Saturday, 23 October 2021

'ভয় করলেই ভয়'

হচ্ছেটা কী!

অশোকেন্দু সেনগুপ্ত


সদ্য যৌবনে পা রাখা একজন দেখেছিল একটি নাটক: হচ্ছেটা কী? তারপর কেটে গেছে কত বছর। তাকে দেখতে হয়নি দেশভাগ বা গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং; দেখতে হয়নি  তেমন কোনও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। ইন্দিরা গান্ধী হত্যার পর তাকে অবশ্যই শুনতে হয়েছে বীভৎস শিখ-নিধন বা গোধরা কাণ্ড। কিন্তু হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা? এই রাজ্যে? যখনই তেমন সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে, তখনই এই রাজ্যে শাসক ও বিরোধী পক্ষ মিলে তা রুখে দিয়েছে। দাঙ্গা সে দেখেনি। সম্প্রীতি নষ্ট  করার অপচেষ্টা হয়নি এমন নয়, তবে তা তুচ্ছ। যদিও বাম বা ডান- কোনও পক্ষই নির্বাচন এলে মুসলমান প্রধান অঞ্চলে মুসলমান বা হিন্দু প্রধান অঞ্চলে হিন্দু প্রার্থী দিতে ভোলেনি (ব্যতিক্রম বাদে)। সে সব কেন্দ্রে প্রচারে এসেছেন সংশ্লিষ্ট ধর্মের বিশিষ্ট মানুষরা। কিছু মানুষ প্রতিবাদ করেছেন, বলেছেন কেন এমন ভাগ- দেশ ভাগ করেও কেন তোমাদের তৃষ্ণা মেটেনি।

সে প্রতিবাদে কান দিল কে? সেই যুবকের মতো আমি ও আমার মতো কেউ কেউ প্রতিবাদে জেগে উঠলাম, কিন্তু নির্ভেজাল ধর্মচিন্তা মুক্ত রাজনীতির উত্থান দেখলাম না। পড়লাম আর শুনলাম কবিতা, নানা অনুষ্ঠানে। এক বন্ধু বার্ধক্যে পৌঁছে পড়ল বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা: 

এই অন্ধকারে নিঃশ্বাস নিতেও মানা

কেন না মানুষ এই অন্ধকারে নিজের মুখ-কে

লুকিয়ে রাখার জন্য

চারিদিকে কশাইখানার মধ্যে

ছ'ফুট মাটির নিচে চুপচাপ স্থির ব'সে আছে।

কোথাও জানলা নেই

দরজার কথা ভাবা অসম্ভব,

কেননা বাতাস ঢুকলে কেউ হিন্দু কেউ মুসলমান

হতে হবে। কেন না ঘরের মধ্যে, ঘরের বাইরে

অন্তহীন দ্বেষের আগুন।

[কাব্যগ্রন্থ: ভিসা অফিসের সামনে (১৯৬৭)]


সে বন্ধু আরও জানাল- ভীষণ কান্না পায়।

কান্না পায় কেন তা জিগ্যেস করিনি, করতে হয়নি। সবার মতো আমিও তাকে জানি, জানি যে কান্না পায় বাংলাদেশে সাম্প্রতিক হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িক সংঘাত দেখে। কান্নার পাশাপাশি জেগে ওঠে কিছু প্রশ্নও। যে মুসলমানরা হিন্দুদের উৎসবপ্রধান ধর্মীয় অনুষ্ঠানে সাম্প্রদায়িকতার বীজ ছড়ায় তারা কি নিজ ধর্মের ইতিহাস  জানে? নিজ দেশের সংস্কৃতির সঙ্গে তাদের যোগ আছে কী? আজও কি নির্মূল হয়নি ঘাতক-দালাল? তারা কী শুনেছে বঙ্গবন্ধুর কথা, তার দেওয়া প্রতিশ্রুতির কথা?

যে অঞ্চলে এই দাঙ্গা বেঁধেছে, বছর কয়েক আগে সেখানে গিয়েছিলাম। তারাই শেখালো, এক হয়ে থাকার কী সুখ। তবে তাদের অনেকে এখনও সহনশীলতা শেখেনি। এবার দাঙ্গা রুখতে বাংলাদেশের সরকার এগিয়ে এসেছে। দেরি হয়ে গেল না? গোধরা কাণ্ডের পর এই দেশের সরকারের গয়ংগচ্ছ ভাবে শক্তি পেয়েছে বিভেদকামী সাম্প্রদায়িক শক্তি। তেমনটা হবে না তো?

এই দেশের সব মানুষই যে অসাম্প্রদায়িক এমন তো নয়। তা যদি হত...

যাক গে, কী হলে কী হত সে আলোচনা বৃথা। তবে দুঃখ এই যে, তারা মাঝে মাঝে সুযোগ পেয়ে বড্ড তড়পায়। তারা সংস্কৃতির শিক্ষা অবহেলা করে, ইতিহাস উপেক্ষা করে। আমাদের শুভ ইচ্ছাগুলিকে ব্যঙ্গ করে, উপহাসে বিদ্ধ করতে চায়। তারা আমাদের অসাম্প্রদায়িকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। আমরাও তাদের নির্মূল করতে পারিনি। মানছি, এদের চুপ করানো সহজ নয়। বলতেই হয়:

'তুমি যদি ভাসাও মোরে/ চাই নে পরিত্রাণ।' (রবীন্দ্রনাথ)।

আমরা ভয় পাইনি, পাব না- যারা মৌলবাদের সমর্থক তারা মনে রাখুক; আর আমরা মনে রাখি নীরেন্দ্রনাথের কবিতা, কবেই তো শুনেছি তার কন্ঠে:

ভয় করলেই ভয়

......

ওদের মারমুখো ওই ভঙ্গিটা তো আর কিছু নয়,

লোক-দেখানো লোক ঠকানো

ছলা। চলো বেরিয়ে পড়ি


ভয় করলেই ভয়, নইলে দেখো,

কিচ্ছু না, কাঁচকলা।


Wednesday, 20 October 2021

'সর্দার উধম'

রাম মহম্মদ সিং আজাদ

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য

 


রাম মহম্মদ সিং আজাদ।

লন্ডনে বৃটিশ পুলিশ হেফাজতে যখন বিপ্লবী উধম সিং’কে বার বার জিজ্ঞেস করা হচ্ছে তাঁর নাম, তখন জামার হাতা সরিয়ে বাঁ-হাতে ট্যাটু করা তাঁর ওই নাম তিনি গোয়েন্দাদের দেখিয়েছিলেন।

হ্যাঁ, বার বার তিনি বলেছেন, এমনকি আদালতেও, যে তাঁর নাম রাম মহম্মদ সিং আজাদ।

এই বিষময় সময়ে দাঁড়িয়ে সুজিত সরকার আমাদের এক অমূল্য রতন উপহার দিয়েছেন: সর্দার উধম। প্রায় আড়াই ঘন্টার একটি রুদ্ধশ্বাস ছবি। কীভাবে বৃটিশ শাসক আমাদের নির্দ্বিধায় ছিন্নভিন্ন করেছে আর মনের মধ্যে সাহস ও সঙ্কল্পকে মজুত করে উধম সিং, ভগৎ সিং, চন্দ্রশেখররা তার মোকাবিলা করেছেন। এই ছবি তাই শুধুমাত্র দেখার নয়, উপলব্ধি করা ও রুখে দাঁড়ানোর।

১৯১৯’এর জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের মূল কাণ্ডারী মাইকেল ও’ ডায়ার শুধুমাত্র এক হত্যাকারী নয়, নৃশংসতম হত্যাকে কীভাবে যুক্তিগ্রাহ্য উপায়ে উপস্থাপন করতে হয়, তারও দক্ষ কারিগর ছিল। তাই হাজার হাজার মানুষকে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা তার কাছে এক নিষ্ঠুর কর্তব্য মাত্র, যা ‘বর্বরতা থেকে ভারতীয়দের উদ্ধার করতে শ্বেতবর্ণের মানুষের বোঝাস্বরূপ’; নয়তো তারা নাকি আবার ‘বর্বরতায় ফিরে যাবে’।

তাই, উধম সিং অপেক্ষা করেছেন। লন্ডনে এসেও অন্তত ছ’ বছর অপেক্ষা করেছেন। নির্জনে হাতের সামনে ডায়ারকে পেয়েও তাকে মারেননি সশস্ত্র উধম। কারণ, মাইকেল ডায়ার তাঁর কাছে নিছক এক নিষ্ঠুরতম ব্যক্তি মাত্র নয়, হিংস্র বৃটিশ সাম্রাজ্যের প্রতিভূ, যা গোটা ভারতবর্ষকে নিংড়ে, ছিবড়ে, রক্তাক্ত করেছে। অতএব, এ হেন ব্যক্তিকে যদি মারতে হয়, তা আসলে হতে হবে এমন এক উন্মুক্ত প্রতিবাদ, এমন এক যোগ্য জবাব, যা আপামর ভারতবাসীকে উদ্বুদ্ধ করবে আত্মমর্যাদা ও স্বাধীনতা অর্জনে। উধম তেমনই করেছিলেন। তাঁর সেই প্রয়াস ও সফলতা তাই সারা বিশ্ব জুড়ে এক গণ আলোড়নের জন্ম দিয়েছিল।

সুজিত সরকার এই ছবি নির্মাণ করতে গিয়ে নিজেকে গভীরভাবে উজাড় করে দিয়েছেন। শুধু তথ্য সংগ্রহ বা খুঁটিনাটি গবেষণা মাত্র নয়, তাঁর এই নির্মাণের পিছনে কাজ করেছে এক অন্তর্লীন ইতিহাস চেতনা ও তার প্রতি দায়বদ্ধতা। ‘সর্দার উধম’ তাই কোনও বায়োপিক নয়, বর্তমান সময়েরও এক সুকঠিন উচ্চারণ; যে উচ্চারণ শক্তিশালী আততায়ীকে আড়াল করে মানুষে মানুষে সংঘাত ও রক্তপাত নির্গমনের সুকৌশলী রাজনীতির বিরুদ্ধে আজকের সময়ের জেহাদ।

জালিয়ানওয়ালাবাগের সেই নির্মমতম হত্যাকাণ্ডের দিন উধমের বয়স ছিল মাত্র ২০। সেদিনের সভায় তিনি যেতে পারেননি কিন্তু হত্যাকাণ্ড-স্থল থেকে সারা রাত ধরে আহত ব্যক্তিদের একে একে তুলে নিয়ে গিয়েছেন নিকটবর্তী চিকিৎসা কেন্দ্রে, যদি কোনওভাবে মৃতপ্রায় মানুষগুলি বেঁচে ওঠে। সেদিনই রক্তস্নাত হাজার লাশ পড়ে থাকা সেই ময়দানে উধম জড়িয়ে পড়েছিলেন এক মহাকালের সঙ্গে যেখানে সুনির্দিষ্ট হয়ে গেছে তাঁর জীবনের লক্ষ্য। তাঁর মনে পড়েছিল ১৮ বছর বয়সে তাঁরই এক শিক্ষকের বাচন, যিনি বলেছিলেন, জীবনকে অর্থপূর্ণ করে বাঁচতে শেখো। জীবনের সেই গূঢ় অর্থের সন্ধান তিনি জালিয়ানওয়ালাবাগের রক্তাক্ত ময়দানের সে রাতেই পেয়েছিলেন। তারপর ২১ বছর তিনি অপেক্ষা করেছেন তাঁর জীবনের গভীর লক্ষ্যকে সুগঠিত করে তাকে বাস্তব রূপ দিতে।

এমনই এক ব্যক্তির দীর্ঘায়ত নীরব সাধনাকে বাঙ্ময় করে তুলেছেন সুজিত সরকার। এ ছবি না দেখলে শুধু এক সেরা চলচ্চিত্র-দর্শন থেকেই বঞ্চিত থাকা হবে না, ইতিহাসের প্রায়-অজানা এক আকর ও উপলব্ধিকেও হারানো হবে। তাই, ‘সর্দার উধম’ শুধুমাত্র এক চলচ্চিত্র নয়, ইতিহাসের এক মর্মস্পর্শী আলেখ্য, চৈতন্য ও জীবনবোধ।

      

Tuesday, 19 October 2021

প্রতিবেশী দেশের থেকেও পিছিয়ে

‘ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়...’

