Tuesday, 20 February 2024

আধার যখন আঁধারে

যে কোনওদিন আপনার নাগরিকত্ব বিপন্ন

সুমন সেনগুপ্ত



চারিদিকে শোরগোল পড়ে গেছে। আধার কর্তৃপক্ষ, অর্থাৎ, ইউআইডিএআই'এর কাছ থেকে চিঠি পাচ্ছেন অনেকেই, তাঁদের আধার ডি-অ্যাক্টিভেটেড বা অচল করে দেওয়া হয়েছে। চিঠিতে পরিষ্কার বলা হয়েছে, যেহেতু এই মানুষেরা ভারতে বসবাস করার শর্ত পূরণ করতে পারেননি, তাই তাঁদের ক্ষেত্রে এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এই চিঠি যাঁরা পেয়েছেন, তাঁরা এবার অকূল পাথারে পড়েছেন! কোথায় যাবেন, কার কাছে গেলে এর প্রতিকার পাওয়া যাবে, তাঁরা বুঝতেই পারছেন না। রাজনীতির মানুষজনও মাঠে নেমে পড়েছেন। কেন্দ্রের শাসক দলের বাংলার নেতারা তিনজন তিন রকম বয়ান দিয়েছেন, কারও বয়ানের সঙ্গে কারও মিল নেই। 

বিজেপি'র রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার বলেছেন, তাঁর সঙ্গে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কথা হয়েছে, কারও চিন্তার কোনও কারণ নেই, সবার আধার আবার চালু হয়ে যাবে। কেন্দ্রীয় জাহাজ প্রতিমন্ত্রী শান্তনু ঠাকুর আরও এক ধাপ এগিয়ে বলেছেন, তাঁর ব্যক্তিগত ইমেইলে এবং ফোন নম্বরে যেন অভিযোগ জানানো হয়; তিনি একটি অভিযোগ জানানোর ফর্ম ছাপিয়েছেন, সেই ফর্ম ভর্তি করলেই সবার আধার নম্বর চালু হয়ে যাবে। বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী, যেমন সবেতেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ষড়যন্ত্র দেখতে পান, এবারও সেটাই দেখেছেন। তিনি বলেছেন, কোনও আধার কার্ড বাতিল হয়নি, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নাকি ইউআইডিএআই'এর রাঁচি অফিসের সঙ্গে যোগসাজশে এই চিঠি পাঠিয়েছেন। বলাই বাহুল্য, আদ্যন্ত মিথ্যে বলছেন বিরোধী দলনেতা, সারা দেশে এই ধরনের চিঠি অনেকেই পেয়েছেন। ২০২০ সালেই বেঙ্গালুরুর দু’জন যুবক এই ধরনের চিঠি পান, তাঁদের শুনানির জন্য হাজির হতে বলা হয়। ঐ জায়গায় গিয়ে তাঁরা দেখেন, তাঁদের মতো অনেকেই এই চিঠি পেয়েছিলেন। পরে হইচই হওয়াতে তখনকার মতো ইউআইডিএআই এই চিঠি পাঠানো বন্ধ করে।  

বাংলার বিজেপি ছাড়া 'গণশক্তি' তাদের কাগজে বড় বড় হেডলাইন করেছে- মানুষকে ভয় পাওয়ানোর লক্ষ্যে তৃণমূল ও বিজেপি মিলেমিশে এই কাজটা করেছে। অর্থাৎ, তাদের সুরের সঙ্গে শুভেন্দু অধিকারীর সুরের খুব বেশি তফাত নেই। 

কিন্তু বিষয়টা কি এতটাই সরল এবং সোজা? বাংলার মুখ্যমন্ত্রী এই বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখেছেন এবং বলেছেন যে এই ধরনের কাজ অত্যন্ত অনৈতিক; এই ভাবে মানুষের আধার অচল করে দিলে সমস্যা হবে। তিনি এও বলেছেন, প্রয়োজনে তিনি বাংলার জন্য অন্য একটি কার্ডের ব্যবস্থা করছেন যাতে বাংলা কিংবা দেশের যে প্রকল্পগুলো চলছে তা থেকে কেউ বঞ্চিত না হন। এই কথা শুনে বিজেপি বলেছে, একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোতে এটা করা যায় নাকি? নানান তর্ক বিতর্ক চলছে, মাঝখান থেকে যে মানুষেরা এই আধার নিষ্ক্রিয় হওয়ার চিঠি পেয়েছেন তাঁরা কী করবেন বুঝতে পারছেন না। 

২০০৯ সালে কংগ্রেস আধার এনে বলেছিল, যাঁদের কোনও পরিচয়পত্র নেই তাঁদের জন্য একটি পরিচয়পত্র তৈরি করার উদ্দেশ্যেই আধার আনা হল। ২০১৪ সালে বিজেপি ক্ষমতায় এসে  আধারকে আইনে পরিণত করে। সেই আইনের মাধ্যমেই তারা দেশের প্রায় সমস্ত নাগরিককে বলে, আধার কার্ড তৈরি করা বাধ্যতামূলক এবং তার জন্য দুটি প্রাথমিক পরিচয়পত্র, হাতের ছাপ, চোখের মণি ও মুখের ছবি তুলে আধার পেতে হবে। কংগ্রেসের আমলে যা ছিল একটি স্বেচ্ছামূলক প্রকল্প, বিজেপি এসে তাকে আইনের বলে বাধ্যতামূলক করে সরকারি সমস্ত নথির সঙ্গে যুক্ত করার প্রক্রিয়া নিল। এই মুহূর্তে একজন মানুষের কোনও পরিচয় নেই, তিনি এখন শুধুই একটা সংখ্যা। রবীন্দ্রনাথ তাঁর 'রক্তকরবী' নাটকে যেভাবে ৪৭ফ কিংবা ৬৯ঙ এই পরিচিতিতে খনি শ্রমিকদের দেখিয়েছিলেন, এও অনেকটা সেইরকম। এখান থেকেই আসল খেলার সূত্রপাত- একটি মানুষকে মেরে ফেলা কঠিন, কিন্তু একটি সংখ্যাকে নিষ্ক্রিয় করা অত্যন্ত সহজ। এই পদ্ধতিকেই এডওয়ার্ড স্নোডেন বলেছিলেন, সিভিল ডেথ অথবা নাগরিক মৃত্যু। এই আধার নিষ্ক্রিয়করণ সেই সিভিল ডেথ।


 

আজ নাগরিকদের আধার যে নিষ্ক্রিয় করা হচ্ছে, তার পিছনে কারণ কী? যাঁরা চিঠি পেয়েছেন তাঁদের লেখা হয়েছে, নাগরিকত্বের শর্ত পূরণ করা হয়নি বলে আধার নিষ্ক্রিয় করা হয়েছে। কিন্তু একজন নাগরিক যিনি ভোট দিয়ে সরকারকে নির্বাচিত করেছেন, তাঁর আধার যদি নিষ্ক্রিয় করা হয়, তাহলে সেই নির্বাচিত সরকারের বৈধতা নিয়েই তো প্রশ্ন উঠে যাবে! আধার আইনের ২৮এ ধারায় বলা আছে, যদি কোনও নাগরিকের এই দেশে থাকার শর্ত দেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের মনোমত না হয়, তাহলে ইউআইডিএআই আধারকে নিষ্ক্রিয় করে দিতে পারে। সুতরাং, বিজেপি নেতারা যতই বলুন না কেন কাল থেকে আবার আধার চালু হয়ে যাবে, তা সম্পূর্ণ মিথ্যা। 

আধার আপডেট করা হয়েছে ২০১৫ সালে আর সেটাই এনপিআর। যেদিন সংসদে নাগরিকত্ব আইন পাশ হয়েছিল সেদিনই জানা ছিল এনআরসি হবে। পাশাপাশি  এনপিআর যে এনআরসি'র প্রথম ধাপ, তাও পরিষ্কার বলা আছে। আজ যে বিভিন্ন মানুষের আধার নিষ্ক্রিয় করা হচ্ছে, তা এনআরসি’র অঙ্গ। অসমের উদাহরণ যদি দেখা যায়, এখনও ঐ রাজ্যে প্রায় ১৭ লক্ষ মানুষের আধার নিষ্ক্রিয় হয়ে আছে। এখনও যখন সে সমস্যা মেটেনি, তখন এখানকার বিজেপি নেতারা বলে চলেছেন স্বরাষ্ট্র দফতরের সঙ্গে কথা বলে এই আধার সমস্যা মিটিয়ে দেবেন। কোনও নেতার বক্তব্যে ভুলে না গিয়ে উল্টে তাঁদের প্রশ্ন করা উচিত, যে সরকার আমাদের ভোটে নির্বাচিত, সেই সরকার কি আমাদেরকেই বে-নাগরিক করে দিতে পারে?


