Saturday, 24 June 2023

অন্য গণতন্ত্রের সন্ধানে

গ্রামসভা: গণতন্ত্রের সর্বোচ্চ রূপ

সুমিত


 

ভারতের প্রতিবাদ-মুখর মেয়ে কুস্তিগীররা এশিয়াড ও অলিম্পিকে প্রাপ্ত মেডেলগুলি হরিদ্বারের গঙ্গায় বিসর্জন দিতে যাবার আগে একটি বিবৃতি দেন। তাতে ওরা লিখেছিলেন, 'আমরা মেডেলগুলি কি আমাদের প্রধানমন্ত্রীর হাতে তুলে দেব? তিনি তো একদিন আমাদেরকে নিজের কন্যা বলেই অভিহিত করেছিলেন। আমাদের হৃদয় বলছে ‘না’, কেননা উনি ওর কন্যাদের সাথে কথা বলতে কখনই আসেননি। বরং, আমাদের লাঞ্ছনাকারীকে নয়া সংসদ-ভবন উদ্বোধনের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ করলেন। এমনকি ছবি তোলার জন্য উনি উজ্জ্বল, দীপ্তিমান সাদা পোশাকে ক্যামেরার সামনে দাঁড়ালেন। যেন উনি আমাদের বলতে চাইলেন, উনিই সিস্টেম। ওর এই ঔজ্জ্বল্য আমাদের ওপর কলঙ্কের ছোপ ফেলেছে।'

‘সিস্টেম’ বলতে কুস্তিগীররা কী বোঝাতে চেয়েছিলেন সেটা বিবৃতির আরেক অংশে তারা পরিষ্কার করে দিয়েছেন: 'এই উজ্জ্বল ব্যবস্থায় আমাদের জায়গা কোথায়? ভারতের কন্যাদের জায়গা কোথায়? আমরা কি কেবলই শ্লোগান অথবা ক্ষমতায় আসার জন্য নির্বাচনী কর্মসূচি?'

‘সিস্টেম’ মানে তাহলে ভারতের কঠোর পুরুষতান্ত্রিক সমাজ এবং নির্বাচন-কেন্দ্রিক শাসন ব্যবস্থা ও রাজনীতি। যার মর্মবস্তু প্রকাশ পেল কুস্তিগীরদের যৌন হেনস্থাকারী ছ’বারের সাংসদ দোর্দণ্ডপ্রতাপ ব্রিজভূষন শরণ সিং মারফত আর তাকে জামাই-আদরে সসম্মানে উদ্ধার করার আপ্রাণ প্রচেষ্টার মাধ্যমে

২৮ মে যাগ-যজ্ঞ পুজো-আর্চ্চা করে, ত্রিশূলধারী অর্ধনগ্ন কিছু সাধু-সন্ত পরিবৃত হয়ে, সোনায় মোড়া রাজদণ্ড (তামিলনাডু থেকে আনীত সেঙ্গল) হাতে নিয়ে শ্রীযুক্ত নরেন্দ্র দামোদর মোদির রাজ্যাভিষেক হল। হিন্দু রাষ্ট্রের সূচনা ঘোষিত হল হিন্দুত্ব মতাদর্শের জনক বিনায়ক দামোদার সাভারকারের ১৪১তম জন্মদিবসে। আর স্বয়ং ‘হিন্দু হৃদয়সম্রাট’ বসলেন ভারত-ভাগ্য-বিধাতার সিংহাসনেহিন্দু রাষ্ট্র যে কী হতে চলেছে তারও দৃষ্টান্ত স্থাপন করা হল ওইদিনই যখন কুস্তিগীরদের ওপর বর্বর আক্রমণ নামিয়ে আনা হল, গ্রেফতার করা হল কয়েক’শ প্রতিবাদকারীদের, নিরাপত্তার আবেষ্টনীতে ঘিরে ফেলা হল সমগ্র দিল্লিকে।

প্রশ্ন, কেন রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা হল উদারনৈতিক গণতন্ত্রের পীঠস্থান সংসদ-ভবন উদ্বোধনের নামে? প্রশ্নটা সহজ আর উত্তরটাও জানা। গভীরে না গিয়েও এটা পরিষ্কার যে নির্বাচনী গণতন্ত্রকে হাতিয়ার করেই একনায়কতন্ত্র কায়েমের লক্ষ্যপুরণ করতে চাইছে হিন্দুত্বের ধ্বজাধারীরা। মনে পড়ে, ২০১৪ সালে হিন্দুত্বের জয়যাত্রা শুরুর লগ্নে, মাত্র ৩১ শতাংশ ভোট পেয়ে প্রধানমন্ত্রী হয়ে জীবনে প্রথমবার সংসদে প্রবেশ করার মূহুর্তে তাকে সাষ্টাঙ্গে সম্মান জানিয়েছিলেন মোদি। ঠিক যেমন নতুন সংসদ-ভবন উদ্বোধনেও তিনি হোমের আগুনের সামনে সাষ্টাঙ্গ প্রণতি জানালেন।

আজকের দুনিয়ায় বেশ কয়েকটি দেশে যেখানে সংসদীয় গণতন্ত্র চালু রয়েছে সেখানে নির্বাচনে জিতেই ক্ষমতায় আসীন হচ্ছেন পৃথিবীর তাবড় তাবড় একনায়করা। এই কয়েক দিন আগেই তুরস্কে তৃতীয় বার ভোটে জিতে ক্ষমতায় রয়ে গেলেন রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোগান। ব্রাজিলের জাইর বলসোনারো এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডোনাল্ড ট্রাম্প ভোটের মাধ্যমেই ক্ষমতায় আরোহণ করেছিলেনপরে হেরে গেলেও তাদের পরাজয়ের ব্যবধান যৎসামান্য এবং অদূর ভবিষ্যতে ফিরে আসতে পারেন বলেও জল্পনা চলছে। অরুন্ধতী রায় একেই বলেছেন ‘ডেমোক্র্যাটিক ডিক্টেটরশিপ’ মুসোলিনি-হিটলারও তো ক্ষমতা দখল করেছিলেন ভোটে জয়লাভ করে। নির্বাচনী জয় তাদের একনায়ক হয়ে ওঠাকে বৈধতা দিয়েছিল। মোদি-আরএসএস সেই একই পন্থা অবলম্বন করছে।

মোদিরা বোঝেন নির্বাচন একটি সংখ্যার খেলা। এ খেলায় জো জিতেগা ওহি সিকান্দার। ইলেক্টরাল বন্ড ও কর্পোরেট ফান্ডিং, ব্যয়বহুল প্রচারের জাঁকজমক, বন্দুক বোমাবাজি বাহুবলের দাপট, হিংসার অজুহাতে পুলিশ-আধাসেনার হাতে নির্বিচার ক্ষমতা অর্পণ, তা সত্ত্বেও ব্যাপক রিগিং, জোট ঘোঁট, ভোটব্যাঙ্ক রাজনীতি ও সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ এবং ভোটের পরে ঘোড়া কেনাবেচা, দলবদল ইত্যাদি এ খেলার ফলাফল নির্ণয় করে দেয়বাজার আরও গরম করে তোলে ওপিনিয়ন কিংবা এক্সিট পোল, সেফলজি বা কোনদিকে কত পারসেন্ট সুইং, টিভির সান্ধ্য আসরে কলতলার ঝগড়া, আরও কত কি। এসবের মধ্যে সাধারণ মানুষের আশা, আকাঙ্ক্ষা, আবেগের প্রতিফলন কোথায়? প্রতি পাঁচ বছর লাইন দিয়ে একটা বোতাম টেপা ছাড়া এতে জনগণের আর কোনও সক্রিয় ভূমিকা নেই। একেই আমরা বলি গণতন্ত্র! আমাদের গর্ব আমরা ‘বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র’!

 বাতাস, সূর্য, বৃষ্টি আজ অন্য কথা বলছে।…. বাতাস বইছে নীচের থেকে।'

-  সাব-কমানদান্ত মার্কোস (জাপাতিস্তা অভ্যুত্থানের কান্ডারী)।

বীরভূমে দেওচা-পাঁচামীতে কয়লা খনি বিরোধী আন্দোলনে একের পর এক গ্রামসভা গড়ে তোলা হচ্ছে, শ্লোগান উঠেছে ‘লোকসভা না বিধানসভা, সবচেয়ে বড় গ্রামসভা।’ পুরুলিয়ার মারাং বুরু পাহাড়েও ঠুড়গা বিদ্যুৎ প্রকল্পের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের হাতিয়ার হিসাবে অন্তত ২৭টি গ্রামসভা তৈরি হয়েছে, বনাধিকার আইন (২০০৬)-কে ভিত্তি করে তাদের শ্লোগান: ‘আবওয়া দিশম, আবওয়া রাজ’।

উপরিউক্ত দু’টি শ্লোগানই প্রথম উঠেছিল ২০১৮ সালে ঝাড়খন্ডের পথালগড়ি (পাথর খোদাই) আন্দোলনে। সাঁওতাল পরগনা টেনান্সি অ্যাক্ট (১৮৭৬) ও ছোটা নাগপুর টেনান্সি অ্যাক্ট (১৯০৮)– যাতে বলা হয়েছে, আদিবাসী ভূমির সত্বাধিকারী আদিবাসীরাই- তাকে সংশোধন করে আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চল কর্পোরেট ও জমি-মাফিয়ার হাতে তুলে দেবার চক্রান্তের বিরুদ্ধে ধিকিধিকি জ্বলছিল ক্ষোভ ও বিদ্রোহের আগুন। সেই বিদ্রোহই একদিন পরিণত হয় আদিবাসী অভ্যুত্থান পথালগড়ি আন্দোলনে

বিরসা মুন্ডার জন্মস্থান অরণ্য-আবৃত খুঁটি জেলায় পথালগড়ি আন্দোলনের সূত্রপাত। ২৫ ফেব্রুয়ারি কোচাং ব্লকের একটি জায়গায় প্রায় ২০০ গ্রামের কয়েক হাজার মুন্ডা, সাঁওতাল, ওঁরাও নারী-পুরুষ জমায়েত হয়। তাদের কাঁধে তীর-ধনুক, হাতে নকল বন্দুক। বাঁশির সুরে, ধামসা-মাদলের ছন্দে, মুন্ডারি গান গেয়ে, করাম নাচ পরিবেশন করে উৎসবের মেজাজে মেতে ওঠে সবাই। শিঙা ফুঁকে সেখানেই ঘোষণা করা হয় যে তারাই, অর্থাৎ গ্রামবাসীরাই, আসল সরকার। রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, রাজ্য কিংবা কেন্দ্রীয় সরকার, কাউকেই তারা মানেন না। কেবলমাত্র গ্রামসভাই প্রকৃত সাংবিধানিক সত্তা। পঞ্চায়েত এক্সটেনশন টু শিডিউল্ড এরিয়াস্ (সংক্ষেপে পেসা) আইন অনুসারে পঞ্চম শিডিউল এলাকায় গ্রামসভার উপর আর কিছু নেই। গ্রামসভাই শেষ কথা।

দিন দু’য়েকের মধ্যেই গ্রামে গ্রামে পেসা আইনের কথাগুলি এবং গ্রামসভার কিছু আদেশ-নির্দেশ বিশাল বিশাল পাথর খন্ডের ওপর খোদাই করে গ্রামের প্রবেশপথে পুঁতে ফেলা হয়। গ্রামসভার বিনা অনুমতিতে পুলিশ, প্রশাসন, এমনকি মন্ত্রী বিধায়ক সাংসদেরও গ্রামে প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়। জানিয়ে দেওয়া হয়, জঙ্গল, জমি, পাহাড়, নদী, নির্ঝর, চারণভূমি- এই অনন্ত প্রকৃতির সব কিছুই গ্রামের সাধারণ মানুষের যৌথ অধিকারভুক্ত। এই আদেশনামা যে সংবিধান অনুযাত তা জ্ঞাপন করতে পাথরগুলির ওপর আশোকচক্র চিত্রিত করা হয়। আরও বলা হয়, পুঁজিপতিদের স্বার্থে উপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া উন্নয়ন আর মেনে নেওয়া হবে না। এ উন্নয়ন প্রকৃতিকে ধ্বংস করে, মানুষের জীবনে সর্বনাশ নিয়ে আসে।

এরপর ঝড়ের গতিতে পথালগড়ি ছড়িয়ে পড়ে চাঁইবাসা, সেরাইকেলা-খারসোয়ান, সিমদেগা, গুমলা, ঝাড়খন্ডের বিভিন্ন জেলায়। ছত্তিসগড়, মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্রের আদিবাসী গ্রামগুলিতেও একই কায়দায় আন্দোলন দানা বাঁধে। নির্বাচনী গণতন্ত্র পেরিয়ে মানুষ এক অন্য গণতন্ত্রের সন্ধান পায়যদিও রাষ্ট্রশক্তির বর্বর আক্রমণের মুখে এবং মিডিয়ায় ব্যাপক কুৎসা রটনার ফলে আন্দোলন অচিরেই স্তিমিত হয়ে যায়।

