Friday, 26 November 2021

কৃষক আন্দোলনের বর্ষপূর্তি

'ঔর এক ধাক্কা দো, 

মোদি সরকার গিরা দো'

শোভনলাল চক্রবর্তী 


১৯ নভেম্বর সকালে ঘুম থেকে উঠেই কি প্রধানমন্ত্রীর মনে হল, তিন কৃষি  আইন বাতিল করতে হবে! তাঁর নিন্দুকেরা বলছেন, সামনে পাঁচ রাজ্যে ভোট। হাল বুঝেই তাই তিন কৃষি আইন বাতিল করার সিদ্ধান্ত। তাঁরা বলছেন, প্রধানমন্ত্রীর কাছে রিপোর্ট আছে, কৃষক আন্দোলনের জেরে উত্তরপ্রদেশে ক্ষমতা ধরে রাখা যাবে না। তাই দূরদর্শনের মাধ্যমে দেশবাসীর উদ্দেশ্যে নত মস্তকে ক্ষমা চেয়ে তিন কৃষি আইন প্রত্যাহার করার ঘোষণা করলেন। 

তবে আমার বিবেচনায় বলে, ভোট বড় বালাই। মানি। কিন্তু কৃষক আন্দোলনের মানসিক কাঠামোই মোদীকে ব্যাকফুটে যেতে বাধ্য করল। প্রধানমন্ত্রীর এই ঘোষণা আকস্মিক মনে হলেও লক্ষ করুন, দীর্ঘ এক বছর ধরে আন্দোলনকারী কৃষকরা তাঁদের আত্মবিশ্বাস ও নৈতিক দৃঢ়তায় এ কথা আগে থেকেই বলে আসছিলেন যে, যতই হামলা হোক, মামলা চাপানো হোক, সরকারকে তাঁদের এই গান্ধীবাদী আন্দোলনকে মর্যাদা দেওয়ার দাবি একদিন মানতেই হবে। আগ্রাসী ক্ষমতা ও দম্ভের ওপর ভিত্তি করে মোদী-শাহ ও তাঁদের বশংবদ কর্পোরেটদের অশুভ শক্তি ভেবেছিল এই কৃষক আন্দোলনের কাছে সরকার কোনওভাবেই মাথা নোয়াবে না। কিন্তু ১৯ নভেম্বর সকালে কার্যত সেটাই তাঁদের করতে হল। এ কথা নিশ্চিত যে, কৃষকদের সত্যাগ্রহের কাছে অদূর ভবিষ্যতে সরকারকে আরও পিছু হটতে হবে। 

