ-নির্দিষ্ট নয়; কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও রোবোটিক্স’এর বর্তমান যুগে শিল্পের সঙ্গে কর্মসংস্থানের কোনও প্রত্যক্ষ যোগ নেই; বিনিয়োগের চরিত্র আজ বহুধা বিচিত্র, তার নানান আকার-প্রকার, অতএব, তার গতিবিধিও উথাল-পাথাল। ফলে, চোখকান খোলা, তথ্যনিষ্ঠ, আধুনিক যুবকটি ঠিকানা খুঁজে নিচ্ছে, হয়তো কতকটা আপাত ঠিকঠাক। আমূল বদলে গেছে বিশ্ব। তার ভালমন্দের বিচারও চলবে! কিন্তু বাস্তব বদলগুলির দিকে চোখ ফিরিয়ে থাকার অর্থ আত্মঘাত।



৭ মে ২০২৪- রাষ্ট্রসংঘের The International Organization for Migration (IOM) প্রকাশ করল World Migration Report 2024চমক জাগানো এই প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, ২০২২ সালে ভারত, মেক্সিকো ও চীন ছিল প্রবাস থেকে নিজ দেশে অর্থ আসার তালিকার শীর্ষে। ২০২০ সালে ভারতে যেখানে ৮৩ বিলিয়ন ডলার ‘প্রবাসী অর্থ’ (remittances) ঢুকেছিল, ২০২২ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১১ বিলিয়ন ডলারে। সামগ্রিক ভাবে, ২০০০ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে আন্তর্জাতিক প্রবাসী অর্থ বা remittances ১২৮ বিলিয়ন ডলার থেকে ৮৩১ বিলিয়ন ডলারে বৃদ্ধি পেয়েছে, যা প্রায় ৬৫০ শতাংশ। প্রতিবেদনের মতে, উন্নয়নশীল দেশগুলিতে এই বিপুল প্রবাসী অর্থের সঞ্চালন জিডিপি’র বৃদ্ধিতে সহায়তার ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণকেও ছাপিয়ে গিয়েছে। আন্তর্জাতিক দেশান্তরের এই বিপুল প্রবণতাকে প্রতিবেদনটি বলছে, আজকের অর্থনৈতিক ও মানব উন্নয়নের চালিকাশক্তি। উল্লেখ্য, ৮৩১ বিলিয়ন ডলারের এই প্রবাসী অর্থের মধ্যে ৬৪৭ বিলিয়ন ডলার ঢুকেছে শুধুমাত্র নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশগুলিতে। তবে প্রতিবেদনে এও স্বীকার করা হয়েছে যে, দেশান্তরের সমস্ত পর্বটা মোটেই উৎসাহব্যঞ্জক নয়, কারণ, বহু মানুষ ভিটেমাটি ছেড়ে, সহিংস উচ্ছেদের বলি হয়ে দেশান্তরিত হতে বাধ্য হয়েছে। তাদের সংখ্যাও কম নয়- সারা বিশ্বে বর্তমানে ২৮.১ কোটি দেশান্তরীদের মধ্যে আনুমানিক ১১.৭ কোটি মানুষ এই বাধ্যত দেশান্তরের শিকার।

কিন্তু যে দেশান্তরগুলি অর্থনৈতিক বিচারে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে ঘটেছে, তার ফলাফল কিন্তু সাড়া জাগানো। IOM’এর একটি ম্যাপে দেখাচ্ছে, সংযুক্ত আরবশাহী, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরবে যথাক্রমে ৩৪.৭ লক্ষ, ২৭ লক্ষ ও ২৫ লক্ষ প্রবাসী ভারতীয় বসবাস করছেন। বলাই বাহুল্য, দেশে মোট প্রবাসী অর্থ আসার ক্ষেত্রে ভারত বিশ্বে সবার শীর্ষে; এবং প্রতিবেদনে প্রদত্ত তথ্যে দেখা যাচ্ছে, ২০১০ সালে ভারতে আসা এই অর্থের পরিমাণ ৫৩.৪৮ বিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে ২০২২ সালে ১১১.২২ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। ভারতের পরে ক্রমানুসারে যে চারটি দেশে সব থেকে বেশি প্রবাসী অর্থ প্রবেশ করেছে সেগুলি হল: চীন, মেক্সিকো, ফিলিপিন্স ও ফ্রান্স; যদিও এই দেশগুলি নিজেদের মধ্যে নানা সময়ে ক্রম বদল করেছে কিন্তু ভারত সদাই শীর্ষে থেকেছে। অন্যদিকে, ২০১০ সাল ও পরবর্তী সময়ে যে দেশগুলি থেকে প্রবাসী অর্থ নির্গত হয়েছে তার শীর্ষে সব সময়েই থেকেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ২০২২ সালে যার মোট পরিমাণ ছিল ৭৯.১৫ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ, বিশ্ব অর্থনীতি আজ দেশকালের সীমানা পেরিয়ে যোগাযোগ প্রযুক্তির কল্যাণে এমন এক অবয়ব পেয়েছে যেখানে শ্রমের অবাধ যাতায়াত যেন এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে যাওয়ার মতোই সাবলীল ও অনায়াস; ফলে, যেখানে যে দেশে কাজের সুযোগ ও মজুরি বেশি, শ্রমিক ও শ্রম সেদিকেই বইতে চাইছে। ২০২৩ সালে আমাদের দেশে প্রবাসী অর্থ ঢুকেছে ১২৫ বিলিয়ন ডলার যা জিডিপি’র ৩.৪ শতাংশ। এ ক্ষেত্রে কেরল রাজ্যের ভূমিকা অগ্রগণ্য। সারা বিশ্বে ১৮২টা দেশে কেরল থেকে দেশান্তরী হয়ে কাজ করছেন প্রায় ৪০ লক্ষ মানুষ। ইতিমধ্যে দাবি উঠেছে রাজ্য স্তরে ‘প্রবাস মন্ত্রক’ তৈরির এবং তেলেঙ্গানা, হরিয়ানা ও ঝাড়খণ্ডের মতো কিছু রাজ্যে তা গড়ে তোলার কাজও শুরু হয়েছে বলে শোনা যাচ্ছে।

এই বাস্তবতা সম্ভব হয়েছে মূলত দুটি কারণে। এক, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও রোবোটিক্স’এর ব্যাপক প্রয়োগের ফলে ম্যানুফ্যাকচারিং ও পরিষেবা ক্ষেত্রের সংগঠিত পরিসরে শ্রমের চাহিদা প্রায় ফুরিয়েছে। অর্থাৎ, ‘শিক্ষিত’ ও ‘দক্ষ’ শ্রমের অধিকাংশ কাজগুলি যন্ত্রই করে দিতে সক্ষম। দুই, ধনী দেশগুলিতে গড় বয়স বেড়ে যাওয়া ও নানাবিধ কারণে বিশেষত অসংগঠিত ক্ষেত্রে ব্লু-কলার বা কায়িক শ্রমের অভাব বেশ প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে। একেক দেশে তা একেকরকম। যেমন, মরিশাসে নারকেল-কুড়োনো একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ যার মজুরি বার্ষিক ৪.৫ লক্ষ টাকা, সঙ্গে বিনামূল্যে থাকার জায়গা ও কাজের সময় ফ্রি মিল। প্রচুর ভারতীয় এই কাজগুলিতে যোগ দিয়ে সচ্ছল আয় করে দেশে অর্থ পাঠাচ্ছেন। এছাড়াও, এই মুহূর্তে যে কাজগুলির চাহিদা বেশ তুঙ্গে: জার্মানিতে ফিটার, জাপানে কসাই, অস্ট্রিয়াতে প্লামবার ও রাশিয়াতে লিফট অপারেটর। এইসব কাজের খোঁজ এনে, উৎসাহী লোকজনদের প্রশিক্ষিত করে, তাদের ভিসার বন্দোবস্ত করে দেশান্তরের প্রক্রিয়াও শুরু হয়ে গেছে। মহারাষ্ট্র, গোয়ায় এই ধরনের কিছু প্রশিক্ষণ কেন্দ্রও গড়ে উঠেছে যাদের সঙ্গে বিভিন্ন শিক্ষা ও সরকারি প্রতিষ্ঠান জুড়ে গিয়ে কাজটাকে গতি দেওয়ার চেষ্টা করছে।