পথালগড়ি গ্রামসভাকে গণতন্ত্রের সর্বোচ্চ ও মহত্তম রূপ হিসাবে বাস্তবায়িত করতে চেয়েছিল। আমাদের ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েত ব্যবস্থায় গ্রামসভা বা গ্রাম সংসদকে যথেষ্ট মর্যাদাপূর্ণ ভূমিকা দেওয়া হয়েছে (যদিও বাস্তবে তার বিন্দুমাত্র প্রতিফলন দেখা যায় না)তবে, পঞ্চায়েতি গ্রামসভা আর পথালগড়ির গ্রামসভার মধ্যে গড়ন, বিন্যাস ও ধারণায় বিস্তর ফারাক রয়েছে। পঞ্চায়েত ব্যবস্থায় গ্রামসভা নির্বাচিত পঞ্চায়েতের অধীন এবং কেবল তার পরামর্শদাতার ভূমিকা পালন করে। এই গ্রামসভা নীতি নির্ধারণ করে না, পঞ্চায়েত-নির্ধারিত নীতি রূপায়নের পথ দেখায়। অন্যদিকে, পথালগড়ি নির্বাচনকে গুরুত্ব দেয় না, প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রের বদলে গ্রামের সকলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং সেই সিদ্ধান্তকে সকলে সমান দায়িত্ব নিয়ে সম্পাদন করার ওপর জোর দেয়। প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রে- লোকসভা, বিধানসভা, এমনকি পঞ্চায়েতেও- দলগত নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় আর ভোটে জিতে আসা প্রার্থী, তা সে যতই অপরাধ বা দুর্নীতি করুক না কেন, তার মেয়াদ শেষ হবার আগে তাকে ফিরিয়ে আনার অধিকার ভোটদাতাদের নেই। অন্য দিকে স্বশাসনের বোধে গড়ে ওঠা গ্রামসভা দল-মত, জাত-ধর্ম নির্বিশেষে গঠিত।

প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে শ্রেণি ও বর্ণ বিভক্ত সমাজে ঐক্যমত কীভাবে সম্ভব? বাস্তবে এ ধরনের যে কোনও জন-সংগঠনেই, তা গ্রামসভা হোক বা মজদুরদের নিজস্ব ইউনিয়ন, দ্বন্দ্ব-সংঘাত অনিবার্য। সেই কারণেই এগুলি হয়ে উঠতে পারে শ্রেণি-সংগ্রামকে আরও জোরদার করার মোক্ষম হাতিয়ার, ভারতের মাটি থেকে ব্রাহ্মণ্যবাদকে নির্মূল করার শক্তিশালী উপাদান।

আমাদের দেশে যেখানে আজ ক্রমাগত দ্রুত লয়ে ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ ঘটে চলেছে, আওয়াজ উঠছে ‘এক দেশ এক জাতি এক নেতা’, সেখানে একেবারে তৃণমূল স্তরে ‘আমরা সবাই রাজা’ ওই দমবন্ধকারী সর্বগ্রাসী (totalitarian) ক্ষমতাকে এক গভীর চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিতে পারে। যেখানে ভারতীয় সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তিকে অভিন্ন, একরূপী, একজাতীয় হিসাবে তুলে ধরার প্রচেষ্টা প্রবলভাবে বিদ্যমান, সেখানে গ্রামসভার মতো বিকেন্দ্রিক প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রই পারে বহুমত, বহুস্বরের মিলন ঘটাতে, বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যের ধারাকে ধারণ করতে। আশা রাখি, আমাদের ফ্যসিবাদ বিরোধী মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবীরা নির্বাচনী অংকের হিসেবনিকেশের অলস মানসিকতা ত্যাগ করে গণতন্ত্রের এই অন্য ভাবনা, অন্য রূপের দিকে তাঁদের দৃষ্টি ফেরাবেন। ক্ষমতা দখল নয়, ক্ষমতার পরিবর্তন নয়, ক্ষমতার বিনাশই ফ্যাসিস্ত শক্তির মৃত্যঘন্টা বাজাবে।

নব্বইয়ের দশকে মেক্সিকোর চিয়াপাস অঞ্চলে মায়া জনজাতির জাপাতিস্তা অভ্যুত্থানের নীতিবাণী ছিল: ‘সবকিছু সকলের জন্য, আমাদের বলে কিছু নেই।’ মনে পড়ে গেল, ছোটবেলার স্কুলপাঠ্যে কবি কামিনী রায়ের কবিতার লাইন: ‘সকলের জন্য সকলে আমরা, প্রত্যেকে আমরা প্রত্যেকের তরে।’ এটাই গণতন্ত্রের আসল পাঠ।

 

Monday, 19 June 2023

গৌরকিশোর ১০০

এক ভিন্নমুখি জগতের অধিবাসী

প্রশান্ত ভট্টাচার্য 


(২০ জুন ১৯২৩ - ১৫ ডিসেম্বর ২০০০)

নিজের বিয়েতে আমন্ত্রিতদের দু' টাকার কুপন কেটে খাবার খেতে হয়েছিল। শোনা যায়, ওঁর এই বিচিত্র সিদ্ধান্তের সহযোগী ছিলেন ওঁর বন্ধুরা। ১৯৫৬ সালে রবি ঠাকুরের জন্মদিনে কলেজ স্ট্রিটে রেজিস্ট্রি সেরে বন্ধু কবি অরুণ সরকারের বাড়িতে ফুলশয্যা। সেটা বড় কথা নয়। কথা হল, দু' টাকার কুপন কেটে নিমন্ত্রণ রক্ষা! মনে রাখতে হবে, ওঁর বিয়ের সময় দু' টাকা কিন্তু কম নয়। তবে এই ব্যবস্থাপনায় ওঁর এক কাকা বেজায় ক্ষেপে গিয়েছিলেন, পরিস্থিতি সামাল দিতে গৌরকিশোর তড়িঘড়ি নিজে একটা কুপন কিনে কাকার হাতে গুঁজে দেন। 

এই কাহিনি দিয়ে শুরু করার একটাই কারণ। আমার মনে হয়, গৌরকিশোর ঘোষ ছিলেন আজন্ম অ্যাডভেঞ্চারিস্ট। নইলে ওইভাবে আচমকা পশ্চিমবঙ্গের প্রথম পর্বত অভিযানে, গাড়োয়ালের ২১,০০০ ফুট উচ্চতার নন্দাঘুন্টির উদ্দেশে অন্যান্য অভিযাত্রীদের সঙ্গী হতে পারেন ৩৭ বছরের গৌরকিশোর! একবার ভেবে দেখুন মানুষটার ওই নাদুস-নুদুস চেহারাটা! ওটা কি পাহাড়ে পাহাড়ে চড়ে বেড়াবার চেহারা। তবু যাবেন। যাবেন ডরপুক নন বলে। শুনেছি, পাহাড়ে চড়ার বিশেষ জুতো পরা রপ্ত করতে তিনি নাকি ক্লাইম্বিং বুট পরে কলকাতার রাস্তায় হাঁটা অভ্যাস করতেন। অভিযানের সময় নিজের ভারী রুকস্যাক নিজে বয়ে শেরপাদেরও তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। সবচেয়ে বড় কথা, এই অভিযানপ্রিয় মনটা নন্দাঘুন্টির দিনলিপি এবং সেই শৃঙ্গ জয় লিখে পেটরোগা ঘরকুনো বাঙালির চিত্তে পাহাড়কে জয় করবার ক্ষুধা জাগিয়ে দিয়েছিলেন। আর গৌরকিশোর যেন তাঁর বন্ধু কবি অরুণ সরকারের 'যাও উত্তরের হাওয়া' কবিতার সেই পঙক্তি বাস্তবে রূপ দিলেন- 'প্রবল আক্ষেপে যার পঙ্গুও পাহাড়ি পথে চলে।' 

এই অভিযানপ্রিয়তা থেকেই তিনি অক্লেশে রাষ্ট্রের রাঙানো চোখ উপেক্ষা করে জেলে যান। দাঙ্গা বিধ্বস্ত অলিগলি রাজপথে হেঁটে যান ভ্রাতৃত্ববোধে; প্রসন্ন হৃদয়ের অধিবাসী হয়ে। মহামানবের ওঙ্কারে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সাক্ষী থাকতে গৌরকিশোর ছুটে যান চুয়াডাঙায়। 

সাংবাদিক গৌরকিশোর ঘোষ কত বড় এলেমদার ছিলেন, সাহিত্যিক গৌরকিশোর কতখানি মৌলিক ছিলেন- এসব বিচারের জন্য অনেক জজ সাহেব আছেন, আমার সেখানে কলকে জুটবে না। তথাপি গৌরকিশোর নিয়ে আমার একটা বাড়তি আকর্ষণ আছে। মানুষটাকে ঠিক আড়েদিঘে ফেলে মূল্যায়ন করা হয়নি। আসলে 'সুটারকিনের' অমোঘ টানে কখনই ততটা টলেননি। তোষামুদেদের ভিড়ে ছিলেন স্বরাট। ডান-বাম কোনও শিবিরের হলমার্ক জোটেনি। তবে আমি যখন গৌরকিশোরের কথা জানতে শুরু করেছি, সেই স্কুল বয়সে, তখন ওঁকে আমার সামাজিক বৃত্তের লোকেরা বলতেন সিআইএ'র চর। গৌরকিশোর সম্পর্কে বিশেষ করে সিপি়আইএমের শিবির থেকেই এই প্রচারটা ছিল। বলা হত, পাক্কা প্রতিক্রিয়াশীল। ওঁর সৃষ্ট শ্রমিক নেতা সাগিনা মাহাতোকে সরকারি কমিউনিস্টদের বেজায় অপছন্দ। সাগিনা ইনডিভিজুয়ালিস্ট। ট্রেড ইউনিয়নে সে পার্টি ম্যান্ডেট তোয়াক্কা করে না, স্বেচ্ছাচারী। তবে এসব প্রচারে সিলমোহর পড়েছিল, মার্কিন মুলুকের কয়েকজন বাদ্যযন্ত্রী একবার তাঁর বাসায় কনসার্ট করার পর। শোনা যায়, বিষয়টা এত দূর গড়ায় যে, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের তিনজন ছাত্র-প্রতিনিধি তাঁর চুনিবাবুর বাজারের ফ্ল্যাটে গিয়ে হাজির হয়েছিলেন, আঁখে দেখো হাল করতে। তাঁরা শুনেছিলেন, সিয়া'র এজেন্ট গৌরকিশোর ঘোষ অতি বিলাসবহুল জীবনযাপনে অভ্যস্ত। দামি আসবাব, আগাগোড়া কার্পেটে মোড়া বাতানুকুল ফ্ল্যাটে থাকেন। ঢুঁড়ে এসে তাঁদের ভুল ভাঙল। দেখলেন, বিবেকবান সাংবাদিকের দিনযাপন ছোট্ট ঘরে তক্তাপোষে। 

এই আবহের মধ্যে ইন্দিরা গান্ধীর জরুরি অবস্থার সময় জেলে গেলেন। বিশ্বজোড়া ঠান্ডাযুদ্ধের আবহে ইন্দিরা তখন সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের বন্ধু। তাই প্রথমে ভেবে নিয়েছিলাম, 'সিয়ার এজেন্টকে তো জেলে পুরবেই'। অর্থাৎ, জাস্টিফাই হয়েছিল সিপিএমের লাইন। শুধু তাই নয়, ততদিনে আমি জেনে গিয়েছি, এই লোকটাকে একবার নকশালরা কড়কে দিতে চেয়েছিল। উনি তখন বরানগরে থাকতেন। বরানগর বাজারের ঠিক উলটোদিকে একটা ব্যাঙ্কের ওপরতলায়। সেই সময় ১৯৭০ সালে 'রেড বুক'এর পর্বে নকশালদের কোপের মুখে পড়তে হয়েছিল তাঁকে। নকশালরা তখন শ্রেণিশত্রু খতমের লাইন প্র্যাকটিস করছে। এখানে ওখানে লাশ হয়ে যাচ্ছে অনেকে। আদর্শের দোহাই দিয়ে এই ব্যক্তি হত্যার রাজনীতি মেনে নিতে পারেনি গৌরকিশোরের সংবেদী মন ও কলম। তাঁর লেখনি তীক্ষ্ণ আক্রমণ করেছিল ওই হঠকারিতার বিরুদ্ধে। নকশালরা ডাক দিল, ‘গৌরকিশোর ঘোষের মুন্ডু চাই।’ শুভানুধ্যায়ীরা অনেকেই পরামর্শ দিয়েছিলেন বরাহনগরের মতো ‘উপদ্রুত’ এলাকা ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যেতে। অকুতোভয় স্বভাব অ্যাডভেঞ্চারিস্ট গৌরকিশোর রাজি হননি। লেখাও থামাননি। বরং রাতবিরেতে কাজকর্ম সেরে একাই হেঁটে ঢুকতেন পাড়ার রাস্তায়। গৌরকিশোরের ছোট মেয়ে সোহিনী ঘোষের এক সাক্ষাৎকারে পড়েছিলাম, ‘বাবাকে কীভাবে মারা যেতে পারে তাই নিয়ে তিনি নিজেই প্রেসিডেন্সি কলেজের লাগোয়া ভবানী দত্ত লেনে নকশাল কর্মীদের সঙ্গে এক আলোচনায় বসেন।’ এমন আলোচনা যে শেষতক ভেস্তে যাবে এটাই স্বাভাবিক। গৌরকিশোরের বেশবাস, চেহারা, ভঙ্গি ও ভারী ফ্রেমের চশমার আড়ালে মর্মভেদী দৃষ্টির মধ্যেই ছিল ছেলেভোলানো অভিঘাত। তাই এই মানুষটিই আবার নকশালদের বিরুদ্ধে পুলিশের নির্বিচার দমন নীতির প্রতিবাদে গর্জে উঠেছিলেন। ‘রূপদর্শী’র কলমে বারবার লিখেছিলেন, সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের পুলিশ যেভাবে নকশাল-নিধন চালাচ্ছে তা অমানবিক। কোনও গণতান্ত্রিক দেশে এমনটা চলতে পারে না।  

এই গৌরকিশোরকে আমার আবিষ্কার ইন্দিরা গান্ধীর জরুরি অবস্থার শেষ লগ্নে। তখনও স্কুলের গণ্ডি পেরনো হয়নি। তিনি জেল থেকে ছাড়া পান  ১৯৭৬-এর অক্টোবরে। তার কয়েক মাস বাদেই জরুরি অবস্থা কিছুটা শিথিল হল, ইন্দিরা গান্ধী সাধারণ নির্বাচনের পথে হাঁটলেন। 'আমাকে বলতে দাও' শিরোনামে গৌরকিশোর ঘোষের একটা বই তখন আমাদের হাতে হাতে ঘুরছে। আমি ওঁকে তখনই প্রথম চাক্ষুষ দেখি। এর আগে স্বদেশি করা, জেলখাটা, আন্দামান ফেরত জ্যাঠা, দাদুকে দেখেছি। কিন্তু লেখার জন্য, মতপ্রকাশের জন্য জেল খেটেছেন, এমন মানুষ সেই আমার প্রথম দেখা। তখন জেনে গিয়েছি কী লেখার কারণে জেলে গিয়েছিলেন। 