এই আন্দোলনকে যাঁরা আন্তরিকভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন তাঁরা জানেন, কৃষকরা শান্তিপূর্ণভাবে আলোচনার মাধ্যমে তাঁদের দাবির মীমাংসার জন্য সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা করেছেন। বার বার আবেদন জানানো সত্ত্বেও ১১ বার দ্বিপাক্ষিক আলোচনা ভেস্তে গিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারের অনড় মনোভাবের জন্য। আমরা দিনের পর দিন দেখেছি, কেন্দ্রীয় সরকার এবং হরিয়ানা ও উত্তরপ্রদেশের সরকার কৃষকদের সঙ্গে বৈমাত্রেয় সুলভ আচরণ করেছে। বিজেপি পরিচালিত এই সরকারগুলো প্রথম থেকেই শান্তিপূর্ণ পথে চালিত কৃষকদের মিছিল, প্রতিবাদ সভা ও ধর্নাস্থলগুলোর ওপর প্রকাশ্যে ও গোপনে অন্তর্ঘাতমূলক দমন-পীড়ন চালিয়ে গিয়েছে। প্রথমে দিল্লিমুখি কৃষক মিছিলগুলোতে লাঠিচার্জ, প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় অমানবিকভাবে যথেচ্ছ জলকামানের ব্যবহার, প্রধান জাতীয় ও রাজ্য সড়কগুলিতে সরকারি লোক নিযুক্ত করে আড়াআড়ি ভাবে দশ ফুট গভীর ও পাঁচ ফুট চওড়া পরিখার মতো গর্ত খুঁড়ে রাখা হয়েছে। এর পাশাপাশি দিল্লির চারটি সীমানায় অদ্ভূত ধরনের ব্যারিকেড যা একই সঙ্গে পরপর সারিবদ্ধভাবে সজ্জিত নৃশংস কাঁটাতারের বাধা, ভারী ভারী কংক্রিটের আড়াল, ৮ থেকে ১০ সারির লোহার খাঁচার ঝালাই করা দেওয়াল তুলে দেওয়া হয়েছিল। এমনকি, সামনের রাস্তায় অজস্র প্রাণঘাতী ছুঁচলো লোহার শলাকা পুঁতে দেওয়া, যাতে কৃষকরা এগোতে না পারে। এর সঙ্গে আছে পানীয় জলের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার মতো নির্মম নিষ্ঠুরতা। ছিল ধর্নাস্থলগুলোর লাগোয়া অঞ্চলের মানুষের সঙ্গে আন্দোলনরত কৃষকদের বিভেদ তৈরি করার মতো হীন চক্রান্ত। এসব সত্ত্বেও আমরা লক্ষ করলাম, বহু কৌণিক আক্রমণেও কৃষকরা দিশাহীন হলেন না। বরং এই এক বছরের মধ্যে- আজ ২৬ নভেম্বর এক বছরে পা দিল কৃষক আন্দোলন- দুর্বল হওয়ার বদলে দিন দিন শক্তি সঞ্চয় করে অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠল, যা শেষ পর্যন্ত মোদী সরকারের ভিত নাড়িয়ে দিয়েছে। 

এত উচ্চমানের জোরদার গণ আন্দোলন স্বাধীন ভারতে কৃষক আন্দোলনের ইতিহাসে আর নেই। এমনি এমনি প্রধানমন্ত্রী জাতির কাছে ক্ষমা চাননি। ভারতীয় কৃষকদের অনেক ত্যাগ ও তিতিক্ষার বিনিময়ে এই বিজয় এসেছে। প্রজাতান্ত্রিক ভারত গড়ে ওঠার ৭১ বছর বাদে, ২০২১ সালে আমরা জানলাম, সংসদে আইন পাশ হলেও জনগণের দুর্মর প্রতিবাদের মুখে পড়ে সরকার তা প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য। তার ওপর ভারত যতই ডিজিটাল হয়ে উঠুক, আমাদের এই দেশ শেষ বিচারে কৃষি প্রধান। তাই কৃষকদের উপেক্ষা করা কোনও রাজনৈতিক দলের পক্ষেই সম্ভব নয়। উত্তরপ্রদেশের লখিমপুর খেরির নৃশংসতার পরেও কৃষকরা যে সত্যাগ্রহের পথেই অটল, তাতেই বিজেপি-আরএসএস'এর সব কৌশল ব্যর্থ হয়ে গিয়েছে। শুক্রবার সকালে মোদীর আত্মসমর্পণের পরে কৃষকরা এতটাই তাজা হয়ে উঠেছেন, তাতে নিশ্চিত করে বলা যায়, সংসদের উভয় কক্ষে তিন কৃষি আইন প্রত্যাহারের পাশাপশি ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের গ্যারান্টি, বিদ্যুৎ বিল প্রত্যাহার, কৃষি উপকরণের দাম কমানো এবং কৃষকদের ওপর থেকে সমস্ত মামলা প্রত্যাহার ইত্যাদি আদায় না করে তাঁরা নড়বেন না। 

