Thursday, 8 February 2024

মহিলা বেগার শ্রম!

মিড-ডে মিল কর্মীদের জীবন ও আন্দোলন 

অজয় বসাক



ডিসেম্বর ২০২০'তে এলাহাবাদ হাইকোর্ট এক ঐতিহাসিক রায়ে ঘোষণা করে- 'মিড-ডে মিল প্রকল্পের রন্ধন কর্মীদের 'বেগার' খাটানো বন্ধ করতে হবে। এটা সংবিধানের মৌলিক অধিকার বিরোধী। অবিলম্বে তাঁদের ন্যূনতম মজুরি এবং বিগত ১৫ বছরের বকেয়া মিটিয়ে দিতে হবে।' ৮০ পাতার এই রায় যখন ঘোষণা হচ্ছে, তখন আমাদের দেশের প্রায় ১ কোটি মিড-ডে মিল কর্মীরা কেন্দ্রীয় সরকারের মাসিক ৬০০ টাকা ও রাজ্যের অনুপাত ৪০০ টাকা ধরে মোট ১০০০ টাকা সাম্মানিক পাচ্ছেন। তাও ১০ মাসের জন্য; অথচ কাজ করতে হয় ১২ মাস। পশ্চিমবঙ্গে স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মাধ্যমে কাজ করার ফলে এই সাম্মানিক ভাগ হয়ে দাঁড়ায় মাসিক ৫০-২৫০ টাকা সর্বোচ্চ।

কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে কোর্টের এই নির্দেশ আসার পরে তারা 'মহান' কিছু পদক্ষেপ নেয় ! মিড-ডে মিল প্রকল্পের দখল নিতে ২০২২ সালে তার নাম পাল্টে 'পিএম পোষণ' করা হয়। পরিবর্তনের নতুন বৈশিষ্ট্য হল প্রকল্পটির বেসরকারিকরণ। মূলত মেগাসিটি ও পৌর শহরগুলিতে প্রকল্পটিকে বেসরকারি এনজিও'র হাতে ছেড়ে দেবার প্রক্রিয়া শুরু হয়। দেশ জুড়ে প্রতিরোধও গড়ে ওঠে। তা কোথাও সফল হয়, কোথাও ব্যর্থ। কিন্তু মুলগতভাবে যা বোঝা গেল, খাদ্য-পুষ্টি-শিক্ষার নিশ্চয়তার জন্য কুড়ি বছর আগে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে যে প্রকল্পের সূচনা হয়েছিল, তাকে বিপথগামী করাই বর্তমান সরকারের বিবিধ পদক্ষেপের উদ্দেশ্য। ২০১৪ সালে ক্ষমতায় এসেই দিল্লির সরকার এই প্রকল্পের ৯০ শতাংশ দায় ধাপে ধাপে কমিয়ে আজ ৬০ শতাংশে নামিয়ে এনেছে। গত আর্থিক বছরের বরাদ্দ ১২,৮০০ কোটি থেকে কমিয়ে চলতি বছরে তা ১১,৬০০ কোটি টাকায় এনে দাঁড় করিয়েছে। ছাত্র-ছাত্রীদের দৈনিক মাথাপিছু বরাদ্দ (প্রাথমিকে ৫.৪৫ টাকা/ উচ্চ প্রাথমিকে ৮.১৭ টাকা) 'পুষ্টি' এক প্রহসনে পরিণত হয়েছে। 

দেশের বেশ কিছু রাজ্য, যেমন কেরালা, পন্ডিচেরি, হরিয়ানা মিড-ডে মিল কর্মীদের মজুরির কিছু দায়িত্ব নিয়ে যথাক্রমে তা ১৮০০০, ১৪০০০ ও ৭০০০ টাকা করে দিচ্ছে। আবার বেশ কিছু রাজ্য যেমন উড়িষ্যা, মহারাষ্ট্র, পাঞ্জাব প্রভৃতি রাজ্য ৩০০০ টাকা করে দিচ্ছে, যদিও সারা দেশের শেষ সীমায় দাঁড়িয়ে পশ্চিমবঙ্গে তা মাথাপিছু ১৫০০ টাকা। আন্দোলনের চাপে এই বছরের বাজেটে আরও ৫০০ টাকা বরাদ্দ বাড়িয়ে আজই তা ২০০০ টাকা হয়েছে, কিন্তু তবুও দেশের বহু রাজ্যের পিছনেই থাকল এ রাজ্য। 

