Sunday, 11 September 2022

'লক্ষ্মী ছেলে'

অন্ধকারে প্রদীপের মতো

অর্ধেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়


দেশ জুড়ে অদ্ভুত হাওয়া। সেই হাওয়ায় বাজার এখন খুব গরম। যখন-তখন যার-তার ‘ভাবাবেগে আঘাত’ ক্রমাগত লেগেই চলেছে। কথায় বলে, ‘ফুলের ঘায়ে মূর্ছা যাওয়া’। ব্যাপারটা কিছুটা যেন সে-রকমই দাঁড়িয়েছে। পান থেকে চুন খসলেই নানান মানুষের নানান ভাবাবেগ– এমনকি কিছু ক্ষেত্রে একেবারে আনকোরা ভাবাবেগ- এমনই আহত হচ্ছে যে ‘হা হতোস্মি’ বলে বসে পড়া দূরস্থান, প্রাচীন ডাকাত দলের মতো ‘হা-রে রে-রে’ অট্টহাস্যে দশদিক কাঁপিয়ে অনেকেই তেড়ে আসছেন। ব্যাপারটা প্রাথমিকভাবে হাস্যকর মনে হলেও আদতে ভয়ের, আশঙ্কার; আবার একইসঙ্গে ইতিবাচক প্রত্যাশারও। 

বেশিরভাগেরই মতে, ‘ট্রেন্ড’ হিসাবে যদি এটা চলতেই থাকে, মানে চলতে-চলতে একদিন যদি উসেইন বোল্টের সক্ষমতা অর্জন করে ফেলে, তাহলে এ-দেশ অন্ধ-বোবা-কালাদের দেশে পরিণত হবে। অথচ ভেবে দেখলে এও বোঝা যায় যে, সমাজের প্রগতির জন্য ‘ভাবাবেগে আঘাত’ অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটি আয়ুধ। যাঁদের নিয়ে আমাদের গর্ব, অর্থাৎ রামমোহন, বিদ্যাসাগরের কথাই দৃষ্টান্ত হিসাবে ধরা যেতে পারে; তাঁরা আজ কেন প্রণম্য, কেন তাঁদের সমাজ-সংস্কারক কিংবদন্তির মর্যাদা দেওয়া হয়? কেননা, তাঁরা সেই যুগে মানুষের ‘ভাবাবেগে আঘাত’ দেওয়ার কাজটিই করেছিলেন। সতীদাহ প্রথা বন্ধ করা থেকে বাল্যবিবাহ রোধ, বিধবাবিবাহ চালু, নারী শিক্ষার জন্য দিকে-দিকে বিদ্যালয় খুলে দেওয়া ইত্যাদি সবই তো সে-যুগের আমজনতার ‘ভাবাবেগে আঘাত’ করেই করা সম্ভব হয়েছিল। তার জন্য রামমোহন-বিদ্যাসাগরদের কী-কী ঝড় পোয়াতে হয়েছিল সে-কথা বলাই বাহুল্য। তাঁদের জন্যই আজ একুশ শতকে অনেকটা খোলা-হাওয়ার উন্মুক্ত পরিবেশ বাঙালি পেয়েছে। ‘ভাবাবেগে ক্রমাগত আঘাত’ দেওয়া ছাড়া এটা সম্ভব হত না। 

জানি না, কৌশিক গাঙ্গুলির নতুন ছবি ‘লক্ষ্মী ছেলে’ জনমনে শেষাবধি কী প্রভাব ফেলবে, তবে ‘ভাবাবেগে আঘাত’ না-হোক সামান্য খোঁচা যে অবশ্যই দেবে তা নিশ্চিত। এমনিতে বাংলা ছবির বাজার খারাপ। বাংলা কেন, হিন্দি-বলিউডি ছবিও মুখ থুবড়ে পড়েছে। ওটিটি'র দৌলতে বিদেশি সিরিজ আর দক্ষিণী ছবি বাজার মাত করে রেখেছে। বাঙালিত্বে সুড়সুড়ি দিয়ে বাংলা ছবি দেখার জন্য বাঙালিকে হলমুখি করার চেষ্টা প্রবল, তবুও কাজের কাজ কিছু হচ্ছে না। ‘লক্ষ্মী ছেলে’ হয়তো মোড় ঘোরাবে। 

এ-ছবিতে সুপার-স্টার বলতে যা বোঝায় সেরকম প্রায় কেউই নেই, শ্যুটিং-এর লোকেশনও আহামরি কিছু নয়, আগমার্কা ঝাড়পিট নেই, ঝিনচ্যাক আইটেম-সং বা কোমর-দোলানোও নেই, মারকাটারি ভিএফএক্স নেই; অর্থাৎ, সব মিলিয়ে বিগ-বাজেট বিনিয়োগের মতো কিচ্ছুটি নয় এ-ছবি। বরং একেবারে উলটো পথের পথিক। এমন এক ছবি যা প্রচলিত জনমতকে তীব্র শ্লেষ করে– বলে, ধর্ম নয়, বিজ্ঞান– আরও গম্ভীর হয়ে জানায়, কুসংস্কার নয়, মানবতাই হল টিকে থাকার একমাত্র পন্থা। অন্ধবিশ্বাস, নির্বিচার ভক্তিকে পুঁজি করে যেখানে দু-পয়সা কামিয়ে নেওয়ার বাসনা কালো-মেঘের মতো ঘিরে ধরেছে গোটা সমাজকে, সেখানে এক টুকরো প্রদীপ হাতে ‘লক্ষ্মী ছেলে’ ‘অমরনাথ’ নয় ‘আমির হোসেন’ হাজির হয়, সঙ্গে পায় গায়ত্রী আর শিবনাথকেও। নির্মিত হয় কাহিনির শরীর যা সমাজের রক্ত-মাংস-মজ্জাকে আশ্রয় করে গড়ে তোলে আশ্চর্য এক ছবি। একে ছায়াছবি না বলে বরং কায়াছবিই বলা যাক। ঠাসবুনোটে গল্পকে কীভাবে জ্যান্ত করে তুলতে হয় তা কৌশিক গাঙ্গুলি দেখিয়েছেন আবারও। আর এটাই ছবিটির ইউএসপি, জনমুখে যা প্রচারিত হচ্ছে। এমন একটি সময়ে এমন একটি ছবি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে– বাণিজ্যিক দিক থেকেও, অগ্রসর দৃষ্টিভঙ্গিতেও। 

এই ছবি সত্যিই আঁধারাচ্ছন্ন সময়ে প্রদীপ নিয়ে এসেছে। মনে পড়ে যায়, রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্যের ‘অন্ধকারকে অভিশাপ দেওয়ার চেয়ে…’ নিবন্ধটির কথা। কতদিন আগে পড়েছিলুম, অথচ আজও অমলিন। তিনি প্রশ্ন করেছিলেন, ‘অন্ধকার কী?’ বলেছিলেন, 'অন্ধকার তো সত্যিকারের কোনো জিনিস নয়। সে তো শুধু আলোর অভাব। যতই গাঢ় হোক, একটা জোনাকি উড়লেই ভয় কেটে যায়।' এই ছবিও তাইই। হিংসা, অসহিষ্ণুতা, কুসংস্কার, দুর্নীতি, কণ্ঠরোধের অন্ধকার সময়ে একটি প্রদীপ। এ-কথা সত্য যে প্রদীপের শক্তি কতটুকু, কতখানিই বা আলো সে ছড়িয়ে দিতে পারে, সে-তো আর বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডকে আলোকিত করার ক্ষমতা রাখে না। তবুও বাঙালির জীবন যখন নবজাগরণের আলোয় আলোকিত হয়েছিল, তখন থেকে আজ অবধি কেটে গিয়েছে অনেকটা সময়। এখন বোধকরি সে-আলো কিছুটা নিষ্প্রভ হয়েছে। আজকাল আবার পেছন দিকে টানছে নরকের হাতগুলি। সেখানে দাঁড়িয়ে কৌশিক গাঙ্গুলির এই প্রদীপটিকে ক্ষুদ্র বলে দূরে ঠেলা যায় নাকি, বরং হাত দিয়ে আড়াল করে বিষাক্ত-হাওয়ার কবল থেকে বাঁচিয়ে রাখাই কর্তব্য। হোক না সে ক্ষুদ্র প্রয়াস, তবুও সেও তো এক নতুন শুরু। 'আদিম মানুষ যদি সূর্যাস্তের পর হাত পা গুটিয়ে থাকত, শুধুই অপেক্ষা করত সূর্য ওঠার জন্য – তবে যে-তিমিরে সে ছিল, সেই তিমিরেই থেকে যেত। অন্ধকারকে জয় করার পথে প্রদীপ ছিল নেহাতই তুচ্ছ একটা ধাপ। অতটুকু আলো দিয়ে কতটুকু আঁধার কাটত? তবু সেই নগন্য সূচনাটুকুও না-হলে আমরা আজ কোথায় থাকতুম?'