সোমনাথ গুহ


২০১৩ সালে ‘খাদ্য সুরক্ষা আইন’ প্রণয়নের কিছু দিন আগে অর্থনীতিবিদ জঁ দ্রেজ খাবারের একটি ঝুড়ি নিয়ে একটি সাক্ষাৎকারে উপস্থিত হন। তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হয় যে যখন এনরেগার মতো প্রকল্প আছে, রেশন ব্যবস্থা, মিড-ডে-মিল আছে, তখন নতুন করে এই আইন আনার কী প্রয়োজন? দ্রেজ বলেন, সেই কারণেই তিনি ঐ ঝুড়িটা সঙ্গে নিয়ে এসেছেন। তিনি ঝুড়িটি থেকে একটি কলা, ডিম ও এক গ্লাস দুধ (পাউচে রাখা) বার করেন। পাঁচজনের পরিবারে এই জলখাবারের খরচ হচ্ছে ৬০ টাকা। ঝুড়িটিতে পুরো দিনের পরিবারের খাবার আছে যার খরচ ২৩৫ টাকা। এনরেগাতে আট বছর আগে গড় মজুরি ছিল ১০০-১৫০ টাকা, তাও তাতে মাত্র একশো দিন কাজ পাওয়া যায়। দ্রেজ বলেন, এই ঘাটতি পূরণের জন্যই এই আইনের প্রয়োজন। আজ ঐ ফুড বাস্কেটের দাম অন্তত ৪০০ টাকা হয়েছে, যে মজুরি দক্ষিণের কেরালা, কর্নাটক কিংবা পাঞ্জাব, হরিয়ানাতেই শুধুমাত্র পাওয়া যায়। 

খাদ্য সুরক্ষা আইন গ্রামীণ ভারতের ৭৫ শতাংশ এবং শহরাঞ্চলের ৫০ শতাংশ পরিবারকে খাদ্য সুরক্ষা দেওয়ার টার্গেট নেয়। তখন জনসংখ্যা ছিল ১২০ কোটি (২০১১'র জনগণনা অনুযায়ী), যাদের মধ্যে রেশন কার্ড ছিল ২০ কোটি মানুষের; পরিবার প্রতি চারজন মানুষ ধরলে খাতায় কলমে অন্তত ৮০ কোটি মানুষের খাদ্য নিশ্চিত হওয়ার কথা ছিল। বাকি ৪০ কোটির একটি বড় অংশ আর্থিক সচ্ছলতার কারণে রেশন ব্যবস্থায় (পিডিএস) অন্তর্ভুক্ত নন। রেশন মূলত বিপিএল (দারিদ্রসীমার নীচে) চিহ্নিত মানুষদের দেওয়া হয়। এখন এই বিপিএল চিহ্নিতকরণের ব্যবস্থাটা অত্যন্ত গোলমেলে, একেবারেই নির্ভরযোগ্য নয়। যেমন দ্রেজ বলছেন, দরিদ্রতম ২০ শতাংশ মানুষের মধ্যে ৫৩ শতাংশের বিপিএল কার্ড নেই। গত আট বছরে জনসংখ্যা প্রায় ২০ কোটি বৃদ্ধি পেয়েছে। এর মধ্যে বিপুল সংখ্যক মানুষ কিন্তু রেশন ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত হননি। ঝাড়খণ্ড, বিহার, ওড়িশা, উত্তরপ্রদেশের মতো রাজ্যে রেশন কার্ডের বহু আবেদন পেন্ডিং পড়ে আছে। ২০২০'র একটি হিসাবে দেখা যাচ্ছে, প্রায় এগারো কোটি মানুষের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নেই, রেশন কার্ড নেই। এখন আবার একটা নতুন ঝক্কি শুরু হয়েছে: রেশন কার্ডের সঙ্গে আধারের সংযুক্তিকরণ। এতে বহু ভুয়ো কার্ড যেমন বাতিল হচ্ছে, তেমনি নামের বানান ভুল, ঠিকানা পরিবর্তনের কারণে বহু প্রকৃত স্বত্বভোগীর নাম বাদ হয়ে যাচ্ছে। এঁদের কাছে খাদ্যই পৌছয় না, পুষ্টিকর খাদ্য তো অনেক পরের কথা।

এই পরিপ্রেক্ষিতে ‘গ্লোবাল ফুড ইনডেক্স’এ (ক্ষুধা সূচক) ভারতের স্থান ১১৬টি দেশের মধ্যে ১০১ হওয়াতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। আফগানিস্তান ছাড়া প্রতিবেশী অন্য দেশগুলির অবস্থান ভারতের চেয়ে উন্নত। গত কয়েক বছর ধরে এরকমটাই হয়ে আসছে। ২০১৯'এ ১১৭টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ছিল ১০২, ২০২০'তে ১০৭টি দেশের মধ্যে ৯৪। এই সমীক্ষা ‘কনসার্ন ওয়ার্ল্ডওয়াইড’ এবং ‘ওয়েল্ট হাঙ্গার হিলফ’ নামে দুটি আন্তর্জাতিক সংস্থা প্রতি বছর করে থাকে। চারটি মাপকাঠির ভিত্তিতে সমীক্ষা হয়: 

                (১) খাদ্য, বিশেষ করে ক্যালোরি-যুক্ত খাদ্যের সহজলভ্যতা। এটি খাদ্য বন্টন ও সরবরাহের                             ওপর নির্ভর করে। এই মাপকাঠিটি সমস্ত বয়সের মানুষের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য; 

               (২) চাইল্ড ওয়েস্টিং, অর্থাৎ, যেখানে পাঁচ বছরের কম বয়সের একটি শিশুর দৈর্ঘ্যের তুলনায়                         ওজন কম; 

               (৩) চাইল্ড স্টান্টিং, অর্থাৎ, পাঁচ বছরের কম বয়সি শিশুর বয়স ও ওজন অনুযায়ী খর্বাকৃতি; 

               (৪) শিশুমৃত্যুর হার (পাঁচ বছরের নীচে)। 

গত দেড় দশকে এই মাপকাঠিগুলোতে ভারত যে উন্নতি করেনি এমনটা কিন্তু নয়। যেমন, ২০০৬'এ ভারতের স্কোর ছিল ৩৭.৪, যা ২০১২'তে ২৮.৮'এ নেমে আসে (স্কোর যত কম হবে তত ভালো)। তারপর থেকে উন্নতি অত্যন্ত ধীর, ২০২১'এ স্কোর ২৭.৫। 

ভারত সরকার এই রিপোর্ট দেখে ক্ষুব্ধ। তারা অভিযোগ করেছে, ফোন করে চারটে প্রশ্নের মাধ্যমে মতামত নিয়ে এই সমীক্ষা তৈরি হয়েছে। অবশ্য, 'গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স'এর (জিএইচআই) সমীক্ষক সংস্থাগুলি এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে। তারা জানিয়েছে, দেশ জুড়ে খাদ্যের সহজলভ্যতার গড়ের ভিত্তিতে এই সমীক্ষা করা হয়। এতে সমস্যা অবশ্য হতেই পারে। ভারতের মতো একটা বিরাট দেশ যেখানে উন্নতি অত্যন্ত অসমান এবং ধর্ম ও জাতপাতের বিভাজন সামাজিক ব্যবস্থার মধ্যে মজ্জাগত, যে কারণে একটা বিশাল অংশের মানুষ এমনিতেই সরকারি আনুকূল্য থেকে বঞ্চিত, সেখানে সারা দেশের একটা গড়ের ভিত্তিতে কোনও সমীক্ষা ঝুঁকিপূর্ণ তো বটেই। যেমন, খাদ্য সুরক্ষা আইনের ফলে কেরালার ৯০ শতাংশ মানুষের কাছে খাদ্য পৌঁছয়, ঝাড়খণ্ডে ৫০ শতাংশ। সুতরাং, যে কোনও সমীক্ষা যেমন পুরোপুরি সঠিক হয় না, তেমনই জিএইচআই যে একশো ভাগ নির্ভুল, তা কখনই বলা যায় না। কিন্তু তাই বলে, আন্তর্জাতিক স্বীকৃত সমীক্ষাকে কেউ সম্পূর্ণত উড়িয়েও দেয় না।

দেখা যাচ্ছে, এই সূচক তৈরি করার ক্ষেত্রে অন্যতম নির্ণায়ক হচ্ছে পাঁচ বছর বয়সের নীচের শিশুর পুষ্টি ও স্বাস্থ্য এবং তাদের মৃত্যুহার। এটা জানাই যে গর্ভবতী মায়ের স্বাস্থ্যের ওপর শিশুর স্বাস্থ্য নির্ভর করে। রেশন ব্যবস্থায় যা খাদ্যশস্য দেওয়া হয় তাতে গর্ভবতী মায়ের রক্তাল্পতা, আয়রনের অভাব পূরণ হয় না, যার প্রভাব সদ্যোজাত শিশুর ওপর বর্তায়। মা রুগ্ন হওয়ার ফলে বহু শিশু স্তন্যদুগ্ধ থেকে বঞ্চিত হয়। ল্যানসেট'এর একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, যে শিশুরা জন্ম থেকেই স্তন্যদুগ্ধ পায় তাদের স্বাভাবিক অনাক্রম্যতা বেশি হয়; আমাশা, নিমোনিয়া ধরনের রোগ হয় না, যে ব্যাধিগুলি শিশুমৃত্যুর অন্যতম কারণ। ছয় মাস মাতৃদুগ্ধের পর থেকে পরিপূরক খাদ্যের প্রয়োজন। আমাদের দেশে ৬-৯ মাস বয়সের প্রায় অর্ধেক শিশু এর থেকে বঞ্চিত। 

ইউনিসেফ'এর ২০১৮ সালের হিসাব অনুযায়ী, পুষ্টির অভাব, রোগভোগের কারণে দেশে প্রায় দুই কোটি (১৭ শতাংশ) ক্ষয়প্রাপ্ত শিশু ছিল যাদের দৈর্ঘ্যের তুলনায় ওজন কম। একই সালে বয়স ও ওজনের তুলনায় বৃদ্ধি কম, খর্বাকৃতি স্টান্টেড শিশুর সংখ্যা ছিল ৩৫ শতাংশ, প্রায় চার কোটি। ২০০৬ সালে এটা ছিল ৪৮ শতাংশ যা দেড় দশকে প্রায় পনেরো শতাংশ কমেছে। পাঁচ বছরের নীচে শিশু মৃত্যুর হারও কমেছে; ১৯৯০ সালে ৩৪ লক্ষ থেকে যা ২০১৯ সালে ৮.২৪ লক্ষে নেমে এসেছে। ক্ষয়প্রাপ্ত ও খর্বাকৃতি শিশুর সংখ্যা জিএইচআই'এর সমীক্ষার একেবারে নীচের দিকের দেশগুলি যেমন নাইজেরিয়া বা কঙ্গোর সমতুল্য হওয়া সত্ত্বেও ভারতে শিশুমৃত্যুর হার ঐ দেশগুলির তুলনায় কম কারণ এখানে স্বাস্থ্য পরিষেবা তুলনামূলক ভাবে উন্নত।  

প্রধান সমস্যা অবশ্যই খাদ্য মানুষের কাছে পৌঁছচ্ছে না। খাদ্যের অভাব নেই, এফসিআই'এর গুদাম উপচে পড়ছে। ইঁদুর শস্য খেয়ে নিচ্ছে। এত শস্য যে তার থেকে ইথানল তৈরি হচ্ছে কিন্তু ক্ষুধার্ত মানুষ তা পাচ্ছেন না। পাবেই বা কী করে, অধিকাংশের তো কার্ডই  নেই। এর ওপর সরকারি ঘোষণার অল্পই কার্যকরী হয়। ২০২০'র মার্চে লকডাউনের পরে অর্থমন্ত্রী ঘোষণা করেন যে রেশনে এপ্রিল থেকে জুন মাস অবধি অতিরিক্ত ৫ কেজি করে চাল বা গম দেওয়া হবে। প্রথম মাসেই ৫ কোটি মানুষ যাঁদের রেশন কার্ড আছে তাঁরা এই অতিরিক্ত শস্য পাননি। পরে ঘোষণা হয়, পুষ্টির জন্য জনপ্রতি এক কেজি করে ডাল দেওয়া হবে, সেটাও ২৩ শতাংশ মানুষ পাননি। পরে এই অতিরিক্ত শস্য বাড়িয়ে ১০ কেজি করা হয় যা নভেম্বর মাস অবধি চালু আছে। বহু মানুষ কেন্দ্রের দেওয়া এই অতিরিক্ত রেশনের কথা জানেনই না, রেশন মালিকও তাঁদের জানান না। জানালেও দশের জায়গায় পাঁচ কেজি দিয়ে ভাগিয়ে দেওয়া হয়। 

প্রধান সমস্যা, ২০১৪'র পর থেকে রেশন ব্যবস্থা খুব কমই প্রসারিত হয়েছে। স্বত্বভোগীর সংখ্যা প্রায় স্থিতিশীল। ‘এক দেশ, এক রেশন কার্ড’ নিয়ে ব্যাপক হৈচৈ, কিন্তু আগে তো দারিদ্রসীমার নীচে থাকা প্রতিটি মানুষকে কার্ডটা দিতে হবে। সেখানে আবার বিপিএল নির্ধারণ করা সমস্যা। এ জন্যই অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন যে আধারের ভিত্তিতেই রেশন দেওয়া হোক; ১৩০ কোটি মানুষের আধার আছে, যা রেশন কার্ড আছে এরকম মানুষের থেকে অনেক বেশি। আরও ভালো যেটা অভিজিৎ সহ অমর্ত্য সেন এবং রঘুরাম রাজন বলেছিলেন, যে লাইনে দাঁড়াবে তাকেই রেশন দেওয়া হোক। ক্ষুধা নিবারণ করার জন্য এছাড়া আর অন্য কোনও পন্থা আছে কিনা সন্দেহ।   

