Thursday 15 February 2024

আবারও রাজপথে কৃষকেরা

সরকারের যুদ্ধ ঘোষণা

সোমনাথ গুহ



প্রখ্যাত কৃষি বিজ্ঞানী ও সদ্য মরণোত্তর ভারতরত্ন প্রাপ্ত এমএস স্বামীনাথনের কন্যা মধুরা স্বামীনাথন বিজ্ঞানীদের এক সভায় বলেন, 'যাঁরা এমএসপি'র জন্য আন্দোলন করছেন তাঁরা কৃষক, ক্রিমিনাল নন।' তিনি কৃষকদের দাবি আন্তরিক ভাবে সমাধান করার জন্য তাঁদের কাছে আহ্বান জানান। বাস্তবিকই, সংযুক্ত কিষাণ মোর্চা (অরাজনৈতিক) এবং কিষাণ মজদুর মঞ্চের নেতৃত্বে ‘দিল্লি চলো’ অভিযানের মোকাবিলা করতে কেন্দ্রীয় সরকার ও বিভিন্ন রাজ্যের বিজেপি সরকার অভুতপূর্ব সন্ত্রাস সৃষ্টি করেছে। এই সন্ত্রাস ২০২০-২১'এর সন্ত্রাসকে ছাপিয়ে গেছে। 

কৃষক আন্দোলন নতুন করে শুরু হওয়া শুধু ছিল সময়ের অপেক্ষা মাত্র। কারণ, ২০২১'এর নভেম্বরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী প্রায় পনেরো মাস ধরে চলা কৃষক আন্দোলনের কাছে নতি স্বীকার করে কৃষকদের অধিকাংশ দাবি মেনে নিলেও আজ দু' বছর বাদেও তার কিছুই প্রায় কার্যকর হয়নি। দীর্ঘ প্রতীক্ষায় হয়রান হয়ে অন্নদাতারা নতুন উদ্যমে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। এবার হরিয়ানা সরকার পঞ্জাবের শম্ভু সীমানায় দানবীয় সব বাধা তৈরি করে কৃষকদের দিল্লির সিঙ্ঘু বর্ডার থেকে প্রায় ২০০ কিলোমিটার দূরে আটকে দিয়েছে। ভেবে দেখুন, গতবার এই সিঙ্ঘু বর্ডারেই  হাজারো কৃষক শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা, শাসকের হুমকি, গা-জোয়ারি উপেক্ষা করে সমবেত ছিলেন, কোনও প্রতিকূলতাই তাঁদের টলাতে পারেনি। গতবারও সরকার কাঁটাতারের বেড়া, কংক্রিটের দেওয়াল, বোল্ডার ইত্যাদি দিয়ে এঁদের আটকানোর চেষ্টা করেছিল। কিন্তু এবারে ব্যারিকেডের সংখ্যা ও ঘনত্ব অনেক বেশি। সারি দিয়ে ধাতব দেওয়াল বা কাঁটাতারের বেড়া, হাইওয়েতে সারি দিয়ে গজাল পোঁতা, জানানো হয়েছে প্রয়োজন হলে রাস্তা খুঁড়ে দেওয়া হবে। গতবারের মতো এবারও জলকামান আছে, এর সাথে জুড়েছে রাবার বুলেট, যা কাশ্মীরে লাগামছাড়া ব্যবহারের কারণে কুখ্যাত; ড্রোন থেকে নিক্ষেপিত হচ্ছে কাঁদানে গ্যাস, যা ইজরায়েল কর্তৃক গাজায় ব্যবহার করার কারণে কুখ্যাত। ইতিমধ্যে গোটা পঞ্জাব জুড়ে আজ বেলা ১২টা থেকে কৃষকেরা চার ঘন্টার জন্য রেল রোকো অভিযান করেছেন।

শম্ভু সীমান্ত এখন যুদ্ধক্ষেত্র- সেখানে সন্ধ্যা নামলে যুদ্ধ বিরতি ঘোষণা হয়, মাইলের পর মাইল ইন্টারনেট সংযোগ নেই। পুরো দিল্লি এবং হরিয়ানার বিভিন্ন জেলায় ১৪৪ ধারা জারি হয়েছে। রাজধানীতে কোনও মিছিল, সমাবেশ, ট্র্যাক্টর-ট্রলির প্রবেশ নিষিদ্ধ। এবারও প্রায় লোক-দেখানোর মতো একটা আলোচনা চলছে। তিনজন মন্ত্রী ৮ এবং ১২ ফেব্রুয়ারি কৃষক নেতাদের সাথে আলোচনায় বসেছেন এবং যথারীতি তাঁরা সুষ্ঠু কোনও সমাধান সূত্র দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। আজ আরও একটি বৈঠক চণ্ডীগড়ে বসার কথা। 