তাই প্রশ্নগুলি উঠুক আবার নতুন করে। কুসংস্কারের সঙ্গে বিজ্ঞানের সংঘাত লাগুক। ভাবাবেগ আহত হয়ে শতচ্ছিন্ন হোক। মানুষ বরং নতুন প্রদীপের উষ্ণতার আশিস মাথায় ঠেকিয়ে নিক। মনে রাখতে হবে, দিনের শেষে মানুষই মানুষের শত্রু, আবার মানুষই তো মানুষের বন্ধুও। কোন্ হাত মানুষ বাড়াবে সেটা এবার মানুষকেই ঠিক করতে হবে। আমরা এইবারে দেরি না-করে ছবিটা বরং দেখেই আসি। আর কিছু না-হোক, এক অন্য রেশের স্পর্শ যে অবশ্যই লাগবে, তা গ্যারেন্টেড। কেননা এই বাজারে এমন ছবি আত্মশক্তির দোরে টোকা মারে যে!


Friday, 9 September 2022

উন্নয়নের সলিল সমাধি!

জলে ভেসে যায় বেঙ্গালুরু 

অশোকেন্দু সেনগুপ্ত


 

বেঙ্গালুরু ডুবু ডুবু, মহেঞ্জোদারো ভেসে যায়! পাকিস্তানে বন্যাতাতে কী? কিন্তু যদি আর ফিরে না পাই মহেঞ্জোদারো, ফিরে না পাই ভারতীয় সংস্কৃতির আদি ঠিকানা? মহেঞ্জোদারো–হরপ্পা একসাথে উচ্চারিত দুই নাম, একটি থাকবে, অন্যটি? তো, সেও ভাবায়। আর ভাবতে পারি না, এমন বৃষ্টিবিহীন দিনে। ওদিকে বৃষ্টিতে ডুবতে বসেছে আমাদের দেশেরই এক প্রিয় শহর।
 

শহরটার নাম বেঙ্গালুরু। আমাদের গর্বের সিলিকন সিটি বা প্রধান আইটি নগরী এ দেশে প্রধান নগর বলতে এই সেদিনও আমরা মুম্বই, চেন্নাই, দিল্লীর পাশে দেখতে অভ্যস্ত ছিলাম আমাদের অতি প্রিয় শহর কলকাতাকে। এখনও আমরা চাই বটে, কিন্তু বিশ্ব যে মানে না। তাদের কেউ পছন্দের তালিকায় রাখে হায়দ্রাবাদ, কেউ রাখে আমেদাবাদ, কেউ বলে পুনে– এখন অবশ্য অনেকেই বলে বেঙ্গালুরুর নাম। হায়দ্রাবাদকে হটিয়ে দিয়ে এখন সেই শহরই হয়েছে প্রধান আইটি নগরী। 

 

এর মধ্যে অন্য কোনও সূত্র (যথা রাজনীতি, প্রাদেশিকতা ইত্যাদি) খোঁজা বৃথা। আমরা যারা সবেতে রাজনীতি বা প্রাদেশিকতা খুঁজি, তারা দুঃখ পেতে পারি। তাদের দুঃখ কমাতেই বুঝি আসরে নেমেছেন স্বয়ং পরিবেশের দেবতা। এই দেবতা ইন্দ্র না বরুণ, জানি না। তাঁদের যেন দয়ামায়া নেই- তাই আমাদের জন্য খরা, বৃষ্টিহীন মাস, আর ওদের ভাসাতে ব্যস্ত বৃষ্টি।

 

এমন বৃষ্টি পারে নাকি একটা শহরের পতন ঘটাতে? মহেঞ্জোদারো ডুবে যাক, ভেসে যাক। সবাই জানে, আমরা আর ‘দিবে আর নিবে’ নীতি বা ধর্মনিরপেক্ষতার নীতিতে বিশ্বাস রাখি না। তাই, হে প্রভু, ডোবালে ডোবাও পাকিস্তান, কিন্তু বেঙ্গালুরুকে বাঁচাও যে কোনও মূল্যে। 

 

ওদিকে দেখছি, হায়, হায়! বেঙ্গালুরুর বড় বিত্তশালীদের ব্যবসা থেকে প্রিয় বাসস্থান সব ভেসে যায় যে। দেখ, কেমন অঝোরে ঝরেই চলেছে বারিরাশি। নগর ভাসছে। সেই ২০০৬ সালে একবার দেখেছিলাম এই শহরে এমন বৃষ্টি। মুখ্যমন্ত্রী হয়ে কংগ্রেসের বাসবপুন্নিয়া বলেছিলেন, এই শহরকে তিনি বিশ্বের সেরা শহর করে দেবেন। এমন হবে এর উন্নয়ন। এই বুঝি সেই উন্নয়ন! বলা হচ্ছে, বিগত ৯০ বছরে নাকি এই শহর এমন বৃষ্টি দেখেনি। স্কুল-কলেজ বন্ধ, ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ।

 

যে যা বলে বলুক, হোটেল মালিকদের সংগঠন, সরকার কিছু বলেনি! জানি বলবেও না। সরকার চালায় যে দল তাদের তো দল চালাতে টাকা লাগে, নাকি? আমাদের চাঁদা না পেলে ওদের চলবে? তাই তো আমরা হোটেলওয়ালারা, এ হেন পরিস্থিতিতে ঘরভাড়া বাড়িয়েছি অবিশ্বাস্য হারে। এক রাতের ভাড়া এখন মাত্র ৪০,০০০ টাকা! লাল সঙ্কেত শহর জুড়ে। আর কী বা করা যায়? সেই জমা জল যে বেরচ্ছেও না। কিন্তু কেন? নিশ্চয় দেশকে খুশি করার জন্য নয়, বা কর্নাটকের রাজনীতি বদলে দিতে নয়। যদিও যে সব অঞ্চল ভাসছে বা অতি বর্ষণে ডুবতে বসেছে, সেখানকার অধিকাংশ বিধায়ক ঘোড়া কেনাবেচার আগে থেকেই বিজেপি দলের। বেঙ্গালুরু পুরসভার আয় বিস্তর। দেশে তার আয়ের তুলনা চলে একমাত্র বৃহৎ মুম্বই পুরসভার সঙ্গে। আর রাজ্যের যা আদায় তার কম-বেশি ৬০ শতাংশ তো এই পুরসভাই দেয়।

 

তবে, নেতাদের দায় ঝেড়ে ফেলার প্রবণতা এখানেও সমান তালে বহমান। সবচেয়ে বড় সমস্যা পরিবেশ সংক্রান্ত। কেউ সেদিকে নজরই দেয়নি। দিকে দিকে গড়ে উঠেছে মল, বহুতল। বড় ব্যবসায়ীরা চাইলেই যত্রতত্র বুজিয়ে ফেলা হয়েছে পুকুর-দীঘি। খালি জায়গা পেলেই হল। শহরে গাছও কমেছে, শিশুদের খেলাধুলোর জায়গা নিত্য কমেছে (অবশ্য তাদের নানা কিসিমের শিক্ষায়তন বাড়ছে), শহরের ৭০ শতাংশের বেশি অংশ কংক্রিটের ঢালাই।  ওদিকে রাজ্য সরকার নাকি ভাবছে, নিকাশি ব্যবস্থার উন্নতি ঘটাতে তারা কিছু জলাশয়ে স্লুইস গেট বসাবে! এমন প্রতিশ্রতিও যে অতি বিপজ্জনক, কে বোঝাবে কর্তাদেরকে বোঝাবে যে শুধু শিল্প, নিয়ন্ত্রণহীন শিল্প কেবল জিডিপি বাড়ায় না, দূষণও বাড়ায়। পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য নষ্ট করে। মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশন কর্তারা যেন হঠাৎ টের পেলেন যে তাঁরা পরিবেশের গুরুত্ব অস্বীকার করে ব্যক্তিগত সুখ-সাধনায় মেতে ছিলেন এতকাল! এখন কী হবে?

