Wednesday, 21 April 2021

'শুয়ে আছি শ্মশানে...'

ক্ষমা করো... ত্রিকালজ্ঞ 

অমৃতা ঘোষাল


'এখনো যে ও যুবক আছে প্রভু !' ( 'মাতাল ', শঙ্খ ঘোষ )।

কবিরা চিরযুবক। আসলে ত্রিকালজ্ঞরা যুবকই হন, আমরা জোর করে তাকে প্রৌঢ় কিংবা বৃদ্ধ বানাই। শঙ্খ ঘোষ (জন্ম: ৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৩২/ মৃত্যু: ২১ এপ্রিল ২০২১) ছিলেন সেই অ-নমনীয় প্রগলভ যুবক! লোকপুরাণ থেকে সহজপুরাণ পরিক্রমা করে গড়ে তুলেছিলেন এক স্বয়ংপুরাণ। কোথাও কোনও মূর্ছা কিংবা আত্মঘাত ছিল না। ছিল শুধু এক মহৎ মুদ্রাদোষ- শব্দের সূক্ষ্মপীড়ণে মুহুর্মুহু কম্পিত হওয়া। যন্ত্রণার অমরাবতীই যে কবির প্রাণভোমরা। 

তাঁর কবিতায় শব্দ-বর্ণগুলো আর গৌরচন্দ্রিকা কিংবা ক্ষমাহীন রাতের কথকতা হয়ে রইল না, কারণ ক্রমশ শোনা যেতে লাগল পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ।

কবির জীবনকে একটু ফিরে দেখি। প্রকৃত নাম চিত্তপ্রিয় ঘোষ। পিতা মণীন্দ্রকুমার ঘোষ ও মাতা অমলাবালা ঘোষ। দেশ বরিশালের বাণারিপাড়া আর জন্ম চাঁদপুরে মাতুলালয়ে। কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে স্নাতক হওয়ার পর কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতকোত্তর পাঠ গ্রহণ। তারপর অধ্যাপনার ক্ষেত্রে প্রবেশ। বেশ কিছু কলেজের পর যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর দীর্ঘদিনের কর্মজীবন। এছাড়াও দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়, বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, শিমলার ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ অ্যাডভান্সড স্টাডিজ প্রভৃতির সঙ্গে তাঁর নাম অধ্যাপনার সূত্রে জড়িয়ে আছে। টেগোর রিসার্চ ইনস্টিটিউট থেকে 'রবীন্দ্রতত্ত্বাচার্য' উপাধি লাভ করেছেন। অর্জন করেছেন নরসিংহ দাস পুরস্কার, সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার, রবীন্দ্র পুরস্কার, দেশিকোত্তম পুরস্কার, পদ্মভূষণ পুরস্কার, জ্ঞানপীঠ পুরস্কার প্রভৃতি আরও অনেক উল্লেখযোগ্য সম্মান। প্রথম বই সম্ভবত ১৯৫৬'এর জানুয়ারিতে প্রকাশিত কিশোরপাঠ্য জীবনী 'বিদ্যাসাগর'। ওই একই বছর সেপ্টেম্বর মাসে তাঁর প্রথম কবিতার বই 'দিনগুলি রাতগুলি' তেত্রিশটি কবিতা নিয়ে প্রকাশিত হয়। শঙ্খ ঘোষের কবিতা অন্যান্য ভারতীয় ভাষার সমান্তরালে বিদেশি ভাষাতেও অনূদিত হয়েছে। জার্মান, ফরাসি, চেক ভাষায় রীতিমতো জনপ্রিয় হয়েছে তাঁর কবিতা। এছাড়াও আবৃত্তি, ভাষ্যরচনা, রেকর্ড পরিচিতি লেখা ইত্যাদি কাজেও তিনি বেশ দক্ষ ছিলেন। কিন্তু কবিরা মহোৎসবে মাতেন না, একাকীর বৈভবে দূরে চলে যান। 'রাঙামামিমার গৃহত্যাগ' মনে পড়বে। ঘর-বাড়ি-আঙিনা-খাল-সাঁকো পেরলেও পালকেরা ছড়িয়ে থাকে। সেভাবে কবি আত্ম-গভীরে অবগাহন করলেই  শব্দ-ব্রহ্মরা তাদের অস্তিত্ব জানান দেয়। যেমন শঙ্খ ঘোষের শ্রেষ্ঠ কবিতার প্রবাহে নিরন্তর জেগে থাকবে 'যমুনাবতী' কিংবা 'বাবরের প্রার্থনা'।

আসলে প্রত্যেক কবির অন্তরে 'দাইমন' বসত করেন। অজ্ঞাত সময়ে তাঁরা কবির নিজস্বতা আর মৌলিকতাকে প্রভাবিত করেন। কবিতায় 'এরস' আর 'থ্যানাটস'এর বিচিত্র গতি বুঝিয়ে দেয় সেই 'দাইমন'এর উচ্ছ্বাস। শঙ্খ ঘোষ খুব সহজেই বলতে পারতেন, তাঁর 'দাইমন' হল উদ্ভিদ। কিন্তু উদ্ভিদের শিকড় তো বহুগামী, আর ডাল তার বহুমুখী। আসলে কবি মাত্রেই জানেন যে জীবন মানেই মাটি-পাথর-আকাশ টপকানোর খেলা। আর পাহাড় টপকাতে গিয়ে হঠাৎই এসে পড়ে শুশুনিয়া। তাঁর 'শুশুনিয়া' কবিতায় এসে আর আমরা টপকাতে পারি না 'সাঁওতাল সঙ্ঘের আদিমানবীর চোখ' কিংবা 'খরা' কবিতার সেই অমোঘ প্রশ্ন 'পুরুলিয়া তোমার সংসার?'। পুরাণের আর্কেটাইপ নারীদের মুখোমুখি দাঁড় করান শ্মশান-শিব আর পথভিখারিদের। চুনবালির মতো খসে পড়ে তাদের আলগা পৌরুষ। কবিই পারেন লিঙ্গচেতনা নির্বিশেষে প্রতিভাময় মানবত্বকে জাগিয়ে তুলতে। তাই ঝরা বালিকে মন্থন করলেই ধমনীতে রক্তের স্রোত বাড়ে আর ঝলকে ঝলকে বিষ ওঠে। খুব লোভ হয়- শঙ্খ ঘোষকে একবার 'নীলকন্ঠ' অভিধা দিই!

শঙ্খ ঘোষ মহানগরের মহাপথিক, 'কইলকাত্তা'র কবি। শব্দ দিয়ে ছুঁয়েছেন শ্যাওলাপচা লাশ থেকে শ্যামবাজারের কাছাকাছি কোনও বোকার প্রত্যেকটা কোষ। রেড রোড কিংবা ময়দানে ভেসে চলা 'একলা অসামাজিক' আর তার চোখে জমে থাকা ঘোলা জলে ভিজতে থাকে শঙ্খ ঘোষের কবিতার শব্দেরা। তাঁর 'বাবুমশাই' কবিতায় মিলে যায় উনিশ শতকীয় আশ্রয়। এক কলকাতার মধ্যে সত্যি আরেকটা কলকাতা লুকিয়ে থাকে। তাকে গাড়ির জানলা দিয়ে নয়, হেঁটে অনুভব করতে হয়। হাঁটতে হাঁটতেই আমরা প্রত্যক্ষ করি 'এই শহরের রাখাল'-কে, যে দিব্যি সব ভুলে গরুর পিঠে দাঁড়িয়ে গর্বে ফেটে পড়ে। কিংবা কখনও তুলে ধরেন মহানগরের রাতের ছবি- শহরের পাঁচ মাথায় রিপুর ভিড় আর কেবিন-পর্দার আড়াল কিংবা গভীর ময়দানে নষ্ট-ত্রস্ত-শুষ্ক-তুখোড়-খুচরো-প্রখর চুম্বন। চোখের চাওয়া বিকিয়ে যাওয়ার আগে 'চোখের পাতা চায় চোখের চুম্বন।' কলকাতার সংবেদনার  সঙ্গে মিশেছে কখনও ঢাকা শহরেরও গন্ধ। যেমন 'ঢাকা ১৯৭৫' কবিতায় রয়েছে ধুলো আর কৃষ্ণচূড়াকে সাক্ষী রেখে এক মুক্তিকামী সত্তার দীপ্র অভিজ্ঞতা। কিংবা 'মনোহরপুকুর' কবিতায় ধরা পড়েছে নাগরিক ত্রাস আর সময়ের চোরাবাঁক।

কবি হতে গেলে 'ব্যক্তিগত আমি'র মার্জিন ভাঙতে হয়। অতীত-অভিসার তাঁর কবিতায় যেমন উঠে এসেছে, তেমনই প্রকট হয়েছে তাঁর রবীন্দ্র-জিজ্ঞাসাও। কবির ছাত্ররাই বলেন যে স্থিতপ্রজ্ঞ কবি তাঁর ইতিহাস-চেতনা আর রবীন্দ্র-ভাবনাকে সর্বদাই ক্লাসরুমের মার্জিন থেকে মুক্ত করতেন। তাঁর গদ্যগ্রন্থ 'এ আমির আবরণ', 'কবিতার মুহূর্ত' কিংবা 'কালের মাত্রা ও রবীন্দ্রনাটক'এ দেখিয়েছেন রবীন্দ্ররচনার পদ্ধতি-প্রকরণ। নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে বিশ্লেষণ করেছেন রবীন্দ্র-বিরুদ্ধবাদীদের সমস্ত যুক্তিও। সহিষ্ণু ও দূরদর্শী শঙ্খ ঘোষ সমস্ত মিথ ভেঙে পাঠককে চিনিয়েছেন আধুনিক রবীন্দ্রনাথকে। রবীন্দ্র-গানের আলোচনায় তিনি মাথা নত করেছেন দুঃখতত্ত্বের গভীরে, যে দুঃখের গভীরে শুধুই প্রাপ্তির আনন্দ। ক্যাথারসিস্!

শঙ্খ ঘোষ ছিলেন লিটল ম্যাগাজিনেরও কবি। 'কৃত্তিবাস' থেকে 'কবিতা', 'কৌরব' থেকে 'এক্ষণ' কিংবা 'বিভাব' থেকে 'প্রমা' প্রভৃতি তাঁর মননশীলতার স্পর্শ থেকে বঞ্চিত হয়নি। অনুবাদক হিসেবে কিন্তু শঙ্খ ঘোষ কখনও এতটুকু নিয়ম ভাঙেননি। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিই ছিল অনুবাদক নয়, মূল কবিকে পাঠকের কাছে বিম্বিত করার। সম্পাদক হিসেবেও যথাসম্ভব সূক্ষ্ম-দৃষ্টি বজায় রাখতেন শিল্পী শঙ্খ ঘোষ।

অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন আজীবন। কিন্তু বুদ্ধিজীবী হিসেবে কোনও বিজ্ঞাপনী প্রচারের অঙ্গ কখনওই হননি। মানুষকে প্রত্যক্ষ করিয়েছেন- দেশ আমাদের কোনও মাতৃভাষা দেয়নি। ক্ষিপ্ত জনতাকে দেখিয়েছেন- দেশকে আমরা একমাত্র পাথরেই ছুঁই। আমরা তাঁর লেখা পঙক্তি উচ্চারণ করে বুকে ভরে নিয়েছি অক্সিজেন। কিন্তু কবিকে কী দিয়েছি? একরাশ হতাশাই শুধু।

গৃহবন্দী কবি নিস্তার পেলেন না আর। করোনা শেষ শমন হয়ে ছিনিয়ে নিল তাঁর বিধ্বস্ত প্রাণটুকু। বেঁচে রইল তাঁর কাব্যভূমি, শব্দ-বিশ্ব। প্রণাম জানানোর আগেও আমরা যেন তাঁর আত্মার কাছে ক্ষমা চাই। আর ক্ষমা চাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই  শান্ত কবি যেন এক্ষুনি বলে উঠলেন-

'শুয়ে আছি শ্মশানে। ওদের বলো/ চিতা সাজাবার সময়ে/ এত বেশি হল্লা ভালো নয়।' (ধর্ম)।

 

আজ থেকে শঙ্খ যাপনের কাল

'ধ্বংসকে বিধিলিপি ভেবে আমরা চুপ করে থাকব না আর'