না আঁচালে বিশ্বাস নেই- কৃষক নেতাদের এই মনোভাব উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়। কেন না, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর টেলিভাইজড ভাষণ থেকে যদি সরকার সরে যায়, তবে তো কৃষকদের হাতে লাঙল বা ট্রাক্টরের স্টিয়ারিং ধরার অবস্থাও থাকবে না। কৃষি আইন প্রত্যাহারে মোদীর নাটকে অভ্যস্ত পোড়খাওয়া কৃষক আন্দোলনের সচেতন নেতারা তাই স্পষ্ট বলে দিয়েছেন, সংসদের দুই কক্ষে এই তিন কৃষি আইন প্রত্যাহার না করলে তাঁরা আন্দোলন থেকে সরে আসবেন না। শীতকালীন অধিবেশনে এই তিন আইন প্রত্যাহারের প্রক্রিয়া শুরু করা হবে বলে মোদী তাঁর ভাষণে বলেছেন (ইতিমধ্যে ক্যাবিনেট তিন কৃষি আইন বাতিলের প্রস্তাব পাশ করেছে)। তবু কৃষকরা সেটি না হওয়া পর্যন্ত নট নড়নচড়ন। 

একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে ভেবে দেখুন, প্রায় এক বছর পূর্ণ হতে চলা ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলনের 'আন্দোলনজীবীরা' দেশের প্রধানমন্ত্রী কথার ওপর ন্যূনতম আস্থা রাখতে নারাজ। আর সেটা প্রধানমন্ত্রীও বুঝেছেন। তাই জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে তিনি বলেছেন, এই তিনটি কৃষি আইনের 'উপকারিতা' কৃষকদের একাংশকে বোঝানোর জন্য যে তপস্যা তিনি করেছিলেন, তাতে তিনি ব্যর্থ হয়েছেন। আচ্ছা মোদীজী, আপনার মতো বাচস্পতি রাজনৈতিক নেতা কেন ব্যর্থ হলেন 'আনপড়' কৃষকদের বোঝাতে? সবই কি বিরোধীদের ভুল বোঝানো? ঠিক যেমনটা আপনি ১৯ নভেম্বর দুপুরেই বললেন উত্তরপ্রদেশের মাহোবার জনসভায়! ওই সভায় প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'পরিবারতন্ত্রের দলগুলি কৃষকদের দাবিদাওয়া, চাহিদা পূরণ করতে চায় না। দুর্বিষহ করে রাখতে চায় কৃষকদের জীবন।' মোদী ফের দাবি করেন, কৃষকদের সমস্যা নিয়ে রাজনীতি করছেন বিরোধীরা। তাঁর ভাষায়, 'সমস্যা নিয়ে রাজনীতি করে কিছু রাজনৈতিক দল। আমরা সমাধানের রাজনীতি করি। সব পক্ষের সঙ্গে কথা বলে তারপরই আমরা এই সিদ্ধান্তে এসেছি।' তিনি নিজেও যে রাজনীতি করছেন, সেটা ভুলে গিয়েছেন। কিন্তু কৃষকরা ভোলেননি। 

এই আন্দোলনরত কৃষকদের কখনও পাকিস্তানি কখনও খলিস্তানি কখনও বা দেশদ্রোহী আখ্যা দিয়েছেন মোদীর দলের নেতারা। তাঁর দলের নেতা-মন্ত্রীরা যখন আমাদের অন্নদাতাদের এমন সব অপমানকর আখ্যা দিয়েছেন, তখন রাজধর্ম পালন করে তাঁদের শাসন না করে মোদী স্বয়ং আন্দোলনজীবী বলে কৃষকদের ব্যঙ্গ করেছেন। ফলে, আজ সচেতন কোনও মানুষই প্রধানমন্ত্রীর মুখের ভাষণে বিশ্বাস করবেন না। বিশেষ  করে লোকসভা ভোটের আগে দেওয়া তাঁর প্রতিশ্রুতি নিয়ে তাঁর সবচেয়ে বড় সহযোগী অমিত শাহ যেভাবে সংবাদমাধ্যমে ওসব 'জুমলা' বলে উড়িয়ে দিয়েছেন, তাতে নিপাট ভক্তরা ছাড়া কেউই মোদীর কথায় আস্থা রাখেন না। দেশের প্রধানমন্ত্রীর কাছে এর চেয়ে লজ্জাজনক আর কী হতে পারে? 