পশ্চিমবঙ্গে এই প্রকল্প পরিচালনার সূচনাতেই (২০০৪) ছিল তদানীন্তন সরকারের মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গির গলদ। একটা কেন্দ্রীয় প্রকল্পে দরিদ্র ঘরের মহিলাদের সারা বছর পরিশ্রমের নামকরণ হল 'সেবা'। প্রকল্পের সাথে যুক্ত বাকি সবই বাজার নিয়মে চলবে, শুধ রন্ধনকর্মীরা বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করবেন। স্বনির্ভর গোষ্ঠীর অপর নামই হল মিড-ডে মিল কর্মী। নতুন নতুন গোষ্ঠী গঠন করা হল যাদের স্কুলে রান্নার কাজে নেওয়া হল, যার পরিণতিতে স্কুলগুলি এক বেগার শ্রমের কেন্দ্র হয়ে উঠল। ২০০৭ সাল থেকেই এর বিরুদ্ধে শুরু হল প্রতিবাদ। ২০০৯ সালে পঞ্চায়েতের পট পরিবর্তনে আরও বড় গোলযোগ দেখা দিল। বেগার খাটাতেও নতুন শাসক দলের দখলদারি শুরু হল। ২০১১ সালে রাজ্যে পরিবর্তনের পর শুরু হল এক বিশৃঙ্খলা। পুরনো সব গরিব ঘরের কর্মীরা হলেন 'বিরোধী দলের'! অতএব, সব বাদ। হামলা, হয়রানি, ছাঁটাই চলল। কিন্তু প্রকল্পের গুণগত মান, কর্মীদের জীবনমান উন্নয়ন নিয়ে নতুন শাসকেরাও উদাসীন থাকলেন। এই সময় রাজ্য জুড়েই কিন্তু কর্মী সংগঠনগুলির প্রতিরোধ চলল। ব্লক, জেলা প্রশাসনগুলিকে বড় বড় বিক্ষোভের মুখোমুখি হতে হল।

২০১৯ সালে কলকাতার বুকে মিড-ডে কর্মীরা মুখ্যমন্ত্রীর উদ্দেশ্যে এক সুবিশাল সমাবেশে জড়ো হলেন। রাজ্যের তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী বিধানসভায় কর্মীদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন। মজুরি বৃদ্ধি ও ছাঁটাই রোধের দাবি জানালেন কর্মীরা। ছাঁটাই রোধের নির্দেশ জারি হলেও মজুরি বৃদ্ধির দাবিটি আশ্বাস হিসেবেই থেকে গেল। 

২০২২ সালে কর্মীরা আবারও দু' দিনের অবস্থান করলেন কলকাতায়। 'কেন্দ্রীয় প্রকল্প, আমরা কী করতে পারি?' এই বলে শিক্ষা দফতর দায় এড়ালো। কিন্তু এই সময়কালেই অন্য কেন্দ্রীয় প্রকল্পগুলিতে রাজ্য সরকার মজুরি বাড়িয়েছে, ভবিষ্যৎ সুরক্ষার কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। তাহলে, এই কেন্দ্রীয় প্রকল্প বাদ থাকল কেন? স্বাভাবিক, এই প্রশ্ন কর্মীদের মধ্যে ক্ষোভ বাড়িয়ে দিল। সমাজের প্রান্তসীমার মহিলা বলেই কি 'বিশেষ বঞ্চনা?' আর কেন্দ্রীয় প্রকল্প হলেও ২০১৩ সালে এই সরকার তার দেয় অনুপাতের অতিরিক্ত ৫০০ টাকা দিয়েছিল। যদিও সারা দেশে তা সর্বনিম্ন। তহবিলের ঘাটতির কথা বারবার সরকারি মহল থেকে বলা হলেও বাস্তবে সরকারের নানান প্রকল্প খাতে দান-ধ্যানের বহর দেখে কোনও রাজ্যবাসীই তাদের এই কান্নায় সমব্যথী নন।

বিগত ১০ বছর মূল্যবৃদ্ধির ক্রমঊর্ধ্বগতি সত্ত্বেও কীভাবে একটি প্রকল্পের কর্মীদের দারিদ্র্য নিয়ে সরকার উদাসীন থাকে, এটাই প্রশ্ন। নথিভুক্ত ২.৩৩ লক্ষ এবং অতিরিক্ত মিলিয়ে রাজ্যে প্রায় ৮ লক্ষ কর্মী এই প্রকল্পে যুক্ত, যারা গত ২০ বছর নিরবচ্ছিন্ন পরিশ্রম করে চলেছেন। ইতিমধ্যেই বহু কর্মী কর্মরত অবস্থায় দুর্ঘটনায় বা অসুস্থতায় মারা গেছেন। কেউ তাঁদের কথা ভাবেনি। রাজ্যের সরকারি শিক্ষার ক্রমসঙ্কটে স্কুল উঠে যাচ্ছে। মাঝপথেই কর্মীরা কর্মহীন হচ্ছেন। সরকার বা সমাজ কেউই এঁদের আর খোঁজ রাখছে না। তাঁদের পরিশ্রমের কোনও মূল্য, না সরকার না সমাজ, কোনও হিসাবের মধ্যে কেউ আনছে না। সাম্প্রতিক রাষ্ট্রপুঞ্জের সমীক্ষা রিপোর্ট অনুযায়ী ভারতে ৭৪ শতাংশ শিশু ও নারী অপুষ্টিতে ভুগছেন। এই শিশুদের এক বড় অংশই আগামী শ্রমের বাজারে ঢুকবে। তাদের যদি পুষ্টির নামে এই মধ্যাহ্নভোজন হয়, তবে ভবিষ্যৎ কী ভয়াবহ তা কল্পনা করা কষ্টকর। অপরদিকে, নারীদের বড় অংশ যারা এই প্রকল্পে যুক্ত, তাঁদের এই নিম্ন মজুরির হার কী ধরনের জীবনযাত্রার প্রতিশ্রুতি দেবে?