শোভনলাল চক্রবর্তী


সামাজিক সংকটের আগুনকে আড়াল করে যে সব কবি পলায়নবাদীর মতো প্রেম, প্রকৃতি আর আত্মগত সংকটের মধ্যে ডুবে থাকেন, শঙ্খ ঘোষ তাঁদের দলভুক্ত ছিলেন না। তিনি আমাদের জাগ্রত বিবেক। তিনি সংগ্রামী মানুষের কানে কানে তূর্যনাদ উচ্চারণ করে গিয়েছেন নির্ভয়ে। আর অত্যন্ত লক্ষণীয় যে, সেই  তূর্যনাদের ভাষা মাটি ও রৌদ্রের মতো সরল, সুন্দর ও সবল। সৈনিকের পোশাকের মতো ভারমুক্ত সেই ভাষা। তাঁর গদ্য ও কবিতা একই সঙ্গে চিরকালের ও সমকালের। নন্দীগ্রামে গুলি চালানোর প্রতিবাদে তিনি সাম্মানিক সরকারি পদ থেকে সরে আসতে যেমন দ্বিধা করেননি, তেমনই গুজরাটের বীভৎস দাঙ্গার সময় 'ধ্বংসের মুখোমুখি আমরা' নামক নিবন্ধে তিনি বলিষ্ঠ ভাষায় অকুতোভয়ে লিখেছিলেন, 'গুজরাট জ্বলছে। আমরা জানি, গুজরাটের মানুষদের সঙ্গে সঙ্গে সে-আগুন নেভাবার দায়িত্ব আমাদেরও, এই রাজ্যের মানুষদেরও।' 

যাদবপুরের প্রিয় ছাত্র তিমিরবরণ সিংহ নকশাল আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার অপরাধে পুলিশের হাতে মার খেয়ে মারা গেলে কবির চোখ ময়দানের মাটিতে পড়ে থাকা কৃষ্ণচূড়ার মধ্যে খুঁজে পায় তিমিরের ছিন্ন শির- 'ময়দান ভারী হয়ে নামে কুয়াশায়/ দিগন্তের দিকে মিলিয়ে যায় রুটমার্চ/ তার মাঝখানে পথে পড়ে আছে ও কি কৃষ্ণচূড়া?/ নিচু হয়ে বসে হাতে তুলে নিই/ তোমার ছিন্ন শির, তিমির।' কোন রহস্যময় সূচনাবিন্দু থেকে একটি কবিতা উঠে আসে তা পাঠকের কাছে জানানোটা কবির কাজ নয়। এ নিয়ে বিস্তর বিতণ্ডা আছে। পাঠকের বোধ ও ব্যাখ্যার বিচিত্র ভিন্নতা ও বৈপরীত্য দেখে নিরুপায় রবীন্দ্রনাথকেও একদা 'সোনার তরী' কাব্যের নাম কবিতাটির একটি মর্মসংকেত দিতে হয়েছিল।  শঙ্খ ঘোষের বিখ্যাত কবিতা 'যমুনাবতী' পাঠ করে এক তরুণ পাঠকের মনে হয়েছিল, 'কোনও সত্য ইতিহাসের বিন্দুকে হয়তো-বা ছুঁয়ে আছে ওই লেখা। সে ইতিহাস কি জানা যায় কোনওভাবে।' তারই উত্তরে লেখা হয়ে যায় 'কবিতার মুহূর্ত'। এই গ্রন্থ কোনওমতেই কবিতার নোটবই নয়, ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ নয়। কেবল আলতো হাতে এক একটি কবিতার উৎসমুখ খুলে দেওয়ার প্রচেষ্টা। ভাগ্যিস, এই সূচনাবিন্দুগুলি হাতে পেয়েছি আমরা, নইলে কি কোনওমতে জানা সম্ভব ছিল ১৯৫১ সালে খাদ্যের দাবিতে কোচবিহারে এক ষোল বছরের কিশোরীর পুলিশের হাতে মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতেই রচিত হয়েছিল- 'নিভন্ত এই চুল্লিতে মা একটু আগুন দে/ আরেকটুকাল বেঁচেই থাকি বাঁচার আনন্দে!' 

১৯৩২ সালে অভিভক্ত বাংলার চাঁদপুরে জন্মেছিলেন যে চিত্তপ্রিয় ঘোষ তিনিই হয়ে উঠলেন এক অলোকসামান্য স্নিগ্ধ ও মরমি গদ্যের জাদুকর শঙ্খ ঘোষ। তাঁর কবিতা আমাদের শিখিয়েছে প্রেম, প্রতিবাদ ও আত্মব্যবচ্ছেদের ভাষা কতখানি লক্ষ্যভেদী হতে পারে। তাঁর গদ্য পাঠ করে আমরা অনুভব করতে শিখি জীবনের বহুবর্ণময় বিস্তারকে কীভাবে প্রসাদগুণের আধারে ব্যক্ত করা সম্ভব। সেদিক থেকে মনে হয়, কবি শঙ্খ ঘোষ এবং গদ্যশিল্পী শঙ্খ ঘোষ একে অপরের পরিপূরক। তাঁর কবিতায় রয়েছে প্রগাঢ় দ্যোতনাময় বীজ আর গদ্যের ছত্রে ছত্রে খুঁজে পাই তারই অপার বিস্তার। কোমলে ও কঠিনে অপরূপ সেই বিস্তার। কবিতা পড়ে ঠিক চেনা যায় না তাঁকে। তবু বাংলা কবিতায় তাঁর অবদান কিংবদন্তীপ্রতিম। 'দিনগুলি রাতগুলি', 'বাবরের প্রার্থনা'- যেটি ১৯৭৭ সালে ভূষিত হয় সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কারে, 'মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে', 'ধুম লেগেছে হৃদকমলে'- যার জন্য রবীন্দ্র পুরস্কার পান, এছাড়াও পেয়েছেন জ্ঞানপীঠ পুরস্কার- তবে এ সবই আজ কেবলই তথ্য। তাঁর গদ্য পাঠে বোঝা যায় বৈদগ্ধ্য ও রসবোধের স্নিগ্ধতা কত অনায়াসে বসবাস করতে পারে পাশাপাশি। 'ওকাম্পোর রবীন্দ্রনাথ', 'এ আমির আবরণ', 'নির্মাণ আর সৃষ্টি', 'কবির অভিপ্রায়', 'শব্দ ও সত্য', 'উর্বশীর হাসি', 'এখন সব অলীক'-এর পাতায় পাতায় যেন ছড়ানো রয়েছে শাশ্বত আনন্দনগরী। ওরকম গম্ভীর আর স্বল্পবাক মানুষের মধ্যেও যে বাস করেন একজন সুরসিক মানুষ, সে কথা অজানাই থেকে যেত 'ইছামতীর মশা' পড়া না থাকলে। 

তাঁর গদ্যের সম্ভার কবিতার থেকে কিছু কম নয়। সে সব পড়তে বসলে মনে হয় একজন বন্ধুর মুখোমুখি বসে বিচিত্র বিষয়ের আলোচনা শুনছি; এমন এক বন্ধু যাঁর পঠনপাঠন ও জীবনকে দেখার পরিধি অনেক বড়। বস্তুত শঙ্খ ঘোষ হয়ে রইলেন আমাদের 'সব পেয়েছির দেশ'। তিনি আমাদের আত্মার শান্তি, প্রাণের আরাম। তাঁর গদ্য ও পদ্যের জগৎ সব শ্রেণির পাঠকের জন্য উন্মুক্ত, অবারিত। যাঁর যেমনভাবে খুশি, যাঁর যতদূর সাধ্য ততখানিই অবগাহন করতে পারেন শঙ্খ সমুদ্রে। এক সম্পূর্ণ মানুষ ছিলেন তিনি। কল্লোল উত্তরকালের সর্বশ্রেষ্ঠ কবি, গদ্যকার, সাহিত্য অস্বাদক ও সামাজিক বিবেকবান মানুষ তিনি। কেউ যদি আজীবন শুধু তাঁর কবিতার মধ্যেই ডুবে থাকতে চান তবে তিনি সেই নিমজ্জনের দুর্নিবার হাতছানিতেও দেখতে পাবেন কবিতার মধ্যে লুকিয়ে থাকা গদ্য। কবিতার চিরাচরিত ছন্দের প্রতি যাঁদের পক্ষপাতিত্ব, তাঁরা ছন্দের সামান্য অনটনে ও নতুন নিরীক্ষায় আহত হন, তাঁদের জন্য রইল 'নিঃশব্দের তর্জনী'র সেই অমোঘ কথন, 'ছন্দের সমস্যা আসলে ব্যক্তিত্বেরই সমস্যা, সে তো কেবল ছান্দসিকের শুকনো পুঁথি নয়। ব্যক্তিরই মুক্তির জন্য ছন্দের ক্রম উন্মোচনের প্রয়োজন ঘটে, দরকার পরে তার অনড় চলৎশক্তিহীনতার বাইরে বেরিয়ে আসা।' আজ থেকে বাঙালির শঙ্খ যাপনের কাল শুরু হল।


Tuesday, 20 April 2021

যদি গান্ধী থাকতেন

মহামারীর জরুরি কথা

সোমনাথ গুহ

 

কলকাতায় গড়িয়ার কাছে রথতলা বাজারের কর্পোরেশন অফিসের সামনে থেকে লাইনটা মাদার ডেয়ারির দোকানের পাশ দিয়ে বিধানপল্লী ব্রিজ পেরিয়ে খালের ওপারে চলে গেছে। তখন প্রায় সকাল নটা। কীসের লাইন? ভ্যাকসিন- এক পরিচিত বললেন। প্রায় সত্তর-আশি জনের লাইনে সবাই শুধু শিক্ষিত ধোপদুরস্ত ভদ্রলোক এমনটা নয়, দুঃস্থ গোবেচারা গেরস্থও কিছু আছেন যাঁরা ‘বিনা পয়সায় গু’ খাওয়ার জন্য উদগ্রীব। গু হোক আর যাই হোক তাঁদের কাছে টিকাই ঈশ্বর, টিকাই সেই বিশল্যকরণী যা তাঁদের কোভিড ত্রাসের থেকে মুক্তি দেবে। সেই পরিচিতকে একটু উসকে দিলাম, টিকা নিলেই যে করোনা হবে না এমনটা কিন্তু নয়! তো, সে নির্লিপ্ত ভাবে উত্তর দিল, চান্সটা তো কমবে! এই প্রতিবেদক চিকিৎসা বিজ্ঞান সম্পর্কে আনাড়ী, কিন্তু ঘটনা হচ্ছে বিশেষজ্ঞরা যাই বলুন মানুষ এমনটাই ভাবছে।

আর ভাববে নাই বা কেন? টিকা এলেই যে ব্যাধিকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করা গেছে এমনটা তো নয়। মানুষ বুদ্ধু নন, তাঁরা সেটা জানেন। অনেক বয়স্ক মানুষের বাহুতে ছোটবেলায় টিকা নেওয়ার জ্বলজ্যান্ত প্রমাণ এখনও রয়েছে। কিন্তু তা বলে কি তাঁরা কেউ হাম, মাম্পস, চিকেন পক্সে ভোগেননি? কিন্তু তা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ছিল নিরীহ। যেটা প্রাণনাশক ছিল সেটা হচ্ছে স্মল পক্স বা গুটি বসন্ত যেটাকে টিকা নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে, আবার অনেক ক্ষেত্রে পারেওনি। এই সব রোগই আজ পঞ্চাশ বছর পরে ইতিহাস হয়ে গেছে। উনবিংশ শতাব্দীতে কলেরার আবির্ভাবের প্রায় ৬০ বছর পর তার টিকা আবিষ্কৃত হয়। তারপরেও আধুনিক যুগের আগে কলেরার আরও দুটি মহামারী দেখা গেছে- একটি ১৮৮০'র দশকের শুরু থেকে ১৮৯৬ অবধি এবং পরেরটি ১৮৯৯ থেকে ১৯২৩ অবধি। এই দুটি ঢেউ আগের চারটি ঢেউয়ের চেয়ে কোনওভাবেই কম মারণঘাতী ছিল না। ইতিহাসের সবচেয়ে প্রাচীন মহামারী প্লেগের টিকা আবিষ্কার হয় এই সেদিন, ১৮৯৭ সালে। তারপরেও ২৬ বছর বাদে আমেরিকার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে এই ইঁদুর-বাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা গেছে। সুতরাং টিকা এলেই রোগ নির্মুল হয়ে যায় এমনটা নয়, তা সে মাত্র এক বছরের গবেষণায় ধনকুবেরের ভাণ্ডার পূর্ণ করার জন্য তৈরি করা হোক, বা অর্ধ-শতাব্দীর মেহনতের আবিষ্কারই হোক।       