২৬ নভেম্বর দেশ জুড়ে পালিত হোক কৃষি বিজয় দিবস। দেশ জুড়ে স্লোগান উঠুক 'ঔর এক ধাক্কা দো, মোদি সরকার গিরা দো।'


Thursday, 25 November 2021

দীপেন্দু চক্রবর্তীকে মনে রেখে

তিনি ও সেই সময়

সুমিত ঘোষ


 

ীপেন্দু চক্রবর্তীর পরিচয় আমার কাছে লেখক, প্রবন্ধকার এবং সাহিত্য-সমালোচক হিসেবেতখন ছিল এক প্রবল রাজনৈতিক উত্থানের সময়- সত্তরের দশকনতুন সমাজতান্ত্রিক সমাজের স্বপ্ন সব তরুণদের মতো ছিল আমারও। কলেজ স্ট্রিট কফি-হাউস ছিল সেইসব রাজনৈতিক বন্ধু ও সাংস্কৃতিক বন্ধুদের মিলনক্ষেত্র যাকে আমরা অনেকেই রঁদেভ্যু বলি সত্তরের দশককে মুক্তির দশকে পরিণত করুন’- ছিল তখনকার রাজনৈতিক শ্লোগান সমাজতান্ত্রিক সমাজের স্বপ্নে তখন লেখক শিল্পীরাও তাঁদের মতো করে লেখনি ধরেছিলেন, ছবি এঁকেছিলেন, গান বেঁধেছিলেন।

সেই সময়ে সাহিত্য-সংস্কৃতি বিষয়ক পত্রিকা ‘অনুষ্টুপ’ প্রকাশিত হচ্ছিল ‘অনুষ্টুপ’ পত্রিকায় দীপেন্দু চক্রবর্তীর দুটি বিশেষ প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় একটি ‘পুস্তক সমালোচকের মস্তক বিক্রয়’, আর একটি ‘যাহাই সাংবাদিকতা তাহাই সাহিত্য নহে’ তখনকার সময়ে বিগ কমার্শিয়াল হাউসের পত্র-পত্রিকার দৌলতে পাদপ্রদীপের আলোয় আসা অনেক লেখক ও তাঁদের সম্পর্কে নতুন মূল্যায়ন এবং সাহিত্য বিচারের এক বিশেষ পালাবদল শুরু হল এই দুটি প্রবন্ধের মাধ্যমে বাংলা সমালোচনা সাহিত্যের যে ধারা বঙ্কিমচন্দ্র, রবি ঠাকুর, মোহিতলাল মজুমদার, বুদ্ধদেব বসু (An Acre of Green Grass), ধূর্জটিপ্রসাদের কলমে উজ্জীবিত হয়েছিল তা স্তিমিত হয়ে এসেছিল এই সমালোচনা সাহিত্য প্রাণবন্ত হল আবার; একদিকে সাহিত্যিক অসীম রায় অন্যদিকে দীপেন্দু চক্রবর্তীর সূক্ষ্ম বিচার বিশ্লেষণ ও মূল্যায়নে সাহিত্যের সত্য আর বাস্তব সত্যের পার্থক্য নির্ণীত হল এঁদের কলমে একই সময়ে অপরিচিত কিছু অনিয়মিত লেখক-কবিদেরও সাহিত্য শিল্পের নানা দিক নিয়ে উন্নত মানের কিছু রচনা আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছিল এঁদের মধ্যে ছিলেন কবি শ্যামলকুমার ঘোষ, কবি সমালোচক অতনু রেজ যিনি পরে কবি অক্টাভিও পাজের একটি কাব্যগ্রন্থ আদিত্য শিলা নামে বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন বালী থেকে প্রকাশিত 'অয়ন' সাহিত্য পত্রিকায় এ ছাড়াও লেখক-কবি জ্যোতির্ময় মুখোপাধ্যায়, কবি অমলকান্তি ভট্টাচার্য, ষাটের দশকের কবি ও লেখক মৃণাল দেব সম্পাদিত কবিতা-সাপ্তাহিকীর সম্পাদকের লেখা ‘বীক্ষণ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল

সেই সময় আরও একটি সাংস্কৃতিক পত্রিকা 'মধ্যাহ্ন' শৈলেন বসুর সম্পাদনায় প্রায় নিয়মিত প্রকাশ পেত। সেখানে সত্যজিৎ রায়, বিনয় ঘোষ, মহাশ্বেতা দেবীও লিখেছেন এই পত্রিকার উদ্যোগে মে-দিবসে প্রতি বছর বিভিন্ন স্থানে আয়োজন করা হত সাহিত্য সভা এমনই এক সাহিত্য সভা কাঁকুরগাছিতে ১৯৭৮ সালে অধ্যাপক দিলীপ মিত্রের বাড়িতে হয়েছিলসেখানে দীপেন্দু চক্রবর্তী, অচ্যুত গোস্বামী আমন্ত্রিত ছিলেন আলোচনার বিষয় ছিল ইয়েনান ফোরামে সাহিত্য সংস্কৃতি সম্পর্কে মাওসেতুঙের বক্তৃতা ঐ সভায় বক্তব্য রাখতে গিয়ে দীপেন্দুদা বলেন, সাহিত্যের বিষয় ও আঙ্গিক কোনও ওয়াটারটাইট কম্পার্টমেন্ট নয় এ দুয়ের মধ্যে আত্মিক মেলবন্ধন থাকে।’ এ কথা তখনকার সাহিত্যের দিকদর্শন কী হবে তা নিয়ে তরুণ ও প্রবীণদের বিতর্ক অনেকটা প্রশমিত হয়েছিল সে সময় অনেক রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক কর্মীরা এবং আরও কিছু তরুণ যারা সাহিত্যের নন্দনতত্ত্ব চর্চায় ছিল, তারা দীপেন্দু চক্রবর্তীর নানা লেখাতে বেশ উৎসাহিত আর উজ্জীবিত হত।


 

সত্তর দশকের শুরু থেকে শেষ অবধি এবং পরেও, শিল্পসাহিত্য, অঙ্কন, সঙ্গীত ছাড়াও নাট্য-আন্দোলনেও এক সতেজ প্রাণবন্ত হাওয়া বহমান ছিল প্রসেনিয়াম প্রসেনিয়াম-বহির্ভূত সব ক্ষেত্রেই চলছিল নতুন বিষয় আঙ্গিকের উৎসাহব্যঞ্জক পালাবদল উৎপল দত্তের রচনা, পরিচালনা অভিনয়ে প্রযোজিত পরিবেশিত ‘টিনের তলোয়ার’, ‘ব্যারিকেড’, ‘তীর’, ‘ম্যাকবেথ’ তদানীন্তন সময়ে নাটকের ক্ষেত্রটিকে উর্বর করে তুলেছিল একই সময়ে নবনাট্য আন্দোলনে ব্রেখটের ‘থ্রি পেনিস অপেরা’র বাংলা রূপান্তর ‘তিন পয়সার পালা’, পিরান্দেলোর লেখা নাটক 'Six Characters in the Search of a Dramatist' বাংলা অনুদিত হয়ে 'নাট্যকারের সন্ধানে ছটি চরিত্র' এবং চেকভের নাটক 'চেরি অর্চার্ড'এর বাংলা রূপান্তর 'মঞ্জরী আমের মঞ্জরী' প্রযোজনা ও পরিচালনা করলেন অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় আবার নাট্য পরিচালক ও অভিনেতা বিভাস চক্রবর্তী নির্দেশনা দিলেন মনোজ মিত্র রচিত নাটক চাকভাঙা মধু, মোহিত চট্টোপাধ্যায় রচিত নাটক রাজরক্ত, এছাড়াও অশ্বথামা, নরক গুলজার, মহাকালীর বাচ্চা, ব্রেট অবলম্বনে পাঁচু ও মাসী নাটকগুলি পরিচালনা করে যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করেছিলেন আর ছিল এক অনবদ্য ব্রেখটিয় আঙ্গিকের মৌলিক স্বরচিত নাটক 'মারীচ সংবাদ' যা অরুণ মুখোপাধ্যায় পরিচালনা করে বাংলা নাটকে এক দিগন্ত খুলে দিলেনতাঁরই প্রযোজনা, পরিচালনা ও অভিনয়ে রচিত হল লু সুনের ছোট গল্প 'ট্রু স্টোরি অফ  কিউ' অবলম্বনে 'জগন্নাথ'এর পাশাপাশি তখন সত্তর দশকের শেষ দিকে প্রসেনিয়াম বর্জনের নাটক 'বাসি খবর' আলোড়ন আনল নাট্য রচয়িতা ও পরিচালক ছিলেন বাদল সরকার। বীর সেন নামে আরেক পরিচালক একইরকম আঙ্গিকে নাটক করছিলেন কার্যত এ দুই ধারাই নাট্য জগৎ'কে বেশ সমৃদ্ধ করেছিলএর অভিঘাত পড়েছিল মফস্বলে তখন চলচ্চিত্রে সত্যজিৎ রায়ের প্রতিদ্বন্দ্বী, সীমাবদ্ধ, জনঅরণ্য, মৃণাল সেনের ইনটারভিউ, কলকাতা ৭১, পদাতিক, ঋত্বিক ঘটকের যুক্তি তক্কো গপ্পো, তপন সিংহের এখনই, হারমোনিয়াম তখন ছিল এক সার্বিক সাংস্কৃতিক তরঙ্গের অভিঘাত, যার ফসল লেখক দীপেন্দু চক্রবর্তী নকশাল আন্দোলনের প্রাথমিক ব্যর্থতার পর তার নেতিবাচক ও ইতিবাচক দিকগুলি নিয়ে অনেক লেখক শিল্পী সাহিত্যিক নাট্যকার সাংবাদিকরা মুখর তখন