এই কাজগুলি সম্পর্কে একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন (The Great Indian Outplacement) ‘টাইমস অফ ইন্ডিয়া’য় ৫ মে ২০২৪’এ প্রকাশ পেয়েছে। দেখা যাচ্ছে, হরিয়ানায় যে স্বাস্থ্যকর্মী মাসে ৮ হাজার টাকা রোজগার করতেন, তিনি জাপানে গিয়ে একই কাজে মাসিক ১ লক্ষ টাকা কামাচ্ছেন। গুরগাও’তে যে ব্লু-কলার শ্রমিক মাসে ২০ হাজার টাকা কামাচ্ছিলেন, তিনি দুবাই’তে গিয়ে বাউন্সার হিসেবে পাচ্ছেন ১.৫ লক্ষ টাকা। আগে আমরা NRI বলতে জাঁদরেল, পয়সাওলা ব্যবসায়ী অথবা উচ্চ-চাকুরে কিংবা উদ্যোগপতি লোকজনদের যে ছবিটা কল্পনা করতাম তা আজ পালটে যাচ্ছে ব্লু-কলার NRI’র গল্পে। এখন ধনী দেশগুলিতে দরকার দক্ষ ও প্রশিক্ষিত গাড়ির চালক, বাউন্সার, স্বাস্থ্যকর্মী, নার্স, প্লামবার, বেবি-সিটার, কেয়ার-গিভার, কুকুর-হাঁটানো ব্যক্তি, পাচক, রেস্টুরেন্টের বয়, বাগান পরিচর্যাকারী, রাজমিস্ত্রী এবং আরও বিবিধ ও বিচিত্র কর্মের শ্রমবাহিনীর। এর জন্য স্কুল-কলেজের শিক্ষা তেমন প্রয়োজনীয় নয়, দরকার কিছু কর্মের প্রশিক্ষণ ও স্ব স্ব দেশের আচার-বিচার সম্পর্কে কিঞ্চিৎ বোধগম্যতা ও মান্যতা।

অতএব, যে সমস্ত বিরক্তিকর প্রাচীনপন্থীরা নিজ গ্রামে, শহরে বা রাজ্যে অথবা দেশে যাবতীয় কর্মসংস্থানের অলীক রূপকল্প তৈরি করেন, তাঁরা ভুলে যান যে কোনও একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক প্রাঙ্গণে দুনিয়ার যাবতীয় কাজের হাব আজ তৈরি হতে পারে না। কর্মের প্রক্রিয়া আজ বিশ্বজোড়া- তার মুড়োটা যদি বিশ্বের উত্তর প্রান্তে থাকে, ল্যাজাটা হয়তো পূব প্রান্তে। বড় বড় শিল্প আজ আর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে না, তারা যন্ত্র দিয়েই কাজ সারে। যে পরিষেবা ক্ষেত্রে ব্যাঙ্কিং ও বিমা ব্যবস্থা, পরিবহন ব্যবস্থা গত ৭০ বছরে, সর্বোপরি, তথ্য প্রযুক্তি ও যোগাযোগ ব্যবস্থা গত ৩০ বছরে এক বড় মাপের কর্মসংস্থানের আয়োজন করেছিল, তাদের নিয়োগ গতিও যন্ত্রের দাপটে আজ অস্তমিত। তাই বলে, এমএ পাশ করে চাকরি না পেয়ে অটোরিকশা টানার গ্লানি সহ্য করতে হবে? তা কেন? নিজেকেই জিজ্ঞেস করতে হবে, বিএ, এমএ সত্যি সত্যিই পাশ দেব কেন? চাকরির জন্য নাকি নিজের জ্ঞান, পাণ্ডিত্য অথবা নিছক ডিগ্রি অর্জনের জন্য? যদি দ্বিতীয়টা হয়, তাহলে অপেক্ষা করতে হবে। যারা বাবু ও পণ্ডিতদের কাজ দেবেন, তারা বিচার করে দেখবেন, অত সহস্র বাবু ও পণ্ডিত সত্যি সত্যিই আজ আর লাগে কিনা! আর যদি প্রথমটা হয় (চাকরি), তাহলে বুঝতে হবে, আজ আর বেশি পড়াশোনা বা অধিক ডিগ্রিতে কাজ নাই! কিন্তু আচারে আছে, গরিব বামুন ভিক্ষা করবে, তবুও কায়িক শ্রমে ‘হাত নোংরা করবে না’। ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রে কায়িক শ্রম হীন, ঘৃণ্য। তাই, ‘বাবুগিরির কাজ’ না পেলে বামুন ও উচ্চজাতের যত আক্ষেপ আর বিলাপ! অবশ্য, যারা ফাঁকতালে দেশান্তরী হচ্ছেন, তাঁরা কিন্তু ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের লোটা-কম্বল বিসর্জন দিয়ে দিব্যি সেখানে গাড়ি চালাচ্ছেন অথবা রেস্টুরেন্টে বাসন মেজে আয় করে ‘প্রবাসী অর্থ’ দেশে পাঠাচ্ছেন। শুধু দেশের লোকেরা জানেন না, তাঁদের ছেলে বা মেয়ের কাজটা ঠিক কী!

বিশ্ব জুড়ে মজুরি সমস্যাই আজ সব থেকে বড় সমস্যা। উচ্চ মজুরির টানেই দেশান্তর। কারণ, পুঁজিবাদের পুরনো ফরম্যাটে যে স্থানিক কারখানা-ভিত্তিক সংগঠিত ব্যবস্থা ছিল, যেখানে এক শেডের তলায় হাজার হাজার শ্রমিক কাজ করতেন, তার আজ অবসান হয়েছে। সে জায়গায় এসেছে বিশ্বায়িত ডিজিটাল গ্লোবাল ফরম্যাট, যেখানে যন্ত্রই আজ প্রায় সমস্ত কাজের ধারক ও বাহক। মনুষ্য শ্রমের কতটুকুই বা প্রয়োজন আর? কাজের স্থানিক চরিত্রও অতএব উধাও। যা থাকছে তা অসংগঠিত ক্ষেত্রের এমন শ্রমের চাহিদা, যেখানে যন্ত্র এখনও পারদর্শী নয়; যেমন, সুস্বাদু রান্না অথবা অসুস্থ মানুষের শুশ্রূষা, এই কাজগুলিতে (পাচক অথবা স্বাস্থ্যকর্মী) যান্ত্রিক নিপুণতার থেকেও আরও বড় প্রয়োজন পরিপাট্য ও মানসিক সান্নিধ্য। অতএব, শ্রমও ছুটছে কাজের নতুন আঙিনা ও চাহিদায়। মূলত কায়িক শ্রমই এখন দেশান্তরের চালিকাশক্তি। তাতে স্ব স্ব দেশ, রাজ্য ও গ্রাম বা শহরের সার্বিক লাভও হচ্ছে।

   

Sunday, 5 May 2024

'নিস্তব্ধ করিয়া দিব মুখরা নগরী'