 

বাংলার মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, বাংলায় বিকল্প একটা কার্ড তৈরি করে সমস্যার সমাধান করবেন। কিন্তু উনি যদি বলতেন, কোনও আধারের দরকার নেই, যা যা পরিচয়পত্র আছে তা দিয়েই চলবে, তাহলে দু' হাত তুলে তাঁকে সমর্থন করা যেত। কিন্তু তিনি আধার বন্ধ করার কথা বলেননি। বললে হয়তো সারা দেশে আধার বিরোধী আন্দোলনকে তিনি একাই নেতৃত্ব দিতে পারতেন। ঘটনাচক্রে আরও একটা কথা বলা উচিত, কংগ্রেস কিন্তু এখনও এই আধার নিষ্ক্রিয়করণ নিয়ে একটা কথাও বলেনি। তাহলে কি তারা ভাবছে, তারা যদি ক্ষমতায় ফিরে আসে আবার সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে! নাকি তারাও বিজেপির মতো একই কাজ করবে? এটা না বুঝলে কিন্তু বিজেপিকে কোনওদিন ঠেকানো সম্ভব নয়। 

বিজেপি কিন্তু আধারকে অন্যভাবে ব্যবহার করছে। তারা নাগরিকদের মধ্যে একটা ভীতির সঞ্চার করতে চাইছে, বিশেষত সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলিতে। বাঙালিদের প্রকারান্তরে ভয় দেখানো, যখন তখন স্রেফ ভাষার কারণে তাদের 'বাংলাদেশি বিদেশি' বলে যত্রতত্র দাগিয়ে দেওয়া হবে। এই ভয় যদি কার্যকরী হয়, তখন আক্রান্ত বাঙালিরা বিজেপি'র নেতাদের কাছে গিয়ে সিএএ মারফত নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্য হন্যে হয়ে দৌড়বে। হয়তো আগামী লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি এই রণকৌশল নিয়েছে। রাজনৈতিক ভাবে যাঁরা বিজেপি বিরোধী, তাঁরা যদি এই সহজ সত্যটা বুঝে আন্দোলন না করতে পারেন, তাহলে আগামী দিনে কিন্তু সারা দেশের সমস্ত নাগরিকদের অসুবিধায় পড়তে হবে। নাগরিক সমাজও যদি এই বিষয় নিয়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতার প্রচার এবং আধার বন্ধ করার আন্দোলন না করে, তাহলে বড় বিপদে পড়তে চলেছি আমরা সবাই। একদিন কিন্তু আমাদের ভবিতব্য রবীন্দ্রনাথের 'রক্তকরবী'র খনি শ্রমিকদের মতো হবে। 

আজ যাঁরা উদাসীন হয়ে আছেন, তাঁদের মধ্যেও কেউ আধারচ্যুত হতে পারেন যে কোনও দিন। সবার আগে যেটা করণীয়, ব্যাঙ্কের থেকে আধারকে বিযুক্ত করার আন্দোলন। সেটা তো শুরু করা যায় এখনই। যাঁরা ভাবছেন এই বিষয়ে ভয় পাওয়ার কিছু নেই, এটা তৃণমূল এবং বিজেপির চক্রান্ত, তাঁরা আরও একবার ভেবে দেখুন, এই বিষয়ে আন্দোলন সংগঠিত করতে পারলে কিন্তু আখেরে তাঁদেরই সাংগঠনিক এবং রাজনৈতিক লাভ হতে পারে।


2 comments:

  1. এ লেখাটা এখন খুবই প্রাসঙ্গিক।বেশ আকর্ষণীয় প্রতিবেদন।তবে এ বিষয়ে লেখক যে কার্যক্রমের আভাস দিলেন তার একটা সম্ভাব্য প্রয়োগের ইঙ্গিত দিলে আরো ভালো হত।

    ReplyDelete
  2. Making mountain out of a molehill

    ReplyDelete