বিশিষ্ট লেখক এবং ‘কলকাতা’ পত্রিকার সম্পাদক জ্যোতির্ময় দত্ত জরুরি অবস্থার বিরুদ্ধে এক ইস্তাহারে স্বাক্ষর দেওয়ার আর্জি নিয়ে গৌরকিশোর ঘোষের কাছে গিয়েছিলেন। গৌরকিশোর সইয়ের পরিবর্তে নিজের লেখা প্রবন্ধ ‘কলকাতা’ পত্রিকাকে দেওয়ার অঙ্গীকার করেন। 'কলকাতা' পত্রিকার বর্ষা সংখ্যায় বেরয় সেই দুটি ঐতিহাসিক লেখা, ‘ইন্দিরা, দেশ, গণতন্ত্র’ এবং ‘পিতার পত্র’। এরপরই মিসা আইনে গ্রেফতার হন গৌরকিশোর। 'কলকাতা' পত্রিকায় প্রকাশিত প্রথম লেখাটিতে গৌরকিশোর লেখেন, এলাহাবাদ হাইকোর্টের রায়ে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নির্বাচন খারিজ হয়ে যাওয়ায় তিনি ‘ভয় পেলেন। এবং শেষ পর্যন্ত স্থৈর্য হারিয়ে ফেললেন। ফলে, তিনি দলের উপর নির্ভর না করে চাটুকারদের দিকে ঝুঁকে পড়লেন। এই অবস্থা গণতন্ত্রের পক্ষে অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর।’ আর দ্বিতীয়টিতে তাঁর  স্কুল পড়ুয়া পুত্র ভাস্কর ঘোষকে  লিখেছিলেন, ‘তুমি আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলে, বাবা তুমি মাথা মুড়িয়েছ কেন? আমি তোমাকে বলেছিলাম, সরকার জরুরী অবস্থা ঘোষণা করে আমার স্বাধীনভাবে লেখার অধিকার কেড়ে নিয়েছেন।… আমি সেই অন্যায়ের প্রতিবাদ জানাবার জন্যই মাথা মুড়িয়ে ফেলেছি।’ চিঠির শেষে তিনি লিখছেন, ‘গণতান্ত্রিক বাতাবরণে তোমরা বড় হয়ে ওঠো, এই কামনা।’

এই চর্চার পর্বেই গৌরকিশোর সম্পর্কে আমার ভাবনায় বদল এল। বুঝলাম, যখন বাংলার বড় বড় আন্দোলনবাজরা ঘরে ঢুকে পড়েছেন তখন গৌরকিশোর ব্যক্তিগতভাবে কলমবাজি করে জরুরি অবস্থা মোকাবিলা করতে জেলে যান। এ লোক তো তৈরি ছাঁদের নন। তারপরেই জানলাম, জেলের ভেতরেও তিনি চুপসে থাকার জিনিস নন। 

মনোবল ধাত্রী করে গণতান্ত্রিক চেতনায় তাঁর এই কারাবাস পর্বে অনেক লিখেছেন। যার অন্যতম দু’টির একটি ‘প্রধানমন্ত্রীকে খোলা চিঠি (ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলন প্রসঙ্গে গুটিকয়েক কথা)’, অন্যটি ‘দাসত্ব নয়, দাসত্ব নয়, স্বাধীনতা’। ‘মিসা’ বন্দি হিসেবে কারাগারে তাঁর ওপর নজরদারি যথেষ্ট ছিল, তা সত্ত্বেও গৌরকিশোরের ওই দুটি সরকার-বিরোধী লেখা বাইরে আসে এবং ‘জরুরি অবস্থা’ চলাকালীন নানা ভারতীয় ভাষায় অনূদিত হয়ে চারদিকে ছড়িয়েও পড়ে।

যত জানছি ততই মনে হচ্ছে, লোকটাকে তো কাল্টিভেট করতে হয়। আর সেটা করতে গিয়েই জানলাম, ১৯৩৮ সালে মাত্র ১৫ বছর বয়সে গৌরীপ্রসাদ বসুর প্রভাবে গৌরকিশোর ঘোষ ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির ছাত্র শাখায় যোগ দেন। সেই সময়ে ইংরেজ সরকার সিপিআইকে নিষিদ্ধ করেছিল। ওই সময় গৌরকিশোর একটি ধর্মঘট সংগঠিত করেন আর এই আন্দোলনই তাঁকে শাসকের দমনপীড়নের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর স্বাদ দিয়েছিল, শক্তি দিয়েছিল কর্তৃত্ববাদের মোকাবিলা করার। যখন মতবিরোধের কারণে মানবেন্দ্র রায়কে সিপিআই দল থেকে বহিষ্কার করা হয়, গৌরকিশোর তখন গৌরীপ্রসাদ বসুর সঙ্গে দলত্যাগ করেন এবং এম এন রায়ের র‌্যাডিক্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টিতে যোগ দেন, যা পরবর্তীকালে 'র‍্যাডিক্যাল হিউম্যানিস্ট অ্যাসোসিয়েশন’ হিসেবে নামকরণ হয়। তবে দল বা সংগঠনের শৃঙ্খলে বাঁধা পড়ার বান্দা ছিলেন না গৌরকিশোর। তাই কিছুদিন পর প্রত্যক্ষ রাজনীতি থেকে সরে যান। তবে রয়িস্টদের সঙ্গে তাঁর আজীবন সম্পর্ক ছিল। 

এই গৌরসন্ধানের সময়ই তাঁর 'প্রেম নেই' পড়তে গিয়ে গ্রন্থে তাঁর যে পরিচয় মুদ্রিত হয়েছিল তাতে তাজ্জব বনে যাই। সেখানে ১৯৪১-৫২ সাল পর্যন্ত তাঁর পেশার উল্লেখ ছিল: ‘প্রাইভেট টিউটর, ইলেকট্রিক মিস্ত্রি, ফিটার, ও-আর-পি রেস্কিউ সার্ভিসের খালাসি, রেস্তোরাঁর বয়, কাঠের কনট্রাক্টর, রোড সরকার, বিমান জাহাজের ফিটার, ট্রেড ইউনিয়ন অর্গানাইজার, রেশন দোকানের কেরানি, ইস্কুল মাস্টার, ওষুধ কোম্পানির এজেন্ট, ভ্রাম্যমান নৃত্য-সম্প্রদায়ের ম্যানেজার, ল্যান্ডকাস্টমস ক্লিয়ারিং কেরানি, প্রুফ রিডার, সর্বোপরি মোসাহেব।’ এবার যেন গৌরকিশোরকে বোঝাটা সহজ হয়ে গেল। একটা মানুষ তাঁর অন্তরলোকে কতটা স্বাধীন হলে এমন বিচিত্র সব পেশায় নিজেকে বাজিয়ে দেখতে পারেন! বোঝা গেল, বিভিন্ন পেশায় থাকার ফলে খুব কাছ থেকে নানা রঙের নানা বর্ণের মানুষকে দেখেছেন, তাঁদের ভালবাসা পেয়েছেন, ভালবাসা দিয়েছেন।

এ-কারণেই লোকটা আশিরনখ মানবতাবাদী। মহাত্মা গান্ধীর নোয়াখালি ছুটে যাওয়ার মতো ১৯৮৯ সালে দাঙ্গা-বিধ্বস্ত ভাগলপুরে ছুটে গিয়েছেন গৌরকিশোর। আবার ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ধূলিসাৎ হওয়ার পর শান্তি ফেরাতে কলকাতার খিদিরপুর অঞ্চলে খালি পায়ে 'চিত্ত যেথা ভয়শূন্য' হেঁটেছেন। এই গৌরকিশোর ঘোষ আর দুঁদে সাংবাদিক নন, অ্যাক্টিভিস্ট-সাংবাদিক। আজ যখন আমাদের চারদিকে চকচকে গোদি মিডিয়ার বনসাই আস্ফালন তখন গৌরকিশোর যেন এক দানব, যে বাম আমলের ভরা মরশুমে জ্যোতি বসু সম্পর্কে কটাক্ষ করে লিখতে পারেন, 'শ্রী গদিবল্লভ পুরাগুছাইত'। 

শেষ করব 'আজকাল' দিয়ে। আমাদের কলেজ জীবনে একটা আস্ত দৈনিক পত্রিকার জন্ম হল। তখন বাংলা সংবাদপত্র জগৎ নিয়ন্ত্রণ করছে 'আনন্দবাজার' ও 'যুগান্তর'। সেই সময় এল 'আজকাল'। কানাঘুষো শুনতাম, রিটায়ার্ড নকশালদের কাগজ। যাক পরে সে ভ্রম ভাঙল। প্রথম যেটা নজর কাড়ল, কাগজটাতে প্রথম দিন থেকেই, 'কাল কেমন যাবে' বা 'আজকের দিনটি' জাতীয় কোনও ভাগ্যবার্তা নেই। আমাদের মতো অদৃষ্টবাদ বিরোধীদের মহামজা। তারপর লক্ষ করলাম, খবরের বিন্যাস ও ভাষায় কোথায় যেন ভীষণ আলাদা। সেই খবর ছাপা হয় যা অন্য কাগজ গুরুত্ব দেয় না। অধিকার আন্দোলনের খবর দেওয়া, নারীবাদী আন্দোলনকে মর্যাদা দেওয়া, পাতায় জায়গা পায় পরিবেশ সচেতনতা। পাশাপাশি বাংলার মুসলিম সমাজের হাল হকিকত নিয়ে নিয়মিত কলাম। আর মহিলা সাংবাদিকদের বিনোদন বা লাইফস্টাইল ছাড়িয়ে তথাকথিত কঠিন বিটে পাঠানো। এমনকী, খবরের কাগজের অফিসে মেয়েদের নাইট শিফটে কাজ করার সুযোগ দেওয়ার ক্ষেত্রেও সক্রিয় ভূমিকা ছিল গৌরকিশোরের। ধর্ম, সম্প্রদায়, আচার, নিয়ম কোনও কিছু নিয়ে তাঁর যেমন কোনওরকম গোঁড়ামি ছিল না, তেমনই ছিল না মহিলা সাংবাদিক সম্পর্কে বস্তাপচা ধারণা। সংস্কাররহিত, উদারপন্থী, ভিন্নমুখি জগতের অধিবাসী এই মানবতাবাদী গৌরকিশোরের বেদমন্ত্র ছিল, 'I believe in love, for love and only love makes a man human.'।


Thursday, 15 June 2023

জ্যাক ডরসি হাটে হাঁড়ি ভাঙলেন

বাক স্বাধীনতা বলে আর কিছু আছে?

শোভনলাল চক্রবর্তী



২০২১ সালের নভেম্বরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তিনটি বিতর্কিত কৃষি আইন প্রত্যাহার করার কথা ঘোষণা করেন। বস্তুত, ২০২০ সালের নভেম্বর থেকে এই একই দাবি নিয়ে দিল্লি সীমানায় পথ অবরুদ্ধ করে ধর্না আন্দোলনে বসেছিলেন কৃষকরা। আন্দোলন শুরুর এক বছরের মাথায় প্রধানমন্ত্রী তিনটি বিতর্কিত আইন প্রত্যাহার করার কথা ঘোষণা করে কৃষকদের আন্দোলন শেষ করে বাড়ি ফিরে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। সংসদের শীতকালীন অধিবেশনে আনুষ্ঠানিক ভাবে তিনটি কৃষি আইন প্রত্যাহার করে নেয় মোদী সরকার।

এবার সেই আন্দোলন নিয়েই বিস্ফোরক দাবি করলেন প্রাক্তন টুইটার কর্তা জ্যাক ডরসি। ব্রেকিং পয়েন্ট’ নামে এক ইউটিউব চ্যানেলের সাক্ষাৎকারে জ্যাককে নির্দিষ্ট প্রশ্ন করা হয়েছিল, ‘কোনও বিদেশি সরকার কি তাঁর উপর কোনও ভাবে চাপ সৃষ্টি করত?’ জবাবে, গত বছরই টুইটারের পরিচালন পর্ষদ থেকে ইস্তফা দেওয়া জ্যাক বলেন, 'উদাহরণ হিসাবে ভারতের কথা ধরুন। ভারত এমন একটি দেশ, যে দেশ থেকে অনেক অনুরোধ পেতাম কৃষক আন্দোলন নিয়ে, সরকারের সমালোচক সাংবাদিকদের নিয়ে... এবং এর পরিণতি হিসাবে আমাদের হুমকি দেওয়া হত, ‘আমরা ভারতে টুইটার বন্ধ করে দেব’, ‘আমরা তোমাদের কর্মীদের বাড়িতে অভিযান চালাব’, ‘যদি নিয়ম না মানো, তাহলে আমরা বন্ধ করে দেব’... এটাই ভারত, একটি গণতান্ত্রিক দেশ!' এবং তিনি স্বৈরাচারের নিরিখে ভারতের সঙ্গে তুরস্ক ও নাইজিরিয়াকে একাসনে বসিয়ে কথাগুলি নির্দ্বিধায় বলেছেন।

