Wednesday, 27 March 2024

লাদাখের পথে মানুষ

ভূপ্রকৃতি পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্র বাঁচানোর লড়াই

শান্তনু চক্রবর্তী



গতকাল (২৬ মার্চ) ইঞ্জিনিয়ার, উদ্ভাবক, বিজ্ঞানী, শিক্ষাবিদ ও সমাজকর্মী সোনাম ওয়াংচুক ও অবসরপ্রাপ্ত সুবাদার সিরিং স্তানবা (Tsering Stanba) তাঁদের ২১-দিনের অনশন সত্যাগ্রহ সমাপ্ত করলেন। ওয়াংচুক বারে বারে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং গৃহমন্ত্রী অমিত শাহকে লাদাখবাসীর ন্যায়সংগত দাবি ও বিজেপির নিজস্ব প্রতিশ্রুতির কথা স্মরণ করিয়েছেন। কিন্তু, কেন্দ্রীয় সরকারের হেলদোলের কোনও চিহ্ন পাওয়া যায়নি। 

আজ (২৭ মার্চ) থেকে শুরু হচ্ছে লাদাখি মহিলা সংগঠনগুলোর লাগাতার দশ-দিনের উপবাস। তারপরে যুবকরা উপবাসে বসবেন; তারপরে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা এবং বয়স্ক মানুষরা। তারপর হয়তো ওয়াংচুক আবার। অর্থাৎ, চলবে। এই পরিস্থিতিতে লাদাখবাসীর আন্দোলন সম্পর্কে যে প্রশ্নগুলোর উত্তর মানুষ খুঁজতে চাইবেন, তার কয়েকটি নীচে আলোচনা করা হল।

প্রশ্ন ১) লাদাখ আন্দোলনের লক্ষ্য কী?

উত্তরআন্দোলনের লক্ষ্য—

লাদাখের পাহাড়গুলির অবস্থা যাতে হিমাচল প্রদেশ, উত্তরাখণ্ড ও সিকিমের পাহাড়গুলির মতো না হয়

এবং

লাদাখের প্রকৃতি-পরিবেশ-বাস্তুতন্ত্র ও তার নিজস্ব সাংস্কৃতিক পরম্পরা যাতে সুরক্ষিত থাকে

তার জন্য

সংবিধানের ষষ্ঠ তফশিল মারফত লাদাখের জনজাতি (ট্রাইবাল) অঞ্চলগুলির স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠা ও অনতিদূর ভবিষ্যতে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল থেকে লাদাখ একটি স্বশাসিত রাজ্য হওয়া।

প্রশ্ন ২) ওয়াংচুক বারে বারে বলছেন যে বিজেপি লাদাখের মানুষের কাছে তার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছে। ঠিক কোন প্রতিশ্রুতির কথা বলা হচ্ছে?

উত্তর: ২০১৯ সালের লোকসভা এবং ২০২০ সালে লাদাখের পার্বত্য পরিষদ নির্বাচনে বিজেপি লাদাখের মানুষের কাছে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে লাদাখকে ষষ্ঠ তফশিলের অন্তর্ভুক্ত করবে যাতে লাদাখের মানুষের জমিজমা, কর্মসংস্থান, প্রকৃতি-পরিবেশ সুরক্ষিত হয়। লাদাখের লোকসভা আসন ও লেহ্‌-এর পার্বত্য পরিষদে বিজেপির জয়ের পেছনে এই প্রতিশ্রুতির একটা বড় ভূমিকা ছিল। 

লাদাখবাসীর রাজ্যের দাবিটি তুলনায় সাম্প্রতিক। বিজেপির প্রকাশিত নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির মধ্যে এটি ছিল বলে জানা যায় না। নির্বাচনী বক্তৃতায় অবশ্য এসে থাকতে পারে।      

প্রশ্ন ৩) ষষ্ঠ তফশিল অঞ্চল না হওয়ার ফলে লাদাখবাসীর কী অসুবিধা হচ্ছে এবং ষষ্ঠ তফশিল হলে লাদাখবাসীর ঠিক কী সুবিধা হবে?

উত্তর: ২০১৯ সালের অগস্ট মাস অবধি জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্য ছিল সংবিধানের ৩৭০ ধারার আওতায়। এই সময়, লাদাখও ছিল জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের অন্তর্গত। ফলে, লাদাখের ক্ষেত্রেও বলবৎ ছিল ৩৭০ ধারা। ৩৭০ ধারা অনুযায়ী জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের বাইরের মানুষ বা বিনিয়োগকারী সংস্থা ওই রাজ্যে জমি কিনতে পারতেন না। সেই সুবাদে লাদাখেও জমিজমা ব্যবসা-বাণিজ্যের উপর স্থানীয় মানুষের নিয়ন্ত্রণ ছিল।

২০১৯-এ ৩৭০ ধারা উধাও হল। তারপর, ২০১৯-এর নতুন আইনে লাদাখ জম্মু ও কাশ্মীর থেকে বেরিয়ে হয়ে গেল স্বতন্ত্র কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল। অধিকাংশ কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের মতো তার কোনও বিধানসভা থাকল না। ফলে, আসল ক্ষমতা লেফটেনান্ট গভর্নরের হাতে। ওদিকে ৩৭০ ধারা না থাকায় জম্মু ও কাশ্মীরে এখন বাইরের লোকেরা জমি কিনছে; বাইরের বিনিয়োগ ঢুকছে, বাইরের লোক চাকরি পাচ্ছে। লাদাখিরা তা জানতে পারল। বুঝল, ৩৭০ ধারার অনুপস্থিতিতে এখন কেন্দ্রীয় সরকার বা যে-কোনও বিনিয়োগকারী সংস্থা আঞ্চলিক মানুষের ইচ্ছা-অভিরুচি-উদ্‌বেগ-আশঙ্কার তোয়াক্কা না করে এখানে যে-কোনও পরিমাণে জমি দখল করতে পারে— কেন্দ্রীয় সরকারের ছাড়পত্র নিয়ে প্রকল্প চালু করতে পারে। পার্বত্য পরিষদ দিয়ে তা আটকানো যাবে না। শুধু পারে না, তাই হওয়ার সূচনা হচ্ছে। কারণ, পরিষদের ক্ষমতা খুব সীমিত। গোটা লাদাখের উপর নিয়ন্ত্রণ লেফটেনান্ট গভর্নরের।  

ষষ্ঠ তফশিলের আওতাভুক্ত হলে লাদাখের জমিজমা প্রাকৃতিক সম্পদ সবই লাদাখের মানুষের গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণের আওতায় আসবে। ষষ্ঠ তফশিলের রেওয়াজ অনুযায়ী, লাদাখে তৈরি হবে লাদাখি জনজাতি নির্বাচিত আঞ্চলিক ও জেলা পরিষদ এবং তারাই ঠিক করবে অঞ্চল ও জেলার অর্থনৈতিক বিকাশ কেমন ঢঙে ও কীভাবে হবে। তারা যেহেতু নিজেদের অঞ্চলের ভূপ্রকৃতি-বাস্তুতন্ত্রকে নিবিড়ভাবে জানে ও সে সব সম্পর্কে তাদের স্বাভাবিক দরদ আছে, তাদের পক্ষে সে সবের সুরক্ষার কথা মাথায় রেখে অর্থনৈতিক বিকাশের পরিকল্পনা করা সহজ হবে।   

প্রশ্ন ৪) কেন, ৩৭০-এর আওতা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর লাদাখে এমন কী ঘটেছে যাতে ওয়াংচুক বা অন্যান্য লাদাখবাসীর উদ্‌বেগের যথাযথ কারণ থাকতে পারে?

উত্তর: আজকাল বাইরের মানুষ লাদাখে অনেক বেশি সহজে পৌঁছতে পারলেও, মালপত্র-যন্ত্রপাতি লাদাখে পৌঁছনো কাশ্মীরের তুলনায় এখনও অনেক বেশি কঠিন। কিন্তু, ৩৭০ ধারার আওতা থেকে লাদাখ বেরিয়ে যাওয়ার পর কেন্দ্রীয় সরকার লাদাখে যোগাযোগ ব্যবস্থা বাড়ানোর ব্যাপারে ভীষণ ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। কোভিড অতিমারীর জন্য সব কিছু দেরি হওয়া সত্ত্বেও, লাদাখে ৭৫০.২১ কিলোমিটার রাস্তা নতুন নির্মাণ হয়েছে কিংবা পুরনো রাস্তা সারানো হয়েছে, ২৯টি নতুন ব্রিজ তৈরি হয়েছে এবং ৩০টি নতুন হেলিপ্যাড বসেছে। পাশাপাশি তৈরি হচ্ছে শ্রীনগর থেকে কারগিলে সহজে পৌঁছনোর লক্ষ্যে জোজি লা সুড়ঙ্গ (Zoji La Tunnel), সহজে সীমান্তে পৌঁছনোর উদ্দেশ্যে তৈরি হচ্ছে কারগিল-জানস্কার রোড, এবং গতকাল সন্ধ্যাতেই সম্পূর্ণ হল লাদাখে পৌঁছনার তৃতীয় এবং সবচেয়ে কম কঠিন রাস্তা— ২৯৮ কিমি দীর্ঘ নিম্মু-পদম-দরচা রোড, যা লাদাখকে যুক্ত করল হিমাচল প্রদেশের সঙ্গে।

শুধু সীমান্তের সঙ্গে উন্নততর সংযোগ আর পর্যটন উৎসাহিত করা নয়, আরও ব্যাপার আছে। ২০০৭ সালেই উত্তর লাদাখের নুবরা-শিওক উপত্যকার ভূপ্রস্তরে পাওয়া গিয়েছে সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম-থোরিয়াম ডিপোজিটের হদিশ। চিনের সঙ্গে সীমান্ত অঞ্চল। তার উপরে দারুণ গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার। তাই, ২০০৭-৮ সালের পর এই নিয়ে আর কোনও কথা মিডিয়াতে বা জনপরিসরে প্রকাশিত গবেষণাপত্রে অনুপস্থিত।

এখানেই শেষ নয়!

ইলেক্ট্রনিক যন্ত্রপাতি নির্মাণের ক্ষেত্রে অত্যন্ত মূল্যবান যে প্ল্যাটিনাম গোষ্ঠীর ধাতু— যথাক্রমে প্ল্যাটিনাম, প্যালাডিয়াম, রোডিয়াম, রুথেনিয়াম, ইরিডিয়াম ও অসমিয়াম— সেই ধাতুগুলির আকরের সন্ধান মিলেছে লাদাখে। সবগুলোই দুষ্প্রাপ্য ও দামি। তার মধ্যে রোডিয়াম সোনার চেয়েও দামি।   

তাই, কেন্দ্রীয় সরকার ও নানা বিনিয়োগকারী যে লাদাখের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলির সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ স্থাপনে উৎসাহী হবেন তাতে আশ্চর্য কিছু নেই। আর, লাদাখের বিভিন্ন কোণে পৌঁছে যাওয়ার যোগাযোগ আরও সহজ হলে পর্যটন ও হোটেল ব্যবসায়ে বিনিয়োগকারীদের আটকে রাখা মুশকিল হবে। বাড়বে যোগাযোগ, হু হু করে বাড়বে গাড়ি, বাস, লরির যাতায়াত, বাড়বে হোটেল, রিসর্ট ও নানা কিসিমের পর্যটনকেন্দ্র। জলের মতো টাকা ঢুকলে পরিবেশ, স্বাস্থ্য, জননিরাপত্তা-সংক্রান্ত প্রাথমিক সুরক্ষা ও সাবধানতার নিয়মগুলো লঙ্ঘিত হতে থাকবে— যেমন হয়েছে উত্তরাখণ্ড, হিমাচল ও সিকিমে। পাহাড়ের সর্বনাশ হবে, হবে লাদাখবাসীর সর্বনাশ।

প্রশ্ন ৫) ওয়াংচুক বারে বারে বলছেন হিমবাহের কথা। সে সব কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে?

উত্তর: হিমালয় ও কারাকোরাম রেঞ্জের মধ্যে গুঁজে রয়েছে লাদাখ। জলবায়ু বদলের ফলে পৃথিবী জুড়ে হিমবাহ গলছে। বিপন্ন হচ্ছে এই গ্রহের নদীগুলি। সুমেরু ও কুমেরু অঞ্চলের বাইরে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি হিমবাহ আছে হিমালয় ও কারাকোরোম রেঞ্জের অন্তর্ভুক্ত অঞ্চলে। লাদাখের নদীগুলি এবং লাদাখবাসীর জলের জোগান হিমালয় ও কারাকোরাম রেঞ্জের হিমবাহগুলির উপর নির্ভরশীল।  

কিন্তু শুধু গ্রহের জলবায়ু বদলের জন্যই হিমবাহ গলছে তা নয়। আঞ্চলিক কাণ্ডকারখানার একটা বিরাট ভূমিকা আছে। যেমন, আপনার আশপাশের তাপমাত্রা যতটা গ্রহের জলবায়ুর উপর নির্ভরশীল ততটাই নির্ভরশীল আপনার আশপাশে কী ঘটছে তার উপর (যেমন আপনি ঘরের মধ্যে উনুনের কাছে আছেন নাকি পুকুর পাড়ে গাছের ছায়ায় আছেন), তেমনই হিমবাহের স্বাস্থ্যও নির্ভর করে পারিপার্শ্বিক কাণ্ডকারখানার উপর। হিমবাহের কাছাকাছি যদি নগরায়ন ঘটে, শয়ে শয়ে বা হাজারে হাজারে গাড়ি যায়, বড় নির্মাণকার্য হয়— স্বাভাবিকভাবেই পারিপার্শ্বিক তাপমাত্রা বাড়বে এবং হিমবাহ আরও বেশি বেশি করে গলবে। সাম্প্রতিক গবেষণা দেখাচ্ছে যে ২০০১ থেকে ২০১৯-এর মধ্যে, লাদাখের পাংগং এলাকার হিমবাহগুলি বেশ খানিকটা গলেছে। লাদাখের ব্যাপক ‘উন্নয়ন’ শুরু হলে সে সব হিমবাহর দশা কী হবে তা নিয়ে সন্ত্রস্ত হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। ওয়াংচুক এসব প্রসঙ্গ এনেছেন।

প্রশ্ন ৬) ধরা যাক যষ্ঠ তফশিল হল। এমনকী লাদাখ একটি স্বতন্ত্র রাজ্য হল এবং নিজের বিধানসভা পেল। তাতেই কি এই সমস্যাগুলো উধাও হবে?

উত্তর: উধাও হবে এমন দাবি করা হচ্ছে না। কিন্তু এগুলো হলে কেন্দ্রীয় সরকার বা বাইরের কর্পোরেট সংস্থার পক্ষে ‘উন্নয়ন’-এর নামে আস্তিন গুটিয়ে লাদাখের ভূপ্রকৃতির বারোটা বাজানোর বন্দোবস্ত করা কঠিন হবে। এই কারণে অন্ততপক্ষে ষষ্ঠ তফশিলটুকু দরকার। রাজ্য হলে তো লাদাখবাসীর স্বনিয়ন্ত্রণের আরও সুবিধা।

তারপর বেশ খানিকটা লাদাখবাসীর হাতে থাকবে। জনজাতি গোষ্ঠীগুলির বহু শতাব্দী ধরে অর্জিত আঞ্চলিক পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্র সংক্রান্ত কাণ্ডজ্ঞান এবং সোনাম ওয়াংচুক ও তাঁর দ্বারা প্রভাবিত মানুষজনের বুদ্ধি ও বিদ্যা যদি নির্বিচার লোভ ও মুনাফামুখী অর্থনীতি ও সংস্কৃতির প্রভাবকে অনেকটা লাগামে রাখতে পারে তাহলে লাদাখের ভূপ্রকৃতি-পরিবেশ-বাস্তুতন্ত্র অনেক দূর সুরক্ষিত হবে। মুসলমানপ্রধান কারগিল জেলা ও বৌদ্ধপ্রধান লেহ্‌ জেলার মধ্যে পারস্পরিক সন্দেহের খানিকটা আবহাওয়া ছিল। গত দু-তিন বছরে তা অনেকটা স্বাভাবিক হয়েছে। কারগিল ও লেহ্‌ একজোট হয়ে ষষ্ঠ তপশিল ও স্বতন্ত্র রাজ্যের দাবি জানাচ্ছে। ফলে, বিজেপি কোণঠাসা এবং কেন্দ্রীয় সরকার বিপদে পড়েছে। যদি এই সৌহার্দ্য টিকে থাকে ও ভবিষ্যতে আরও বাড়ে তাহলে লাদাখবাসীর সুবিধা। আর, রাজ্যের প্রশাসন ও ষষ্ঠ তফশিলের প্রশাসনের মধ্যে দ্বন্দ্বের যে সম্ভাবনা তার নিষ্পত্তির ফর্মুলা যদি তাঁরা বার করতে পারেন তাহলে তো সোনায় সোহাগা।

বুক ভরে আশা করতে দোষ কি?


Wednesday, 20 March 2024

প্রোমোটারের দাপট

নগর যখন ভেঙ্গে পড়ে!