তাই, সাম্প্রতিক দিনগুলিতে মিড-ডে মিল কর্মীদের বড় ধরনের আলোড়ন আমরা দেখছি। গত সেপ্টেম্বর ২০২৩'এ বিহারের পাটনায় হয়ে গেল সারা ভারত প্রকল্প কর্মীদের জাতীয় সম্মেলন। সেখানে অন্যান্যদের সঙ্গে মিড-ডে মিল কর্মীরাও সারা দেশ থেকে বড় আকারে সমবেত হলেন। রাজ্যে রাজ্যে তাঁদের সংগ্রামী স্লোগানে মোদি সরকারের প্রতি চরম ক্ষোভ প্রকাশ পেল। রাজ্য সরকারগুলোর প্রতিও তাঁদের ক্ষোভ সমান। ভারতীয় সমাজের নব উদিত শ্রমিক শ্রেণির এই বিপুল শক্তি সংগ্রামের নব জোয়ার সৃষ্টি করেছে।  

সম্প্রতি কলকাতার বুকে এমনই প্রতিবাদের ঢেউ দেখলাম। রাজ্যের ৬টি ইউনিয়ন জোটবদ্ধ হয়ে ২৯ জানুয়ারি মুখ্যমন্ত্রীর কাছে মূলত ৭ দফা দাবি নিয়ে হাজারও কর্মী কলকাতায় হাজির হলেন। না, কোনও শাসক দলের মহোৎসবের ব্যবস্থায় নয়, সুদূর বাংলার প্রত্যন্ত প্রান্তর থেকে ভোরের আলো চিরে তাঁরা দলবদ্ধভাবে কলকাতা এলেন। কলকাতা দেখল 'এগিয়ে বাংলায়' কীভাবে শ্রমজীবী ঘরের মা-বোনেরা পিছিয়ে! তাঁরা দাবি করেছেন ন্যূনতম সরকারি মজুরি, সরকারি কর্মীর স্বীকৃতি, ১২ মাস মজুরি, বোনাস, ছাত্র-ছাত্রী পিছু দৈনিক বরাদ্দ বৃদ্ধি ইত্যাদি।

মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার আবেদনে কোনও সাড়া না পেয়ে তাঁরা ধর্মতলা মোড়েই বসে পড়েন। জীবন-মৃত্যু পায়ের ভৃত্য করে সেদিন দেখলাম এই কর্মীরা রাস্তায় শুয়ে আছেন। কল্লোলিনী তিলোত্তমার কোলে তারই সন্তানেরা দীর্ঘ বঞ্চনার বিচার চেয়ে বার বার মুষ্টিবদ্ধ হাত তুলছেন। দীর্ঘ ১ ঘন্টা পর রাজ্য সরকারের মন্ত্রীর সাক্ষাতের আশ্বাসের পর তাঁরা রাস্তা ছেড়ে দেন। রাজ্য সরকার কী পদক্ষেপ নেয় তা দেখে আন্দোলনের পরবর্তী ধাপ এগোবে বলে কর্মীরা ঘোষণা করেন। 

দেশ জুড়ে নয়া উদারবাদী অর্থনীতির কর্পোরেট রাজ যেমন সামগ্রিক শ্রমিক শ্রেণিকে বাঁধা মজুরে পরিণত করতে চাইছে, তেমনই মহিলা শ্রমশক্তিকে জনহিতকর প্রকল্পের নামে বেগার শ্রমের অধীন করতে চাইছে। কিন্তু ইতিহাসের যেমন একই রূপে পুনরাবৃত্তি হয় না, এই কর্মীদের দৃপ্ত লড়াই তার পুনরাবৃত্তি রোধ করবেই। যে কোনও সরকারকে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড় করাবার শক্তি ও সামর্থ্য এই কর্মীদের আন্দোলন প্রমাণ করেছে। আমাদের বিশ্বাস, রাজ্যের শিক্ষক, শিক্ষানুরাগী ও গণতান্ত্রিক নাগরিক সমাজের ঐকান্তিক সমর্থন ও সহযোগিতা মিড-ডে মিল কর্মীদের অধিকার ও ভবিষ্যৎ জীবনকে মর্যাদাপূর্ণ করবেই।


No comments:

Post a Comment