কেন বুনুয়েল এখনও টানে
উত্তান বন্দ্যোপাধ্যায়
(২২ ফেব্রুয়ারি ১৯০০ - ২৯ জুলাই ১৯৮৩)
ল্যুই বুনুয়েল পা দিলেন ১২৫'এ। তিনি স্পেনে জন্মগ্রহণ করলেও নিজেকে মনে করতেন একজন বিশ্বনাগরিক ও মানবতাবাদী। তাঁর শিল্পের নৈপুণ্য যে কোনও চলচ্চিত্রের ছাত্রছাত্রীদের কাছে শেখার। বুনুয়েল আমেরিকায় গিয়েছিলেন কিন্তু হলিউডের দাসত্ব করেননি। প্রচুর অফার পেয়েছিলেন কিন্তু হলিউডের হয়ে একটাও ছবি বানাননি। তাঁর প্রতিবাদ ছিল নীরব অথচ অসাধারণ অন্তর্ঘাতী।
তাঁর শেষ চারটি ছবি: ১) বেল দ্য জ্যুঁর ২) ডিসক্রিট চার্ম অফ দ্য বুর্জোয়া ৩) দ্যাট অবস্কিওর অবজেক্ট অফ ডিজায়ার ৪) ফ্যানটম অফ্ লিবার্টিজ। ছবিগুলো দেখলে মনে হবে, ৫০ বছর এগিয়ে উনি ছবি করেছেন। পরাবাস্তববাদী স্পেনীয় শিল্পী এল সালভাদোর দালিকে নিয়ে বুনুয়েল সম্ভবত প্রথম ছবি করেছিলেন লাঁ শিয়ে আঁন্দালু (অ্যান আন্দালেশিয়ান ডগ)- এই ছবিতে তিনি স্যুররিয়ালিজম বা পরাবাস্তবতাবোধের স্বাক্ষর প্রথম থেকেই রেখেছেন। কিন্তু শেষ চারটে ছবি নিয়ে ভুবন-রাজনীতির সব কিছুরই যেন ব্লুপ্রিন্ট রাখা আছে এক প্রকাণ্ড ক্ষমতায়নের কাছে- সে খ্রিশ্চানিটিই হোক কিংবা পরাক্রমশালী আন্তর্জাতিক ক্ষমতা। বিষয়টি বোঝাতে গিয়ে তিনি ফিল্ম ন্যারেটিভ-এর দর্শনটাকেই পাল্টাতে শুরু করেন, যেখানে ছবি দেখতে দেখতে মানুষ অন্যরকম ভাবে ভাববেই।
ভাবুন, 'বেল দ্য জুর'এ বুনুয়েল দেখাচ্ছেন যে একটি বাচ্চা ছেলে খেলার মাঠে বিকেলে খেলছে, ছেলেটির গভর্নেস দূরে একটি লোকের সঙ্গে শৌখিন আলাপচারিতায় মত্ত। এক বয়স্ক প্রৌঢ় মানুষ সুযোগ বুঝে বাচ্চাটির কাছে আসে- সে বাচ্চাটির হয়তো দাদুর বয়সী- বাচ্চাটিকে কত কত অ্যাডাল্ট ছবি দেখাচ্ছে। ছবিগুলো কিন্তু ক্যামেরায় দেখা যাচ্ছে না। ক্যামেরায় দেখা যাচ্ছে এক বয়স্ক ভাম, তার মুখের আদলে যেন এক বন্য আনন্দ যে সে একটা শিশুকে নষ্ট করছে। শিশুটিও যেন নতুন অজানা জানায় কত খুশি।
কাট্ করল ক্যামেরা।
পরের দিন প্যারিসের মতো আধুনিক শহরের অ্যাপার্টমেন্টে এক বিপুল ঘরে বাচ্চাটির মায়ের গজগজ মেজাজ, স্বামীর দিকে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে বলছে, 'ছেলে কী করছে খবর রাখো? দেখ, ছেলের কোটের পকেট থেকে অত্যন্ত আপত্তিকর এই ছবিগুলো পেলাম।' এই বলে মহিলাটি তার স্বামীকে একটার পর একটা ছবি টেবিলের উপর ফেলে দেখাচ্ছে। এইবার প্রথম কিন্তু ক্যামেরাতে দেখা যাচ্ছে সব ছবিগুলি। কোনওটা তাজমহলের ছবি, কোনওটা নায়াগ্রা ফলসের, কোনওটা সেন্ট পিটার্সবুর্গ চার্চের ছবি, কোনওটা চীনের প্রাচীরের, আবার কোনওটা বা ফ্রান্সের প্যারিস শহরের আইফেল টাওয়ার।