সাহিত্য সংস্কৃতির সমালোচনা বহু দিনের নীরস একমুখি বদ্ধ জলাশয়ের ভাবনা থেকে নির্গত হল, এল এক সতেজ প্রাণবন্ত বাতাস আলোচ্য প্রয়াত লেখক ও প্রাবন্ধিক এই প্রেক্ষাপট থেকেই উঠে এসেছেন তাঁর স্বকীয় ভাবনা নিয়ে তাঁর প্রাগুক্ত প্রবন্ধ দুটি সাহিত্য সমালোচনার নব চিন্তনের উদ্বোধন। নিরবচ্ছিন্ন মোসাহেবী ছিল বিগ কমার্শিয়াল হাউসের এতদিনকার সমালোচনার রীতি তার বিরুদ্ধে দীপেন্দুদা যেমন এক প্রতিস্পর্ধী অভিনব বার্তা আনলেন আবার তা এক সাহিত্যবোধ জনিত প্রজ্ঞা, নান্দনিকতা, মেধা ও সৃজনভাবনার সম্মিলিত উদ্ভাসন তাঁর ‘সংস্কৃতির ক্ষয়ক্ষতি’ আর 'এঁরা এবং ওঁরা' গ্রন্থ দুটিতে মূল্যায়ন ছিল নকশাল আন্দোলনের সাংস্কৃতিক অর্জন ও ক্ষয়ক্ষতি, আর উনিশ আর বিংশ শতকের বুদ্ধিজীবীদের একাংশের কথা এবং কাজের মৌখিক প্রত্যয় আর যাপনের ফারাক জনিত এক নিবেদন এ ক্ষেত্রে বলা বাহুল্য, তিনি উনিশ শতকের বুদ্ধিজীবীদের অগ্রগণ্য মনে করলেন সশ্রদ্ধ চিত্তে বিংশ শতকের বুদ্ধিজীবীদের একাংশের মধ্যে বিশেষত বিভিন্ন বর্ণের বামপন্থী বুদ্ধিজীবীদের দ্বিচারিতা লেখককে হতাশ করেছিল আর অনেক পর নব্বইএর দশকে (১৯৯৩ সালে) অনুষ্টুপ পত্রিকায় প্রকাশিত হল আর একটি অনন্যসাধারণ রচনা: মানুষ চেনার সহজ পাঠতখন ব্যক্তি, সমাজ, রাজনীতি এবং রাজনৈতিক ও মার্কসবাদী সংগঠনে মানুষকে বিচার করার দৃষ্টিভঙ্গি, এসব মিলিয়ে এক অভাবনীয় মনস্তাত্ত্বিক গভীরতার এক ব্যাপ্ত অঙ্গনে এলেন লেখক

