Sunday, 13 October 2019

কাশ্মীর নিয়ে দু-চার কথা

৩৭০  ধারা বাতিলের কৃতিত্ব কংগ্রেসেরও 
 সৌমেন  নাগ
১৯৪৭  সালের ১৫ আগস্ট  ব্রিটিশ  ঔপনিবেশিক শাসকের হাত  থেকে ভারতকে দ্বিখণ্ডিত করে ক্ষমতার বাটোয়ারার মাধ্যমে শাসন ভার পাওয়ার পর ধরে নেওয়া হয়েছিল, এবার  দুই  সম্প্রদায় তথা দুই দেশের শাসকেরা অন্ততপক্ষে লক্ষ লক্ষ মানুষের সব হারানোর আর্তনাদের বিষাদঘন ঘটনাগুলির কথা মনে রেখে উভয় খণ্ডের মধ্যে শান্তির প্রচেষ্টায় ব্রতী হবেন। কিন্তু ১৫ আগস্ট  থেকে ২৭ অক্টোবর- মাত্র তিন মাসের মধ্যেই উভয় দেশের সেনাবাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ল একে অপরের বিরুদ্ধে। লক্ষ্য কাশ্মীরের দখল। ১৯৪৯ সালের ১ জানুয়ারি উভয় দেশের মধ্যে যুদ্ধবিরতির চুক্তি হয়। কাশ্মীর দ্বিধাবিভক্ত হয় যুদ্ধ বিরতির রেখা বরাবর। ২৭ জুলাই ১৯৪৯ রাষ্ট্রসঙঘের ভারত-পাকিস্তান বিষয়ক কমিটির উপস্থিতিতে করাচীতে উভয় দেশ যুদ্ধবিরতি রেখা চিহ্নিত করে যে চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করেছিল, মনে করা হয়েছিল এই রেখাটিকেই উভয় দেশের সীমানা চিহ্নিত করে একটা স্থায়ী সমাধান হতে পারে; দেশের সাধারণ মানুষ এই যুদ্ধের উত্তাপ থেকে সরে এসে নতুন করে তাদের ভাঙা ঘরে ভবিষ্যৎ গড়ার কাজে শান্তিতে অবশিষ্ট খুদকুড়ো নিয়ে আত্মনিয়োগ করতে পারবে। সমস্যা হচ্ছে, সাধারণ মানুষ শান্তি চাইলেও সেই শান্তি যে ক্ষমতার কারবারীদের ক্ষমতাকে ধরে রাখতে অনিশ্চয়তার আশঙ্কার সামনে দাঁড় করিয়ে দেয় অশান্তিকে টিকিয়ে রাখতে, তাই তারা আজকের দুনিয়ায় নবতম ভয়াবহ অস্ত্র ধর্ম ও জাতিগত বিভেদ নীতিকে ব্যবহার করে।

৭০ বছর ধরে জম্মু-কাশ্মীর-লাদাখ নিয়ে  চলেছে ভারত পাকিস্তানের রাজনৈতিক লড়াই। তিন তিনটি যুদ্ধের উত্তাপ সইতে হল উভয় দেশের মানুষকে। এখনও প্রতিদিন যুদ্ধের হুমকির উত্তেজনার তাপে উভয় দেশের মানুষের ক্ষুধার রুটি সেঁকার পরিবর্তে উত্তেজনার অনিশ্চয়তার ভাবনাকে সেঁকতে হচ্ছে। কতদিন  চলবে একে অপরের বিরুদ্ধে এই মানসিক লড়াইয়ের বন্দীশালায় আটকে রেখে মূল সমস্যাগুলি থেকে তাদের দূরে রাখার এই কৌশলের খেলা? এবার  তো সময়  এসেছে এর এক স্থায়ী  সমাধানের।

লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান বা লড়কে লেঙ্গে হিন্দুস্থানের মতো লড়কে লেঙ্গে কাশ্মীর যে সম্ভব নয় এটা জেনেও আমাদের  রাজনৈতিক প্রভুরা তাদের ভোট মৃগয়ার স্বার্থে বাস্তব কথাটা বলতে পারছেন না। সেদিন জহরলাল নেহেরু যুদ্ধ  বিরতির কথা ঘোষণা না করলে সম্পূর্ণ  কাশ্মীর আজ ভারতের অংশ হত, সৃষ্টি  হত না আজাদ কাশ্মীর-  এইসব বিলাপের কোনও মূল্য বর্তমান আন্তর্জাতিক বিন্যাসে নেই। অতীতের রাষ্ট্রনেতার কোনও চুক্তি সেই শাসনের অবসানের সঙ্গে বাতিল হয় না। তাহলে তো জার শাসনের চুক্তি বলে আলাস্কায় আমেরিকার অধিকার বাতিল হয়ে  আবার রাশিয়ার অধিকারে চলে আসত। চীন তখন দুর্বল ছিল বলে শক্তিশালী ব্রিটিশ শাসকদের তৈরি ডুরান্ড বা ম্যাকমোহন লাইনকে সীমানা বলে মেনে  নিয়েছিল, তাহলে তো চীনের এই যুক্তি মেনে ভারতের অনেক এলাকা চীনের হাতে  দিয়ে  দিতে হয়। আবার শক্তিশালী মাঞ্চুরিয়া সাম্রাজ্যের আমলে চীনের অধীনে যে বিশাল  এলাকা এসেছিল তা আজকের  তথাকথিত  সমাজতান্ত্রিক চীনের দাবি  অনুসারে  মেনে  নিলে ভারতও তাহলে  দাবি  করতে পারে, অতীতের ভারতীয় সম্রাটরা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার যে বিশাল এলাকা জুড়ে  তাদের  সাম্রাজ্য  বিস্তার  করেছিল সেগুলি আজ ভারতের অন্তর্ভুক্ত  হবে। আজকের বাস্তবতায়  যা সম্ভব তাকে বিবেচনায় এনে সমস্যার স্থায়ী  সমাধানের পথ খুঁজতে হবে। বার্লিনের প্রাচীর ভেঙ্গে দুই জার্মানি এক হওয়ার মতো ভারত ও পাকিস্তানের দ্বি-জাতিতত্ত্বের প্রাচীর সরে গিয়ে  আবার  দুই  দেশ এক হবে, এই সুখস্বপ্ন সত্যি হলে তার থেকে সুখকর আর কিছু  হতে পারে না। কিন্তু বাস্তবকে  নিয়ে  ভাবতে হবে। খোঁজ  করতে হবে মীমাংসার পথ।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী  লোকসভায়  ঘোষণা  করেছেন,  শুধু  পাকিস্তান  অধিকৃত কাশ্মীর নয়, চীনের দখলে  থাকা লাদাখকেও তিনি  মুক্ত করবেন। প্রতিটি  ভারতবাসী তাই চায়। তবে চাওয়া  ও পাওয়ার  মাঝে  যে বিশাল ফাটল তাকে অতিক্রম করার পথও যে বলা দরকার। আপাতত  চীন এই আলোচনার বাইরে  থাক। পাকিস্তানের  দখলে  থাকা কাশ্মীর যা আজাদ কাশ্মীর নামে পরিচিত তার সম্পর্কে  তো আমাদের  জানাটাও অনেকটা ভাসা ভাসা।

পাকিস্তানের অধীন এই এলাকাটির দুটি ভাগ। একটি আজাদ কাশ্মীর। এটি জম্মু ও কাশ্মীর  প্রদেশের পশ্চিম অংশ। আয়তন  ৫১৩৪ বঃ কিমি যা পাক অধিকৃত কাশ্মীরের ১৫ শতাংশ এবং সমগ্র  জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের ৬ শতাংশ মাত্র। তুলনামূলক ভাবে পাক অধিকৃত কাশ্মীরের উত্তরাঞ্চলের  আয়তন অনেক বড়। পাক অধিকৃত  কাশ্মীরের ৮৫ শতাংশ। এই অঞ্চলটি প্রায় জনবিরল। তবে মনে রাখা দরকার, গিলগিট এজেন্সি ও বালতিস্থান নিয়ে এই উত্তরাঞ্চল ব্রিটিশ রাজনৈতিক প্রতিনিধির নিয়ন্ত্রণাধীন প্রশাসনিক বাঁধনে কাশ্মীরের আংশিক নিয়ন্ত্রণে থাকলেও এটি সম্পূর্ণ  ভাবে কাশ্মীরের  অংশ ছিল না।  ব্রিটিশ প্রতিনিধি মেজর ব্রাউনের প্ররোচনায় গিলগিট এজেন্সির আদিবাসী নেতারা সেখানে পাকিস্তানের পতাকা উত্তোলন  করে তারা পাকিস্তানে যোগ  দিয়েছে বলে ঘোষণা করেছিল। চীন, তিব্বত, আফগানিস্তান ও রাশিয়ার সীমান্তবর্তী  বলে এর সামরিক গুরুত্ব  খুব বেশি। গিলগিট ও বালতিস্তান  নিয়ে  গঠিত  এই অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ শিয়া এবং আদিম জনজাতি। এরা নিজস্ব নেতা দ্বারা শাসিত। পাকিস্তানের  দখলে  থাকলেও এরা সেখানকার  আইন রীতিনীতির খুব একটা ধার ধারে না।