ড্যানিয়েল ডিফো তাঁর ‘রবিনসন ক্রুসো’ উপন্যাসের কারণে বিশ্ববন্দিত। তাঁর অন্যান্য সাহিত্যকর্ম সম্পর্কে খুব কম মানুষই অবহিত। অথচ ১৬৬৫'র লন্ডন প্লেগের ওপর লিখিত তাঁর ‘দ্য জার্নাল অফ দ্য প্লেগ ইয়ার্স’এর উৎকৃষ্টতা সম্পর্কে স্বয়ং গার্সিয়া মার্কেজ উচ্ছ্বসিত। আজ যখন করোনার দাপটে গোটা দেশ টলোমলো, তখন তাঁর এই ডায়েরির শেষাংশ বেশ প্রাসঙ্গিক মনে হয়। ডিফো লিখছেন, বৃহস্পতিবার যখন সাপ্তাহিক মৃতের সংখ্যা জানা গেল তখন মানুষের মুখের অভিব্যক্তিটা বর্ণনা করা দরকার। তাদের চেহারায় মনে হল একটা গোপন বিস্ময়ের আভাস, একটা পুলক। অপরিচিত লোকেরা, যারা এতদিন মারীর কারণে একে অন্যকে এড়ানোর জন্য বিপরীত রাস্তায় হাঁটত, তারা করমর্দন করল। যেখানে রাস্তা সংকীর্ণ সেখানে মানুষ বাড়ির জানালা খুলে চেঁচিয়ে পরস্পরের কুশল জানল এবং তারপর জিজ্ঞাসা করল ভালো খবরটা তারা শুনেছে কি না? কয়েক জন জিজ্ঞাসা করল, কী সেই ভালো খবর? যখন তাদের বলা হল যে প্লেগের প্রকোপ কমে এসেছে, তারা উল্লসিত হয়ে উঠল, ঈশ্বর করুণাময় বলে উচ্চস্বরে ফুঁপিয়ে উঠল। চিকিৎসকরা পর্যন্ত অবাক হয়ে গেল। দেখল রুগিরা সেরে উঠছে, তারা কম ঘামছে, তাদের আর জ্বর নেই, ফোঁড়া ও রক্তিম ব্রণগুলো শীর্ণ হয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে, ভয়ঙ্কর মাথাধরাটা হ্রাস পাচ্ছে, কয়েক দিনের মধ্যে সবাই সেরে উঠছে।

গত বছরের জুন মাসের শুরুতে আনলক পর্ব যখন শুরু হয় তখন আমরাও হয়তো ভেবেছিলাম এই রকম নাটকীয় ভাবেই করোনা এক দিন আমাদের জীবন থেকে অন্তর্হিত হয়ে যাবে। আমরা ভেবেছিলাম, লকডাউন শেষ মানে কোভিড১৯ শেষ। দেশে নতুন করে আর একজনও আক্রান্ত হবে না, পুরনো রুগীরা সেরে উঠবে। টিভিতে ডাক্তার এবং বিজ্ঞানীরা উত্তেজিত স্বরে ভাইরাসের বিরুদ্ধে মানুষের জয় ঘোষণা করবে। লোকে দলে দলে রাস্তায় বেরিয়ে পড়বে, কোলাকুলি করবে। সমস্ত গাড়ি হর্ন বাজাবে, উল্লসিত যুবক-যুবতীরা হুসহাস করে বাইকে চরে বেড়াবে, শিস দেবে, ভেঁপু বাজাবে। অনেকে বাজি ফাটাবে। কিন্তু সেরকম কিছুই হল না। ভাইরাসকে সঙ্গে নিয়েই জীবনযাপন করতে হবে বিশেষজ্ঞরা নিদান দিলেন। অগত্যা কী আর করা? স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে হবে, যদিও একটা অস্বস্তি থেকেই যাবে এবং মাথার ওপরে কোভিড-১৯ এর খাঁড়া ঝুলতেই থাকবে

কিন্তু এটাই তো হওয়ার কথা ছিল। ইতিহাসে কোনও মহামারী নেই যা একটা ঢেউয়ের পরেই নিঃশেষিত হয়ে গেছে। সভ্যতার শুরু থেকেই প্লেগের আবির্ভাব। শতাব্দীর পর শতাব্দী এই বিভীষিকা বারবার হানা দিয়েছে, সমাজ ছারখার করে দিয়েছে, লাখো লাখো মানুষের যন্ত্রণাক্লিষ্ট মৃত্যুর কারণ হয়েছে। চোদ্দশো শতাব্দীর প্লেগ যা ইতিহাসে ‘ব্ল্যাক ডেথ’ নামে কুখ্যাত তা ইউরোপ উজাড় করে দেয়। মহাদেশের জনসংখ্যার ৪০-৬০ শতাংশ সাফ হয়ে যায়। ক্ষেতে তখন কাজ করার লোক পাওয়া ভার, সামন্ততন্ত্রের অস্তিত্ব সংকটে এবং এই সুযোগে গুটিগুটি পায়ে গিল্ড অর্থনীতির যাত্রা শুরু। প্রায় একশো বছর আগে স্প্যানিশ ফ্লু'র কথা ধরা যাক- ১৯১৮'র শুরু থেকে যা ১৯২০'র এপ্রিল-মে মাস অবধি চলেছিল। এই আড়াই বছরে মহামারীর চার চারটি ঢেউ আছড়ে পড়েছিল সারা বিশ্ব জুড়ে, যার মধ্যে দ্বিতীয় ঢেউটা ছিল সবচেয়ে মারাত্মক। মৃতের সংখ্যা নিয়ে নানা বিতর্ক আছে। মোটামুটি ধরে নেওয়া হয় যে ৪ থেকে ১০ কোটি মানুষ মারা গিয়েছিলেন যার মধ্যে অন্তত এক কোটি আমাদের দেশে। 

মহামারী যখন শুরু হয় তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ তুঙ্গে। আমেরিকা সহ ব্রিটেন, ফ্রান্সে সংবাদপত্রে বা রেডিওতে মারী সম্পর্কে একটি শব্দ উল্লেখ করাও ছিল অমার্জনীয় অপরাধ, কারণ তাতে যুদ্ধের প্রস্তুতির ব্যাঘাত ঘটবে, সৈন্যদের মনোবল ভেঙে পড়বে। যুদ্ধ নভেম্বরে শেষ হয় এবং শান্তি স্থাপিত হয়। সৈন্যরা সানন্দে গ্রাম-শহরে ফিরে যান আর তখনই মহামারীর দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয়। ব্যাধি সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণে সৈন্যরা চতুর্দিকে নিজেদের অজান্তেই সংক্রমণ ছড়ায়, মহামারী ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করে। আমেরিকায় প্রচুর মানুষ মারা যান কিন্তু যুদ্ধের কারণে মারীর খবর ধামাচাপা পড়ে যায়, তাই বলা হয় ‘দ্য প্যান্ডেমিক আমেরিকা ফরগট’। শুধু কি প্লেগ আর স্প্যানিশ ফ্লু? প্রায় দেড়শো বছরে কলেরার সাত সাতটি ঢেউ ছিল, কোনটা কত বেশি প্রাণনাশক ছিল তা জানতে হলে পূর্ণাঙ্গ রিসার্চ করতে হয়। তাই কোভিডের দ্বিতীয় বা তৃতীয় ঢেউ এসে পড়লে বিস্মিত হওয়ার কী আছে?      

গত বছরের জুন মাসে করোনার সংক্রমণ যখন ইতালি, আমেরিকা, রাশিয়া, ব্রাজিল এবং আমাদের দেশে যথেষ্ট উদ্বেগজনক, তখন বিখ্যাত এবং বিশ্বাসযোগ্য মেডিক্যাল জার্নাল ‘ল্যানসেট’এ একটি লেখা প্রকাশিত হয়: ‘আজকের এই সংকটের সম্মুখীন হলে গান্ধী কী করতেন?’ তাঁরা বলছেন, প্রথমত, মহাত্মা গান্ধী শুধু জ্ঞান দিতেন না, যা বলতেন তা করে দেখাতেন। দ্বিতীয়ত, তিনি স্থানীয় স্তরে কাজ শুরু করতেন, সারা বিশ্বের পেছনে ছুটতেন না। তৃতীয়ত, তিনি এমন কিছু নিয়ে শুরু করতেন যা খুব মামুলি মনে হত, যেমনটা করেছিলেন একমুঠো নুন নিয়ে যা ইতিহাস পালটে দিয়েছিল। তিনি করোনার আতঙ্ক থেকে মানুষকে মুক্তি দিতেন। 

আশার কথা হল, এই কাজটা আজ মানুষ নিজেরাই করছে। মানুষ ঠিক করে নিয়েছে, আর গৃহবন্দী হয়ে থাকা নেই। কোনও লকডাউন আর সে মানবে না, করোনার ভয়ে না খেতে পেয়ে সে মরবে না। সে অষ্টপ্রহর পরিশ্রম করবে, নিজের এবং পরিবারের ক্ষুধা নিবৃত্ত করবে, তাতে করোনা হলে হবে, না হলে না হবে। পত্রিকায় আরও লিখছে, গান্ধী প্রাকৃতিক নিরাময়ের ওপর জোর দিতেন; পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা, মাস্ক পড়া, হাত মুখ ধোয়া। লকডাউনের সময় এই যে আমরা পরস্পরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকতাম, পরিচিত মানুষকেও এড়িয়ে চলতাম, এমনকি অসুস্থ স্বজনের ধারে কাছেও ভিড়তাম না, গান্ধী কঠোর ভাবে এর বিরোধিতা করতেন। তিনি বলতেন, আমার পাড়া আমার দায়িত্ব। ‘আমার প্রতিবেশী আমারই দায়িত্ব। সেটাই আমার স্বধর্ম, আমার কর্তব্য---বিশেষ করে এই সময়ে।’ লেখক লিখছেন, আমার তো সন্দেহ হয় লকডাউনের সময় বিভিন্ন এলাকায় এই ঘেটো তৈরি করার বিরুদ্ধে তিনি হয়তো সত্যাগ্রহ করে ফেলতেন। আর তিনি বিশ্বায়নের বিপরীতে গ্রাম-স্বরাজের ওপর জোর দিতেন। তিনি হয়তো মানবিক সম্পর্কের ভিত্তিতে স্থানীয় উৎপাদন, স্থানীয় বন্টন ও উপভোগ এবং দৃঢ় সৌহার্দ্যমূলক সম্প্রদায় গড়ে তোলার ওপর জোর দিতেন। তিনি আবারও মনে করিয়ে দিতেন, মানুষের যা প্রয়োজন তা সবই প্রকৃতিতে আছে, কিন্তু তাঁর লোভের জন্য কিছু নেই।

আমাদের নেতারা এইভাবে কোনও সমস্যার অনুধাবন করবে এটা ভাববার কোনও অবকাশই নেই। তাই গত বছরের জনতা কার্ফুর সময় দেশে দৈনিক সংক্রমণ যেখানে ছিল ৫০০'র কাছাকাছি সেখান থেকে আজ আমরা ২,৫৯,১৭০ রোজকার সংক্রমণের মহাসমুদ্রে নিমজ্জিত।


Monday, 19 April 2021

মতুয়া ভাইদের বলছি

কর্পোরেট পুঁজির জালে ধরা দেবেন না 

শিবশংকর পাল 


মনোবিজ্ঞানের অন্যতম বিদ্যায়তনিক পাঠবস্তু হল সমাজ মনোবিজ্ঞান। মেরিল্যান্ড ইউনিভার্সিটির মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক চার্লস স্টেনগার তাঁর অন্যতম গ্রন্থ 'সোসাল সাইকোলজি প্রিন্সিপলস'-এ সমাজের মানসিক বিন্যাসের উপর গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা করেছেন। এই গবেষণার জন্য তিনি আমেরিকার সাইকোলজিক্যাল সোসাইটির চার্টার ফেলো নির্বাচিত হন। তাঁর তত্ত্ব বিশ্ব জুড়ে মান্যতা পেয়েছে। তিনি দেখিয়েছেন, সমাজের মনকে নানাভাবে গড়েপিটে নেওয়া যায়, ভেঙেচুরে দেওয়া যায় পছন্দমাফিক। প্রয়োজনে নানা প্রলোভন ও মিথ্যা দিয়ে প্রভাবিত করে ক্ষমতাসীনরা নিজেদের অনুকূলে তা ব্যবহারযোগ্য করেও গড়ে তুলতে পারে। 