'মজবুত' কেন্দ্র বনাম আমার অঙ্গ রাজ্য

মালবিকা মিত্র



বেশ মনে আছে, আমাদের এক বন্ধু সহ-শিক্ষক, চন্দ্রশেখরকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে কিছুতেই মেনে নিতে পারেননি কখনও। কেমন যেন খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি, ঠিক প্রধানমন্ত্রী মানায় না। একবারও ভেবে দেখেননি যে, খোদ মার্কিন প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন ছিলেন প্রায় চন্দ্রশেখর সদৃশ্য। একইরকম মনোভাব প্রকাশ করত ট্রেনে আমার সহযাত্রী এক শিক্ষিকা। সে ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদিকে দেখে বলেছিল, এতদিনে একটা মানানসই ফিগার, মুষ্টিবদ্ধ হাত, পেশীবহুল কাঁধ, 'না খাউঙ্গা, না খানে দুঙ্গা' পাওয়া গেল- এইরকম প্রধানমন্ত্রীই তো চাই। মনমোহন সিং কেমন যেন মিনমিনে, দাদু-দাদু সুলভ। আসলে, শাসক সম্পর্কে কল্পনায় বিরাজ করে পরাক্রমশালী, দীর্ঘ দেহী, বলিষ্ঠ বাহুর ছবি। সেই ছবিতে কখনই দয়াশীল, স্নেহশীল কর্তব্যপরায়ণ হরিশচন্দ্র বা যুধিষ্ঠির মার্কা ভাবমূর্তি গড়া হয়নি। 

লক্ষ করবেন, রাজা রামচন্দ্রের সৌম্য শান্ত স্থিতধী মূর্তিটি বহুদিন হল বিদায় নিয়েছে। পরিবর্তে রাম রাজ্যের রামের চেহারা বদলে গেছে--  বলিষ্ঠ বাহু, চওড়া কাঁধ, সরু কোমর, সিক্স-প্যাক মার্কা রামের ছবি চিত্রিত হচ্ছে। এমনকি ভুঁড়ি সর্বস্ব ভোলানাথ বাবার 'শ্মশানে থাকে গায়ে ভস্ম যে মাখে' ছবিটাও পাল্টে গিয়ে ইদানীং জিম থেকে বেরিয়ে আসা সিক্স-প্যাক'এর শিব মূর্তি খুব প্রাধান্য পাচ্ছে। মানুষের মধ্যে শাসক ও প্রভু সম্পর্কে একটা ভিন্ন ভাব জাগানোর জন্য ফিজিক্যালি একটা ভিন্ন মূর্তি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চলছে। শক্তি ও ক্ষমতা যার মূল কথা। শাসককে হতে হবে শক্তিশালী, বলিষ্ঠ, নির্দয়। 'ঠোক দো শালেকো'..., 'গোলি মারো শালেকো'..., 'এনকাউন্টার স্পেশাল'..., 'বুলডোজার বাবা'-- এই মনোভাবের সঙ্গে আমাদের 'এক দেশ এক ধর্ম এক ভাষা এক নেতা'র মানানসই চেহারাটা অবশ্যই নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদির সঙ্গেই খাপ খায়। রাহুল সাবালক হল না, অরবিন্দের মাফলার সমস্যা ঘুচল না; আর যদি নেতা নারী হয়, তবে তো কথাই নেই। মমতা ও হাওয়াই চটি, মমতার পা ভাঙা এসব নিয়ে কত গল্প। রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মূর্মুকেও সটান দাঁড় করিয়ে রাখতে পারেন নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদী। এমনই এক শক্তির প্রতীক তিনি। 

এর বিরুদ্ধে আপনি কি বিকল্প এক জন আব্রাহাম বা সলমন খান খুঁজবেন? নাকি আপনাকে শাসক সম্পর্কে ধারণাটা পাল্টাতে হবে। ভিন্ন আখ্যান রচনা করতে হবে। আসুক রাজা হরিশচন্দ্র, রাজা গোবিন্দ মানিক্য, তবে তো নতুন আখ্যান তৈরি হবে। ছাপ্পান্ন ইঞ্চি পেশি বহুল ছাতিকে মোকাবিলা করতে আটান্ন ইঞ্চি ছাতি খুঁজবেন? পারবেন ধূর্ততা ও চালাকির দ্বারা মানুষকে কিছু উত্তরবোধক প্রশ্ন দিয়ে নিজের কথা বলিয়ে নিতে? যিনি তা করছেন তাকে সুবক্তা বলবেন? হৃদয়ের অন্তঃস্থল থেকে উঠে আসা, আমাদের হৃদয়ের সঙ্গে নিত্য সম্পর্কিত সমস্যাগুলিকে নিয়ে সংযুক্তি তৈরি করা ও তার সমাধানের রাস্তা খোঁজা- সেটা যিনি পারেন তিনি সুবক্তা নন? কিন্তু দুঃখজনক হলেও এটা সত্যি যে, বিজেপি বিরোধী দলগুলিও আজ মঞ্চে ভাষণ দিতে গিয়ে নিজের স্বকীয়তা হারিয়ে মোদিসুলভ প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে মানুষকে কিছু বলানোর চেষ্টায় রত। 

মোদির বিরুদ্ধে উপযুক্ত বিকল্প হতে গিয়ে শরীরচর্চা, টি-শার্ট, একমুখ দাড়ি-- এসবের মধ্য দিয়ে 'পাপ্পু' নাম ঘোচানোর চেষ্টা অর্থহীন। বরং 'ভারত জোড়ো যাত্রা'র মধ্য দিয়ে যে অভিজ্ঞতার সঞ্চয় রাহুল গান্ধী করেছিলেন, সেটাই তাঁকে ভিন্ন আখ্যান রচনায় সাহায্য করেছিল। 'ভারত জোড়ো যাত্রা'র পর রাহুল গান্ধীর যে সাক্ষাৎকার, পরিণতমনস্ক কথাবার্তা, তা যেন হঠাৎই ভোটের প্রতিযোগিতায় কোথাও হারিয়ে গেল। ঘৃণার রাজনীতির বিরুদ্ধে প্রেম-প্রীতি-ইনসানিয়াৎ'এর রাজনীতির সেই স্লোগানটাই আর দেখতে পাই না। 

আখ্যান রচনার ক্ষেত্রে আরেকটি বিষয়ও গুরুত্বপূর্ণ। কেন্দ্রীয় দল হিসেবে কংগ্রেস সর্বভারতীয় স্তরে দীর্ঘদিন প্রাধান্য করেছে। এমনকি সেই মধ্য গগনে সূর্যের দিনগুলিতে কংগ্রেস সম্পর্কে প্রধান অভিযোগ ছিল যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে ধীরে ধীরে দুর্বল করে শক্তিশালী কেন্দ্র গঠন করার চেষ্টা চলছে। দেবকান্ত বড়ুয়ার সেই উক্তি এখনও অনেকেরই মনে আছে- 'ইন্দিরা ইজ ইন্ডিয়া অ্যান্ড ইন্ডিয়া ইজ ইন্দিরা।' আমার মনে হয় না, বিজেপির 'এক দেশ এক দল এক ধর্ম এক নেতা' আখ্যানকে প্রতিহত করার জন্য কংগ্রেস উপযুক্ত। কারণ, সর্বভারতীয় দল হিসেবে কংগ্রেসের মধ্যেও এই প্রবণতাগুলি ছিল এবং ভবিষ্যতেও পুনরায় দেখা দেবে। সম্প্রতি কর্নাটক নির্বাচনের পরেও সেই মনোভাব দেখা দিয়েছিল। আজ যে ৩৭০ ধারা নিয়ে এত  শোরগোল চলছে, মনে রাখতে হবে, কংগ্রেস শাসনে ধারাবাহিকভাবে এই ৩৭০ ধারার ক্ষয় ধরানো হয়েছে অন্তত ৫৬টি সংশোধনীর মাধ্যমে। কংগ্রেস শাসনেই তো সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে নয়/ বারোটি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ও নেতারা বিভিন্ন সময় ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন রাজ্যের অধিকার রক্ষার দাবিতে। ফলে, মোদি'র অমিতবিক্রম পেশীবহুল ভাবমূর্তির বিরুদ্ধে কংগ্রেসকে দাঁড় করানো যাবে না। কারণ, সেই মূর্তির আপাত জরাজীর্ণ অবস্থা হলেও ভেতরের খড়ের কাঠামোটি একইরকম। বরং আঞ্চলিক শক্তিগুলি তার নিজস্ব আঞ্চলিক সত্তা, স্বতন্ত্র স্বপ্ন, আবেগ, ভিন্ন রুচির অধিকার, এগুলিকে সযত্নে লালন করে শক্তিশালী, একমাত্রিক স্বরকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে। আঞ্চলিক শক্তিগুলিকে নিজেদের স্বার্থেই ঐক্যবদ্ধ হতে হবে ভিন্ন স্বর সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে। তা না হলে সংসদীয় শাসন, যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা, সবই বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবে। দেখাও গেল, একটি স্টিং অপারেশনে বিজেপি'র স্থানীয় মণ্ডল সভাপতির স্বীকারোক্তিতে, সন্দেশখালি'তে কীভাবে 'মহিলা নির্যাতনের' অভিযোগগুলিকে নির্মাণ করা হয়েছিল। 

বাংলার মুখ্যমন্ত্রী যখন বাংলা ও বাঙালির স্বার্থের কথা বলেন, সেটা চটকদারি ভোটের ফায়দা শুধু নয়, অতি কেন্দ্রিক দানবীয় রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আঞ্চলিক, ক্ষুদ্র এককের সংস্কৃতি ও অর্থনীতির স্বাতন্ত্র্য রক্ষার স্লোগান। শুধু বাংলা নয়, বিহার, উড়িষ্যা, ঝাড়খন্ড, তেলেঙ্গানা, অন্ধ্র, তামিলনাড়ু, কেরল, কর্নাটক, মহারাষ্ট্র, পাঞ্জাব, কাশ্মীর এই সমগ্র আঞ্চলিক এককগুলির পক্ষে যা একান্ত জরুরি। অন্যথায় আঞ্চলিক স্বাতন্ত্র্য, যুক্তরাষ্ট্রীয় সংবিধান বিপন্ন হতে বাধ্য। আঞ্চলিক দল ও শক্তিগুলির অস্তিত্ব রক্ষার জন্য এটা আজ জরুরি চাহিদা ও শর্ত। কিন্তু দুঃখজনক হলেও এ কথা সত্য যে, বৃহৎ এককের চাপের সামনে ক্ষুদ্র এককের লড়াইয়ে ক্ষুদ্র একক বৃহৎ এককের অনুরূপ কৌশল অনুকরণ করছে। আম আদমি পার্টি সর্বভারতীয় হয়ে উঠতে চাইছে। বাংলায় তৃণমূল কংগ্রেস অল ইন্ডিয়া তৃণমূল হতে চাইছে। সিপিআইএম যতই আঞ্চলিক শক্তি হোক না কেন নিজেকে সর্বভারতীয় শক্তি হিসেবেই দেখে। ফলে, শক্তিশালী কেন্দ্র, এক দেশ, এক দল, এক নেতার বিপরীতে ভিন্ন ভাষ্য বা আখ্যান তৈরি হচ্ছে না; যে আখ্যান আঞ্চলিকতার কথা বলবে, বৈচিত্র্যময় ভারতের কথা বলবে, বিবিধের মিলনের কথা বলবে। 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই কথাটাই মনে পড়ছে- 'ব্যাঘ্রসনে নখে দন্তে নহিক সমান, তাই বলে ধনুঃশরে বধি তার প্রাণ, কোন নর লজ্জা পায়?' শক্তিশালী কেন্দ্রের বিরুদ্ধে বিকল্প শক্তিশালী কেন্দ্র হয়ে ওঠা সম্ভব নয়। জনমত যাচাই করলে তাই নরেন্দ্র মোদির প্রধানমন্ত্রীত্বের পক্ষে এখনও ৬৭ শতাংশ মানুষ সমর্থন দেয়। কিন্তু একবারও কি আঞ্চলিক স্বাতন্ত্র্য, আমার ভাষা, আমার পোশাক, আমার খাদ্যাভ্যাসের উপরে কোনও জনমত যাচাই হয়েছে? আমি নিশ্চিত সেটা হলে শক্তিশালী কেন্দ্রের পক্ষে অবশ্যই ৬৭ শতাংশ সমর্থন জুটত না। দুঃখজনক বিষয় হল, একদা কংগ্রেসের সুদিনে ইন্দিরা গান্ধী শক্তিশালী কেন্দ্র ও স্থায়ী সরকার গড়ার গ্যারান্টি দিয়ে ভোটে জিতেছেন। আবার পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থীরাও স্থায়ী সরকারের স্লোগান দিয়েছে নিজের রাজ্যে। ফলে, বিকল্প ভাষ্য ও আখ্যান তৈরি হল না। যুক্তরাষ্ট্রীয় রাজনীতিটা সঠিকভাবে অনুশীলন করাই হল না। কেবলই শক্তিশালী কেন্দ্রের অনুশীলন। আজ মোদি যেটা খোলামেলা ভাবে ডাবল ইঞ্জিন সরকার বলছেন, বাস্তবে ব্যবহারিক অনুশীলন কংগ্রেস জমানাতে তার সূচনা। 

খবরের কাগজে দেখলাম, মে মাসের ৩ তারিখে কলকাতায় উচ্চ শিক্ষিত জ্ঞানীগুণী অধ্যাপকদের এক সভায় পরকাল প্রভাকর স্মরণ করিয়ে দেন, ওই তারিখটিতে মনিপুরের জাতি দাঙ্গার বীভৎসতা ও হিংস্রতার এক বছর পূর্ণ হল। আরও মনে করান যে, মনিপুরে ডবল ইঞ্জিন সরকার। তিনি বলেন, এবারের ভোট খুব ভেবে চিন্তে না দিলে ভবিষ্যতে নির্বাচনী গণতন্ত্রকে এখনকার রূপে আর দেখা যাবে কিনা তা নিয়েই আশঙ্কা আছে। মনে রাখবেন, সভাটি ছিল উচ্চশিক্ষিত পণ্ডিত অধ্যাপকদের সভা। সেই সভায় একজন শ্রোতা প্রশ্ন করেন, কেন্দ্রে মজবুত সরকার গঠিত না হলে বিনিয়োগ আসবে কীভাবে? অর্থনীতির ভিত শক্ত হবে কীভাবে? পরকাল প্রভাকর জবাব দেন, মজবুত সরকার ও আর্থিক মাপকাঠিগুলি ঠিকঠাক থাকা সত্ত্বেও গত ১০ বছরে বিনিয়োগকারীরা হাত খোলেননি, জিডিপি'র নিরিখে সঞ্চয় তলানিতে ঠেকেছে, কমেছে প্রত্যক্ষ বিদেশি লগ্নি। 

বোঝা গেল, উচ্চবর্গের চেতনাতেও একটি লোমশ মজবুত পেশীবহুল কেন্দ্র বিরাজ করে। প্রভাকর যখন গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত, তখন পণ্ডিত প্রশ্নকর্তা মজবুত সরকার ও বিদেশি লগ্নি নিয়ে চিন্তিত। পশ্চিমবঙ্গের একজন বামপন্থী নেতা বলতেন, সরকারটা যদি জনবিরোধী, পশ্চাতে বাঁশ হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে সেটা কম মজবুত, কম স্থায়ী, ভঙ্গুর হওয়াই বাঞ্ছনীয়। এবারের লোকসভা নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদির পেশীবহুল শক্তিশালী কেন্দ্রের বিপরীতে আঞ্চলিক রাজনীতির প্রচার ও উত্থান সম্ভব ছিল। শেষাবধি কত দূর তার বাস্তবায়ন হবে, ভবিষ্যৎ সে কথা বলবে।


Sunday, 28 April 2024

নাগরিকত্বের টোপ

জুমলাবাজি ও দখলদারির রাজনীতি

শিবশংকর পাল



মনোবিজ্ঞানের অন্যতম বিদ্যায়তনিক পাঠবস্তু হল সমাজ মনোবিজ্ঞান। মেরিল্যান্ড ইউনিভার্সিটির মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক চার্লস স্টেনগার তাঁর অন্যতম গ্রন্থ 'সোশ্যাল সাইকোলজি প্রিন্সিপলস'-এ সমাজের মানসিক বিন্যাসের উপর গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা করেছেন। এই গবেষণার জন্য আমেরিকার সাইকোলজিক্যাল সোসাইটির চার্টার ফেলো নির্বাচিত হন তিনি। তাঁর তত্ত্ব বিশ্ব জুড়ে মান্যতা পেয়েছে। তিনি দেখিয়েছেন, সমাজের মনকে নানাভাবে গড়েপিটে নেওয়া যায়, ভেঙেচুরে দেওয়া যায় পছন্দমাফিক। 

বৃহত্তর সমাজের গভীরতর প্রদেশে কোনও সত্যি/মিথ্যে ধারণা গড়ে তুলতে এতদিন সাধারণত দু' ভাবে প্রচেষ্টা চালানো হত: ১) তীব্র দেশপ্রেমের নামে উগ্র রাষ্ট্রপ্রেমের জন্ম দেওয়া ও ২) ক্রমাগত অনৃতভাষণের সাহায্যে 'সফেদ ঝুট'কে ‘নিছক’ সত্যে পরিণত করা। এর ধ্রপদি ব্যবহার একদা হিটলার করেছিলেন। এখনও এই অস্ত্রের বহুল প্রয়োগ আমরা দেখতে পাচ্ছি আমাদের দেশে।

সম্প্রতি ভারতবর্ষের আসন্ন লোকসভা নির্বাচনের দিকে তাকালে চার্লস স্টেনগার-এর তত্ত্বগুলির প্রাসঙ্গিকতা ও প্রয়োগ স্পষ্টভাবে চোখে পড়বে। ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচন বহু কারণে জাতীয় স্তরে অত্যন্ত গুরুত্ব পেয়েছিল। বিজেপির হিন্দুরাষ্ট্র গঠনের প্রধান বাধা ছিল পশ্চিমবঙ্গ এবং এখনও এই বাধা তাদের দুশ্চিন্তার কারণ। ভারতের যে অংশকে রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা আর্যাবর্ত বা গো-বলয় অথবা হিন্দিবলয় হিসেবে গণ্য করে থাকেন সেখানকার 'লোক'-এর মানসিকতা প্রায় বিজেপির অনুকূল। ‘হিন্দু খতরে মে হ্যাঁয়’ আর তার কারণ ‘মুসলমানদের বাড়বৃদ্ধি’— এই সোশ্যাল সাইকি দিয়ে গুজরাত দাঙ্গা করে ২০১৪-য় ‘মোদী-শাহের’ গোদিয়ান হওয়া এবং অতঃপর ক্রমাগত ‘হিন্দুত্ব’কে সারজল দিয়ে চাষ করে তার ফসল ঘরে তোলার চেষ্টা অধিকাংশতই সফল। পশ্চিমবঙ্গেও তাঁরা নানা নামে সংগঠন গড়ে প্রচার চালিয়ে গিয়েছেন বহুকাল, সেই বাম আমল থেকেই। বাঙালির মেধা-মনন ও দ্রোহাত্মক বাম মনোভাব সেই প্রচারের একটা বড় বাধা ছিল এতদিন। বাংলার মাটিতে প্রেম-কবিতা-দ্রোহ-বিপ্লব-- এই সংস্কৃতিকে সমূলে উৎপাটন করতে না পারলে হিন্দু-হিন্দি-হিন্দুস্তান প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন অধরাই থেকে যাবে, ‘মোদী-শাহ’ এটা ভালো করেই জানেন। তাই মোদীর মুখে তীব্র ঘৃণাভাষণ; নির্বাচন কমিশন ‘স্নেহান্ধ’ ধৃতরাষ্ট্র। আরএসএস ও তার ভাবপোষ্য বিশ্বস্ত দল বিজেপি বুঝেছে হিন্দুরাষ্ট্র গঠনের এটাই তাদের শেষ সুযোগ। 

কেন্দ্রীয় সরকারে একক দল হিসেবে বিজেপি তৃতীয়বার নিরঙ্কুশ সাংখ্যাগরিষ্ঠ না হলে তাদের একশো বছরের ‘সংগ্রাম’-এর জলাঞ্জলি হবে। বিফলে যাবে রামমন্দির নির্মাণ, ৩৭০ ধারা বিলোপ ও এনআরসি করার খাতা। তাই দরকার 'অব কি বার চারশ পার' করার  শপথপূরণ। বিগত পাঁচ বছরে বিপুল গরিষ্ঠতার বাহানায় করোনার মতো অতিমারীর ‘সুযোগ’ নিয়ে তারা একের পর এক এমন সব বিল পাশ করিয়েছে, যার সাহায্যে একদিকে দেশের যাবতীয় রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রগুলি সহ সমস্ত প্রাকৃতিক সম্পদ কতিপয় পুঁজিপতিদের হাতে হস্তান্তরিত হয়েছে, শ্রম আইনে শ্রমিকের অধিকার বিপুলভাবে সঙ্কুচিত হয়েছে। কৃষি ও শিক্ষার দায় সরকারের কাঁধ থেকে নামিয়ে দেওয়ার ফিকির আজ আর গোপন নেই।  সেই সঙ্গে আরও অধিক মুনাফার জন্য প্রয়োজন সস্তা মজুর; তাই প্রায় রাতারাতি অতি তৎপরতার সঙ্গে এনআরসি আনার চেষ্টা  চলছে। অন্যদিকে দাদন দেওয়ার টোপ দিয়ে কৃষিকে শিল্পপতিদের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য আনা হয়েছিল নতুন কৃষি আইন। শ্রমকোড আইনে এমন বদল আনা হয়েছে যে, মজুরদের অবস্থান মে-দিবসের আগের জমানায় পৌঁছে গিয়েছে। এবং সর্বোপরি নাগরিকত্ব আইনের সংশোধন করা হয়েছে। এগুলি মূলত একই উদ্দেশ্যের 'ক্রোনোলজি'। 

কথা হল, এই আইনগুলি এত কর্কশ ও তীব্রভাবে জনবিরোধী যে, এর একটাও বিজেপির দলীয় ইশতাহারে ঘোষণা না করে গ্যাসের দামে একশো টাকা ছাড়ের মতো কিছু আর্থিক সুযোগ-সুবিধা ঘোষণা করা হয়েছে; যার অধিকাংশই তৃণমূলের ইশতেহার থেকে ফেলু ছাত্রের মতো টুকে নেওয়া। বিজেপি খুব ভালো করেই জানে, পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলি (বিহার, ওড়িশা, পশ্চিমবঙ্গ) জিততে হলে যা কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হবে হিন্দু ভোটের সত্তর থেকে আশি শতাংশের উপর। এই সত্তর-আশির মধ্যে একটা বড় অংশ তফশিলি জাতি উপজাতি সম্প্রদায়ের মানুষ; বাংলায় এঁদের অধিকাংশ মতুয়া, নমঃশূদ্র, রাজবংশী সম্প্রদায়ের। এঁদের আবার সকলেই ৭১-পূর্ব ও পরে ভারতে এসেছেন। দীর্ঘকাল ভারতে বাস করে রেশন কার্ড থেকে আধার ও ভোটের পরিচয় পত্র প্রায় সবই অর্জিত হয়েছে। অনেকেই সরকারি চাকরিবাকরি করছেন। বছর বছর নানা কিসিমের ভোটে নাগরিক অধিকার প্রয়োগ করে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছেন। তারপরেও নাগরিকত্বের জন্য এঁদের এক অংশের হীনম্মন্য আবদার আর সেই বাঞ্ছা মেটানোর জন্য অমিত শাহের প্রতিশ্রুতি বিলোনো দেখে চার্লস স্টেনগার-এর তত্ত্বগুলোর কথা মনে পড়বেই।  

বাংলা জেতার জন্য মোদী-শাহ্‌ কেন্দ্রীয় সরকারের সব কাজ ফেলে প্রায় গোটা ক্যাবিনেট নিয়ে ডেলি প্যাসেঞ্জারি করেছিলেন গত বিধানসভা নির্বাচনে। এবার বোধহয় তাঁরা জনসংযোগের তোয়াক্কা করবেন না। বরং পাগলা কুকুরের মতো সরাসরি ইডি-সিবিআই-আইটি-আদালত লেলিয়ে দিয়ে কাজ সারবেন। ঝাড়খণ্ড ও দিল্লীর মুখ্যমন্ত্রীকে গ্রেফতার করে জেলে পুরে এবং কংগ্রেসের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করে প্রায় বিরোধী শূন্য ময়দান প্রস্তুত। বাংলায়ও ইডি-সিবিআই লেলিয়ে দেওয়া চলছে বেশ কয়েক বছর ধরে। এখনও চার্জশিট দিতে না পারায় উচ্চ আদালতের বকুনিও চলছে। এদিকে হাইকোর্ট পাঁচ হাজারের দুর্নীতির জন্য প্রায় ছাব্বিশ হাজারের চাকরি খেয়ে ভোটের ময়দানে বিজেপির পক্ষে একটা ‘সোর মাচানো’ বল তৃণমূলের কোর্টে ঠেলে দিয়েছে। এর পাশাপাশি নিয়ম করে প্রায় প্রতিটি সভায় বিজেপির সব স্তরের নেতানেত্রী ক্রমাগত চরম মিথ্যে ও ঘৃণ্য ভাষণ দিয়ে চলেছেন। অমিত শাহ আগেই জানিয়ে দিয়েছিলেন যে, একজনও 'ঘুসপেটিয়া'কে (বাঙালিকে এঁরা উইপোকা বলেই মনে করেন) ভারতে থাকতে দেওয়া হবে না। সিএএ আইন পাশের চার বছর পর লোকসভা ভোটের আগে এর নিয়মকানুন প্রকাশিত হয়েছে। এবার সমস্ত মতুয়া ও নমঃশূদ্র সম্প্রদায়ের মানুষকে নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। এই সংবাদে উক্ত সম্প্রদায়ের অনেকেই উদ্বাহু হয়ে ধেই ধেই নাচছেন। 

তাঁরা কি ভেবে দেখেছেন, নাগরিকত্ব যদি দিতেই হয় তবে নিঃশর্তে নয় কেন? অন্য দেশের আক্রান্ত মুসলমানরা সেই তালিকায় কেন থাকবে না? নাগরিকত্ব দানের আইনটি তা হলে সংবিধান বিরোধী নয় কি? এই আইনটি কি আদৌ সকলে খুঁটিয়ে পড়েছেন? একবার আবেদন করলেই তিনি ঘোষিতভাবে বে-নাগরিক হয়ে যাবেন জেনেও আবেদন করবেন? অন্য দেশে ধর্মীয় কারণে আক্রান্ত হওয়ার বা সেই দেশের নাগরিকত্বের কোনও তমসুক বা কাগজপত্র আপনার আছে তো? 'ঘুসপেটিয়া' বলতে অমিত শাহ্‌ কাদের বোঝাচ্ছেন? হিন্দুদের, নাকি মুসলমানদের? মুক্তিযুদ্ধের পরে ওপার বাংলা থেকে আসা মুসলমানদের সংখ্যা নেহাতই নগণ্য। ওপার থেকে আসা ৯৮ শতাংশই হিন্দু। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কি ‘ঘুসপেটিয়া’ বলে হিন্দুদেরই অপমান করছেন না? মতুয়ারা কেন সেই অপমান সহ্য করছেন? দেশভাগের জন্য মূলত দায়ী স্বাধীনতা পূর্বকালের নেতৃবৃন্দ, বিশেষত জনসংঘের জনক শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় স্বয়ং। তাঁর কৃতকর্মের দায় কেন মতুয়ারা নেবেন? প্রায় সকল মতুয়াই বিগত নির্বাচনগুলিতে অংশ নিয়ে নাগরিকের দায়িত্ব পালন করেছেন; পাশাপাশি রেশন ও নানা সরকারি সুযোগ-সুবিধা পেয়ে নাগরিকত্ব পাকা করেছেন। যদি তাঁরা নাগরিক না-ই হন তাহলে তাঁদের দেওয়া ভোটে নির্বাচিত কেন্দ্র-রাজ্য উভয় সরকারই কি অবৈধ হয়ে যায় না? সেই ‘অবৈধ’ সরকারের ফরমান কেন একজন স্বাধীন নাগরিক মানবেন? 

সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্য যে মুহূর্তে সরকারি পোর্টালে বা ‘গোলাপি কাগজে’ কেউ লিখিত আবেদন জানাবেন সেই মুহূর্তে সিএএ অনুযায়ী তাঁর নাগরিকত্ব ‘ভ্যানিশ’ হয়ে যাবে। তাঁর যাবতীয় স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ ও চাকরি-ব্যবসা ‘সিজ’ করা হবে। এবং তাঁকে লিখিত প্রমাণ দিতে হবে যে, তিনি বাংলাদেশে ধর্মীয় উৎপীড়নের কারণে এ দেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন। বাংলাদেশের পুলিশ কি আজ কোনও মতুয়াকে উক্ত মর্মে জেনারেল ডায়েরি বা এফআইআর করতে দেবে? যদি দেয়ও তবু আপনার মামলার নিষ্পত্তি হতে হতে এক দশক থেকে দেড় দশক কেটে যাবে। ঐ সময় আপনি জেলে বা ডিটেনশন ক্যাম্পে অন্তরীণ থাকবেন। সিএএ-তে কোনও নিঃশর্ত নাগরিকতা দেওয়ার কথা নেই। ইতিপূর্বে যে ৩২ হাজার জন আবেদনকারী উপরোক্ত বয়ানে ভারতের নাগরিক হওয়ার আবেদন জানিয়েছেন, তার সঙ্গে মতুয়া-নমঃশূদ্রদের কোনও সম্পর্ক নেই। সিএএ আসলে খুড়োর কলের একটি গাজর। যা কোনওদিন মতুয়াদের নাগালে আসবে না। 

এই পর্যন্ত পড়ে হয়তো আমরা সবাই ভাবছি, দেশের প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কি এত বড় ‘ঢপ’ দিতে পারেন? এ যে দিন-দহারে সমুদ্রসমান মিথ্যা প্রতিশ্রুতি। মনে রাখুন, 'না খাউঙ্গা, না খানে দুঙ্গা' বলে 'বন্ড-ই-ভারত'-এর চুরিবিদ্যা ও তোলাবাজি কিন্তু এই দুই হুজুরেরই মগজপ্রসূত যা দুনিয়ার সবচেয়ে বড় দুর্নীতি হিসেবে চিহ্নিত। এইখানে চার্লস স্টেনগার-কে স্মরণ করব। তিনি জানিয়েছেন, যে-প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা প্রায় অসম্ভব সেই প্রতিশ্রুতি বারবার দিলে সাধারণের মনে একটা ইতিবাচক আগ্রহ তৈরি হয়। এই মনোভাব আরও গভীর হয় গোষ্ঠীভুক্ত মানুষদের উদ্দেশে পুনঃপ্রচারিত হলে। খেয়াল করে দেখুন, চার্লস স্টেনগার-এর তত্ত্ব অনুযায়ী বিজেপি পাকিস্তানকে আমাদের কল্পিত শত্রু বানিয়ে রেখেছে, মাঝে মাঝে কিছু জওয়ানকে ‘বলি’ দিয়ে সীমান্তে যুদ্ধজিগির জাগিয়ে রেখেছে। দ্বিতীয়ত, হিন্দুদের বিকাশের পথে প্রধান বাধা হিসেবে মুসলমানদের প্রতিপক্ষও বানিয়ে ছেড়েছে। ইতিহাস থেকে 'হাপিস' করে দেওয়া হয়েছে একটা গোটা মোগল যুগ। 

সরকারি তথ্য পরিসংখ্যানকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে তাঁরা দিনের পর দিন প্রচার করে চলেছেন, মুসলমানদের  চারটে পাঁচটা করে বিয়ে; চোদ্দ-পনেরোটা করে কাচ্চাবাচ্চা। আগামী দশ-বিশ বছরেই 'ওরা' নাকি ভারতের দখল নিয়ে নেবে। ১৪ শতাংশ ৮৬ শতাংশকে এইভাবে নাকি গিলে নেবে। বিজেপি-আরএসএস এবং এদের আইটি সেল নিরন্তর এই মিথ্যা প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে সারা ভারত জুড়ে সংখ্যালঘু মানুষ জঘন্য হিংসার শিকার হচ্ছেন। এবং বিজেপির দলীয় উদ্যোগে তা সামাজিক মান্যতা পাচ্ছে। সংখ্যালঘু এলাকায় চলেছে হাড়হিম ত্রাসের রাজত্ব। ভোটের এই হিংসাত্মক আবহে অমিত শাহের মিথ্যা প্রচারের ফাঁদে পা দিয়ে মতুয়ারা বোধহয় ভুলে যাচ্ছেন অসমের হাতেগরম অভিজ্ঞতার কথা। বিজেপিকে ভোট দিয়ে মতুয়ারা যদি জেতান, তবে সবার আগে কিন্তু তাঁরাই ডিটেনশন ক্যাম্পে যাবেন। মাকড়সার জাল যত সুন্দর কারুকার্যমণ্ডিত হোক না কেন, খাদ্য সংগ্রহই তার একমাত্র উদ্দেশ্য। কয়েক লক্ষ মতুয়া বাঙালিকে বসিয়ে খাওয়ানোর জন্য অসমে ডিটেনশন ক্যাম্প তৈরি হয়নি। জেনে রাখুন, সিএএ আম্বানি-আদানিদের সস্তার মজুর সাপ্লাই দেওয়ার জন্য একটি ছলনাজাল মাত্র।


Friday, 26 April 2024

সততা সততই ত্যাজ্য!

যখন বিচারের এক চোখে ঠুলি

মালবিকা মিত্র



সূক্ষ্ম মান-অপমান বোধ সকলের থাকে না। আবার কারও কারও থাকে। আমার দিদিমা বিদ্রূপ করে বলতেন, এত সূক্ষ্ম যে 'আছে নাকি নাই হেইয়াই বোঝা যায় না'। কথাটা উঠল, নির্বাচন কমিশন পশ্চিমবাংলার স্বঘোষিত দাপুটে বিজেপি নেতা দিলীপ ঘোষকে কিছুদিন আগে 'সেন্সর' করায় ও তাঁকে 'নজরবন্দী' রাখায়। কমিশনের এই ঘোষণাকে তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে দিলীপ ঘোষ তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দিয়েছিলেন এই বলে যে, 'মেসোমশাইকে' নালিশ করেছে, 'মেসোমশাই' ব্যবস্থা নিয়েছে। এরপরেও দিলীপবাবু নির্বিকার ভাবে তুড়ি মারা ভঙ্গিতে অনর্গল কুকথা বলে চলেছেন। 

এদিকে প্রাক-নির্বাচনী পরিস্থিতিতে রামনবমীর সশস্ত্র মিছিল সামাজিক ও রাজনৈতিক উত্তেজনার কারণ হতে পারে- এই আবেদনকে বিবেচনা করে হাইকোর্ট রায় দিয়েছিল, দুশো জনের বেশি রামনবমীর জমায়েত করা যাবে না; আর সশস্ত্র জমায়েত কখনই নয়। কী আশ্চর্যের ব্যাপার, উত্তরবঙ্গে সভা করতে এসে মোদীজী স্বয়ং বলে গেলেন, এবারের রামনবমী হবে অনেক বেশি জাঁকজমক ও ধূমধাম করে, কারণ, এই বছর রাম মন্দির প্রতিষ্ঠা হয়েছে। দিলীপ ঘোষ সংবাদমাধ্যমকে সরাসরি বললেন, মানুষের আবেগ বলে কথা, পঞ্চাশ হাজার মানুষের জমায়েত হবে; যা হয় আমি দেখে নেব, আমি দিলীপ ঘোষ, সেই মিছিলে থাকব। অক্ষম অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র (নির্বাচন কমিশন) এসব কিছুই শোনেন না, দেখেন না। হাওড়ায়, বীরভূমে সশস্ত্র মিছিলের ছবি দেখলাম টিভি'তে। প্রায় সর্বত্রই সশস্ত্র মিছিল, দুশোর অনেক বেশি জমায়েত, ডিজে বাজিয়ে নৃত্য, প্ররোচনামূলক শ্লোগান ও অন্য ধর্মের প্রার্থনা-গৃহের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় হামলা অথবা কটূক্তি। মুর্শিদাবাদের বেলডাঙ্গা অঞ্চলে সশস্ত্র সংঘর্ষও হল- তা নিয়ে এখন নির্বাচন কমিশনের তরফে সিআইডি তদন্তের নির্দেশও দেওয়া হয়েছে। তো, এই যে ব্যাপক ভাবে আদালত অবমাননা হল, তার বিরুদ্ধে আদালত কি কোনও ব্যবস্থা নিল? ভো-কাট্টা! এত সূক্ষ্ম মান-অপমান বোধ যে বোঝাই গেল না। 

২০১৯ সালে ভোটের প্রাক্কালে নরেন্দ্র মোদি ও অমিত শাহ অন্তত পাঁচটি ক্ষেত্রে আদর্শ আচরণবিধি লঙ্ঘন করেছেন বলে মনে করেছিলেন নির্বাচন কমিশনার অশোক লাভোস। এরপর আর এমন দৃঢ়তা চোখে পড়েনি। যদিও কমিশনের বাকি দুই সদস্য তাঁর সঙ্গে সহমত পোষণ করেননি। প্রাতিষ্ঠানিক গোপনীয়তার যুক্তিতে লাভোসের বক্তব্য প্রকাশ করা হয়নি। যে ইন্দিরা গান্ধী এবং তাঁর শাসনকাল নিয়ে এত নিন্দামন্দ, এলাহাবাদ হাইকোর্টের বিচারপতি জগমোহন সিনহা সেই ইন্দিরা গান্ধীর বিরুদ্ধে রায় দিয়েছিলেন। দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। এমনকি তাঁর নির্বাচন খারিজ করে দেওয়া হয়। অভিযোগ ছিল, প্রশাসনকে কাজে লাগানো ও সরকারি অর্থ খরচ এবং দলীয় কাজে সরকারি আধিকারিকদের ব্যবহার। প্রধানমন্ত্রীর দফতরের একজন আধিকারিক ছিলেন যশপাল কাপুর। তিনি ইন্দিরা গান্ধীর নির্বাচনী এজেন্ট হওয়ার আগেই ওই পদে ইস্তফা দিয়েছিলেন। কিন্তু নির্বাচনী জনসভায় ইন্দিরা গান্ধীর ভাষণের আগে তাঁর ইস্তফাপত্র আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহীত হয়নি। এই কারণে ইন্দিরা গান্ধী অপরাধী ঘোষিত হয়ে ছয় বছরের জন্য নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে নির্বাসিত হন। 

এইসব আইন কিছুই লুপ্ত হয়নি। আজও আছে। কিন্তু সংবিধান প্রণেতা আম্বেদকরের বক্তব্যটি খুবই প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন, ভালো সংবিধান খারাপ সংবিধান বলে কিছু হয় না, সংবিধানটা কাদের হাতে রয়েছে সেটাই আসল কথা। অর্থাৎ, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর কলঙ্কিত শাসনেও বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশন যে দৃঢ়তায় শিরদাঁড়া সোজা রাখার ক্ষমতা দেখিয়েছিল, আজ সেই ক্ষমতাটুকু বুঝি উধাও। হবে নাই বা কেন, বিজেপি'র বড় থেকে চুনোপুটি নেতা সকলেই বুঝে গেছেন, বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশন, সিবিআই, ইডি এসব আসলে প্রহসন। বিজেপি নেতাদের কেশাগ্র স্পর্শ করার ক্ষমতা এদের নেই। একজন বিজেপির নেতা যদি রাজভবনে দাঁড়িয়ে সংবাদমাধ্যমের সামনে বলতে পারে, 'আমাদের রাজ্যপাল, আমাদের কেন্দ্রীয় বাহিনী, আমাদের কেন্দ্রীয় এজেন্সি, দেখি কীভাবে এরা সরকার চালায়!', এই বলার মধ্য দিয়ে কর্মীদের মনে রাষ্ট্রের এই স্তম্ভগুলিকে উপেক্ষা ও অবজ্ঞা করতে শেখানো হয়। রঞ্জন গগৈ যে ভাবে হাতে গরম পুরস্কার লাভ করে তৃপ্ত থাকেন, একজন বিজেপি কর্মীর কাছে তখন সমগ্র বিচার ব্যবস্থার ভাবমূর্তি ভেঙে পড়ে। 

চেয়ারে থাকাকালীন হাইকোর্টের বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় যে সমস্ত কথাবার্তা বলেছেন, এমনকি তাঁর একটি রায়কে সুপ্রিম কোর্ট স্থগিত রাখার পর প্রকাশ্যে ব্যঙ্গ করে বলেন 'সুপ্রিম কোর্ট যুগ যুগ জিও'। এসব কথার পর সেই বিচারপতি ঠিক লোকসভা নির্বাচনের মুখে নিজ পদে ইস্তফা দিয়ে বিজেপির প্রার্থী হলেন। এবার বলুন দেখি, তাঁর কোন কোন রায়গুলি 'নিরপেক্ষ' বা ন্যায়ের পক্ষে ছিল আর কোনগুলি তাঁর দলের রাজনৈতিক সুবিধা করে দেওয়ার জন্য? তদুপরি, তমলুক সহ সারা পশ্চিমবঙ্গের বিজেপি কর্মীদের কাছে হাইকোর্টের বিচারপতিদের ভাবমূর্তিটা কী দাঁড়ালো? দুশো টাকা নিয়ে মিছিলে যাওয়া বিজেপি কর্মী, অথবা দু' হাজার টাকা নিয়ে ভোট দিতে যাওয়া বিজেপি কর্মীর চোখে অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় বা রঞ্জন গগৈ তাঁদের সমকক্ষ হয়ে পড়ে। বাড়তি মর্যাদা লুপ্ত হয়। 

শুধু তো এখানেই শেষ নয়, অশোক লোভাস শিরদাঁড়া সোজা রাখার জন্য কী কী মূল্য চুকালেন, সেটাও মনে করে দেখুন। স্ত্রী নাভেল, পুত্র আবির, ভগিনী শকুন্তলা প্রত্যেকের ওপর চলেছে এজেন্সির পীড়ন ও হয়রানি। এ প্রসঙ্গে অশোক লোভাসের মন্তব্যটি প্রণিধানযোগ্য-- এমন প্রত্যাশা ঠিক নয় যে, যাদের বিরোধিতা করা হচ্ছে, তারা নম্রভাবে বিরুদ্ধতার উত্থান মেনে নেবে। তারাও প্রত্যাঘাত করবে। সততার মূল্য দিয়ে পেতে হয় একাকিত্বের যন্ত্রণা বোধ ও প্রকাশ্য বিচ্ছিন্নতা। বন্ধু বা শত্রু- উভয়ের কাছে সততা ত্যাজ্য।

সততার পথে প্রাপ্ত ২০১৬ সালের রাজ্য শিক্ষা দফতরের প্যানেলের প্রায় ২০,০০০ শিক্ষক ও অশিক্ষক কর্মীদের চাকরি (দোষী ও নির্দোষ আলাদা না করতে পারার অপারগতায়) যখন আদালতের এক ভয়ঙ্কর রায়ে বাতিল হয়ে গেল, তখন এই বাচনটিই তো আরেকবার সাব্যস্ত হয় যে, সততা সততই ত্যাজ্য। কারণ, ন্যায় দণ্ড হাতে আদালতই যখন দোষী আর নির্দোষকে আলাদা করতে পারে না, তখন নির্দোষদের নির্বিচার দণ্ড দিতে তাদের হাত বা কলম কাঁপবেই বা কেন! অথচ, কত আদিখ্যেতা করে বলা হয়, দশজন দোষী যদি পার পেয়েও যায়, তবুও যেন একজন নির্দোষ সাজা না পায়। 

কিন্তু বিপদ আরও গভীর ও নির্মম। যখন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বিচারব্যবস্থা সাঁট করে চলে, তখন তাকে আর বিচারব্যবস্থা বলা যায় না! এক সামগ্রিক ফ্যাসিস্ট ব্যবস্থায় তা পর্যবসিত হয়। বিরোধী দলনেতা গত সপ্তাহের শুক্রবার বললেন, আগামী সপ্তাহে একটি বোমা বিস্ফোরণের জন্য প্রস্তুত থাকুন যা শাসক দলকে তছনছ করে দেবে; এ সপ্তাহের ঠিক সোমবারই আদালতের রায়ে ২৫,৭৫৩ জনের চাকরি বেমালুম লোপাট হয়ে গেল। আবার বিজেপি'র এক এমএলএ দু' দিন আগে জোর ঘোষণা দিয়েছেন যে খুব শিগগির ৫৯,০০০ প্রাইমারি শিক্ষকের চাকরি যাবে। সেই ঘোষণাকে সমর্থন করে বিরোধী দলনেতাও তালি মেরে বলেছেন, আগামী সপ্তাহেই তা হবে। যুক্তিগ্রাহ্য মনে প্রশ্ন উঠছে, রায়গুলি আসলে কে লিখছে?

এ কি এক যুদ্ধ? বাংলাকে ভাতে মারার, কর্মহীন করার এক নৃশংস অভিসন্ধিমূলক যুদ্ধ? বাংলাকে ভাতে ও কাজে মারতে পারলে তবেই দেশ জুড়ে ফ্যাসিবাদ সম্ভব হতে পারে! এ কথা কিছুটা ঘুরিয়ে অমিত শাহ ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার পর এইভাবে বলেছিলেন যে, তাঁদের 'ভারত জয়' এখনও সম্পূর্ণ হয়নি এবং তা সেদিনই হবে যেদিন তাঁরা বাংলাকে জয় করতে পারবেন। মনে রাখবেন, যাঁদের চাকরি গেল, তাঁদের মধ্যে অনেকেই কিন্তু ছিলেন 'অন্ধভক্ত', তবুও তাঁরা রেহাই পাননি!