কাশ্মীরের মানুষের  আত্মনিয়ন্ত্রণের  অধিকার  অবশ্যই  আছে। তাদের যদি মনে হয় সেই অধিকার  খর্ব  হচ্ছে, তাদের  আন্দোলনেরও অধিকার আছে। এই অধিকার শুধু কাশ্মীরীদের ক্ষেত্রে নয় সব সম্প্রদায় তথা জাতির আছে। কিন্তু  এই অধিকারে যদি ধর্মীয় পরিচয় প্রধান হয়ে দাঁড়ায় তখন কিন্তু  তাকে আর আত্মনিয়ন্ত্রণের আন্দোলন বলা চলে না। সেটা  হয়ে  দাঁড়ায় সাম্প্রদায়িক ভাবনার প্রকাশ। এখানেই  মানবাধিকার  সংগঠনগুলির দুর্বলতা প্রকট হয়ে পড়ছে। এরা রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস নিয়ে প্রতিবাদে মুখর হয় অথচ মৌলবাদী মুসলিম সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বহু ক্ষেত্রেই এক আত্মক্ষয়ী  নীরবতা পালন করে বলেই সাধারণ মানুষ তাদের প্রতিবাদকে ভোট  রাজনৈতিক  দলগুলির মতো মুসলিম  তোষণ বলে তাদের পাশে আসতে  চান না। অথচ সাধারণ মুসলিম জনগোষ্ঠী কিন্তু  এই সন্ত্রাসবাদী  ইসলামি ভাবনাকে সমর্থন করে না। এই প্রসঙ্গে  আরও  একটি প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার দরকার  ছিল। কারা কাশ্মীরী? কাশ্মীরী পণ্ডিতরা কি কাশ্মীরী নয়? ধর্ম  বিশ্বাসে তারা হিন্দু  বলে কাশ্মীর থেকে সাম্প্রদায়িক  ইসলামিক সন্ত্রাসবাদীদের আক্রমণ থেকে বাঁচতে দলে দলে তাদের জন্মভূমি কাশ্মীর  থেকে তারা পালিয়ে এসে উদ্বাস্তু শিবিরে আশ্রয়  নিয়েছিল, তখনই  তো সব ধর্মনিরপক্ষ সংগঠনগুলির বোঝা দরকার  ছিল যে এই ঘটনা পাল্টা  আরেক ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক শক্তির জন্ম  দেবে। কাশ্মীরের  এই বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের অন্যতম শীর্ষ নেতা সৈয়দ আলীশাখ গিলানী তাঁর ‘কাশ্মীর নভ-ই হুরিয়ত’ বইতে  লিখেছেন, তাঁরা কাশ্মীরী বলতে শুধু  কাশ্মীরী মুসলিমদেরই মনে করেন। তাই তিনি ‘হিন্দু’ ভারতের  পরিবর্তে ইসলামিক  পাকিস্তানের  সঙ্গে  কাশ্মীরকে যুক্ত  করার দাবি  করেন। এর কারণ হিসেবে তাঁর আরও যুক্তি, কাশ্মীরী মুসলমানরা ভাষা, বর্ণ, সংস্কৃতি, সভ্যতা, আচার-ব্যবহার ও চিন্তায় এক পৃথক জাতি। এদের ঐক্যের ভিত্তি ইসলাম।

প্রশ্নটা যে এখানেই। ধর্মীয় পরিচয় কি মানবাধিকার, আত্মনিয়ন্ত্রণ বা পৃথক এক জাতির পরিচয়
নিয়ে  এভাবে বিচ্ছিন্ন হবার অধিকারের দাবি করতে পারে? ভারতের প্রায় ৮০ শতাংশ হিন্দু সেই দাবিতে যদি ভারত নিজেদের হিন্দু  রাষ্ট্রের আত্মনিধনকারী সিদ্ধান্ত  নেয় তবে গোয়া, নাগাল্যান্ড কোথায়  যাবে? সেখানে তো অধিকাংশ খ্রিস্টান। শিখদের কিছু  অংশ যে পৃথক শিখ রাষ্ট্রের দাবি করছে তার কী হবে? মানবাধিকারের অর্থ তো খণ্ডিত মানবাধিকার  হতে পারে না। ধর্ম বিশ্বাস আর মানবাধিকার যদি এক হত তবে পৃথিবীতে এত যুদ্ধের ঘটনা ঘটত না। খ্রিস্টান হিটলার আক্রমণ করত না খ্রিস্টান ধর্মভাইদের। লড়াই হত না ইরান ইরাকের। পাকিস্তানের সেনার হাতে নিহত হত না পূর্ব পাকিস্তানের  লক্ষ লক্ষ মুসলমানেরা।

বিহার থেকে রুটি রোজগারের তাগিদে যেদিন মজুরেরা কাশ্মীরের ইটভাটায় কাজ করতে গিয়েছিল, তারা হিন্দু, এই বিচারে  যখন  তাদের  সারিবদ্ধ ভাবে  দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা  করা হয়েছিল, কাশ্মীরী পন্ডিতদের কাশ্মীর থেকে বিতাড়িত করে এই উপত্যকায় যখন সম্পূর্ণ ইসলামিকরণের আত্মক্ষয়ী  ভাবনার প্রকাশ  শুরু হয়েছিল, তখনই  তো দেশের সব শক্তির একযোগে এর প্রতিরোধে এগিয়ে আসার কথা ছিল। বিজেপি  প্রতিবাদ  করেছিল তার রাজনৈতিক  অঙ্ক  কষে। যত বেশি  হিন্দু  আক্রান্ত  হবে তত সে তার হিন্দু ঐক্যের সাম্প্রদায়িক তাসকে ব্যবহার করতে পারবে। আজ বিজেপি  সেই  রাজনৈতিক পাশা খেলায় জয়ী হওয়ায় তথাকথিত প্রগতিবাদীরা এখন সর্বনাশের রব তুলেছেন। তারা যদি  কুরু  রাজসভায় দ্রৌপদীর লাঞ্ছনার সময় কুরু মহারথীদের মতো এমন ভাবে মুখ লুকিয়ে  না রেখে কাশ্মীরের সন্ত্রাসের প্রশ্নে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের  বিরুদ্ধে প্রতিবাদের পাশাপাশি এই তালিবানী সন্ত্রাসের বিরুদ্ধেও তীব্র প্রতিবাদ  করতেন তবে কিন্তু  বিজেপির এই বিজয় নিয়ে এমন  অসহায়  আত্মবিলাপ করতে হত না। পাকিস্তানের হানাদারদের হাত থেক কাশ্মীরকে বাঁচাতে ব্রিগেডিয়ার  ওসমানের সেই অভূতপূর্ব  বীরত্ব  ও শহীদ  হওয়ার  ইতিহাস  আজকের  প্রজন্মের কাছে উপযুক্ত মর্যাদায় যদি তুলে ধরা হত তবে বুরহান ওয়নিরা এমন  ভাবে উপস্থিত হত না।