বৃহত্তর সমাজের গভীরতর প্রদেশে এতদিন সাধারণত দু' ভাবে প্রভাব বিস্তার করা হত: ১) তীব্র দেশপ্রেমের নামে উগ্র রাষ্ট্রপ্রেমের জন্ম দেওয়া ও ২) ক্রমাগত অনৃতভাষণের সাহায্যে সফেদ ঝুটকে ‘আসল’ সত্যে পরিণত করা। এর ধ্রপদী ব্যবহার একদা হিটলার করেছিলেন। এখনও এই অস্ত্রের বহুল প্রয়োগ আমরা দেখতে পাচ্ছি আমাদের দেশে। পাশাপাশি তার থেকেও উন্নত শস্ত্রাদির জন্ম দিয়ে চলেছে বিভিন্ন দেশের শাসকের দল। তার অন্যতম কয়েকটি হল- প্রায় অবাস্তব অথচ জনমনোরঞ্জনী প্রতিশ্রুতির বিতরণ; কাটা ঘা-কে উসকে দেওয়া; কাল্পনিক শত্রু তৈরি করা; যেহেতু হিংসা আরও হিংসার জন্ম দেয়, তাই হিংসার চাষ করা; এবং সমাজের ঐক্য ভাঙার জন্য পরস্পরকে প্রতিপক্ষ হিসেবে দাগিয়ে দেওয়া ইত্যাদি। প্রায় সব দেশের শাসকরা নিজেদের সিংহাসন অটুট রাখতে সমাজ মনোবিজ্ঞানের এই পরীক্ষা-নিরীক্ষাগুলি করে চলেছে এবং সফলও হচ্ছে। সাম্প্রতিক কালে বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশ এ ব্যাপারে পথিকৃতের ভূমিকা নিয়েছে। সদ্য প্রাক্তন ট্রাম্প-শাসিত আমেরিকা ও মোদী-শাসিত ভারত এর উজ্জ্বল উদাহরণ।  

সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গের চলমান বিধানসভা নির্বাচনের দিকে তাকালে চার্লস স্টেনগার-এর তত্ত্বগুলির প্রাসঙ্গিকতা ও প্রয়োগ স্পষ্টভাবে চোখে পড়বে। ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচন বহু কারণে জাতীয় স্তরে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষত, বিজেপির হিন্দুরাষ্ট্র গঠনের প্রধান বাধা পশ্চিমবঙ্গ। কারণ, ভারতের যে অংশকে রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা আর্যাবর্ত বা গো-বলয় অথবা হিন্দিবলয় হিসেবে গণ্য করে থাকেন সেখানকার সাধারণের মানসিকতা প্রায় বিজেপির অনুকূল। দীর্ঘকাল ধরে এই অংশের রাজনীতিতে আরএসএস প্রতিষ্ঠিত ‘হিন্দুত্ব’কে সারজল দিয়ে চাষ করা হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গেও আরএসএস দীর্ঘদিন ধরে হিন্দু নামধারী নানা সংগঠনের নামে তাদের প্রচার চালিয়ে গিয়েছে। তবু বাঙালির মেধা-মনন ও দ্রোহাত্মক ভাবধারা সেই প্রচারের একটা বড় বাধা। আরএসএস বুঝেছে, হিন্দুরাষ্ট্র গঠনের এটাই তাদের শেষ সুযোগ। 

প্রায় একশো বছরের ‘সংগ্রাম’ শেষে এই প্রথমবার তারা কেন্দ্রীয় সরকারে একক দল হিসেবে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ। এই গরিষ্ঠতার বাহানায় করোনার মতো অতিমারির ‘সুযোগ’ নিয়ে তারা একের পর এক এমন সব বিল পাশ করিয়েছে, যার সাহায্যে একদিকে দেশের যাবতীয় রাষ্ট্রায়ত্ত সম্পদ সহ সমস্ত প্রাকৃতিক সম্পদ কতিপয় পুঁজিপতির হাতে তুলে দিচ্ছে। সেই সঙ্গে আরও অধিক মুনাফার জন্য প্রয়োজন সস্তা শ্রমিকমজুর; তাই প্রায় রাতারাতি অতি তৎপরতার সঙ্গে আনা হয়েছে এনআরসি। অন্যদিকে কৃষি আইন ও শ্রমকোড আইন আনা হয়েছে এবং নাগরিকত্ব আইনের সংশোধন করা হয়েছে। কেবল আইন তৈরি করাই নয়, হিন্দুরাষ্ট্র গঠনের অত্যুগ্র উৎসাহে এনআরসি ও এনপিআর প্রয়োগ করার সুযোগ খুঁজছে তারা।

কথা হল, এই আইনগুলি এত কর্কশ ও তীব্রভাবে জনবিরোধী বলে এর একটাও বিজেপির দলীয় ইশতাহারে ঘোষণা না করে বরং কিছু আর্থিক সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে বাংলার বিধানসভা নির্বাচনে, যার অধিকাংশই তৃণমূলের ইশতেহার থেকে ফেলু ছাত্রের মতো টুকে নেওয়া। বিজেপি খুব ভালো করেই জানে, পশ্চিমবঙ্গের ভোটে জিততে হলে যা কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হবে ৭০ শতাংশের উপর। এই ৭০ শতাংশের একটা বড় অংশ তফশিলি জাতি উপজাতি সম্প্রদায়ের মানুষ; এঁদের অধিকাংশ মতুয়া ও নমঃশূদ্র সম্প্রদায়ের। এঁদের আবার সকলেই ৭১-পূর্ব ও পরে ভারতে এসেছেন। দীর্ঘকাল ভারতে বাস করে রেশন কার্ড থেকে শুরু করে ভোটের পরিচিতিপত্র প্রায় সবই হস্তগত হয়েছে। অনেকেই সরকারি চাকরিবাকরি করছেন। প্রায় বছর বছর নানা কিসিমের ভোটে নাগরিক অধিকার প্রয়োগ করে সরকার নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছেন। তারপরেও নাগরিকত্বের জন্য এঁদের হীনম্মন্য আবদার আর সেই বাঞ্ছা মেটানোর জন্য অমিত শাহের প্রতিশ্রুতি বিলোনো দেখে চার্লস স্টেনগার-এর তত্ত্বগুলোর কথা মনে পড়ে যাচ্ছে।  

বাংলা জেতার জন্য মোদী-শাহ্‌ কেন্দ্রীয় সরকারের সব কাজ ফেলে প্রায় গোটা ক্যাবিনেট নিয়ে ডেইলি প্যাসেঞ্জারি করছেন। পাশাপাশি নিয়ম করে প্রায় প্রতিটি সভায় একজন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে ও তাঁর দলের এক সাংসদকে নজিরবিহীনভাবে ব্যক্তিগত আক্রমণ করে চলেছেন। আর অন্যজন ক্রমাগত মিথ্যে কথা বলে চলেছেন এবং অবাস্তব প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন; যার অধিকাংশ সভায় তৃণমূলের ব্লক লেবেলের নেতার করা জনসভার চেয়েও কম জমায়েত হচ্ছে। তিনি হুমকি দিচ্ছেন, একজনও ঘুসপেটিয়াকে (বাঙালিকে এঁরা উইপোকা বলেই মনে করেন) ভারতে থাকতে দেওয়া হবে না। ভোটে জিতলে সমস্ত মতুয়া ও নমঃশূদ্র সম্প্রদায়ের মানুষকে নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। এই প্রতিশ্রুতি পেয়ে উক্ত সম্প্রদায়ের বেশ কিছু নেতৃস্থানীয় মানুষ যাঁদের হাতে ভোটব্যাঙ্ক মজুদ আছে বলে মনে করা হয়, তাঁরা ধেই ধেই করে নাচছেন। 

সাধারণ মতুয়া সম্প্রদায়ের মানুষের কাছে আমার কয়েকটি প্রশ্ন-

প্রশ্ন ১) বঙ্গ বিজয়ের পর কেন নাগরিকত্ব দেওয়া হবে? কেন হারলে নয়? কেন না নাগরিকত্ব দেওয়ার অধিকারী কেন্দ্র, রাজ্য নয়। 

প্রশ্ন ২) ঘুসপেটিয়া বলতে অমিত শাহ্‌ কাদের বোঝাচ্ছেন? হিন্দুদের, নাকি মুসলমানদের? মুক্তিযুদ্ধের পরে ওপার বাংলা থেকে আসা মুসলমানদের সংখ্যা নেহাতই নগণ্য। ওপার থেকে আসা ৯৮ শতাংশই হিন্দু। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কি ‘ঘুসপেটিয়া’ বলে হিন্দুদেরই অপমান করছেন না? মতুয়ারা কেন সেই অপমান সহ্য করছেন? 

প্রশ্ন ৩) দেশভাগের জন্য মূলত দায়ী স্বাধীনতা পূর্বকালের নেতৃবৃন্দ, বিশেষত জনসংঘের জনক শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় স্বয়ং। বিজেপি দলটির পিতৃদেব তিনিই। তাঁর কৃতকর্মের দায় কেন মতুয়ারা নেবেন? আসলে অমিত শাহ্‌ প্রায় শুকিয়ে যাওয়া পুরনো ঘা-কে খুঁচিয়ে সংকীর্ণ ভোট রাজনীতি করছেন না? আর সেই রাজনীতি কেন মতুয়ারা হজম করছেন প্রায় বিনা প্রশ্নে, বিনা বিচারে? 

প্রশ্ন ৪) রাষ্ট্রের সঙ্গে ব্যক্তির সম্পর্কই হল নাগরিকত্ব। খুব স্বাভাবিক কারণে কোনও সভ্য রাষ্ট্র তার নাগরিকদের বিশেষ কিছু সুবিধা প্রদানের পাশাপাশি বিশেষ পরিচিতিও দিয়ে থাকে। এই অধিকার থেকেই রাষ্ট্র পরিচালনায় অংশগ্রহণ করেন নাগরিকগণ। প্রায় সকল মতুয়াই বিগত নির্বাচনগুলিতে অংশ নিয়ে নাগরিকের দায়িত্ব পালন করেছেন; পাশাপাশি রেশন ও নানা সরকারি সুযোগসুবিধা পেয়ে নাগরিকত্ব পাকা করেছেন। যদি তাঁরা নাগরিক না-ই হন তাহলে তাঁদের দেওয়া ভোটে নির্বাচিত কেন্দ্র-রাজ্য উভয় সরকারই কি অবৈধ হয়ে যায় না? সেই ‘অবৈধ’ সরকারের ফরমান কেন একজন স্বাধীন নাগরিক মানবেন? 

সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্য যেই মুহূর্তে ‘গোলাপি কাগজে’ কেউ লিখিত আবেদন জানাবেন সেই মুহূর্তে সিএএ অনুযায়ী তাঁর নাগরিকত্ব ‘ভ্যানিশ’ হয়ে যাবে। তাঁর যাবতীয় স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ ও চাকরি-ব্যবসা ‘সিজ’ করা হবে। এবং তাঁকে লিখিত প্রমাণ দিতে হবে তিনি বাংলাদেশে ধর্মীয় উৎপীড়নের কারণে এ দেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন। বাংলাদেশের পুলিশ কি আজ আপনাকে উক্ত মর্মে জেনারেল ডায়েরি বা এফআইআর দেবে? যদি দেয়ও তবু আপনার মামলার নিষ্পত্তি হতে হতে এক দশক থেকে দেড় দশক কেটে যাবে। ঐ সময় আপনি জেলে অন্তরীণ থাকবেন। সিএএ-তে কোনও নিঃশর্ত নাগরিকতা দেওয়ার কথা নেই। সর্বোপরি ৩২ হাজার জন আবেদনকারী উপরোক্ত বয়ানে ভারতের নাগরিক হওয়ার আবেদন জানিয়েছেন; এর সঙ্গে মতুয়াদের কোনও সম্পর্ক নেই। সিএএ আসলে খুঁড়োর কলের একটি গাজর। যা কোনওদিন আপনার নাগালে আসবে না।