 

আপাতত একে অন্যকে প্রবোধ দিচ্ছেন- কিছু হবে না, পাগল প্রকৃতি ফের শান্ত হবে।  যেমন ২০০৬-এ শান্ত হয়েছিল নিজ খেয়ালে। এবারও তাই হবে। ফের আমরা ঘোড়া কেনাবেচায় মন দেব। দিতেই হবে। তবে কিছু কাজ তো দেখাতে হবে। নতুবা লোকে মানবে কেন? এই রাজ্যের ঘোড়াদের মতির স্থিরতা কম, কবে বলবে বেশ ছিলাম আমরা কুমারস্বামী বা সিদ্ধারামাইয়ার রাজত্বে, অতএব...।

 

ব্যবসায়ীদের মতিগতিও বোঝা ভার। তবে, ভরসা এই যে তাদের একটা বড় অংশ আজও মোদী ভাইদের সঙ্গে আছে। থাকবেও। সবাই তো মোহনদাস পাই নয়। তিনিই বা কোন সাধুপুরুষ! ইনফোসিসের প্রাক্তন কর্তা তিনি, সুযোগ নেননি? যতদিন ব্যাঙ্ক ব্যবস্থা আছে, ঋণ শোধ না করার ব্যবস্থা আছে বা অর্থমন্ত্রী নির্মলা আছেন, আছে পরিবেশের আইনকানুন অগ্রাহ্য করার সুযোগ, বিদেশি ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্ট খোলার সুযোগ, অন্তত ততদিন তো তারা আছেই মোদীভাই-এর সঙ্গে। থাকতেই হবে। নইলে আয়কর, ইডি, সিবিআই ধরবে না? কংগ্রেস আমলেও তারা এসব সুযোগ পেয়েছে তবে কংগ্রেসিরা জানত না বহু কিছু। এখন মোদিজীর রাজত্বে তারাও শিখেছে অনেক। তাই ভয়, কংগ্রেস যদি তাদের অন্যভাবে পুষিয়ে দেবার চক্রান্ত করে, আমরা যদি তাদের সেই চক্রান্তের শিকার হতে দিই, তবে তো...।

 

ওসব নিয়ে পরে ভাবলেও চলবে। এখন এই বৃষ্টি বা জলদস্যুর হাত থেকে উদ্ধার পাওয়াটাই বড় ব্যাপার। তারপর একদিন নিশ্চয় বলতে পারব যে, 'এমন শহরটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি’- অন্তত যদি হোটেলের ঘরভাড়া দেখেন। যদিও জানি, সব দেশেই এক নিয়ম। বরং, চলো গান করি– এমন উন্নয়ন দেখি নাই কভু, শুনি নাই প্রভু!

 



Wednesday, 31 August 2022

শেয়ার বাজারের অর্থনীতি

আসতে পারে নতুন বুল রান

পার্থ  হালদার


গত বছরের অক্টোবর মাসে নতুন উচ্চতায় পৌঁছনোর পর এই বছরের জুলাই মাস পর্যন্ত শেয়ার বাজার ক্রমেই নিম্নমুখি হয়েছে। এর কারণ হিসাবে বলা যায়, চড়া মুদ্রাস্ফীতি, সুদের হার বৃদ্ধির সম্ভাবনা ও তার আগের বছরগুলিতে শুধু বেলাগাম অর্থ জোগানের কারণে বাজারের অস্বাভাবিক উত্থান। তাই, বাজারের পতন অস্বাভাবিক ছিল না। তার উপর রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি ও ভোজ্য তেলের হঠাৎ দাম বৃদ্ধি সারা পৃথিবীর অর্থনীতির কাছে বড়  চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। গত এক বছরে আমেরিকার ফেড ও অন্যান্য সেন্ট্রাল ব্যাঙ্কগুলি সুদের হার বৃদ্ধি করতে থাকে ও বাজারে অতিরিক্ত অর্থ জোগান কমতে থাকায় শেয়ার বাজারে বড়রকম পতন দেখা দেয়। এই পতন জুলাই মাস পর্যন্ত চলার পর মুদ্রাস্ফীতি ধীরে ধীরে কমতে শুরু করে এবং ওপেক ও অন্যান্য তেল উৎপাদনকারী সংস্থাগুলি তেল উৎপাদন বৃদ্ধি করায় জ্বালানি তেলের দাম নিম্নমুখি হয়। উপরন্তু, ইন্দোনেশিয়া পাম তেল রফতানি আবার শুরু করায় খাদ্যদ্রব্যের মুদ্রাস্ফীতি ধীরে ধীরে কমতে শুরু করে। এছাড়াও, শ্রীলংকার আর্থিক সংকটের জন্য ভারতের রফতানি সে দেশে বাধাপ্রাপ্ত হলে ভারতীয় অর্থনীতিতে তার প্রভাবও পড়েছে।

এত কিছুর মধ্যেই জুলাই মাসের শেষ দিক থেকে ধীরে ধীরে পৃথিবীর সমস্ত শেয়ার বাজারই ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে। তার প্রভাব ভারতীয় শেয়ার বাজারেও পড়ে। জুলাইয়ের মধ্য ভাগ থেকে মাথা তুলতে শুরু করে ভারতীয় শেয়ার সূচক। এবারের উত্থানে যেটা লক্ষণীয়, প্রথমেই ভালো প্রদর্শন করেছে অটো শেয়ারগুলি। মাহিন্দ্রা অ্যান্ড মাহিন্দ্রা, টাটা মোটর্স, হুন্ডাই প্রভৃতি কোম্পানিগুলি একের পর এক ইলেকট্রিক কার বাজারে আনতে শুরু করেছে। ফলে, আগামী দিনে ভারতকে অনেক কম পরিমাণ জ্বালানি তেল আমদানি করতে হবে। জ্বালানি তেল আমদানিকারী রাষ্ট্র হিসেবে ভারতের কাছে এটি একটি বড় সুখবর। এতে একদিকে যেমন পরিবেশ দূষণমুক্ত হবে, তেমনই বাঁচবে বৈদেশিক মুদ্রা। অটো সেক্টর'এর সঙ্গে সঙ্গে ভালো প্রদর্শন করেছে ক্যাপিটাল গুডস সেগমেন্ট। 

ভারতীয় অর্থনীতির কাছে আর একটি সুখবর হল, আগামী অক্টোবর মাস থেকে ৫জি  পরিষেবার সূত্রপাত। এই পরিষেবা দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিজ্ঞান ও বাণিজ্যিক জগৎকে আরও গতিশীল করে তুলবে, যার প্রভাব পড়তে চলেছে শেয়ার বাজারে। টাকার দামের পতন আপাতত বন্ধ হওয়ার কারণে ভারতীয় মুদ্রাবাজার এখন স্থিতিশীল। এই অবস্থা আগামী দিনে বজায় থাকলে অবশ্যই তার সুপ্রভাব শেয়ার বাজারে  আসতে চলেছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে মন্দার আশঙ্কা এই মুহূর্তে বেশ কম। তাই সারা পৃথিবীব্যাপী মুদ্রাস্ফীতি কমা শুরু হলে ও উপরিউক্ত সমস্ত প্রভাবগুলি আসতে শুরু করলে তার উপর ভর করে শুরু হতে পারে নতুন বুল রান। গত দু' মাসে আমাদের দেশেও ভোজ্য তেল ও শাকসবজির দাম কিছুটা কমায় আশার আলো দেখতে শুরু করেছে ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। ফলে, খুব তাড়াতড়ি চড়া ভাবে সুদের হার বাড়ার সম্ভাবনাও কম। সারা বিশ্বের সেন্ট্রাল ব্যাঙ্কের চোখ এখন আগামী দিনে দ্রব্যমূল্যের স্থিতিশীলতার উপর।

এসবের মধ্যে অবশ্যই কিছু আশঙ্কাও থেকে গেছে। আদানি গ্রুপের ব্যাঙ্ক লোন নিয়ে সতর্ক করেছে স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড পুওর। কোনও কারণে এই ব্যাঙ্ক ঋণ মন্দা অবস্থার মধ্যে পড়লে তার পরিণতি হতে পারে মারাত্মক এবং ঋণ নিয়ে কোনও কোম্পানি অধিগ্রহণ কখনই ভালো বাণিজ্যিক সিদ্ধান্ত নয়। অন্যদিকে চীন এবং তাইওয়ানের মধ্যে ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক টানাপোড়েন শেয়ার বাজারের উত্থানে বাধা সৃষ্টি করতে পারে। অগস্ট মাসের ফেড'এর মিটিং'এ ফেড চেয়ারম্যান জেরম পাভেল জানিয়েছেন যে, আমেরিকাতে সুদের হার দীর্ঘদিন বেশি থাকতে পারে। তাই বহু আর্থিক বিশেষজ্ঞ এখনই বাজার বাড়ার সম্ভাবনা না দেখলেও অনেকের মতে, উঁচু সুদের হার আগামী দিনে সেরকম কোনও প্রভাব ফেলবে না। হয়তো আগামী জানুয়ারিতেই নতুন উচ্চতায় পৌঁছবে শেয়ার সূচক। তবে বিনিয়োগের কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে বিনিয়োগ বিশেষজ্ঞের মতামত নেওয়া জরুরি।