অমরনাথ  শিবলিঙ্গ  তো আবিষ্কার  করেছিলেন এক কাশ্মীরী মেষপালক মুসলিম। তার পরিবার তখন  থেকে  এই পবিত্র  শিবলিঙ্গের রক্ষণাবক্ষেণ করে আসছে। ২০০৮ সালে ৪০ একর জমি অমরনাথ শ্রাইন বোর্ডকে দেওয়া  হয়েছিল সেখানে তীর্থযাত্রীদের জন্য একটা  স্থায়ী  বিশ্রামাগার  নির্মাণের জন্য। এতে স্থানীয় কাশ্মীরীদেরই সুবিধা হত। অথচ গিলানীদের মতো বিচ্ছিন্নতাবাদী  সাম্প্রদায়িক  শক্তিগুলি এর বিরুদ্ধে হিংসাত্মক আন্দোলন সৃষ্টি  করলে জম্মুতে তার পাল্টা যে পথ অবরোধ  হয়েছিল তাতে কিন্তু  সেখানে হিন্দু  ও মুসলমান উভয়েই সামিল হয়েছিল। কারণ, অমরনাথ  তীর্থযাত্রার ওপর এই রাজ্যের অর্থনীতি অনেকটাই নির্ভরশীল।

৩৭০ ধারার ইতিহাস ও তার বিলোপ  নিয়ে  ইতিমধ্যেই  বহু  আলোচনা  হয়েছে এবং হবে। একচক্ষু  হরিণের মতো এই বিলোপ নিয়ে শুধুমাত্র বিজেপির সাম্প্রদায়িক  রাজনীতির দিকে আলোচনাকে নিক্ষেপ করলে কিন্তু  নিজেদের  দায়কে এড়ানো যাবে না। এতগুলি ধর্মনিরপক্ষে দল ও সংস্থা  থাকতেও  বিজেপি কেন  আজ এমন অপ্রতিহত  গতিতে  তাদের পেছনে  ফেলে  দেশের শাসনক্ষমতায়  আসতে পারল তার উত্তর দেওয়ার  দায়  থাকলেও  তা দিতে  না পারলে মানুষ  কিন্তু  বিজেপির কাছেই সেই  উত্তর খুঁজতে যাবে। খুঁজবে তাদের কাছেই আশ্রয়।

এক সময়ের সেই ‘লড়কে  লেঙ্গে  পাকিস্তান’ বা ‘ লড়কে  লেঙ্গে  কাশ্মীর’ আজ অচল। রাজনাথের  পরমাণু অস্ত্র  ব্যবহার নীতি পরিবর্তনের ঘোষণা, অপরদিকে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর হুমকি,  কোনওটাই বাস্তবায়িত হওয়ার সম্ভাবনা  নেই। উভয়েই  যদি  আত্মহত্যা করতে চায় সে অন্য কথা। ভাবতে হবে এর সমাধানের কথা। ভুট্টো এক সময়  ভারতের  বিরুদ্ধে  কাশ্মীর  নিয়ে  হাজার বছরের  যুদ্ধের কথা ঘোষণা করেছিলেন। তার দেশেরই সামরিক  শাসক তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে  দিল। জহরলাল নেহেরু সেদিন যুদ্ধবিরতি ঘোষণা না করলে কী হত সেই  প্রশ্নের এখন কোনও মূল্য নেই। কাশ্মীরের  একটা  অংশ পাকিস্তানের  দখলে  আছে  ৭০ বছরেরও বেশি সময়  ধরে। মেনে  নেওয়া  হয়েছে অঘোষিত ভাবে লাইন অফ কনট্রোলকে সীমানা বলে। কাশ্মীর উভয় রাষ্ট্রের নায়কদের কাছে  তাদের ভোট রাজনীতির হাতিয়ার। উগ্র জাতীয়তাবাদ তাদের  মূলধন। সেই সুযোগে পৃথিবীর  ভয়ঙ্করতম শক্তি  ইসলামিক সন্ত্রাসবাদ সাধারণ মানুষের মনে প্রভাব বিস্তার করার সুযোগ পাচ্ছে। সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রভাব  থেকে  মুক্ত  হতে চেয়ে তালিবানদের আগমনের সুযোগ করে দিয়ে  আজ শুধু আফগানিস্তান নয় সারা দুনিয়ার মানুষকে তার মূল্য পরিশোধ করতে  হচ্ছে। LOCকে সামনে রেখে দুই দেশ আলোচনা শুরু  করতে পারে কিনা ভেবে দেখলে ক্ষতি তো কিছু নেই। ভারত তো এক দলীয়  শাসনে চীনের মতো তার মাটিতে প্রতিবাদীদের ট্যাংকের চাকার তলায় পিষে মারতে পারবে না। পাকিস্তানের মতো সামরিক শাসকের হাতে দেশের মানুষের ভাগ্যকে সঁপে দিতেও পারবে না। ভারত গণতান্ত্রিক দেশ। আলোচনার মাধ্যমেই সমস্যার সমাধান করতে হবে। কাশ্মীর আমাদের। কাশ্মীরের মানুষেরা আমাদেরই আপন লোক। তাদের  কোনও ভাবেই সন্ত্রাসবাদীদের শিকার  হতে দিতে পারা যায় না।