এই পর্যন্ত পড়ে হয়ত ভাবছেন দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কি এত বড় ‘ঢপ’ দিতে পারে? এ যে দিন দহারে সমুদ্রসমান মিথ্যা প্রতিশ্রতি। এইখানে চার্লস স্টেনগার-কে স্মরণ করব। তিনি জানিয়েছেন, যে প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা প্রায় অসম্ভব সেই প্রতিশ্রুতি বারবার দিলে সাধারণের মনে একটা ইতিবাচক আগ্রহ তৈরি হয়। এই মনোভাব আরও গভীর হয় গোষ্ঠীভুক্ত মানুষদের উদ্দেশে পুনঃপ্রচারিত হলে। খেয়াল করে দেখুন, চার্লস স্টেনগার-এর তত্ত্ব অনুযায়ী বিজেপি পাকিস্তানকে আপনার কল্পিত শত্রু বানিয়ে রেখেছে, মাঝে মাঝে কিছু জওয়ানকে ‘বলি’ দিয়ে সীমান্তে যুদ্ধজিগির জাগিয়ে রেখে।  দ্বিতীয়ত, হিন্দুদের বিকাশের পথে প্রধান বাধা হিসেবে মুসলমানদের প্রতিপক্ষ বানাচ্ছে। সরকারি তথ্য পরিসংখ্যানকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে ওঁরা দিনের পর দিন প্রচার করে চলেছে, মুসলমানরা চারটে পাঁচটা করে বিয়ে করে, চোদ্দ-পনেরোটা করে কাচ্চাবাচ্চা। আগামী দশ-বিশ বছরেই ওঁরা নাকি ভারতের দখল নিয়ে নেবে। ১৪ শতাংশ ৮৬ শতাংশকে এইভাবে নাকি গিলে নেবে। বিজেপি-আরএসএস এবং ওদের আইটি সেল নিরন্তর এই মিথ্যা প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে শীতলকুচিতে ঠাণ্ডা মাথায় বিনা প্ররোচনায় চারজন সংখ্যালঘু মানুষ খুন করে এবং সেই খুনের পক্ষে সাফাই দিয়ে জঘন্য হিংসাকে সামাজিক মান্যতা দিচ্ছে। এমন কি দেগঙ্গাতেও গুলি চালিয়ে সংখ্যালঘু এলাকায় সৃষ্টি করে চলেছে হাড়হিম করা ত্রাসের রাজত্ব। 

ভোটের এই হিংসাত্মক আবহে অমিত শাহের মিথ্যা প্রচারের ফাঁদে পা দিয়ে মতুয়ারা বোধহয় ভুলে যাচ্ছেন অসমের হাতেগরম অভিজ্ঞতার কথা। বিজেপিকে ভোট দিয়ে আপনারা যদি জেতান, তবে সবার আগে আপনারাই কিন্তু ডিটেনশন ক্যাম্পে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হোন। মাকড়সার জাল যত সুন্দর কারুকার্যমণ্ডিত হোক না কেন, খাদ্য সংগ্রহই তার একমাত্র উদ্দেশ্য। কয়েক লক্ষ মতুয়া বাঙালিকে বসিয়ে খাওয়ানোর জন্য ডিটেনশন ক্যাম্প তৈরি হয়নি। জেনে রাখুন, সিএএ আম্বানি-আদানিদের সস্তার মজুর সাপ্লাই দেওয়ার জন্য নির্মিত একটি ছলনাজাল মাত্র।


Saturday, 17 April 2021

মার্কিন নৌবাহিনীর মাতব্বরি

ইতিহাসের চাকা ঘুরছে?

অর্ধেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়


 

দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও অর্থনীতির সঙ্গে বিশ্বের রাজনৈতিক ও আর্থনীতিক পালাবদলের সম্পর্ককে অগ্রাহ্য করা যায় না। বিশেষ করে সেই যুগে যেখানে প্রায় সমস্ত দেশ উদার অর্থনীতির দ্বারা অভিগ্রস্ত। দেশে এখন বিধানসভা নির্বাচনের হেলিকপ্টার উড়ছে, একই সঙ্গে কোভিড অতিমারির দ্বিতীয় ঢেউ রোজ ভেঙে ফেলছে সমস্ত খতিয়ানের নজির– সেখানে দাঁড়িয়ে ১০ এপ্রিল সংবাদের শিরোনাম হয়ে উঠল একেবারে অন্য একটি বিষয়: আমেরিকার নৌ-বাহিনীর ভারতের লক্ষদ্বীপ অঞ্চলে বিনা অনুমতিতে প্রবেশ। পাকিস্তানের আক্রমণ হলে হয়তো আরও একটু উত্তেজক পরিবেশ সৃষ্টি হত, কিন্তু পুরনো বন্ধু আমেরিকার তরফে এরকম আচরণ বলেই হয়তো এখনও ব্যাপারটা গণমাধ্যমে দাবানল হয়ে ওঠেনি। 

তাই বলে এই ঘটনাকে কি বিচ্ছিন্ন বা আনকোরা বলা যায়? যায় না। কারণ, বিশ্ব-অর্থনীতির মানচিত্র বদলের ইঙ্গিত হল এই ঘটনা যা বিগত কয়েক দশক ধরে ধীরে ধীরে নিজের জায়গা বিস্তার করেছে। ‘ইতিহাসের চাকা ঘুরছে’ বলে একটি জনপ্রিয় কথা বেশ প্রচলিত। কথাটিকে যতটা অবহেলার সঙ্গে ব্যবহার করা হয় আদতে তা কিঞ্চিৎ গুরুত্বপূর্ণ মনোযোগ দাবি করে। এ-কথা তো অজানা নয় যে, মধ্যপ্রাচ্য থেকে এককালে যে-মানবসভ্যতার উত্থান শুরু হয়েছিল তা সময়ের অগ্রগতিতে প্রথমে ইউরোপ ও পরবর্তীতে আমেরিকার শাসকদের কুক্ষিগত হয়। এশিয়া সেখানে যেন নিতান্তই দীনবেশ। কিন্তু এক্ষণে, কোভিড অতিমারির প্রভাবে ইতিহাসের রথচক্র এশিয়ার মাটিতে এসে নিশ্চিত করেছে আগামী আর্থনীতিক দৈত্যের মানদণ্ড। আর এশিয় ভূমিতে ভারতবর্ষ ও চিন হল সেই রাজমুকুটের সর্বপ্রথম দাবিদার। ফলে, আমেরিকার সমাগত পতনকালে সে যে অন্তত একবার গা-ঝাড়া দিয়ে উঠে নিজেকে রক্ষা করতে চাইবে সে-কথা বলাই বাহুল্য। আর তাই-ই একদিকে দক্ষিণ চিন সাগরকে কেন্দ্র করে ও অন্যদিকে ভারতের ইইজেড অঞ্চলে বিনা অনুমতিতে আমেরিকার নৌ-বাহিনীর গতায়াত শুরু হয়েছে।

গত বছরের ১৭ জুন, টাইমস নাও-এর একটি প্রতিবেদনে লেখা হয়েছিল যে, 'শি বোধহয় ২০২০ সালটিকে আর্থনীতিক দৈত্য হয়ে ওঠার যানে গতিবৃদ্ধির বছর হিসেবে গ্রহণ করেছেন। সারা বিশ্ব যেখানে করোনা বিধ্বস্ত সেখানে বেজিং এক প্রজন্মে একটি মাত্র সুযোগ হিসাবে এশিয়ার একাধিপতি হওয়া-কে দেখছে ও আমেরিকাকে ধূলিসাৎ করে ফেলতে বদ্ধপরিকর হয়েছে।' এই সংবাদের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে ২৬ ডিসেম্বর বিবিসি কর্তৃক প্রকাশিত একটি শিরোনামে জানানো হয় যে, 'সেন্টার ফর ইকোনমিক্স অ্যান্ড বিজনেস রিসার্চের ভাবীকথন অনুযায়ী চিনের অর্থনীতি ২০২৮ সালের মধ্যেই আমেরিকার অর্থনীতিকে ছাপিয়ে যাবে এবং ২০৩০ সালের মধ্যে ভারতবর্ষও নিজেকে তৃতীয় সেরা অর্থনীতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবে।' তাছাড়া আমেরিকা ও ইউরোপের সুবিখ্যাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে সংযুক্ত আরব ও চিনের ব্যাপক বিনিয়োগের ঘটনাও এখন আর অজানা নয়। তাই সব মিলিয়ে এ-কথা অস্বীকার করার আর সুযোগ নেই যে আগামী পৃথিবীর জ্ঞান-বিজ্ঞান, রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি, সামরিকনীতি প্রভৃতি সর্বক্ষেত্রেই বেশ কয়েকটি দশক জুড়ে এশিয়দের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে। 

অয়েলার এহ্রমেসের একটি গবেষণা অনুযায়ী প্রমাণ হিসাবে তিনটি মূল প্রবণতার কথা বলা হয়েছে। প্রথম, ১৯৯০ সাল থেকে ২০০২ সাল অবধি বিশ্ব-অর্থনীতিতে দুটি মূল স্পৃহা- একটি আমেরিকার গতির বিপরীতে অর্থনীতির যাত্রা ও অন্যটি চিনের ওয়ার্ড ট্রেড অর্গানাইজেসনে প্রবেশ, যা একইসঙ্গে বিশ্ব-অর্থনীতির কেন্দ্রকে প্রথম প্রাচ্যাভিমুখে ঠেলা দিয়েছে। দ্বিতীয়, করোনা অতিমারি এই প্রক্রিয়াকে আরও তরস্বান্‌ করেছে কেননা এশিয়া-পেসিফিক অঞ্চলই একমাত্র যারা কোভিডের প্রভাবকে দ্রুত কাটিয়ে উঠতে পেরেছে। ২০২০-২১ সালের প্রাচ্যাভিমুখী এই গতি ২০১৫-১৯ সালের থেকে ১.৮ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে ও যা ২০২৪ সাল নাগাদ আরও বাড়বে। তৃতীয়, ২০৩০ সালে এই কেন্দ্র চিন, ভারত ও পাকিস্তান সন্নিহিত অঞ্চলে এসে স্থির হবে। 

এই অনুলাপগুলিকে একেবারেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না, কেননা, চিন ও ভারতবর্ষের হাতে আছে এমন এক অস্ত্র যা বিশ্বের প্রায় কোনও দেশের কাছে নেই। আর তা হল জনসংখ্যা। পুঁজিতান্ত্রিক কাঠামো এই জনসংখ্যাকে কেবলমাত্র কয়েকটি মাথা হিসাবে নয়, কনজিউমার বা উপভোক্তা বিবেচনা করে। অর্থাৎ, বিদেশের বাজার ছাড়াও এই দেশের অভ্যন্তরেই আছে এক সুবিশাল বাজার যদি এই উপভোক্তা শ্রেণিকে কার্যকরী উপভোক্তা শ্রেণিতে রূপান্তরিত করা যায়। চিন ইতিমধ্যেই প্রযুক্তি ও উৎপাদন শিল্পে বিপ্লব করে ফেলেছে যা দেশের ভেতরের ও বাইরের প্রায় সমস্ত বাজার দখল করেছে। পক্ষান্তরে, ভারতবর্ষেও ‘আত্মনির্ভরতা’ প্রকল্পের ঘোষণার মধ্য দিয়ে জাতীয় ও জাতীয়তাবাদী পুঁজির জন্ম দেওয়া হয়েছে ও পুঁজির পক্ষে বাজার তৈরির মার্গ প্রস্তুত করা শুরু হয়ে গেছে (যে-কারণে নানারকমের জনবিরোধী নীতি, এনআরসি-সিএএ, কৃষিবিল, শ্রম আইন, পিএসইউ বিক্রি, রেলের বেসরকারিকরণ, পরিবেশ বিল ইত্যাদি নিত্যনৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে)। দ্য রিজিওনাল কম্প্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপের তরফেও এই অগ্নিতে ঘৃতাহুতি দেওয়া হয়েছে যা আর্থনীতিক গতার্তবা আমেরিকাকে বিপদে ফেলেছে। তারা ‘ASEAN’ দেশগুলির মধ্যে বিভিন্ন প্রকারের বাণিজ্য চুক্তির মধ্য দিয়ে নিজেদের আর্থনীতিক বৃদ্ধিকে জোরালো করে তুলছে। চিন-জাপান ও জাপান-দক্ষিণ কোরিয়ার আলাদা বাণিজ্যচুক্তি ছাড়াও একত্ব আকারে চিন-জাপান-দক্ষিণ কোরিয়ার মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি দ্রুততার সঙ্গে বাস্তবায়িত হচ্ছে। এর ফলে অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের নানা দ্রব্যসামগ্রীর ক্ষেত্রে যেমন, তেমন-ই জাপানের যানবাহন ও যন্ত্রপাতির প্রেক্ষিতে ব্যাপক উত্থান দেখা দেবে। ভারতবর্ষ ও ইন্দোনেশিয়ার মধ্যে রফতানি প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি পাবে যা ইন্ধন জোগাবে আরও আগ্রাসী বাজার দখলের প্রক্রিয়াকে। শুধু তাই-ই নয়, চিন নিকটবর্তী দেশগুলির মধ্যে অর্থাৎ ফিলিপাইনস, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া ও কিছুটা থাইল্যান্ডের মধ্যে গড়ে উঠবে সাপ্লাই-চেনের সুসংগঠিত বন্দোবস্ত। ফলে, পলিসি-মেকার ও নানা কর্পোরেটের কাছে এই অঞ্চলগুলি আগামী কয়েক দশকের জন্য হয়ে উঠবে বিনিয়োগ ও লাভের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ক্ষেত্র। 

