‘ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়...’
সোমনাথ গুহ
২০১৩ সালে ‘খাদ্য সুরক্ষা আইন’ প্রণয়নের কিছু দিন আগে অর্থনীতিবিদ জঁ দ্রেজ খাবারের একটি ঝুড়ি নিয়ে একটি সাক্ষাৎকারে উপস্থিত হন। তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হয় যে যখন এনরেগার মতো প্রকল্প আছে, রেশন ব্যবস্থা, মিড-ডে-মিল আছে, তখন নতুন করে এই আইন আনার কী প্রয়োজন? দ্রেজ বলেন, সেই কারণেই তিনি ঐ ঝুড়িটা সঙ্গে নিয়ে এসেছেন। তিনি ঝুড়িটি থেকে একটি কলা, ডিম ও এক গ্লাস দুধ (পাউচে রাখা) বার করেন। পাঁচজনের পরিবারে এই জলখাবারের খরচ হচ্ছে ৬০ টাকা। ঝুড়িটিতে পুরো দিনের পরিবারের খাবার আছে যার খরচ ২৩৫ টাকা। এনরেগাতে আট বছর আগে গড় মজুরি ছিল ১০০-১৫০ টাকা, তাও তাতে মাত্র একশো দিন কাজ পাওয়া যায়। দ্রেজ বলেন, এই ঘাটতি পূরণের জন্যই এই আইনের প্রয়োজন। আজ ঐ ফুড বাস্কেটের দাম অন্তত ৪০০ টাকা হয়েছে, যে মজুরি দক্ষিণের কেরালা, কর্নাটক কিংবা পাঞ্জাব, হরিয়ানাতেই শুধুমাত্র পাওয়া যায়।
খাদ্য সুরক্ষা আইন গ্রামীণ ভারতের ৭৫ শতাংশ এবং শহরাঞ্চলের ৫০ শতাংশ পরিবারকে খাদ্য সুরক্ষা দেওয়ার টার্গেট নেয়। তখন জনসংখ্যা ছিল ১২০ কোটি (২০১১'র জনগণনা অনুযায়ী), যাদের মধ্যে রেশন কার্ড ছিল ২০ কোটি মানুষের; পরিবার প্রতি চারজন মানুষ ধরলে খাতায় কলমে অন্তত ৮০ কোটি মানুষের খাদ্য নিশ্চিত হওয়ার কথা ছিল। বাকি ৪০ কোটির একটি বড় অংশ আর্থিক সচ্ছলতার কারণে রেশন ব্যবস্থায় (পিডিএস) অন্তর্ভুক্ত নন। রেশন মূলত বিপিএল (দারিদ্রসীমার নীচে) চিহ্নিত মানুষদের দেওয়া হয়। এখন এই বিপিএল চিহ্নিতকরণের ব্যবস্থাটা অত্যন্ত গোলমেলে, একেবারেই নির্ভরযোগ্য নয়। যেমন দ্রেজ বলছেন, দরিদ্রতম ২০ শতাংশ মানুষের মধ্যে ৫৩ শতাংশের বিপিএল কার্ড নেই। গত আট বছরে জনসংখ্যা প্রায় ২০ কোটি বৃদ্ধি পেয়েছে। এর মধ্যে বিপুল সংখ্যক মানুষ কিন্তু রেশন ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত হননি। ঝাড়খণ্ড, বিহার, ওড়িশা, উত্তরপ্রদেশের মতো রাজ্যে রেশন কার্ডের বহু আবেদন পেন্ডিং পড়ে আছে। ২০২০'র একটি হিসাবে দেখা যাচ্ছে, প্রায় এগারো কোটি মানুষের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নেই, রেশন কার্ড নেই। এখন আবার একটা নতুন ঝক্কি শুরু হয়েছে: রেশন কার্ডের সঙ্গে আধারের সংযুক্তিকরণ। এতে বহু ভুয়ো কার্ড যেমন বাতিল হচ্ছে, তেমনি নামের বানান ভুল, ঠিকানা পরিবর্তনের কারণে বহু প্রকৃত স্বত্বভোগীর নাম বাদ হয়ে যাচ্ছে। এঁদের কাছে খাদ্যই পৌছয় না, পুষ্টিকর খাদ্য তো অনেক পরের কথা।
এই পরিপ্রেক্ষিতে ‘গ্লোবাল ফুড ইনডেক্স’এ (ক্ষুধা সূচক) ভারতের স্থান ১১৬টি দেশের মধ্যে ১০১ হওয়াতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। আফগানিস্তান ছাড়া প্রতিবেশী অন্য দেশগুলির অবস্থান ভারতের চেয়ে উন্নত। গত কয়েক বছর ধরে এরকমটাই হয়ে আসছে। ২০১৯'এ ১১৭টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ছিল ১০২, ২০২০'তে ১০৭টি দেশের মধ্যে ৯৪। এই সমীক্ষা ‘কনসার্ন ওয়ার্ল্ডওয়াইড’ এবং ‘ওয়েল্ট হাঙ্গার হিলফ’ নামে দুটি আন্তর্জাতিক সংস্থা প্রতি বছর করে থাকে। চারটি মাপকাঠির ভিত্তিতে সমীক্ষা হয়:
(১) খাদ্য, বিশেষ করে ক্যালোরি-যুক্ত খাদ্যের সহজলভ্যতা। এটি খাদ্য বন্টন ও সরবরাহের ওপর নির্ভর করে। এই মাপকাঠিটি সমস্ত বয়সের মানুষের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য;
(২) চাইল্ড ওয়েস্টিং, অর্থাৎ, যেখানে পাঁচ বছরের কম বয়সের একটি শিশুর দৈর্ঘ্যের তুলনায় ওজন কম;
(৩) চাইল্ড স্টান্টিং, অর্থাৎ, পাঁচ বছরের কম বয়সি শিশুর বয়স ও ওজন অনুযায়ী খর্বাকৃতি;
(৪) শিশুমৃত্যুর হার (পাঁচ বছরের নীচে)।
গত দেড় দশকে এই মাপকাঠিগুলোতে ভারত যে উন্নতি করেনি এমনটা কিন্তু নয়। যেমন, ২০০৬'এ ভারতের স্কোর ছিল ৩৭.৪, যা ২০১২'তে ২৮.৮'এ নেমে আসে (স্কোর যত কম হবে তত ভালো)। তারপর থেকে উন্নতি অত্যন্ত ধীর, ২০২১'এ স্কোর ২৭.৫।
ভারত সরকার এই রিপোর্ট দেখে ক্ষুব্ধ। তারা অভিযোগ করেছে, ফোন করে চারটে প্রশ্নের মাধ্যমে মতামত নিয়ে এই সমীক্ষা তৈরি হয়েছে। অবশ্য, 'গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স'এর (জিএইচআই) সমীক্ষক সংস্থাগুলি এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে। তারা জানিয়েছে, দেশ জুড়ে খাদ্যের সহজলভ্যতার গড়ের ভিত্তিতে এই সমীক্ষা করা হয়। এতে সমস্যা অবশ্য হতেই পারে। ভারতের মতো একটা বিরাট দেশ যেখানে উন্নতি অত্যন্ত অসমান এবং ধর্ম ও জাতপাতের বিভাজন সামাজিক ব্যবস্থার মধ্যে মজ্জাগত, যে কারণে একটা বিশাল অংশের মানুষ এমনিতেই সরকারি আনুকূল্য থেকে বঞ্চিত, সেখানে সারা দেশের একটা গড়ের ভিত্তিতে কোনও সমীক্ষা ঝুঁকিপূর্ণ তো বটেই। যেমন, খাদ্য সুরক্ষা আইনের ফলে কেরালার ৯০ শতাংশ মানুষের কাছে খাদ্য পৌঁছয়, ঝাড়খণ্ডে ৫০ শতাংশ। সুতরাং, যে কোনও সমীক্ষা যেমন পুরোপুরি সঠিক হয় না, তেমনই জিএইচআই যে একশো ভাগ নির্ভুল, তা কখনই বলা যায় না। কিন্তু তাই বলে, আন্তর্জাতিক স্বীকৃত সমীক্ষাকে কেউ সম্পূর্ণত উড়িয়েও দেয় না।
দেখা যাচ্ছে, এই সূচক তৈরি করার ক্ষেত্রে অন্যতম নির্ণায়ক হচ্ছে পাঁচ বছর বয়সের নীচের শিশুর পুষ্টি ও স্বাস্থ্য এবং তাদের মৃত্যুহার। এটা জানাই যে গর্ভবতী মায়ের স্বাস্থ্যের ওপর শিশুর স্বাস্থ্য নির্ভর করে। রেশন ব্যবস্থায় যা খাদ্যশস্য দেওয়া হয় তাতে গর্ভবতী মায়ের রক্তাল্পতা, আয়রনের অভাব পূরণ হয় না, যার প্রভাব সদ্যোজাত শিশুর ওপর বর্তায়। মা রুগ্ন হওয়ার ফলে বহু শিশু স্তন্যদুগ্ধ থেকে বঞ্চিত হয়। ল্যানসেট'এর একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, যে শিশুরা জন্ম থেকেই স্তন্যদুগ্ধ পায় তাদের স্বাভাবিক অনাক্রম্যতা বেশি হয়; আমাশা, নিমোনিয়া ধরনের রোগ হয় না, যে ব্যাধিগুলি শিশুমৃত্যুর অন্যতম কারণ। ছয় মাস মাতৃদুগ্ধের পর থেকে পরিপূরক খাদ্যের প্রয়োজন। আমাদের দেশে ৬-৯ মাস বয়সের প্রায় অর্ধেক শিশু এর থেকে বঞ্চিত।