৩৭০ ধারা বাতিল করা নিয়ে  আজ যারা প্রতিবাদ মুখর  হয়ে  উঠেছে  তারা একটা সত্যকে অস্বীকার করছে। ৩৭০ ধারার বিলোপ কিন্তু কংগ্রেসের শাসনকালেই ঘটেছে। পণ্ডিত জহরলাল নেহেরুর আমলেই শেখ আব্দুল্লার মন্ত্রীসভাকে বাতিল করে তাকে কারারুদ্ধ করে বক্সী গোলাম মহম্মদকে কাশ্মীরের প্রধানমন্ত্রীর পদে বসানো হয়েছিল। সে সময় (১৯৫৪) ভারতের রাষ্ট্রপতির জম্মু-কাশ্মীরের  জন্য একটি সাংবিধানিক নির্দেশিকায় বলা হয়েছিল, জম্মু-কাশ্মীরে যে কোনও  বিষয়ে  আইন প্রণয়নের  ক্ষমতা  ভারত সরকারকে দেওয়া  হল। সেদিন গোলাম মহম্মদের উদ্যোগে জম্মু-কাশ্মীরের  বিধানসভায় তা অনুমোদিত  হয়েছিল। এভাবেই  তো ৩৭০ ধারা অবসানের  সূত্রপাত  হয়েছিল। ১৯৫৬ সালের ১৭ নভেম্বর জম্মু-কাশ্মীরের যে সংবিধান গৃহীত হয়েছিল, সেখানেই বলা হয়েছিল  জম্মু-কাশ্মীর ভারতের একটি  অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ  হিসেবে  রয়েছে এবং থাকবে। তাহলে আজ ৩৭০  ধারা বাতিল করে জম্মু ও কাশ্মীরকে যে ভারতের অন্য সব রাজ্যের মতোই এক সমমর্যাদার রাজ্যে রূপান্তরিত  করা হয়েছে তার পূর্ণ  কৃতিত্ব  যেমন বিজেপি  নিতে পারে না তেমনি  কংগ্রেসও এর বিরোধিতায় এভাবে  রাস্তায় নামতে পারে না।

তবে কাশ্মীর উপত্যকার সাধারণ মানুষ যাতে উপলব্ধি  করে যে তারা ধর্মীয় পরিচয় ছাড়াও পৃথিবীর  বৃহত্তম  গণতন্ত্রের এক গর্বিত নাগরিক, তা বুঝতে দেওয়ার  দায়িত্ব  কিন্তু  আমাদের  সবার। এখানেই প্রয়োজন খোলা মনে আলোচনা। পাকিস্তানের শাসকেরা এই আলোচনা  চায় না। কারণ, পাকিস্তানের  জন্মই হয়েছে  দ্বিজাতি তত্ত্বের ওপর দাঁড়িয়ে। তাদের  যুক্তি  ছিল, হিন্দু  ও মুসলমান  পৃথক  জাতি, তারা তাই একসঙ্গে  থাকতে পারে না। মুসলিমদের জন্য  চাই পৃথক ইসলামি পাকিস্তান। ভারতের  নেতৃত্ব তো দ্বিজাতি তত্ত্ব  মানতে  চায়নি। কমিউনিস্ট পার্টি অবশ্য স্তালিনের জাতি তত্ত্বকে সমর্থন  জানাতে ১৯৪২  সালের সেপ্টেম্বর  মাসের মাদুরাই প্লেনামে মুসলমানদের পৃথক জাতি  ঘোষণা করে তাদের পৃথক হবার অধিকারকে সমর্থন করে প্রস্তাব  নিয়েছিল। কংগ্রেসের মধ্যে কিছু  উগ্র হিন্দুত্ববাদী নেতারাও অবশ্যই মুসলিম লীগকে পৃথক হবার প্ররোচিত করার দায়ে অভিযুক্ত  হবে।

