Friday, 15 April 2022

দলসমাজের পাঁকে নিমজ্জিত বাংলা

হরে কৃষ্ণ হরে হরে

তৃণমূল ঘরে ঘরে

সোমনাথ গুহ

 


আজ ২০২২'এ এসে আক্ষরিক অর্থেই শিরোনাম-শ্লোগানটি বাস্তবায়িত হয়েছে। এখন সর্বত্র তৃণমূল। সামনে-পিছনে, ডাইনে-বায়ে, ওপরে-নীচে, ঘরে-বাইরে, পথেঘাটে, মাঠে-ময়দানে, অফিস-কাছারিতে, পাড়া-বেপাড়ায়, স্কুল-কলেজে, ফ্ল্যাটবাড়ি-বসতবাড়িতে, সিনেমা-নাটকে, পুলিশ-প্রশাসনে, পুরসভা-পঞ্চায়েতে, বুদ্ধিজীবী-মিথ্যেজীবী সর্বত্র তৃণমূল। প্রায় সবাই তৃণমূল। পরিচিত-অপরিচিত, আগন্তুক-প্রতিবেশী, শত্রুমিত্র, কেউ বাদ নেই। পরিবারের মধ্যেও তাই, যেমনটা মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন: কাকা-কাকি, জ্যাঠা-জ্যাঠি, নানা-নানি, ভাইবোন, বাবা-মা, দাদু-দিদিমা, খালা-খালি, সবাই ঘাসফুল। কিন্তু এমনটা তো হওয়ার কথা নয়। ২০২১'এর নির্বাচনে টিএমসি বিজেপির থেকে ৬০ লাখ ভোট বেশি পেয়েছে। সিপিএমের প্রাপ্য ভোট যদি যোগ করা হয়, তাহলে, তৃণমূলের ভোট মাত্র ৩০ লাখ বেশি। তাহলে বছর ঘুরতে না ঘুরতেই এই বিরোধী ২ কোটি ৬০ লক্ষ লোক কি গায়েব হয়ে গেল! ভ্যানিশ! 

আসলে ভয়! রুটিরুজি চলে যাওয়ার ভয়; পাড়া, মহল্লায় একঘরে হয়ে যাওয়ার ভয়; ধোপা-নাপিত বন্ধ হয়ে যাওয়ার ভয়; এরপরেও বেশি বাড়াবাড়ি করলে, অর্থাৎ শাসক দলের বিরোধিতা করলে বাড়ির বৌ-মেয়ের ইজ্জত নিয়ে টানাটানি, তাঁদের এবং নিজের জীবনের ভয়। এই ভয়ে বিপুল সংখ্যক বিরোধী মানুষ হয় শাসক দলের কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন নয়তো সামাজিক জীবন থেকে নিজেকে পুরো বিযুক্ত করে ব্যক্তি জীবনে সিঁটিয়ে গেছেন। ১৯৩৩ সালে হিটলার যখন সাড়া জাগিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন তখনও কম্যুনিস্ট ও সমাজতন্ত্রীরা মিলে ১১৮৪৫০০০ ভোট পেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁরা নাৎসি রাজনীতির বিরুদ্ধে কোনও প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেননি। কারণ, ভয়! এটা অবশ্যই বলতে চাইছি না যে তৃণমূলীরা নাৎসিদের মতো হয়ে গেছে। কিন্তু ভয় মানুষকে কীরকম জড়ভরত করে দেয় এটা তার একটা দৃষ্টান্ত। এটা তখনই হয় যখন পুরো সমাজটাই একটা দল হয়ে যায়। যাঁরা বিরোধী, ব্যাতিক্রমী, তাঁরা পাশের মানুষটাকেও ভয় করতে শুরু করেন। আশেপাশে যেদিকে তাকান, দেখেন সব ঘাসফুল, সব ঘাসফুল! ফ্রান্সের সর্বশক্তিমান সম্রাটের মতো নেত্রীও তখন বলতেই পারেন- আমিই পার্টি, পার্টিই সমাজ। 