একই ভাবে গুরুত্বপূর্ণ একটা সুস্থ জীবন গড়ে তোলার জন্য যথেষ্ট উপাদান সম্পন্ন খাদ্যই যথেষ্ট নয়, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাও অত্যন্ত প্রয়োজন। শিশু জন্মের পূর্বে মায়ের স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য পরিচ্ছন্ন পরিবেশ প্রয়োজন এবং এর প্রয়োজনীয়তা নারী ও তার পরিবার তখনই উপলব্ধি করবে যখন জীবনযাপনের একটা সুস্থ শিক্ষা তাদের মধ্যে বংশানুক্রমিক ও সামাজিক ভাবে জারিত হবে। এটা হলে শিশুর স্বাস্থ্যের উন্নতি হবে, মৃত্যুহার কমবে, ক্ষুধার সূচকে দেশের স্থান অনেক ওপরে হবে। কাঁদুনি না গেয়ে এসব ব্যাপারে সরকার একটু  দায়িত্বশীল হলে ভালো হয়।   


Monday, 18 October 2021

একটি বইয়ের কথা

ভারতের ভূগোলের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

শোভনলাল চক্রবর্তী


দুর্গা পুজোর ছুটিতে হাতে পেলাম একটি আশ্চর্য বই। বইয়ের নাম 'ল্যান্ড অফ দ্য সেভেন রিভারস: আ ব্রিফ হিস্ট্রি অফ ইন্ডিয়াজ জিওগ্রাফি'। বইটির লেখক সঞ্জীব সান্যাল; পেশায় অর্থনীতিবিদ ও ইতিহাসবিদ এবং বর্তমানে ভারত সরকারের অর্থ দফতরের মুখ্য উপদেষ্টাদের অন্যতম। ভারতীয় সভ্যতার বিবর্তনের ইতিহাসে নদীর ভূমিকা বহু আলোচিত। সেই আলোচনায় নিঃসন্দেহে এক নতুন সংযোজন 'ল্যান্ড অফ দ্য সেভেন রিভারস'। 

বইটি প্রথম প্রকাশিত হয় ২০১২ সালে। পড়তে বসে আফসোস হচ্ছিল, আরও আগে এই গুরুত্বপূর্ণ বইটি পড়লাম না কেন! কারণ, ভূপ্রকৃতি, নদী ও জলবায়ুর সঙ্গে এই সভ্যতার আন্তঃসম্পর্ক শুধু ইতিহাস নয়, আরও অনেক কিছু নিয়ে সামগ্রিক আলোচনার বিষয়। লেখক তাঁর কথকতা শুরু করেছেন সেই ভূতাত্ত্বিক সময় থেকে, যখন ভারতীয় উপমহাদেশ অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে যুক্ত হয়ে দক্ষিণ গোলার্ধে অবস্থান করত। তারপর দীর্ঘ সময় ধরে উত্তরমুখি সঞ্চরণ, ইউরেশিয় পাতের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষের ফলে হিমালয়ের উত্থান এবং আরও পরে সিন্ধু, গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র সহ বহু নদীর জন্ম-বৃত্তান্ত। ভূ-বিজ্ঞানের প্রাথমিক বিষয়গুলি নিয়ে সাধারণ পাঠকের উপযোগী আলোচনা করেছেন। 

লেখক প্রাক-ইতিহাস থেকে ইতিহাসের সরণিতে হাঁটতে গিয়ে একবারও হোঁচট খাননি, এই কৃতিত্ব নেহাত কম নয়। আটটি পরিচ্ছেদে বিভক্ত বইটির আলোচ্যসূচিতে অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে রয়েছে এক বিশাল ক্যানভাস। যার বিস্তৃতি নদী পাড়ের হারিয়ে যাওয়া মানুষ থেকে শুরু করে বণিক সমাজ ও তাদের বাণিজ্য এবং ঔপনিবেশিক শাসনের উত্থান, তারপর তার ক্রমবিস্তার ও পতন এবং সব শেষে বাজার অর্থনীতির প্রভাবে বদলে যাওয়া ভারত। 

খ্রিষ্টপূর্ব ৩৫০০ অব্দ থেকে ভারতীয় সভ্যতার বিকাশ ঘটেছিল সিন্ধু-সরস্বতী নদীর অববাহিকায়। মহেঞ্জোদরো ও হরপ্পার নগর নির্মাণশৈলিতে মুগ্ধ হয়েছেন আপামর পুরাতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক। কিন্তু সেই সমৃদ্ধি চিরস্থায়ী হয়নি। লেখকের মতে, মূলত জলবায়ু পরিবর্তনের ফলেই সরস্বতী নদী বিলুপ্ত হয়ে যায়। খ্রিষ্টপূর্ব ২২০০ অব্দ থেকে এই উপমহাদেশের জলবায়ু বদলাতে শুরু করে। মৌসুমী বায়ুর আরব সাগরীয় শাখাটি দুর্বল হয়ে পড়ে এবং সক্রিয় হয়ে ওঠে বঙ্গোপসাগরীয় শাখাটি, যার ফলে আমূল পরিবর্তন ঘটে উপমহাদেশের বৃষ্টিপাতের আঞ্চলিক বণ্টনে। এই ভৌগোলিক পরিবর্তনের ফলেই ভারতীয় সভ্যতার ভরকেন্দ্র সরে চলে আসে গাঙ্গেয় অববাহিকায়। এই পর্বের সূচনা খ্রিষ্টপূর্ব ১৩০০ অব্দ থেকে। 

অতিকথন বাদ দিলে রামায়ণ ও মহাভারত যে ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান তা কমবেশি অনেক ঐতিহাসিক মেনে নিয়েছেন। লেখক এই বইয়ে আলোচনা করেছেন রামায়ণ ও মহাভারতের ভূগোল নিয়ে। যেমনটা আমরা জানি, রামায়ণের পটভূমির বিস্তৃতি উত্তরে অযোধ্যা থেকে দক্ষিণে সিংঘল পর্যন্ত আর অন্যদিকে মহাভারত আবর্তিত হয়েছে পশ্চিমের আফগানিস্তান থেকে পূর্বের বর্তমানের নাগাল্যান্ডের মধ্যে। এই দুই মহাকাব্যের সময়কাল ভিন্ন, কিন্তু রামায়ণ উত্তর-দক্ষিণ ও মহাভারত পশ্চিম-পূর্ব বরাবর ওই দুই সময়কালের ভূগোল বুঝতে সহায়তা করছে। মহাকাব্যকে এই ভাবেও যে দেখা যায়, তা ভাবতে ভালো লাগে বই কী। 

লেখকের অনুসন্ধিৎসা অপরিসীম। নানা প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে লেখক ঘুরে বেড়িয়েছেন দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। তিনি যে প্রশ্নগুলির উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করেছেন তাঁর বইয়ে, তার মধ্যে রয়েছে, কেন এই দেশ ভারত নামে পরিচিত? কবে এক মহাপ্লাবন ভারতের উপকূল এলাকাকে ভাসিয়ে দিয়েছিল? বুদ্ধদেব কেন সারনাথে তাঁর প্রথম উপদেশ দিয়েছিলেন? কীভাবে ইউরোপিয়রা এ দেশের মানচিত্র তৈরি করেছিল? লেখক নিজে অর্থনীতির কৃতি ছাত্র হলেও কিছু কিছু বিষয়ে তাঁর বিশ্লেষণ কেমন যেন খাপছাড়া এবং কিছু ক্ষেত্রে অসম্পূর্ণ মনে হয়। 

আজ থেকে দশ হাজার বছর আগে হিমযুগের অবসান, উষ্ণযুগের সূচনায় হিমালয়ের হিমবাহ-গলা জলে নদীতে প্লাবন এবং সাগরের এগিয়ে এসে উপকূল তৈরি করা নিয়ে বহুদিন ধরেই দেশে বিদেশে চর্চা শুরু হয়েছে এবং প্রকাশিত হয়েছে নানা গবেষণাপত্র। কিন্তু এই বিষয়ে আলোচ্য বইটিতে লেখক তাঁর আলোচনা শুধুমাত্র পুরাকাহিনিতেই সীমাবদ্ধ রাখলেন কেন, তা বোঝা গেল না। ব্রিটিশরা এ দেশের শাসনের দায়িত্ব হাতে নেওয়ার পর নির্ভুল মানচিত্র তৈরির কাজে হাত দেয়, সেই কাজ শুরু হয়েছিল এই বাংলা থেকে। জরিপের দায়িত্ব দেওয়া হয় জেমস রেনেলকে। ১৭৬৪ থেকে ১৭৭৭ পর্যন্ত বিস্তৃত জরিপের পর ১৭৮০ সালে প্রকাশিত হয় 'বেঙ্গল অ্যাটলাস'। উনবিংশ শতাব্দীর সূচনায় উইলিয়াম ল্যামটন ত্রিকোণমিতি জরিপের মাধ্যমে আরও বিস্তারিত ও নির্ভুল তথ্য সংগ্রহ করেন। ওই একই সময়ে এ দেশে বাষ্পীয় শক্তির ব্যবহার ও রেলপথের বিস্তার শুরু হয়। এ প্রসঙ্গে লেখক বিস্তৃত আলোচনা করলেও পরিবেশের উপর এই উন্নয়ন পরিকল্পনার প্রভাব অনুল্লিখিত থেকে গেছে। রেলপথ বিস্তারের পাশাপাশি কীভাবে ম্যালেরিয়া গ্রামবাংলায় মহামারী হয়ে দেখা দিয়েছিল, বন্যার প্রকোপ বেড়েছিল, কৃষি উৎপাদন কমেছিল, সে কথা না বললে আলোচনা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। এ ক্ষেত্রেও তাই আরও আলোচনার প্রয়োজন ছিল। তবে এই সব অপূর্ণতা সত্ত্বেও বইটি সযত্নে রেখে দেওয়ার মতো একটি রচনা। 

লেখকের ভাষায়, তাঁর আলোচনার বিস্তার প্রাচীন ভূ-ভাগ গন্ডোয়ানা থেকে দিল্লির উপকণ্ঠে গড়ে ওঠা উত্তর আধুনিক শহর গুরগাঁও পর্যন্ত। ভারতের ভূ-প্রকৃতির অনুসন্ধেয় ইতিহাস জানতে গেলে এই বইটি পড়তেই হবে।


Sunday, 17 October 2021

যা নাকি আলোচনা-নিষিদ্ধ!!

যে আধার নারীর ব্যক্তিগত

অমৃতা ঘোষাল


গল্পটা ছিল এইরকম:

পার্লারে কাজ করা একটা মেয়ে একবার দেখে ফেলে একটা নতুন বস্তু। বস্তুটার খরচ খুবই কম। পরিবেশের ক্ষতিও বিশেষ করে না। শরীরের পক্ষেও ভালো। বস্তুটা মেনস্ট্রুয়াল কাপ। ব্যাস, পার্লারে আসা এক কাস্টমার দিদির থেকে সে কিনেই ফেলল। বাড়ি ফিরেই প্রেমিককে ফোনে জানায়। প্রেমিকের সাজেশন- 'ওই কাপেই সন্ধ্যের চা'টা ঢেলে খেয়ে নে।' যাই হোক, অনেকটা আত্মবিশ্বাস সঞ্চয় করে মেয়েটা কাপ'টা দেহে ব্যবহার করে। ক্রমশ এটাই ব্যবহার করা তার অভ্যাসে পরিণত হয়। সে সন্তুষ্ট।

সন ১৮৬৭। মেনস্ট্রুয়াল কাপের একেবারে প্রাথমিক একটা রূপ দেখা গেল। শিকাগোর এসএল হকার্ট নামে এক ব্যক্তি 'ক্যাটেমেনিয়াল স্যাক'এর ডিজাইন পরিকল্পনা করলেন। কোমর ঘিরে একটা বেল্ট, তার সঙ্গে যুক্ত একটা সুতো বা সরু দড়ির মতো অংশ, সেই সঙ্গে যুক্ত একটা রিং আর স্যাক। স্যাক ও রিং সম্পূর্ণ কিংবা আংশিক যোনিপথে প্রবেশ করিয়ে এটা ব্যবহার করা যাবে- এই ছিল সেই ডিজাইনের দাবি। তবে সামাজিকভাবে এই ডিজাইন কিংবা এই 'স্যাক'এর ব্যবহার কোনওটাই আদর পেল না। সম্ভবত এর ব্যবহার-প্রণালী খুব একটা আরামপ্রদ ছিল না।

এরপর ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে আমেরিকান অভিনেত্রী লিওনা ডবলিউ চালমার্স আরেকটা ডিজাইনের পরিকল্পনা করেন। রবার দিয়ে তৈরি একটা মেনস্ট্রুয়াল কাপ, যেটা ব্যবহারের জন্যে দড়ি, সুতো, বেল্ট বা অন্যান্য কিছুর প্রয়োজন পড়ত না। সম্ভবত একটা প্যাড-ফ্রি পৃথিবীর স্বপ্ন দেখেছিলেন লিওনা। লিওনা'র আবিষ্কৃত এই কাপটির যাত্রা হঠাৎই থেমে যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় রবারের বিশেষ অভাব দেখা দিলে এর নির্মাণকার্যও থেমে যায়। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক হলে লিওনা আবার মেনস্ট্রুয়াল কাপ সমাজে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু নারী-অঙ্গ আর ঋতুচক্র নিয়ে এত মিথ আর কুসংস্কার মানুষের মধ্যে গেঁথে ছিল যে বস্তুটি এতটুকু জনপ্রিয়তা অর্জন করল না। যোনির ভেতরে কোনও কিছু প্রবেশ করানো নিয়েও অনেক অদ্ভুত ভাবনা জেগে উঠেছিল। কেউ ভাবত এটা হয়তো কোনও নিষিদ্ধ সুখ-গ্রহণের কৌশল, কেউ বা ভাবত এর পরিণতি হয়তো অসুস্থতা।