দ্বিজাতি তত্ত্ব মিথ্যা, এটা  প্রমাণিত হলে পাকিস্তানের জন্মই ভুল, তা স্বীকার করে নিতে হবে। পাকিস্তানের সামরিক শাসন নিয়ন্ত্রিত সরকারের টিকে থাকতে হলে তাকে ভারত বিরোধিতাকে বজায়  রাখতে হবে। এতে  কিন্তু  ভারতের লাভ। কারণ, পাকিস্তান যে একটি  ব্যর্থ রাষ্ট্র  তা প্রমাণিত। ইতিমধ্যেই সে হারিয়েছে পূর্ব পাকিস্তানকে। বালুচিরা বিদ্রোহের পতাকা তুলেছে। আমাদের দরকার  তাই এক সহনশীলতা। পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ আমাদের মিত্র  ও ভাই। পাকিস্তানের  শাসক বিরোধিতা তাই কোনওভাবেই যেন পাকিস্তানী বিরোধীতায় রূপান্তরিত না হয়।

Friday, 11 October 2019

জলাতঙ্ক

নিজেরা সচেতন হই
সঞ্জয় মজুমদার
শিউরে ওঠারই কথা। আমাদের পৃথিবীর দুই-তৃতীয়াংশ শুধু জল। তার মাত্র ২ শতাংশ ব্যবহারযোগ্য, যার আবার ১.৩ শতাংশ হিমবাহ আর পোলার আইস-ক্যাপে মোড়া। অথচ বছরের পর বছর আমাদের দেশ এই দুর্লভ ব্যবহারযোগ্য জলসম্পদের পরিকল্পনাবিহীন যথেচ্ছ ব্যবহার করে আসছে। বিশ্বব্যাপী জল-সূচকের সমীক্ষায় ১২২টি দেশের মধ্যে আমাদের দেশের স্থান ১২০। নীতি আয়োগের কম্পোজিট ওয়াটার ম্যানেজমেন্ট ইন্ডেক্স ২০১৮'র তথ্য বলছে, ২০২০ থেকে ২০৫০ সালের মধ্যে ভারতের প্রায় সমস্ত মাঝারি ও বড় শহরের ভূগর্ভস্থ জলস্তর শূন্যে গিয়ে দাঁড়াবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা হিসেব করে দেখিয়েছে, প্রতিদিন একজন ব্যক্তির ২৫ লিটার জল দৈনন্দিন কাজে প্রয়োজন হয়, শুধু বেঁচে থাকার প্রয়োজনে অর্থাৎ রান্নাবান্না এবং পানীয় হিসেবে। আমাদের দেশের বর্তমানে সামগ্রিক জনসংখ্যাকে ২৫ দিয়ে যদি গুন করি তাহলে যে পরিমাণ ব্যবহারযোগ্য জলের মাথাপিছু প্রতিদিন প্রয়োজন, তার জোগান সরকার সুনিশ্চিত করতে পারছে কি? অথবা, পারবে তো?

পরিকাঠামো এবং নির্মাণ ক্ষেত্রে ব্যবহৃত জলের পরিমাণের কোনও হিসেব নেই। এরপর খেলাধুলো, বিনোদন, পর্যটন এবং আরও কত অজস্র ক্ষেত্র পড়ে রয়েছে যেখানে একজন নাগরিকের খেয়ে বেঁচে থাকার বাইরেও জলের প্রয়োজন। না হলে বাণিজ্যে বসতি লক্ষ্মী হবে না। কোন দিকে যাবে সরকার ঠিক করুক। বিনে পয়সায় খাবার জল দেবে নাকি ব্যবসার প্রয়োজনে জল খরচা করবে। রাষ্ট্রপতি ভবনের মুঘল গার্ডেনস বাঁচিয়ে রাখার জন্য কত লিটার জল লাগে? আমাদের জলশক্তি মন্ত্রক হিসেব করে দেখেছে? আইপিএল প্রসঙ্গ টেনে আনা অত্যন্ত যুক্তিযুক্ত। যদিও সেটা প্রতীকী, কিন্তু ভাবতে হবে, এক টুকরো সবুজ মাঠ প্রয়োজন। কিন্তু স্পন্সর ও কর্পোরেট দুনিয়ার চাপে এত ঘনঘন মুনাফা অর্জনকারী টুর্নামেন্টের প্রয়োজন কতদূর? সাধারণ মানের একটা রেস্তোরাঁয় খেতে গেলেও ওয়েটার জিজ্ঞেস করেন, মিনারেল ওয়াটার নাকি রেগুলার ওয়াটার? একে তো প্লাস্টিকের বোতল, তার মধ্যে মিনারেল ওয়াটার! সুস্থ মস্তিষ্কে যার ব্যাখ্যা মেলে না। 'মিনারেল' এই অক্ষর সমষ্টি দিয়ে দেশের জনগণকে বোঝানো হয়েছে যে একমাত্র এই জল পান করলেই সুস্থ থাকা নিশ্চিত। ঠিক যেমন প্রজন্মের পর প্রজন্ম বোঝানো হয়েছে, গঙ্গাতে একমাত্র বিশুদ্ধ জল পাওয়া যায়; যার ধর্মীয় সংস্করণ 'পবিত্র' এবং তা শিব ঠাকুরের মাথায় ঢাললে দেবাদিদেব সব পাপ ধুয়ে দেবেন। সরকারি প্ররোচনায় শুধু পাপ ধুতেই দেশের জনগণ কতটা জল খরচ করে? মুখ দিয়ে টুঁ শব্দটা করা যাবে না, খুন হয়ে যেতে পারি। সত্যজিৎ রায়ের 'গণশত্রু' ছবির প্রতিটি সংলাপ যেন জীবন্ত।