 

Tuesday, 23 August 2022

দুর্নীতির রাজনীতি

চরম বৈষম্য ও বঞ্চনার খেলা

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য


 

দেখাই যাচ্ছে, কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী, মুম্বই থেকে ইম্ফল- দেশের সরকার ইডি, সিবিআই, আয়কর দফতর, এনআইএ, ইউএপিএ ইত্যাকার নানাবিধ এজেন্সি, আইন ও উর্দিধারীদের নিয়ে বিরোধীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। যেন, যা কিছু অপরাধ, যা কিছু দুর্নীতি, সব তথাকথিত বিরোধী দল বা ব্যক্তিদেরই অপকর্ম মাত্র। এইসব কাজে শাসকদের কেউ কোথাও ‘যুক্ত নয়’! মনে পড়ে যাচ্ছে, ১৯৭৫ সালে জরুরি অবস্থা জারির প্রাক্কালেও এই ছবিটাই বহুলাংশে দেখা গিয়েছিল।

ঘটনা এই যে, আমাদের দেশের কোনও রাজনৈতিক দলই ধোয়া তুলসিপাতা নয়। হয় দুর্নীতি, নয়তো কাজে অপারদর্শিতা বা পদ্ধতিগত ত্রুটি অথবা জনবিরোধী নীতি, নচেৎ ক্ষমতার সন্ত্রাস এমনতর বিবিধ পঙ্গুতা ও জরায় এরা বরাবর কমবেশি আক্রান্ত। কিন্তু আজ যেন হঠাৎই দিল্লির কেন্দ্রীয় শাসক ছোটবড় যে কোনও বিরোধী পদস্খলন, দুর্নীতির গন্ধ পেলে তো কথাই নেই, এমনকি মিথ্যা অভিযোগ এনেও সর্বতোভাবে শুধুমাত্র বিরোধী দলগুলির ওপরই সারা দেশ জুড়ে এজেন্সি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। এমন নগ্ন আক্রমণ আগে কখনও দেখা যায়নি। এ বিষয়ে তাদের কোনও চক্ষুলজ্জারও বালাই নেই: হাজার অপরাধেও নিজেদের দল ও চরম দুর্নীতিগ্রস্ত নেতাদের আড়াল করতে তারা বিন্দুমাত্র কুন্ঠিত নয়। তারা যে কতবড় নির্লজ্জ তা আমরা সদ্য সদ্য দেখলাম- স্বাধীনতা দিবসে বিলকিস বানোর ধর্ষকদের আজীবন সাজাপ্রাপ্তি থেকে গুজরাত সরকার কীভাবে বেহায়ার মতো মুক্তি দিল।

অবশ্যই এমনটা ভাবারও কোনও কারণ নেই যে, বিরোধী দলগুলির নেতারা কোনও বড়মাপের দুর্নীতি করেনি। করেছে, অবশ্যই করেছে। বিশেষত পার্থ চট্টোপাধ্যায়, অনুব্রত মণ্ডল প্রভৃতি সম্পর্কে যে সমস্ত অভিযোগ উঠে এসেছে, তাকে আপাত-মান্যতা না দেওয়ার কোনও কারণ নেই। আমরা বহুদিন ধরেই পশ্চিমবঙ্গে নানাবিধ দুর্নীতির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ নজির চলতে-ফিরতে টের পাচ্ছিলাম। হয়তো, আমাদেরও অনেকেই সেই সব দুর্নীতির ঘোরতর শিকার। স্কুল-কলেজে শিক্ষক নিয়োগে যে দুর্নীতি হয়েছে, লক্ষ লক্ষ টাকা নিয়ে অযোগ্য প্রার্থীদের চাকরি দেওয়া হয়েছে, তা শাক দিয়ে ঢেকে রাখার উপায় নেই। আদালতের তীক্ষ্ণ নজরদারিতে তা এখন দিনের আলোর মতো উদ্ভাসিত। তাই, যে কারণে বা উদ্দেশ্যেই হোক, তদন্ত যে শুরু হয়েছে, ফলে, কিছু কার্যকরী ফলাফলও আমরা দেখতে পাচ্ছি, উচ্চপদস্থ নেতারা জেলবন্দী হচ্ছেন, তা হওয়ারই ছিল, হয়ে ভালই হয়েছে। আইনের বিচারে ভবিষ্যতে যদি অন্যতর কিছু প্রকাশ পায় তবে তা নিশ্চয়ই এক নতুন মাত্রা নিয়ে আসবে; যদিও তা অভূতপূর্ব কিছু নয়। কারণ, আমরা তো আগেও দেখেছি, শাসকেরা কতশত মিথ্যা অভিযোগে বিরোধীদের নিকেশ করেছে। তাই, এই হেনস্থা হওয়ার ঝঞ্ঝাটটা রাজনীতিবিদদের বহন করতেই হয়, তা নিয়ে আক্ষেপ করে লাভ নেই। কিন্তু শুধুমাত্র সেটুকু বললে গল্পের অর্ধাংশটা অধরা থেকে যায়, যা এক গভীর গেমপ্ল্যানের অংশ।

একদিকে যেমন দুর্নীতির দায় বিরোধীদের অনেকেরই আছে, বহুবার বহু বিরোধী নেতা দুর্নীতিগ্রস্ত হিসেবে সাব্যস্ত হয়েছেন, অন্যদিকে শাসকের তরফ থেকেও অযথা হেনস্থা অথবা তিলকে তাল করে দেখিয়ে টার্গেট করাটাও সমানতালে চলেছে। উপরন্তু, বিজেপির দুর্নীতিগ্রস্ত নেতাদের আড়াল করে তাদের বাঁচিয়ে নেওয়া বা তাদের সম্পর্কে গুরুতর অভিযোগগুলোকে বিন্দুমাত্র আমল না দেওয়া- এই প্রক্রিয়াটিও চালু আছে সমানতালে। যেমন, কী সুন্দর গায়ে বাতাস লাগিয়ে শুভেন্দু অধিকারী, নিশীথ প্রামাণিক, হিমন্ত বিশ্ব শর্মারা দিব্যি নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। অর্থাৎ, বিজেপি’র গেমপ্ল্যানটা হল: ১) ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে যতটা সম্ভব সমস্ত বিরোধী দলগুলির সুনাম ও অর্জনকে ধুলোয় মিশিয়ে দিয়ে বিপ্রতীপে নিজেদের শুদ্ধ, ওয়াশিং মেশিনে ধবধবে সাদা হয়ে আসা ‘ইমেজ’কে নিশ্চিত করা; ২) সর্বত্র এক সন্ত্রাস ও ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি করা যেখানে মানুষ আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে বিজেপির পায়ে পরে বাঁচতে চাইবে; ৩) বামপন্থী মতাদর্শকে তীব্র ভাবে আক্রমণ করা, যা ব্যতিরেকে নিজেদের ধর্মান্ধ মতাদর্শকে তারা মানুষের মনে ভাসাতে পারবে না। খেয়াল রাখি, বামপন্থী মতাদর্শ শুধুমাত্র তথাকথিত বাম দলগুলির মধ্যে আজ আর সীমায়িত নেই। বামপন্থী মতাদর্শের বহু কিছুকে আজ অ-বামপন্থীরাও হাতিয়ার করেছে। সে অর্থে, বামপন্থা্র নতুন ভাবে প্রাণসঞ্চার হচ্ছে। এই জায়গাটাকেই বিজেপি দুরমুশ করতে চায়, তাই বামপন্থী দলগুলির থেকেও বেশি করে বাম-ধারণার প্রচ্ছায়ায় অবস্থিত 'অবাম দলগুলি'কেই তারা এখন টার্গেট করেছে যারা এই মুহূর্তে তাদের সামনে রাজনৈতিক বিপদ। যেমন, আপ, ডিএমকে, তৃণমূল, টিআরএস, আরজেডি, সমাজবাদী দল ইত্যাদি। ‘রেউড়ি’ বা জনকল্যাণ রাজনীতির বিরুদ্ধে মোদীর আচম্বিত বিষোদগার কতকটা এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই।

