Sunday, 29 January 2023

সাধারণজনের বিনিয়োগ বিমুখতা কেন?

শেয়ার বাজার কি সাধারণেরও ক্ষমতার ধারক?

পার্থ  হালদার


 

জাত গেল জাত গেল বলে একি আজব কারখানা, সত্য কাজে কেউ নয় রাজি, সবই দেখি তা- না -না- না। লালন সাঁই’এর এই কথাটাই মনে এল। প্রতিদিন দারিদ্র, আর্থিক বৈষম্য নিয়ে কত লেখাই তো দেখি, কত  আলোচনাই তো শুনি কিন্তু কোথাও আর্থিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কোনও সঠিক রাস্তা তো দেখি না। এত আলোচনা, লেখালিখি, কত নোবেলের পরও তো বৈষম্য কমার কোনও লক্ষণ দেখা যায় না বরং প্রতিদিনই তা আরও প্রকট হয়ে চলেছে। পৃথিবীর ১০ শতাংশ মানুষের হাতে ৯০ শতাংশ সম্পদ আর ৯০ শতাংশ মানুষের হাতে মাত্র ১০ শতাংশ সম্পদ- তা আজ আমাদের সকলেরই জানা। তবে একটা মতামত আজকাল প্রায়ই দেখা যায় যে ইউনিভার্সাল বেসিক ইনকাম অর্থাৎ কোনও কোনও দেশের সরকার তার সংগৃহীত করের কিছুটা অংশ দরিদ্র কর্মহীন মানুষের মধ্যে বিতরণ করে। কিন্তু তাতে কি সত্যি সমস্যার সমাধান হয়? নাকি আমরা আবার সেই পুরনো জমিদারি প্রথায় ফিরে যাই যেখানে দরিদ্র প্রজাদের জন্য দরিদ্রনারায়ণ সেবার ব্যবস্থা আর বিনামূল্যে দাতব্য চিকিৎসালয়। তাছাড়া একদল মানুষ সারা জীবন কর্মহীন হয়ে থাকবে এটা আবার কেমন কথা! অনেক অর্থনীতিবিদের মতে, এ ধরনের ব্যবস্থা উন্নয়নেরও বিরোধী। আসলে এটা দিশাহীন সুবিধাবাদী উদার অর্থনীতির আসল চেহারাটা লুকোবার একটা প্রয়াস মাত্র।

আমি যেটুকু কথা বলে বুঝেছি, অধিকাংশ সাধারণ মানুষের সম্পদ সম্পর্কে ধারণাও খুব স্পষ্ট নয়। কোনও শিল্পপতি ৫০০ কোটি বা ১০০০ কোটির মালিক মানে তার ব্যাঙ্কে কি সত্যিই সেই টাকাটা আছে? তা তো নয়। আসলে তাদের সম্পদের একটা বড় অংশ নির্ভর করে তাদের কোম্পানির শেয়ারের বাজার মূল্যের ওপর। কিন্তু দেশের ৯৫ শতাংশ মানুষ যদি সেই বাজারে যোগদানই না করে তাহলে বৈষম্য দূর হবে কীভাবে? আমরা ছোটবেলায় ঠাকুমার ঝুলির রূপকথাতে পড়েছি, রাজপুত্র যতবারই রাক্ষসীকে মারতে গিয়ে তার হাত, পা, গলা, কেটে ফেলে, ততবারই রাক্ষসী আবার বেঁচে ওঠে। কিন্তু যখন সমুদ্রের নিচে গুহার মধ্যে সোনার খাঁচায় থাকা তোতা পাখিটাকে মেরে ফেলা হয় তখনই সেই রাক্ষসী মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। তাই বৈষম্যের দৈত্যটাকে মারতে হলে আঘাত করতে হবে তার অন্তরাত্মায়, অর্থাৎ, পুঁজির বাজার বা শেয়ার বাজারে। সাধারণ মানুষের সম্মিলিত বিনিয়োগের মাধ্যমে উৎপাদন ব্যবস্থার মালিকানা দখলই পারে বৈষম্য মুক্ত সমাজ গড়তে। অন্য কোনওভাবে এই বৈষম্য দূর করা প্রায় অসম্ভব।

সমাজতন্ত্র বা সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থার কথা ভাবতে হলে শুধুই যে বামপন্থী হতে হবে বা লাল ঝান্ডা নিয়ে ঘুরতে হবে, এমন কোনও মাথার দিব্বি'র কথা আমার অন্তত জানা নেই। পুঁজিবাদের প্রবক্তাদের অনেকেরই ধারণা যে, পুঁজিবাদের একটি বিশেষ অবস্থার পর তা আপনা থেকেই সাম্যবাদী ও সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার দিকে যাত্রা শুরু করবে। উৎপাদন ব্যবস্থার যৌথ মালিকানা অর্থাৎ শেয়ার, কমিউনিটি লিভিং (আর্থিক যোগ্যতা অনুসারে), কমিউনিটি কিচেন, সংগঠিত ও পরিকল্পিত শিল্প এবং কৃষির উৎপাদন- সবই আজ বিজ্ঞানের আশীর্বাদে সম্ভব হচ্ছে। কেবল সাধারণ মানুষের বিনিয়োগ বিমুখতাই জন্ম দিচ্ছে মুষ্টিমেয় এক শ্রেণির ধনকুবেরের। যেন সমাজের দায় এদের সৃষ্টি করা উৎপাদন ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার জন্য। কিন্তু কেন? আমাদের দেশেই তো আছে আমূল, স্টেট ব্যাঙ্ক, এইচডিএফসি’র মতো সংস্থা, এছাড়া অসংখ্য রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্র যারা সমান ভাবে লাভজনক ব্যবসা করতে সক্ষম। রাষ্ট্র ব্যবস্থা যদি কেবল মাত্র শ্রমিক স্বার্থ ছাড়া বিনিয়োগকারীর স্বার্থরক্ষারও চেষ্টা করে তাহলেই গড়ে উঠতে পারে নতুন এক অর্থনীতি। গড়ে উঠতে পারে ক্ষুদ্র ও মাঝারি বিনিয়োগকারী সমাজ।