ক্ষমতা কতটা ভয়ঙ্কর সেটা বোঝাতে 'দল' শব্দটা ঠিক চলে না। 'পার্টি' বলতে হবে। পার্টির লোক দেখলেই শরীর দিয়ে হিমস্রোত বয়ে যাবে। পার্টি বলেছে, অর্থাৎ স্বয়ং ঈশ্বর বললেও তার নড়চড় হবে না। পশ্চিমবাংলার সমাজ পার্টি সমাজ। ধর্ম নয়, জাতপাত নয় এখানে সমাজে নির্ধারক শক্তি, চালিকা শক্তি হচ্ছে পার্টি। অনেকে বলবেন, সেই ধান ভানতে শিবের গীত; কিন্তু পার্টি এবং সিপিএম যে সমার্থক এই ধারণাটা বাম আমলেই শুরু এবং এই শব্দটাকে হেলাফেলা করলে কিংবা পার্টিকে গুরুত্ব না দিলে কপালে যে দুঃখ আছে সেটা ঐ আমলেই সমাজের গভীরে প্রোথিত হয়ে যায়। ক্ষমতার যে আজ সর্বস্তরে, সর্বব্যাপী বিস্তার আমরা প্রত্যক্ষ করছি, তারও শুরুওয়াত ঐ আমল থেকেই। 

সোভিয়েত ইউনিয়নে বলা হত, পাঁচটা লোক এক জায়গায় জড়ো হলে তাঁদের মধ্যে একজন অবশ্যম্ভাবী এনকেভিডির চর। বাম আমলেও বৃহত্তর বন্ধু বৃত্তের মধ্যে একজন ছিল যে মাঝে মধ্যে এসে উদয় হত, দেঁতো হেসে কুশল জিজ্ঞাসা করত। ‘বহুদিন দেখি না’ বলে পিরিত দেখাত। আশেপাশের সব বাড়ি তো তখন সিপিএম, তাঁদের রান্নাঘরে পর্যন্ত ক্যাডারদের অবাধ যাতায়াত। সেই প্রতিবেশীরাই খবর দিত অমুক বাড়িতে নতুন কেউ এসেছে কিনা! তখন তো সিসিটিভি'ও ছিল না, পেগাসাসও ভবিষ্যতের গহ্বরে। তাই সমর্থকদের মধ্যে নিঁখুত নেটওয়ার্ক গড়ে এই নজরদারি চালানো হত। আর চারিদিকে তো তখন তাঁদেরই সমর্থক, সবাই সিপিএম। 

সুতরাং ক্ষমতা ও পার্টির এই সর্বব্যাপী প্রসার এটা আগেও ছিল। কিন্তু এই আমলে এসে তা ভয়ঙ্কর রূপ নিয়েছে। কলকাতায় মধ্যবিত্ত এলাকায় তৃণমূলের নজরদারি করার সেরকম প্রয়োজন নেই, কারণ এখানে টাকাপয়সার গল্প তুলনামূলক ভাবে কম। কিন্তু গ্রামবাংলায় পার্টির দাপট অভুতপূর্ব এক হিংস্র রূপ নিয়েছে। বাম আমলের হিংসাত্মক রাজনীতির সাথে এই আমলের পার্থক্য আছে। তখন নানুর থেকে নেতাই এবং নন্দীগ্রাম- সবকটি হত্যাকাণ্ড ছিল হয় কোনও বিরোধী রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে, নয় শাসকের ওপর বিক্ষুব্ধ জনতার বিরুদ্ধে। তারও আগে যদি যাই, অর্থাৎ মরিচঝাঁপি, বানতলা বা আনন্দমার্গী নিধন- কোনওটাই কিন্তু সিপিএমের আভ্যন্তরীণ গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের ফলে ঘটেনি। তা বলে কি সিপিএমে কোনও দলাদলি ছিল না। বিলক্ষণ ছিল, কিন্তু প্রকাশ্যে এলেও পারস্পরিক হানাহানি কদাচিৎ হত। সিপিএম শহরে ঘাড়ের ওপর নিঃশ্বাস ফেলে সবাইকে চুপ করিয়ে রাখত। গ্রামাঞ্চলে কলাটা মূলোটা দিয়ে বিরোধীদের বশে রাখত, বেগড়বাই করলে আক্রমণ করত। 

তৃণমূলের বিরুদ্ধে তো বলার মতো কোনও বিরোধী শক্তিই নেই। পঞ্চায়েত ও পুরসভাতে লাগামছাড়া সন্ত্রাস করে তারা তো রাজ্যটাকে বিরোধী-শূন্য করে দিয়েছে। তাহলে কেন এত হিংসা, প্রতিনিয়ত ধর্ষণ, খুন? যখন পার্টির বাইরে কোনও বিরোধী থাকে না, তখন পার্টির ভিতরে বিরোধী তৈরি হয়। পুরো সমাজটাই যখন দলের করায়ত্ত হয়ে যায়, তখন নিজেদের মধ্যে শুরু হয় হানাহানি। এখন প্রচুর সরকারি প্রকল্প, প্রতিটি পঞ্চায়েতে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা। এছাড়া বালি, কয়লা, গরু পাচার, অবৈধ খনন, নির্মাণের কাঁচা টাকা তো আছেই। এর জন্য শাসক দল একটি পঞ্চায়েত বা পুরসভাও হাতছাড়া করতে রাজি নয়, তাতে রক্তগঙ্গা বয়ে গেলে যাক। একমাত্র ঝালদার ঘটনা বাদ দিলে, আনিশ খানের হত্যা থেকে শুরু করে আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে হেনস্থা করা, বেহালায় দু' দিন ধরে বোমাবাজি- প্রতিটি ক্ষেত্রে তৃণমূলিরা জড়িত। তৃণমূলের বিরুদ্ধে তৃণমূল- যারা মরছে তারাও তৃণমূল, যারা মারছে তারাও তৃণমূল। 

বাম আমলের থেকে আরেকটা পার্থক্য হল- তখন সরকারি চাকরির জন্য পরীক্ষাগুলো হত (পিএসসি, এসএসসি)। নিজেদের লোক কি ঢুকত না, আলবত ঢুকত। এরা এসে তো পিএসসি তুলেই দিল; এসএসসি'তে এত কারচুপি যে পরীক্ষার্থীদের রোদ, বৃষ্টি, শীত উপেক্ষা করে মাসের পর মাস সঠিক ফলাফলের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। পুলিশ সম্পর্কে দলদাস কথাটা বহুকাল ধরেই ব্যবহৃত হয়। দশ বছর আগেও দময়ন্তি সেনের মতো মেরুদণ্ডসম্পন্ন অফিসাররা ছিলেন, এখন তাও নেই। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারের তাঁবেদার হয়ে গেছে। মানবাধিকার কমিশন, মহিলা কমিশনের অস্তিত্ব আদৌ আছে কি? একের পর এক ঘটনা ঘটে যাচ্ছে, কোথাও তো এঁদের টিকিটিও দেখা যাচ্ছে না। বিচারব্যবস্থার নিরপেক্ষতা বজায় রাখার জন্য বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় অনমনীয় ভূমিকা পালন করছেন এবং তার জন্য তাঁকে যে ভাবে হেনস্থা করা হচ্ছে তা অভুতপূর্ব। এইসব ঘটনা সম্পর্কে যে সব নিকৃষ্ট, অসংবেদনশীল মন্তব্য করা হয়েছে তাও অভুতপূর্ব। 

কেউ কেউ বলেন, দলটার মধ্যে একটা মন্থন চলছে। পুর নির্বাচনের আগে ‘এক নেতা এক পদে’র দাবি, পার্টির ওয়েবসাইটে নেতৃত্বের অনুমোদন না থাকা সত্ত্বেও বিকল্প প্রার্থী তালিকা দীর্ঘদিন থেকে যাওয়া- এর থেকে হালকা একটা আভাস পাওয়া গিয়েছিল। এরপরে অতীতের পুর নির্বাচনে গা-জোয়ারির বিরুদ্ধে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং সৌগত রায় আওয়াজ তুলেছিলেন। হাঁসখালির ঘটনা কেন ধর্ষণ তা সম্পর্কে একটা আইনি ব্যাখ্যা মহুয়া মৈত্র মুখ্যমন্ত্রীকে জানিয়ে দিয়েছেন। সৌগত রায় তো বলেই ফেলেছেন যে একজন মহিলা যেখানে মুখ্যমন্ত্রী সেখানে একজন নারীরও নিগৃহীত হওয়া উচিত নয়। সর্বোপরি কুণাল ঘোষ, যাঁর নিজের মাথার ওপরে খাঁড়া ঝুলছে, তিনি পর্যন্ত হেভিওয়েট মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে কামান দাগছেন। এসব কীসের ইঙ্গিত? ভবিষ্যৎ বলবে।

আপাতত এই দলসমাজের নাগপাশ থেকে পশ্চিমবাংলার মুক্তি পাওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই। 


No comments:

Post a Comment