চালমার্স'এর স্বপ্ন বাস্তবের মাটি না ছুঁলেও, মেনস্ট্রুয়াল কাপের যাত্রা কিন্তু থামল না। এরপর দায়িত্ব গ্রহণ করেন রবার্ট পি ওরেক। ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি মেনস্ট্রুয়াল কাপের একটি নতুন কোম্পানি খোলেন। এবার সমস্যা হল, তিনি এই বস্তুটার প্রচার করবেন কীভাবে? সারা সমাজ জুড়েই তো 'ভ্যাজাইনা' আর 'মেনস্ট্রুয়েশন' নিষিদ্ধ শব্দ। বিজ্ঞাপনে তাই সে শব্দগুচ্ছের ব্যবহার করা যাবে না। তখন প্রচারের একটা উপায় বের করা হল। নার্সদের জিনিসটা ব্যবহার করার জন্যে পাঠানো হল ও তাদের ফিডব্যাক চেয়ে নেওয়া হল। নার্সদের অনুকূল প্রতিক্রিয়াকে সমাজের কাছে তুলে ধরা হল। তখন সেটা মেনস্ট্রুয়াল হেলথ প্রোডাক্ট হিসেবে সামান্য জায়গা পেল। খুব সামান্যই সে জায়গা, কারণ সমাজ চিরকালই শুচিবায়ুগ্রস্থ। 'মেনস্ট্রুয়াল কাপ'কে ব্যবহারের পর যোনি থেকে আঙুলের সাহায্যে বের করা, তারপর সেটাকে পরিষ্কার ও পুনরায় ব্যবহার করা- এই পদ্ধতি শুনে অনেকেই নাক কুঁচকে ফেলতেন।

আশির দশকের 'দ্য কিপার'-এর উদ্ভাবিত ল্যাটেক্স রবারের মেনস্ট্রুয়াল কাপ অবশ্য একটু বেশি সাড়া পায় আগেরগুলোর চেয়ে। ২০০১'এ শেষ অবধি তৈরি হয় প্রথম সিলিকন মেনস্ট্রুয়াল কাপ। এগুলোতে ব্যবহৃত সিলিকন রীতিমতো মেডিক্যাল গ্রেডের, যাতে অ্যালার্জিক প্রতিক্রিয়া প্রায় হয় না বললেই চলে। ক্রমশ এই প্রোডাক্টটার উৎপাদন শুরু করে বেশ কিছু কোম্পানি। বর্তমানে প্রায় সারা বিশ্বে বিভিন্ন আকার-আয়তনের মেনস্ট্রুয়াল কাপ বিক্রি ও ব্যবহার হতে দেখা যায়। ২০১০'এ উন্নয়নশীল দেশগুলোতে যেমন কেনিয়া, সাউথ আফ্রিকা প্রভৃতি দেশে মেনস্ট্রুয়াল কাপ নিয়ে বেশ সদর্থক প্রচার দেখা গিয়েছে। ২০১৯-এ কেরালার আলাপ্পঝায় মিউনিসিপালিটি কর্তৃক একটা প্রজেক্ট গৃহীত হয়েছিল। পাঁচ হাজার মেনস্ট্রুয়াল কাপ নারীদের মধ্যে একেবারে বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়েছিল। তারপর সেই এলাকার প্রচুর নারী স্থায়ীভাবে এই প্রোডাক্ট ব্যবহারে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। নিঃসন্দেহে এটা একটা যুগান্তকারী ব্যাপার।

স্যানিটারি ন্যাপকিন বেশিরভাগই প্লাস্টিক-বেসড। এগুলোর ব্যবহার-পরবর্তী নিক্ষেপ-প্রক্রিয়া মাটি, জল, বাতাস সমস্তটাকেই ভয়ানক ভাবে দূষিত করে চলেছে। একবার একটি গার্লস হোস্টেলের পেছনের রাস্তা দিয়ে হাঁটতে গিয়ে দেখেছিলাম, একটা পথ নুড়িতে বা ঘাসে নয়, ব্যবহৃত প্যাডে বিছানো। একবার এক কলেজের টিচার্স টয়লেটে গিয়ে ন্যাপকিন চেঞ্জ করার পর কোনও ডাস্টবিন দেখতে না পেয়ে প্যাডটাকে কোনও ভাবে মুড়ে কাঁধের ব্যাগেই ঢুকিয়ে নিয়েছিলাম। আসলে উপায় কিন্তু আমাদের সকলের সামনেই রয়েছে, শুধু গ্রহণ আর প্রয়োগ করলেই হবে।

নটে গাছ মুড়িয়ে ফেলার আগে একটা গল্প বলি:

ফেসবুকে এক দারুণ কাপল'এর ব্রেক আপ স্টোরি। লিখেছে অবশ্য বীর প্রেমিকটি। দু' বছর প্রেমের পর পুরুষসিংহটি দেখে তার ড্রিমগার্ল মেনস্ট্রুয়াল কাপ ব্যবহার করে। তখনই ড্রিমগার্লকে সে নানা জন্তুর স্ত্রীলিঙ্গ-বাচক নামের অভিধায় সাজিয়ে ফেসবুকে ব্রেক আপের স্টেটাস দেয়।

সে যাই হোক, তবে এটুকু বলে রাখা ভালো যে, আমার এই লেখা কিন্তু এই জাতের প্রেমিকদের জন্যে নয়। আর মেনস্ট্রুয়াল কাপ ব্যবহার করা বা না-করা যে নারীর নিজস্ব সিদ্ধান্ত, সে বিষয়ে কোনও দ্বিমত থাকতেই পারে না।


Thursday, 14 October 2021

আবেগরুদ্ধ কবি...

'তবু মনে রেখো'

প্রবুদ্ধ বাগচী

 

বিশ শতকের গোড়ার দিকে এই দেশে রেকর্ডিং প্রযুক্তি বাণিজ্যিক ভাবে প্রচলন হয়। কলকাতায় তার প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন বাঙালি উদ্যোগপতি হেমেন্দ্রনাথ বসু যাকে সবাই এইচ বোস বলেই চিনত। আদপে তিনি ছিলেন সুগন্ধি-ব্যবসায়ী, নিজের ল্যাবরেটারিতে নানা সুগন্ধি তৈরি করে বাণিজ্যিকভাবে বিপণন করতেন। তাঁর উৎপাদিত ‘কুন্তলীন’ ছিল অতি পরিচিত একটি সুগন্ধি। সাহিত্যমনস্ক এইচ বোস সাময়িকপত্রে প্রকাশিত গল্প বাছাই করে ‘কুন্তলীন’ পুরস্কার চালু করেছিলেন এটাও আমরা জানি। পরে ‘কুন্তলীন’ পুরস্কারপ্রাপ্ত গল্পের একটা সংকলনও প্রকাশিত হয়েছে। পারিবারিক সূত্রে এইচ বোস ছিলেন উপেন্দ্র কিশোর রায়চৌধুরীর ভগ্নীপতি। 

সিলিন্ডার রেকর্ডিং পদ্ধতি চালু হওয়ার পরে এইচ বোস রেকর্ড ও তা বাজানোর যন্ত্র তৈরি করে সাফল্যের সঙ্গে বিপণন করতে আরম্ভ করেন। রবীন্দ্রনাথের কন্ঠ রেকর্ডিং করার প্রথম কৃতিত্ব তাঁরই। এইচ বোসের বাড়িতে রবীন্দ্রনাথ তাঁর গান রেকর্ডিং করতে আসতেন, এই তথ্য অনেক জায়গাতেই পাওয়া যায়। তখন কলকাতা শহরে গায়ক হিসেবে রবীন্দ্রনাথের ভীষণ নামডাক। কিন্তু এগুলো সবই ছিল সিলিন্ডার রেকর্ড যা একাধিক কপি করা ছিল খুবই কঠিন আর তার সংরক্ষণ ছিল আরও সমস্যার। ফলে, ওই সময়ে করা রবীন্দ্রনাথের নিজের রেকর্ডিং প্রায় সবই নষ্ট হয়ে গেছে। কোনও কোনও সূত্র থেকে জানা যায়, ১৯০৬ সালে রবীন্দ্রনাথ নাকি এইচ বোসের স্টুডিওতে ‘বন্দেমাতরম’ গান নিজের সুরে রেকর্ডিং করেছিলেন। পরে পুলিশ এসে সেই রেকর্ড বাজেয়াপ্ত ও নষ্ট করে দেয়।

রেকর্ডিং প্রযুক্তির নতুন রকম উন্নতি হল ১৯২৪-২৫ নাগাদ। যখন সিলিন্ডার রেকর্ডের বদলে এল চ্যাপ্টা গ্রামোফোন রেকর্ড। বৈদ্যুতিক পদ্ধতিতে এই রেকর্ডিং হত। বাঙালি উদ্যোগপতি চণ্ডী চরণ সাহা ১৯২৫ সালে জার্মানি গিয়েছিলেন এই বৈদ্যুতিক রেকর্ডিং প্রযুক্তি বিষয়ে জ্ঞান লাভ করতে। সেই সময় রবীন্দ্রনাথও ছিলেন জার্মানিতে। সেখানে তাঁদের দেখা হয় এবং চন্ডীবাবু রবীন্দ্রনাথকে জানান, তিনি জার্মানি থেকে সমস্ত যন্ত্রপাতি কলকাতায় নিয়ে গিয়ে খুব শিগগিরি রেকর্ডিং কোম্পানি চালু করবেন। রবীন্দ্রনাথের কাছে অনুরোধ রাখা হয়, তিনি যেন এই বাঙালি কোম্পানি থেকে নিজের রেকর্ড করেন। এই প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ একটি চিঠিতে চিত্তরঞ্জন দাশের পত্নী বাসন্তী দেবীকে লিখছেন, '…এক ভদ্রলোক গ্রামোফোনে সুর ধরিয়া রাখার বিদ্যা য়ুরোপে গিয়া আয়ত্ত করিয়াছেন। তাঁর ইচ্ছা আমি তাহার কোম্পানিতে রেকর্ড করি।' (১৩৩৮, ৭ চৈত্র)।

১৯২৬ সালে এই চণ্ডী চরণ সাহা (সি সি সাহা) কলকাতায় তাঁর রেকর্ড কোম্পানি ‘হিন্দুস্থান মিউজিকাল প্রোডাক্টস’ তৈরি করলেন। মধ্য কলকাতার অক্রূর দত্ত লেনে তৈরি হল তাঁদের স্টুডিও যা পরবর্তীকালের বহু যশস্বী শিল্পীর পায়ের ধুলোয় ধন্য হয়ে উঠবে। স্টুডিওর আনুষ্ঠানিক সূচনা হল ওই বছর রাখি পূর্ণিমায় যেদিন স্বয়ং কবি সেখানে উপস্থিত ছিলেন ও ভিজিটর্স খাতায় লিখলেন তাঁর আশীর্বাণী। পরাধীন দেশের প্রথম দেশিয় কোম্পানি ছিল এই হিন্দুস্থান মিউজিকাল প্রোডাক্টস। ১৯৩২-এ কোম্পানি থেকে রেকর্ডিং'এর আমন্ত্রণ এল কবির কাছে। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ তখন যে এই বিষয়ে খুব আগ্রহী ছিলেন তা নয়। রথীন্দ্রনাথও কিছুটা আপত্তি করেছিলেন; কারণ ওই সময়কালে কবির বয়স একাত্তর, গলার সতেজভাব অনেকটাই স্তিমিত। এই অশক্ত গলার রেকর্ডিং কতটা ভাল হবে বা মানুষ তা কীভাবে নেবেন, এই নিয়ে তাঁদের একটা চিন্তা ছিল।

এখানে একটা কথা বলে নেওয়া দরকার। ১৯১৩ সালে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার আগে অবধি গ্রামোফোন কোম্পানি থেকে অনেক গানের রেকর্ড প্রকাশ পেয়েছিল যার কথা ও সুর রবীন্দ্রনাথের হলেও তাঁর নামের কোনও উল্লেখ অনেক সময়ই থাকত না, আর সেগুলি যারা গাইতেন তাঁরাও মূল স্বরলিপির তোয়াক্কা না করে একেবারে নিজেদের মতো করে গাইতেন। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে রবীন্দ্রনাথের সলিসিটর খগেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় গ্রামোফোন কোম্পানির দৃষ্টি আকর্ষণ করেন ও প্রকাশিত গানের রয়্যালটি দাবি করেন। গ্রামোফোন কোম্পানি কর্তৃপক্ষ সেই দাবি মেনে নেন ও পরে প্রকাশিত গানের জন্য কবিকে নিয়মিত রয়্যালটি দিতে থাকেন। রবীন্দ্রনাথই প্রথম ব্যক্তি যিনি সংগীত রচয়িতা হিসেবে রেকর্ড কোম্পানি থেকে নিজের লেখার জন্য সম্মানভাতা পেয়েছেন। এই সূত্রেই গ্রামোফোন কোম্পানির সঙ্গে কবির একটি চুক্তি হয় যাতে বলা হয় কবির গান গাওয়া ও প্রকাশ করার ক্ষেত্রে কবির অনুমোদন বাধ্যতামূলক হবে। আর কবি নিজে রেকর্ড করলেও তিনি নিয়মমাফিক তাঁর রয়্যালটি পাবেন। এর পরে গ্রামোফোন কোম্পানি থেকেও কবির অনেকগুলি রেকর্ড প্রকাশিত হয়, সেগুলিতে কবির কন্ঠ তুলনায় অনেক জোরালো, সেই সময়ের রেকর্ডিং প্রযুক্তির সীমাবদ্ধতা মেনে নিয়েও।