মানুষের সঙ্গে মানুষের সামান্য মেলামেশা থেকেই চটজলদি বা দু-একটা কথা ও বক্তব্যের ভিত্তিতে গোটা মানুষের পূর্ণাঙ্গ মূল্যায়ন- এ এক অদ্ভুত অভ্যাস মানুষের তিনি এই রচনাতে বলেন, একটি মানুষের মৃল্যায়নে প্রায়শই দেখা যায় পণ্ডিত চূড়ামণি ও অতি মূর্খজনের কোনও পদ্ধতিগত পার্থক্য নেই।’ বা, কে কতটা আত্মভোলা, কে কতটা ধান্দাবাজ, কে বিনয়ের অবতার, কার দেমাকে মাটিতে পা পড়ে না, আমরা সব বলে দিতে পারি কয়েক ঘন্টার বাহ্যিক যোগাযোগের ভিত্তিতে।’ একই পদ্ধতি লেখক পর্যবেক্ষণ করেন, এক একটি বৃত্তের প্রতিনিধি হিসেবে টেকনোলজি-নিয়ন্ত্রিত মাস সোসাইটির একটি উপাদান ছাড়া কিছুই নয়।' মারকিউসের ওয়ান ডাইমেনশনাল ম্যান’ তারই প্রতিবাদপত্র; আর্থার মিলারের ‘ডেথ অফ সেলসম্যানতারই দীর্ঘশ্বাস

মার্কসবাদী পার্টি সংগঠনের ক্রমাগত নিষ্পেষণে, যান্ত্রিক মার্কসবাদের দাপটে মানুষ খণ্ডিত অস্তিত্ব নিয়ে বেঁচেছিল এমন কথাও লেখক এই প্রবন্ধে উল্লেখ করেন ব্যক্তিকে বিচার করার জন্য কয়েকটি কৃত্রিম ছাঁচ বানানোই যথেষ্ট মনে করছিলেন সমাজতান্ত্রিক দেশের নেতৃবর্গ।’ ব্রেট তাঁর সেজুয়ানের ভাল মানুষে নাটকে বুর্জোয়া সমাজের অন্তর্নিহিত অসঙ্গতি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছিলেন ভালমানুষ/খারাপ মানুষের ভূমিকায় একই মানুষকে তুলে ধরে একই রকম অসঙ্গতি কি সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা সৃষ্টি করে নি, যেখানে মার্কসীয় তত্ত্বের আশ্বাসটি বারবার বাস্তবে ঘা খেয়ে চুরমার হয়ে যায়।' এইসব উদ্ধৃতি মানুষের মনস্তত্ত্ব অনুধাবনের ক্ষেত্রে সব সমাজেই যে খণ্ডিত একপেশে অভ্যাসে মানুষ অভ্যস্ত হয়ে এসেছে এবং তা এক সময়ে ন্যায়সঙ্গত অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে, সে সম্পর্কে লেখকের এই গভীর পর্যবেক্ষণ মানুষ সত্তাটির আপেক্ষিকভাবে এক সামগ্রিক রূপ উন্মোচনে সক্রিয় এই ধীশক্তি ও হৃদয়ের সমন্বয়ে লেখক বাংলা সাহিত্যেকে যথেষ্ট ঋদ্ধ করেছেন আজ এ কথা অনস্বীকার্য লেখকে কাছে তাই আমাদের ঋণ অপরিশোধ্য