গভীরভাবে দৃক্‌পাত করলে এ-কথা স্পষ্ট হয়ে উঠবে যে এই অঞ্চলগুলি প্রায় সবই দক্ষিণ চিন সাগরের নিকটবর্তী এলাকা যেখানে বছরে প্রায় তিন ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের ব্যবসা হয়। আর তাই এই সমুদ্রাঞ্চলে এখন আমেরিকা অবৈধভাবে তার প্রভাব বজায় রাখার মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছে। অন্যদিকে ভারতের সঙ্গে চিন ও মধ্যপ্রাচ্যের নানা দেশের বাণিজ্যিক সুসম্পর্ক বৃদ্ধির প্রচেষ্টাও আমেরিকার নজরে সংশয় বৃদ্ধি করছে। তাই সে এখন ভারতকেও যেন ছেড়ে কথা বলতে নারাজ। এই সমস্ত ঘটনা একত্রে তাই একদিকে আমেরিকার টিকে থাকার আগ্রাসী চেষ্টাকে নগ্ন করে দিয়েছে ও অন্যদিকে ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও ফেলেছে গভীর প্রভাব। শিল্পবিপ্লব পরবর্তী যুগ হোক কিংবা মধ্য বিশ শতক, যখনই আর্থনীতিক এই রূপান্তর ঘটেছে তখনই, সমগ্র দেশ-দুনিয়াব্যাপী অব্যবস্থা প্রবল হয়েছে। সংবাদপত্রের পাতায় পাতায় এখন তাই দেখা যায় পৃথিবীর প্রায় সব দেশে ঘটমান জনরোষ, গৃহযুদ্ধ, শাসকের নির্মমতা, বিচ্ছিন্নতাবাদ, অসহিষ্ণুতা ও মানবতাবাদের প্রতি অবমাননার দৃষ্টান্ত। এমতাবস্থায় এই দেশও একই প্রবাহে শামিল, এখানকার শাসকও ব্যতিক্রম নয়। তাই আগামী দিনে জনসাধারণের কাছে আরও বেঁধে বেঁধে থাকা ছাড়া উপায়ান্তর নেই। হয় এই ঐতিহাসিক মুহূর্তকে মগজস্থ করে উপভোগ করতে হবে, নয়তো বিমূর্ত এই ঘূর্ণিঝড়ের অলাতচক্র সব কিছু গিলে ফেলবে। 


তথ্যসূত্র:

1. eulerhermes.com/en_global/news-insights/economic-insights/the-world-is-moving-east-fast.html

2. https://www.businesstoday.in/current/world/global-economic-balance-is-shifting-from-us-eu-to-china-india-un-report/story/394064.html

3. https://www.bbc.com/news/world-asia-china-55454146

4. https://www.asianage.com/world/americas/100421/us-navy-challenges-indias-excessive-maritime-claims-at-lakshadweep-islands.html


Friday, 16 April 2021

অশনি সংকেত?

হিন্দু জাতীয়তা ও পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচন

শোভনলাল চক্রবর্তী



অবশেষে নীল শেয়ালের গায়ের রং মুুছে গেল শীতলকুুুচিতে। এই বঙ্গে প্রচারে এসে বিজেপির সর্বভারতীয় নেতারা হিন্দুত্ব নিয়ে প্রথম দিকে 'রা কাটেন নি। ছোট, বড়, মেজ নেতা নেত্রীরাও ছিলেন এই ব্যাপারে নীরব। ভাবটা এমন যেন, বিজেপি ব্যাপারটা শুধুই বাংলার উন্নয়নের সঙ্গে জড়িত, হিন্দু রাষ্ট্রের প্রকল্পের সঙ্গে তার কোনও সম্পর্ক নেই। এটা যে এক ধরনের ভাবের ঘরে চুরি, বা জেনেশুনে চোখ বুঁজে থাকা, তা প্রমাণিত হল। শীতলকুুুচির পর এক দল বিজেপি নেতা চরম উস্কানিমুলক কথা বলেন, যা আগে আমরা কখনও শুনিনি। কমিশন কোনও কিছুই কানে তুললেন না। শীতলকুুুচিতে ছেড়ে দেওয়া হল অপরাধীদের। তার ভিডিও সামনে এসেছে। প্রমাণ হয়েছে বিজেপির বলা সব কথা ভুল। 

আসলে কেন্দ্রীভূত হিন্দু জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্র গঠনের কাজ সমান তালে এগিয়ে চলেছে। এটা সুকৌশলে করে চলেছে বিজেপি-আরএসএস। ২০১৪ সালে ক্ষমতা দখল করে মোদি হিন্দুত্বের কথা বলেননি। কিন্তু তলে তলে বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলোতে মুসলিম-খ্রিস্টান বিরোধিতা বেড়ে চলল। ২০১৭ সালে যোগী আদিত্যনাথ উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী হয়ে গোরক্ষা, লাভ জিহাদ প্রভৃতি বিভিন্ন ছুতোতে মুসলিমদের উপর অত্যাচার বাড়াতে লাগল। ২০১৯-এর নির্বাচনের পর কেন্দ্রীয় সরকার হিন্দুত্ববাদীদের দাবি একে একে পূরণ করতে শুরু করে দিল। 'তিন তালাক' বে-আইনি ঘোষণা, জম্মু কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা রদ, অযোধ্যায় নতুন রাম মন্দির নির্মাণে সরকারি সাহায্য, নাগরিকত্ব আইন সংশোধন- সবই হিন্দুত্ব প্রকল্পের অঙ্গ। পাশাপাশি এল বড় পুঁজিপতিদের আবদার মেনে নতুন কৃষিপণ্য আইন, সংশোধিত শ্রম আইন, বড় বড় সরকারি উদ্যোগ, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক, বীমা কোম্পানি বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়ার প্রস্তাব। রাষ্ট্রনীতির এই গতিপথ মসৃণ করার জন্য দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে কেন্দ্রীভূত করার কাজ চলছে। এমনিতেই আর্থিক ব্যাপারে কেন্দ্রের পাল্লা ভারী ছিল, জিএসটি আসার পর তা আরও বেড়ে গেল। 

পাশাপাশি, কেন্দ্রের প্রশাসনিক নির্দেশ রাজ্যের উপর চাপিয়ে দেওয়ার প্রবণতা ক্রমশ বেড়ে চলেছে। যে সব বিষয়ে রাজ্যেরই একমাত্র সাংবিধানিক অধিকার, তাতেও কেন্দ্রীয় সরকার আইন পাশ করছে, একের পর এক নির্দেশ দিয়ে চলেছে। এই যে ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ, এর পেছনে রয়েছে রাজনৈতিক কারণ। ২০১৪ সালে সারা ভারতে বিজেপি পেয়েছিল ৩১ শতাংশ ভোট, ২০১৯-এ তা বেড়ে হয় ৩৭ শতাংশ। তাতেই বিজেপি লোকসভায় একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। অথচ, দেশের বৃহত্তর অংশে (৬৩ শতাংশ) এবং বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিজেপির সমর্থন বিশেষ নেই। সুতরাং, কেন্দ্রের ক্ষমতাকেই যত দূর সম্ভব ব্যবহার করে বিজেপিকে তার রাজনৈতিক উদ্দেশ্যসাধন করতে হচ্ছে। অনেক রাজ্যে নির্বাচনে হারার পর বিধায়ক ভাঙিয়ে সরকার গঠন করেছে বিজেপি। কিছু রাজ্যে সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। দিল্লিতে পরের পর নির্বাচনে পরাজিত হয়ে অবশেষে সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার সুবিধা নিয়ে, আইন পাশ করিয়ে দিল্লির রাজ্য সরকারকে ক্ষমতাহীন করার ব্যবস্থা করা হল ক'দিন আগে। 

উপরন্তু, বিচারব্যবস্থা, নির্বাচন কমিশন, সিবিআই ইত্যাদি যত স্বাধীন সংস্থা ছিল সেগুলোকে একে একে পকেটে পুরছে হিন্দুত্ববাদীরা। এই প্রসঙ্গেই হিন্দুরাষ্ট্রের কল্পনায় পশ্চিমবঙ্গের স্থান গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। হিন্দু জাতীয়তাবাদী উত্থানে এক সময় বাংলার উচ্চবর্ণের হিন্দু নেতারা বড় ভূমিকা নিয়েছিলেন। হিন্দু মহাসভার সামনের সারির বহু নেতা ছিলেন বাঙালি। বাংলায় কংগ্রেসের প্রাদেশিক নেতৃত্ব ছিল ধনী উচ্চবর্ণ হিন্দুদের হাতে, ব্যতিক্রম ছিল চিত্তরঞ্জন দাশের নেতৃত্বে অল্প কয়েক বছরের শাসনকাল। ১৯৪৭-এর বাংলা ভাগের দাবি মুসলিম দলগুলো করেনি, করেছিল শ্যামাপ্রসাদের নেতৃত্বে বাংলার হিন্দুবাদীরা। তাই হিন্দুত্ববাদীদের কাছে বাংলার একটা আলাদা গুরুত্ব আছে। সুতরাং, বাংলায় পালাবদল হলে এখানে হিন্দুত্বের রাজনীতি জাঁকিয়ে বসবে, তা অবধারিত। 

জনবাদী প্রকল্পে যে অঢেল টাকা আসবে সে গুড়ে বালি, কারণ  কোনও বিজেপি শাসিত রাজ্যে এমন অঢেল খরচের ব্যবস্থা নেই। কিন্তু অনুপ্রবেশ আর মুসলিম তোষণ নিয়ে অভিযোগ ছাড়াও গোরক্ষা, লাভ জেহাদ, ধর্মান্তরের উপর নিষেধাজ্ঞা ইত্যাদি নানা ব্যাপারে সংখ্যালঘু মানুষকে কোণঠাসা করা হবে। শিক্ষা, চাকরিতে সংরক্ষণ নিয়ে দলিত-ওবিসি বনাম মুসলিম বিভাজন সৃষ্টি করা হবে। যুক্তরাষ্ট্রের কাঠামোর যা অবস্থা তাতে কেন্দ্রে-রাজ্যে বিজেপি শাসন কায়েম হলে পুরো শাসনের রাশ চলে যাবে কেন্দ্রের হাতে। পশ্চিমবঙ্গের বিজেপির সংগঠন ও নেতৃত্বের যা হাল দেখা যাচ্ছে তাতে রাজ্যের নেতাদের কেন্দ্রের নেতাদের সর্বদা জো-হুজুর করে চলতে হবে, নতজানু হয়ে থাকতে হবে। বৃহৎ কর্পোরেট পুঁজিনির্ভর অর্থনীতি আর উত্তর ভারত মার্কা হিন্দু জাতীয়তাবাদী গুটকা সংস্কৃতি সেই রাজার ঘাড়ে চেপে থাকা বেতাল ভূতের মতো বাংলার ঘাড়ে চেপে বসবে। 

অতএব, এবার যদি পালাবদল হয়  তবে তা শুধু রাজনীতি নয়, বাংলার অর্থনীতি, সমাজ, সংস্কৃতি সব কিছু আপাদমস্তক বদলে দেওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে আসবে। হিন্দিতে যাকে বলে হিন্দুরাষ্ট্র, বাংলায় তাকে বলা যায় হিন্দু জাতীয়তা যেখানে বহুত্বের কোনও স্থান নেই। তার মন্ত্র 'এক দেশ, এক ধর্ম, এক ভাষা'। এই হিন্দুরাষ্ট্রের দেহে বাংলার মানুষ নিজেদের সঁপে দেবেন কিনা তা আপাতত লাখ টাকার প্রশ্ন। তার পরীক্ষা এই নির্বাচন। সেই অর্থে এ এক ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণ বাংলার মানুষের কাছে। আগামীর অশনি সংকেত কি দেখতে পাচ্ছেন বাংলার মানুষ ?


Wednesday, 14 April 2021

Life is Simple!

Either You Screw Facts Else Go to Pakistan

Satya Bol



So, my dear brothers and sisters of India, last time I checked, it was still a free country. Freedom of speech was still a part of our Constitution. However, that was in the morning. It is night now. Has it been changed? Changes come overnight these days na! Anyway, if not, then let's have some fun.