এখন সেই কারণেই কবি ও তাঁর পরিবার হিন্দুস্থান কোম্পানির এই প্রস্তাব নিয়ে একটু কুন্ঠিত ছিলেন। তখন এগিয়ে এলেন দুই মহলানবীশ ভাই- প্রফুল্লচন্দ্র ও প্রশান্তচন্দ্র এবং চণ্ডীবাবু নিজেও। তাঁরা কবিকে বোঝালেন, দেশবাসীর স্বার্থেই তাঁর কণ্ঠ রেকর্ডে ধরে রাখা উচিত। অনেক অনুরোধ উপরোধ রবীন্দ্রনাথ আর ফেলতে পারলেন না। এইভাবেই হল তাঁর রেকর্ডিং। 'তবু মনে রেখো'- কবির একাত্তর বছর বয়সের রেকর্ডিং:

 

এই রেকর্ডিং যারা শুনলেন তাঁরা নিশ্চয়ই খেয়াল করেছেন গানটির রেকর্ডিং'এর একটা বৈশিষ্ট্য। গানের একদম শেষ দিকে কবি একবারে ‘তবু মনে রেখো’ কথাটা উচ্চারণ করেননি- গেয়েছেন ‘ত……….বু মনে রেখো’; কেন এমন হল? এটা কি রেকর্ডিং'এর ত্রুটি? যদি ত্রুটিই হয় তাহলে এই রেকর্ড বাজারে এল কেন? উত্তরকালে ঠিক এই প্রশ্নটিই গায়িকা চিত্রলেখা চৌধুরীকে করেছিলেন এই রেকর্ডিং'এর রেকর্ডিস্ট নীরদবরণ বন্দ্যোপাধ্যায়। চিত্রলেখা বিজ্ঞানের ছাত্রী হিসেবে বলেছিলেন, এটা প্রযুক্তিগত ত্রুটি। আসলে কী? সেই কথা জানিয়েছেন স্বয়ং রেকর্ডিস্ট নীরদবাবু। এই গান কবির একদম প্রথম জীবনে লেখা এবং বহু অনুষ্ঠানে এই গান তিনি গেয়েছেন। ফলে, গানটির প্রতি কবির ছিল একরকমের গভীর একাত্মতাবোধ। পরিণত বয়সে এই গান রেকর্ড করতে এসে সত্যি সত্যি তিনি একাকার হয়ে গিয়েছিলেন এই গানের বাণীর ব্যঞ্জনার সঙ্গে। তাই গানের মধ্যে বারবার ধুয়ো হিসেবে উঠে আসা ‘তবু মনে রেখো’র উচ্চারণ আসলে ছেয়ে ফেলেছিল তাঁর ব্যক্তি আবেগের আকাশ। রেকর্ডিং করতে করতে ওই জায়গাটায় এসে সত্যি সত্যি কবির চোখে জল, কন্ঠ অশ্রুবাষ্পে অবরুদ্ধ- এই দৃশ্য প্রত্যক্ষ করেছিলেন রেকর্ডিস্ট। সেই অবকাশে ক্ষণিকের জন্য হলেও থেমে গিয়েছিল কবির কণ্ঠ। মুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিয়ে ফিরে এসেছেন গানে- কিন্তু ওই ‘ত………বু’র উচ্চারণ বিক্ষেপ রেকর্ড করতে যন্ত্র তো আর ভুল করেনি!

কিন্তু ওই রেকর্ডিং বাতিল করা হল না কেন? এই বিষয়ে জানা যায়, রেকর্ডিং শোনার পরে কোম্পানি কর্তৃপক্ষ ঠিক করেন এই ‘ভুল’টার এক মানবিক আবেদন আছে, তাই কবির আবেগ সমেত এই রেকর্ডিং'টিই বাজারে প্রকাশিত হয়। তাঁরা যথার্থ কাজই করেছেন। কিন্তু আক্ষেপের কথা, পরবর্তীকালে ডিজিটাল যুগে আরও উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে এই অংশ বাদ দিয়ে মেরামত করে রেকর্ডিং প্রকাশ করা হয় হিন্দুস্থান মিউজিকাল কোম্পানির তরফে যা খুব উচিত বলে আমাদের মনে হয় না। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে যদিও এই রেকর্ডিং এখনও পাওয়া যায়। 

  

Sunday, 10 October 2021

নোবেল কমিটি পথ দেখাল

বিশ্ব উষ্ণায়ন সমস্যার স্বীকৃতি

শোভনলাল চক্রবর্তী


এ বছর পদার্থবিজ্ঞানের জন্য নোবেল পুরস্কার ঘোষণা করতে গিয়ে নোবেল কমিটির তরফে বিশ্ব উষ্ণায়নের বিষয়টিকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে তাকে আগামী দিনে বিশ্বের সবচেয়ে বড় বিপদ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বিষয়টি যে নতুন এমন নয়। এর আগেও বহু বিজ্ঞানী থেকে শুরু করে পরিবেশ কর্মী এই বিষয়ে বিপদঘন্টি বাজিয়েছেন, কিন্তু দুনিয়া জুড়ে রাষ্ট্র ও সাধারণ মানুষ নির্বিকার। খাতায় কলমে বেশ কিছু কাজ চলছে সারা বিশ্ব জুড়ে। কিন্তু তার কোনও প্রত্যক্ষ ফলাফল আমরা প্রকাশ্যে দেখতে পাইনি। নোবেল কমিটি এবার এগিয়ে এল এবং পুরস্কৃত করল এমন তিনজনের কাজকে যাঁরা উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন বিশ্ব উষ্ণায়ন প্রক্রিয়ার ব্যাখ্যায়। 

'বাটারফ্লাই এফেক্ট' কথাটা আজ অনেকেই শুনেছেন। প্রকৃতির খামখেয়ালিপনা বোঝাতে ব্যবহৃত হয় শব্দবন্ধটি। অর্থাৎ, প্রকৃতি এতটাই খামখেয়ালি যে, নিউ ইয়র্কে একটি প্রজাপতির ডানা নাড়ার ফলে হয়তো ঝড় উঠে গেল বেজিং শহরে। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের যে সব ঘটনা কোনও নির্দিষ্ট ছক মেনে চলে, তাকে গণনার মধ্যে আনা তুলনামূলক ভাবে সহজ। কিন্তু যে সব ঘটনা ছকভাঙা, তাদের ক্ষেত্রে কী উপায়? এই ছক ভাঙা ব্যবস্থা বোঝাতেই বিজ্ঞানীরা 'বাটারফ্লাই এফেক্ট' উপমাটি প্রথম ব্যবহার করেছিলেন। পরবর্তীকালে উপমাটি ব্যবহার করা হয় এটা বোঝাতে যে, শুরুতে যদি একটা ছোট্ট ভুল হয়ে যায় তবে পরে শেষ ফলাফলে বড় ভুল হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আমরা যাকে বলি তিল থেকে তাল, অনেকটা তাই। 

বিজ্ঞানীরা একমত যে আপাত ভাবে যে জিনিসটা দেখে মনে হচ্ছে ছক ভাঙা, আসলে তার মধ্যেও লুকিয়ে রয়েছে একটা ছক। এই পথ ধরেই বিজ্ঞানের জগতে প্রবেশ ঘটে 'ক্যাওস থিওরি' বা 'বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি তত্ত্বের'। এই তত্ত্ব যে দুটি ক্ষেত্রে সফল ভাবে প্রয়োগ করা হয়েছে সেগুলি হল- আবহাওয়া ও জলবায়ুর পরিবর্তনের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন এবং স্টক মার্কেট'এর শেয়ারের দাম ওঠাপড়ার ব্যাখ্যায়। জলবায়ু ও আবহাওয়া পরিবর্তনের যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি তাকে গণিতের আওতায় আনতে সফল হয়েছেন সিউকুরো মানাবে ও ক্লাউস হাসেলমান। আবার পরমাণু পর্যায় থেকে গ্রহের বিশাল মাপের ভৌত অবকাঠামো নির্মাণের সঙ্গে কীভাবে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি যুক্ত হয়ে থাকে- তার পুঙ্খানুপুঙ্খ গাণিতিক হিসেব-নিকেশ দিয়েছেন জিওর্জিও পারিসি। 

এই আবিষ্কারগুলির জন্যই এই তিন বিজ্ঞানীকে এবার পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কার দেওয়া হল। এবারের পুরস্কার দেওয়ার মাধ্যমে নোবেল কমিটি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল যে বিশ্ব উষ্ণায়ন এই মুহূর্তে সারা বিশ্বের সামনে সবচেয়ে বড় সমস্যা। দীর্ঘদিন ধরে এ সব নিয়েই কাজ করেছেন এই তিন বিজ্ঞানী। এমন একটা সময়ে পুরস্কার দেওয়া হল, যখন অনেক রাষ্ট্রই এই সমস্যাকে তেমন গুরুত্ব দিচ্ছে না। 

জাপানে জন্ম হলেও সিউকুরো মানাবে বর্তমানে আমেরিকার বাসিন্দা, প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী। তাঁর বয়স নব্বই বছর। নব্বই পেরিয়ে নোবেল জয়ের নজির খুব বেশি নেই। এবারের তিন বিজয়ীর মধ্যে অর্ধেক পুরস্কার মূল্য পাবেন রোমের সাপিয়েঞ্জা বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণাকারী অধ্যাপক জিওর্জিও পারিসি। পারিসি'কে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে এই পুরস্কার দেওয়ার ক্ষেত্রে, কারণ, তাঁর গবেষণার কাজ অতিক্রম করেছে পদার্থবিদ্যার চেনা গণ্ডি। পারিসি'র গবেষণা যে কোনও জটিল বিশৃঙ্খল ব্যবস্থাকে ব্যাখ্যা করতে সাহায্য করবে, তা সে জীববিদ্যা হোক বা মেশিন লার্নিং কিংবা গণিত অথবা স্নায়ুবিদ্যা। 

সেই ছয়ের দশকে সিউকুরো মানাবে দেখিয়েছিলেন, বায়ুমণ্ডলে থাকা কার্বন-ডাই-অক্সাইড'এর মাত্রা বাড়লে কীভাবে ভবিষ্যতে বিশ্ব উষ্ণায়ন বাড়বে। তিনিই প্রথম বিজ্ঞানী যিনি পৃথিবী থেকে তাপ বিকিরণের ভারসাম্য ও বায়ুর উল্লম্ভ তলে তাপ পরিবহনের মধ্যে সঠিক সম্পর্ক গাণিতিক ভাবে নির্ণয় করেন। মানাবে যখন এই কাজ করছেন তখন তিনি ছিলেন পরিবেশ বিজ্ঞানের একলা পথের পথিক। কারণ, তখন পদার্থবিদ্যার আসল মুগ্ধতা কণা তত্ত্ব ও জ্যোতির্বিজ্ঞানকে ঘিরে। সেই সময় আপেক্ষিকতা বাদ দিয়ে কোনও বিজ্ঞানী কাজ করলে তাঁদের ঠিক জাতের বিজ্ঞানী বলে বিজ্ঞান মহল মেনে নিত না। বিজ্ঞানের নোবেল পুরস্কার বিজয়ীদের নামের তালিকা এবং তাঁদের কর্মক্ষেত্র এর সবচেয়ে বড় সাক্ষ্য বহন করছে। বিশ শতকের শেষের দিকে যখন পরিবেশ বিজ্ঞান জাতে উঠল, তখন মানাবে'র গণিতের ভিত্তিতে আধুনিক সব পরিবেশ মডেল তৈরি হতে থাকে বিশ্বের নানান প্রান্তে। 

