Thursday, 22 September 2016

কৃষির গুরুত্ব বাড়ল

সিঙ্গুরের বার্তা
অনিন্দ্য ভট্টাচার্য

দশ বছর আধা-অভুক্ত অবস্থায় থেকে সিঙ্গুরের কৃষকেরা অবশেষে আইনি জয় পেয়েছেন। যদিও ২০০৮'এ টাটাদের ওই জমি ছেড়ে চলা যাওয়া এবং ২০১১ ও ২০১৬'র নির্বাচনে বামফ্রন্টের শোচনীয় পরাজয় জনতার আদালতে সিঙ্গুরের জয়কে নিশ্চিত করেছিল। কিন্তু আইনি গোলযোগ থেকে যাওয়ায় জিতেও যেন না জেতা - এমন একটা অবস্থায় সিঙ্গুরের কৃষকেরা পড়েছিলেন। সে গেরো কেটেছে। এখন যত তাড়াতাড়ি জমি ফেরত হবে, নিঃসন্দেহে বলাই যাবে 'সব ভাল যার শেষ ভাল'।

নিঃসন্দেহে এ এক ঐতিহাসিক জয়। তার সঙ্গে কিছু প্রশ্নের উত্থাপন ও সমাধান। সেই সব নিয়েই দু-চার ফোড়ন কাটব।

কৃষকের মান-মর্যাদা, খাওয়া-পড়া, দৈনন্দিনতাকে উপেক্ষা করে জোর জবরদস্তি তাঁদের জমিজমা কেড়ে, ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করে উন্নয়নের যে সর্বগ্রাসী মডেলটি এতদিন চালু ছিল তার শেষকৃত্য হয়েছে সিঙ্গুরের দীর্ঘস্থায়ী লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে। এ কথা সর্বপ্রথম অনস্বীকার্য। এই উচ্চারণের মধ্যে আরেকটি সমাধানের বার্তাও লুকিয়ে আছে। এতদিন কৃষিকে শিল্পের নিরিখে অসম দৃষ্টিতে দেখা হত। যেন সর্বত্র কৃষি থেকে শিল্পে উত্তরণ এক স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। যেন কৃষিকে মুছে দিয়েই শিল্পের ভবিতব্য। আর এর অর্থই 'উন্নয়ন'। এই দেখা এবার পালটাবে। কৃষি ও শিল্পকে সম-পাটাতনে দাঁড় করিয়েই বিচার করতে হবে। কৃষিকে শিল্পের তুলনায় নগণ্য করে রাখার পেছনে মূল উদ্দেশ্যটা ছিল কৃষি থেকে শিল্পে সস্তায় শ্রমিকের যোগান নিশ্চিত করা। বলা বাহুল্য, সিঙ্গুর আন্দোলনের জয় কৃষিকে অর্থনৈতিক কদর ও মূল্য দিয়েছে। দ্বিতীয়ত, চাইলে শিল্প থেকে কৃষিতেও ফেরত যাওয়া যেতে পারে। যে সব শিল্প ইতিমধ্যে পাততাড়ি গুটিয়েছে বা বন্ধ হয়েছে, সেই সব জমিতে কৃষিরও পত্তন হতে পারে। এই ভাবনাটা এবার আসবে। তৃতীয়ত, এই ঐক্যবদ্ধ কৃষক আন্দোলনের ফলে কৃষিকাজও যে একটি যূথবদ্ধ প্রক্রিয়া ও কৃষিকে একটি সামগ্রিক অর্থনৈতিক আলোকে দেখা যেতে পারে তার পরিসর তৈরি হয়েছে। জমি প্রস্তুত করা ও বীজ বোনা থেকে যে কাজের শুরু, অন্তে গিয়ে কৃষি পণ্যকে বাজারে পাঠানো - এই গোটা প্রক্রিয়াটার ওপর কৃষকেরা তাঁদের নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারেন। গড়ে উঠতে পারে বিভিন্ন কনফেডারেশন বা গিল্ড। এই ভাবনাটাও সাহস পাবে এবার।

কিন্তু সঙ্গে উঠেছে কিছু প্রশ্নও। যখন কোনও শিল্পে তালা ঝোলে, কেউ বলে না যে শিল্পের কোনও ভবিষ্যৎ নেই। কিন্তু কৃষিতে আয় কমে এলে এ প্রশ্ন বারবার তোলা হয়। এর পেছনে সেই পুরনো দৃষ্টিভঙ্গি - আসলে কৃষি থেকে তো শিল্পে যেতে হবে তাই কৃষির আর ভবিষ্যৎ নেই। অথচ, কৃষিতেও তো সংকটের করালছায়া। ছোট জমিগুলি থেকে আয় পেতে কৃষকের নাভিশ্বাস উঠছে। জনমজুরের আকাল ও মজুরি বেড়েছে। ঘরের যে ছেলেটা বা মেয়েটা কৃষিকাজে সঙ্গত দিত, সে এখন স্কুলে যায়, ফলে পারিবারিক শ্রমও অপ্রতুল। একটি ছোট বা মাঝারি শিল্প যে সংকটে ভোগে, ছোট জোতও এখন সেই গেরোয়। ফলে, জমি ফেলে ছোট জমির মালিকরা এখন শহর পাড়ি দিচ্ছে রোজগারের আশায়। এই সমস্যার দিকে অচিরে তাকাতেই হবে। তার মানে এই নয় যে কৃষির দিন শেষ, শিল্পে পাড়ি না দিলে গত্যন্তর নেই। শিল্পও আজ অনিশ্চিয়তায় জেরবার। এই বছর রমরমিয়ে উৎপাদন হল, শ্রমিকেরা ভাল বোনাস পেলেন তো পরের বছর সেই শিল্পে তালা পড়ল। এ ঘটনা আকছার ঘটছে। তাই, এক সামগ্রিক অর্থনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে ছোট ও ক্ষুদ্র কৃষকের সমস্যাকে নতুন ভাবে যুঝতে হবে। এটাও সিঙ্গুরের বার্তা।

No comments:

Post a Comment