আমরা দেখলাম, নিউ ইয়র্ক টাইমস’এ দিল্লির আপ সরকারের স্কুল পরিচালনার সাফল্য নিয়ে বড় করে খবর প্রকাশের পরপরই সিবিআই কীভাবে হামলে পড়ল উপমুখ্যমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী মণীশ সিসোদিয়ার বাড়িতে। তার মাসখানেক আগেই ইডি দিল্লির স্বাস্থ্যমন্ত্রী সত্যেন্দ্র জৈনকে তুলে নিয়ে গেছে। কারণ, সত্যেন্দ্র জৈন’র নেতৃত্বে দিল্লি সরকার স্বাস্থ্যক্ষত্রেও সাফল্যের সঙ্গে কাজ করেছে এবং মহল্লা ক্লিনিক সারা দেশ জুড়েই এক অভূতপূর্ব নিদর্শন হয়ে উঠেছে। সবিশেষ উল্লেখ্য, আপ নেত্রী অতিশী সাংবাদিক বৈঠক করে জানিয়েছেন, বিজেপি’র পক্ষ থেকে যিনি মণীশ সিসোদিয়াকে বিজেপিতে যোগ দিলে সমস্ত কেস প্রত্যাহার করে নেওয়া হবে বলে যে বার্তাটি দিয়েছেন, সেই তিনিই শুভেন্দু অধিকারী, মুকুল রায়, হিমন্ত বিশ্ব শর্মাকেও একই প্রস্তাব দিয়ে দলে ভিড়িয়েছিলেন। আশাকরি, দুর্নীতির বহর ও খেলাটি এবার খোলসা হচ্ছে। সম্প্রতি, পশ্চিমবঙ্গেও আয়কর বিভাগ থেকে কলকাতা টিভি’র দফতর ও তাদের অধিকর্তাদের বাড়িতে ৮০ ঘন্টা ব্যাপী ব্যাপক অভিযান চালানো হয় এবং তাদের জনপ্রিয় ‘চতুর্থ স্তম্ভ’ শীর্ষক সম্প্রসারণটি শুধুমাত্র বন্ধ করে দেওয়া নয়, তার পরিচালক সুচন্দ্রিমা পালকে ব্যক্তিগত ভাবেও তুমুল হেনস্থা করা হয়। কারণ, ‘চতুর্থ স্তম্ভ’ নামক ওই সম্প্রসারণটিতে বহু খোলামেলা কথা বলা হত যা বিজেপি’র কাছে চক্ষুশূল হয়ে উঠেছিল। উল্লেখ্য, এই অভিযানে সিবিআই'কে কিন্তু খালি হাতেই ফিরতে হয়েছে; হেনস্থা করাটাই ছিল মুখ্য উদ্দেশ্য।

কিন্তু মৌলিক প্রশ্নটি হল, দুর্নীতির এই দুর্বিনীত খেলা কি চলতেই থাকবে? এত আলোড়ন, হৈ-হট্টগোলের পরেও তার থেকে কি কোনও নিস্তার নেই? মুশকিল হচ্ছে, এই কিছুদিন আগেও বড় গলায় কেউ কেউ বলতেন, সমস্ত কাজকর্ম যদি ডিজিটাল হয়ে যায়, ঘরে বসে অনলাইনে যদি লেনদেন করা যায় তাহলে দুর্নীতির প্রকোপ কমে আসবে। কথাটা আংশিক সত্য। ছোট ছোট খুচরো সরকারি দুর্নীতির ক্ষেত্রে তা সত্য। কিন্তু ডিজিটাল ভুবন জোড়া যে গভীর ফাঁদ বিস্তৃত, তাতে অহরহ আর্থিক তথ্য সমেত ধরা পড়ে যাওয়া ও সর্বস্বান্ত হওয়া এখন নিত্যকার ঘটনা মাত্র। খুব সজাগ ও সতর্ক ব্যক্তি ছাড়া এই ফাঁদে অধিকাংশ মানুষই নানা উপায়ে পড়ছেন ও প্রতারিত হচ্ছেন। অর্থাৎ, ডিজিটাল দুনিয়া এক নতুন ধরনের বাটপাড়ি ও দুর্নীতির পথ খুলে দিয়েছে। তার সঙ্গে ‘ডার্ক ওয়েব’এর অভূতপূর্ব অন্ধকার জগতের কারবার তো আছেই। আর কর্পোরেট দুর্নীতি? যেখানে লক্ষ কোটি টাকা হাপিশ করে গায়েব হয়ে যায় তথাকথিত কর্পোরেটরা! কর্পোরেট বন্ধুকে খাতিরদারি করতে দেশের শীর্ষতম শাসকেরা মকুব করে দেয় রাষ্ট্রীয় ব্যাঙ্কের ঋণ! পিএম কেয়ার ফান্ড? ইলেক্টোরাল বন্ড? যে বিপুল অর্থের কোনও সরকারি অডিট নেই, উৎস জানানোর বাধ্যবাধকতা নেই! তাহলে কি দুর্নীতিকে আইনত মান্যতা দেওয়ার তোড়জোড় চলেছে বর্তমান শাসকের আমলে?

বলাই বাহুল্য, আপনি যদি দুর্নীতির জগতে প্রবেশ করতে না চান, প্রদানকারী ও গ্রহণকারী উভয় ভূমিকাতেই নিজেকে দুর্নীতি মুক্ত রাখতে চান, এবং শুধু আপনি নন, অধিকাংশ মানুষই তেমনটা চান, তাহলে দুর্নীতির শিকড় আলগা হবে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, কর্পোরেট দুর্নীতি আমার-আপনার ভাবনা নির্ভর নয়। তা শাসকের নীতি-প্রকৌশলের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। সে দুর্নীতিকে রোধ করতে হলে জনসমাজকে প্রত্যক্ষ আন্দোলনে নামতে হবে। সেই ভাবনার জগতে আমরা অধিকাংশেরা পৌঁছতে পারব কিনা, তা বলা দুষ্কর, কিন্তু পৃথিবীর বহু দেশ আছে যেখানে দুর্নীতির ঘটনা প্রায় শূন্য (যেমন, ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড)। তার জন্য অবশ্যই জনতার স্বার্থবাহী এমন এক ব্যবস্থা থাকা উচিত যা পুরোদস্তুর কাজ করতে সক্ষম। সে ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পারে রাজনৈতিক নেতৃত্ব। দিল্লি ও পঞ্জাবের রাজ্য সরকার এ বিষয়ে নিশ্চয়ই তাদের যথাসাধ্য অবদান রেখেছে ও ইতিবাচক ফলাফলও পেয়েছে। এখন দেখার, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চালিত ডিজিটাল ভুবন যে আংশিক ভাবে হলেও দুর্নীতিকে রোধ করতে সক্ষম বলে দাবি করা হয়, তা কতটা কার্যকরী হয়ে উঠতে পারে। কারণ, জনমানসে দুর্নীতি যদি এক সামাজিক-মান্য বর্গ হিসেবে দাঁড়িয়ে থাকে, তাহলে তা হানাহানিতেই লিপ্ত থাকবে যে কোনও পরিস্থিতিতেও। এই ‘মেনে নেওয়া’র মানসিকতা দানা বাঁধতে যেমন সময় নিয়েছে, তেমনই খুব অল্প সময়ে তা নিরসনও হবে না, কিন্তু প্রচেষ্টা ও জনমত দুইই সচল থাক। কতটা এগোনো গেল বোঝা যাবে। এবার অন্তত সে যাত্রা শুরু হোক।

        

Thursday, 18 August 2022

স্বাধীনতা দিবসের মর্যাদা হানি

গণধর্ষকদের নির্লজ্জ মুক্তি

নীলকন্ঠ আচার্য


 

এ বছরের স্বাধীনতা দিবস আমাদের কাছে যে বিশেষ কয়েকটি কারণে স্মরণীয় হয়ে থাকবে তার মধ্যে অন্যতম গুজরাত দাঙ্গায় গণধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় আজীবন সাজাপ্রাপ্ত ১১ জন কুখ্যাত অপরাধীর সরকারি বদান্যতায় সমস্ত আইনি বিধিনিষেধকে উপেক্ষা করে জেল থেকে মুক্তি। স্বাধীনতার 'অমৃত মহোৎসবে' সারা দেশ এই সরকারি বেপরোয়া ন্যক্কারজনক ঘটনায় স্তম্ভিত। একদিকে দেশের প্রধানমন্ত্রীর লালকেল্লা থেকে ৮৩ মিনিটের অদ্ভুত ভাষণের এক অংশে দেশের নারী সমাজকে সম্মান দেওয়া, সুরক্ষিত ও শক্তিশালী করার কথা উদাত্ত ভাবে তুলে ধরা হচ্ছিল, অন্যদিকে তার কিছুক্ষণের মধ্যেই গুজরাতের সরকারের নির্দেশে গোধরার সাব-জেল থেকে ১১ জন খুনী ও ধর্ষকদের ঘটা করে মিষ্টি খাইয়ে ও ফুলের মালায় বরণ করে বের করে আনা হল। এই ঘটনা বহু আইনজীবীকেও হতবাক করেছে। কারণ, দেশের সংবিধান, শীর্ষ আদালতের সিদ্ধান্ত এবং কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের (গুজরাত) রেমিশন নীতি অনুযায়ী ধর্ষণ ও পরিকল্পিতভাবে খুনের অপরাধে আজীবন‌ সাজাপ্রাপ্ত বন্দিদের কোনও অবস্হাতেই ক্ষমা প্রদর্শন করা যায় না, এ কথা স্পষ্টভাবে বলা আছে। তবুও কেন এই সিদ্ধান্ত? 