এবার  প্রশ্ন  হচ্ছে, তবে কি রাষ্ট্রব্যবস্থা তার নাগরিকদের ক্রমাগত অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেবে? তা ঠিক নয়। কারণ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি আজ এমন জায়গায় এসে পৌঁছেছে যা অনিশ্চয়তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। কিছুদিন আগেও আমরা আবহাওয়াকে সঠিক ভাবে বিশ্লেষণ করতে পারতাম না। এ নিয়ে বহুবিধ হাসি-মস্করাও সমাজে প্রচলিত ছিল, কিন্তু আজ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির মাধ্যমে আমরা তা সহজেই বুঝতে পারি। ঠিক সেরকমই আজ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও অ্যালগরিদমিক ট্রেডিং’এর মাধ্যমে গড়ে তোলা যেতে পারে ক্যাপিটাল প্রোটেকশন সিস্টেম যা বিনিয়োগকারীর আমানতকে স্বয়ংক্রিয় ভাবে রক্ষা করতে সক্ষম। যার দ্বারা উপকৃত হতে পারেন অসংখ্য পেনশন ভোগী মানুষ। আমি আগের একটি লেখায় দেখিয়েছি, কীভাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিনিয়োগকারীকে মুনাফা করতে সাহায্য করতে পারে। ঠিক সেই রকমই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিনিয়োগকারীকে লোকসানের হাত থেকে  বাঁচাতেও সাহায্য করতে পারে। প্রয়োজন শুধু সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি ও প্রচেষ্টা। আমার একজন খুব প্রিয় লেখক জুলে ভার্ন সাবমেরিন তৈরি হবার বহু আগে সাবমেরিনের নকশা তৈরি করতে পেরেছিলেন। তাহলে আমরা ভাবতে পারব না কেন? আমাদের দেশের আইআইটি ও আইআইএমগুলো এই কাজে যথেষ্ট ভাবেই যোগ্য এবং কেন্দ্রীয় সরকারের ইনভেস্টর প্রোটেকশন ফান্ডের সামান্য অংশ খরচেই এই ব্যবস্থা গড়ে তোলা যায় বলেই আমার বিশ্বাস।

ভারতের ৭০ শতাংশ মানুষ কৃষিজীবী, তাঁরা নিয়মিত ঝুঁকি নিয়েই কৃষিকাজ করে থাকেন। আজ ফসল বীমার মাধ্যমে এই কৃষক সমাজকে নিরাপত্তা দেওয়া সম্ভব হলে উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে কেন ক্ষুদ্র ও মাঝারি বিনিয়োগকারীকে নিরাপত্তা দেওয়া সম্ভব নয়? পৃথিবীতে অস্তিত্ব বজায় রাখতে হলে সমস্ত জীবজগৎকেই প্রতিনিয়ত অনিশ্চয়তার সম্মুখীন হতে হয়, তাই এই অনিশ্চয়তাকে সামগ্রিক ভাবে যোগ্যতা অনুযায়ী ভাগ করে নিয়ে এগিয়ে চলাই তো হতে পারে নয়া সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থার মূল কথা।

তাই নতুন করে সরকারি শিল্প উদ্যোগগুলির পুনরুজ্জীবন, নতুন রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা নির্মাণ ও শ্রম আইন পরিবর্তনের মাধ্যমে সেগুলিকে প্রতিযোগিতামুখি করে তোলা সম্ভব। আর তার জন্য যে অর্থের দরকার তার জন্য তো আছেই পুঁজির বাজার। চীনের মতো দেশ কিন্তু সরকারি উদ্যোগগুলিকে সম্পূর্ণ বিসর্জন দেয়নি। এ নিয়ে বিভিন্ন মতামত থাকলেও চীনের আর্থিক অগ্রগতির ক্ষেত্রে তাদের সরকার নিয়ন্ত্রিত কোম্পানিগুলির গুরুত্ব অপরিসীম এবং যে কোনও ভাবেই হোক সেগুলিকে ব্যবহার করে তারা পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম শক্তি হিসাবে নিজেদের তুলে ধরেছে। তাই শুধু সমালোচনা না করে শিক্ষণীয় বিষয়গুলির উপর আলোচনা শুরু করা একান্ত জরুরি। কারণ, আর কয়েক বছর পর সরকারগুলির হাতে বেচবার মতো কিছুই থাকবে না। তাছাড়া দুধের ব্যবসার বেসরকারিকরণ ও মদের ব্যবসার জাতীয়করণ ধরনের অদ্ভুত অর্থনৈতিক নীতির হাত থেকে বাঁচা যাবে। আর লোকসানে চলা স্যুইগি’র মতো কোম্পানি যদি পুঁজির বাজার থেকে পুঁজি তুলে নিজেদের ব্যবসা চালিয়ে যেতে পারে তবে সরকারি কোম্পানিগুলি কী দোষ করল?

আজ সময় থাকতে যদি এ নিয়ে আলোচনা, বিতর্ক আয়োজন না করা যায় তবে সেদিন আর বেশি দূরে নেই যেদিন আমরা বসে বসে দেখব ১ শতাংশ মানুষের হাতে কীভাবে সারা পৃথিবীর ৯৯ শতাংশ সম্পদ কুক্ষিগত হয়ে গেল।

 

 

 

2 comments:

  1. dhusss...share market niye deading diye eta ki lekha !!!! sei eki purono katha ...

    ReplyDelete