সবার অলক্ষ্যে হরিয়ানার গ্রামে-গঞ্জে সঙ্ঘী বাহিনী ছড়িয়ে পড়েছে। বাড়ি বাড়ি গিয়ে তারা স্ত্রী-পুরুষদের হুমকি দিচ্ছে যাতে কেউ আন্দোলনে যোগদান না করেন। এখন একটা নতুন শয়তানি কায়দা শুরু হয়েছে- কেউ প্রতিবাদ করলে তাঁর রুটিরুজি কেড়ে নাও, ঘরবাড়ি ধ্বংস করে দাও। সংখ্যালঘু এলাকায় এটা চালু হয়েছে, কৃষক এলাকাতেও এটা প্রয়োগ করার চেষ্টা হচ্ছে। প্রচার করা হচ্ছে, আন্দোলনে গেলে সরকারি সুযোগ-সুবিধা বন্ধ করে দেওয়া হবে, জমির নথিপত্র বাজেয়াপ্ত হবে ইত্যাদি। সরকারি সম্পত্তি নষ্ট হলে আন্দোলনকারীদের থেকে তার মূল্য আদায় করা হবে। সুদূর ভোপালে কর্নাটকের কিছু কৃষক যাঁরা দিল্লিতে সমাবেশে যোগদান করতে আসছিলেন তাঁদের ট্রেন থেকে নামিয়ে গ্রেফতার করা হয়েছে। আগামী ১৬ তারিখ সংযুক্ত কিষাণ মোর্চার গ্রামীণ ভারত বনধ বানচাল করার জন্য মধ্যপ্রদেশে বিভিন্ন কৃষক সংগঠন ও এনএপিএম'এর কার্যকর্তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে। 

১৯ নভেম্বর ২০২১- প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে নানা প্রতিশ্রুতির মধ্যে এটাও বলেছিলেন যে ফসলের ন্যূনতম মূল্য (বা এমএসপি)'কে আরও অধিক কার্যকর করা হবে। তিনি সমস্ত দাবি খতিয়ে দেখার জন্য একটি কমিটি গঠন করার কথা বলেছিলেন। দীর্ঘ আট মাস কেটে যাওয়ার পর ১২ জুলাই ২০২২ অবশেষে কমিটি গঠিত হয়। কৃষি মন্ত্রক জানায়, বিভিন্ন নির্বাচনের কারণে নির্বাচন কমিশন অনুমতি না দেওয়ায় এবং এসকেএম তাদের প্রতিনিধির নাম জানাতে গড়িমসি করায় এই বিলম্ব। 'ডাউন-টু-আর্থ' পত্রিকা আরটিআই করে জানতে পারে যে উক্ত বিষয়ে উল্লেখ্য আট মাসে মন্ত্রক ও নির্বাচন কমিশনের মধ্যে কোনও ধরনের যোগাযোগ হয়নি। কমিটি গঠন হওয়ার পর এবং সদস্যদের নাম প্রকাশ্যে আসার পর এসকেএম'এর গড়িমসির কারণ পরিষ্কার হয়। কমিটির মোট সদস্য সংখ্যা ২৯, যার মধ্যে ১৮ জন সরকার মনোনীত আধিকারিক। শোনা যায়, বাকি ১১ জনের অধিকাংশ শাসক-ঘনিষ্ঠ লোকজন। এই পরিস্থিতিতে এসকেএম তাঁদের ৩ জন সদস্যের নাম জানানো মুলতুবি রাখে। গত ১৮ মাসে কমিটির ৩৫টি মিটিং হয়েছে, তাতেও কোনও সমাধান সূত্র বেরয়নি। রাজ্যসভায় কংগ্রেসের এক সদস্য যখন এই বিষয় সম্পর্কে জানতে চায়, শাসক দল কোনও উত্তর দিতে অস্বীকার করে। 

ন্যূনতম সহায়ক মূল্য নিয়ে শাসকের এই টালবাহানার দীর্ঘ ইতিহাস একটু দেখে নেওয়া যেতে পারে। এমএসপি’র ওপর স্বামীনাথন কমিটির রিপোর্ট গত ২০০৬ সাল থেকে সংসদে পড়ে আছে। এতে প্রস্তাব আছে যে ফসল উৎপাদনের খরচের ওপর ৫০ শতাংশ যোগ করে এমএসপি নির্ধারণ করা প্রয়োজন। ইউপিএ আমলে এই প্রস্তাব ঠাণ্ডা ঘরে পড়েছিল। ২০১৪ সালে নির্বাচনে বিজেপি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ক্ষমতায় এলেই তারা কমিটির সুপারিশ কার্যকর করবে; এখন রাহুল গান্ধীও একই প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। ২০১৫ সাল থেকে কেন্দ্রীয় সরকার বলে আসছে যে খরচার ওপর ৫০ শতাংশ যোগ করলে তা বিপুল ব্যয়বহুল হয়ে পড়বে। ২০১৭'এ মধ্যপ্রদেশের মন্দাসরে চাষিরা এই দাবিতে লাগাতার আন্দোলন করেন, পুলিশের গুলিতে কয়েক জন মারা যান। 