ইউনিসেফ'এর ২০১৮ সালের হিসাব অনুযায়ী, পুষ্টির অভাব, রোগভোগের কারণে দেশে প্রায় দুই কোটি (১৭ শতাংশ) ক্ষয়প্রাপ্ত শিশু ছিল যাদের দৈর্ঘ্যের তুলনায় ওজন কম। একই সালে বয়স ও ওজনের তুলনায় বৃদ্ধি কম, খর্বাকৃতি স্টান্টেড শিশুর সংখ্যা ছিল ৩৫ শতাংশ, প্রায় চার কোটি। ২০০৬ সালে এটা ছিল ৪৮ শতাংশ যা দেড় দশকে প্রায় পনেরো শতাংশ কমেছে। পাঁচ বছরের নীচে শিশু মৃত্যুর হারও কমেছে; ১৯৯০ সালে ৩৪ লক্ষ থেকে যা ২০১৯ সালে ৮.২৪ লক্ষে নেমে এসেছে। ক্ষয়প্রাপ্ত ও খর্বাকৃতি শিশুর সংখ্যা জিএইচআই'এর সমীক্ষার একেবারে নীচের দিকের দেশগুলি যেমন নাইজেরিয়া বা কঙ্গোর সমতুল্য হওয়া সত্ত্বেও ভারতে শিশুমৃত্যুর হার ঐ দেশগুলির তুলনায় কম কারণ এখানে স্বাস্থ্য পরিষেবা তুলনামূলক ভাবে উন্নত।
প্রধান সমস্যা অবশ্যই খাদ্য মানুষের কাছে পৌঁছচ্ছে না। খাদ্যের অভাব নেই, এফসিআই'এর গুদাম উপচে পড়ছে। ইঁদুর শস্য খেয়ে নিচ্ছে। এত শস্য যে তার থেকে ইথানল তৈরি হচ্ছে কিন্তু ক্ষুধার্ত মানুষ তা পাচ্ছেন না। পাবেই বা কী করে, অধিকাংশের তো কার্ডই নেই। এর ওপর সরকারি ঘোষণার অল্পই কার্যকরী হয়। ২০২০'র মার্চে লকডাউনের পরে অর্থমন্ত্রী ঘোষণা করেন যে রেশনে এপ্রিল থেকে জুন মাস অবধি অতিরিক্ত ৫ কেজি করে চাল বা গম দেওয়া হবে। প্রথম মাসেই ৫ কোটি মানুষ যাঁদের রেশন কার্ড আছে তাঁরা এই অতিরিক্ত শস্য পাননি। পরে ঘোষণা হয়, পুষ্টির জন্য জনপ্রতি এক কেজি করে ডাল দেওয়া হবে, সেটাও ২৩ শতাংশ মানুষ পাননি। পরে এই অতিরিক্ত শস্য বাড়িয়ে ১০ কেজি করা হয় যা নভেম্বর মাস অবধি চালু আছে। বহু মানুষ কেন্দ্রের দেওয়া এই অতিরিক্ত রেশনের কথা জানেনই না, রেশন মালিকও তাঁদের জানান না। জানালেও দশের জায়গায় পাঁচ কেজি দিয়ে ভাগিয়ে দেওয়া হয়।
প্রধান সমস্যা, ২০১৪'র পর থেকে রেশন ব্যবস্থা খুব কমই প্রসারিত হয়েছে। স্বত্বভোগীর সংখ্যা প্রায় স্থিতিশীল। ‘এক দেশ, এক রেশন কার্ড’ নিয়ে ব্যাপক হৈচৈ, কিন্তু আগে তো দারিদ্রসীমার নীচে থাকা প্রতিটি মানুষকে কার্ডটা দিতে হবে। সেখানে আবার বিপিএল নির্ধারণ করা সমস্যা। এ জন্যই অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন যে আধারের ভিত্তিতেই রেশন দেওয়া হোক; ১৩০ কোটি মানুষের আধার আছে, যা রেশন কার্ড আছে এরকম মানুষের থেকে অনেক বেশি। আরও ভালো যেটা অভিজিৎ সহ অমর্ত্য সেন এবং রঘুরাম রাজন বলেছিলেন, যে লাইনে দাঁড়াবে তাকেই রেশন দেওয়া হোক। ক্ষুধা নিবারণ করার জন্য এছাড়া আর অন্য কোনও পন্থা আছে কিনা সন্দেহ।
একই ভাবে গুরুত্বপূর্ণ একটা সুস্থ জীবন গড়ে তোলার জন্য যথেষ্ট উপাদান সম্পন্ন খাদ্যই যথেষ্ট নয়, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাও অত্যন্ত প্রয়োজন। শিশু জন্মের পূর্বে মায়ের স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য পরিচ্ছন্ন পরিবেশ প্রয়োজন এবং এর প্রয়োজনীয়তা নারী ও তার পরিবার তখনই উপলব্ধি করবে যখন জীবনযাপনের একটা সুস্থ শিক্ষা তাদের মধ্যে বংশানুক্রমিক ও সামাজিক ভাবে জারিত হবে। এটা হলে শিশুর স্বাস্থ্যের উন্নতি হবে, মৃত্যুহার কমবে, ক্ষুধার সূচকে দেশের স্থান অনেক ওপরে হবে। কাঁদুনি না গেয়ে এসব ব্যাপারে সরকার একটু দায়িত্বশীল হলে ভালো হয়।