প্রাথমিকভাবে এর একটাই  উত্তর হতে‌ পারে: সরকারি খোলসের মধ্যে (কেন্দ্র ও গুজরাত) বিরাজমান এই চরম জনবিরোধী, অমানবিক, দেশবিরোধী ফ্যাসিস্ত শক্তিটি আজ আরও উদ্ধতভাবে তার নির্দিষ্ট অশুভ লক্ষ্যের দিকে দ্রুত এগিয়ে যেতে চাইছে। অতএব, এই বেপরোয়া উদ্ধত পন্থা গ্রহণে তাদের‌ আর কোনও দ্বিধা নেই। বরং বলা যায়, এই লক্ষ্যে তাদের প্রস্তুতি প্রায় সম্পূর্ণতার পর্যায়ে পৌঁছেছে।      

দিনটা ছিল অভিশপ্ত ৩ মার্চ, ২০০২'র সকাল; যখন ১৯ বর্ষীয়া বিলকিস বানো (পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা) গোধরায় তাঁর পৈতৃক বাড়ি থেকে তিন বছরের মেয়ে, মা সহ পরিবারের প্রায় ১৭ জনের একটি আর্ত দলের সঙ্গে প্রাণ বাঁচাতে উর্ধ্বশ্বাসে কোনও নিরাপদ আশ্রয়ের দিকে যাচ্ছিলেন, তখন উগ্র হিন্দুত্ববাদী নরঘাতকদের একটি দল তাঁদের পথ আটকায়। ওই ঘাতক দলের মধ্যে ১১ জন ছিল বর্তমানে সরকারি মদতে জেল থেকে সদ্য মুক্তি পাওয়া যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত খুনী ও গণধর্ষণকারীরা। এদের মধ্যে অনেকেই বিলকিসের পরিচিত। ঘাতকের ওই দল সেদিন মোট ১৪ জনকে হত্যা করে যার মধ্যে বিলকিসের তিন বছরের মেয়েটিও ছিল, যাকে বিলকিসের সামনেই আছাড় দিয়ে মেরে ফেলা হয়। একই সঙ্গে বিলকিস সহ ওই পরিবারের কয়েকজনকে গণধর্ষণের পর হত্যা করা হয়। বিলকিসকে মৃত ভেবে ঘাতকের দল বধ্যভূমি ত্যাগ করে।

বর্তমানে‌ সেই ১১ জন ঘাতককে জেল থেকে ছেড়ে দেওয়ার ফলে বিলকিসের অবশিষ্ট পরিবার পুনরায় আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। উল্লেখ্য, ১১ জন যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত এই ঘাতকের দলকে এভাবে ছেড়ে দেওয়ার পিছনে শীর্ষ আদালতেরও পরোক্ষ ভূমিকা আছে। ওই ঘাতকদের একজন ক্ষমা প্রার্থনার জন্য শীর্ষ‌ আদালতে আবেদন‌ জানালে গত ২৩ মে ২০২২ আদালত একটি প্যানেল গঠন করে তাদের ওপর ক্ষমা প্রদর্শন সংক্রান্ত বিষয়টি ফয়সালা করার দায়িত্ব দেয়। সংশ্লিষ্ট প্যানেল পরোক্ষভাবে ক্ষমা প্রদর্শনের পক্ষে মতামত জ্ঞাপন করে গুজরাত সরকারকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা বলে। ঘুঁটি সাজানোই ছিল। গুজরাত সরকার হরিয়ানা উচ্চ আদালতের রেমিশন সংক্রান্ত একটি রুলিংকে অজুহাত করে অপরাধী ১১ জনকে 'ক্ষমা প্রদর্শনের' মাধ্যমে মুক্তির নির্দেশ দেয়।   ‌‌‌‌‌                          

বিচারশাস্ত্রের মাপকাঠিতে গোটা প্রক্রিয়াটি বিতর্কিত এবং অনেকের মতেই এটি আইন ব্যবস্হার পরিপন্থী। বিলকিস বানোর আইনজীবী বলেছেন, এত বড় একটা ঘটনা আদালত ও সরকারের অংশগ্রহণে হয়ে গেল, অথচ এ বিষয়ে বাদী পক্ষকে আগাম কোনও প্রতিলিপিও দেওয়া হল না! তাঁর প্রশ্ন, যেখানে শীর্ষ আদালতের পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চ থেকে ২০০৫ সালে স্পষ্টভাবে বলা আছে, আজীবন কারাবাস মানে জীবনের 'শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত' কারাবাস, যেখানে জানুয়ারি ২০১৪, গুজরাত ও কেন্দ্রীয় সরকারের রেমিশন নীতিতে ধর্ষক এবং পরিকল্পিতভাবে হত্যাকারীদের ক্ষমা প্রদর্শন নীতির বাইরে রাখা হয়েছে, তখন এই ঘটনা বিচার ব্যবস্হা ও সরকারি প্রশাসনকে একসঙ্গে অভিযোগের কাঠগড়ায় তুলে দেয়।

গুজরাতের জনৈক মানবাধিকার কর্মীর মতে, ওই রাজ্যের সমস্ত কারাগারে অধিকাংশ সাজাপ্রাপ্তরা হলেন সাধারণ অপরাধী। এদের অনেকের জন্য এর আগে রেমিশন চাওয়া হলেও কোনও সুরাহা হয়নি। এই 'অমৃত মহোৎসবে' এদের অনেকেই তো রেমিশন পাওয়ার যোগ্য। সরকার ও আদালত এ বিষয়ে নিষ্ক্রিয় কেন? প্রশ্ন আরও আছে। যেখানে আজীবন সাজাপ্রাপ্ত ধর্ষক ও খুনীরা আইন অনুযায়ী কোনওভাবেই জেল থেকে ছাড়া পেতে পারে না, সেখানে সেই সাজাপ্রাপ্তরা আবেদন করেই ছাড়া পেয়ে যাচ্ছে। অথচ, এই একই গণতান্ত্রিক(!) বিচার ব্যবস্হার মধ্যে আদিবাসীদের অধিকার রক্ষায় ৮৪ বছরের  নিরলস ব্যক্তিত্ব ফাদার স্ট্যান স্বামীকে- যিনি তীব্র পারকিনসন রোগে আক্রান্ত- একজন বিচারাধীন কারাবন্দী থাকাকালীন জল ও তরল খাদ্য খাওয়ার জন্য জেল ও আদালতের কাছে একটি সিপার দেওয়ার জন্য আবেদন করলেও তাঁকে তা দেওয়া হয়নি। জীবনের অন্তিম লগ্নে আদালতের কাছে শেষ কয়েকটা দিন সবুজ প্রকৃতি ঘেরা আদিবাসী অঞ্চলে বেঁচে থাকার জন্য জামিনের আবেদন করলেও এই ন্যায় (!) প্রদানকারী বিচার ব্যবস্থা এবং হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিস্ট প্রভুদের পদলেহনকারী কেন্দ্রীয় সংস্থা NIA সংশ্লিষ্ট হিংস্র গোয়েন্দা অধিকর্তারা তা অনুমোদন করেনি। শুধু তাই নয়, উক্ত মিথ্যা মামলায় আটক বিচারাধীন বয়স্ক অসুস্হ আরও অনেক মানবাধিকার কর্মীদের জামিনের আবেদন বার বার করা হলেও এই বিচার ব্যবস্হা তা অনুমোদন করছে না। এই মুহুর্তে সোমা সেন, আনন্দ টেলটুম্বে, গৌতম নাভলাখা, রানা জ্যাকব, অরুণ ফেরেইরা, ভারনন গনজালভেস, হ্যানিবাবু, উমর খালিদ, শারজিল ইমাম, সিদ্দিকী কাপ্পান সহ সারা দেশে প্রায় ৬ হাজার রাজনৈতিক বন্দীদের বিনা বিচারে আটকে রাখা হয়েছে। পশ্চিমবাংলায় এই সংখ্যা প্রায় ১০০। এদের মধ্যে অনেকেই ইতিমধ্যে ১৪/১৫ বছর বিনা বিচারে আটক আছেন। 

সম্প্রতি শীর্ষ আদালতের পরবর্তী প্রধান বিচারপতি উদয় উমেশ ললিত এক দূরদর্শন সাক্ষাৎকারে বলেছেন, সারা দেশে বিচারাধীন বন্দীদের সংখ্যা প্রায় ৭০ শতাংশ, যদিও ২০২০ সালের NCRB-র প্রিজন স্ট্যাটিস্টিকস অনুযায়ী এই সংখ্যা হল ৭৬.১ শতাংশ। এই সূত্র মতে, দেশে মোট কারাবন্দীর সংখ্যা ৪,৮৮,৫১১ (৩১ ডিসেম্বর ২০২০ পর্যন্ত)। অতএব, বিচারাধীন বন্দীর সংখ্যা তাহলে ৩,৭১,২৬৮। দেশের এই বিচার ব্যবস্হায় আজ সরকারি মতে প্রায় পৌনে চার লক্ষ বন্দী রয়েছেন দোষী সাব্যস্ত না হয়েও কারারুদ্ধ এবং জামিন পাচ্ছেন না। সম্প্রতি, তিস্তা শেতলাবাদ, হিমাংশু কুমারের মামলা সম্পর্কে এক আলোচনা সভায় বর্ষীয়ান সুপরিচিত আইনজীবী কপিল সিব্বল খুব দুঃখের সঙ্গে স্পষ্টভাবে বলেছেন যে, এই শীর্ষ আদালত সহ দেশের বিচার ব্যবস্হার প্রতি তাঁর সমস্ত আশা ভরসার সমাপ্তি ঘটেছে। প্রখ্যাত গান্ধীবাদী অধিকার রক্ষা কর্মী হিমাংশু কুমার বলেছেন, কয়েকজন বিচারপতি মানে আদালত নয়। দেশের আদালত ও বিচার ব্যবস্হাকে রক্ষার জন্য সাধারণ মানুষদের আজ এগিয়ে আসতে হবে। প্রখ্যাত আইনজীবী প্রশান্ত ভূষণ বলেছেন, আদালতের কোনও রায় অন্যায্য অনৈতিক জনবিরোধী হলে তার বিরুদ্ধে দৃঢ়ভাবে প্রতিবাদ করতে হবে। তার স্বরূপ মানুষের মধ্যে উন্মোচিত করতে হবে। 

তাই, এই গোটা প্রেক্ষাপটে আজ বিলকিস বানো সহ দেশের সামগ্রিক পরিস্হিতিকে আমাদের বুঝতে হবে। এখন ফ্যাসিবাদ শুধু একটা শব্দ নয়। এই চরম অপশক্তিটি আমাদের জনজীবনে ক্রমশ প্রবেশ করে চলেছে। রাষ্ট্রশক্তি ও এই ফ্যাসিস্টদের যেন বর্তমান সন্ধিক্ষণে সব থেকে নিবিড়ভাবে পরস্পরের পরিপুরক হয়ে একে অপরের সঙ্গে লীন হয়ে অনেকটা এগিয়ে এসেছে। একে প্রতিরোধ করতেই হবে। একে আটকাতেই হবে। এবং একে নিশ্চিন্হ করার জন্য সবাই মিলে, হ্যাঁ, সবাই মিলেই আমজনতাকে সঙ্গে নিয়ে এক দীর্ঘস্থায়ী নির্ভীক বন্ধুর অভিযানের পথে এগোতেই হবে। অন্য আর কোনও বিকল্প নেই।


Saturday, 13 August 2022

‘রেউড়ি’ রাজনীতি

গরিবকে দিলে ‘রেউরি’

কর্পোরেটকে দিলে ‘বিকাশ’

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য


 

গত ১৬ জুলাই উত্তরপ্রদেশের এক জনসভায় প্রধানমন্ত্রী হঠাৎ ‘রেউরি সংস্কৃতি’র বিরুদ্ধে সবিশেষ সোচ্চার হন। তিনি বোঝাতে চান, যে ভাবে সাধারণ মানুষের মধ্যে নানান উৎসবাদিতে রেউরি (এক ধরনের উত্তর ভারতীয় মিষ্টি) বিলি করা হয়, সে ভাবেই নাকি বিরোধী দলগুলি সরকারি অর্থ মানুষের মধ্যে বিলি করে এ দেশে ‘রেউরি সংস্কৃতি’র আমদানি করেছে।

বলাই বাহুল্য, এর পটভুমি প্রস্তুত ছিল। প্রধানমন্ত্রী শুধু সলতেয় আগুন দিয়েছেন আর তা নিয়ে এক রাজনৈতিক সোরগোল খুব পরিকল্পিত ভাবে শুরু করে দেওয়া হয়েছে। বিচার বিভাগকেও এর মধ্যে টেনে আনা হয়েছে। অর্থাৎ, দেশের অর্থনীতির পথ কী হবে, তা একমাত্র এবং শুধুমাত্র একটি কি দুটি লোকই (মোদী-শাহ) ঠিক করবে, বাকী সকলকে তা মানতে বাধ্য থাকতে হবে।

কিন্তু প্রশ্ন হল, জনকল্যাণ প্রকল্পগুলি নিয়ে হঠাৎ করে মোদী সাহেব এত ক্ষেপে গেলেন কেন? কারণ, তিনি এখন বেশ বিপদে। সম্প্রতি সি-ভোটার কৃত একটি সমীক্ষায় প্রকাশ (ইন্ডিয়া টুডে চ্যানেলে দ্রষ্টব্য), এনডিএ চালিত দেশের অর্থনীতির অবস্থাকে জানুয়ারি ২০২১ সালে ৬৭ শতাংশ মানুষ ‘ভাল’ বলেছিলেন, অগস্ট ২০২২’এ এসে ৪৮ শতাংশ ‘ভাল’ বলছেন। পাশাপাশি, ওই ২০২১’এর জানুয়ারিতে মাত্র ১০ শতাংশ মানুষ অর্থনীতির অবস্থাকে ‘খারাপ’ বলেছিলেন যা অগস্ট ২০২২’এ এসে বলছেন ২৯ শতাংশ মানুষ। বোঝাই যাচ্ছে, মানুষ ক্রমেই মোদী সরকারের ওপর আস্থা হারাচ্ছেন। তদুপরি, এলপিজি’র দাম ১১০০ টাকা ছুঁইছুঁই, পেট্রল-কেরোসিন বহুদিন হল ১০০ টাকার সীমানা পেরিয়েছে, আটা-মুড়ির ওপর জিএসটি লাগু হয়েছে, ওষুধের দাম গগনচুম্বী- সব মিলিয়ে সাধারণ মানুষের জীবনে নাভিশ্বাস উঠেছে। অর্ধভুক্ত মানুষের একটা অংশ যে ভাবে অতি সস্তার বিষাক্ত নেশা করে খিদে ভুলে পড়ে থাকে (মরেও যায়), সে ভাবেই ধর্মের নেশা দিয়ে আমাদের পঙ্গু করে রাখার প্রয়াস চলেছে। এতে যে কোনও ‘কাজ’ হয়নি, তা তো নয়! কিন্তু গত কয়েক মাসে ছবিটা যেন দ্রুত পালটে যাচ্ছে। সম্ভবত, নেশার ঘোরও আস্তে আস্তে কাটছে।

বিশেষ করে আগামী নভেম্বরে গুজরাত নির্বাচন বিজেপির রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে। আঞ্চলিক বিভিন্ন সমীক্ষায় প্রকাশ পাচ্ছে যে, এবারে গুজরাতে বিজেপি ও নব উদিত আপ’এর মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হতে চলেছে। সাম্প্রতিক পঞ্জাবে অভাবনীয় সাফল্যের পর গুজরাতেও যে আপ অকল্পনীয় কিছু করে ফেলতে পারে, তা নিয়ে অনেকের মধ্যেই বেশ প্রত্যয় তৈরি হয়েছে। প্রতি মাসে অন্তত তিন-চারবার অরবিন্দ কেজরিওয়াল গুজরাত সফরে যাচ্ছেন ও বিশাল বিশাল জনসভা করছেন। দিল্লি ও পঞ্জাবে আপ সরকার যে জনকল্যাণমূলক প্রকল্পগুলি নিয়েছে তা একপ্রকার রাজ্যের চেহারাই বদলে দিয়েছে, বিশেষত গরিব মানুষের জীবনযাপনে প্রভূত সহায়তা ও খুশখবরই এনেছে। বিদ্যালয় শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে দিল্লি সরকার আগেই এক বিপ্লব ঘটিয়েছে এবং পঞ্জাবেও অনুরূপ কাজগুলিকে তারা হাতে নিয়েছে। উপরন্তু, ২০০ কি ৩০০ ইউনিট অবধি ফ্রি বিদ্যুৎ গরিব মানুষের জীবনে এক অভূতপূর্ব পরিবর্তন এনেছে। এখানেই বিজেপির সব থেকে বেশি ব্যথা লাগছে। কারণ, গুজরাতে গিয়ে অরবিন্দ কেজরিওয়াল ইতিমধ্যেই ঘোষণা করে দিয়েছেন যে তাঁরা ক্ষমতায় এলে দিল্লি ও পঞ্জাবের মতো ২০০ কি ৩০০ ইউনিট অবধি বিদ্যুৎ ফ্রি করে দেওয়া হবে। এই ঘোষণাটি শোনামাত্র দেশের শাহেন শাহ ও তাঁর দোসর (দুজনেই যখন আবার গুজরাতের লোক) নিজেদের আর স্থির রাখতে পারেননি। গুজরাতই যদি হাতছাড়া হয়ে যায় তাহলে আর থাকেটা কী! অতএব, খড়্গহস্ত হয়ে তাঁরা জনকল্যাণমূলক প্রকল্পগুলির ওপরেই বিষোদ্গার শুরু করে দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, জনকল্যাণমূলক প্রকল্পগুলিতে কীভাবে রোক লাগানো যায়, তারও অঙ্ক কষতে লেগেছেন। কারণ, লড়াইটা আসলে দু’ ধরনের ‘রেউরি বিলি’র চরিত্রের মধ্যে (আদতে দুই শ্রণির মধ্যে)।