ডরসির এই সাক্ষাৎকারের পর তোলপাড় পড়ে গিয়েছে দেশে। তাঁর দাবি, তিনি যখন টুইটারে ছিলেন তখন ভারত সরকারের উপর থেকে নিয়মিত চাপ আসত। কৃষক আন্দোলনের সময় যে সমস্ত হ্যান্ডল থেকে ওই আন্দোলনের খবর প্রকাশিত হচ্ছিল, সেই অ্যাকাউন্টগুলি বন্ধ করার জন্য চাপ দেওয়া হত। এ ছাড়া সরকারের সমালোচনাকারী সাংবাদিকদেরও অ্যাকাউন্ট বন্ধের জন্য চাপ আসত। যদিও ডরসির কোনও অভিযোগকেই মান্যতা দেয়নি ভারত সরকার। কেন্দ্রীয় তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী রাজীব চন্দ্রশেখর ডরসির অভিযোগের জবাব দিতে বেছে নিয়েছেন সেই টুইটারকেই! ডরসির মন্তব্যকে ‘আদ্যন্ত মিথ্যা’ বলে অভিহিত করে লম্বা টুইট করেছেন তিনি।

প্রসঙ্গত, ২০২১ সালে কৃষক আন্দোলন চলাকালীন কেন্দ্রীয় সরকার টুইটারকে প্রায় ১২০০ অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দিতে বলেছিল। কেন্দ্রের দাবি ছিল, ওই হ্যান্ডলগুলির সঙ্গে খালিস্তান আন্দোলনের সম্পর্ক রয়েছে। তারও আগে কেন্দ্র টুইটারকে ২৫০-এর বেশি অ্যাকাউন্ট নামিয়ে দিতে বলেছিল। ডরসির বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে সংযুক্ত কৃষক মোর্চার অন্যতম নেতা রাকেশ টিকায়েত সংবাদমাধ্যমে বলেছেন, 'আমরা তো বারবারই বলেছি যে আমাদের স্বর বন্ধ করতে সব চেষ্টা সরকার করেছে। টুইটারের ওপর চাপ থাকা মোটেই অস্বাভাবিক নয়। সংস্থার প্রাক্তন প্রধানের অভিযোগ শুনে আশ্চর্য হচ্ছি না।' আন্তর্জাতিক অধিকার মঞ্চগুলির অভিযোগ, করোনা-কালে এবং কৃষক আন্দোলনের সময় সরকারের বিরুদ্ধে করা একাধিক টুইট ব্লক করার মরিয়া চেষ্টা চালিয়েছিল গেরুয়া সরকার। টুইটারের অফিসে রেড করা হয়েছে। জ্যাকের সাক্ষাৎকারেও সেই কথাগুলিই উঠে এসেছে বারবার।

ভারতে টুইটারের বিরাট বাজার আছে। টুইটারের জন্য ভারত বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম বাজার- জাপান, রাশিয়া এবং তুরস্কের পরেই। ভারতে থাকতে গেলে বনিবনা করে থাকতে হবে, এটাই মোদ্দা কথা। বর্তমান টুইটার পরিচলন পর্ষদে যাঁরা রয়েছেন তাঁরা যেমনটি করছেন। আসলে গোয়াল একটাই- যার নাম গোদি মিডিয়া। মোদিকে সামনে রেখে এদের পথ চলা। মোদি যা বলেন তার দশ গুণ এরা বলে। যেমন, কৃষক আন্দোলন চলার সময়ে এরা অম্লান বদনে বলে দিল যে  কৃষকরা সব ভুয়ো, আসলে এরা খালিস্তানি। সেই নিয়ে দিনের পর দিন টেলিভিশনে প্রচার চলল। যাবতীয় দমন-পীড়নের সামনে অকুতোভয় কৃষকরা যখন ছাপ্পান্ন ইঞ্চি বুকের ছাতি নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন তখন নকল ছাপ্পান্ন ইঞ্চি পিছু হটলেন। টেলিভিশন চ্যানেলের তখন অন্যতম কাজ ছিল, কৃষকদের কথা শুনে বিল প্রত্যাহার করে মোদি কী প্রচণ্ড মহানুভবতার পরিচয় দিলেন, তার প্রচার করা।

শুধু কি টেলিভিশন, সামাজিক মাধ্যমের অনেকটাই এখনও এই মোদি ভক্তদের হাতে। এই ব্লগেই একটি লেখায় লিখেছিলাম সেই সময়ে যে কীভাবে পুলিশ প্রশাসন রাস্তা খুঁড়ে, সিমেন্টের পাকা ব্যারিকেড বসিয়ে, রাস্তায় পেরেক পুঁতে কৃষকদের দিল্লি অভিযান বানচাল করার চেষ্টা চালাচ্ছিল। মার্কণ্ডেয় নামে এক অন্ধ ভক্ত বিরাট এক মন্তব্য করেছিলেন সেই লেখার কমেন্ট বক্সে। বক্তব্য ছিল, পুলিশ সন্ত্রাসবাদীদের আটকাতে ঠিক পদক্ষেপই নিচ্ছে। এরাই টুইটারেও আছে, এদের নিয়ে সরকারের কোনও মাথাব্যথা নেই। মাথাব্যথা তাদের নিয়ে যারা জাল ছবি, জাল প্রচার, জাল বক্তব্যের বিপক্ষে বলছেন। কুস্তিগীরদের নিয়ে গোদি মিডিয়া কি প্রচার চালালো? এরা নাকি কংগ্রেসের দালাল। শুনলাম, ডরসিকেও কংগ্রেসের দালাল বলেছেন বিজেপির এক প্রগলভ মুখপাত্র! এরা নাকি টুলকিট প্রতিবাদী। এরা নাকি কৃষকদের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে আন্দোলনে নেমেছেন ইত্যাদি। কিন্তু কোনওটাতেই কাজ হল না। শেষমেশ সরকার বাধ্য হলেন কুস্তিগীরদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে।

কয়েক দিন আগে ঘটে যাওয়া বালেশ্বর'এর রেল দুর্ঘটনায় এই টুইটারেই মন্দিরকে মসজিদ বানিয়ে চলল নির্লজ্জ মিথ্যাচার। বর্তমান টুইটার কর্তৃপক্ষের উচিত ছিল ওই ভুয়ো ছবিটি তুলে দেওয়া। তাঁরা সেটি করলেন না। শেষে ওড়িশা পুলিশ টুইট করে গোটা ব্যাপারটা অত্যন্ত দুঃখজনক বলে জানায়। সেই সময় গোটা ভারতের গোদি মিডিয়ার টেলিভিশন জুড়ে চলছিল হিন্দু-মুসলমান বাইনারির আলোচনা। কেউ হিন্দুত্ববাদীদের বিপদে ফেলতে চাইছে, তাই চক্রান্ত করে এই দুর্ঘটনা- এই ছিল মোটের উপর মতামত। যে কোনও মাধ্যমের উপর হিন্দুত্ববাদীদের চাপ আছে এই সন্দেহ আমাদের ছিল, এখন ব্যাপারটা জলের মতো পরিষ্কার। ডরসির বক্তব্য আসলে আমাদের সন্দেহটাকেই সত্যি বলে প্রমাণ করল। এই দেশের এখন এমন হাল যে একজন সাংবাদিক স্রেফ প্রশ্ন করতে চাইলে, মন্ত্রী তার মালিককে ফোন করে তার চাকরি খেয়ে নিচ্ছেন। মন্ত্রী স্মৃতি ইরানিকে একটি প্রশ্ন করতে চাওয়ার অপরাধে চাকরি গেছে 'দৈনিক ভাস্কর'এর সাংবাদিকের। স্মৃতির সন্দেহ ছিল যে সাংবাদিক হয়তো কোনও অস্বস্তিকর প্রশ্ন করে বসবে।

যত ২০২৪'এর ভোট এগিয়ে আসছে ততই কিন্তু হিন্দুত্ববাদীদের নার্ভাস মনে হচ্ছে। একটু এদিক থেকে ওদিক হলেই 'এই গেল গেল সব ভেসে গেল' করে মন্ত্রী, সান্ত্রী, চাটুকার মিডিয়া সবাই মিলে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। ডরসি ইস্যুতে তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রী যে বিশাল টুইট করেছেন, তা পড়লেই ঘাবড়ানোর মাত্রাটা বোঝা যায়। এবার কি তবে উপরতলার নেতৃত্ব মণিপুরে ঘোল খেয়ে বুঝেছেন যে দাঙ্গা বড় বিপজ্জনক ব্যাপার! তাই দল কি আগ্রাসন ছেড়ে আবার সেই পুরনো 'হিন্দু খতরে মে হ্যায়', অর্থাৎ সর্বত্র কেবল চক্রান্তের গন্ধ শুঁকে বেড়ানোর তত্ত্বে ফেরত যাবে? নাকি দল দিশেহারা। বুক ফুলিয়ে মাঠে নেমে কাশ্মীর এবং মণিপুরে সব প্ল্যান কেঁচে গণ্ডুষ হয়ে যাওয়াতে হিন্দুত্ববাদীরা ঠিক কোন পথে গেলে জনগণেশের কৃপাদৃষ্টি পাওয়া যাবে তার হদিস পেতে এখনও পর্যন্ত ব্যর্থ। লালমোহনবাবু বেঁচে থাকলে এমন পরিস্থিতি বোঝাতে নিশ্চয় বলতেন, হাইলি সাসপিশাস।


Monday, 12 June 2023

পঞ্চায়েত নির্বাচনের দামামা

বাংলায় সন্ত্রাসমুক্ত ভোটপর্ব চাই

অশোকেন্দু সেনগুপ্ত


 

পঞ্চায়েত নির্বাচনের নির্ঘন্ট প্রকাশিত। অনেক মানুষের মনে হয়েছিল, বুঝি শাসক দল তথা মুখ্যমন্ত্রী  পঞ্চায়েত নির্বাচন চান না।

কেন এমন মনে হয়েছিল? বহুবিধ কারণে।

যেমন, মুখ্যমন্ত্রীর দল সমস্যায়। কেমন সমস্যা সে তো সকলে জানেন বা দেখছেন। আন্দোলনের ঢেউ উঠেছে রাজ্যে। একদিকে নিয়োগ-দুর্নীতি, অন্যদিকে ডিএ নিয়ে কর্মচারীদের আন্দোলন। অনুমান, যদি শিক্ষক আর সরকারি কর্মচারী বিপক্ষে যায় তো দল বিপদে পড়ে। তার ওপর একে একে ছোট-বড় নেতাদের সিবিআই-ইডি'র হাতে গ্রেফতারি।

এমন সময়ে দলে নেই পার্থ চট্টোপাধ্যায়। নিয়োগ দুর্নীতির অভিযোগে তিনি কারান্তরালে। সংগঠন ও দলের পরম বিশ্বস্ত এক সৈনিক ছিলেন তিনি। কেউ কেউ কটাক্ষ করছেন, দলের জন্য কী না করেছেন, সে কিনা অর্পিতা নামে কে এক মেয়ের পাল্লায় পড়ে টাকা তোলায় ব্যস্ত হল! দলেরও টাকার প্রয়োজন  আছে। তা বলে এত টাকা! বুঝলাম, এই রাজ্যে শিল্প নেই, তা বলে শিল্পপতিও নেই নাকি। আছেন তো আমলা, পুলিশরা। তার পরও! 

ওদিকে পাশে নেই কেষ্ট মণ্ডলও। সে তো প্রায় একার বাহুবলেই বীরভূমের মাটি থেকে সব সরকার-বিরোধী দলকে কার্যত দূর করে দিয়েছিল। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ কয়লা-গরু আর বালি পাচারের। সেও তিহারে, কারান্তরালে। অর্থলোভ। 

অর্থলোভ- এমন দোষ নেই কার? শুভেন্দুর নেই নাকি? তবে সে যে বিজেপি দলে নাম লিখিয়েছে। তাদের হাতেই তো ইডি, সিবিআই, আইটি দফতর। তারা দিনে রাতে কেবল ভয় দেখায়! ডাবল এঞ্জিন! অথচ, দুর্নীতি হয় না কোন রাজ্যে? পূর্বতন কর্নাটক সরকারের মন্ত্রীরা যে কোনও কাজে কমিশনই নিতেন ৪০ শতাংশ। এক ঠিকাদার এই কমিশন জোগাতে না পেরে আত্মহত্যা করেছিলেন। তা নিয়ে গোটা রাজ্য তোলপাড় হয়েছিল। আর যদি বলেন সুশাসন নেই এই রাজ্যে, তবে প্লিজ একবার যান মণিপুরে বা যোগী আদিত্যনাথের উত্তরপ্রদেশে; অথবা গুজরাতেও যেতে পারেন দেখতে কোন নিয়মে ছাড়া পেল বিলকিস বানোকে ধর্ষণের দায়ে শাস্তিপ্রাপ্ত সেই সব অপরাধীরা। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, অতএব, এ রাজ্যের অনিয়ম ও দুর্নীতিগুলি ছাড় পেয়ে যাবে।

বিরোধী দলগুলির প্রচার তুঙ্গে- শাসক দল নাকি পঞ্চায়েত ভোট চায় না। কারণ, এই সব গোলমেলে কেসে জড়িয়ে গেছে সরকার। কিন্তু প্রশ্ন, বিরোধীরা সব আসনে প্রার্থী দিতে পারবেন তো? গোলমাল নতুন নাকি? নেহাত এমন শক্তিশালী মিডিয়া ছিল না। ছিল না এত নানাবিধ সামাজিক মাধ্যম। মধ্যবিত্তরাও দলের সাথে ছিল। থাকবেই তো, পুরনো সাথী তারা। তারা যে তখনও সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের  কথা ভোলেনি। 