এই যে ভিশ্যুয়াল ইমেজের শক, এই যে প্রচলিত ন্যারেটিভকে চাবকে দেওয়া- এ বুনুয়েলের আগে কেউ করেনি।
'ডিসক্রিট চার্ম অফ্ দ্য বুর্জোয়া' ছবিতে একটা লোক একটা হোটেলের করিডোরে ঢুকে হাল্কা করে কী যেন বলল। দৃশ্যকল্পনায় মনে হবে যেন লোকটা হোটেলের কর্মচারীটিকে জিজ্ঞেস করছে, খুব জোর চেপেছে, বাথরুমটা কোথায়? উত্তরে লোকটা হাত তুলে দেখিয়ে দিল, 'ওইদিকে'। দেখা গেল, স্যুইং ডোর থেকে একটা লোক বেরিয়ে এল, এবার সে ঢুকল। ঘরটি ছোট। দরজা বন্ধ করে দিল। দেওয়ালে সাঁটা আছে একটা টেবিল। টেবিলটাকে মেঝের উপর প্লেস করল, তারপর দেওয়ালের ভিতরে একটা তাক বা প্রকোষ্ঠ থেকে একটা আপেল নামাল। একটা ফোল্ডিং চেয়ারে বসল। টেবিলে রাখল আপেলটা। তারপর আপেলটা কামড়াতে লাগল। এই কাজটির জন্যই সে খুব পার্সোনালি ও কনফিডেন্সিয়ালি এই ঘরটাতেই ঢুকতে চাইছিল।
'দ্যাট অবস্কিওর অবজেক্ট অফ্ ডিজায়ার'-এ একটা হলের বড় গোল টেবিলে সব রাষ্ট্র নেতা, সবাই পুরুষ, বসে আছেন ও ডিনার করছেন। কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে টুকরো টুকরো- সন্ত্রাসবাদ, যুদ্ধ, নিউক্লিয়র বোমা ইত্যাদি। একটু পরে সম্প্রতি কেউ মারা গেছে বলে সবাই উঠে দাঁড়িয়ে এক মিনিটের নীরবতা পালন শুরু করলেন। এই সময়ে কোনও ডায়লগ নেই। সবাই দণ্ডায়মান ও চুপ। ক্যামেরা উপর-নিচ, এপাশ-ওপাশ থেকে দৃশ্যের ছবিগুলো তুলে নিচ্ছে। ক্যামেরার হাই-অ্যাঙ্গেল টপ শট-এ প্যান করতে করতে দেখা যাচ্ছে যে এই সমস্ত রাষ্ট্রীয় দূতেরা যে স্যুট-বুট-টাই পরে আছেন, প্রত্যেকেরই পিছন বা পশ্চাৎদিক একেবারেই অনাবৃত, আন্ডারগারমেন্টও নেই এবং সকলেই বসেছিলেন এক একটা কমোডে। সবাই কমোডে বসেই রাষ্ট্রসংঘের মতো একটা প্ল্যাটফর্মে ডিনার সারছেন আর মিটিং করছেন।
শুধু পরাবাস্তবতাবোধই নয়, আধুনিক কদর্য রাজনীতিকেও বুনুয়েল ছবিতে ভিজ্যুয়াল রিডাকশনিস্ট বা খণ্ডিত ন্যারেটিভের রাজনীতি দিয়েই বোঝাতেন। ঋত্বিক ঘটক বুনুয়েল'এর এই ভাবটা নিজের ছবিগুলোতে সঞ্চারিত করেছেন। হিন্দু দর্শনের ভিতরে রাম ও সীতাকে জনগণের প্রতিবাদের ভাষায় রূপান্তর ঘটিয়েছিলেন তাঁর 'নাগরিক', 'সুবর্ণরেখা', 'তিতাস একটি নদীর নাম' ছবিতে।
বুনুয়েল তাই পৃথিবীর ১০ জন শ্রেষ্ঠ চিত্র পরিচালকদের মধ্যে একজন, পৃথিবীর ৫ জন সেরা পরিচালকদের মধ্যে একজন এবং সেরা ৩ জন পরিচালকদের মধ্যে অন্যতম।
No comments:
Post a Comment