এবারের পদার্থবিদ্যার নোবেলের তৃতীয় বিজয়ী ক্লাউস হাসেলমানের কর্মক্ষেত্র জার্মানির হামবুর্গ শহরের ম্যাক্স প্লাঙ্ক ইনস্টিটিউট ফর মেটিওরোলজি। আবহাওয়া দ্রুত বদলালেও কেন নির্ভর করা যায় পরিবেশ মডেলগুলোর উপর, তার ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন হাসেলমান। প্রাকৃতিক ঘটনা এবং মানুষের নানা কাজের ফল কীভাবে জলবায়ুর উপর প্রভাব ফেলে, আর তার থেকেও বড় কথা, কীভাবে তা চেনা যায়, সেই পথ বাতলেছিলেন এই জার্মান বিজ্ঞানী। তখন মানুষের সময় হয়নি সেই সব কথা মন দিয়ে শোনার। আজ যখন পৃথিবী জুড়ে পরিবেশ বদলের প্রভাব শুরু হয়ে গেছে তখন এই সব প্রান্তিক বিজ্ঞানীর কণ্ঠস্বর শুনতে মানুষ এবং অবশ্যই নোবেল কমিটি বাধ্য হয়েছে। নোবেল কমিটির প্রধান থর্স হান্স হানসন বলেছেন যে, এই তিনজনের আবিষ্কার থেকে জানা যায় পরিবেশ ও জলবায়ু নিয়ে আমরা যা জানি, তা বৈজ্ঞানিক ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে। ভাগ্যিস বললেন, এত দিন মানুষের মনে আবহাওয়াবিদদের সম্পর্কে ধারণা ছিল যে এঁরা যা বলেন তার উলটোটাই ঘটে। সেটার কারণ এই যে, জলবায়ু এতটাই বিশৃঙ্খল একটা ব্যবস্থা যার সঠিক পূর্বাভাসের জন্য চাই- উপগ্রহ যে ছবি বা বার্তা দিচ্ছে তার দ্রুত বিচার করে ব্যবস্থা নেওয়া এবং তা সাধারণ মানুষকে জানানো। এই কাজে সহায়ক দ্রুততম সময়ের মধ্যে কাজ করতে পারা সুপার কম্পিউটার, যার যোগ্য উত্তরাধিকারী বাইনারি কম্পিউটার। 

আমেরিকায় পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনের সঠিক তথ্য জানানোর জন্য ব্যবহৃত হয় ১২২টি সুপার কম্পিউটার, চিন ব্যবহার করে ১৮৮টি, আর ভারত? আন্দাজ করতে গিয়ে ঠকতে হতে পারে- মাত্র তিনটি। এরপরের বার হাওয়া ভবনের পাঠানো ঝড় বৃষ্টির নির্দেশিকা নিয়ে হাসাহাসি করার আগে এই তথ্যটা মাথায় রাখবেন। মাত্র তিনটি সুপার কম্পিউটার নিয়ে আমাদের দেশের পরিবেশ বিজ্ঞানীরা যে কাজ করছেন তাকে কুর্নিশ না জানিয়ে উপায় নেই। বিশ্ব উষ্ণায়নের দিকে চোখ ফেরাতে গিয়ে জলবায়ু পরিবর্তনের বিপদ সম্পর্কে যদি সাধারণ মানুষ সচেতন হন, তবে এবারের পদার্থবিদ্যার নোবেল প্রাপকদের নাম ইতিহাস হবে। এঁরা কিন্তু অনেকদিন ধরে বলে আসছেন যে শেষের সে দিন আর খুব দূরে নয়, তবুও কারও কোনও হেলদোল নেই। এবার যদি রাষ্ট্রনেতাদের কানে কিছু জল ঢোকে। দেখা যাক।


Monday, 4 October 2021

'জাগ উঠা ইনসান'

উত্তরপ্রদেশে মুষল পর্ব

সোমনাথ গুহ


গতকাল (৩ অক্টোবর) উত্তরপ্রদেশের লখিমপুর খেরিতে যা ঘটে গেল তাতে সারা দেশ স্তম্ভিত। আদিত্যনাথের জমানায় নাগরিকত্ব আইন বিরোধী আন্দোলনের ওপর অভূতপূর্ব দমনপীড়ন থেকে শুরু করে হাথরস কাণ্ড পর্যন্ত এই রাজ্যে বহু মর্মান্তিক ঘটনা দেখা গেছে, কিন্তু পূর্ব উত্তরপ্রদেশের এই জেলায় রবিবার যা ঘটে গেল তা নির্মমতায় অতীতের সমস্ত নজির ছাপিয়ে গেছে। কৃষকরা কেন্দ্রীয় গৃহ প্রতিমন্ত্রী অজয় মিশ্র এবং রাজ্যের উপমুখ্যমন্ত্রী কেশব মৌর্য'র বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখানোর জন্য জড়ো হয়েছিলেন। দুটি এসইউভি উন্মত্ত ষাঁড়ের মতো জনতার ওপর হামলে পড়ে, যার ফলে নয় জন নিহত হন। এঁদের মধ্যে চারজন কৃষক ও একজন সাংবাদিক আছেন। অভিযোগ, একটি গাড়ি কেন্দ্রীয় গৃহ প্রতিমন্ত্রীর পুত্র আশিস মিশ্র নিজেই চালাচ্ছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করা হয়েছে।   

গত কয়েক মাস ধরেই দেখা যাচ্ছিল যে বিজেপি সারা উত্তর ভারতে ক্রমশ মারমুখি ও আগ্রাসী হয়ে উঠছে। কৃষক আন্দোলনের শুরু থেকেই বিজেপি সরকার এই আন্দোলনকে মোকাবিলা করার জন্য দ্বিমুখি রাস্তা অবলম্বন করেছে এবং কিষাণ নেতৃত্বের সঙ্গে আলোচনা বন্ধ হয়ে যাবার পর তারা তা আরও সক্রিয় ভাবে অনুশীলন করা শুরু করেছে। তারা একদিকে খালিস্তানি, পাকিস্তানি, সন্ত্রাসবাদী ইত্যাদি তকমা দিয়ে আন্দোলনকে কলঙ্কিত করা ও অন্যদিকে লাগাতার প্ররোচণামূলক প্রচার ও নানা ছলচাতুরি করে কৃষকদের হিংসাত্মক করে তোলার চেষ্টা চালিয়ে গেছে। এর আগে আমরা দেখেছি, পুলিস কী নির্মম ভাবে হরিয়ানার কার্নালে আন্দোলনকারীদের ওপরে লাঠিচার্জ করে। একজন কৃষক সেই আক্রমণে মারা যান, বহু কৃষক রক্তাক্ত হন। ২৭ সেপ্টেম্বরের ভারত বনধ'এও বিভিন্ন জায়গায় প্রতিবাদকারীদের ওপর আক্রমণ হয়েছে, রটনা হয়েছে যে তাঁরা বলপূর্বক বনধ সফল করার চেষ্টা করেছেন। বনধের দিন প্রধানমন্ত্রী ‘ডিজিটাল হেলথ মিশন’ উদ্বোধন করলেন কিন্তু কৃষকদের দাবি-দাওয়া নিয়ে একটি কথাও বললেন না। কয়েকদিন বাদেই বললেন, বিরোধীরা কৃষকদের বিপথগামী করছে; যেন কৃষক নেতৃত্ব এতই দুর্বল ও নাদান যে তাঁরা অন্যদের দ্বারা চালিত হবেন। এমনকি মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট, যারা এতদিন এই আন্দোলন সম্পর্কে বিরূপ কোনও মন্তব্য করা থেকে বিরত থেকেছে, তারা হঠাৎ বলে বসল যে কৃষি আইনগুলির ওপর তো স্থগিতাদেশ দেওয়া হয়ে গেছে, তবুও কেন আন্দোলন চলছে। রাস্তা আটকে বিক্ষোভ দেখানোর জন্য তারা কৃষক নেতৃত্বের নিন্দাও করল। 

হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রী মনোহরলাল খাট্টার স্বয়ং তাঁর দলের কর্মীদের সশস্ত্র হওয়ার আহ্বান জানালেন। এটা অভূতপূর্ব এবং অকল্পনীয় যে, কোনও মুখ্যমন্ত্রী তাঁর চেয়ার থেকে এই ধরনের সহিংস প্রত্যাঘাত করার আহ্বান জানাচ্ছেন। আন্দোলন মোকাবিলা করার জন্য তিনি কর্মীদের পরামর্শ দিলেন নিজেদের মধ্যে দল তৈরি করতে এবং লাঠি সহ অন্যান্য হাতিয়ার তুলে নিতে। তিনি তাঁদের আশ্বস্ত করলেন, এর জন্য তাঁদের মার খেতে হতে পারে, জেল যেতে হতে পারে, একই সাথে এই অভিজ্ঞতার ফলে তাঁরা বড় নেতাও হয়ে উঠতে পারেন। লক্ষ্যণীয়, মুখ্যমন্ত্রী খাট্টারের এই উস্কানিমূলক বক্তব্যই অজয় মিশ্রকে বলতে প্ররোচিত করে যে এই কৃষকরা হাতে গোনা কয়েকজন মাত্র, বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষিজীবী নাকি তাঁদেরই দিকে। প্রধানমন্ত্রী চুপ, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক চুপ। হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি হিংসার একটা আদ্যোপান্ত আখ্যান। না হলে গান্ধীর জন্মদিবসে যখন নাথুরাম গডসে ট্যুইটারে ট্রেন্ডিং হচ্ছে তখনও অধুনা 'গান্ধী-ভক্ত' এই নেতারা সেটা বন্ধ করার জন্য কোনও উদ্যোগ নিলেন না! অসমে মরা লাশের ওপর যখন নৃত্য করা হল তখনও কেন্দ্রীয় সরকার প্রতিবাদ করার কোনও প্রয়োজন বোধ করল না! 

ঘটনা ঘটে যাবার পর আদিত্যনাথ এখন সিঁদুরে মেঘ দেখছেন। পুরো উত্তরপ্রদেশ অবরুদ্ধ, একটা জেলখানার মতো। রাজনৈতিক দলের কোনও নেতা-নেত্রীকে লখিমপুর খেরিতে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। শাসক বলছে, বিরোধীদের এখানে রাজনৈতিক পর্যটন করতে আসতে দেওয়া হবে না। প্রিয়াঙ্কা গান্ধিকে সিতাপুর নামক জায়গায় আটকে দেওয়া হয়েছে এবং একটি গেস্ট হাউসে বন্দী করে রাখা হয়েছে। পঞ্জাবের উপমুখ্যমন্ত্রী সুখবির সিং রণধাওয়াকে রাজ্যের সীমান্তে আটকে দেওয়া হয়েছে। মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী ভূপেন্দ্র বাঘেলকে লখনউ বিমানবন্দরে নামতেই দেওয়া হয়নি। সমাজবাদী দলের নেতা অখিলেশ যাদবকে তাঁর বাড়িতে গৃহবন্দী করে রাখা হয়েছে। 

কিন্তু বিজেপি জানে যে এই বিরোধী দলগুলি কোনও সমস্যা নয়। ফেব্রুয়ারির বিধানসভা নির্বাচনে এসপি, বিএসপি, কংগ্রেস কেউ তাদের প্রতিপক্ষ নয়, তাদের আসল প্রতিপক্ষ কৃষক আন্দোলন। এটা নিশ্চিত যে কৃষক নেতৃত্ব উত্তরপ্রদেশের নির্বাচনেও ‘নো ভোট টু বিজেপি’ প্রচার করবেন এবং সে ক্ষেত্রে মানুষ যদি বাংলার ভোটারদের মতো বিচক্ষণতা দেখান এবং বিজেপির সবচেয়ে শক্তিশালী যে প্রতিপক্ষ তাকেই ভোট দেন তাহলে লখনউয়ের মসনদে বিজেপির প্রত্যাবর্তন আটকে তো যাবেই, দু' বছর বাদে কেন্দ্রেও তারা সরকার গড়তে পারবে কিনা তা অনিশ্চিত হয়ে যাবে।

লখিমপুর খেরি'তে কৃষক হত্যার বিরুদ্ধে কলকাতায় জনবিক্ষোভ
 

আট বছর আগে মুজফরনগরে দাঙ্গা বাঁধিয়ে, হিন্দু ভোট এককাট্টা করে তারা হেলায় ২০১৪ ও ২০১৭'র নির্বাচন জিতে গিয়েছিল। কিন্তু কৃষক আন্দোলনের ফলে পশ্চিম উত্তরপ্রদেশে এখন হিন্দু-মুসলিম ঐক্য অটুট। রাজ্যের পূর্ব প্রান্তেও এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ার ফলে বিজেপি এখন রীতিমতো বিপাকে। তাই রাকেশ টিকায়েতকে পাশে বসিয়ে পুলিস প্রশাসন নানা প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। প্রথমত, একজন অবসরপ্রাপ্ত হাইকোর্টের বিচারপতিকে দিয়ে ঘটনার বিচারবিভাগীয় তদন্ত হবে। দ্বিতীয়ত, নিহতদের পরিবারকে ৪৫ লক্ষ টাকা ও আহতদের দশ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে এবং নিহতদের পরিবারের একজনকে সরকারি চাকরি দেওয়া হবে। আদিত্যনাথ নিজে ঘোষণা করেছেন যে যারা এই ঘটনার জন্য দায়ী তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হবে।

প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিজেপি কি পার পেয়ে যাবে! সবাই জানে যে কৃষক আন্দোলন থামবে না, রাকেশ টিকায়েত বলেই দিয়েছেন, প্রয়োজন হলে তা আরও দশ বছর চলবে। আর আন্দোলন যদি জারি থাকে তাহলে বিজেপি'র ক্ষমতার পথ কন্টকিত, দুর্গম। সুতরাং, সংঘাত অনিবার্য। বিজেপি'র পক্ষ থেকে আগামী দিনে হিংসা আরও বাড়বে, আরও রক্ত ঝরবে। উত্তরপ্রদেশের আমজনতা নিশ্চয়ই তার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন।