এই যে কর্নাটকে নির্বাচন হল, মারামারি-খুনোখুনি তো হয়নি। বিজেপি ক্ষমতা হারাল, তা সত্ত্বেও। মারামারি-খুনোখুনি আর বিহারেও হয় না। বিহার কেন, ত্রিপুরা আর পশ্চিমবঙ্গ ছাড়া কোথাও হয় না। শেখালে কে? সিপিএম! 'তুমি মহারাজ সাধু হলে আজ আমি আজ চোর বটে'! তারপর যারাই ক্ষমতায় এসেছে, এই রাজনৈতিক হিংসাকে পাখি পড়ার মতো রপ্ত করেছে। তৃণমূলের নেতা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, এবারের নির্বাচন হবে সংঘাতহীন। তাই তো হবার কথা। গণতন্ত্রে হিংসার কোনও স্থান নেই, এই কথা সকলেই মানি, অন্তত অন্য রাজ্যে। এই রাজ্যে হিংসা ছাড়া নির্বাচন- ভাবতে পারি না। কারণ, ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনের স্মৃতি এখনও দগদগে ঘায়ের মতো মনে লেপ্টে আছে।   অভিষেক বলেছেন, অভিযোগ  জানাতে হবে তাঁকে বা তাঁর দলকে। নির্বাচন কমিশনকেই বা নয় কেন? কিন্তু, হিংসাহীন রাজনীতি শুধু শাসক দলকে মানলেই হবে না, সবাইকেই মানতে হবে। তবে শাসক দলের দায়দায়িত্ব অনেক বেশি। কারণ, তাদের হাতে প্রশাসন ও পুলিশ।

অভিষেক নির্বাচনে হিংসা বর্জনের কথা বারবার বলছেন কেন? রাজনীতিতে নতুন বলে? নাকি, শাসকের শক্তি কিছুটা হ্রাস পেয়েছে, তাই খানিক আশঙ্কায় আছেন হয়তো। অথবা, স্মৃতিতে আছে ২০১৮ সালের পর ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে নিজ দলের বিধ্বংসী ফলাফল। হয়তো, ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে এবারের পঞ্চায়েত ভোটের কোনও নেতিবাচক আঁচ যাতে না পড়ে তার জন্য সতর্কতা। কিংবা, সত্যি সত্যিই তিনি হয়তো অন্যান্য রাজ্যগুলির মতো এ রাজ্যেও হিংসা বর্জিত নির্বাচনী সংস্কৃতির গোড়াপত্তন করতে চাইছেন। তবে না আঁচালে বিশ্বাস নেই। 

এই লেখাটি প্রকাশের সময় অবধি মুর্শিদাবাদে একজন রাজনৈতিক কর্মী খুন হয়েছেন ও কিছু কিছু অঞ্চলে বিচ্ছিন্ন-বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছে। সার্বিক ভাবে, বিরোধীরা মনোনয়নপত্র তুলছেন ও জমা করছেন। বরং, তাদের মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার হার শাসক দলের থেকে এখনও বেশি। গতবারের সেই তীব্রতর সন্ত্রাস এখনও দেখা যায়নি। তবে কাল কী হবে, অথবা ভোটের দিন, তা আমরা এখনও জানি না। মহামান্য আদালতও বিচার করে দেখছেন পরিস্থিতি কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে। আমরা আশাবাদী।

এই যে পরপর বাজি কারখানায় বিস্ফোরণ ঘটল! মাঠেঘাটে মিলছে বস্তাবন্দী বোমা। আমরা জানি, সরকারের যিনি প্রধান তিনিই দল চালান, তিনিই পুলিশ দেখেন। তাতে কী? জেনে বুঝেই প্রশ্ন করব, পুলিশ কিছু করে না কেন? অবশ্য পুলিশ তো এখন নির্বাচন কমিশনের কথায় চলবে। আমাদের ভরসা মানুষ। 

পঞ্চায়েত নির্বাচনে ফলাফল কী হবে তা ১৫ জুলাইয়ের পরই জানা যাবে। কিন্তু এই নির্বাচনেও রাজনৈতিক প্রশ্ন উঠছে, উঠবেও। বিজেপি এক প্রধান বিরোধী প্রতিপক্ষ। আমরা সকলে জানি, ওরা গণতন্ত্র, সংবিধান মানে না। আনতে চায় স্বৈরতন্ত্র। আমরা কেন ওদের পাতা ফাঁদে পা দেব? আমরা জোট বাঁধছি সারা দেশে ওদের হারাতে। তাই তো ভোট ভাগাভাগি রুখতে এবারের পঞ্চায়েত নির্বাচনে এই রাজ্যে প্রার্থী দিচ্ছে না আম আদমি পার্টি। 

প্রশ্ন করতেই পারেন, তবে ভোটটা দেব কাকে? উত্তর আপনার কাছেই আছে। বিজেপি নয় এমন যে কোনও প্রার্থীকে বেছে নিন।


Sunday, 4 June 2023

যাত্রী সুরক্ষাকে কাঁচকলা

রেল দুর্ঘটনা চলছে চলবে 

শোভনলাল চক্রবর্তী 



সমাজ মাধ্যমে ছবিগুলো ঘুরছে। কেউ অভ্যাসবশত হাতবদল করে দিচ্ছেন, কেউ ধড় থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া মাথাটা ভালো করে দেখছেন- না তেমন কোনও পরিতাপ নেই। আমাদের সংবেদনশীলতা কি লোপ পেল? লাশের স্তূপ দেখেও সবাই কেমন যেন নির্বিকার। প্রত্যক্ষদর্শীর মুখে শুনেছি, ১৯৮৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের ছাদ ভেঙে পড়ে চল্লিশজন ছাত্রের মৃত্যুর অভিঘাতে সারা বাংলাদেশ জুড়ে অরন্ধন পালিত হয়েছিল। আমাদের এখানে মৃত্যুর সংখ্যা তিনশো ছাড়িয়েছে, সবাই নির্বিকার, যেন কিছুই হয়নি। আসলে দিনের পর দিন ধরে নাগাড়ে মানুষকে পিটিয়ে মেরে, জ্যান্ত গায়ে আগুন লাগিয়ে দিয়ে মেরে ফেলে, চলন্ত ট্রেন থেকে ফেলে দিয়ে, গায়ের উপর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে যে হিংস্রতার উগ্র রূপে আমাদের অভ্যস্ত করে তোলা হয়েছে, সেই বীভৎস ছবিগুলোর পাশে গত শুক্রবার বালাসোরে হয়ে যাওয়া ভারতের সর্ববৃহৎ রেল দুর্ঘটনার লাশের মিছিলের ছবি বড়ই ফিকে লাগছে কি দেশের মানুষের চোখে? জানি না, তবে খুব জানতে ইচ্ছে করে।

অথচ এমনটা কি হওয়ার কথা ছিল? একটি লুপ লাইনে দাঁড়িয়ে রয়েছে একটি মালগাড়ি, সেই লাইনে কী করে হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ল আর একটি ট্রেন? এই ন্যূনতম সুরক্ষাও কি নেই ভারতীয় রেলের? সিগন্যাল কি গিয়েছিল মালগাড়ির  চালক অথবা দুর্ঘটনাগ্রস্ত ট্রেনের চালকের কাছে? কে ভুল করলেন? লাইনম্যান না সিগন্যালম্যান? কেউ কোনও উত্তর জানেন না। 

রেলমন্ত্রী পূর্বতন রেল বোর্ডের নিরাপত্তা প্রধান ছিলেন, তাঁর আমলে মোট ১৬৫টি রেল দুর্ঘটনা ঘটেছে, এই তথ্য দিচ্ছে স্বয়ং রেল মন্ত্রক। হ্যাঁ, এরপরেও তিনি মন্ত্রী। মন্ত্রীমশাই দুটি জিনিস করেছেন এখনও পর্যন্ত: এক) দুটি উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন এবং আমরা সবাই প্রায় জানি যে ওই কমিটির রিপোর্ট আসবে আমাদের স্মৃতি থেকে বালাসোর মুছে যাওয়ার পর; দুই) তিনি দুর্ঘটনাস্থলে পা দিয়েই ঘোষণা করে দিয়েছেন যে প্রতি মৃতের নিকটজনকে দশ লাখ করে টাকা দেওয়া হবে। তখনও লাশ বেরচ্ছে ট্রেনের বগি থেকে। দশ লাখ টাকা দেওয়ার জন্য এত তাড়াহুড়ো? 

কেন হল এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনা? সবার মুখে এখন একটাই প্রশ্ন। রেলের দুর্ঘটনা রোধে কি কোনও ব্যবস্থাই নেই? এদিকে সরকার দাবি করে যে, আছে। কিন্তু কাজে কোথায় দেখতে পাচ্ছি আমরা সেই দাবির সারবত্তা? অথচ সবুজ সংকেত দিয়েছিলেন খোদ রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণব। কেন্দ্রের দাবি ছিল, রেলে দুর্ঘটনা রোধে ব্রহ্মাস্ত্রের মতো কাজ করবে দুর্ঘটনা প্রতিরোধী প্রযুক্তি ‘কবচ’। করমণ্ডল এক্সপ্রেসের দুর্ঘটনার পর এখন এই ‘কবচ’ই কাঠগড়ায়। আদৌ দুর্ঘটনা রুখতে সক্ষম তো রেলের এই আধুনিক প্রযুক্তি? উঠছে প্রশ্ন। যদিও দুর্ঘটনাগ্রস্ত ট্রেনগুলিতে ‘কবচ’ ছিলই না। 

রেলের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, 'কবচ' হল মূলত একটি সংঘর্ষ বিরোধী প্রযুক্তি। দু’টি ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষ এর মাধ্যমে এড়ানো যায়। একই লাইনের উপর দু’টি ট্রেনের উপস্থিতি নির্দিষ্ট দূরত্ব থেকেই বুঝতে পারে ‘কবচ’। সেই অনুযায়ী সে আগেভাগে ট্রেনের চালককে সতর্ক করে দেয়। দু’টি ট্রেন একই লাইনে চলে এলে ইঞ্জিনে বসানো একটি যন্ত্রের মাধ্যমে অনবরত সিগন্যাল দিতে থাকে ‘কবচ’। যা চালকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করেন তিনি। শুধু তাই নয়, চালককে সতর্ক করার পরও তিনি পদক্ষেপ না করলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে রেলের গতিবেগ কমিয়ে দেয়। দুটি ট্রেনের ধাক্কা লাগার আগেই ব্রেক কষে থামিয়ে দেয়। 

২০১২ সালে ইউপিএ জমানা থেকেই ‘কবচ’-এর নির্মাণ প্রক্রিয়া চলছে। ২০১৪ সালে প্রথম এই প্রযুক্তির পরীক্ষামূলক প্রয়োগ করা হয়। ‘কবচ’ প্রযুক্তিতে রয়েছে মাইক্রোপ্রসেসর, জিপিএস এবং রেডিও যোগাযোগ ব্যবস্থা সহ বহু অত্যাধুনিক প্রযুক্তি। ২০২২ সালের মার্চ মাসে ‘কবচ’এর চূড়ান্ত ট্রায়াল হয়। খোদ রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণব একটি ট্রেনের লোকোতে বসে তা পরীক্ষা করেছিলেন। সেই পরীক্ষার সময় দু’টি লোকো একই লাইনে পরস্পরের দিকে ছুটে যায়। কিন্তু ধাক্কা লাগার আগেই একটি ইঞ্জিন অপরটির চেয়ে ৩৮০ মিটার দূরত্বে থেমে গিয়েছিল। কোনও দুর্ঘটনা ঘটেনি। তার ভিডিও টুইটারে পোস্ট করে রেলমন্ত্রী বৈষ্ণব জানান, পরীক্ষা ১০০ শতাংশ সফল। 

তবে বালেশ্বরের এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনার পরও 'কবচ' নিয়ে প্রশ্ন ওঠার কোনও কারণ নেই। কারণ, যে ট্রেনগুলিতে দুর্ঘটনা হয়েছে, তার কোনওটিতেই 'কবচ' প্রক্রিয়ার ব্যবহার শুরুই হয়নি! এ ক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠছে, এ হেন গুরুত্বপূর্ণ রুটের ট্রেনে এখনও কেন 'কবচ'এর ব্যবহার শুরু করা গেল না? দুর্ভাগ্যবশত, ভারতের মোট রেলপথের ৯৮ শতাংশ পথে এই রক্ষা'কবচ' নেই। এখন রেলের বড়বাবুরা গল্প শোনাচ্ছেন যে 'কবচ' নয়, তাঁরা আরও আধুনিক প্রযুক্তি TCAS (Train Collision Avoidance System) নিয়ে কাজ শুরু করেছেন। সমগ্র প্রকল্পের খরচ এক লাখ কোটি টাকা যার মধ্যে নাকি ২২ হাজার কোটি টাকা খরচ হয়ে গেছে। কেউ কি জানেন কোথায় সেই টাকা, ঠিক কোন রেল লাইনে খরচ হয়েছে? 

স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠছে যে, রেলপথের সুরক্ষা না বাড়িয়ে কেন ভারতীয় রেল আরও দ্রুতগামী ট্রেন চালাবার কথা ভাবছে? এ তো জেনেশুনে বিপদ ডেকে আনার সামিল। এর আগে আমাদের বুলেট ট্রেনের গল্প শোনানো হয়েছিল, কিন্তু সেই গল্পে চিঁড়ে না ভেজায় তড়িঘড়ি মাঠে নামানো হল বন্দে ভারত এক্সপ্রেস। এখন পর্যন্ত প্রত্যেকটি বন্দে ভারতের উদ্বোধন করেছেন, না রেলমন্ত্রী নন, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। বন্দে ভারতের মাধ্যমে ভারতীয় রেলের অসামান্য সাফল্য প্রমাণের তাগিদে আট বগির বন্দে ভারতও উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী, যে ট্রেন স্টেশন থেকে বেরিয়ে সোজা ঢুকে গেছে রেলশেডে। বাকি বগি তৈরি হলে চলবে ষোল বগির সেই ট্রেন।

বন্দে ভারত যে বেগে চলে বলে দাবি করা হয়, করমন্ডল এক্সপ্রেস শুক্রবার দুর্ঘটনার সময় চলছিল তার কাছাকাছি বেগে। যে লাইনে লাইনম্যানের অস্তিত্ব প্রমাণ করা যাচ্ছে না, সেই লাইনে ট্রেন চালিয়ে মানুষের জীবন নিয়ে খেলা করছে ভারতীয় রেল। শনিবার দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি জানিয়েছেন, 

প্রথমত, আপতকালীন ভিত্তিতে উদ্ধারকার্য চলবে। জানিয়ে রাখা ভালো যে, উদ্ধারকার্য বেশির ভাগটাই করে চলেছেন সাধারণ মানুষ, আশেপাশের গ্রামের মানুষ। উদ্ধারকার্যে সরকারি লোকজন সংখ্যায় অপ্রতুল। 

দ্বিতীয়ত, দোষীরা কেউ ছাড়া পাবে না। এটা ভাবতেই শিহরণ হচ্ছে। ধর্ষক ব্রিজভূষণকে জেলে পুরতে যাদের হাত পা কাঁপছে, তাদের মুখে এমন বাণী! সত্যিই স্বর্গীয়! 

তৃতীয়ত, এই দুর্ঘটনা থেকে আমাদের ভবিষ্যতে শিক্ষা নিতে হবে। এখনও হবে হচ্ছে চলছে।

দেশের সর্ববৃহৎ রেল দুর্ঘটনার দায়িত্ব কি শেষ পর্যন্ত বর্তাবে ওই অলীক লাইনম্যানের উপর? যে পদ আছে, কিন্তু ব্যক্তি নেই। ছাপ্পান্ন ইঞ্চি ছাতির কাছে আমরা এই দুর্ঘটনার দায়িত্ব নেওয়ার মতো সাহস আশা করি না। বর্তমান রেলমন্ত্রীর সঙ্গে লালবাহাদুর শাস্ত্রীর রেল দুর্ঘটনার দায়িত্ব নিয়ে পদত্যাগ করার তুলনা টেনে শাস্ত্রীজীকে ছোট করব না। এই লেখার শিরোনামটি যেন আমাদের রেল মন্ত্রকের তরফে স্লোগান। 

শেষ কথা, অনেক বাঙালি মারা গেছেন এই দুর্ঘটনায়। আমাদের কি স্মরণ করিয়ে দিতে হবে যে শোক পালনের যথেষ্ট কারণ আছে। অনুপ্রেরণা ছাড়া কি কিছুই স্বতঃস্ফূর্ত হতে পারে না?


Sunday, 28 May 2023

কর্নাটক নির্বাচনের ইঙ্গিত

নির্বাচনী সংস্কার কি জরুরি?

অশোকেন্দু সেনগুপ্ত



রাজ্য বা কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশন যে বর্তমানে আদৌ নিরপেক্ষ নয়, তা সকলেই জানেন ও বোঝেন। তা কোনও কালে ছিল কী? মানুষ বোঝে, যখন যে ক্ষমতায় থাকে/ থাকবে সে চাইবে তেমন একটি কমিশন, যে উঠতে বসতে তার কথা মেনে চলবে। মোদী আমলে সরকারের এই কুঅভ্যাসটা চোখে পড়ার মতো বেড়েছে এই যা, এবং তারা যেন গণতন্ত্রকে ধ্বংস করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। 

তার মানে এই নয় যে অন্য প্রধানমন্ত্রীদের/ মুখ্যমন্ত্রীদের (রাজ্যে রাজ্যে) আমলে সরকারি প্রভাবমুক্ত ছিল নির্বাচন কমিশন। (এই মন্তব্য থেকে বাদ দিচ্ছি দুই ইলেকশন কমিশনার  ও তাদের সময়ের কমিশনকে- একজন সুকুমার সেন ( প্রথম চিফ ইলেকশন কমিশনার) অন্যজন টি এন শেষণ। প্রতিটি সচেতন নাগরিক অন্তত এই নাম দুটি 'জীবনে ভুলবেন না'।)

আজ পরিস্থিতি এমন হয়েছে, আমরা মানতে বাধ্য যে নির্বাচন (যে কোনও স্তর বা পর্যায়ে) কার্যত হয়ে উঠেছে এক প্রহসন। মানুষ যতই গণতন্ত্রকে কাছে টানতে চায়, দল ও তার পরিচালকরা তাকে ততই দূরে ঠেলে দেয়। যত দিন যাচ্ছে ততই সংক্রামক রোগের মতো সমাজের সর্বস্তরে ছড়িয়ে পড়ছে এই ব্যাধি। দলগুলি ও তার নেতারা আস্থা হারাচ্ছে গণতন্ত্রেই। অথচ, আমরা সাধারণ মানুষ চাই গণতন্ত্র। উপায় খুঁজতে বেরিয়েছেন যাঁরা, তাঁরা সকলে চাইছেন নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কার। 

কেমন সংস্কার? অনেক প্রস্তাব আমাদের সামনে। কেউ চাইছেন ইভিএম সরুক, ফিরুক পূর্ব ব্যবস্থা, তাঁরা আস্থা হারিয়েছেন যন্ত্রে। এ কথা সত্য যে  চাইলে যন্ত্রে কারচুপি সম্ভব। তবে সেই পুরনো ব্যবস্থাও পারে না মূল সমস্যাগুলির সমাধান দিতে। অতএব, তাকাতেই হবে মূল সমস্যার দিকে। এ দেশে (বা বলা ভালো, যে কোনও গণতান্ত্রিক দেশেরই) মূল সমস্যা (সংক্ষেপে): 

১। ভোটে টাকার খেলা

২। ধর্ম ও সম্প্রদায়ভিত্তিক ভোট। 

টাকার খেলা

ভুলতে পারি না যে এই দেশটা গরিব। তবে বড়লোকের দেশেও টাকার খেলা যে নেই তা হলফ করে বলতে পারি না। টাকার খেলা না যদি থাকে তো তার জায়গা নেয় অন্য খেলা। অর্থাৎ, বলতে চাই, যদি লোভ থাকে মানুষের স্বভাবে তো কেমন করে একটা নির্বাচনের সময় তা থেকে মুক্ত হবে মানুষ। অর্থলোভ জয় যদি কেউ করেও তো তাকে লোভ দেখায় অন্য কিছু; যথা, চাকরি, নিজের ও সন্তানের ভবিষ্যৎ, ভালো-মন্দ ইত্যাদি। 

ধর্ম ও সম্প্রদায়ভিত্তিক ভোট

এও এমন এক অসুখ যা সব দেশেই আছে কম-বেশি।  আমাদের দেশেও চিরদিন তার প্রভাব দেখা গেছে বেশ কিছুটা। সম্প্রতি তার প্রভাব যেন বেশ বেড়েছে। 

এই সমস্যাগুলি থেকে বেরব কোন পথে! পথ তো অনেক। যেমন,

কেউ কেউ চাইছেন সরকারি অর্থে নির্বাচন। সরকার ইচ্ছে করলে কত কী উপায়ে অর্থ জোটাতে পারে তা দেখিয়েছেন মোদিজী। আবারও বলি, এরকম খেলা তিনি প্রথম খেলছেন এমন নয়। তবে, প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলের বদলে তিনি হিসেব দিতে হয় না এমন এক ফান্ড চালু করেছেন যা অবশ্যই অভিনব (PM Care Fund)। বলতে ইচ্ছে করে, দুর্বৃত্তের ছলের অভাব হয় না। দুর্বৃত্ত কে সে কথা নিশ্চয় সকলে বোঝেন। এই মানুষটিকে কেউ মহামানবও বলতে পারেন। তবে, এমন কূটবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের হাতে কোনওভাবে কোনও খরচের সুযোগ থাকলেই বিপদ! সরকারি অর্থে নির্বাচন আরও অনেক জটিলতার জন্ম দিতে পারে, যেমন কেউ বলতেই পারেন আমার ট্যাক্সের টাকা...। টাকার ভাগ নিয়েও প্রশ্ন উঠবে। যতদিন দেশে শিল্পপতিরা থাকবেন ততদিন খরচের অভিন্নতা কার্যত অসম্ভব। আরও পথ আছে।

যেমন, দলহীন গণতন্ত্র। সেই কবে এক মহামানব যেন আমাদের এমন পরামর্শ দিয়েছিলেন, আমরা শুনিনি, মানিনি। চেষ্টা অবশ্য করেছি যাতে অন্তত পঞ্চায়েত দলহীন হয়। আমরা তাও পারিনি। ফল কী সাংঘাতিক হতে পারে তার নমুনা দেখছি রোজ এই পশ্চিমবঙ্গে। তা বলে, দলহীন গণতন্ত্র মানা সহজ সে কথাও ভাবা যায় না। 

তাহলে পথ কি নেই? নিশ্চয় আছে। আমরা কেবল সম্ভাব্য পথ নিয়ে কথা বলতে পারি, অন্য কিছু নয়। সম্ভাব্যতা নিয়ে প্রধান সমস্যা এই যে, সেখানে উঁকি  দেয় সংখ্যাতত্ত্বও। আর কে না জানে, সংখ্যাতত্ত্বে অনেক কেরামতি দেখানো সম্ভব।

কর্নাটক নির্বাচনের পর বহু দল ও তাদের সমর্থকদের মধ্যে সাহস ও আশা বেড়েছে। মানুষ বুঝেছে মোদি অপরাজেয় নয়। অনেকের মনে হচ্ছে যেন, কেন্দ্রে তাদের দল বুঝি ক্ষমতায় এল বলে। এমনটাই মানুষ ভাবত ১৯৬৭-র আগে, ভাবত বুঝি কংগ্রেস গেল বলে। তা তেমন না ভাবলে বা তেমন না ভাবাতে পারলে আর পৃথক দল করা কেন? তেমন ভাবতেই হয়। এবং ভাবাতেই হয়। তাতে দোষ নেই। কিন্তু তার মানে এই নয় যে মানুষ তার সাধ্যের সীমা কী তা ভাববে না। 

সাধ্যের সীমা ভাবছে যারা তারাও এবার কর্নাটক নির্বাচনের ফল দেখে উৎসাহিত। এমন নয় যে কর্নাটক নির্বাচনের ফল অস্বাভাবিক বা অপ্রত্যাশিত। তবে সাধারণ নির্বাচনের ঠিক আগে তো এমন ফল নিয়ে আশা জাগে। তাই হয়েছে। উৎসাহ বেড়েছে বা জেগেছে কেবল কংগ্রেস সমর্থকদের মধ্যে, তা নয়। সব বিরোধী দলের কর্মী ও সমর্থকই প্রবল উৎসাহিত। তবু  চিন্তা বা ভয় যায় না। অনেক নিশ্চিত দেখায় বিজেপিকে। কেন? কারণ, তারা এও জানে যে বিরোধী শক্তি একজোট হতে পারবে না। তাই ৩০ শতাংশ সমর্থন এলেও তারা ক্ষমতায় থাকবে, যেমন আগে ছিল। হিসেবটা ভুল বলা যায় না। এই সত্য বদলের জন্য বিরোধী দলগুলির ঐক্য জরুরি। তবে যতই জরুরি হোক তা হবার নয়। বলে না, সাত মণ তেলও পুড়লেও রাধাও নাচবে না। তবে উপায়? 

আমরা যারা গণতন্ত্র চাই যে কোনও মূল্যে, তারা বলব, নজর দিন নির্বাচনী সংস্কারে। কেমন সংস্কার হলে মানুষের ইচ্ছার প্রতিফলন হতে পারে? ওপরে কিছু বলেছি এবং তার সমস্যাও বলেছি। তাই সেগুলি বাদ দিতেই হয়। আর রইল একমাত্র সমাধান। তা হল, সংখ্যা অনুপাতে ক্ষমতার ভাগ। এমন অঙ্ক চালু আছে কিছু দেশে। আমাদের দেশেও চালু হোক না, ক্ষতি কী? সমস্যা এতেও আছে, তবে তার সমাধান পাওয়া অসম্ভব নয়।


Thursday, 25 May 2023

মেধার নিপীড়ন

দক্ষিণপন্থার এত জনপ্রিয়তা কেন!

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য


 

গত এক দশকে প্রায় গোটা বিশ্ব জুড়েই চরমতম দক্ষিণপন্থার শুধুমাত্র উদয় হয়নি, দক্ষিণপন্থী মতাদর্শ ও তাদের একমেবোদ্বিতীয়ম নেতাদেরও তুমুল জনপ্রিয়তা লক্ষ করা গেছে। আর সে প্রবণতা যে অচিরেই পুরোপুরি বিদায় নেওয়ার নয়, তাও বেশ বোঝা যাচ্ছে। ব্রাজিলে সদ্য রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে চরম দক্ষিণপন্থী নেতা বোলসোনারো পরাজিত হয়েছেন বটে, কিন্তু তাঁর সঙ্গে বামপন্থী প্রতিদ্বন্দ্বী লুলা’র ভোট প্রাপ্তির ফারাক ছিল ১ শতাংশেরও কম। গত বছর (অক্টোবর ২০২২) ইতালিতে ফ্যাসিস্টপন্থী দল ‘ব্রাদার্স অফ ইতালি’র নেত্রী জিওর্জিয়া মেলোনি প্রধানমন্ত্রীত্বের পদে আসীন হয়েছেন। হাঙ্গেরি, সুইডেন, ফ্রান্স, তুরস্ক, রাশিয়া সহ বহু দেশ ও আমাদের উপমহাদেশেও দক্ষিণপন্থী জনপ্রিয় রাজনীতির এখন রমরমা। উগ্র জাতীয়তাবাদ, ‘বিদেশি’ শনাক্তকরণ, ধর্ম-বর্ণ-জাতি ভিত্তিক বিভাজনের রাজনীতির সহজ গাণিতিক সমীকরণে এর উত্থান। কর্নাটকের বিধানসভা নির্বাচনে উগ্র দক্ষিণপন্থা ধাক্কা খেলেও তার বিপদ যে কেটে গেছে, অথবা, আগামী কোনও নির্বাচনে তারা যে আবার সাফল্য পাবে না, তা বলার অবকাশ এখনও তৈরি হয়নি।

প্রশ্ন হল, এই উগ্র দক্ষিণপন্থী রাজনীতির এমনতর আপাত বিপুল সাফল্যের কারণ কী? এ নিয়ে একটি পুস্তক-বোমা ফাটিয়েছেন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক দর্শনের অধ্যাপক মাইকেল জে স্যান্ডেল। তাঁর সদ্য প্রকাশিত গ্রন্থ ‘The Tyranny of Merit’ নিয়ে বেশ হৈচৈ পড়ে গিয়েছে। যদিও তাঁর আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু মূলত ইউরোপ ও আমেরিকার রাজনৈতিক ও সামাজিক জগৎ, কিন্তু যে কথাগুলি তিনি পেড়েছেন তার প্রাসঙ্গিকতা আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশেও সমভাবে প্রযোজ্য।

বলা যেতে পারে, তিনি ‘মেধাতন্ত্রের নিপীড়নের’ বিরুদ্ধে একপ্রকার বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন। বিশেষ করে, গত শতকের ৮০-৯০’এর দশক থেকে বিশ্বায়ন ও উদার অর্থনীতির হাত ধরে যে মেধাতন্ত্রের উত্থান তা পিছিয়ে-পড়া, তথাকথিত অল্প-শিক্ষিত, দরিদ্র ও বিপন্ন মানুষদের দক্ষিণপন্থার পিছনে সমবেত করেছে। কারণ, বিশ্বায়নের প্রবক্তারা মনে করেছিলেন, উদারনৈতিক অর্থনীতির ফলে যে কোনও ব্যক্তি, প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে মেধার মাধ্যমে নিজ যোগ্যতায় সাফল্য অর্জন করে নিজেকে এবং দেশ ও দশ’কে এগিয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম। শুনতে ও ভাবতে কথাখানি বেশ। কিন্তু তা যে এক নিপীড়নের হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে, সে ভাবনা হয়তো তখনও মাথায় আসেনি। দেখা গেল, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা অর্জন এমন এক মহিমান্বিত স্তরে স্ফীত হয়ে উঠল যে, নামীদামী প্রতিষ্ঠানের একটি উচ্চ ডিগ্রি শুধুমাত্র অর্থনৈতিক সাফল্যের চাবিকাঠি হল না, তা আত্মগর্ব, সামাজিক সম্মান ও অর্থ কৌলিন্যেরও এক কঠিন আবহ ও বিভাজন তৈরি করল; যে আবহে তথাকথিত অল্প-শিক্ষিত ও অসাফল্যদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য ও উপেক্ষা করা এক সাধারণ প্রবণতা হয়ে দাঁড়াল। মাইকেল স্যান্ডেল তথ্য দিয়ে দেখাচ্ছেন, বিশ শতক জুড়ে আমেরিকায় মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধি পেয়েছে, কিন্তু ২০১৪ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে তা ক্রমেই কমে গেছে। এর কারণ, আত্মহত্যা, মাদক দ্রব্যের অতিরিক্ত ব্যবহার ও মদ জনিত যকৃতের রোগ। এই প্রবণতাকে কোনও কোনও সমাজবিজ্ঞানী বলেছেন ‘হতাশাপ্রসূত মৃত্যু’। অর্থাৎ, মেধাতন্ত্রের আগ্রাসনের ফলে এমন এক তীব্র বিভাজিত সমাজের জন্ম হয়েছে যেখানে অসফল বা ‘অল্প-শিক্ষিতরা’ বিষাদগ্রস্ত হয়ে আত্মবিনাশ বা আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছেন।

মোদ্দা কথায়, প্রাতিষ্ঠানিক ‘শিক্ষা’ হয়ে দাঁড়াল এমন এক অত্যাবশ্যকীয় অর্জন যা সমাজে যে কোনও ব্যক্তির সাফল্য বা অসাফল্যকে প্রায় একক ভাবে সূত্রায়িত করার যন্ত্র হয়ে উঠল। ভাবখানা এই, নিজ মেধা গুণে অর্জিত শিক্ষার জোরে যে সাফল্য-চূড়োয় পৌঁছনো গেল, তার আত্মগর্বী অধিষ্ঠানে বাকী জনসমাজ (বিশেষত অসফলেরা) আসলে খুড়কুটো। এইভাবে নির্মিত হল এক নতুন বিভাজনের আখ্যান। ইংল্যান্ডে ব্রেক্সিটের ভোট ও আমেরিকায় ট্রাম্প’এর জয় ছিল এই বিভাজনের বিরুদ্ধে নিচুতলার বিপন্ন মানুষের সটান জবাব। সে সময় ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে ব্রিটেন বেরিয়ে গেলে সাধারণ মানুষ কতটা অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে পড়তে পারেন, তা নিয়ে যখন অর্থনীতিবিদরা দেশবাসীকে সাবধান করছেন, তখন ব্রেক্সিটপন্থী এক নেতা বলেছিলেন, ‘আমাদের দেশ বিশেষজ্ঞদের ভারে যথেষ্ট ক্লান্ত।’

লেখক বলছেন, ঐতিহাসিক ঘটনাবলী দেখাচ্ছে, রাজনৈতিক সুবিচারের সক্ষমতার মধ্যে যে অন্তর্দৃষ্টি নিহিত থাকে তার সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথাগত শিক্ষায় উচ্চ নম্বর পাওয়ার কোনও সম্পর্ক নেই। উদাহরণ দিচ্ছেন, আমেরিকার দুই প্রবাদপ্রতিম রাষ্ট্রপতি জর্জ ওয়াশিংটন ও আব্রাহাম লিঙ্কনের কলেজ-ডিগ্রি পর্যন্ত ছিল না। সম্ভবত তিনি বলতে চেয়েছেন, শিক্ষা, প্রজ্ঞা ও অন্তর্দৃষ্টিকে শুধুমাত্র প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার মোড়কে আবদ্ধ রাখা যায় না। তাঁর মতে, বিশ শতকে ইউরোপ ও আমেরিকায় সমাজতান্ত্রিক ও সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক দলগুলি সংসদের গঠনকে বহুল পরিমাণে গণতান্ত্রিক করে তুলেছিল। ১৯২০ থেকে ১৯৫০ সালের মধ্যে দেখা গেছে, এক-তৃতীয়াংশ থেকে অর্ধেক সাংসদের কোনও কলেজ-ডিগ্রি ছিল না। অথচ, ২০০০ সালে এসে দেখা গেল, সংসদগুলিতে কলেজ-ডিগ্রিহীন সাংসদ একেবারেই আর নেই। যেন, পুরনোকালের অভিজাত ও সামন্তপ্রভুদের দিন আবার ফিরে এল। ডিগ্রিধারীদের এক নতুন শ্রেণি এবার দাপিয়ে বেড়াতে শুরু করল। এই বার্তা ক্রমে গেল রটি, তোমার যথাযথ ডিগ্রি থাকলে তোমার আরও আরও অর্জন-ক্ষমতা আছে, নচেৎ তুমি ব্রাত্য।

তাহলে কি শংসাপত্রের সামাজিক ও অর্থনৈতিক দড় বাড়িয়ে এক নতুন ধরনের বৈষম্যধারী সমাজ তৈরি করা হল? চিত্রটা দাঁড়াল, লেখকের ভাষায়, ‘প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার sorting যন্ত্রকে অবলম্বন করে যারা উপরে উঠে গেল, তারা নিজেদের ভঙ্গুর আত্ম-অহমিকাকে বজায় রাখতে ক্রমেই নানাবিধ শঙ্কা, ঠিকঠাক থাকার দুর্বিষহ কসরত ও মেধাকেন্দ্রিক অহংকারে নিমজ্জিত হল। যাদের পিছনে ফেলে তারা উঠল, তাদের ওপর চাপিয়ে দিল ভয়ঙ্কর অনৈতিক, এমনকি লজ্জাজনক ব্যর্থতার এক অসহনীয় বোঝা।’

খেয়াল করলে মালুম হবে, ৬০-৭০ দশকের শ্রমজীবী মানুষের উত্তাল বাম আন্দোলন ৮০-৯০’এর দশকের পর থেকে ধীরে ধীরে এলিট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের চিন্তার ঘেরাটোপে আবদ্ধ হয়ে ক্রমেই শক্তিক্ষয়ের পথে এগিয়েছে। বিশ্বায়ন ও উদার অর্থনীতির ধারণাও তখন পাকতে শুরু করেছে। ৯০-এর দশকে তা এক নির্দিষ্ট গতিপথে এগোতে থেকেছে। নতুন রাজনৈতিক-অর্থনীতির বীজ তখন অঙ্কুরিত হচ্ছে ইন্টারনেট ও ডিজিটাল বিপ্লবের মধ্য দিয়ে। তথ্য প্রযুক্তির জোয়ার এসেছে। এই নতুন উত্থানকে পুষ্ট করতে বাড়ছে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অসীম গুরুত্ব। উদার অর্থনীতির প্রবক্তারা এক নতুন মতাদর্শ নিয়ে আসছেন, যেখানে অর্জিত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার মধ্য দিয়ে যে কোনও মানুষ নিজের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ও অর্থ কৌলিন্য গড়ে নিতে পারে। সেই দৌড়ে যারা সফল হচ্ছে, তাদের হাতে এসে পড়ছে দুনিয়ার প্রাচুর্য ও অত্যাশ্চর্য বৈভব। সৃষ্টি হচ্ছে নতুন ধরনের এক তীব্র বৈষম্যমূলক সমাজ।

বাম আন্দোলনে যেহেতু তাত্ত্বিক চর্চা এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পরিসর, ফলে, বাম মতাদর্শও ঢুকে পড়ছে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থার মেধাতন্ত্রের জোয়ালে- বিশ্ববিদ্যালয়ের সেমিনার কক্ষে তা আলোচিত হচ্ছে, গবেষণাপত্র লেখা হচ্ছে, গবেষক, অধ্যাপকেরা সেই সব বিষয়ে অর্জন করছেন খ্যাতি, অর্থ ও পুরস্কার। বামেদের দৃষ্টি নিজভূম শ্রমজীবীদের জীবন-জীবিকা-আন্দোলন থেকে সরে যাচ্ছে পরবাসে মেধাতন্ত্রের সেমিনার কক্ষ ও গবেষণাপত্রে। শ্রমজীবী মানুষটি কী ভাবছেন, তার থেকেও বেশি আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে মেধাতান্ত্রিক গবেষণার ফলাফল। পিকেটি বলছেন, বাম দলগুলি ক্রমেই শ্রমজীবীদের দল থেকে বুদ্ধিজীবী ও পেশাদার এলিটদের দলে রূপান্তরিত হওয়ার কারণেই সাম্প্রতিক দশকগুলিতে বাড়তে থাকা বৈষম্যকে তারা মোকাবিলা করতে পারেনি। বামেদের এই ক্রম-বিচ্ছিন্নতা ধীরে ধীরে এমন এক জমিন বুনেছে যেখানে দাঁড়িয়ে খুব সহজেই যখন মোদি বলেন, ‘হার্ভার্ড নয়, হার্ড ওয়ার্ক চাই’, অথবা, ট্রাম্প ঘোষণা দেন, ‘আমেরিকা হল আমেরিকাবাসীদের জন্য’- তাঁদের জনপ্রিয়তার কারণগুলি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। অর্থাৎ, মেধাতন্ত্রের সাফল্য-ক্ষমতা সরাসরি দাঁড়িয়ে পড়েছে আমজনতার বিপক্ষে। কারণ, মাইকেল স্যান্ডেল’এর মতে, যদিও মেধাতান্ত্রিক সমাজ পারিবারিক উত্তরাধিকারের অধিকারকে নাকচ করে, কিন্তু তা কখনই বৈষম্যের বিরুদ্ধে নয়, বরং বৈষম্যকে বৈধতা দেয়; উপরন্তু, মেধাকে সর্বোচ্চ প্রাপ্য দেওয়ার উৎসব পালনের মধ্য দিয়ে মেধাতন্ত্র বাকী ‘অমেধাবী’দের জঞ্জাল হিসেবে গণ্য করে। শুধু আর্থিক বৈষম্যই নয়, গত চার দশকে মেধাতন্ত্র মেধাবী ধনী ও সাধারণজীবীদের মধ্যে এতটাই দূরত্ব নির্মাণ করেছে যে তারা পরস্পরের ধারেকাছেও আর থাকে না- তাদের উভয়ের বাসস্থান, কাজের এলাকা, দোকানপাট, বিনোদন-স্থান সব আলাদা, এমনকি বাচ্চাদের স্কুলগুলি পর্যন্ত। অথচ, বাজারে যে কোনও কাজের আর্থিক উচ্চমূল্য কিন্তু সর্বজন হিতায়ে উদ্দিষ্ট নয়। তা সত্ত্বেও মেধাতন্ত্র প্রচার করে- বাজার যাকে আর্থিক উচ্চমূল্য দিচ্ছে তার সামাজিক অবদানও অতএব অধিক। লেখকের মতে, তাহলে তো বলতে হয়, অল্প বেতনের স্কুল শিক্ষকদের থেকে অধিক মুনাফা অর্জনকারী ড্রাগ-ডিলাররা অনেক বেশি সামাজিক হিতে অবদান রাখেন।