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য


 

কলকাতা পৌরসভার ১৩৪ নং ওয়ার্ডে অবৈধ ভাবে নির্মীয়মাণ একটি বহুতল ভেঙ্গে এখন পর্যন্ত দশজনের মৃত্যুতে তুমুল সোরগোলের পর প্রোমোটার মহঃ ওয়াসিম ও জমির মালিককে গ্রেফতারি কতটা ক্ষতে মলম দেবে তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় আছে। কারণ, শহরতলির অলিতে গলিতে চলমান যে অবৈধ হাইরাইজের নির্মিতি তা একদিনের ঘটনাক্রম নয় এবং ভবিষ্যতে যে এর ইতি ঘটবে তার তেমন কোনও ইঙ্গিতও নেই। সস্তার মালমশলায় ছোট ছোট খুপরিতে নাগরিকদের মাথা গোঁজার ঠাই করে দিতে যে ‘সামাজিক ব্যাধি’ (মেয়রের ভাষায়) আজ শহরের আনাচে কানাচে ডানা মেলেছে, তার রসদ বহু গভীরে। এর সঙ্গে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক যোগও যথেষ্ট সুবিদিত।

যদিও কাউন্সিলর অতীন ঘোষ এই দুষ্ট চক্রে রাজনৈতিক যোগের কথা স্বীকার করেছেন, এমনকি রাজ্যের শাসক দলের মুখপাত্র কুণাল ঘোষও অন্তর্নিহিত গভীর অন্যায়ের তদন্তের দাবিকেও মান্যতা দিয়েছেন, কিন্তু মহানাগরিক বিষয়টিকে ঠেলতে চেয়েছেন শুধুমাত্র প্রশাসনিক অকর্মণ্যতার দিকেই। বলাই বাহুল্য, এই ব্যাধি সাম্প্রতিক নয়, গত ২০-২৫ বছর ধরেই প্রোমোটার-দাপটে বহু অঞ্চলে সাধারণ নাগরিক যাপনে এক অস্থিরতা শুধু বিরাজই করেনি, উত্তরোত্তর তার ক্রমবৃদ্ধি এক তীব্র সংকটেরও জন্ম দিয়েছে। পুকুর ও জলাভূমি বুজিয়ে, নাগরিক পরিসরের সুস্থিতিকে তছনছ করে এর প্রকোপ দিনের পর দিন প্রবলতর হয়েছে। ‘টক টু মেয়র’ অনুষ্ঠানে সাহস করে বহু মানুষ এই তাণ্ডবের বিরুদ্ধে নালিশ জানিয়েছেন, তৎক্ষণাৎ প্রশাসনিক আধিকারিকেরা ঘটনাস্থলে ছুটেও গিয়েছেন, কিন্তু কোনও এক যাদুবলে আবার তা কিছুদিন পরে ধামাচাপাও পড়ে গিয়েছে। বহু জায়গায় মানুষ নালিশ জানাতে ভয়ও পেয়েছেন। অর্থের জোর ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে ‘সব ঠিক হ্যায়’ গোছের এক ভারসাম্য বজায় থেকেছে। বাইক নিয়ে সপার্ষদ এই প্রোমোটারেরা এমন মেজাজে এলাকায় ঘুরে বেড়ায় যে নিরীহ জনতার কার ঘাড়ে কটা মাথা আছে তাদের বিরুদ্ধে কোথাও অভিযোগ জানানোর।

এই প্রবণতা শুধু কলকাতা শহরেই নয়, ভারতবর্ষের বহু মহানগরে আজ নাগরিক জীবনের কাছে এক ত্রাস হয়ে দাঁড়িয়েছে। কলকাতার অ্যাডেড এরিয়ায় যত্রতত্র গজিয়ে ওঠা ফ্ল্যাট রাস্তার পরিসর, পয়ঃপ্রণালীর বহন ক্ষমতা, পানীয় জলের জোগানের নাব্যতা- কোনও কিছুকেই ধর্তব্যের মধ্যে গণ্য করে না। আট-দশ ফুটের রাস্তায় দেড়-দু কাঠা জমিতেও অবাধে উঠে যাচ্ছে তিন-চারতলার ফ্ল্যাটবাড়ি। নির্মাণের শুরুতে লোকদেখানো নিয়ম মেনে আইন অনুসারে জমির কিছু অংশ রাস্তায় ছাড় দিয়ে ছোট পাঁচিল তুলে নির্মাণ সম্পূর্ণ করে তারপর সেই পাঁচিল ভেঙ্গে ছাড় দেওয়া রাস্তাকে আবার জমির অংশে ঢুকিয়ে নতুন করে পাঁচিল তুলে দেওয়া হচ্ছে। খুপরি ফ্ল্যাটের সংখ্যা বাড়াতে ও ঘরগুলিকে ঈষৎ বড় করতে নিয়মমাফিক জমির চারধারে ছাড় দেওয়ারও কোনও বালাই নেই। এইগুলি যে স্থানীয় কাউন্সিলর বা পৌরসভার আধিকারিকেরা জানেন না তেমনও নয়। কৌশলটা ভারী চমৎকার। হুড়হুড় করে ফ্ল্যাট তুলে চটজলদি তা বিক্রি করে দিলেই কেল্লা ফতে! কারণ, একবার ফ্ল্যাটবাড়িতে লোক ঢুকে গেলে ‘মানবিকতা’র স্বার্থে সে ফ্ল্যাটের অবৈধ অংশ আর নাকি ভাঙ্গা যায় না, এই যুক্তিতেই সিদ্ধ হয়ে যাচ্ছে যাবতীয় অপরাধ। উপরন্তু, ‘কমপ্লিশন সার্টিফিকেট’ বা ‘সিসি’ নেওয়ারও দায় প্রোমোটারদের নেই! তারা বিক্রি করেই ধা! ক্রেতারা এবার পৌরসভার দরজায় দরজায় ‘সিসি’র জন্য হন্যে হয়ে দৌড়চ্ছে মিউটেশনের জন্য।

আসলে, কলকাতা এবং মফস্বল শহরগুলিতে নগর পরিকল্পনা বলে কিছুই নেই। দু-একটি পার্ক তৈরি করে নগর পরিকল্পনার দায় ঝেড়ে ফেলা হচ্ছে। একটি পাড়া বা অঞ্চলে যেখানে রাস্তা অপ্রশস্ত, সেখানে বাড়িগুলির উচ্চতা কত দূর অবধি হতে পারে, ঘিঞ্জি পরিসরকে কতটা নিরাময় দেওয়া যায়, সে সবের কোনও দায়-ই নেই। সল্ট লেক বা নিউ টাউন যে ভাবে পরিকল্পনা করে গড়ে তোলা হয়েছিল, তার ছিটেফোঁটাও দ্রুত নগরে পরিণত হতে থাকা দূর-দূরান্তের শহরতলির ক্ষেত্রে দেখা যায় না। এখানে যেনতেন প্রকারেণ জমি হাতিয়ে ফ্ল্যাট তুলে বিক্রি করে দেওয়ার মধ্যেই নগরায়নের যাবতীয় কর্মকাণ্ড কেন্দ্রীভূত। ফলে, শহরতলি যেন ক্রমেই হয়ে উঠছে ইট-কংক্রিটের নতুন ‘পাকা’ বস্তি। আট কি বারো ফুটের রাস্তার ওপর দু-কাঠা জমিতে নির্মিত চার-পাঁচতলা ফ্ল্যাটের মধ্যে বাস করছেন প্রায় ৬০ থেকে ৮০ জন মানুষ। বহু জায়গায় পরিশ্রুত পানীয় জলের জোগান নেই, ফলে ডিপ টিউবেল বসিয়ে এতগুলি লোককে জল জোগাতে গিয়ে নিঃস্ব হচ্ছে পাতালপুরী। আর এ তো একটা মাত্র ফ্ল্যাটে নয়, এরকম পাড়ায় পর পর দশটা বাড়িকে গুনতি করলে তার মধ্যে ৭ থেকে ৮টা বাড়িই এখন ফ্ল্যাট। অতএব, পরিস্থিতি কতটা ভয়ানক তা সহজেই অনুমেয়।

নিম্নমানের সস্তা মশলায় তৈরি ফ্ল্যাট ভেঙ্গে পড়ার আশঙ্কাই শুধু নয়, বিক্রির দু-তিন বছরের মধ্যে ক্রেতারা নিজ নিজ ফ্ল্যাটের অবস্থা দেখেও কপাল চাপড়াচ্ছেন। কোথাও পিলারে ক্র্যাক তো কোথাও ছাদ ভিজে উঠছে বৃষ্টির চুইয়ে পড়া জলে; অথবা, ঘরের দেয়ালে ফাটল নয়তো মেঝে উঠছে ঘেমে। সে ফ্ল্যাট বিক্রি করে পালানোর পথও নেই। কারণ, এই অবস্থায় নতুন ক্রেতাও অমিল। সময় গড়াতে ফ্ল্যাটগুলির অবস্থা এতটাই খারাপ হয়ে পড়ছে যে তা একপ্রকার মনুষ্য-বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠছে। শরীর হয়ে পড়ছে রোগের ডিপো; শিশু অথবা বাচ্চাদের অবস্থা আরও শোচনীয়। ঘরে বা বারান্দায় জামাকাপড় মেলবার জায়গা নেই, ছাদে মেলতে গিয়ে সামান্য পরিসরে ফ্ল্যাট-প্রতিবেশীদের মধ্যে লেগে যাচ্ছে ধুন্ধুমার কাণ্ড। সব মিলিয়ে, স্থান সংকুলানের গোদের ওপর রোগভোগের বিষফোঁড়া।

কিন্তু কেন এই বাধ্যবাধকতা? ফ্ল্যাট বানালেই যে বিক্রি হবে তার তো কোনও মানে নেই। এখানেই একটি মজার চিত্র লুকিয়ে আছে। ছোট জমির ওপর ফ্ল্যাট তুলতে গিয়ে যদি পৌরসভার বিধি (জমি ছাড় ইত্যাদি) অমান্য করা যায়, ৪০০ থেকে ৫০০ বর্গ ফিটের অনেকগুলি ছোট ছোট ফ্ল্যাট একেকটা ফ্লোরে নির্মাণ করা যায়, বেআইনি ভাবে যতটা সম্ভব তলা (তিন থেকে পাঁচ) বাড়ানো যায়, এবং যতটা সম্ভব রড, সিমেন্ট ও স্টোনচিপে কারচুপি করে মশলা তৈরি করা যায় তাহলে এক লপ্তেই যে বিপুল মুনাফা ওঠে তা লটারিতে প্রথম পুরস্কার পাওয়ার চেয়ে কম কিছু নয়। অতএব, আপাত-দৃশ্যে ‘সস্তায়’ এই ক্ষুদ্রকায় ফ্ল্যাটগুলি নগদের বিনিময়ে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত ক্রেতাদের হাতে সহজেই তুলে দেওয়া যায়। এখানে ক্রেতা ও বিক্রেতার আপাত ভারসাম্যও সাধিত হয়। বলাই বাহুল্য, এই কারবারটা রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক যোগ ব্যতিরেকে একেবারেই অসম্ভব। অন্যদিকে, ফ্ল্যাট তৈরির জমিগুলি আসে দুই তরফ থেকে- এক) পারিবারিক উত্তরাধিকারে একাধিক ওয়ারিশ হয়ে যাওয়ায় কারওরই যখন তেমন প্রাপ্তি কিছু নেই, প্রোমোটারের হাতে তুলে দিলে বরং ফ্ল্যাট নয়তো নগদ মিলতে পারে; দুই) অবসরের পরে বাড়ি করার উদ্দেশ্যে, ২০-২৫ বছর আগে সস্তায় কিনে রাখা ২-৩ কাঠা জমির বিনিময়ে যদি মুফতে ফ্ল্যাট ও নগদ মিলে যায় তাহলে তার থেকে সহজে কিস্তিমাত আর কী হতে পারে!

তাই, জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা প্রোমোটার-রাজ যে আজ শুধু এক ‘সামাজিক ব্যাধি’ নয়, বরং, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক যোগসাজসে এক মাফিয়া-রাজ, এবং নগর-বিধ্বংসী প্রকল্প, তা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। বার বার একেকটা ইমারত ভেঙ্গে পড়বে, মানুষের মৃত্যু-মিছিল দেখা দেবে, সকলে আপাত সজাগ হবেন, কিছুটা হৈচৈ হবে। কয়েকদিন সব শান্ত থাকবে। সব মিটে গেলে আবার, নীরবে মৃত্যুসজ্জা তৈরি হবে। আমরা কখনও দাবি তুলব না যে,

১) শহরের কিছু নির্দিষ্ট অঞ্চল ব্যতিরেকে কোথাও হাইরাইজ তোলা যাবে না;

২) অন্তত ১৬ ফিট প্রশস্ত রাস্তা না হলে দোতলার বেশি তল তৈরির অনুমতি দেওয়া যাবে না;

৩) প্রোমোটার ‘সিসি’ না পাওয়া পর্যন্ত ফ্ল্যাট বিক্রি করতে পারবে না;

৪) জমি প্লট করে নতুন বসতি গড়ে তুলতে গেলে অন্তত ১৬ ফিটের রাস্তা থাকাটা বাধ্যতামূলক করতে হবে, নয়তো জমির মিউটেশন অথবা বাড়ির নকশা অনুমোদন পাবে না।

এটা বাস্তব, দেশভাগ ও ১৯৭১’এর যুদ্ধের কারণে এ রাজ্যে যে বিপন্ন মানুষের বিপুল আগমন, তার ফলে জনসংখ্যার আচম্বিত বিস্ফোরণে রুটি-রুজি সহ বাসস্থানের সমস্যার কারণে শহরতলির ওপর স্থানজনিত অত্যধিক চাপ পড়েছে। কিন্তু তার থেকে নিস্তারের উপায় অপরাধপ্রবণ প্রোমোটার-রাজ নয়, সুপরিকল্পিত নগরায়ন ও যথাযথ ইমারত-নীতি। এই সুবোধ চিন্তা কি আদৌ প্রশাসন ও রাজনৈতিক মহল থেকে আশা করতে পারি? 

  

Tuesday, 12 March 2024

নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়ার হুমকি?

কোন ভয় থেকে সিএএ'র বিজ্ঞপ্তি জারি?

সোমনাথ গুহ



প্রায় পাঁচ বছর আগে ২০১৯-এর ১১ ডিসেম্বর ‘নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন’ (সিএএ) সংসদে প্রণয়ন করা হয়। ছয় মাসের মধ্যে ওই আইনের নিয়মাবলী গঠিত হবার কথা ছিল। ইতিমধ্যে ওই আইনের প্রতিবাদে দেশ জুড়ে প্রবল আন্দোলন দেখা যায়, অন্তত একশো জন রাষ্ট্রের দমনপীড়নের শিকার হন। অসমে পাঁচ ছাত্র পুলিশের অত্যাচারে মারা যান। আইনের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে প্রায় দুশো পিটিশন জমা পড়ে। সরকার এর ফলে বারবার পিছু হটে, করোনার অজুহাত দিয়ে নিয়মাবলী গঠনের জন্য বারবার সময় চায়। অবশেষে ঠিক লোকসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে, তারা একগুচ্ছ নিয়মাবলী ঘোষণা করে ১২ মার্চ থেকে সিএএ চালু করল। তাদের এই সিদ্ধান্ত ইতিমধ্যেই  দেশের বিভিন্ন অংশে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। 

কেন এই সিএএ? নাগরিকত্ব সংক্রান্ত মূল সমস্যা শুরু হয় ২০০৩ সালে যখন আইনের একটি সংশোধনী অনুযায়ী জনসংখ্যাপঞ্জী (এনপিআর) এবং জাতীয় নাগরিকপঞ্জী (এনআরসি) প্রস্তুত করার সিদ্ধান্ত হয়। এই সংশোধনীর ১৪(এ) ধারা অনুযায়ী কেন্দ্রীয় সরকার চাইলে দেশ জুড়ে পঞ্জীকরণ চালু এবং প্রতিটি নাগরিকের ‘জাতীয় পরিচয়পত্র’ তৈরি করা বাধ্যতামূলক করতে পারে। এই সংশোধনীকে হাতিয়ার করে ২০১৬ সালে অসমে বিজেপি সরকার এনআরসি চালু করে। চূড়ান্ত এনআরসি থেকে উনিশ লক্ষ মানুষের নাম বাদ যায় যার মধ্যে প্রায় বারো লক্ষ ছিলেন হিন্দু। এটা বিজেপিকে হতচকিত করে। অসম বিজেপি পত্রপাঠ এই ফলাফল খারিজ করে দেয়। হিন্দু মানুষের নাম এনআরসি থেকে বাদ পড়ায় বিজেপির ভাবমূর্তি ধাক্কা খায়। এমনকি ২০১৯'এ পশ্চিমবঙ্গের তিনটে উপনির্বাচনেও এর প্রভাব পড়ে। মাত্র ছয় মাস আগে লোকসভা নির্বাচনে ঝড় তোলা সত্ত্বেও বিজেপি কিন্তু তিনটি কেন্দ্রেই হারে। কালিয়াগঞ্জ কেন্দ্রের ফল বিশেষ ভাবে ইঙ্গিতপূর্ণ, কেননা লোকসভায় এই কেন্দ্র থেকে তারা প্রায় ৫৬,০০০ ভোটে  এগিয়ে ছিল। ২০২১ সালে পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচনে জেতা তখন বিজেপির ‘পাখির চোখ’। কিন্তু এনআরসি থেকে এত হিন্দুর নাম বাদ যাওয়ার কারণে বাংলায় হিন্দুদের মনে বিজেপি সম্পর্কে ঘোর সংশয় তৈরি হয়। উপরন্তু, মতুয়ারা আদৌ বিজেপিকে সমর্থন করবে কিনা তা নিয়েও আশঙ্কা  তৈরি হয়।

এই ক্ষতি সামাল দিতে বিজেপি তড়িঘড়ি বাজারে সিএএ নিয়ে আসে। শোনা যায়, অমিত শাহ'র বিখ্যাত উক্তি: 'আপ ক্রোনোলজি সমঝিয়ে'- প্রথমে সিএএ, তারপর এনআরসি। অর্থাৎ, সিএএ'র সুযোগ নিয়ে হিন্দুরা নাগরিকত্ব পেয়ে যাবেন এবং এনআরসি হয়ে দাঁড়াবে মুসলিম ছেঁকে তোলার কল। মতুয়া সম্প্রদায়ের একটা অংশ কেন্দ্রের শাসক দলের এই প্রতিশ্রুতিতে প্রভাবিত হন। নাগরিকত্বের কলা-মুলো ঝুলিয়ে বিজেপি ২০২১-এর বিধানসভা ভোটে ফয়দা তোলে- নদীয়া, উত্তর ২৪-পরগণা এবং উত্তর বাংলার কিছু অংশে এই সম্প্রদায় অধ্যুষিত প্রায় পনেরোটা আসনে তারা জয়লাভ করে। 

বিজেপি এবার লোকসভায় ৩৭০টি আসন জয়ের লক্ষ্য নিয়ে নেমেছে। এর জন্য অসমে ও পশ্চিমবাংলায় তারা আসন সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য মরীয়া। বাংলায় মতুয়া ভোটব্যাঙ্ক তাদের কাছে অপরিহার্য। তাই তারা 'নিঃশর্তে নাগরিকত্ব' নামক আরও একটি জুমলা সামনে নিয়ে এসেছে। সিএএ কি আদৌ নিঃশর্ত নাগরিকত্ব দেবে?  