কথাটা হল, ‘রেউরি’ (মোদীর ভাষায়) বা সরকারি অর্থ সাধারণ গরিব মানুষের উন্নতিকল্পে ব্যবহার করা হবে, নাকি, কতিপয় ঘনিষ্ঠ কর্পোরেট হাউজকে দেওয়া হবে তাদের সম্পদ ও মুনাফা বৃদ্ধির জন্য- এখানেই মূল দ্বন্দ্বটা নিহিত আছে। শুধু আপ বলেই নয়, বিভিন্ন রাজ্যেই আঞ্চলিক দলগুলি নানা ধরনের জনকল্যাণমূলক প্রকল্প গ্রহণ করে চেষ্টা করেছে অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে পড়া মানুষদের সক্ষমতা প্রদানে। এই অনুশীলনে নানারকম দুর্নীতিও দেখা গেছে (আপ পরিচালিত সরকার কিছুটা ব্যতিক্রম), সেই দুর্নীতির বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ ও বিরোধী দলেরা সোচ্চারও হয়েছে, কারও কারও শাস্তিও হয়েছে; কিন্তু শুধুমাত্র দুর্নীতির অজুহাতে জনকল্যাণ প্রকল্পগুলিকে কখনই বন্ধ করে দেওয়া যায় না। কারণ, আমাদের দেশের দুর্নীতির সিংহভাগ (অন্তত ৭৫ শতাংশ) হচ্ছে কর্পোরেট লুঠ, যেখানে ব্যাঙ্ক থেকে লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা তুলে কেন্দ্রীয় শাসকের মদতে হয় দেশ ছেড়ে লুঠেরারা পালিয়ে যায়, নয়তো রাষ্ট্রীয় ব্যাঙ্ক থেকে নেওয়া তাদের ঋণ মকুব করে দেওয়া হয়, অথবা জলের দরে তাদের হাতে সরকারি জমি, সম্পত্তি তুলে দেওয়া হয়। ললিত মোদী (যাকে সুস্মিতা সেন খুঁজে পান কিন্তু ভারত সরকার খুঁজে পায় না), নীরব মোদী, মেহুল চোক্সি, বিজয় মাল্য ইত্যাদিরা আমাদের সামনে এই ধারার জ্বলজ্যান্ত উদাহরণ। কেন্দ্রীয় শাসকদের অতি ঘনিষ্ঠ আদানি-আম্বানিদের গত কয়েক বছরে বিপুল সম্পদ লাভ আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে এই প্রবণতাকে স্পষ্ট করে দেখিয়ে দেয়। এখন তো আবার বন সংরক্ষণ আইনকে সংশোধন করে বিনা বাধায় আদিবাসীদের জমি দখল নেওয়ার নীল নকশা তৈরি হয়েছে। এ এক সর্বগ্রাসী লুঠ। 

এই ভয়ঙ্কর লুঠকেই মোদী সরকার চাইছে ‘রেউরি’র হকের দাবিদার বানাতে। অর্থাৎ, সরকারের অর্থ শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ন্যূনতম জীবনযাপন, রাস্তাঘাট, পরিবেশ এইসব সর্বজনীন জনকল্যাণমূলক খাতে ব্যয় করা হলে তাকে বলা হবে ‘রেউরি’ বিলি, আর সেই অর্থ যদি কর্পোরেটদের দেয় অপরিশোধযোগ্য ঋণ, কর্পোরেট কর মকুব, পাইপলাইন মনেটাইজেশনের নামে রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রগুলিকে জলের দরে কর্পোরেটদের হাতে তুলে দেওয়ার ফন্দি-ফিকির হিসেবে বিলি করা হয় তবে তাকে ‘রেউরি বিলি’ বলা যাবে না। কারণ, এটা সর্বজনবিদিত যে লক্ষ লক্ষ কোটি সরকারি টাকা বন্ধু কর্পোরেটদের দিলে তার একটা অংশ ‘ইলেক্টোরাল বন্ড’ হিসেবে আবার বিজেপি’র কাছে ফেরত আসে। আর তাই এটাকেই বলতে হবে ‘বিকাশ’। এ নিয়ে নীতি নির্ধারণের পথেও এগোতে চলেছে মোদী সরকার। অথচ শুধু কেজরিওয়াল নন, ঊড়িষ্যার মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়কও এ প্রসঙ্গে স্পষ্টতই জানিয়েছেন, তাঁর নিজ রাজ্যে জনকল্যাণমূলক প্রকল্পগুলি গরিব ও প্রান্তিক মানুষদের আরও সক্ষমতা দিয়েছে। আমরা জানি, পশ্চিমবঙ্গ, কেরল, অন্ধ্রপ্রদেশ, তামিলনাড়ু, তেলেঙ্গানার রাজ্য সরকারগুলিও বেশ কয়েক বছর ধরে এমনতর জনকল্যাণমূলক প্রকল্প অনুশীলন করে মানুষের সক্ষমতা বৃদ্ধি ও জীবনযাপনে কিছুটা হলেও উন্নতি এনেছে।

আজ যখন সারা বিশ্ব জুড়ে ইউনিভার্সাল বেসিক ইনকামের দাবি জোরালো হয়ে উঠছে, অগাধ বৈষম্যের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের জনকল্যাণমূলক উদ্যোগকে অর্থনীতির সর্বজনীন পথ হিসেবে মান্যতা দেওয়া হচ্ছে, তখন সে পথকে ‘রেউরি বিলি’ অপবাদ দিয়ে জনকল্যাণমূলক প্রকল্পের বিরুদ্ধে মোদী সরকারের যুদ্ধ ঘোষণা এক অশনি সংকেতের ইঙ্গিত দিচ্ছে। ২০২৪ সালে ক্ষমতা দখল অটুট রাখতে মরীয়া বিজেপির সামনে এখন তাই মূলত দুটি পথ খোলা: এক) আদানি-অম্বানিদের মতো কর্পোরেট বন্ধুদের থেকে ইলেক্টোরাল বন্ড ও অন্যান্য পথে লক্ষ কোটি টাকা নিয়ে অর্থবলের জোরে ক্ষমতা হাসিল করা; আর তাই, ‘রেউরি’টা কর্পোরেটদের মধ্যে বিলি করার একটা পাক্কা বিধিব্যবস্থা তৈরি করা; দুই) সে ক্ষেত্রে গরিব ও প্রান্তিক মানুষদের ধর্মের আফিম খাইয়ে বুঁদ করে ভোট আদায় করা।

এইভাবে কতকটা সফলতা গত কয়েক বছরে তো তারা পেয়েছে। ২০১৭-১৮ সাল থেকে তুলনামূলক ভাবে অনেকটা শক্তি কমলেও তারা তৃতীয়বার ক্ষমতায় ফিরে আসার খোয়াব দেখছে। যদি ঘটনাচক্রে তা বাস্তব হয়ে যায় (তর্কের খাতিরে ধরে নিলে) তাহলে আমরা শুধু ধর্মীয় হানাহানির এক অতল চক্রে নিমজ্জিত হব না, অর্থনৈতিক মহাবিপর্যয়ের এক করালগ্রাসেও নৃশংস ভাবে বিলীন হয়ে যাব। বিহারে জেডিইউ বিজেপির হাত ছেড়েছে, একে একে বহু দলই তাদের সঙ্গ ত্যাগ করেছে, অনেক রাজ্যেও তারা ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে; এবার আশা করতে পারি, দেশের আমজনতাও তাদের হাত ছাড়তে বাধ্য হবে।