Saturday, 2 October 2021

গান্ধীমানস

চির বিতর্কিত অথচ অমর

শোভনলাল চক্রবর্তী

বিংশ শতাব্দীর এক আশ্চর্য ব্যক্তিত্ব মহাত্মা গান্ধী। দুটো বিশ্বযুদ্ধ, সামরিক অভ্যুত্থান, হিংসা, রক্তপাত, বন্দুকের নল থেকেই রাজনৈতিক ক্ষমতা বেরিয়ে আসে- সব দেখেছে এই শতাব্দী। রাজনৈতিক নেতা থেকে বিপ্লবী, সবাই ক্ষমতাকেই মোক্ষ মনে করেছেন। একেবারে বিপরীত মেরুতে মাত্র একজন, অহিংস নীতিতে অবিচল মহাত্মা গান্ধী। চির বিতর্কিত, চির অমর। 

তিনি আমাদের অনেক কিছু দিয়ে গেছেন। যা দিয়েছেন তার সবটা হয়তো আমরা গ্রহণ করতে পারিনি। তাঁর মহত্ব সেই কারণে সার্বিকভাবে অনুধাবন করা সম্ভব হয়নি। তাঁর লেখালেখি, গ্রন্থরাজি, বক্তৃতা উল্টেপাল্টে দেখা হয় বটে, কিন্তু গান্ধীর আত্মাকে স্পর্শ করতে সে অনুধ্যান অপারগ। এ কথা স্বীকার না করে উপায় নেই। একুশ শতকে পৌঁছে এই তপস্বীর চিন্তা চেতনা ভাবনা এবং আদর্শকে ঠাহর করতে আমরা বারবার অসমর্থ হয়েছি। 

বছর খানেক আগে 'ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার্স' আন্দোলনের সূত্রে ঠিক এমনিই একটি বহু বিতর্কিত প্রসঙ্গ ফের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এসে পড়ে। এই মর্মে সুকৌশলে একটি মত ছড়িয়ে দেওয়া হয় যে মহাত্মা আদতে ছিলেন এক বর্ণ বিদ্বেষী মানুষ। তাঁর মননেও নাকি ছিল জাতি বিদ্বেষের প্রবল প্রকাশ। দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রবাস জীবনে সেখানকার আদিবাসীদের থেকে তিনি সর্বদা ভারতীয়দের পৃথক রাখতে তৎপর ছিলেন। কারণ, তাঁর মনে এক আশঙ্কা ছিল, নেটিভ আফ্রিকানদের সঙ্গে মিশিয়ে ফেলে সাম্রাজ্যবাদী ঔপনিবেশিক শাসক যেন ভারতীয়দের কোনওভাবে বঞ্চিত করতে না পারে। কেউ কেউ গান্ধীর লেখা খুলে দেখিয়ে দিয়েছেন যে তিনি প্রথাগত ভাবে নেটিভ আফ্রিকানদের 'কাফির' অভিধায় অভিহিত করেছেন। 

এসব কথা অস্বীকার করার উপায় নেই, কারণ, এ সবের তথ্য ও ইতিহাসগত প্রমাণ আছে। তবে অস্বীকার না করেও গান্ধীর হয়ে কলম ধরেছেন অনেকে, যেমন রাম গুহ, রাজমোহন গান্ধী, ফায়জল দেবজি। তাঁরা গান্ধীজীর মানুষ হিসেবে বিবর্তনের কথা বলেছেন। অনেক কালো মানুষের সঙ্গে গান্ধীজীর নিবিড় বন্ধুত্বের কথাও বলেছেন। তাঁরা গান্ধীজীর লেখা উদ্ধৃত করে দেখিয়েছেন যে ১৯১৩ সালের পর গান্ধীজী এসব ব্যাপারে আর কোনও মন্তব্য করেননি। ভুলে গেলে চলবে না, মার্টিন লুথার কিং থেকে শুরু করে নেলসন ম্যান্ডেলা পর্যন্ত যে সব বিশ্ববরেণ্য কালো মানুষ গান্ধীকে তাঁদের অনুপ্রেরণা বলে বর্ণনা করেছেন, তাঁরা সবাই গান্ধীর আফ্রিকান অতীত সম্পর্কে অবগত ছিলেন। তাঁরা গান্ধীর চিন্তার বিবর্তনকে মেনে নিয়েছিলেন। যাঁরা আজও গান্ধী মূর্তি ভাঙার কথা বলেন, তাঁদের সম্পর্কে তাই নতুন করে কিছু বলার নেই। যাঁরা গান্ধীর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শনের রাজনীতি করেন, সেই রাজনীতিতে ধীর স্থির ভাবনার কোনও পরিসর থাকে না। কলকাতায় যাঁরা সত্তরের দশকে মূর্তি ভাঙার রাজনীতি করেছিলেন, তাঁদের ক'জনকে আমরা মনে রেখেছি? বরং যাঁদের মূর্তি ভাঙা হয়েছিল তাঁরা আজও আমাদের হৃদয়ে স্বমহিমায় অবস্থান করছেন। 

নির্মোহ ভাবনা এবং সময়ের প্রেক্ষিত- ইতিহাস চর্চার এই দুটি অতি আবশ্যিক শর্তের মাপকাঠিতে বিচার করা দরকার গান্ধীর জীবনদর্শনকে। ব্রহ্মচর্য সম্পর্কে তাঁর ধ্যানধারণা থেকে শুরু করে স্বাধীনতার প্রকৃত অর্থ- তাঁর ধারণার ব্যাপ্তি অপরিমেয় এবং সে সব ধারণা নিয়ে তিনি কোনও রাখঢাক রাখেননি, সমস্ত কিছু সাবলীল ভাষায় লিপিবদ্ধ করে গেছেন। তাই তাঁকে ভুল ব্যাখ্যা করার খুব একটা অবকাশ নেই, কিন্তু সেখানেও অনেক প্রশ্ন আর কেন'র ভিড়। ইতিহাসবিদ লেনার্ড গর্ডন লিখেছেন যে, তিরিশ-চল্লিশের দশকে হিন্দু বাঙালিরা গান্ধীকে বলতেন 'গেঁধো শালা', গান্ধী নাকি ছিলেন হিন্দু বিরোধী। গর্ডন আরও লিখছেন, যে সত্তরের দশকে বাংলার দেওয়ালে দেওয়ালে লেখা হল 'চিনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান'- সেই চেয়ারম্যান মাও আজ নিজের দেশেই বিস্মৃতপ্রায়, কিন্তু গান্ধী আজও স্বমহিমায় বিরাজ করছেন বিশ্ববাসীর মনে। 

গর্ডন'এর এই লেখার প্রেক্ষিতে মনে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, কেন এমন হল? কারণ, গান্ধীর সম্পূর্ণ জীবন চিত্র ও ভাষ্যে দীপ্যমান। গান্ধীজীর গ্রামীণ ভারত এবং তার অর্থনৈতিক বিকাশ কিংবা বর্ণাশ্রম সম্পর্কে তাঁর মূল্যায়ন এবং ভাবনা, কোনওটাই বিক্ষিপ্ত চিন্তা বা এলোমেলো নয়, বরং এক সুসংহত সমাজ পরিকল্পনার অঙ্গ। আধুনিকতার সঙ্গে তাঁর বিরোধ ছিল না কিন্তু নির্বিচারে সনাতনী ভারত আত্মাকে বিসর্জন দিয়ে, মানবতাবাদকে উপেক্ষা করে কোনও মতবাদ বা পরিকল্পনায় তিনি সায় দেননি। তিনি বুঝেছিলেন, বিরামহীন নগরকেন্দ্রিকতা সভ্যতার একমাত্র সূচক হতে পারে না, ভারত আত্মা নিহিত আছে তার গ্রামে। গান্ধীর জন্মজয়ন্তীতে এই উপলব্ধি আরও একবার আমাদের বিবেককে জাগ্রত করে তুলুক যে, প্রেক্ষিতহীন ভাবে অতীত এবং অনতি অতীতের ইতিহাসের বিকৃতি এক অর্থে মানসিক ক্লীবত্বকে প্রতিষ্ঠা করে। যে ক্লীবত্ব থেকে গান্ধীর ব্রহ্মচর্য নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষাকে আক্রমণ করা হয়। 'মি টু'র যুগে গান্ধী যা করেছিলেন তাকে যৌন হেনস্থা বলে অনেকে দাগিয়ে থাকেন। অন্যদিকে যাঁরা গান্ধীর এই পরীক্ষার সঙ্গী ছিলেন, তাঁরা বলেছিলেন, গান্ধী ছিলেন তাঁদের মা। একজন পুরুষের মধ্যে মা'কে খুঁজে পাওয়া বড় সহজ নয়, বলেন মনস্তাত্ত্বিকরা। 

গান্ধীজী কোথাও কিছু লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করেননি, সত্যের সঙ্গে সব পরীক্ষা তিনি লিপিবদ্ধ করে গেছেন। তাই তাঁর জীবন যেন একটা খোলা বই। তাঁর জীবনই তাঁর বাণী- কথাটার অর্থই এই যে পাঠক নিজেই বিচার করবেন কোথায় গান্ধীজী ভুল আর কোথায় ঠিক। সত্যের পরীক্ষায় পাশ-ফেলের নম্বর দেবেন পাঠক- এই ছিল গান্ধীর অভিমত। দেশের মুক্তি, মানুষের মুক্তি ও নিজের আত্মার মুক্তির জন্য যে সাধনাত্রয়, সেই ত্রিমুখি সাধনাকে তিনি কখনও পরস্পর বিযুক্ত বলে ভাবেননি। গান্ধীজীর জীবন ছিল ভয়ঙ্কর ও অসাধারণত্বের এক অনন্য সংমিশ্রণ। সুভাষ চন্দ্র বসু'র প্রতি তাঁর আচরণ এবং সুভাষ সম্পর্কে তাঁর মত একেবারে বিপরীত মেরুর। এই বৈপরীত্য আসলে একজন সাধারণ মানুষের। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে মহাত্মার বিজ্ঞান নিয়ে যে তরজা, সেখানেও আমরা এক দেবতা নয়, সাধারণ মানুষকে দেখি যিনি পাপ-পুণ্য বিশ্বাস করেন, টোটকায় বিশ্বাস রাখেন। এসবের ফলে গান্ধী ছোট হয়ে যাননি, শুধু রক্তমাংসের মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। 

বিবিসি'কে দেওয়া একটি রেডিও সাক্ষাৎকারে আম্বেদকর একবার বলেছিলেন, গান্ধীজী স্মরণীয় কেউ নন, ভারত সরকার তাঁর স্মৃতি জিইয়ে রাখার জন্য প্রতি বছর অনেক পয়সা খরচ না করলে পৃথিবীর মানুষ গান্ধীকে মনে রাখত না। সত্যিই কি তাই? আমাদের দেশের এবং পাশ্চাত্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দিকে তাকালে দেখা যাবে, শুধু নাম জানা নয়, প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে অবশ্যপাঠ্য তাঁর রচনা। সবাই তাঁর রচনার সঙ্গে একমত বলে তা নয়, এই আধুনিক, দূষণদুষ্ট, সংঘাতক্লিষ্ট শিল্প সভ্যতার আলোচনা তাঁকে বাদ দিয়ে সম্ভব নয়, তাই তিনি পাঠ্য। কেউ ভাবেন, তাঁর ভাবনা চিন্তা অবাস্তব, কেউ ভাবেন তিনি প্রতিক্রিয়াশীল, কেউ ভাবেন সাধুত্বের আড়ালে তিনি এক ধূর্ত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, কিন্তু তাঁকে বিস্মৃত হওয়া যায় না। ধনী বা নিঃস্বের মধ্যে গান্ধী মহারাজের শিষ্য আজ আর পাওয়া যাবে না হয়তো। আসলে আমরা জেনেশুনেই তাঁর পথে হাঁটি না, কিন্তু তিনি তবু আমাদের মনের মধ্যে বসে থেকে মাঝে মাঝেই প্রশ্ন করেন: কোথায় চলেছ? 

গান্ধীর মৃত্যুর পর আইনস্টাইন বলেছিলেন, আগামী বিশ্ব বিশ্বাসই করবে না যে এইরকম একজন মানুষ পৃথিবীর মাটিতে হেঁটেছিলেন। কথাটা ভীষণ সত্যি, নইলে আজও কেন স্লোগান ওঠে 'গান্ধী নিপাত যাক'। আসলে গান্ধীমানস এক অতলান্তিক সমুদ্র যাত্রা যার গভীরতায় আমরা ভয় পাই, সেই ভয় থেকেই ওই স্লোগান। সেই অতলান্তিক সমুদ্রযাত্রার পরতে পরতে মিশে আছে ভারতের উন্নতির স্বপ্ন। এই স্বপ্নের অভিযাত্রা আমাদের পৌঁছে দিতে পারে কোন শীর্ষে- সে সম্পর্কে আমাদের ধারণা বড় সীমিত। আর এর ব্যাপকতা অনুভব করতে চাই সামগ্রিক ইতিহাস চেতনা। সেই চেতনার এত অভাব দেখে মন অশান্ত হয়ে ওঠে।


Thursday, 30 September 2021

কংগ্রেস’এর ইতি!