আমাদের চারপাশে তাকালেও মেধাতন্ত্রের তুমুল দাপট। এদের কেউ কেউ প্রশ্ন তোলেন, তাদের দেওয়া করের টাকায় কেন সাধারণজনকে ‘খয়রাতি’ দেওয়া হবে! যেন, সাধারণজনেরা কেউ কর দেন না। তাঁরা জানেন না, আমাদের দেশের মোট কর আদায়ের ৫০ শতাংশই হল অপ্রত্যক্ষ কর, যা প্রতিটি নাগরিকের পকেট থেকে আদায় হয়। পথের ধারে চপ-তেলেভাজার দোকান দিলে মালিকের সামাজিক সম্মান থাকে না, কিন্তু সম্মান হননকারী ব্যক্তিটি যখন ব্র্যান্ডেড চপ-সিঙ্গাড়ার দোকানে চাকরির অফার পান, হ্যাট-কোট পরে সটান কাজে লেগে যান। বহুল প্রচারিত বাংলা দৈনিক এক সাধারণজনের ইউটিউব ভিডিও’র ভাষ্য হুবুহু টুকে উত্তর-সম্পাদকীয় লেখে, প্রতিবাদ-পত্র পাঠালেও রা’ কাড়ে না, বিদ্বজ্জনেরাও জেনেবুঝে চুপ মেরে যান। কারণ, মেধাতন্ত্র বরাবর দুর্বল সাধারণের ভাবনা-চিন্তাকে হরণ করে এমন কত যে চৌর্যবৃত্তি করেছে, তার ইয়ত্তা নেই। আশার কথা, আমাদের দেশে বহু রাজ্যে ‘খয়রাতির রাজনীতি’ (অন্য অর্থে, জনকল্যাণমুখি রাজনীতি) জনপ্রিয়তা পেয়েছে, দুর্বলের ঘরে বেঁচে থাকার সংস্থান পৌঁছে দেওয়ার কার্যক্রম নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু আগামী দিনে মেধাতন্ত্র দুর্বলের ওপর এমনতর জিঘাংসা নিয়ে কতদিন সবলে টিকে থাকবে, তা দেখার।   

মাইকেল জে স্যান্ডেল তাঁর গ্রন্থের শেষের দিকে মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রকে উদ্ধৃত করেছেন: ‘আমাদের সমাজকে যদি বেঁচেবর্তে থাকতে হয়, তাহলে জমাদারদের যথাযথ সম্মান ও মর্যাদা জানাতে এগিয়ে আসতে হবে। কারণ, এই জমাদাররা আমাদের জঞ্জালগুলি পরিষ্কার করে ডাক্তারদের মতোই গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেন। তাঁরা যদি জঞ্জাল পরিষ্কার না করতেন তাহলে আমাদের রোগভোগ আরও বাড়ত। সমস্ত শ্রমই মর্যাদাপূর্ণ।’       

     

Friday, 19 May 2023

শ্রীলঙ্কা-পাকিস্তানের পর বাংলাদেশ?

মন্দার আবর্তে বাংলাদেশ!

রাজীব ভট্টাচার্য



রোনা পরবর্তীকালে এশিয়ার একের পর এক দেশ অর্থনৈতিক সংকটের সম্মুখীন হয়েছে। শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তানের পরে এবার কি বাংলাদেশের পালা? কোভিড সংকট মোকাবিলায় অর্থনৈতিক ঋণের বোঝা, জ্বালানি তেলের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি, বিদেশি মুদ্রা ভাণ্ডারে টান, রফতানির দ্রুত হ্রাস ইত্যাদি সমস্যায় হঠাৎ বাংলাদেশ তীব্র সংকটে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা ভাণ্ডার (আইএমএফ)'এর ফেব্রুয়ারি ২০২৩'এর রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২১-২২'এ অন্যতম দ্রুত উন্নয়নশীল দেশের তকমা পাওয়া বাংলাদেশের অর্থনীতি বৃদ্ধি ৭.১ শতাংশ থেকে হ্রাস পেয়ে ২০২৩ সালে ৫.২ শতাংশে পৌঁছনোর আশঙ্কা। সেই কারণেই বাংলাদেশ আজ ঋণের জন্য আইএমএফ'এর দ্বারস্থ। এই আর্জির কথা মাথায় রেখে আইএমএফ ২.৫ বিলিয়ন SDR অর্থাৎ ৩.৩ বিলিয়ন ডলার মঞ্জুর করেছে এবং এটি মূলত দুটি খাতে প্রদান করা হয়েছে- সম্প্রসারিত ঋণ সুবিধা (ECF) এবং সম্প্রসারিত তহবিল সুবিধা (EFF) খাতে।

মাথাপিছু জাতীয় উৎপাদনের দ্রুতগতিতে হ্রাসকে সাধারণত বিশ্ব মন্দার প্রাথমিক সূচক (কোস ও টেরনস, ২০১৫) বলে ধরা হয়। এই জাতীয় উৎপাদনের দ্রুতগতিতে হ্রাসের সাথে যুক্ত হয় মন্থর গতিতে শিল্প বৃদ্ধি, বাণিজ্য শ্লথতা, আন্তর্জাতিক মূলধন চলাচলে নিম্নগতি ও সর্বোপরি কর্মক্ষেত্রে বেকারত্ব বৃদ্ধি। ১৯৭০ সালের পর থেকে বিশ্বে পাঁচটি মন্দা দেখা দেয়- ১৯৭৫, ১৯৮২, ১৯৯১, ২০০৯ ও সর্বশেষ ২০২০। যদিও প্রতিটি মন্দার প্রকৃতি ও ধরনই একে অন্যের চেয়ে পৃথক, তবে তাদের মধ্যে মূলগত সাদৃশ্য আছে।

করোনা পরবর্তী পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার ব্যাহত হয়েছে মূলত রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে। জ্বালানি, বিশেষ করে প্রাকৃতিক গ্যাসের সরবরাহ দ্রুত কমে আসায় বাংলাদেশের অর্থনীতিতে জ্বালানির দাম উর্ধ্বগতি প্রাপ্ত হয়েছে, ফলে মুদ্রাস্ফীতিও আকাশছোঁয়া। তাছাড়া বিশ্ব বাজারে মূল্যবৃদ্ধি, জোগান বা সরবরাহে ছেদ এবং আন্তর্জাতিক চাহিদার ক্রমাবনতি বাংলাদেশের চলতি হিসাবখাতের ঘাটতিকে প্রশস্ত করেছে, টাকার অবমূল্যায়ন ঘটিয়েছে এবং চাহিদা নিয়ন্ত্রণের ফলে দারিদ্রের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে। তাছাড়া, বিশ্ব বাজারেও একটা অর্থনৈতিক মন্দা ও অনিশ্চয়তার পরিবেশ বাংলাদেশের লেনদেনের হিসাবখাতকে বেশ চাপে রেখেছে।

সাম্প্রতিককালে কিছু তথ্যকে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক মন্দার সূচক রূপে তুলে ধরা হয়েছে। যেমন, স্থূল জাতীয় উৎপাদনের গতির শ্লথতা (৭.২ শতাংশ থেকে ৫.২ শতাংশে অবনমন), রফতানি এক লাফে ২৩.২ শতাংশ (২০২২) থেকে হ্রাস পেয়ে (-)৭.২ শতাংশ (২০২৩) নেমে আসা, ভোক্তার মূল্য সূচক (CPI) ৬ শতাংশ (২০২২) থেকে বেড়ে ৮.৯ শতাংশে (২০২৩) পৌঁছে যাওয়া। সামগ্রিক মুদ্রাস্ফীতি আনুমানিক ৯.৫ শতাংশ (বছর থেকে বছর)- যা এই দশকে সর্বোচ্চ। চলতি খাতে ঘাটতি স্থূল জাতীয় উৎপাদনের ১.১ শতাংশ (২০২১) থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪.১ শতাংশে (২০২৩)। মুদ্রা তহবিলের সঞ্চয় মার্কিন ডলারে ৪০.৭ বিলিয়ন (২০২১) থেকে কমে ২৫.৭ বিলিয়ন (২০২৩) হয়েছে। মধ্য ও দীর্ঘকালীন ঋণের বোঝা ৬.৯ বিলিয়ন (২০২১) থেকে বেড়ে আনুমানিক ১১.৭ বিলিয়নে (২০২৩) পৌঁছবে। মোট কেন্দ্রীয় সরকারি ঋণ স্থূল জাতীয় উৎপাদনের ৩৫.৬ শতাংশ থেকে বেড়ে ৪২.২ শতাংশে পৌঁছনোর আশঙ্কা।

অতীতে দারিদ্র দূরীকরণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করলেও বাংলাদেশ আজ যে চ্যালেঞ্জগুলির সম্মুখীন তার অন্যতম ক্ষেত্রগুলি হল মানবসম্পদের উন্নয়ন, জীবনযাত্রার মানের উন্নতি ও ঝুঁকি হ্রাস। তাছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ফলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি বারংবার ধাক্কা খেয়েছে এবং তার জেরে বিদেশি মুদ্রা তহবিল ক্রমশ খালি হয়েছে আর তা দরিদ্র সম্প্রদায়ের চাহিদার উপর ঋণাত্মক প্রভাব ফেলেছে।

সর্বশেষ পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের অর্থায়নের ফাঁক (Financing Gap) প্রায় ২২১৭.৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, যার মধ্যে আন্তর্জাতিক মুদ্রা ভাণ্ডার থেকে মিলবে ৪৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, বিশ্ব ব্যাঙ্কের থেকে ২৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাঙ্কের থেকে ৫০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ও বাকি ১০১৭.৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বহুপাক্ষিক ও দ্বিপাক্ষিক ঋণের মাধ্যমে আসবে। এখন প্রশ্ন হল, এই বিপুল পরিমাণ ঋণের বোঝায় জর্জরিত হয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি কি আদৌ ঘুরে দাঁড়াতে পারবে?

একদা কৃষি-নির্ভর নদী-মাত্রিক এই বাংলাদেশ দারিদ্র, খরা ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিন্তু পরবর্তীকালে শিশু মৃত্যুর হারের পতন, নারী শিক্ষার প্রসার (৭৩ শতাংশ) ও বেতনভুক নারীর কর্মক্ষেত্রে যোগদানের মাত্রা ৪ শতাংশ থেকে বেড়ে আনুমানিক ৩৫ শতাংশে পৌঁছছে। এর মূল কারণ অবশ্যই বস্ত্র শিল্পের অভাবনীয় সাফল্য। তাই অর্থনীতিবিদদের একাংশ মনে করেন যে বাংলাদেশের এই শ্লথতা একটি স্বল্পকালীন পরিস্থিতি যার মূল কারণ উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি, মুদ্রা তহবিলে টান ও ব্যাঙ্ক ব্যবস্থার ত্রুটি।‌ তবে তাঁরা মনে করেন, বাংলাদেশ শীঘ্রই এই শ্লথতা কাটিয়ে পূর্বাবস্থায় ফিরে যাবে।

বাংলাদেশের বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ ড: সেলিম রেহানের মতে, বাংলাদেশকে এই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে হলে কর কাঠামো, বৈদেশিক বাণিজ্য নীতি, মূলধনের বাজার ও মুদ্রা বিনিময় হারের দ্রুত সংস্কার প্রায়োজন, যা বহু দিন যাবৎ অসম্পূর্ণ। এইগুলির সাথে দরকার খরচ কার্যকর প্রকল্পগুলির দ্রুত সমাপ্তি। মূলধনের তহবিল ২০২২'এর প্রথম দিকে ছ' মাস আমদানির খরচের সমতুল্য হলেও তা এখন হ্রাস পেয়ে প্রায় তিন মাসের আমদানির সমান। বাংলাদেশের রফতানির দুটি প্রধান জায়গা হল ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকা। তাই, রফতানির দ্রুত সংস্কার করতে গেলে সার্ক গোষ্ঠীর দেশগুলির সাথে সাথে আঞ্চলিক বাণিজ্যে ও ASEAN (দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলি)'এর উপর বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।

লাগামহীন মুদ্রাস্ফীতি আর একটি বড় চিন্তার কারণ। কিন্তু তেলের দাম রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে বাড়লেও আশা করা যাচ্ছে যে বিশ্ব বাজারে মন্দার ফলে অদূর ভবিষ্যতে তেলের দাম কিছুটা হ্রাস পাবে।‌ তাই মুদ্রাস্ফীতি কিছুটা আয়ত্তের মধ্যে চলে আসবে। মূলধনের বিনিয়োগ যা করোনা কালে দ্রুত হ্রাস পেয়েছিল, তা পুনরুদ্ধারের পথে কিছুটা এগিয়েছে। মাথাপিছু জাতীয় আয় ২৫৯১ মার্কিন ডলার থেকে বেড়ে ২৮২৪ মার্কিন ডলারে পৌঁছনোর পথে। তাছাড়া, বাংলাদেশের ঋণ বৃদ্ধির হার প্রায় ১২ শতাংশের কাছে যা দ্রুত শিল্প অগ্রগতির সহায়ক হয়ে উঠবে বলে অনেকেই আশাবাদী।

শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তান দুই দেশই চিনের অর্থনৈতিক ঋণের জালে জড়িয়ে ক্ষতির সম্মুখীন। বাংলাদেশও কোভিড পরিস্থিতি থেকে বেরনোর জন্য চিন, আমেরিকা ও বিশ্ব ব্যাঙ্কের কাছ থেকে যে ঋণ নিয়েছে, তার সুদের বোঝা বিশাল আকার ধারণা করেছে। বাংলাদেশের অভূতপূর্ব সাফল্য আজ বিপদের সম্মুখীন। ব্যাঙ্ক প্রতারণা, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও বিভিন্ন বিদেশি সংস্থার সাথে চুক্তির ভিত্তিতে পরিকাঠামোগত সংস্কার এবং বহু উন্নয়নমূলক প্রকল্পে পাহাড়প্রমাণ দুর্নীতি (যা বহু প্রকল্পের খরচ প্রচুর বাড়িয়ে দিয়েছে)- এই সব কারণে ঋণের বোঝা বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই শ্রীলঙ্কার মতোই বাংলাদেশকে ঋণ দেওয়ার সুবাদে চিন ও আমেরিকা তার অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে বদ্ধপরিকর। ভারতের ভূমিকা নীরব দর্শকের মতো হলেও, অনেক ক্ষেত্রেই ভারত অবশ্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু প্রতিবেশী দেশ শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের পরপর অর্থনৈতিক সংকটের সম্মুখীন হওয়া কি ঈষান কোণে কোনও অশনি সংকেতের বার্তা বয়ে আনছে? এখন এটাই দেখার।