যে জল না খেতে পেলে আমি মরে যাব, সেই পানীয় জল নিয়েও সূক্ষ্ম শ্রেণিবিভাগ। এই সাজানো প্রহসনের মানে কী? ভারতের নদ-নদী বিশ্বব্যাপী জলসম্পদের মাত্র ৫-৬ শতাংশ বয়ে নিয়ে যায়। আমাদের জানা আছে, নদী শুধু জল বহন করে না, পলিও বহন করে। তার পরিমাণ নেহাৎ কম নয়, প্রায় ৩৫-৪০ শতাংশ। ভারতের কৃষি ব্যবস্থা এখনও বৃষ্টির জল নির্ভর। অনুন্নত এবং অপ্রতুল সেচ ব্যবস্থা সমস্যা আরও বাড়িয়েছে। রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং, ওয়াটার শেড ম্যানেজমেন্ট, ইন্টিগ্রেটেড ওয়াটার রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট এসব সরকারি পরিকল্পনাতেই আটকে আছে; দিনের আলোর যেটুকু মুখ দেখেছে তার বেশির ভাগটাই দালালদের পকেটে গেছে। পবিত্র গঙ্গাকে নিয়ে অপবিত্র অ্যাকশন প্ল্যান বছরের পর বছর আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। পূর্বসুরীদের কথা ছেড়েই দিলাম, বারাণসীর মাননীয় সাংসদ আজ আমাদের সম্মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। নিন্দেমন্দ করছি না, কিন্তু প্রশ্ন তো করতেই পারি। এর সঙ্গে আছে অচেতন নাগরিকদের দায়িত্বজ্ঞানহীন নদীর জলের ব্যবহার এবং শিল্প-বর্জ্য। গোদের উপর বিষফোঁড়া।

ভারতের ৭০ শতাংশের উপর ব্যবহারযোগ্য জল দূষিত হয়ে গেছে এমনি এমনি নয়। একটার পর একটা স্থানীয় জলাভূমি, পুকুর বুজিয়ে বাড়ি উঠেছে। ভোট ব্যাংকের রাজনীতি করতে গিয়ে প্রোমোটার-রাজকে যথেচ্ছভাবে প্রশ্রয় দেওয়া হয়েছে। আমাদের নিজেদের বোধবুদ্ধিও তারিফযোগ্য। নির্দিষ্ট পাত্রে প্রয়োজন মতো জল ধরে যেটুকু দরকার সেটুকুই পরিবারের সদস্যরা ব্যবহার করব, এটুকুও কি আমরা করি? সরকারকে গালমন্দ করার আগে, কর্পোরেট দুনিয়াকে ঢিল মারার আগে নিজের দিকটা ভেবে দেখতে হবে। দিনের শেষে ঘুমের দেশে যাওয়ার আগে সুরাপায়ীরা(নিম্নবিত্ত থেকে উচ্চবিত্ত) কত গ্যালন জল খরচ করে? পণ্ডিতেরা বলছেন, দূরদর্শীরাও বলছেন, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ নাকি জলের জন্যই হবে। এখনই কি যুদ্ধ কিছু কম হচ্ছে? আচ্ছা, একটা পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ পরিচালনা করতে কত জল লাগে?  হিজিবিজবিজ হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছে। হাসি থামছেই না।


Wednesday, 2 October 2019

গান্ধী

স্বরাজ আমার জন্ম অধিকার
অনিন্দ্য ভট্টাচার্য
এই মানুষটি বিচিত্র পরিসরে অবিচল হেঁটেছেন। এমন কোনও বিষয় নেই যার ওপর তিনি তাঁর মতামত জ্ঞাপন করেননি। তাঁকে কেউ ভয়ঙ্কর আপসকামী, ধনীদের অনুগ্রহপ্রার্থী ইত্যাদি ভূষণ আরোপ করেছেন, কেউ বা তাঁকে যুগপুরুষ, মহাত্মা, দুর্বলতম মানুষের পথপ্রদর্শক আখ্যা দিয়েছেন। তিনি সর্বদাই বিতর্কিত, বহু আলোচিত ও দ্বন্দ্ব-কীর্ণ। আজও পৃথিবীর অন্যতম জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে তিনি সমাদৃত।

এ সবই আমরা জানি। তাঁকে নিয়ে খুব বেশি কিছু নতুন করে বলারও নেই। তিনি একেক অস্তিত্বে একেকজনের কাছে এখনও সবাক। তিনি বহুরূপে, বহু অর্থে, নানান ব্যাপ্তিতে মূর্ত। তাঁকে আপন বোধের মাধুরীতে বোঝা যায়, ধরা যায় না। এ হেন বহুগামী, বিস্তৃত চরাচরে ব্যাপ্ত ব্যক্তিত্বের সুতোটি কোথায় বাঁধা তবে? সেও এক রূপকল্পনা।