এই আইনের ফলে ৩১শে ডিসেম্বর, ২০১৪ অবধি পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও আফগানিস্তান থেকে হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ, জৈন, পার্সি ও খ্রিশ্চান ধর্মের যে সব মানুষ ভারতে এসেছেন তাঁদের অবৈধ অভিবাসী হিসাবে গণ্য করা হবে না। মুসলিমরা এই আইনের সুযোগ পাবেন না, তাই এই আইন বৈষম্যমূলক। পাকিস্তান, আফগানিস্তানে শিয়া, হাজারা সম্প্রদায়ের মানুষরাও নির্যাতিত, তাঁরা কিন্তু ভারতে আশ্রয় পাবেন না। পার্শ্ববর্তী দেশ মায়ানমারের রোহিঙ্গারা, যাঁরা গণনিধনের শিকার হয়েছেন, তাঁদেরও এ দেশে ঠাঁই নেই। সঙ্ঘ পরিবারের যুক্তি, শ্রীলঙ্কার তামিলদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি কারণ তারা জাতিগত ভাবে নিপীড়িত, ধর্মীয় ভাবে নয়! নেপাল, ভুটানের নির্যাতিত মানুষেরাও এই আইনের সুযোগ পাবেন না। 

নাগরিকত্ব কি নিঃশর্তে পাওয়া যাবে? আদৌ নয়। আইনে যে বিষয়টি লক্ষণীয় তা হচ্ছে, এই ছটি ধর্মের যে মানুষরা আসছেন তাঁরা কিন্তু সরাসরি নাগরিকত্ব পাচ্ছেন না, তাঁরা শুধুমাত্র ‘অবৈধ অভিবাসী’ হিসাবে গণ্য হবেন না; তাঁদের নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে হবে এবং তার জন্য কিছু শর্ত আছে। প্রথম শর্ত, ওই তিনটি দেশে ধর্মের কারণে নিপীড়িত ছটি ধর্মের মানুষেরাই কেবল এই আইনের সুযোগ পাবেন। দ্বিতীয় শর্ত, তাঁরা এই দেশে এসেছেন ২০১৪'র ৩১শে ডিসেম্বরের মধ্যে। তৃতীয় শর্ত, এক বছর টানা ভারতে থেকেছেন এবং গত চোদ্দ বছরে অন্তত পাঁচ বছর এখানে থেকেছেন।

সিএএ'র জন্য ৩৯ পাতার যে নিয়মাবলী সরকার প্রকাশ করেছে সেটির প্রথম পাঁচ পাতা বিভিন্ন নিয়ম এবং বাকী নানা ধরনের ফর্ম। ধর্মীয় উৎপীড়নের কোনও প্রমাণ দিতে হবে কি না তা পরিষ্কার নয়। প্রথম ফর্মে নিজের সম্পর্কে তথ্য দিতে হবে। পিতামাতার নাম, কোন দেশ, কোন জেলা থেকে এসেছেন, কবে এসেছেন ইত্যাদি জানাতে হবে। সঠিক তথ্য জমা দিয়েছেন এই মর্মে একটি হলফনামা দিতে হবে। কোনও ভারতীয় নাগরিকের থেকে ‘ক্যারেক্টার সার্টিফিকেট’ বা নিজের চরিত্র সম্পর্কে হলফনামা জমা দিতে হবে। আবেদনকারীকে অষ্টম তফসিলের যে কোনও একটি ভাষা বলতে জানতে হবে, সেটি সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান থাকাও প্রয়োজন। তাঁর আবেদন যদি মঞ্জুর হয় তাহলে আগের দেশের নাগরিকত্ব ছাড়তে হবে এবং এই মর্মেও তাঁকে হলফনামা দিতে হবে। 

কেন্দ্রীয় সরকার দ্বারা নিয়োজিত দুটি কমিটি যাবতীয় তথ্য যাচাই করবে। আবেদন প্রথমে যাবে জেলা কমিটির কাছে। তাঁরা সব তথ্য খতিয়ে দেখে সন্তুষ্ট হলে সেই আবেদন উচ্চতর একটি বিশেষ ক্ষমতাপ্রাপ্ত কমিটির কাছে পাঠাবে। দ্বিতীয় কমিটির দুই জন সদস্য, উভয়েই হবেন সরকারের উচ্চপদস্থ আধিকারিক। কোনও আবেদনকারী যদি সঠিক নথি জমা দিতে না পারেন তাহলে প্রথম কমিটি দ্বিতীয়কে সেটি খারিজ করার পরামর্শ দিতে পারে। সমস্ত নথি ঠিক থাকলে ডিজিটাল শংসাপত্র দেওয়া যেতে পারে। 

এর থেকে এটা পরিষ্কার যে, মোটেও নিঃশর্ত নাগরিকত্ব দেওয়া হচ্ছে না। এবার একটা বাস্তব পরিস্থিতি ভেবে দেখুন। ধরা যাক একজন হিন্দু মানুষ ২০০০ সালে বাংলাদেশ থেকে পশ্চিমবাংলায় এসেছেন। সীমান্তবর্তী কোনও ছোট শহরে বাড়ি ভাড়া করে তিনি একটা ব্যবসা শুরু করেছেন। প্রভাবশালী কাউকে ধরে নথিপত্র জোগাড় করেছেন। ছেলেমেয়ে স্কুলে পড়ছে। ভোটও দিয়েছেন এবং মোটামুটি থিতু হয়ে বসে তিনি একটা স্থায়ী জীবন শুরু করেছেন। এবার, কেন্দ্রীয় সরকারের এই নতুন আইন দ্বারা প্ররোচিত হয়ে তিনি সিএএ'র মাধ্যমে নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্য আবেদন করলেন। এটা করা মাত্র যে মানুষটি স্থায়ী জীবন শুরু করেছিলেন তিনি কিন্তু নিজেকে অবৈধ ঘোষণা করলেন, নিজের অস্তিত্ব বিপন্ন করে ফেললেন। এরপর, তাঁর আবেদন যে মঞ্জুর হবে তার কী নিশ্চয়তা আছে? প্রতিটি ফর্ম, হলফনামা তাঁকে ঠিকঠাক পূরণ করতে হবে, সঠিক নথিপত্র জমা দিতে হবে এবং তারপরেও তাঁকে এই দুটি কমিটির কর্মদক্ষতা, ধর্মীয়, জাতিগত নিরপেক্ষতার ওপর নির্ভর করতে হবে। অসমের এনআরসি একটা বিরাট শিক্ষা! শুধুমাত্র নাম, পোশাক বা চেহারা ‘সন্দেহ’ উদ্রেক করার কারণে অনেক আবেদনকারীকে কাগজ নিয়ে বছরের পর বছর ঘুরতে হয়েছে।

বর্তমানে সিএএ সাব-জুডিস, সুপ্রিম কোর্টের বিচারাধীন। সেদিক থেকে দেখলে প্রশ্ন উঠবে, সরকার কি আদৌ আদালতের রায়ের আগে এই আইনের নিয়মাবলী গঠন করতে পারে? এছাড়া এই আইন সংবিধানের ১৪ নম্বর ধারা লঙ্ঘন করে, ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব প্রদান করে ধর্ম নিরপেক্ষতার আদর্শকে অস্বীকার করে। কিন্তু এই সরকার তো সংবিধান বা বিচারব্যবস্থাকে মান্যতা দেয় না। 

রমজান শুরুর পরের দিন নিয়মাবলী ঘোষণা করা হয়েছে যাতে মুসলিম জনতা প্রতিবাদ করতে দ্বিধা বোধ করেন। ‘ইন্ডিয়ান ইউনিয়ন মুসলিম লিগ’ আজ সুপ্রিম কোর্টে এই আইন ও এর নিয়মাবলীর ওপর স্থগিতাদেশের জন্য আবেদন জানিয়েছে। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররা বিক্ষোভ দেখিয়েছেন এবং তাঁদের নির্মম ভাবে দমন করা হয়েছে। অসমে এনআরসি করা হয়েছিল ২৪শে মার্চ, ১৯৭১'কে কাট-অফ ডেট ধরে; সেটা নতুন আইনের কারণে হয়ে দাঁড়াল ৩১শে ডিসেম্বর, ২০১৪। মানুষ সেখানে রাস্তায় নেমে পড়েছে, বিরোধী দলগুলি বনধ ডেকেছে। কলকাতা এবং বিহার ও ঝাড়খন্ডের শহরে বিক্ষোভ প্রদর্শন হয়েছে। নির্বাচনী বন্ডের জালিয়াতি, নির্বাচন কমিশনারের পদত্যাগ, দিল্লিতে নামাজিদের ওপর অভূতপূর্ব আক্রমণ এবং এখন সিএএ'কে আবার ঠাণ্ডা ঘর থেকে তুলে আনা- এসব মিলে মো-শা সরকার দেশ জুড়ে এক তুমুল অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করেছে। 

প্রশ্ন উঠছে, শাসক এত মরীয়া কেন? তারা কি বিপন্ন, বিপর্যস্ত বোধ করছে?


Tuesday, 5 March 2024

তথ্য নিছক তথ্য নয়

জিডিপি'র ফাঁকি ও গরিবি কমার গপ্পো

দীপঙ্কর দে



জাতীয় উৎপাদন বা জিডিপি বৃদ্ধির হার নিয়ে প্রায়শই নানা তথ্য কানে আসে। কখনও বিতর্কও বাঁধে অর্থশাস্ত্রের পণ্ডিতদের মধ্যে। অবশ্য গড়পড়তা নাগরিকের জীবনযাপনে স্রেফ জিডিপি বৃদ্ধির হারে কোনও তফাত হয় না। জিডিপি বৃদ্ধি হলেও ক্ষেত্র বিশেষে নাগরিকের আর্থিক সংকোচন হতে পারে। যেমন ধরুন, বর্তমান অর্থবর্ষের তৃতীয় ত্রৈমাসিকে (অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর) ভারতের জিডিপি বেড়েছে ৮.৪ শতাংশ হারে, কিন্তু একই সময়ে কৃষি ক্ষেত্রে উৎপাদন সংকুচিত হয়েছে। তাই অনুমান করাই যায়, কৃষি ক্ষেত্রে যুক্ত ভারতের বিশাল সংখ্যক নাগরিকের আর্থিক অবস্থার অবনতি হয়েছে। মোদ্দা কথা, জিডিপি বাড়লেই হবে না, জাতীয় উৎপাদনের বন্টন সুষম হতে হবে। নইলে ভারতের মতো রাষ্ট্রে যেখানে সম্পদ ও আয়ের বৈষম্য দিন দিন বাড়তে বাড়তে খুব কুৎসিত রূপ নিয়েছে, সেখানে জিডিপি বাড়লে শ্রেণি বৈষম্য বৃদ্ধির সম্ভাবনা আরও বাড়ে। 

জিডিপি নিয়ে এই নিবন্ধের আলোচনা একটু খটমটে। অন্য সময় এ আলোচনা না করলেও চলত। আম নাগরিকের কী বা যায় আসে যদি সরকার জিডিপি বৃদ্ধির হার বাড়িয়ে বা দেশের গরিবের সংখ্যা কমিয়ে বলে। মিথ্যে পরিসংখ্যানে বাস্তব অবস্থার পরিবর্তন হয় না। রাজনৈতিক চাপানউতোর বাড়ে। তবে মিথ্যের জোরে অপদার্থ শাসকের পক্ষে সহমত নির্মাণ সহজ হয়। নির্বাচনের মরসুমে রাষ্ট্রের তথ্যকে যাচাই করা তাই খুব জরুরি।

সমস্যা শুরু গত সপ্তাহে, যেদিন ন্যাশনাল স্ট্যাটিসটিকাল অফিস (NSO ) ঘোষণা করে যে বর্তমান অর্থবর্ষের তৃতীয় ত্রৈমাসিকে ভারতের জিডিপি বৃদ্ধির হার ছিল ৮.৪ শতাংশ। হঠাৎ এই বৃদ্ধির হার. রিজার্ভ ব্যাংকের বৃদ্ধির আগাম হিসেবের (৬.৫ শতাংশ) থেকে অনেকটাই বেশি। দেশের সংসদীয় নির্বাচনের মুখে এই বৃদ্ধির ফলে বর্তমান অর্থবর্ষে জিডিপি বৃদ্ধির আনুমানিক হার ৭.৩ শতাংশ থেকে বেড়ে দাঁড়ায় ৭.৬ শতাংশে। স্বভাবতই এই তথ্য শাসক দলের সাফল্য বলে প্রচারিত হতে থাকে। 

অর্থনীতির পণ্ডিতেরা সন্দিহান হন দুটি কারণে: ক) রিজার্ভ ব্যাঙ্ক সহ বিশ্ব ব্যাঙ্ক বা আইএমএফ'ও এতটা বৃদ্ধির আগাম অনুমান করেনি; খ) উক্ত সময়ে দেশের গ্রস ভ্যালু অ্যাডেড (GVA) পরিসংখ্যানের সঙ্গে জিডিপি পরিসংখ্যানের অমিল খুব বেশি। ওই ত্রৈমাসিকে ভারতের জিভিএ বৃদ্ধির হার ৬.৫ শতাংশ, যার অর্থ, জিডিপি ও জিভিএ বৃদ্ধির হারের তফাত ১৯০ বেসিস পয়েন্ট যা গত দশ বছরে সর্বাধিক। তাই শুরু হল কাটাছেঁড়া।

নিশ্চয়ই খেয়াল করেছেন, আমরা অনেক পণ্য কিনি যার প্যাকেটে লেখা থাকে 'কর সমেত সর্বোচ্চ মূল্য'। আমরা কিন্তু পণ্যের প্রকৃত মূল্য কত তা নিয়ে মাথা ঘামাই না। ঘামালে দেখব, পণ্যের বিক্রয়মূল্য = পণ্যের প্রকৃত মূল্য + অপ্রত্যক্ষ কর - অনুদান। একই ভাবে যদি এবার জাতীয় উৎপাদনের কথা ভাবি তবে দাঁড়ায়: জিডিপি = জিভিএ + অপ্রত্যক্ষ কর -অনুদান।

বোঝা যাচ্ছে, তৃতীয় ত্রৈমাসিক জিডিপি বৃদ্ধির হার আর জিভিএ বৃদ্ধির হারের যে তফাত'টা হচ্ছে তার কারণ: ১) অপ্রত্যক্ষ কর বৃদ্ধি ও ২) অনুদান হ্রাস। কর বৃদ্ধি ও অনুদান হ্রাস পেলে নাগরিকের ক্রয়ক্ষমতা কমে। তাই বলা যেতেই পারে, ৮.৪ শতাংশ জিডিপি বৃদ্ধি পেয়েছে অপ্রত্যক্ষ কর বাড়িয়ে ও অনুদান কমিয়ে। যার ফলে জিডিপি বাড়লেও আম নাগরিকের আর্থিক দুরবস্থা বেড়েছে। অবশ্য সরকারি তথ্যও সে কথা বলছে। বর্তমান আর্থিক বছরে জিএসটি খাতে রাজস্ব আদায় বেড়েছে ১২.৫ শতাংশ। আর খাদ্য ও সারে সরকারের যে অনুদান দেওয়ার কথা, তার মাত্র ৭০-৭৫ শতাংশ বাস্তবায়িত হয়েছে। তাই অঙ্কের নিয়মেই জিডিপি ও জিভিএ তথ্যে এত গরমিল চোখে পড়ছে। আর সরকার পোষিত মিডিয়া ও কতিপয় অর্থশাস্ত্রী জিডিপি বৃদ্ধির মূল কারণ লুকিয়ে সরকারের জয়গান গাইছে। 

শুধু জিডিপি বৃদ্ধির তথ্যই নয়, দেশের গরিবি মোচনের হার নিয়েও ব্যাপক কারচুপি করছে সরকার। গত সপ্তাহে বহু বছর পর ন্যাশনল স্যাম্পল সার্ভে অফিস (NSSO ) Household Consumption Expenditure Survey ( HCES ) ২০২২-২৩'এর আংশিক রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। তার ভিত্তিতে নীতি আয়োগের কর্তা দাবি করেছেন, বর্তমানে দরিদ্র নাগরিকের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার মাত্র ৫ শতাংশ। অর্থাৎ, ২০১১-১২ সালের সর্বশেষ HCEC তথ্যের নিরিখে দরিদ্র মানুষের অনুপাত কমেছে প্রায় ১৭ শতাংশ। কারণ, ২০১১-১২ সালে সুরেশ তেন্ডুলকরের নেতৃত্বে গঠিত কমিটি  HCEC তথ্যের ভিত্তিতে হিসেব করে বলেছিল, ভারতের মোট জনসংখ্যার ২১.৯ শতাংশ মানুষ দরিদ্র। এ ক্ষেত্রেও বিশেষজ্ঞ অর্থশাস্ত্রীরা সরকারি হিসেবে কয়েকটি গুরুতর ত্রুটির কথা উল্লেখ করেছেন। (টেলিগ্রাফ অনলাইন ২ মার্চ ২০২৪)।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন: 

১) ২০১১-১২ সালে তেন্ডুলকার যে পদ্ধতিতে দরিদ্রের সংখ্যা অনুমান করেছিলেন, সেই একই পদ্ধতি ২০২২-২৩ সালে ব্যবহার করা যাবে না। কারণ, আগেরবার HCES তথ্য সংগৃহীত হয়েছিল মিক্সড রেফারেন্স পিরিয়ড (MRP ) পদ্ধতিতে; কিন্তু নতুন HCES'এর ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়েছে মডিফাইড মিক্সড রেফারেন্স পিরিয়ড (MMRP) পদ্ধতি। তাই, এ ক্ষেত্রে ভিন্ন পদ্ধতিতে হিসেব করতে হবে। কমলা ও আপেলের তুলনা সম্ভব নয়। দুটোই ফল হলেও ভিন্ন জাতের ফল।

২) ২০১১-১২'এর সমীক্ষায় পারিবারিক খরচের হদিস পেতে ৩৪৭টি পণ্য ও পরিষেবার তথ্য তালাশ করা হয়েছিল। কিন্তু ২০২২-২৩'এ সে সংখ্যাটা বেড়ে দাঁড়ায় ৪০৫টি পণ্য ও পরিষেবায়। স্বাভাবিক ভাবেই এ ক্ষেত্রে পারিবারিক খরচের পরিমাণ আগের তুলনায় বেশি হওয়ার কথা।

৩) অর্থনীতিবিদ সন্তোষ মেহরোত্রা হিসেব কষে দেখেছেন, ২০২৬ সালের পর দেশের ম্যানুফ্যাকচারিং ক্ষেত্রে অবনতির ফলে প্রায় ছয় কোটি মানুষ কৃষি ক্ষেত্রে ফেরত যান। এঁদের প্রায় পাঁচ কোটি নিজেদের পারিবারিক কৃষিতে বিনা পারিশ্রমিকে যুক্ত হন, যদিও সরকারি পরিসংখ্যানে তাদের কর্মরত শ্রমিক বলেই নথিভুক্ত করা আছে। স্বাভাবিক ভাবেই অনুমান করা যায়, এই ছয় কোটি নাগরিকের আর্থিক অবস্থার অবনতি হয়েছে। প্রসঙ্গত বলে রাখি, ২০২২-২৩'এর আর্থিক সমীক্ষাতেও স্বীকার করা হয়েছে, মুদ্রাস্ফীতির ফলে ভারতে প্রকৃত মজুরি কমেছে।

সরকারি পরিসংখ্যান যাই বলুক, মুষ্টিমেয় ধনী ও উচ্চবিত্ত ছাড়া ভারতের আম নাগরিক প্রতিদিন টের পাচ্ছেন বাস্তব পরিস্থিতি কী। সরকারি পরিসংখ্যানে নাগরিকের আস্থা দিন দিন তলানিতে এসে ঠেকেছে। মিথ্যে পরিসংখ্যানে আর চিড়ে ভিজবে না। এটাই ভরসা।


Thursday, 29 February 2024

সন্দেশখালি অতঃপর (২)

খেলা শুরুর আগেই শেষ? 

সুমন সেনগুপ্ত



সম্পাদকীয় নোট: গত ১৩ ফেব্রু সন্দেশখালির ঘটনাবলী নিয়ে আমরা প্রথম প্রতিবেদনটি প্রকাশ করি। গোদি মিডিয়ার কলতলার ঝগড়া নয়, বাংলা দখলের রাজনৈতিক চিত্রনাট্য অনুসারে নয়, বাস্তব তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি লেখেন সুমন সেনগুপ্ত (https://ekakmatra2013.blogspot.com/2024/02/blog-post_13.html)। আজ শেখ শাহজাহানের গ্রেফতারের পর দরকার পড়ল আরও একটি প্রতিবেদনের।


অবশেষে গ্রেফতার হল তৃণমূলের নেতা শেখ সাজাহান। শোনা যাচ্ছে, ভোর রাতে মিনাখাঁর কাছে একটি জায়গা থেকে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ গ্রেফতার করেছে শেখ সাজাহানকে। স্বভাবতই সমস্ত মিডিয়া জুড়ে এই খবর। রেশন দুর্নীতির মামলায় ইডি যেদিন শেখ সাজাহানের বাড়িতে তল্লাশি করতে গিয়েছিল, সেদিন থেকেই সে খাতায়-কলমে নিখোঁজ ছিল। অবশেষে আজ গ্রেফতার হল। যদিও তার গ্রেফতারি নিয়ে প্রায় পঞ্চাশ দিনেরও বেশি টালবাহানা চলেছে। হাইকোর্টের একটি নির্দেশনামার কিছু অংশে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয় এবং তা রাজ্য সরকার গত ২৭ ফেব্রুয়ারি প্রধান বিচারপতির বেঞ্চে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে বিচারপতিদ্বয় স্পষ্ট করে এক নতুন নির্দেশনামায় বলেন যে শেখ সাজাহানকে গ্রেফতারে আদালতের কোনও বাধা নেই এবং ইডি, সিবিআই বা রাজ্য পুলিশ, যে কেউ তাকে গ্রেফতার করতে পারে। এই নির্দেশের পরেই পুলিশ কোমর বেঁধে নামে। তবে এ কথা অনস্বীকার্য যে, সন্দেশখালির জনতা, বিশেষত মহিলারা যদি সর্বাত্মক ভাবে এই প্রতিবাদ-প্রতিরোধ আন্দোলনে না নামতেন তবে আদৌ শেখ সাজাহানের দলবল এ ভাবে উন্মোচিত হত বা ধরা পড়ত কিনা, তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় আছে। অবশ্যই এই জয়, সন্দেশখালির মহিলাদের ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদের জয়।

এই গ্রেফতারিতে সন্দেশখালির মানুষ খুশি হয়ে অকাল হোলিতে মেতে উঠলেও প্রধান বিরোধী দল বিজেপি এখনও যে খুশি, তেমনটা নয়। তাদের দাবি, কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা যতক্ষণ না শেখ সাজাহানকে নিজেদের হেপাজতে নিচ্ছে, ততদিন এই গ্রেফতারি নাকি গ্রেফতারিই নয়, শুধুমাত্র লোকদেখানো কিছু নিয়মতান্ত্রিকতা মাত্র। যদিও রাজ্যপাল তাঁর বক্তব্যে 'অন্ধকারের শেষে আলোর দিশা' দেখতে পেয়েছেন, কিন্তু বেশ বোঝা যাচ্ছে, বিজেপি এই ইস্যুটা সহজে ছেড়ে দেবে না। ছেড়ে দিলে, তাদের পোষা গণমাধ্যমগুলোর তো সান্ধ্যকালীন কলতলার ঝগড়াই বন্ধ হয়ে যাবে!

তবে কলতলার ঝগড়া ব্যতিরেকেই শেখ সাজাহান, শিবু হাজরা কিংবা উত্তম সর্দারদের কুকীর্তির কথা জানেন না, এমন মানুষ এ রাজ্যে এখন হাতে গোনা। এই গ্রেফতারির প্রতিক্রিয়ায় রাজ্য রাজনীতিতে কতটা রদবদল হয় তার দিকে যেমন চোখ থাকবে, তার থেকেও বেশি নজর থাকবে সন্দেশখালিতে শাসক দল কীভাবে নিজেদের হারানো জায়গা আবার ফিরে পায়। মার্চের গোড়ায় প্রধানমন্ত্রী আসছেন। তিনিও নিশ্চিত সন্দেশখালি ও তৃণমূল নিয়ে তাঁর সমালোচনার সুর চড়াবেন। আগে শোনা যাচ্ছিল, সন্দেশখালির অত্যাচারিত মহিলাদের নাকি প্রধানমন্ত্রীর মঞ্চে তোলা হতে পারে, কিন্তু পরে হয়তো সেই কর্মসূচি থেকে বিজেপি নিজেকে বিরত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। 

তবে আজ এই গ্রেফতারির পরে বিজেপির কেন্দ্রীয় স্তরের মুখপাত্রেরা যে অভিযোগ করেছেন, তা নিয়েও কথা বলতে হয়। তাঁদের বক্তব্য, সাজাহানকে গ্রেফতারির সময়ে যে ধারাগুলো দেওয়া হয়েছে সেগুলো অত্যন্ত লঘু, এমনকি মহিলাদের ওপর অত্যাচারের কথাও নাকি সেই ধারায় নেই। যদিও তা একেবারেই নয়। বেশ কয়েকটি জামিন-অযোগ্য ধারা এই মামলায় যুক্ত হয়েছে এবং প্রথম সওয়ালেই বসিরহাট আদালত অভিযুক্তকে ১০ দিনের পুলিশ হেফাজত দিয়েছে। ওই নেতাদের দাবি, যদি এই গ্রেফতারির সঙ্গে রেশন দুর্নীতি এবং টাকা নয়ছয়ের বিষয় যুক্ত থাকে, তাহলে পুলিশের উচিত অবিলম্বে সাজাহানকে ইডির হাতে তুলে দেওয়া। কিন্তু ইডি, সিবিআই বা যে কোনও কেন্দ্রীয় সংস্থা যদি তদন্ত করে, তাহলে কি সন্দেশখালির অত্যাচারিত মানুষ সুরাহা পাবেন? নাকি ঐ তদন্তকারী সংস্থার হাতে তদন্ত তুলে দেওয়া গেলে ন্যারেটিভ বা আখ্যান তৈরি করতে সুবিধা হয় বিকিয়ে যাওয়া গণমাধ্যমগুলোর? সকালের কাগজে বড় বড় অক্ষরে হেডলাইন তৈরি না করা গেলে তো আর তদন্ত হয় না! 

এমনিতেই সন্দেশখালিতে অত্যাচারীর ভূমিকায় শেখ সাজাহানের সঙ্গে শিবু হাজরা কিংবা উত্তম সর্দারদের নাম উঠে আসায় ‘হিন্দু-মুসলমান দ্বন্দ্বের’ আখ্যান খুব একটা দাঁড় করানো যায়নি। এরপরে যদি ইডি, সিবিআই'ও না হয়, তাহলে তো গল্পটা শুরু হওয়ার আগেই শেষ হয়ে যাবে, তখন তো আর গণতন্ত্রের স্বঘোষিত দ্বাররক্ষকদের আর কোনও কাজই থাকবে না। সান্ধ্যকালীন কলতলার ঝগড়া না হলে তো টিআরপি পড়ে যাবে; তাই যে করে হোক এই তদন্ত ইডির হাতে দেওয়ার জন্য বিজেপি চাপ সৃষ্টি করেই যাবে। কারণ, বিজেপি জানে, ইডি'র হেফাজতে নিয়ে এলে শেখ সাজাহানকে এমনভাবে বিনা বিচারে আটকে রাখা যাবে যাতে শেষত আগামী লোকসভা নির্বাচনে ফায়দা তোলা যায়। 

শেখ সাজাহান, শিবু হাজরা, উত্তম সর্দাররা যে তৃণমূলের সংগঠন এবং অর্থকরী সামলায় তা এখন সবাই বোঝে। সে কারণেই তাদের যদি ইডি'র মামলার সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়া যায়, তাহলে একদিকে সান্ধ্য টিভি'তে কলতলার ঝগড়া এবং তা থেকে রোজ নতুন নতুন আখ্যান তৈরি করা যাবে এবং অন্যদিকে তৃণমূলকে সাংগঠনিক ভাবেও ধাক্কা দেওয়া যাবে। কেউ ইডির কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্নও তুলবে না, তাদের সাফল্য নিয়েও কথা উঠবে না। কেন দীর্ঘদিন ধরে বিনা বিচারে প্রায়-সমস্ত প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতা-মন্ত্রীদের এক বড় অংশকে আটকে রাখা হয়েছে, এই কথাও কেউ তোলার সাহস পাবে না। অন্যদিকে কৃষক আন্দোলনে কৃষকদের ওপর গুলি চালানোর কথাও আলোচনা হবে না, ইভিএম নিয়ে যে কথা উঠছে, সে কথাও আড়ালে চলে যাবে। 

তৃণমূলও অত্যন্ত সুচতুরভাবে এই গোটা বিষয়টা সামলানোর চেষ্টা করেছে এবং আগামীতেও করার চেষ্টা করবে। তাই পুলিশের পক্ষ থেকে আপাতত এই গ্রেফতারির পরে শেখ সাজাহানকে যে ১০ দিনের পুলিশি হেফাজত চাওয়া হয়েছে, তাও অত্যন্ত সুপরিকল্পিত। ইতিমধ্যেই তৃণমূল দল তাকে ৬ বছরের জন্য সাসপেন্ড করেছে। মোদীজী যতই তাঁর জনসভায় গর্জন করুন না কেন, বেশি কিছু আপাতত আর বলতে পারবেন না। এরপরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হয়তো নিজে সন্দেশখালি যাবেন মানুষের ক্ষোভ বুঝতে এবং পরিস্থিতি সামাল দিতে। আগামী কিছুদিনের মধ্যেই গোটা বিষয়টা হয়তো থিতিয়ে যাবে এবং নির্বাচনের দামামা বেজে উঠবে। মানুষের নজর অন্যদিকে ঘুরে যাবে। আক্ষরিক অর্থেই খেলা শুরুর আগেই খেলা শেষ। 

তবে যে অপ্রিয় কথাগুলো এ ক্ষেত্রে না বললেই নয়, সেগুলো আমাদের মতো নাগরিক সমাজের মানুষদের বলেই যেতে হবে। যে বিজেপি নারী নির্যাতন নিয়ে এত চিন্তিত দেখাতে চাইছে, তাদের কি কোনও নৈতিক জায়গা আছে এ নিয়ে কথা বলার? যে উত্তরপ্রদেশ, যে মণিপুর, যে হরিয়ানা যে মধ্যপ্রদেশে তাদের ডবল ইঞ্জিন সরকার আছে, সেই রাজ্যে নারী নির্যাতন হলে সেখানকার সরকার কি অভিযুক্তদের শাস্তির জন্যে সোচ্চার হয়, নাকি তারা ধর্ষক বা হেনস্থাকারীদের পক্ষে দাঁড়ায়? উন্নাও, হাথরাস কিংবা মণিপুরের ঘটনায় কতবার প্রধানমন্ত্রী সেই জায়গায় ছুটে গেছেন, কতবার তাঁর ‘মন কি বাত’ অনুষ্ঠানে দেশের সেরা কুস্তিগীরদের যৌন হেনস্থাকারীদের শাস্তি দেওয়ার কথা বলেছেন? এখানে এসে বাংলার মহিলাদের জন্য কুম্ভীরাশ্রু ফেলা আর প্রকৃতপক্ষে ব্রিজভুষণ শরণ সিং'দের নতুন সংসদ ভবনে পাশে বসানো কি একই সঙ্গে চলতে পারে? অবশ্য, সন্দেশখালিতে যে অভিযোগগুলি জমা পড়েছে তা মূলত জমি দখল, বকেয়া পাওনা, জমির লিজ নিয়ে পয়সা না দেওয়া, জোরজুলুম এইসব। নারী নির্যাতনের অভিযোগ দুটি কি তিনটি।

সর্বোপরি, এ প্রশ্নটাও তুলতে হবে, কেন বার বার গণমাধ্যমের সাংবাদিক ও গণ-আন্দোলনের কর্মীদের সন্দেশখালি ঘটনায় গ্রেফতার করা হচ্ছে? আজই একজন সাংবাদিকের বাড়িতে পুলিশ চড়াও হয়েছিল বলে খবর ও দু-তিনজন গণ-আন্দোলনের কর্মীদের গ্রেফতার করা হয়েছে। সন্দেশখালির গণপ্রতিবাদকে মান্যতা দিলে এ কাজ ঘোরতর অন্যায়। তবে এটাও খুব আশ্চর্যের ঘটনা, বিভিন্ন গণমাধ্যম যখন সাংবাদিকদের গ্রেফতারির ব্যাপারে সোচ্চার তখন তারা আবার অন্য একটি গণমাধ্যমের এক সম্পাদককে ইডি মাসের পর মাস গ্রেফতার করে রাখলেও সে ব্যাপারে একেবারে নীরব। এই বিচ্ছিন্নতাই গণতন্ত্রের পরিসরকে ক্ষুণ্ণ করে। আশাকরি, সন্দেশখালি এক নতুন সংহতির শিক্ষা দেবে।

  

Wednesday, 28 February 2024

'চিটঠি আয়ি হ্যায়'

অউর আহিস্তা... সাক্ষী উধাস

অমৃতা ঘোষাল


(১৭ মে ১৯৫১ - ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪)


"और आहिस्ता कीजिये बातें

धड़कनें कोई सुन रहा होगा

लब्ज़ गिरने ना पाये होंठों से

वक़्त के हाथ इनको चुन लेंगे"


তখন আমার সদ্য দুই বিনুনি ছেড়ে শ্যাম্পু করা খোলা চুলে কোচিং-এ যাওয়ার বয়স। ব্যাস, প্রেমে পড়লাম টুপ্ করে। একদিন সাইকেলকে সাক্ষী রেখে বাল্যপ্রেমিক গেয়ে উঠল-- "অউর আহিস্তা, কিজিয়ে বাতে"...; উৎসাহ ভরা বুকে, লজ্জামাখা চোখে ঘরে ফিরে টিভিতে ওই গানটাই শুনেছিলাম। অমনি 'পুলক মুকুল অবলম্ব' ব্যাপার। পঙ্কজ উধাসের কণ্ঠের সঙ্গে ওটাই আমার প্রথম পরিচয়।

গজ়লের দুনিয়ায় এক উজ্জ্বল নক্ষত্র তিনি। নির্দোষ প্রশংসা, ইন্দ্রিয়াতীত প্রেম- সবটাই ধরা থাকত তাঁর গানে। আমরা কয়েকজন যারা নিতান্তই বোকাসোকা বলে প্লেটনিক প্রেমে বিশ্বাস রাখি, তাদের কাছে পঙ্কজ উধাসের গানের একটা আলাদা আবেদন ছিল। স্মৃতি-সত্তা-ভবিষ্যৎ মিলে যেন একটা মায়াবী আবরণ তৈরি করে দিত সেই সংগীত। একক রাগ-রাগিনীর লীলা নয়, অথচ বিভিন্ন ঠাট ছুঁয়ে চলেছে। গোঁড়া সংগীতবেত্তারা একে লঘু সংগীত বলতেই পারেন। কিন্তু যা হৃদয়কে খোঁড়ে, তাকে কি আর লঘু বলা চলে? গজ়ল আনন্দে কাঁদায়, কাঁদলে এক অনন্য তৃপ্তি বুকের কানায় টলটল করতে থাকে। গলা ছেড়ে বলতে ইচ্ছে করে, 'আমাকে অনুভব করো।'

গুজরাটের রাজকোটের কাছেই চরখাদি গ্রামের এক ঐতিহ্যবাহী জ়মিনদার পরিবারে তাঁর জন্ম। কেশুভাই উধাস ও জিতুবেন উধাসের তিন পুত্রের মধ্যে পঙ্কজ কনিষ্ঠতম। পিতা কেশুভাই নাকি প্ৰখ্যাত বীণাবাদক আব্দুল করিম খানের কাছে দিলরুবা বাদ্যটি বাজানোর প্রশিক্ষণ নিতেন। পুত্রদের সংগীতের প্রতি আগ্রহ দেখে তাদের রাজকোট সংগীত একাডেমিতে ভর্তি করেন পিতা। প্রথমে তবলার প্রশিক্ষণ নিতে আরম্ভ করেন পঙ্কজ, ক্রমশ ধ্রুপদী সংগীতের প্রতি তাঁর গভীর অনুরাগ জন্মায়। তাঁকে ক্লাসিক সংগীতরীতির তালিম দিতেন স্বয়ং গোলাম কাদের খান। এরপর গোয়ালিওর ঘরানায় সংগীতকে আত্মস্থ করেন মাস্টার নভরঙ্গ নাগপূরকরের কাছে। স্মর্তব্য যে, ওস্তাদ আমন আলী খানের শিষ্য নভরঙ্গ ছিলেন ভেন্ডিবাজার ঘরানার কিংবদন্তী শিল্পী। সুতরাং, তাঁর শিষ্য পঙ্কজের গায়কী শৈলী যে কালজয়ী হবে, তা বলাই বাহুল্য।

কয়েক বছর পর তবলা ও কণ্ঠসংগীতের মেলবন্ধনকে গভীরভাবে উপলব্ধি করার জন্যে রাজকোটেই সংগীত-নাট্য একাডেমিতে যোগ দেন পঙ্কজ। সমান্তরালে উইলসন কলেজ ও মুম্বাইয়ের সেন্ট জেভিয়র্স কলেজে স্নাতক পাঠক্রমও চালিয়ে যান। এরপর 'কামনা' (১৯৭২) ছবিতে নক্শ-এর লেখা আর ঊষা খান্নার সুরারোপিত গান গেয়ে রীতিমতো সকলের নজর কাড়েন। এবার গজ়লকে যথাযথ ভাবে উপলব্ধির জন্যে উর্দু শিখতে আরম্ভ করেন। কেরিয়ার হিসেবে গজ়লের ক্ষেত্রকেই বেছে নেন পঙ্কজ। এরপর বিদেশে বেশ কিছু মাস থেকে ভারতে ফিরে আসেন। আর তাঁকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। হিন্দি ছবির প্লেব্যাক গায়ক হিসেবে তিনি যেমন সার্থকতা পান, তেমনই তাঁর গানের অ্যালবামগুলোও দুর্দান্ত জনপ্রিয় হয়।

গজ়লকে যদি কেউ ওড (ode) ভাবেন, তাহলে তার সার্থক উদাহরণ পঙ্কজের 'চান্দি জ্যায়সা রঙ হ্যায় তেরা /সোনে জ্যায়সে বাল'...