সাম্প্রতিক সময়ে আমরা দেখেছি, ছত্তিশগড় নির্বাচনে বিজেপি ৩১০০ টাকা ধানের সহায়ক মূল্য দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, অথচ সেই সময়ে সারা দেশে সহায়ক মূল্য ছিল মাত্র ২১৮৩ টাকা। নির্বাচন জেতার জন্য তাঁরা অধিক মূল্য দিতে রাজি হলেও কৃষকদের দাবি তারা মানতে নারাজ। কৃষকদের দাবি, এমএসপি'র মৌখিক প্রতিশ্রুতিকে আইনে লিপিবদ্ধ করতে হবে, অর্থাৎ, সমস্ত মান্ডিতে নির্ধারিত সহায়ক মূল্যই চাষিকে দিতে হবে। কেন তাঁরা এই দাবি করছেন? ফসল কাটার পরে তা প্রায় একই সময়ে সব মান্ডিতে আসে। ফসলের প্রাচুর্যের কারণে দাম পড়ে যায়, চাষি যে কোনও মূল্যে ফসল বিক্রি করতে বাধ্য হয়। এই ধারাবাহিক ক্ষতির কারণে আজ চাষির পিঠ দেওয়ালে ঠেকে গেছে, না হলে সরকারের লাঠি-গুলি খেয়ে, দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে বারবার কেউ দিল্লি অভিযান করে না। 

সরকারের যুক্তি, সমস্ত খাদ্যপণ্যের এমএসপি'র গ্যারান্টি দিতে হলে প্রতি বছর নাকি সরকারকে অতিরিক্ত ৭-১১ লাখ কোটি টাকা ব্যয় করতে হবে। এই অঙ্কের প্রকৃত কোনও হিসাব আজ অবধি সরকারের থেকে পাওয়া যায়নি। যদি ধরেও নেওয়া যায়, কৃষকদের ন্যায্য দাবি মেটানোর জন্য কয়েক লক্ষ কোটি টাকা ব্যয় হবে, তাহলে অন্যান্য ক্ষেত্রে কী হারে সরকারি টাকা তছনছ হচ্ছে সেটার দিকেও নজর দেওয়া প্রয়োজন। ২০১৪-২০২১ ব্যাঙ্কের অনুৎপাদনশীল সম্পদ (এনপিএ) ছিল ৬৬.৫ লক্ষ কোটি টাকার, যার মধ্যে ১৪.৫ লক্ষ কোটি টাকা রাইট অফ করা হয়েছে। এছাড়াও মোদী সরকারের প্রথম আট বছরে বিদেশে ১২ লক্ষ কোটি টাকা পাচার করা হয়েছে। প্রতি বছরের বাজেটে যখন কর্পোরেট ট্যাক্স কমানো হয় কিংবা শিল্প স্থাপন করার জন্য সব দেদার ছাড় দেওয়া হয়, তখন তো সরকার ব্যয়বহুলতার বাহানা তোলে না। 

কৃষকদের অন্যান্য দাবিগুলি হল, ঋণ মকুব, বরিষ্ঠ কৃষকদের জন্য পেনশন, তিন বছর আগের আন্দোলনে শহীদ হওয়া ৭০০ চাষির জন্য ক্ষতিপূরণ, লখিমপুর-খেরির ঘটনায় নিজ পুত্রের জড়িত থাকার কারণে মন্ত্রীসভা থেকে অজয় সিং টেনির পদত্যাগ, কৃষকদের বিরুদ্ধে সমস্ত মামলা তুলে নেওয়া ও এমএনরেগা'য় কাজের দিন ১০০ থেকে বাড়িয়ে দ্বিগুণ করা। প্রবল দমনপীড়ণ সত্ত্বেও কৃষকদের মনোবল তুঙ্গে। রোহতাকে তাঁরা পঞ্জাবের চাষিদের সমর্থনে অবস্থান শুরু করেছেন। পুলিশের লাগাতার হুমকি সত্ত্বেও আশেপাশের গ্রাম থেকে দলে দলে মানুষ এসে সমাবেশ আরও পুষ্ট করছেন। শম্ভু সীমান্তে ঘুড়ি উড়িয়ে, আতশবাজি ফাটিয়ে তাঁরা ড্রোনের মোকাবিলা করছেন। তাঁরা বারবার জানাচ্ছেন তাঁরা ভীত নন। ‘ডর’ বলে তাঁরা কিছু জানেন না। তাঁরা দাবি আদায় করেই ছাড়বেন, নচেৎ আবারও দীর্ঘ সময় ধরে অবস্থান করবেন। 


3 comments:

  1. এই লড়াইয়ে নোটভোট খেলা নেই আছে হিম্মত।

    ReplyDelete
  2. It's good news that peasants are up in arms again. The euphoria over the Ram temple is virtually over. Let there be great disorder under the sun. Peasants protest and they protest to show the ground reality of India. For one thing farmers are protesting across the world. They demand higher pay and better working conditions . It reflects the depth of agrarian crisis even in advanced capitalist countries. The need of the hour is to develop solidarity movement in support of agitating farmers.---Timir Basu

    ReplyDelete
  3. Thanks Timirda. It would have been nice if I could include this agrarian crisis in Europe.

    ReplyDelete