We all know India is a sovereign, socialist, secular and democratic republic. Not my words. It's in the Constitution. And I know our hon'ble PM, param pujyo Modiji is trying hard to hardest for the prosperity of the nation. The updates of his dedication- be it a poster boy of Trump or in Ambani wedding, we always get updates in our Whatsapp messages. Like JanaGanaMana has been getting the best national song award for last 7 or 8 odd years. Like, blurring the horizons of nationalism is a fine gesture as our jawans are fighting in Siachen. So it is cool to lynch some anti-national, and shoot Gouri Lankesh. Or none killed Justice Loya. Don't worry, Arnab will win that battle even crazier.

However, if you are ready to move from established and openly declared IT cell or Republic garbage, you are free to look up at the underneath facts. Oh my God, I know I spoke 'facts'! May be it will upset your feelings, if you feel like Karni Sena. 

Anyway, I have deep respect for our Modiji who takes photographers with him during his meditation or maternal visit. I only wish good for him. So what has he done over the last 7 years? Let's have a look. 

[Statutory warning: If you are allergic to facts and walked in the rally in support of Unnao or Hathras rape convicts, this is not for you. This is strictly for human beings.]

1. Women safety index 133 (out of 167) [54 in 2014].

2. World hunger index 94 (out of 107) [Pakistan is 88/ Bangladesh 75].

3. Freedom of press index 142 (out of 180).

4. Human development index 131 (out of 189) [Bangladesh 133].

5. Democracy index 53rd (27th in 2014).

6. Corruption index 86 (85 in 2014).

7. Unemployment rate 5.36% (Pakistan 4.45%, Bangladesh 4.19%).

8. Education budget cut by 6% in 2021.

9. 5 million job lost in demonetization. Black money recovered 0.648%.

10. Corruption laws passed (electoral bond).

11. RTI curbed.

12. 3rd largest beef exporting country in world (In 2014 it was 5th).

13. Rafale file still missing.

14. PM Care fund still in dark.

15. 1% of population earn 21% income of the nation. 10% earns 56%. India is only second to Russia in terms of income disparity.

16. Govt begging votes in the name of soldiers.

17. Pulwama probe still in deep dark.

18. Change in labour law. Complete demolition of employment security.

19. Lowest interest rate ever in history. Highest petrol, diesel, gas etc.

And most importantly,

20. 79.8% Hindu population. 15% Muslim population.

I'm sure Muslims will surpass Hindus in the coming 5 years. After all they produce 5/6 children. So henious! But anyway, our Hon'ble PM is the third child among a total of 6. Oooppss!

So, fact-wise Modi govt is the worst performing govt ever. I have no doubt that the gigantic failure is due to Nehru and 15% Muslim population of India who are going to take over within the next term of India Government Pvt Ltd. 

Moral: Fuck facts, be a deshpremi, vote for Modi or go to Pakistan. Life is simple.


Tuesday, 13 April 2021

Fact Finding on Sitalkuchi

Letter to National Human Rights Commission

(MASUM's Fact Finding On Killings by CISF at Sitalkuchi in the name of Protecting Democracy While the Voters were at Line of Polling)

 



To

The Chairman

National Human Rights Commission

Manav Adhikar Bhawan

Block – C, G.P.O. Complex, INA

New Delhi – 110023


Respected Sir,

Today I lodge one complaint which shakes the fabric of democracy in our country where the CISF (Central Industrial Security Force) jawans arbitrarily used lethal weapon and fired upon the voters causing death of four innocent people who came to cast their vote in West Bengal Assembly Election 2021. The incident which I mention hereunder throws a pile of shame to the world’s largest democracy and indicates the Central Government responsible for this brutal atrocity and arbitrary attitude of the forces.

The details of the incident was investigated through fact finding by our team.  

The Election Commission of India declared eight phase elections for the Assembly Election in West Bengal. On 10.04.2021 in its fourth phase election schedule, the election programme started in the district of Cooch Behar, West Bengal. In Jorpatti village under Sitalkuchi Block and Mathabhanga Sub Division the polling station was created at Amtali Madhyamik Siksha Kendra. On the said day, the villagers were voting peacefully since morning at poll booth number 126, Sitalkuchi (Amtali Madhyamik Siksha Kendra). While polling was underway, some BJP men mobilised 50-60 voters and were on their way to the booth along with CISF personnel. The CISF was escorting them to the booth.

At about 9.35 am, a 14 year old physically challenged boy named Master Mrinal Haque son of Majid Mia in the village was hit by CISF personnel in the market place, which was far from polling booth. The on-duty and uniformed CISF jawan mercilessly beat the boy on the street, for which he fell down. This incident made the local villagers angry. After sometime some CISF jawans tried to shift him in a car. The boy’s brother began recording the incident on his phone. The CISF personnel snatched the mobile phone and beat up his brother. Seeing the incident of torture by the CISF personnel upon the physically challenged boy and his brother, the villagers protested peacefully. At this point of time, sector mobile officer informed QRT (Quick Reaction Team) and the QRT headed by CISF personnel came to the spot with a Bolero car. 4/5 CISF personnel got out from the car and instructed the people to look back and instantly two CISF jawans started firing arbitrarily. Before anyone understood anything, four villagers were shot in their chest and several people were injured. Some voters tried to capture this incident in their mobile phone but the perpetrator jawans snatched their mobile phone and beat them heavily and after some time state police and other voting agents posted in that polling booth left the place. It should be noted that the CISF jawans who fired openly were brought in from outside; the security forces present on duty at the polling booth did not open fire and after the perpetrator CISF jawans shot the four people, they got into their vehicle and left the place. The incident of beating Master Mrinal Haque son of Majid Mia flared up the anger of the villagers.

Four persons namely Mr. Manirul Kaman (24), Mr. Nur Islam Mia (20), Mr. Chamiul Haque (20) and Mr. Hamidul Mia (25) were instantly shot dead during this open firing by the perpetrators CISF personnel and seven other people were injured heavily in this incident. Mr. Binoy Burman, aged about 50 years, received right upper anterior aspect of thigh gunshot injury who has been now shifted to Cooch Behar, M.J.N. Hospital. Mr. Alamgir Alam, aged about 38 years received multiple injuries admitted at Mathabhanga Sub Divisional Hospital. Mr, Mrinal Haque, a minor aged about 14 years, victim of physical assault admitted at Mathabhanga SD Hospital. Mr. Debendra Das aged about 32 received blunt injury on head who was admitted at Mathabhanga SD Hospital; Mr. Dilip Kumar Majumdar, 3rd Polling Officer and Mr. Avijit Burman, 1st Polling Officer and Ms. Minati Ray Burman an ASHA worker who were also injured in this incident (as per official statement).

On the other side, CISF released one statement where they mentioned that on 10.04.2021 at around 09.35 hrs, near Booth No. 126, QRT of CISF 567/C headed by Coy Commander Insp/E Sunil Kumar was attacked by a mob of miscreants about 50 to 60 in numbers while they were taking round of area along with local police representative to clear public who was resisting voters from reaching polling booths. CISF Booth Commander tried to pacify the miscreants but the mob entered the polling booth and few miscreants tried to snatch the weapons of CISF personnel deployed there and when the mob started advancing aggressively towards CISF personnel  and sensing imminent danger to their life, they fired 7 rounds towards the advancing mob of miscreants.


Unfortunately, statement of district superintendent of police of Cooch Behar, who just joined under order of Election Commission seconded the justification of firing by CISF without revealing the truth.  

In this regard I want to mention, while force used by a state in self defense it must meet the demands of proportionality. I am very much suspicious about the truthfulness of the statement of CISF. The following questions which are very much relevant in this case –

·         Why CISF jawan had beaten Master Mrinal Haque son of Majid Mia in the market area?

·         Whether the firing upon the innocent people was in legitimate exercise of right of self-defense or not?

·         Whether the use of force was proportional or not to the resistance offered?

·         How much dangerous situation was there for firing seven rounds of lethal bullet upon innocent villagers?

·         There were no arms in the hands of the villagers, then why the CISF personnel fired bullet towards them?

·         If the CISF thought that there was a dangerous situation, then why at first they did not lathi charge upon the mob?

·         Why firing upon the voters was not consulted with the Presiding Officer, who was in charge of polling activity of that area?

·         Why Tear gas cells were not burst to resist the mob?

·         Who was the commanding officer and ordered to fire and at which direction?

·         Why the CISF jawans did not shot bullets below the belt of the people?

·         If a dangerous situation was created at that point of time by the hooligans, then why any CISF personnel was not injured?

Originally, it is case of arbitrary use of power by the trigger happy CISF where without any cause CISF personnel killed four young persons and after that made a fabricated story of self defense to cover their own crime.

In a leading newspaper report Master Mrinal Haque, a 14 year physically challenged boy told that he was in the local market when CISF jawans grabbed him by the neck and hit him several times with sticks and when he fell into the ground, some villagers protested verbally of that incident and helped him to release from the hand of CISF.

Our District Human Rights Monitor talked with the family members of the deceased victims from where it is revealed that Mr. Nur Islam was the only earning member of the family consisting of 5 members. He was a migrant labourer. On 08.04.2020 he came to his native place to cast his vote. After sticking bullet in his chest he was taken to Mathabhanga Sub Divisional Hospital where he was declared dead. Inquest was done by one executive magistrate and post mortem was done by Dr. N. Das. An Unnatural Death case was registered vide Mathabhanga PS UD case number 26/2021.

Mr. Manirul Jamal also was the main earning member of the family consisting of 7 members. He was also a migrant worker. On 09.04.2021 he came to his village from Gangtok to cast his vote. Mr. Chamiul was also the main earning member of the family consisting of 5 members. Mr. Hamidul Mia was the earning member of the family consisting of 4 members. His wife is pregnant now.

The cousin brother of one deceased victim Mr. Manirul Jamal said that his brother had returned from Gangtok, Sikkim, where he worked as a migrant labourer, to take part in the voting process. He also stated that as per the instruction of BJP leaders, the CISF personnel intentionally fired towards the Muslim people. It was a pre-planned incident.

The perpetrator CISF personnel not only violated the rights guaranteed in Article 21 of Indian Constitution but also the premise of Article 7 of International Covenant on Civil and Political Rights as well as the Goal number 8 and 16 of Sustainable Development Goal earmarked by United Nations and in both these international instruments; the government of India is a party and have agreed. The perpetrator CISF personnel also violated Article 2, 3, 5, 6 and 8 of the Code of Conduct for Law Enforcement Officials; adopted by General Assembly Resolution 34/169 of 17 December 1979 and Basic Principles on the Use of Force and Firearms by Law Enforcement Officials, Eighth United Nation Congress on the Prevention of Crime and the Treatment of Offenders.

This incident where four innocent people were shot dead for attending the festival of democracy made responsible of the central government and its forces.

It must be mentioned here after one day of this fatal incident, BJP West Bengal state president Mr. Dilip Ghosh told in a public rally that this incident of firing and killing will again occur in the subsequent phases of campaign of  West Bengal Assembly Elections but till date the Central Election Commission did not take any steps against him.


In this regard we demand:

·         The whole incident must be investigated impartially by the own investigating wing of the Commission

·         The guilty CISF jawans must be booked and prosecuted in the open court of law.

·         Proper compensation must be provided to the family members of the deceased victims.

·         Proper security and safety of the family members of the victims must be ensured.

·         Immediately book and prosecute under law the BJP West Bengal State President for his hate speech and direct Central Election Commission to ban him from next phases West Bengal Assembly Election.

·         Guidelines of NHRC India on Encounter Death should be followed.

·         A judicial inquiry must be initiated as soon as possible.

·         Immediate suspension of perpetrator CISF personnel, including SP Cooch Behar till investigation is over. 