‘কংগ্রেসি ডায়াসপোরা’র খোঁজে?

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য

 

গোয়ার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ও কংগ্রেস নেতা ফেলেইরো কলকাতায় তৃণমূল দলে যোগদান করে সাংবাদিকদের সামনে এক গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেছেন, দেশের সব থেকে পুরনো দল কংগ্রেস আজ নানা শিবিরে বিভক্ত, যেমন, তৃণমূল, ওয়াইএসআর, এনসিপি, ইন্দিরা কংগ্রেস এমনতর আরও বিবিধ; বিজেপি’কে মোকাবিলা করতে হলে এই ভাঙ্গা কংগ্রেস পরিবারের একতা জরুরি। উল্লেখ্য, ঠিক তার আগের দিন কানহাইয়া কুমার কংগ্রেসে যোগদান করতে গিয়ে বলেছেন যে, কংগ্রেস যদি না থাকে তাহলে দেশ থাকবে না।

উপরের দুই নেতার বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিত আলাদা হলেও অন্তঃসার এক: নতুন করে কংগ্রেস মতাদর্শের পুনর্জাগরণ। কিন্তু এটা স্পষ্ট, দু’ বছরেরও বেশি সময় ধরে সভাপতিহীন একটি দল, যা একের পর এক নির্বাচনে পর্যুদস্ত হয়ে চলেছে, জাতীয় স্তরে বিজেপি’র দুর্দমনীয় শক্তির কাছে যাকে নেহাতই দুর্বল ও বিভ্রান্তিকর বলে সাব্যস্ত হয়, সেই দলের যদি সত্যি সত্যি উঠে দাঁড়ানোর কোনও আবহ তৈরি হয়, তবে তা দলের বর্তমান শীর্ষ নেতৃত্বের দ্বারা একেবারেই সম্ভব নয়। তাহলে কি কংগ্রেসের ইতি সমাগত? এখানেই বোধ হচ্ছে, ১২৫ বছরেরও বেশি পুরনো একটি বৈচিত্র্যময় দলের ‘ডায়াসপোরা’ বলে যদি কোনও পরিসর থেকে থাকে অথবা আজকের পরিস্থিতিতে তা নতুন আলোকে নির্মিত হয়, সে ক্ষেত্রে হয়তো এক নতুন অভিযোজন অসম্ভব কিছু নয়; যা টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়া সাংগঠনিক অস্তিত্বকে এক খোলামেলা মঞ্চে এনে মেলাতে পারে। যাকে আমরা আজকের পরিপ্রেক্ষিতে, পশ্চিমি বর্গ ধার করে বলতে পারি ‘সমাজ-গণতন্ত্রী’ সংহতি। এই সংহতি কি গান্ধী পরিবারের নেতৃত্বের অপরিহার্যতাকে নাকচ করেই নতুন এক কংগ্রেস দলের জন্ম দেবে, নাকি অন্য কোনও নতুনতর মঞ্চ, জোট অথবা দলে এর উত্তরণ ঘটবে, তা এখুনি বলা সম্ভব নয়।

২০২২’এর ফেব্রুয়ারিতে উত্তরপ্রদেশের বিধানসভা এবং তারপর ২০২৪’এর লোকসভা নির্বাচন- এই দুটিকে আপাতত ধরা যেতে পারে ভারতীয় গণতন্ত্র তথা রাজনীতি ও অর্থনীতির এক নির্ধারক মাইলফলক। আগামী দিনে দেশ ও দশের ভাগ্যনিয়ন্তা কে হবে- চরম বিভাজনকামী, একরোখা কর্পোরেট-স্বার্থ সম্বলিত, ধর্মীয় মৌলবাদী ও উগ্র রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা সম্পন্ন একটি দল, নাকি, এক আপেক্ষিক উদার সমাজ-গণতান্ত্রিক এমন এক জোট যা সর্ব অর্থে অন্তত কিছুটা হলেও মানুষের গণতন্ত্র ও রুটি-রুজির সমস্যাকে অগ্রাধিকারে রাখবে। বলাই বাহুল্য, দ্বিতীয় পথটিকে গড়ে তুলতে হলে ‘কংগ্রেসি ডায়াসপোরা’র (কংগ্রেস দল বলছি না) সমাজ-গণতন্ত্রী হয়ে ওঠাটা যেমন জরুরি, তেমনই বাম মতাদর্শের আরও বাস্তবানুগ ও প্রকৃত অর্থে গণতন্ত্রপ্রিয় হয়ে ওঠাটাও সমান প্রাসঙ্গিক

বুঝতে হবে, স্বাধীনতা উত্তরকালে (গত শতকের ৯০’এর দশক অবধি) কংগ্রেসের নানা অনাচারের বিরুদ্ধে কার্যকরী বিরোধী শক্তি হিসেবে তিনটি ধারাকে আমরা দেখতে পেয়েছি: ১) বাম ধারা ২) দক্ষিণ ভারতের আঞ্চলিক শক্তি (প্রথমে তামিলনাড়ু ও পরে অন্ধ্রপ্রদেশ) এবং ৩) কংগ্রেসের সমাজতান্ত্রিক ধারা (যা জয়প্রকাশ নারায়ণের উদ্যোগে জনতা পার্টি গঠন ও পরে তার ভাঙনের মধ্য দিয়ে মূলত উত্তর ভারতে আঞ্চলিক দলে পরিণতি পেয়েছিল)। এছাড়াও স্বতন্ত্র পার্টি ও জনসঙ্ঘীদের একটা ধারা ছিল বটে কিন্তু তা কখনও শক্তিশালী হতে পারেনি ৯০’এর দশকের আগ পর্যন্ত। আজ এই পট সম্পূর্ণতই উল্টে গেছে। সারা ভারতে বিজেপি আজ মুখ্য রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে এবং কংগ্রেস সহ কংগ্রেস-বিরোধী দলগুলি বিরোধী অবস্থানে নিমজ্জিত হয়েছে। কিছু কিছু রাজ্যে কংগ্রেসের সঙ্গে তার অতীতের বিরোধীদের নির্বাচনী সমঝোতাও সম্ভবপর হয়েছে (যেমন বিহার, অসম, তামিলনাড়ু)। কিন্তু এই বিরোধী জোটগুলির ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য প্রবণতা হল, যেখানে যেখানে কংগ্রেস মুখ্য দল হিসেবে অবস্থান করছে সেখানে সেখানে বিরোধীদের মহাজোট কার্যকরী ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে। অন্যদিকে, আঞ্চলিক শক্তিগুলি যেখানে মুখ্য অবস্থানে আছে, সেখানে বরং বিরোধী জোট অনেক ভালো ফল করতে পারছে। অর্থাৎ, রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে কংগ্রেস দল বহুল পরিমাণে পরিত্যক্ত অথবা অবিশ্বাসযোগ্য হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। এর নানাবিধ কারণ আছে কিন্তু সবচেয়ে বড় কারণ সম্ভবত বর্তমান গান্ধী পরিবারের নেতৃত্বের অপরিণামদর্শিতা। তারা শুধুমাত্র মতাদর্শগত ভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছে তাই নয়, রাজনৈতিক কার্যক্রমেও তাদের তীব্র অনীহা এবং সোশ্যাল মিডিয়া নির্ভর এক দায়সারা গোছের দায়িত্ব পালন করা ছাড়া তারা আর বিশেষ কিছু করেও উঠতে পারছে না। যেটুকু যা সাফল্য তারা কিছু রাজ্যে পেয়েছে তা অনেকটাই সেই সব রাজ্যে কংগ্রেসের আঞ্চলিক নেতৃত্বের কৃতিত্বেই। আমার একেবারেই মনে হয় না, রাহুল গান্ধী বা প্রিয়াঙ্কা বঢড়া’র নেতৃত্বে কংগ্রেসের আদৌ কোনও ভবিষ্যৎ আছে। ইতিমধ্যে কংগ্রেসের অভ্যন্তরে কপিল সিবালের নেতৃত্বাধীন জি-২৩ গোষ্ঠী এ বিষয়ে যথেষ্ট সোচ্চার।

তাহলে প্রশ্ন হল, কংগ্রেসের আদৌ কি কোনও ভবিষ্যৎ নেই? এর উত্তর দেওয়ার সময় এখনও আসেনি। গোয়ার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ফেলেইরো ও প্রশান্ত কিশোরের নানান বক্তব্য ও কার্যকলাপে এমন একটা মালুম হচ্ছে যে ‘কংগ্রেসি ডায়াসপোরা’র যদি সত্যিই কোনও অস্তিত্ব থেকে থাকে, তাহলে তাকে হাতিয়ার করে কংগ্রেসের এক মহামঞ্চ হয়তো আগামী দিনে পুনর্গঠিত হতে পারে। সেই মঞ্চের নাম ‘জাতীয় কংগ্রেস’ হবে নাকি ‘তৃণমূল কংগ্রেস’ অথবা অন্য কোনও নতুন কিছু, তা এখনও ভবিষ্যতের গর্ভে, কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে এই ক্ষেত্রে অত্যন্ত এক উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করতে চলেছেন তা কতকটা স্পষ্ট।

এর পাশাপাশি, রাজ্য ভিত্তিক আঞ্চলিক, সমাজবাদী ও বাম দলগুলির ভূমিকাও অতীব গুরুত্বপূর্ণ। কংগ্রেসি ডায়াসপোরা যদি বহুল পরিমাণে সমাজ-গণতন্ত্রী হয়ে উঠতে পারে (অর্থাৎ, তাকে সমাজবাদ ও গণতন্ত্র- উভয় দিকেই সদর্থক দৃষ্টি ফেলতে হবে), তাহলে বিজেপি-আরএসএস’এর বিরুদ্ধে বাম ও অন্যান্য সমাজবাদী শক্তির সঙ্গে তার স্বাভাবিক সখ্য গড়ে ওঠায় কোনও বাধা থাকার কথা নয়। কারণ, গত দু’ দশকে বিজেপি-আরএসএস এ দেশে যে শক্তি সঞ্চয় করেছে তা একটা সুদৃঢ় মতাদর্শগত ভিত্তির ওপরে দাঁড়িয়েই, যা উগ্র হিন্দুয়ানার বনিয়াদের ওপর স্থিত। আর ইতিহাস বলে, এই ধরনের উগ্র মতাদর্শকে মোকাবিলা করতে পারে সক্ষম সমাজ-গণতন্ত্রী ও বাম মতাদর্শ। যদি বামেরা তাদের সংগঠন, প্রভাব ও মতাদর্শের জোরে এই কাজটা করতে সক্ষম থাকতেন, তাহলে তার চেয়ে বেশি মঙ্গলজনক আর কিছু হত না। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, বামেরা গত দু’ দশকে দেশ জুড়ে ক্রমেই দুর্বল হয়েছেন (কিছু ব্যতিক্রম ব্যতীত) এবং পশ্চিমবঙ্গের মতো অগ্রণী বাম রাজ্যে তাদের একটা বড় অংশ বিজেপি’কে বিপুল আকারে ভোট দিয়েছেন। শুধুমাত্র ভোট দেননি, বাম শক্তির বহু অংশ (নেতা-কর্মী সহ) বিজেপি দলে নামও লিখিয়েছেন এবং রাজ্য বাম শীর্ষ নেতৃত্বের পক্ষ থেকে বিজেপি’র বিপদকে হাল্কা ভাবেও নেওয়া হয়েছে (‘২১’এ রাম/ ২৬’এ বাম’ বলে)। এর পাশাপাশি, তৃণমূলেরও বহু নেতা-নেত্রী হেলায় বিজেপি দলে যোগ দিয়েছেন এবং তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ আবার পরবর্তীকালে নিজ দলে ফেরত এসেছেন। অর্থাৎ, ভাবটা এমন, সব দলই একইরকম, নিজের আখের গোছাতে সুবিধামতো কোনও এক দলে গেলেই হল। অতএব, মতাদর্শগত সমস্যাটা শুধুমাত্র বামেদের ক্ষেত্রে নয়, তৃণমূল সহ অন্যান্য বিজেপি বিরোধী দলগুলির ক্ষেত্রেও সমান সত্যি। ফলে, অ-বাম দলগুলির ক্ষেত্রে সমাজ-গণতন্ত্রী মতাদর্শকে শক্ত ভাবে আত্মস্থ করাটা যেমন একটি রাজনৈতিক কর্তব্য, অনুরূপ ভাবে, বামেদের ক্ষেত্রেও বাম মতাদর্শকে যথাযথ ভাবে আয়ত্ব করাটাও সমান জরুরি।

সবটা মিলিয়ে, আজ যদি বিজেপি-আরএসএস’এর উগ্র হানাহানি থেকে দেশকে উদ্ধার করতে হয়, তাহলে সম্ভাব্য সমাজ-গণতন্ত্রী শক্তির সঙ্গে বামেদের মোর্চা অবশ্যম্ভাবী ভাবে জরুরি। অবশ্য তার আগে সমাজ-গণতন্ত্রী পরিসর সত্যি সত্যি কতটা গড়ে উঠল এবং বাম মতাদর্শ কতটা বাস্তবিক শক্ত জমির ওপর দাঁড়াতে পারল ও শ্রমজীবী মানুষের আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হল, তার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে।