গুণ্ডারাজের অজুহাতে ধর্মীয় দাঙ্গা নয়
সুমন সেনগুপ্ত
সন্দেশখালি এই মুহূর্তে বাংলার রাজনীতির মানচিত্রে একটি উল্লেখযোগ্য নাম।
ঘটনার সূত্রপাত কোথা থেকে তা হয়তো অনেকেই জানেন। রেশন দুর্নীতিতে ইডি'র হাতে গ্রেফতার হওয়া তৃণমূলের দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেতা জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত শেখ সাজাহানের খোঁজে যখন ইডির তদন্তকারী অফিসারের দল এবং বেশ কিছু সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিরা সন্দেশখালি ব্লকে উপস্থিত হন, তখন তাঁদের ওপর আক্রমণ করেন সেই ব্লকের বেশ কিছু মহিলা ও পুরুষ। সেদিন তাঁদের আক্রমণ থেকে বাদ যাননি সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিরাও। উক্ত ঘটনার পর থেকে ইডি'র ভয়ে শেখ সাজাহান নিঁখোজ। বলা হচ্ছে, রাজ্য পুলিশ থেকে শুরু করে দিল্লির তদন্তকারী দলও তার নাগাল পেতে ব্যর্থ।
শেখ সাজাহান নিখোঁজ হওয়ার পরে ওই অঞ্চলে তৃণমূলের পায়ের তলার মাটি নরম হতে থাকে। তারাও চেষ্টা চালায়, সাজাহানের বিকল্প মুখ হিসেবে তারই দুই ঘনিষ্ঠ শিবু হাজরা এবং উত্তম সর্দার সহ অন্যান্য নেতারা যাতে আবার এলাকায় তাঁদের রাজনৈতিক দখলদারি কায়েম করতে পারে। পরিকল্পনা অনুযায়ী, একশো দিনের কাজের বকেয়া এবং কেন্দ্রের বঞ্চনার বিরুদ্ধে সন্দেশখালি থানার সামনে একটি ধর্নামঞ্চ করা হয়। সিদ্ধান্ত হয়, বিভিন্ন ব্লক থেকে মিছিল করে ওই ধর্নামঞ্চে যাওয়া হবে। সেইরকম একটি মিছিলের নেতৃত্বে ছিল শিবু হাজরা এবং উত্তম সর্দার, যারা অঞ্চলের তৃণমূলের ব্লক ও অঞ্চল সভাপতি হওয়ার সুবাদে ইতিমধ্যেই এলাকায় বড় নেতা বলে পরিচিত। শোনা যায়, গ্রামের ভিতর দিয়ে যাওয়ার সময়ে তারা গ্রামবাসীদের হুমকি দেয়। সেই হুমকিতে ভয় না পেয়ে গ্রামের মহিলারা হাতের কাছে দা-বটি-ঝাঁটা যা পেয়েছিলেন তা নিয়ে বেরিয়ে আসেন এবং তৃণমূলের মিছিলকে আক্রমণ করেন। তাঁদের একটাই দাবি, শিবু হাজরা এবং উত্তম সর্দারদের গুন্ডামি তাঁরা আর মানবেন না। বেগতিক দেখে তৃণমূলের ছোট-বড় সব নেতা খেয়াঘাট দিয়ে পালিয়ে যান।
এখন প্রশ্ন, কী এমন হল যাতে গ্রামবাসীরা এত ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন। শোনা যাচ্ছে, এই শিবু হাজরা এবং উত্তম সর্দার'রা গ্রামবাসীদের থেকে জোর করে জমি লিখিয়ে, নিজেরাই লিজের টাকা নির্দিষ্ট করে বিঘার পর বিঘায় মাছের ভেড়ি গড়ে তোলে। বেশিরভাগ ভেড়িরই মালিক ওই শেখ সাজাহান। এছাড়াও মহিলাদের তরফ থেকে অভিযোগ আসতে থাকে তাঁদের ওপর অশ্লীল আচরণের, তাঁদের ডেকে পাঠিয়ে হুমকি দেওয়া ইত্যাদি। এই সংক্রান্ত বেশ কিছু ভিডিওতে দেখাও যায়, মহিলারা ক্ষোভে ফুঁসছেন। আসলে এই ক্ষোভ দীর্ঘদিনের। অত্যাচারিত হতে হতে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ায় এবং সাজাহান বাহিনীর প্রতাপ একটু স্তিমিত হওয়ায় আজ সাধারণ গ্রামবাসীরা রাস্তায় নেমে এসেছেন এবং প্রতিবাদে সামিল হয়েছেন। তৃণমূল যতই বলুক গ্রামবাসীদের এই রাস্তায় নামার পিছনে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর উস্কানি এবং মদত আছে, তা বলে, আর্থিক ও শারীরিক নিপীড়নের ঘটনা তো আর মিথ্যে হয়ে যায় না।
এর আগেও রামপুরহাট, বগটুই বা বাংলার অন্যান্য বেশ কিছু গ্রামে তৃণমূলের এই আঞ্চলিক স্তরের নেতাদের দৌরাত্ম্যের অভিযোগ আমাদের কানে এসেছে। আমরা শুনেছি আরাবুল ইসলামদের কথা। একজন শিক্ষিকাকে জগ ছুঁড়ে মারার পরেও সেই সময়ের শিক্ষামন্ত্রী অধুনা জেলে থাকা পার্থ চ্যাটার্জী'র তাঁর পাশে দাঁড়ানোর কথাও আমাদের মনে আছে। কিন্তু গ্রামের সাধারণ মানুষদের এইরকম রাস্তায় নেমে আসার উদাহরণ আমরা আগে হয়তো এই আমলে শুনিনি। সেদিক থেকে দেখতে গেলে, এই আন্দোলন নিশ্চিত একটা অন্য মাত্রা যোগ করেছে বাংলার রাজনীতিতে। ইতিমধ্যে উত্তম সর্দার গ্রেফতার হয়েছে, যদিও শিবু হাজরা ও শেখ সাজাহান এখনও অধরা।
কিছুদিন আগেই রাজ্য বাজেটে লক্ষ্মীর ভাণ্ডারে সাধারণদের জন্যে পাঁচশো টাকা এবং তফসিলী জাতি-উপজাতিদের জন্যে দুশো টাকা বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও শোনা যাচ্ছে, ওই অঞ্চলের মহিলারা এতটাই ক্ষিপ্ত হয়ে আছেন যে তাঁরা নাকি এবার আর তৃণমূলকে ভোট দেবেন না বলে ঠিক করেছেন। অনেকে বলছেন, সন্দেশখালি নাকি দ্বিতীয় নন্দীগ্রাম হতে চলেছে। কিন্তু নন্দীগ্রাম বা সিঙ্গুরের সঙ্গে সন্দেশখালির একটা মৌলিক ফারাক আছে। সিঙ্গুর বা নন্দীগ্রামে সরকার জমি অধিগ্রহণের চেষ্টা করেছিল, আর সন্দেশখালিতে শাসক দলের মদতপুষ্ট দুষ্কৃতীরা এই কাজটি করেছে। যদিও তৃণমূলের ওপরতলার অনেকে যখন বলছেন, এই ধরনের দুষ্কৃতীদের নিয়ন্ত্রণ না করতে পারলে বিজেপির বাড়বাড়ন্ত হবে এবং কথাটা খুব একটা মিথ্যেও নয়, তখন শুধুমাত্র বামেদের ঘাড়ে দোষ চাপালে হবে না। অন্যদিকে, বিজেপি মহল থেকে এই আন্দোলনে সাম্প্রদায়িক মাত্রা যুক্ত করে একে ১৯৪৬'এর নোয়াখালির দাঙ্গার সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে। যাঁরা বলছেন, নোয়াখালি থেকে সন্দেশখালি- এটাই নাকি বাংলার যাত্রাপথ, হিন্দু মহিলাদের রক্ষার্থে একমাত্র বিজেপিতে যোগদান করলেই সমাধান মিলবে, তাঁদের জন্য রইল একরাশ ঘৃণা।
কেন্দ্রীয় মহিলা ও শিশু উন্নয়ন মন্ত্রী স্মৃতি ইরানি এবং বিজেপির আইটি সেলের প্রধান অমিত মালব্য প্রথম দিন থেকেই দেখানোর চেষ্টা করে যাচ্ছেন যে, সন্দেশখালিতে হিন্দু ও তফসিলী জাতি-উপজাতির মহিলারা রোহিঙ্গাদের দ্বারা অত্যাচারিত হচ্ছেন, যে রোহিঙ্গাদের থাকতে অনুমতি দিয়েছে ওই সাজাহান স্বয়ং। কিন্তু রাজ্য মহিলা কমিশন কিংবা রাজ্য পুলিশের বিশেষ দল যে তদন্ত করছে, তাতে এই ঘটনার সঙ্গে কোনওভাবেই সাম্প্রদায়িক যোগ নেই, তা বারংবার বলা হয়েছে। এখনও অবধি যা খবর, সন্দেশখালি থানায় মহিলাদের চারটি অভিযোগ জমা পড়েছে, যার একটিও ধর্ষণের নয়। কিন্তু ধর্ষণ হয়নি মানেই যে মহিলাদের উপর অন্য কোনও ভাবে জোরজুলুম হয়নি, তাও নয়। তদন্ত হওয়া দরকার কে বা কারা এই অত্যাচারের সঙ্গে জড়িত এবং তাঁদের উপযুক্ত শাস্তি হওয়া অত্যন্ত জরুরি, না হলে এই ধরনের ঘটনা আরও বাড়বে। কিন্তু তার মানে এটা হতে পারে না, এই সুযোগে যথেচ্ছ মিথ্যাচার করে স্মৃতি ইরানি ও বিজেপি এই ঘটনার রাজনৈতিক ফায়দা তুলবে। যে স্মৃতি ইরানি মণিপুরে দু’জন জনজাতি মহিলাকে নগ্ন করে হাঁটানো হলেও চুপ করে থাকেন, যে স্মৃতি ইরানি ভারতীয় মহিলা কুস্তিগীররা যখন কুস্তিগীর ফেডারেশনের সভাপতি বিজেপির সাংসদ ব্রিজভূষণ শরণ সিংয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন তখন তা শুনেও না শোনার ভান করেন, সেই স্মৃতি ইরানির ভাষ্য যে সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত তা বুঝতে কারও অসুবিধা হবার কথা নয়। অতএব, বাংলার মানুষ এই চরম ও উগ্র সাম্প্রদায়িক শক্তিকে এ রাজ্যে কোনওদিনই জায়গা দেবে না, তা আমরা বিশ্বাস করি।
কিন্তু শাসক দলের নেতারা যদি এই ধরনের কাজ করতেই থাকে, তাহলে আখেরে ক্ষতিটা কার? নাগরিক সমাজ থেকে যতই 'বিজেপিকে ভোট না দেওয়া'র ডাক দেওয়া হোক, তৃণমূলের থেকে বিজেপি যে আরও ভয়ানক, বাংলার মানুষকে কিন্তু তা বোঝাতে বেশ বেগ পেতে হবে। তৃণমূলের অবশ্যই উচিত, নিজেদের যাবতীয় দুর্বলতাগুলো কাটিয়ে উঠে অপরাধমূলক কাজের সঙ্গে জড়িত সমস্ত নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ নেওয়া এবং প্রশাসনকে নিরপেক্ষভাবে তদন্তে উৎসাহিত করে প্রকৃত অপরাধীদের শায়েস্তার ব্যবস্থা করা। না হলে, বাংলার শাসক দলের যেমন বিপদ, সবল গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ বিকল্পের অভাবে বাংলার মানুষেরও তেমনি বিপদ।
আপাতত সন্দেশখালি একটা স্ফুলিঙ্গ মাত্র। আরও কত যে সন্দেশখালি বাংলার গ্রামেগঞ্জে আছে, তা আমরা আন্দাজ করতে পারছি কী? জমি ও ভেড়ির টাকা লুট করে তৃণমূলের অঞ্চল স্তরের যে নেতারা সাম্রাজ্য বানিয়েছে, তাদের ওপরে দলীয় নেতৃত্বের একাংশের আশীর্বাদ নেই, সে কথা একজন মূর্খ মানুষও বিশ্বাস করবে না। পাশাপাশি এটাও দেখা দরকার, যে বিজেপি কাঠুয়ায় শিশু ধর্ষকদের সমর্থনে মিছিল করে, বিলকিস বানোর ধর্ষকদের সমর্থন করে আইনি সহায়তা দেয়, তাঁরা যেন কোনওভাবেই বাংলা দখলের সুযোগ না পায়; এই সুযোগকে প্রতিহত করতে হলে শাসক দলকে নিজেদের আরও সুসংহত ও রাজনৈতিক করে তুলতে হবে, না হলে শুধু গুণ্ডাগিরি আর দাদাগিরি করে এই ধরনের সংগঠিত শক্তিকে পরাজিত করা সম্ভব নয়।
সেই বস্তাপচা লেসার ইভল তত্ত্ব। রাজ্য পুলিশ আর রাজ্য মহিলা কমিশনের রিপোর্টকে বেদবাক্য ভাবার কোন কারণ আছে কি?
ReplyDeletekichuta sposto holo chobita
ReplyDeleteLast panchayet kader dokole chilo? Tar age kader chilo?
ReplyDeleteঅনেক ঘটনাতেই দেখা গেছে প্রশাসন পক্ষপাতদুষ্ট। তোলাবাজি আজ গুণ্ডাগিরিতে উন্নিত। দুর্দশার আর কিবা বাকি আছে!
ReplyDelete