Thanking you,

Yours truly

Kirity Roy

Secretary, MASUM

&

National Convener, PACTI


To see the testimonies of victims and other related documents, please click: 

https://m.youtube.com/watch?v=so-p68Mg2kc&feature=youtu.be


Sunday, 11 April 2021

শীতলকুচির নির্মল প্রাণ

বাংলা বাঁচানোর লড়াই

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য


 

বিজেপি’র রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ আজ (১১ এপ্রিল ২০২১) বরানগরের প্রকাশ্য নির্বাচনী সভায় হুমকি দিয়েছে- জায়গায় জায়গায় শীতলকুচি করে দেব। অর্থাৎ, শীতলকুচিতে ১০ এপ্রিল সিআইএসএফ বাহিনী যে গণহত্যা সংগঠিত করেছে তার দায় দিলীপ ও তার দলবলের। এটা প্রকারান্তরে সে স্বীকার করে নিয়েছে। এবং স্বীকার করে এই হুঙ্কার ছেড়েছে যে আরও এমন ঘটনা তারা ঘটাবে। স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে, নির্বাচন কমিশন, কেন্দ্রীয় বাহিনী, বিহার-ইউপি থেকে আসা উর্দি পরা আরএসএস ক্যাডার বাহিনী, স্থানীয় প্রশাসন- প্রত্যকের ওপর নিরঙ্কুশ আধিপত্য ও নিয়ন্ত্রণ কায়েম করে দিলীপ-মোদি-শাহ আপাতত বাংলার বিরুদ্ধে এক ভয়ঙ্কর সর্বাত্মক যুদ্ধে নেমেছে। তাই আরও গণহত্যা প্রত্যক্ষ করার জন্য আমরা বাংলার অধিবাসীরা কি ত্রস্ত চোখে বিনিদ্র রাত কাটাব?

কিন্তু কেন এই হিংসাশ্রয়ী রণহুঙ্কার? কেন এই সর্বগ্রাসী যুদ্ধ? প্রথম তিন দফা ভোটে বিজেপি’র যে প্রায় ভরাডুবি হয়েছে তা রাজনীতিতে আনকোরা লোকেরাও এখন বলে দিতে পারছেন। অতএব, এই মোদ্দা কথাটা দিলীপ ও তার দলবলের না বোঝার কোনও কারণ নেই। তাই চতুর্থ দফা (১০ এপ্রিল) থেকেই তারা এক প্রকার অস্ত্র সজ্জিত হয়ে মাঠে নেমেছে। ওইদিন প্রায় সারা রাজ্য জুড়ে কেন্দ্রীয় বাহিনী সন্ত্রাস তৈরি করেছে, জায়গায় জায়গায় ভোটারদের বিজেপি’কে ভোটে দেওয়ার জন্য প্ররোচিত করেছে এবং যে সব অঞ্চলে অ-বিজেপি ভোট বেশি বলে অনুমান, সেখানে সেখানে তারা ভোটারদের ভোট দিতে নানারকম বাধা-বিপত্তি ও অবরোধ সৃষ্টি করেছে। এসব করেও যখন দেখা যাচ্ছে, ভোটারদের ঢল বাঁধনছাড়া, তাঁরা দলে দলে বেরিয়ে এসে সুস্পষ্ট রায় মনে গেঁথে নিজ নিজ ভোটকেন্দ্রে পৌঁছে যাচ্ছেন, তখন বিজেপি’র উন্মত্ত প্রার্থীরা কোথাও গাড়িতে বসে ভেতর থেকে ভারী জিনিস দিয়ে নিজেরই গাড়ির কাঁচ ভাঙছে, তো কোথাও কেন্দ্রীয় বাহিনী সঙ্গে করে বুথের বাইরে সন্ত্রাস তৈরি করে এলাকায় ভয়ের পরিবেশ নির্মাণ করছে। ইতিমধ্যে ওইদিন দুপুরেই খবর এসেছে, ত্রিপুরার উপজাতি পরিষদের নির্বাচনে বিজেপি’র একেবারে ভরাডুবি হয়েছে। তাদের বহু কথিত ‘ডাবল ইঞ্জিন’ সরকার বেমালুম বিকল হয়ে মাঝপথে বসে গেছে। এবং তারা জানে, ত্রিপুরার ভোটের ফলাফলের প্রভাব এ রাজ্যেও বেশ কিছুটা পড়বে। পরিশেষে, উত্তরবঙ্গে যেখানে গত লোকসভায় প্রায় সব আসন দখল করে তাদের মৌরসিপাট্টাটি বেশ কায়েম হয়েছিল, অন্তত সেটুকুও যদি না থাকে, তাহলে তো সারা দেশে মুখ দেখানোই দায়। শুধু কি মুখ দেখানো? ২০১৯’এর পর থেকেই তাদের পরাজয়ের যে ধারা শুরু হয়েছে ও চলেছে, তাতে করে এ রাজ্যে অমন সলিল সমাধি হলে তো দলটার অস্তিত্বই বিপন্ন হয়ে পড়বে; যখন ঘাড়ের ওপর দিল্লি সীমান্তে লক্ষ লক্ষ কৃষক আজও পথে বসে আছেন একটা হেস্তনেস্ত’র আশায়।

অতএব, রাস্তা একটাই: গণহত্যা। হাতে যখন কেন্দ্রীয় বাহিনী মজুত, নির্বাচিত শাসকের হাতে রাজ্যের শাসনভার নেই, নির্বাচন কমিশনই সর্বেসর্বা, তখন এই তো সুযোগ বাংলা ও বাঙালিকে উপযুক্ত শিক্ষাটি দেওয়ার। তবুও যদি প্রথম তিন দফায় ভোটগুলি এন্তারসে ‘পদ্মফুলে’ পড়ত, না হয় ক্ষমাঘেন্না করে ছেড়ে দেওয়া যেত। কিন্তু তা যখন পড়েনি আর পাঁচ দফা আরও বাকী আছে, তখন তো তা ষোলআনা উশুল করতে যা করার তা চতুর্থ দফা থেকেই শুরু করতে হবে।

যেমন ভাবা তেমন কাজ। এতদিন কলটা ছিল, গোদি মিডিয়াকে দিয়ে বিজেপি’র পক্ষে হাইপ তুলে, সোশ্যাল মিডিয়ায় লক্ষ লক্ষ ফেক খবর ও ভিডিও ছেড়ে, সর্বত্র কোটি কোটি টাকা ছড়িয়ে, হিন্দু-মুসলমান, হিন্দু উচ্চবর্ণ-নিম্নবর্ণ, আদিবাসী-আদিবাসী এইসব বিভেদকে সাশ্রয় করে ও উস্কানি দিয়ে এবং এনআইএ-ইডি-সিবিআই লেলিয়ে বিরোধীদের নাজেহাল করে বা জেলে পুড়ে কাজ হাসিল করা। একই ফর্মূলা বাংলাতেও চালানো হয়েছিল। সেই সঙ্গে ছিল, শীর্ষ নেতাদের এ রাজ্যে ডেইলি প্যাসেঞ্জারি করিয়ে সভা-সমাবেশ, রোডশো করানো, বেকার ছেলেদের ভুরি ভুরি টাকা দিয়ে পাড়ায় পাড়ায় পোস্টার, ব্যানার, ফ্লেক্স সাঁটানো, অনামী শিল্পী থেকে শুরু করে সমাজে অল্পস্বল্প মান্যি আছে এমন ব্যক্তিদের ফোন করে প্রায়-হুমকি দিয়ে তুলে এনে প্রধানমন্ত্রী অথবা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে ডিনার করিয়ে বিজেপি’র পক্ষে নামানো- একেবারে বানিয়া স্টাইলে এই প্রক্রিয়াটিও যুক্ত হয়েছিল। সেই সঙ্গে ছিল মোদি-শাহ’এর তুমুল চিৎকার (নাকি আর্তনাদ?)- ‘দিদি গেল’ ‘দিদি গেল’; এতটাই নাটকীয় ও রঙ্গভরা যে নির্বাচন সম্পন্ন হয়ে যাওয়া বিধানসভা এলাকার আধিকারিকদের মোদি স্বয়ং এমনকি নির্দেশও দিয়ে দিলেন যে তাঁরা যেন ‘কিষাণ নিধি’ প্রকল্পের জন্য এখুনি তথ্য সংগ্রহ করতে শুরু করে দেন।

তবুও চিড়ে ভিজল না। দেখা গেল, এইসব হম্বিতম্বি করে ও প্রবল স্নায়ুর চাপ দিয়েও তিন দফা ভোট শেষে তাদের হাতে পেন্সিলটুকুও থাকছে না। ইতিমধ্যে মোদি-দিলীপের নিযুক্ত পেশাদাররা বলতে শুরু করেছে, যেমনটা আশা করা গিয়েছিল তেমনটা হয়নি। সব মিলিয়ে কিছু কিছু বিভ্রান্তি ঘটানো গেলেও সামগ্রিক ভাবে তাদের নাচনকোঁদনের তেমন কোনও প্রভাব পড়েনি। বিজেপি’র বাংলা জয় তো দূরস্থান, পঞ্চাশটা আসনের কোটা পেরোয় কিনা তাই নাকি এখন দেখার। আর সময়ও বেশি নেই। হাতে মাত্র পাঁচ দফা। পুলওয়ামার স্মৃতিও টাটকা। অতএব, প্ল্যান বি: আড়ং ধোলাই, সন্ত্রাস ও গণহত্যা।

পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনী লড়াইকে এবার ওরা টেনে নিয়ে এসেছে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের ময়দানে। একদিকে কেন্দ্রীয় বাহিনীর সশস্ত্র আক্রমণ ও কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রত্যক্ষ নির্দেশে নির্বাচন কমিশনের রাজনৈতিক অভিসন্ধি ও প্যাঁচপয়জার, বিপরীত দিকে ভোটার কার্ড হাতে শান্তিপ্রিয় আমজনতা। ওদের শত প্রচেষ্টাতেও এখনও পর্যন্ত দাঙ্গা লাগানো যায়নি, বাইরে থেকে বড় বড় নেতাদের এনেও মাঠ ভরানো যায়নি, কোটি কোটি টাকা বিলি করে বাংলার ভোটারদেরও প্রভাবিত করা যায়নি। ওরা যতই ‘দিদ্দি ও দিদ্দি’ বলে অসভ্যের মতো টিটকিরি দিক না কেন, বাংলার মানুষ এটা বুঝে গেছেন যে এই লড়াইটা নিছক ‘মোদি বনাম দিদি’ নয়, বাংলা ও বাঙালি এবং তাদের সাধের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের যা কিছু অর্জনের সঙ্গে বানিয়া-হিন্দি-হিন্দুস্থানী বর্গীদের লড়াই। এ লড়াই বর্গীদের বিরুদ্ধে বাংলা ও বাঙালির আত্মমর্যাদা ও আত্মোন্নয়নের লড়াই। বাংলার অর্থনীতি, রাজনীতি, সামাজিকতা ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে রক্ষা করার লড়াই। এই লড়াইয়ে যারাই ওই বানিয়াদের বিপক্ষে বাংলার মানুষ তাদেরই পক্ষে। তাই সারা বাংলা জুড়ে একুশের ডাক: নো ভোট টু বিজেপি।

মনে রাখতে হবে, বাংলা জয়ের মধ্য দিয়েই ওরা চাইছে ‘ভারত জয়’কে সার্থক করে তুলতে। কারণ, বাংলাই পথপ্রদর্শক। যুক্তি-তর্ক, বিদ্যা-বুদ্ধি, রাজনীতি-অর্থনীতি, স্বাধীনতা সংগ্রাম-বিপ্লবী আন্দোলন, লোকশিল্প-আধুনিক সংস্কৃতি, সৃজন-প্রতিভা- সবেতেই বাংলা অগ্রদায়ক। আজও। এই বাংলাকে কব্জা করেই আরএসএস’এর দল আসলে চূর্ণ করতে চায় যা কিছু এ তাবৎকালের অর্জন ও সদর্থক ভাবনা, উদারবাদী ও তর্কপ্রিয় মনন। বাংলার অফুরন্ত সম্পদের দিকে ওই বানিয়াদের কঠিন দৃষ্টি। তাই এই নির্বাচন কঠিন-কঠোর আত্মরক্ষার লড়াই। বাকী চার দফায় উজাড় করে ভোট দিয়ে বিজেপিকে ‘সুপরা সাফ’ করে দেওয়ার লড়াই। ওরা গুলি চালাবে, হুমকি দেবে, হামলা করবে- কিন্তু একবার যদি দাঁতে দাঁত চেপে এ লড়াই আমরা জিতে যাই, তাহলে গোটা দেশ থেকেই নির্মুল হবে মতান্ধ, ঘৃণ্য ও সাম্প্রদায়িক বানিয়াদের ওই জঘন্য দলটি। কৃষকেরা অপেক্ষা করছেন। তাকিয়ে আছেন বাংলার দিকে। দিল্লি সীমান্তে নেতাজী সুভাষ ও ভগৎ সিং’এর ছবি পাশাপাশি রেখে শেষ লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছেন আমাদের অন্নদাতারা। আমাদের ভবিষ্যৎ থাকুক আমাদেরই হাতে। জয় বাংলা!

নো ভোট টু বিজেপি।