"चाँदी जैसा रंग है तेरा सोने जैसे बाल

एक तूही धनवान है गोरी बाकी सब कंगाल"

উঁহু, এখানে নানা -ism-পন্থীরা আপত্তিকর কিংবা বৈষম্যমূলক কিছু খুঁজবেন না। আসলে ভালোবাসার মানুষ যে সর্বদাই অন্তর-দৃষ্টিতে সর্বোত্তম। দেহ আর মন সেখানে ওতপ্রোত জড়িত। আবার গোঁড়া বিশেষজ্ঞরা বিরক্ত হবেন। গজ়লের উৎসে যদি সুফিয়ানার ভূমিকা থাকে তবে দেহবাদী ইতিকথা কেন? আসলে রূপের আধারে রূপাতীতকে পরিবেশন করাই তো শিল্পীর লক্ষ্য।

"मयख़ाने से, शराब से, साक़ी से, जाम से

 अपनी तो ज़िंदगी शुरू होती है शाम से"

অ্যালকোহলিজ়মকে প্রমোট করছেন-- এরকম অভিযোগও তাঁর দিকে ধেয়ে এসেছে। আসলে গজ়লে সুরা-সাকী কিংবা পানপাত্র- এ সমস্তই একটা রূপক মাত্র। আসল অন্বিষ্ট হল প্রেম কিংবা আত্মা! তাই নারীদেহ কিংবা মদ্যের অনুষঙ্গ এখানে ইরোটিক প্রেমকে আভাসিত করেনি, বরং ফুটিয়ে তুলেছে হৃদয়ের স্নেহ-সবুজ অনুভূতিটুকু।

এবার ১৯৮৬। মুক্তি পেল সঞ্জয় দত্ত অভিনীত 'নাম' ছবিটি। দেশ-দেশান্তরে ছড়িয়ে পড়ল সেই অতুলনীয় কন্ঠ --

"चिट्ठी आई है आई है चिट्ठी आयी है

चिट्ठी है वतन से चिट्ठी आयी है

बड़े दिनों के बाद

हम बेवतनो को याद

वतन की मिटटी आई है"

অবাক লাগে শুনতে যে, এই চিরন্তন গানটিই প্রাথমিকভাবে গাইতে রাজি হননি পঙ্কজ। ছবির প্রযোজক রাজেন্দ্র কুমার, পরিচালক মহেশ ভট্ট আর কাহিনিকার সেলিম খান সাহেবের পরিকল্পনা অনুযায়ী এই গানের জন্যে একেবারে নিখুঁত ছিলেন পঙ্কজ। তাঁরা শুধু চেয়েছিলেন গায়কের একটা লাইভ পারফরমেন্স থাক। ভুল বুঝেছিলেন পঙ্কজ। ভেবেছিলেন, গানের পথ থেকে সরিয়ে তাঁকে এবার হয়তো বা অভিনয় জগতে নামানোর কৌশল অবলম্বন করা হচ্ছে। তাই ছবি-নির্মাতাদের প্রস্তাবে প্রথমে কোনও উত্তরই দিতে চাননি তিনি। এই আচরণে ছবির প্রযোজক-পরিচালক খুবই রুষ্ট হন। পরে পঙ্কজকে স্পষ্ট করে জানানো হয় যে, তাঁকে তাঁর নিজস্ব পরিচয়েই ছবিতে দেখানো হবে, শুধু গানটুকুর স্বার্থে। পঙ্কজ তখন বোঝেন, তাঁকে অভিনয় করতে হবে না, শুধু ক্যামেরার সামনে নিজস্ব পরিচয়ে গান গাইতে হবে। প্রবাসীর হৃদয় জুড়ে বাজতে থাকে এক অজানা চিঠির অনুরণন। কাউকে চিঠি পাঠানোর কিংবা কারও চিঠি পাওয়ার আর্তি। হৃদয় থেকে এক একটা শব্দ খসে যেখানে প্রিয়জনের কাছে পৌঁছে যায়। পঙ্কজ উধাসের কন্ঠ আর দর্শকদের কান্না এক স্রোতে মিশে গেল! হিন্দি ছবির গানের জগতে এ স্রোত এক নতুন অভিঘাত নিয়ে এল। এই অভিঘাত কিছুমাত্র কর্কশ নয়, তা মসৃণ আর মর্মস্পর্শী।

এই উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব ২০০৬-এ তৎকালীন রাষ্ট্রপতি এ পি জে আব্দুল কালামের হাত থেকে গ্রহণ করেছিলেন পদ্মশ্রী। দীর্ঘদিন ধরে অগ্ন্যাশয়ের ক্যান্সারে আক্রান্ত পঙ্কজ কর্কট ও থ্যালাসেমিয়া  রোগাক্রান্ত শিশুদের চিকিৎসার জন্যে যথাসাধ্য সাহায্য করেছেন। এছাড়াও দেশে-বিদেশে বহু সম্মান-পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। সে তালিকা বড় দীর্ঘ। তবে তাঁর জীবনের প্রথম পুরস্কারটি কিন্তু গজ়লের জন্যে নয়। ভারত-চীন যুদ্ধের সময়ে 'অ্যায় মেরে ওয়াতন কে লোগো' গেয়ে এক শ্রোতার থেকে ৫১ টাকা উপহার পেয়েছিলেন তিনি। 

মুম্বাইয়ের ব্রিচ ক্যান্ডি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। স্ত্রী ফারিদা উধাস, কন্যা নায়াব ও রেভা আর দুই দাদা নির্মল আর মানহর উধাসের কান্নার চেয়েও অসীম সত্য কিছু আছে। বিপুল সংখ্যক গজ়ল-অনুরাগী মানুষ আছেন, যাঁদের হৃৎকমলে চিরকাল মহব্বতকে জাগিয়ে রাখবেন পঙ্কজ। তাই 'চিটঠি আয়ি হ্যায়'-এর বিরহ-মহব্বতে সিক্ত লাইনগুলো স্মরণ করে তাঁকে প্রণিধান জানানো যাক -

"तेरे बिन जब आई दीवाली

दीप नहीं दिल जले हैं खाली

तेरे बिन जब आई होली

पिचकारी से छूटी गोली"


Saturday, 24 February 2024

ল্যুই বুনুয়েল ১২৫

কেন বুনুয়েল এখনও টানে

উত্তান বন্দ্যোপাধ্যায়


(২২ ফেব্রুয়ারি ১৯০০ - ২৯ জুলাই ১৯৮৩)

ল্যুই বুনুয়েল পা দিলেন ১২৫'এ। তিনি স্পেনে জন্মগ্রহণ করলেও নিজেকে মনে করতেন একজন বিশ্বনাগরিক ও মানবতাবাদী। তাঁর শিল্পের নৈপুণ্য যে কোনও চলচ্চিত্রের ছাত্রছাত্রীদের কাছে শেখার। বুনুয়েল আমেরিকায় গিয়েছিলেন কিন্তু হলিউডের দাসত্ব করেননি। প্রচুর অফার পেয়েছিলেন কিন্তু হলিউডের হয়ে একটাও ছবি বানাননি। তাঁর প্রতিবাদ ছিল নীরব অথচ অসাধারণ অন্তর্ঘাতী। 

তাঁর শেষ চারটি ছবি: ১) বেল দ্য জ্যুঁর ২) ডিসক্রিট চার্ম অফ দ্য বুর্জোয়া ৩) দ্যাট অবস্কিওর অবজেক্ট অফ ডিজায়ার ৪) ফ্যানটম অফ্ লিবার্টিজ। ছবিগুলো দেখলে মনে হবে, ৫০ বছর এগিয়ে উনি ছবি করেছেন। পরাবাস্তববাদী স্পেনীয় শিল্পী এল সালভাদোর দালিকে নিয়ে বুনুয়েল সম্ভবত প্রথম ছবি করেছিলেন লাঁ শিয়ে আঁন্দালু (অ্যান আন্দালেশিয়ান ডগ)- এই ছবিতে তিনি স্যুররিয়ালিজম বা পরাবাস্তবতাবোধের স্বাক্ষর প্রথম থেকেই রেখেছেন। কিন্তু শেষ চারটে ছবি নিয়ে ভুবন-রাজনীতির সব কিছুরই যেন ব্লুপ্রিন্ট রাখা আছে এক প্রকাণ্ড ক্ষমতায়নের কাছে- সে খ্রিশ্চানিটিই হোক কিংবা পরাক্রমশালী আন্তর্জাতিক ক্ষমতা। বিষয়টি বোঝাতে গিয়ে তিনি ফিল্ম ন্যারেটিভ-এর দর্শনটাকেই পাল্টাতে শুরু করেন, যেখানে ছবি দেখতে দেখতে মানুষ অন্যরকম ভাবে ভাববেই। 

ভাবুন, 'বেল দ্য জুর'এ বুনুয়েল দেখাচ্ছেন যে একটি বাচ্চা ছেলে খেলার মাঠে বিকেলে খেলছে, ছেলেটির গভর্নেস দূরে একটি লোকের সঙ্গে শৌখিন আলাপচারিতায় মত্ত। এক বয়স্ক প্রৌঢ় মানুষ সুযোগ বুঝে বাচ্চাটির কাছে আসে- সে বাচ্চাটির হয়তো দাদুর বয়সী- বাচ্চাটিকে কত কত অ্যাডাল্ট ছবি দেখাচ্ছে। ছবিগুলো কিন্তু ক্যামেরায় দেখা যাচ্ছে না। ক্যামেরায় দেখা যাচ্ছে এক বয়স্ক ভাম, তার মুখের আদলে যেন এক বন্য আনন্দ যে সে একটা শিশুকে নষ্ট করছে। শিশুটিও যেন নতুন অজানা জানায় কত খুশি। 

কাট্ করল ক্যামেরা।

পরের দিন প্যারিসের মতো আধুনিক শহরের অ্যাপার্টমেন্টে এক বিপুল ঘরে বাচ্চাটির মায়ের গজগজ মেজাজ, স্বামীর দিকে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে বলছে, 'ছেলে কী করছে খবর রাখো? দেখ, ছেলের কোটের পকেট থেকে অত্যন্ত আপত্তিকর এই ছবিগুলো পেলাম।' এই বলে মহিলাটি তার স্বামীকে একটার পর একটা ছবি টেবিলের উপর ফেলে দেখাচ্ছে। এইবার প্রথম কিন্তু ক্যামেরাতে দেখা যাচ্ছে সব ছবিগুলি। কোনওটা তাজমহলের ছবি, কোনওটা নায়াগ্রা ফলসের, কোনওটা সেন্ট পিটার্সবুর্গ চার্চের ছবি, কোনওটা চীনের প্রাচীরের, আবার কোনওটা বা ফ্রান্সের প্যারিস শহরের আইফেল টাওয়ার। 

এই যে ভিশ্যুয়াল ইমেজের শক, এই যে প্রচলিত ন্যারেটিভকে চাবকে দেওয়া- এ বুনুয়েলের আগে কেউ করেনি। 

'ডিসক্রিট চার্ম অফ্ দ্য বুর্জোয়া' ছবিতে একটা লোক একটা হোটেলের করিডোরে ঢুকে হাল্কা করে কী যেন বলল। দৃশ্যকল্পনায় মনে হবে যেন লোকটা হোটেলের কর্মচারীটিকে জিজ্ঞেস করছে, খুব জোর চেপেছে, বাথরুমটা কোথায়? উত্তরে লোকটা হাত তুলে দেখিয়ে দিল, 'ওইদিকে'। দেখা গেল, স্যুইং ডোর থেকে একটা লোক বেরিয়ে এল, এবার সে ঢুকল। ঘরটি ছোট। দরজা বন্ধ করে দিল। দেওয়ালে সাঁটা আছে একটা টেবিল। টেবিলটাকে মেঝের উপর প্লেস করল, তারপর দেওয়ালের ভিতরে একটা তাক বা প্রকোষ্ঠ থেকে একটা আপেল নামাল। একটা ফোল্ডিং চেয়ারে বসল। টেবিলে রাখল আপেলটা। তারপর আপেলটা কামড়াতে লাগল। এই কাজটির জন্যই সে খুব পার্সোনালি ও কনফিডেন্সিয়ালি এই ঘরটাতেই ঢুকতে চাইছিল।

'দ্যাট অবস্কিওর অবজেক্ট অফ্ ডিজায়ার'-এ একটা হলের বড় গোল টেবিলে সব রাষ্ট্র নেতা, সবাই পুরুষ, বসে আছেন ও ডিনার করছেন। কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে টুকরো টুকরো- সন্ত্রাসবাদ, যুদ্ধ, নিউক্লিয়র বোমা ইত্যাদি। একটু পরে সম্প্রতি কেউ মারা গেছে বলে সবাই উঠে দাঁড়িয়ে এক মিনিটের নীরবতা পালন শুরু করলেন। এই সময়ে কোনও ডায়লগ নেই। সবাই দণ্ডায়মান ও চুপ। ক্যামেরা উপর-নিচ, এপাশ-ওপাশ থেকে দৃশ্যের ছবিগুলো তুলে নিচ্ছে। ক্যামেরার হাই-অ্যাঙ্গেল টপ শট-এ প্যান করতে করতে দেখা যাচ্ছে যে এই সমস্ত রাষ্ট্রীয় দূতেরা যে স্যুট-বুট-টাই পরে আছেন, প্রত্যেকেরই পিছন বা পশ্চাৎদিক একেবারেই অনাবৃত, আন্ডারগারমেন্টও নেই এবং সকলেই বসেছিলেন এক একটা কমোডে। সবাই কমোডে বসেই রাষ্ট্রসংঘের মতো একটা প্ল্যাটফর্মে ডিনার সারছেন আর মিটিং করছেন।

শুধু পরাবাস্তবতাবোধই নয়, আধুনিক কদর্য রাজনীতিকেও বুনুয়েল ছবিতে ভিজ্যুয়াল রিডাকশনিস্ট বা খণ্ডিত ন্যারেটিভের রাজনীতি দিয়েই বোঝাতেন। ঋত্বিক ঘটক বুনুয়েল'এর এই ভাবটা নিজের ছবিগুলোতে সঞ্চারিত করেছেন। হিন্দু দর্শনের ভিতরে রাম ও সীতাকে জনগণের প্রতিবাদের ভাষায় রূপান্তর ঘটিয়েছিলেন তাঁর 'নাগরিক', 'সুবর্ণরেখা', 'তিতাস একটি নদীর নাম' ছবিতে। 

বুনুয়েল তাই পৃথিবীর ১০ জন শ্রেষ্ঠ চিত্র পরিচালকদের মধ্যে একজন, পৃথিবীর ৫ জন সেরা পরিচালকদের মধ্যে একজন এবং সেরা ৩ জন পরিচালকদের মধ্যে অন্যতম।


Tuesday, 20 February 2024

আধার যখন আঁধারে

যে কোনওদিন আপনার নাগরিকত্ব বিপন্ন

সুমন সেনগুপ্ত



চারিদিকে শোরগোল পড়ে গেছে। আধার কর্তৃপক্ষ, অর্থাৎ, ইউআইডিএআই'এর কাছ থেকে চিঠি পাচ্ছেন অনেকেই, তাঁদের আধার ডি-অ্যাক্টিভেটেড বা অচল করে দেওয়া হয়েছে। চিঠিতে পরিষ্কার বলা হয়েছে, যেহেতু এই মানুষেরা ভারতে বসবাস করার শর্ত পূরণ করতে পারেননি, তাই তাঁদের ক্ষেত্রে এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এই চিঠি যাঁরা পেয়েছেন, তাঁরা এবার অকূল পাথারে পড়েছেন! কোথায় যাবেন, কার কাছে গেলে এর প্রতিকার পাওয়া যাবে, তাঁরা বুঝতেই পারছেন না। রাজনীতির মানুষজনও মাঠে নেমে পড়েছেন। কেন্দ্রের শাসক দলের বাংলার নেতারা তিনজন তিন রকম বয়ান দিয়েছেন, কারও বয়ানের সঙ্গে কারও মিল নেই। 

বিজেপি'র রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার বলেছেন, তাঁর সঙ্গে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কথা হয়েছে, কারও চিন্তার কোনও কারণ নেই, সবার আধার আবার চালু হয়ে যাবে। কেন্দ্রীয় জাহাজ প্রতিমন্ত্রী শান্তনু ঠাকুর আরও এক ধাপ এগিয়ে বলেছেন, তাঁর ব্যক্তিগত ইমেইলে এবং ফোন নম্বরে যেন অভিযোগ জানানো হয়; তিনি একটি অভিযোগ জানানোর ফর্ম ছাপিয়েছেন, সেই ফর্ম ভর্তি করলেই সবার আধার নম্বর চালু হয়ে যাবে। বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী, যেমন সবেতেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ষড়যন্ত্র দেখতে পান, এবারও সেটাই দেখেছেন। তিনি বলেছেন, কোনও আধার কার্ড বাতিল হয়নি, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নাকি ইউআইডিএআই'এর রাঁচি অফিসের সঙ্গে যোগসাজশে এই চিঠি পাঠিয়েছেন। বলাই বাহুল্য, আদ্যন্ত মিথ্যে বলছেন বিরোধী দলনেতা, সারা দেশে এই ধরনের চিঠি অনেকেই পেয়েছেন। ২০২০ সালেই বেঙ্গালুরুর দু’জন যুবক এই ধরনের চিঠি পান, তাঁদের শুনানির জন্য হাজির হতে বলা হয়। ঐ জায়গায় গিয়ে তাঁরা দেখেন, তাঁদের মতো অনেকেই এই চিঠি পেয়েছিলেন। পরে হইচই হওয়াতে তখনকার মতো ইউআইডিএআই এই চিঠি পাঠানো বন্ধ করে।  

বাংলার বিজেপি ছাড়া 'গণশক্তি' তাদের কাগজে বড় বড় হেডলাইন করেছে- মানুষকে ভয় পাওয়ানোর লক্ষ্যে তৃণমূল ও বিজেপি মিলেমিশে এই কাজটা করেছে। অর্থাৎ, তাদের সুরের সঙ্গে শুভেন্দু অধিকারীর সুরের খুব বেশি তফাত নেই। 

কিন্তু বিষয়টা কি এতটাই সরল এবং সোজা? বাংলার মুখ্যমন্ত্রী এই বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখেছেন এবং বলেছেন যে এই ধরনের কাজ অত্যন্ত অনৈতিক; এই ভাবে মানুষের আধার অচল করে দিলে সমস্যা হবে। তিনি এও বলেছেন, প্রয়োজনে তিনি বাংলার জন্য অন্য একটি কার্ডের ব্যবস্থা করছেন যাতে বাংলা কিংবা দেশের যে প্রকল্পগুলো চলছে তা থেকে কেউ বঞ্চিত না হন। এই কথা শুনে বিজেপি বলেছে, একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোতে এটা করা যায় নাকি? নানান তর্ক বিতর্ক চলছে, মাঝখান থেকে যে মানুষেরা এই আধার নিষ্ক্রিয় হওয়ার চিঠি পেয়েছেন তাঁরা কী করবেন বুঝতে পারছেন না। 

২০০৯ সালে কংগ্রেস আধার এনে বলেছিল, যাঁদের কোনও পরিচয়পত্র নেই তাঁদের জন্য একটি পরিচয়পত্র তৈরি করার উদ্দেশ্যেই আধার আনা হল। ২০১৪ সালে বিজেপি ক্ষমতায় এসে  আধারকে আইনে পরিণত করে। সেই আইনের মাধ্যমেই তারা দেশের প্রায় সমস্ত নাগরিককে বলে, আধার কার্ড তৈরি করা বাধ্যতামূলক এবং তার জন্য দুটি প্রাথমিক পরিচয়পত্র, হাতের ছাপ, চোখের মণি ও মুখের ছবি তুলে আধার পেতে হবে। কংগ্রেসের আমলে যা ছিল একটি স্বেচ্ছামূলক প্রকল্প, বিজেপি এসে তাকে আইনের বলে বাধ্যতামূলক করে সরকারি সমস্ত নথির সঙ্গে যুক্ত করার প্রক্রিয়া নিল। এই মুহূর্তে একজন মানুষের কোনও পরিচয় নেই, তিনি এখন শুধুই একটা সংখ্যা। রবীন্দ্রনাথ তাঁর 'রক্তকরবী' নাটকে যেভাবে ৪৭ফ কিংবা ৬৯ঙ এই পরিচিতিতে খনি শ্রমিকদের দেখিয়েছিলেন, এও অনেকটা সেইরকম। এখান থেকেই আসল খেলার সূত্রপাত- একটি মানুষকে মেরে ফেলা কঠিন, কিন্তু একটি সংখ্যাকে নিষ্ক্রিয় করা অত্যন্ত সহজ। এই পদ্ধতিকেই এডওয়ার্ড স্নোডেন বলেছিলেন, সিভিল ডেথ অথবা নাগরিক মৃত্যু। এই আধার নিষ্ক্রিয়করণ সেই সিভিল ডেথ।


 

আজ নাগরিকদের আধার যে নিষ্ক্রিয় করা হচ্ছে, তার পিছনে কারণ কী? যাঁরা চিঠি পেয়েছেন তাঁদের লেখা হয়েছে, নাগরিকত্বের শর্ত পূরণ করা হয়নি বলে আধার নিষ্ক্রিয় করা হয়েছে। কিন্তু একজন নাগরিক যিনি ভোট দিয়ে সরকারকে নির্বাচিত করেছেন, তাঁর আধার যদি নিষ্ক্রিয় করা হয়, তাহলে সেই নির্বাচিত সরকারের বৈধতা নিয়েই তো প্রশ্ন উঠে যাবে! আধার আইনের ২৮এ ধারায় বলা আছে, যদি কোনও নাগরিকের এই দেশে থাকার শর্ত দেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের মনোমত না হয়, তাহলে ইউআইডিএআই আধারকে নিষ্ক্রিয় করে দিতে পারে। সুতরাং, বিজেপি নেতারা যতই বলুন না কেন কাল থেকে আবার আধার চালু হয়ে যাবে, তা সম্পূর্ণ মিথ্যা। 

আধার আপডেট করা হয়েছে ২০১৫ সালে আর সেটাই এনপিআর। যেদিন সংসদে নাগরিকত্ব আইন পাশ হয়েছিল সেদিনই জানা ছিল এনআরসি হবে। পাশাপাশি  এনপিআর যে এনআরসি'র প্রথম ধাপ, তাও পরিষ্কার বলা আছে। আজ যে বিভিন্ন মানুষের আধার নিষ্ক্রিয় করা হচ্ছে, তা এনআরসি’র অঙ্গ। অসমের উদাহরণ যদি দেখা যায়, এখনও ঐ রাজ্যে প্রায় ১৭ লক্ষ মানুষের আধার নিষ্ক্রিয় হয়ে আছে। এখনও যখন সে সমস্যা মেটেনি, তখন এখানকার বিজেপি নেতারা বলে চলেছেন স্বরাষ্ট্র দফতরের সঙ্গে কথা বলে এই আধার সমস্যা মিটিয়ে দেবেন। কোনও নেতার বক্তব্যে ভুলে না গিয়ে উল্টে তাঁদের প্রশ্ন করা উচিত, যে সরকার আমাদের ভোটে নির্বাচিত, সেই সরকার কি আমাদেরকেই বে-নাগরিক করে দিতে পারে?


 

বাংলার মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, বাংলায় বিকল্প একটা কার্ড তৈরি করে সমস্যার সমাধান করবেন। কিন্তু উনি যদি বলতেন, কোনও আধারের দরকার নেই, যা যা পরিচয়পত্র আছে তা দিয়েই চলবে, তাহলে দু' হাত তুলে তাঁকে সমর্থন করা যেত। কিন্তু তিনি আধার বন্ধ করার কথা বলেননি। বললে হয়তো সারা দেশে আধার বিরোধী আন্দোলনকে তিনি একাই নেতৃত্ব দিতে পারতেন। ঘটনাচক্রে আরও একটা কথা বলা উচিত, কংগ্রেস কিন্তু এখনও এই আধার নিষ্ক্রিয়করণ নিয়ে একটা কথাও বলেনি। তাহলে কি তারা ভাবছে, তারা যদি ক্ষমতায় ফিরে আসে আবার সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে! নাকি তারাও বিজেপির মতো একই কাজ করবে? এটা না বুঝলে কিন্তু বিজেপিকে কোনওদিন ঠেকানো সম্ভব নয়। 

বিজেপি কিন্তু আধারকে অন্যভাবে ব্যবহার করছে। তারা নাগরিকদের মধ্যে একটা ভীতির সঞ্চার করতে চাইছে, বিশেষত সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলিতে। বাঙালিদের প্রকারান্তরে ভয় দেখানো, যখন তখন স্রেফ ভাষার কারণে তাদের 'বাংলাদেশি বিদেশি' বলে যত্রতত্র দাগিয়ে দেওয়া হবে। এই ভয় যদি কার্যকরী হয়, তখন আক্রান্ত বাঙালিরা বিজেপি'র নেতাদের কাছে গিয়ে সিএএ মারফত নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্য হন্যে হয়ে দৌড়বে। হয়তো আগামী লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি এই রণকৌশল নিয়েছে। রাজনৈতিক ভাবে যাঁরা বিজেপি বিরোধী, তাঁরা যদি এই সহজ সত্যটা বুঝে আন্দোলন না করতে পারেন, তাহলে আগামী দিনে কিন্তু সারা দেশের সমস্ত নাগরিকদের অসুবিধায় পড়তে হবে। নাগরিক সমাজও যদি এই বিষয় নিয়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতার প্রচার এবং আধার বন্ধ করার আন্দোলন না করে, তাহলে বড় বিপদে পড়তে চলেছি আমরা সবাই। একদিন কিন্তু আমাদের ভবিতব্য রবীন্দ্রনাথের 'রক্তকরবী'র খনি শ্রমিকদের মতো হবে। 

আজ যাঁরা উদাসীন হয়ে আছেন, তাঁদের মধ্যেও কেউ আধারচ্যুত হতে পারেন যে কোনও দিন। সবার আগে যেটা করণীয়, ব্যাঙ্কের থেকে আধারকে বিযুক্ত করার আন্দোলন। সেটা তো শুরু করা যায় এখনই। যাঁরা ভাবছেন এই বিষয়ে ভয় পাওয়ার কিছু নেই, এটা তৃণমূল এবং বিজেপির চক্রান্ত, তাঁরা আরও একবার ভেবে দেখুন, এই বিষয়ে আন্দোলন সংগঠিত করতে পারলে কিন্তু আখেরে তাঁদেরই সাংগঠনিক এবং রাজনৈতিক লাভ হতে পারে।


Thursday, 15 February 2024

আবারও রাজপথে কৃষকেরা

সরকারের যুদ্ধ ঘোষণা

সোমনাথ গুহ



প্রখ্যাত কৃষি বিজ্ঞানী ও সদ্য মরণোত্তর ভারতরত্ন প্রাপ্ত এমএস স্বামীনাথনের কন্যা মধুরা স্বামীনাথন বিজ্ঞানীদের এক সভায় বলেন, 'যাঁরা এমএসপি'র জন্য আন্দোলন করছেন তাঁরা কৃষক, ক্রিমিনাল নন।' তিনি কৃষকদের দাবি আন্তরিক ভাবে সমাধান করার জন্য তাঁদের কাছে আহ্বান জানান। বাস্তবিকই, সংযুক্ত কিষাণ মোর্চা (অরাজনৈতিক) এবং কিষাণ মজদুর মঞ্চের নেতৃত্বে ‘দিল্লি চলো’ অভিযানের মোকাবিলা করতে কেন্দ্রীয় সরকার ও বিভিন্ন রাজ্যের বিজেপি সরকার অভুতপূর্ব সন্ত্রাস সৃষ্টি করেছে। এই সন্ত্রাস ২০২০-২১'এর সন্ত্রাসকে ছাপিয়ে গেছে। 

কৃষক আন্দোলন নতুন করে শুরু হওয়া শুধু ছিল সময়ের অপেক্ষা মাত্র। কারণ, ২০২১'এর নভেম্বরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী প্রায় পনেরো মাস ধরে চলা কৃষক আন্দোলনের কাছে নতি স্বীকার করে কৃষকদের অধিকাংশ দাবি মেনে নিলেও আজ দু' বছর বাদেও তার কিছুই প্রায় কার্যকর হয়নি। দীর্ঘ প্রতীক্ষায় হয়রান হয়ে অন্নদাতারা নতুন উদ্যমে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। এবার হরিয়ানা সরকার পঞ্জাবের শম্ভু সীমানায় দানবীয় সব বাধা তৈরি করে কৃষকদের দিল্লির সিঙ্ঘু বর্ডার থেকে প্রায় ২০০ কিলোমিটার দূরে আটকে দিয়েছে। ভেবে দেখুন, গতবার এই সিঙ্ঘু বর্ডারেই  হাজারো কৃষক শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা, শাসকের হুমকি, গা-জোয়ারি উপেক্ষা করে সমবেত ছিলেন, কোনও প্রতিকূলতাই তাঁদের টলাতে পারেনি। গতবারও সরকার কাঁটাতারের বেড়া, কংক্রিটের দেওয়াল, বোল্ডার ইত্যাদি দিয়ে এঁদের আটকানোর চেষ্টা করেছিল। কিন্তু এবারে ব্যারিকেডের সংখ্যা ও ঘনত্ব অনেক বেশি। সারি দিয়ে ধাতব দেওয়াল বা কাঁটাতারের বেড়া, হাইওয়েতে সারি দিয়ে গজাল পোঁতা, জানানো হয়েছে প্রয়োজন হলে রাস্তা খুঁড়ে দেওয়া হবে। গতবারের মতো এবারও জলকামান আছে, এর সাথে জুড়েছে রাবার বুলেট, যা কাশ্মীরে লাগামছাড়া ব্যবহারের কারণে কুখ্যাত; ড্রোন থেকে নিক্ষেপিত হচ্ছে কাঁদানে গ্যাস, যা ইজরায়েল কর্তৃক গাজায় ব্যবহার করার কারণে কুখ্যাত। ইতিমধ্যে গোটা পঞ্জাব জুড়ে আজ বেলা ১২টা থেকে কৃষকেরা চার ঘন্টার জন্য রেল রোকো অভিযান করেছেন।

শম্ভু সীমান্ত এখন যুদ্ধক্ষেত্র- সেখানে সন্ধ্যা নামলে যুদ্ধ বিরতি ঘোষণা হয়, মাইলের পর মাইল ইন্টারনেট সংযোগ নেই। পুরো দিল্লি এবং হরিয়ানার বিভিন্ন জেলায় ১৪৪ ধারা জারি হয়েছে। রাজধানীতে কোনও মিছিল, সমাবেশ, ট্র্যাক্টর-ট্রলির প্রবেশ নিষিদ্ধ। এবারও প্রায় লোক-দেখানোর মতো একটা আলোচনা চলছে। তিনজন মন্ত্রী ৮ এবং ১২ ফেব্রুয়ারি কৃষক নেতাদের সাথে আলোচনায় বসেছেন এবং যথারীতি তাঁরা সুষ্ঠু কোনও সমাধান সূত্র দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। আজ আরও একটি বৈঠক চণ্ডীগড়ে বসার কথা। 

সবার অলক্ষ্যে হরিয়ানার গ্রামে-গঞ্জে সঙ্ঘী বাহিনী ছড়িয়ে পড়েছে। বাড়ি বাড়ি গিয়ে তারা স্ত্রী-পুরুষদের হুমকি দিচ্ছে যাতে কেউ আন্দোলনে যোগদান না করেন। এখন একটা নতুন শয়তানি কায়দা শুরু হয়েছে- কেউ প্রতিবাদ করলে তাঁর রুটিরুজি কেড়ে নাও, ঘরবাড়ি ধ্বংস করে দাও। সংখ্যালঘু এলাকায় এটা চালু হয়েছে, কৃষক এলাকাতেও এটা প্রয়োগ করার চেষ্টা হচ্ছে। প্রচার করা হচ্ছে, আন্দোলনে গেলে সরকারি সুযোগ-সুবিধা বন্ধ করে দেওয়া হবে, জমির নথিপত্র বাজেয়াপ্ত হবে ইত্যাদি। সরকারি সম্পত্তি নষ্ট হলে আন্দোলনকারীদের থেকে তার মূল্য আদায় করা হবে। সুদূর ভোপালে কর্নাটকের কিছু কৃষক যাঁরা দিল্লিতে সমাবেশে যোগদান করতে আসছিলেন তাঁদের ট্রেন থেকে নামিয়ে গ্রেফতার করা হয়েছে। আগামী ১৬ তারিখ সংযুক্ত কিষাণ মোর্চার গ্রামীণ ভারত বনধ বানচাল করার জন্য মধ্যপ্রদেশে বিভিন্ন কৃষক সংগঠন ও এনএপিএম'এর কার্যকর্তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে। 

১৯ নভেম্বর ২০২১- প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে নানা প্রতিশ্রুতির মধ্যে এটাও বলেছিলেন যে ফসলের ন্যূনতম মূল্য (বা এমএসপি)'কে আরও অধিক কার্যকর করা হবে। তিনি সমস্ত দাবি খতিয়ে দেখার জন্য একটি কমিটি গঠন করার কথা বলেছিলেন। দীর্ঘ আট মাস কেটে যাওয়ার পর ১২ জুলাই ২০২২ অবশেষে কমিটি গঠিত হয়। কৃষি মন্ত্রক জানায়, বিভিন্ন নির্বাচনের কারণে নির্বাচন কমিশন অনুমতি না দেওয়ায় এবং এসকেএম তাদের প্রতিনিধির নাম জানাতে গড়িমসি করায় এই বিলম্ব। 'ডাউন-টু-আর্থ' পত্রিকা আরটিআই করে জানতে পারে যে উক্ত বিষয়ে উল্লেখ্য আট মাসে মন্ত্রক ও নির্বাচন কমিশনের মধ্যে কোনও ধরনের যোগাযোগ হয়নি। কমিটি গঠন হওয়ার পর এবং সদস্যদের নাম প্রকাশ্যে আসার পর এসকেএম'এর গড়িমসির কারণ পরিষ্কার হয়। কমিটির মোট সদস্য সংখ্যা ২৯, যার মধ্যে ১৮ জন সরকার মনোনীত আধিকারিক। শোনা যায়, বাকি ১১ জনের অধিকাংশ শাসক-ঘনিষ্ঠ লোকজন। এই পরিস্থিতিতে এসকেএম তাঁদের ৩ জন সদস্যের নাম জানানো মুলতুবি রাখে। গত ১৮ মাসে কমিটির ৩৫টি মিটিং হয়েছে, তাতেও কোনও সমাধান সূত্র বেরয়নি। রাজ্যসভায় কংগ্রেসের এক সদস্য যখন এই বিষয় সম্পর্কে জানতে চায়, শাসক দল কোনও উত্তর দিতে অস্বীকার করে। 

ন্যূনতম সহায়ক মূল্য নিয়ে শাসকের এই টালবাহানার দীর্ঘ ইতিহাস একটু দেখে নেওয়া যেতে পারে। এমএসপি’র ওপর স্বামীনাথন কমিটির রিপোর্ট গত ২০০৬ সাল থেকে সংসদে পড়ে আছে। এতে প্রস্তাব আছে যে ফসল উৎপাদনের খরচের ওপর ৫০ শতাংশ যোগ করে এমএসপি নির্ধারণ করা প্রয়োজন। ইউপিএ আমলে এই প্রস্তাব ঠাণ্ডা ঘরে পড়েছিল। ২০১৪ সালে নির্বাচনে বিজেপি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ক্ষমতায় এলেই তারা কমিটির সুপারিশ কার্যকর করবে; এখন রাহুল গান্ধীও একই প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। ২০১৫ সাল থেকে কেন্দ্রীয় সরকার বলে আসছে যে খরচার ওপর ৫০ শতাংশ যোগ করলে তা বিপুল ব্যয়বহুল হয়ে পড়বে। ২০১৭'এ মধ্যপ্রদেশের মন্দাসরে চাষিরা এই দাবিতে লাগাতার আন্দোলন করেন, পুলিশের গুলিতে কয়েক জন মারা যান। 

সাম্প্রতিক সময়ে আমরা দেখেছি, ছত্তিশগড় নির্বাচনে বিজেপি ৩১০০ টাকা ধানের সহায়ক মূল্য দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, অথচ সেই সময়ে সারা দেশে সহায়ক মূল্য ছিল মাত্র ২১৮৩ টাকা। নির্বাচন জেতার জন্য তাঁরা অধিক মূল্য দিতে রাজি হলেও কৃষকদের দাবি তারা মানতে নারাজ। কৃষকদের দাবি, এমএসপি'র মৌখিক প্রতিশ্রুতিকে আইনে লিপিবদ্ধ করতে হবে, অর্থাৎ, সমস্ত মান্ডিতে নির্ধারিত সহায়ক মূল্যই চাষিকে দিতে হবে। কেন তাঁরা এই দাবি করছেন? ফসল কাটার পরে তা প্রায় একই সময়ে সব মান্ডিতে আসে। ফসলের প্রাচুর্যের কারণে দাম পড়ে যায়, চাষি যে কোনও মূল্যে ফসল বিক্রি করতে বাধ্য হয়। এই ধারাবাহিক ক্ষতির কারণে আজ চাষির পিঠ দেওয়ালে ঠেকে গেছে, না হলে সরকারের লাঠি-গুলি খেয়ে, দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে বারবার কেউ দিল্লি অভিযান করে না। 

সরকারের যুক্তি, সমস্ত খাদ্যপণ্যের এমএসপি'র গ্যারান্টি দিতে হলে প্রতি বছর নাকি সরকারকে অতিরিক্ত ৭-১১ লাখ কোটি টাকা ব্যয় করতে হবে। এই অঙ্কের প্রকৃত কোনও হিসাব আজ অবধি সরকারের থেকে পাওয়া যায়নি। যদি ধরেও নেওয়া যায়, কৃষকদের ন্যায্য দাবি মেটানোর জন্য কয়েক লক্ষ কোটি টাকা ব্যয় হবে, তাহলে অন্যান্য ক্ষেত্রে কী হারে সরকারি টাকা তছনছ হচ্ছে সেটার দিকেও নজর দেওয়া প্রয়োজন। ২০১৪-২০২১ ব্যাঙ্কের অনুৎপাদনশীল সম্পদ (এনপিএ) ছিল ৬৬.৫ লক্ষ কোটি টাকার, যার মধ্যে ১৪.৫ লক্ষ কোটি টাকা রাইট অফ করা হয়েছে। এছাড়াও মোদী সরকারের প্রথম আট বছরে বিদেশে ১২ লক্ষ কোটি টাকা পাচার করা হয়েছে। প্রতি বছরের বাজেটে যখন কর্পোরেট ট্যাক্স কমানো হয় কিংবা শিল্প স্থাপন করার জন্য সব দেদার ছাড় দেওয়া হয়, তখন তো সরকার ব্যয়বহুলতার বাহানা তোলে না। 

কৃষকদের অন্যান্য দাবিগুলি হল, ঋণ মকুব, বরিষ্ঠ কৃষকদের জন্য পেনশন, তিন বছর আগের আন্দোলনে শহীদ হওয়া ৭০০ চাষির জন্য ক্ষতিপূরণ, লখিমপুর-খেরির ঘটনায় নিজ পুত্রের জড়িত থাকার কারণে মন্ত্রীসভা থেকে অজয় সিং টেনির পদত্যাগ, কৃষকদের বিরুদ্ধে সমস্ত মামলা তুলে নেওয়া ও এমএনরেগা'য় কাজের দিন ১০০ থেকে বাড়িয়ে দ্বিগুণ করা। প্রবল দমনপীড়ণ সত্ত্বেও কৃষকদের মনোবল তুঙ্গে। রোহতাকে তাঁরা পঞ্জাবের চাষিদের সমর্থনে অবস্থান শুরু করেছেন। পুলিশের লাগাতার হুমকি সত্ত্বেও আশেপাশের গ্রাম থেকে দলে দলে মানুষ এসে সমাবেশ আরও পুষ্ট করছেন। শম্ভু সীমান্তে ঘুড়ি উড়িয়ে, আতশবাজি ফাটিয়ে তাঁরা ড্রোনের মোকাবিলা করছেন। তাঁরা বারবার জানাচ্ছেন তাঁরা ভীত নন। ‘ডর’ বলে তাঁরা কিছু জানেন না। তাঁরা দাবি আদায় করেই ছাড়বেন, নচেৎ আবারও দীর্ঘ সময় ধরে অবস্থান করবেন। 


Tuesday, 13 February 2024

সন্দেশখালি অতঃপর

গুণ্ডারাজের অজুহাতে ধর্মীয় দাঙ্গা নয় 

সুমন সেনগুপ্ত



সন্দেশখালি এই মুহূর্তে বাংলার রাজনীতির মানচিত্রে একটি উল্লেখযোগ্য নাম। 

ঘটনার সূত্রপাত কোথা থেকে তা হয়তো অনেকেই জানেন। রেশন দুর্নীতিতে ইডি'র হাতে গ্রেফতার হওয়া তৃণমূলের দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেতা জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত শেখ সাজাহানের খোঁজে যখন ইডির তদন্তকারী অফিসারের দল এবং বেশ কিছু সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিরা সন্দেশখালি ব্লকে উপস্থিত হন, তখন তাঁদের ওপর আক্রমণ করেন সেই ব্লকের বেশ কিছু মহিলা ও পুরুষ। সেদিন তাঁদের আক্রমণ থেকে বাদ যাননি সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিরাও। উক্ত ঘটনার পর থেকে ইডি'র ভয়ে শেখ সাজাহান নিঁখোজ। বলা হচ্ছে, রাজ্য পুলিশ থেকে শুরু করে দিল্লির তদন্তকারী দলও তার নাগাল পেতে ব্যর্থ।

শেখ সাজাহান নিখোঁজ হওয়ার পরে ওই অঞ্চলে তৃণমূলের পায়ের তলার মাটি নরম হতে থাকে। তারাও চেষ্টা চালায়, সাজাহানের বিকল্প মুখ হিসেবে তারই দুই ঘনিষ্ঠ শিবু হাজরা এবং উত্তম সর্দার সহ অন্যান্য নেতারা যাতে আবার এলাকায় তাঁদের রাজনৈতিক দখলদারি কায়েম করতে পারে। পরিকল্পনা অনুযায়ী, একশো দিনের কাজের বকেয়া এবং কেন্দ্রের বঞ্চনার বিরুদ্ধে সন্দেশখালি থানার সামনে একটি ধর্নামঞ্চ করা হয়। সিদ্ধান্ত হয়, বিভিন্ন ব্লক থেকে মিছিল করে ওই ধর্নামঞ্চে যাওয়া হবে। সেইরকম একটি মিছিলের নেতৃত্বে ছিল শিবু হাজরা এবং উত্তম সর্দার, যারা অঞ্চলের তৃণমূলের ব্লক ও অঞ্চল সভাপতি হওয়ার সুবাদে ইতিমধ্যেই এলাকায় বড় নেতা বলে পরিচিত। শোনা যায়, গ্রামের ভিতর দিয়ে যাওয়ার সময়ে তারা গ্রামবাসীদের হুমকি দেয়। সেই হুমকিতে ভয় না পেয়ে গ্রামের মহিলারা হাতের কাছে দা-বটি-ঝাঁটা যা পেয়েছিলেন তা নিয়ে বেরিয়ে আসেন এবং তৃণমূলের মিছিলকে আক্রমণ করেন। তাঁদের একটাই দাবি, শিবু হাজরা এবং উত্তম সর্দারদের গুন্ডামি তাঁরা আর মানবেন না। বেগতিক দেখে তৃণমূলের ছোট-বড় সব নেতা খেয়াঘাট দিয়ে পালিয়ে যান। 

এখন প্রশ্ন, কী এমন হল যাতে গ্রামবাসীরা এত ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন। শোনা যাচ্ছে, এই শিবু হাজরা এবং উত্তম সর্দার'রা গ্রামবাসীদের থেকে জোর করে জমি লিখিয়ে, নিজেরাই লিজের টাকা নির্দিষ্ট করে বিঘার পর বিঘায় মাছের ভেড়ি গড়ে তোলে। বেশিরভাগ ভেড়িরই মালিক ওই শেখ সাজাহান। এছাড়াও মহিলাদের তরফ থেকে অভিযোগ আসতে থাকে তাঁদের ওপর অশ্লীল আচরণের, তাঁদের ডেকে পাঠিয়ে হুমকি দেওয়া ইত্যাদি। এই সংক্রান্ত বেশ কিছু ভিডিওতে দেখাও যায়, মহিলারা ক্ষোভে ফুঁসছেন। আসলে এই ক্ষোভ দীর্ঘদিনের। অত্যাচারিত হতে হতে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ায় এবং সাজাহান বাহিনীর প্রতাপ একটু স্তিমিত হওয়ায় আজ সাধারণ গ্রামবাসীরা রাস্তায় নেমে এসেছেন এবং প্রতিবাদে সামিল হয়েছেন। তৃণমূল যতই বলুক গ্রামবাসীদের এই রাস্তায় নামার পিছনে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর উস্কানি এবং মদত আছে, তা বলে, আর্থিক ও শারীরিক নিপীড়নের ঘটনা তো আর মিথ্যে হয়ে যায় না। 

এর আগেও রামপুরহাট, বগটুই বা বাংলার অন্যান্য বেশ কিছু গ্রামে তৃণমূলের এই আঞ্চলিক স্তরের নেতাদের দৌরাত্ম্যের অভিযোগ আমাদের কানে এসেছে। আমরা শুনেছি আরাবুল ইসলামদের কথা। একজন শিক্ষিকাকে জগ ছুঁড়ে মারার পরেও সেই সময়ের শিক্ষামন্ত্রী অধুনা জেলে থাকা পার্থ চ্যাটার্জী'র তাঁর পাশে দাঁড়ানোর কথাও আমাদের মনে আছে। কিন্তু গ্রামের সাধারণ মানুষদের এইরকম রাস্তায় নেমে আসার উদাহরণ আমরা আগে হয়তো এই আমলে শুনিনি। সেদিক থেকে দেখতে গেলে, এই আন্দোলন নিশ্চিত একটা অন্য মাত্রা যোগ করেছে বাংলার রাজনীতিতে। ইতিমধ্যে উত্তম সর্দার গ্রেফতার হয়েছে, যদিও শিবু হাজরা ও শেখ সাজাহান এখনও অধরা।

কিছুদিন আগেই রাজ্য বাজেটে লক্ষ্মীর ভাণ্ডারে সাধারণদের জন্যে পাঁচশো টাকা এবং তফসিলী জাতি-উপজাতিদের জন্যে দুশো টাকা বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও শোনা যাচ্ছে, ওই অঞ্চলের মহিলারা এতটাই ক্ষিপ্ত হয়ে আছেন যে তাঁরা নাকি এবার আর তৃণমূলকে ভোট দেবেন না বলে ঠিক করেছেন। অনেকে বলছেন, সন্দেশখালি নাকি দ্বিতীয় নন্দীগ্রাম হতে চলেছে। কিন্তু নন্দীগ্রাম বা সিঙ্গুরের সঙ্গে সন্দেশখালির একটা মৌলিক ফারাক আছে। সিঙ্গুর বা নন্দীগ্রামে সরকার জমি অধিগ্রহণের চেষ্টা করেছিল, আর সন্দেশখালিতে শাসক দলের মদতপুষ্ট দুষ্কৃতীরা এই কাজটি করেছে। যদিও তৃণমূলের ওপরতলার অনেকে যখন বলছেন, এই ধরনের দুষ্কৃতীদের নিয়ন্ত্রণ না করতে পারলে বিজেপির বাড়বাড়ন্ত হবে এবং কথাটা খুব একটা মিথ্যেও নয়, তখন শুধুমাত্র বামেদের ঘাড়ে দোষ চাপালে হবে না। অন্যদিকে, বিজেপি মহল থেকে এই আন্দোলনে সাম্প্রদায়িক মাত্রা যুক্ত করে একে ১৯৪৬'এর নোয়াখালির দাঙ্গার সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে। যাঁরা বলছেন, নোয়াখালি থেকে সন্দেশখালি- এটাই নাকি বাংলার যাত্রাপথ, হিন্দু মহিলাদের রক্ষার্থে একমাত্র বিজেপিতে যোগদান করলেই সমাধান মিলবে, তাঁদের জন্য রইল একরাশ ঘৃণা। 

কেন্দ্রীয় মহিলা ও শিশু উন্নয়ন মন্ত্রী স্মৃতি ইরানি এবং বিজেপির আইটি সেলের প্রধান অমিত মালব্য প্রথম দিন থেকেই দেখানোর চেষ্টা করে যাচ্ছেন যে, সন্দেশখালিতে হিন্দু ও তফসিলী জাতি-উপজাতির মহিলারা রোহিঙ্গাদের দ্বারা অত্যাচারিত হচ্ছেন, যে রোহিঙ্গাদের থাকতে অনুমতি দিয়েছে ওই সাজাহান স্বয়ং। কিন্তু রাজ্য মহিলা কমিশন কিংবা রাজ্য পুলিশের বিশেষ দল যে তদন্ত করছে, তাতে এই ঘটনার সঙ্গে কোনওভাবেই সাম্প্রদায়িক যোগ নেই, তা বারংবার বলা হয়েছে। এখনও অবধি যা খবর, সন্দেশখালি থানায় মহিলাদের চারটি অভিযোগ জমা পড়েছে, যার একটিও ধর্ষণের নয়। কিন্তু ধর্ষণ হয়নি মানেই যে মহিলাদের উপর অন্য কোনও ভাবে জোরজুলুম হয়নি, তাও নয়। তদন্ত হওয়া দরকার কে বা কারা এই অত্যাচারের সঙ্গে জড়িত এবং তাঁদের উপযুক্ত শাস্তি হওয়া অত্যন্ত জরুরি, না হলে এই ধরনের ঘটনা আরও বাড়বে। কিন্তু তার মানে এটা হতে পারে না, এই সুযোগে যথেচ্ছ মিথ্যাচার করে স্মৃতি ইরানি ও বিজেপি এই ঘটনার রাজনৈতিক ফায়দা তুলবে। যে স্মৃতি ইরানি মণিপুরে দু’জন জনজাতি মহিলাকে নগ্ন করে হাঁটানো হলেও চুপ করে থাকেন, যে স্মৃতি ইরানি ভারতীয় মহিলা কুস্তিগীররা যখন কুস্তিগীর ফেডারেশনের সভাপতি বিজেপির সাংসদ ব্রিজভূষণ শরণ সিংয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন তখন তা শুনেও না শোনার ভান করেন, সেই স্মৃতি ইরানির ভাষ্য যে সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত তা বুঝতে কারও অসুবিধা হবার কথা নয়। অতএব, বাংলার মানুষ এই চরম ও উগ্র সাম্প্রদায়িক শক্তিকে এ রাজ্যে কোনওদিনই জায়গা দেবে না, তা আমরা বিশ্বাস করি। 

কিন্তু শাসক দলের নেতারা যদি এই ধরনের কাজ করতেই থাকে, তাহলে আখেরে ক্ষতিটা কার? নাগরিক সমাজ থেকে যতই 'বিজেপিকে ভোট না দেওয়া'র ডাক দেওয়া হোক, তৃণমূলের থেকে বিজেপি যে আরও ভয়ানক, বাংলার মানুষকে কিন্তু তা বোঝাতে বেশ বেগ পেতে হবে। তৃণমূলের অবশ্যই উচিত, নিজেদের যাবতীয় দুর্বলতাগুলো কাটিয়ে উঠে অপরাধমূলক কাজের সঙ্গে জড়িত সমস্ত নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ নেওয়া এবং প্রশাসনকে নিরপেক্ষভাবে তদন্তে উৎসাহিত করে প্রকৃত অপরাধীদের শায়েস্তার ব্যবস্থা করা। না হলে, বাংলার শাসক দলের যেমন বিপদ, সবল গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ বিকল্পের অভাবে বাংলার মানুষেরও তেমনি বিপদ। 

আপাতত সন্দেশখালি একটা স্ফুলিঙ্গ মাত্র। আরও কত যে সন্দেশখালি বাংলার গ্রামেগঞ্জে আছে, তা আমরা আন্দাজ করতে পারছি কী? জমি ও ভেড়ির টাকা লুট করে তৃণমূলের অঞ্চল স্তরের যে নেতারা সাম্রাজ্য বানিয়েছে, তাদের ওপরে দলীয় নেতৃত্বের একাংশের আশীর্বাদ নেই, সে কথা একজন মূর্খ মানুষও বিশ্বাস করবে না। পাশাপাশি এটাও দেখা দরকার, যে বিজেপি কাঠুয়ায় শিশু ধর্ষকদের সমর্থনে মিছিল করে, বিলকিস বানোর ধর্ষকদের সমর্থন করে আইনি সহায়তা দেয়, তাঁরা যেন কোনওভাবেই বাংলা দখলের সুযোগ না পায়; এই সুযোগকে প্রতিহত করতে হলে শাসক দলকে নিজেদের আরও সুসংহত ও রাজনৈতিক করে তুলতে হবে, না হলে শুধু গুণ্ডাগিরি আর দাদাগিরি করে এই ধরনের সংগঠিত শক্তিকে পরাজিত করা সম্ভব নয়।


Friday, 9 February 2024

এখনও সময় আছে

যুক্তরাষ্ট্র বনাম একনায়কতন্ত্র

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য


 

গত ৮ ফেব্রুয়ারি ‘ইন্ডিয়া টুডে’ ‘মুড অফ দ্য নেশন’ নামে একটি নির্বাচনী সমীক্ষা প্রকাশ করেছে যেখানে দেখা যাচ্ছে, এই মুহূর্তে যদি লোকসভা নির্বাচন হয় তাহলে এনডিএ জোট ৩৩৫টি (প্রদত্ত ভোটের ৪৫ শতাংশ) ও ইন্ডিয়া জোট ১৬৬টি (প্রদত্ত ভোটের ৩৮ শতাংশ) আসন পেতে পারে। এনডিএ’এর শরিক হিসেবে বিজেপি পাবে ৩০৪টি, গতবারের চেয়ে যা ১টি মাত্র বেশি। আমরা যদি ক্ষণিকের জন্য তর্কের খাতিরে এই সমীক্ষাটিকে ‘মোটের ওপর ঠিক’ বলে গণ্য করি, তাহলে দুটি তাৎক্ষণিক ধারণার উদয় হবে: এক) ‘অব কি বার ৪০০ পার’ এই ঢক্কানিনাদটি মাঠে মারা গেল শুধু নয়, এর ধারেকাছেও পৌঁছনো গেল না এবং দুই) ‘ইন্ডিয়া’ জোট যদি কায়মনোবাক্যে মনে করে, তাহলে এখনও সময় আছে এই ফলকে নিজেদের অনুকূলে ঘুরিয়ে দেওয়ার।

প্রথমেই প্রশ্ন উঠবে, গতবারের এনডিএ জোটের প্রাপ্ত ৩৫৩টি আসন এবার ১৯টি কমে ৩৩৫’এ নেমে আসছে কেন? যুক্তিবাদী মোসায়েবরা বলবেন, এই সামান্য কম-বেশি তো হতেই পারে, এ আর এমন কী! একদম ঠিক! ১৯ কি ২০টি আসন কম-বেশি হলে কিচ্ছুটি যায় আসে না যদি দুবার টানা ক্ষমতায় থেকে তৃতীয়বারেও ক্ষমতা দখল করা যায়। দশ বছরের প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতার সামান্য মাশুল তো গুনতেই হবে। কিন্তু প্রশ্নটা সেখানে নয়।

প্রশ্নটা হল, এই সমীক্ষা মোতাবেক ঠিক কোথায় কোথায় এনডিএ খানিক ধাক্কা খেল (আসন হারালো) ও আশাহত হল (যা ভেবেছিল তা হল না, মোটামুটি স্থিতাবস্থাই রইল)? ‘ইন্ডিয়া’ কোথা থেকে আসন সামান্য বাড়াতে পারল ও আশান্বিত হল (সমীক্ষায় স্থিতাবস্থা দেখালেও লড়ে নেওয়ার সুযোগ রইল)?

সমীক্ষা অনুযায়ী, এনডিএ যেখানে যেখানে ধাক্কা খেল সেখানে সেখানে স্বভাবতই ‘ইন্ডিয়া’ কিছুটা লাভবান হল। যেমন, পঞ্জাব, হরিয়ানা, মহারাষ্ট্র, বিহার, তেলেঙ্গানা, তামিলনাড়ু, অসম ও কর্নাটকে গতবারের থেকে এনডিএ সামান্য হলেও পিছিয়ে পড়েছে এবং ‘ইন্ডিয়া’ এগিয়েছে। মহারাষ্ট্রে এই ধাক্কা প্রবল। এখানে এনডিএ’র আসন প্রায় ২০’র কাছাকাছি কমে যাবে বলে আশঙ্কা। একমাত্র অন্ধ্রপ্রদেশে, না এনডিএ না ‘ইন্ডিয়া’- কারওরই লাভক্ষতি নেই, এখানে মূল লড়াই ওয়াইএসআর বনাম টিডিপি। কিন্তু সে ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ দিকটি হল, এই দুটি দলই বিশেষত টিডিপি এনডিএ’র শরিক হতে বিজেপি’র সঙ্গে দরকষাকষি করছে বলে খবর। যদি টিডিপি এনডিএ’তে সামিল হয় তবে তা অবশ্যই ‘ইন্ডিয়া’র মাথাব্যথার পক্ষে যথেষ্ট। কারণ, সমীক্ষানুযায়ী টিডিপি ১৭টি আসন পেতে পারে। উল্টোদিকে, অল্প কিছু রাজ্যে দেখা যাচ্ছে, এনডিএ সামান্য হলেও আগেরবারের চেয়ে বেশি আসন পাচ্ছে। যেমন, উত্তরপ্রদেশ। এখানে এনডিএ ৭০টি পেতে পারে বলে অনুমান, যা গতবারের থেকে ৮টি বেশি।

অন্যদিকে, কোথায় কোথায় স্থিতাবস্থা বজায় থাকছে কিন্তু লড়াইয়ের সুযোগ রয়েছে? প্রথমেই আসবে পশ্চিমবঙ্গের নাম। এখানে এনডিএ ১৯, টিএমসি ২২ ও কংগ্রেস ১ বলে দেখানো হয়েছে। পাশাপাশি, বিহারে যদিও এনডিএ’র আসন গতবারের চেয়ে ৫টি কমবে বলা হয়েছে, কিন্তু এখানেও লড়াইয়ের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। ঝাড়খণ্ডেও স্থিতাবস্থা থাকছে, কিন্তু যেহেতু সমীক্ষাটি হেমন্ত সোরেনের গ্রেফতারি ও তাঁর দলের বিধানসভায় বাউন্স ব্যাক করে আসার আগেই সেরে ফেলা হয়েছে, তাই নতুন পরিস্থিতিতে এখানেও অবশ্যই লড়াইয়ের সুযোগ তৈরি হবে।

অর্থাৎ, ‘মুড অফ দ্য নেশন’ সমীক্ষাকে গণ্য করলে, মোট চারটি রাজ্যে এবারে জোর লড়াইয়ের সম্ভাবনা আর সেখান থেকেই নির্ধারিত হতে পারে আগামী লোকসভার অন্তিম ফলাফল। মহারাষ্ট্রের কথা আগেই বলেছি। সম্ভবত, ভয় দেখিয়ে শিবসেনা ও এনসিপি দল ভেঙ্গে জোরজবরদস্তি সরকার তৈরি, বিশেষত, অজিত পাওয়ারের মতো দুর্নীতিগ্রস্ত নেতাদের নিজেদের জোটে টেনে আশ্রয় দেওয়ায় বিজেপি’র প্রতি বিশ্বাসযোগ্যতা বহুল পরিমাণে নষ্ট হয়েছে বলে অনেকের ধারণা। সমীক্ষা-লব্ধ আরও একটি তথ্য থেকেও এর ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে, যেখানে দুর্নীতি বিষয়ে বিরোধীদের বিরুদ্ধে এজেন্সি যতই সক্রিয় হোক, বিজেপিকে দুর্নীতিমুক্ত বলে ৪৭ শতাংশ মানুষ মনে করছেন না। পরিসংখ্যানটি যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ।

দ্বিতীয় রাজ্যটি হল বিহার। এখানে ‘ইন্ডিয়া’ জোটের জবরদস্ত লড়াই দেবার সম্ভাবনা প্রবল। প্রথমত, দীর্ঘদিন ধরে মূলত তিনটি দলের ‘মহাগঠবন্ধন’ এখানে বেশ মজবুত (বরং হঠাৎ করে জেডি(ইউ) ঢুকে পড়ায় ভারসাম্যের কিঞ্চিৎ অসুবিধা হচ্ছিল বলে খবর)। দ্বিতীয়ত, তেজস্বী যাদব উপ-মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন কর্মসংস্থানের বিষয়ে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নেওয়ায় যুবসমাজের মধ্যে তুমুল জনপ্রিয় হয়েছেন। তৃতীয়ত, মনোজ ঝা, দীপঙ্কর ভট্টাচার্য ও তেজস্বী যাদবের পরিণত ও বাস্তববোধসম্পন্ন রাজনৈতিক নেতৃত্ব এই মহাগঠবন্ধনের পক্ষে ভাল জনমত সংগঠিত করতে পেরেছে এবং সিপিআই(এমএল) লিবারেশন যদি কিছু বেশি আসনে লড়ার সুযোগ পায় তাহলে গত বিধানসভা নির্বাচনে তাদের যে অত্যন্ত ভাল স্ট্রাইকিং রেট ছিল, তা বেশ চমকপ্রদ সাফল্য পাবে বলে অনুমান। ফলে, বিহারেও এনডিএ অন্তত ২০-২৫টি আসন হারাতে পারে। তার জন্য অবশ্য এখন থেকেই ‘মহাগঠবন্ধন’কে আদাজল খেয়ে নামতে হবে।

তৃতীয় রাজ্যটি নিঃসন্দেহে ঝাড়খণ্ড। এখানেও ‘ইন্ডিয়া’ জোট সম্প্রতি এক কঠিন পরীক্ষায় নিজেদের মজবুতিকে দৃঢ় করতে পেরেছে। বিধানসভার ফ্লোর টেস্টে হেমন্ত সোরেনের উদ্দীপক ভাষণ, মূলবাসী অস্মিতার ওপর কেন্দ্রীয় সরকারের আঘাত ও দল ভাঙানোতে বিজেপি’র ব্যর্থ কসরতে জনমতে এক ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে বলে বহুজনে বলছেন। যদি ‘ইন্ডিয়া’ জোট এখন থেকেই সর্বাত্মক ভাবে আসন বোঝাপড়া করে ঝাঁপিয়ে পড়ে, তাহলে ১৪’টার মধ্যে ১২টা জিতে যাওয়া ঘোরতর সমস্যা হবে বলে মনে হয় না।

চতুর্থ গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যটি আমাদের পশ্চিমবঙ্গ। এখানে মূল প্রতিপক্ষ তৃণমূল ও বিজেপি। সমীক্ষাতেও তাই প্রতিভাত হয়েছে এবং কংগ্রেস-বাম জোটকে ১টি মাত্র আসন দেওয়া হয়েছে। অতএব, তৃণমূল এখানে একাই বিজেপিকে মোকাবিলা করতে অনেকটাই সক্ষম; যদি কংগ্রেসের সঙ্গে জোট হয় তাহলে এই মোকাবিলা অন্তত তিনটি জেলায় আরও শক্তিশালী হবে। এ রাজ্যে বিজেপি যেখানে এখনও ছন্নছাড়া, গোষ্ঠী কোন্দলে দীর্ণ, একা কুম্ভ শুভেন্দু অধিকারীর চোখ পাকিয়ে তীব্র পাগলামি, সেখানে তৃণমূল ইতিমধ্যেই মাঠে নেমে পড়েছে; যদিও নানা বিষয়ে, বিশেষত দুর্নীতি নিয়ে শাসক দলের বিরুদ্ধে জনমানসে এক গভীর অসন্তোষ দানা বেঁধে আছে। সন্দেশখালিতে বিরাট সংখ্যক মানুষের লাগাতার প্রতিবাদ তার জোরালো ইঙ্গিত দিচ্ছে। এখানেই লড়াইয়ের তাৎপর্য- মাটি কামড়ে পড়ে (২০২১ সালের মতো) তৃণমূল যদি নিজের অন্যায়গুলিকে মেরামতি করে লড়াই দিতে পারে, তালেগোলে কংগ্রেসের সঙ্গে জোটও হয়ে যায়, তাহলে বিজেপিকে ৫’এর নিচে বেঁধে ফেলা তেমন কোনও সমস্যা হবে বলে মনে হয় না। সে ক্ষেত্রে বিজেপি এ রাজ্যে ১৩ থেকে ১৫টি মতো আসন হারাতে পারে।

তাহলে, মহারাষ্ট্রে আরও ৫, বিহারে ২০, ঝাড়খণ্ডে ১০ ও পশ্চিমবঙ্গে ১৫টি আসন যদি এনডিএ সমীক্ষা-লব্ধ প্রাপ্তি থেকে হারায় তাহলে তার মোট আসন সংখ্যা নেমে আসবে ২৮৫’তে। আর বিজেপি নেমে যাবে ২৫৪’এ- একক সংখ্যাগরিষ্ঠতার অনেক নিচে। এটা কি সম্ভব? এখানেই লড়াইয়ের মাহাত্ম্য। কেউ সহজে জায়গা ছেড়ে দেয় না কিন্তু জায়গা তৈরি করে নিতে হয়।

এ ব্যতীত আরও তিনটি বিশেষ উপাদান থেকে যাচ্ছে:

১) ‘ইন্ডিয়া’ জোট ছেড়ে যদি আরও কেউ বেরিয়ে যায় অথবা এই জোটের বাইরের অন্য কোনও শক্তি এনডিএ’তে সামিল হয় তাহলে ‘কোথাকার জল কোথায় গড়াবে’ তা কিন্তু নিতান্তই হাতের বাইরে;

২) সমীক্ষায় যদিও বলা হয়েছে কংগ্রেসের আসন ৭১’এ এসে দাঁড়াবে, অর্থাৎ, গতবারের ৫২ থেকে ১৯টি বাড়বে, দেখা যাচ্ছে, এই আসনগুলি মোটেই সেইসব রাজ্য থেকে আসছে না যেখানে তারাই মূল শক্তি এবং তাদের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী বিজেপি। আসনগুলি আসছে সেইসব রাজ্য থেকে যেখানে কংগ্রেস আঞ্চলিক দলগুলির সঙ্গে হয় জোটে আছে নয় বিপক্ষে। তাই, কংগ্রেস যদি তার নিজ গড়ে বিজেপিকে সামান্যতম ভাবেও পরাজিত না করতে পারে তাহলে মূলত আঞ্চলিক দলগুলির ওপরেই ‘ইন্ডিয়া’ জোটকে জেতানোর দায়িত্বভার এসে পড়ছে। এর চেয়ে করুণ অথচ সম্ভাবনাপূর্ণ অবস্থা আর কী হতে পারে!

৩) মনে রাখতে হবে, রামমন্দিরে কিন্তু চিঁড়ে ভিজছে না- হিন্দি বলয়ে কিছুটা প্রভাব পড়তে পারে মাত্র। বরং, মোদি সাহেব ‘বিক্ষিত ভারত’ নিয়ে প্রচারে নেমেছেন, তার চারটি স্তম্ভের কথা বলছেন- মহিলা, যুবা, কৃষক ও গরিব। বিষয়টি বেশ মজার। গরিব ছাড়াও তিনি মহিলা, যুবা ও কৃষকদের আলাদা করে গুরুত্ব দিচ্ছেন। ‘গ্যারান্টি’র কথা বলছেন। এগুলো সবই একদা তাঁরই তিরস্কৃত ‘রেউড়ি’গুচ্ছ, যাকে তিনি গত এক বছরে মৌলিক কার্যসূচিতে অঙ্গীভূত করে নিয়েছেন। অর্থাৎ, ‘রেউড়ি’ বা ‘ডোল’ কিংবা ‘ভিক্ষার দান’, যাই বলে গাল পাড়া হোক না কেন, জনকল্যাণের রাজনীতিই যে এখন প্রধান স্রোত তা দায়ে পড়ে অতি-দক্ষিণপন্থীদেরও হজম করতে হচ্ছে! এবারের লোকসভার লড়াইও এই বিন্দুতেই।

শেষের কথা এই, দেখা যাচ্ছে, আজকের আঞ্চলিক রাজনীতির বিবিধ বৈশিষ্ট্যের মধ্যেই ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের প্রকৃত স্বর নিহিত, যা আত্মপ্রকাশে ব্যাকুল। জাতীয় একনায়কতন্ত্রের যে ধ্বজা উড়িয়ে মোদি-শাহ’এর নেতৃত্বে হিংস্র নখ-দাঁত বের করা হয়েছে, তার বিনাশ যুক্তরাষ্ট্রের প্রকৃত উন্মোচনের মধ্য দিয়েই হবে। হয়তো, আগামী লোকসভা নির্বাচন তার একটা ফয়সালা করতে পারে। হয়তো দেখা যাবে, আঞ্চলিক দলগুলির যুক্তরাষ্ট্রীয় সম্মিলনেই এক নতুন ভারতের অবয়ব স্বাধীনতার ৭৫ বছর পর ২০২৪’এই উদ্ভাসিত হচ্ছে।