তাঁর মূল অভিঘাতটি বোধহয় 'স্বরাজ'। আপন রাজ। সে রাজের অধিষ্ঠান কোথায়? নিজের অন্তর্লোকে, গভীর চৈতন্যে। এ তাবৎকালের সমস্ত রাজনৈতিক প্রজ্ঞাকে অস্বীকার করে 'স্বরাজ' ছিল তাঁর নিজস্ব অভিজ্ঞান। শাসক যেই হোক, স্বরাজের বীক্ষা বলে, আমার অধিকারে, পরিসরে হস্তক্ষেপ এলে আমি প্রতিরোধ করব - প্যাসিভ রেজিসটেন্স। যার মূর্ত প্রকাশ: অসহযোগিতা। আর সেই আন্দোলনেই অগ্নিপরীক্ষা। কারণ, অসহযোগিতা তখনই সফল হতে পারে যদি তাতে সামিল হয় জনসাধারণের বিপুল অংশ। মানুষের এই বিশাল সমাগমই গণতন্ত্রের মূর্ত প্রতীক। তাঁর স্বরাজ চিন্তা এই বয়ানের ওপরেই দাঁড়িয়ে।

লবণ আইন অমান্যে সবরমতী আশ্রম থেকে ৩৮৮ কিলোমিটারের পথ ডান্ডির উদ্দেশ্যে যেদিন তিনি হেঁটে রওনা দিলেন, তাঁর সঙ্গে ছিলেন মাত্র ৭৮ জন সত্যাগ্রহী। ভারতের বড়লাট এ খবর শুনে খুব স্বস্তিতে ছিলেন যে গান্ধীর এই 'পাগলামো'তে তিনি অন্তত কিছুদিন শান্তিতে ঘুমতে পারবেন। ২৮ দিন পায়ে হেঁটে তিনি যখন ডান্ডি পৌঁছলেন তখন অন্তত ৩০ লক্ষ মানুষ তাঁর পেছনে সমবেত হয়েছেন। এই সমাগমই রাজনৈতিক বার্তা। স্বরাজ তখন ব্যক্তি স্তর থেকে সামাজিক স্তরে ব্যাপ্ত। বলাই বাহুল্য, বড়লাটের নিশ্চিদ্র নিদ্রার দিবাস্বপ্ন অধরাই থেকে গেল।

তিনিও জানতেন, তিনি যখন থাকবেন না তখন কী থাকবে। তা আজ বিশ্ব প্রত্যক্ষ করছে। একদিকে লোভ, লালসা, তঞ্চকতার দাসত্ব, অন্যদিকে নিঃস্ব হয়ে যাওয়া খেটে-খাওয়া মানুষের দঙ্গল - এই দুই পৃথিবীর মধ্যেই পরিব্যাপ্ত হয়ে আছে স্বরাজ। ইতিহাসকে উলটো করে পেশ করেছিলেন তিনি - যদি তুমি সব থেকে পিছিয়ে পড়া মানুষটি নিজেকে সর্বাগ্রে স্বরাজের আসনে বসাতে পার তাহলে শাসক আর পেরে উঠবে না তোমার সঙ্গে। এইভাবেই অসহায়, পীড়িত মানুষের ভাবনায় ও কর্মে স্বরাজ এলেই বৃহত্তর রাজনৈতিক,  সামাজিক, অর্থনৈতিক প্রাঙ্গণেও স্বরাজ তখন বাধ্যত আসবে।

এই অসম সাহসী চিন্তককে সার্ধশতবর্ষের বিনীত প্রণাম। তিনি দৃশ্যত ইউটোপিয় কিন্তু চিন্তায় সদর্থক।তিনি আপাত ক্ষণিকে দুর্বল কিন্তু  চিরঅবধ্য। তিনি কার্যত বিস্মৃত কিন্তু নিয়ত চলমান ভূখণ্ডের প্রতি পল-অনুপলে।

Monday, 2 September 2019

ভবিষ্যতের কথা


কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বলয়ে
অনিন্দ্য ভট্টাচার্য
(একুশ শতকের রাজনৈতিক অর্থনীতি নিয়ে লেখকের প্রকাশিতব্য গ্রন্থ ‘আশায় বাঁচে চাষা’র অংশবিশেষ। গত ১ সেপ্টেম্বর ২০১৯ বঙ্গীয় জাতীয় শিক্ষা পরিষদের উদ্যোগে 'কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও ভবিষ্যতের অর্থনীতি' শীর্ষক শিশির কুমার পাঠক স্মারক বক্তৃতায় লেখক তাঁর বক্তৃতার অংশ হিসেবে এটি পাঠ করেন।)




এতদিন প্রয়াসটা ছিল, মনুষ্য-শ্রমের সঙ্গে যন্ত্রের অনুপাতকে ক্রমশ যন্ত্রের দিকে ঠেলে, ফলত মনুষ্য-শ্রম কমিয়ে উৎপাদনশীলতাকে বাড়িয়ে চলা। কারণ, আমরা আগের আলোচনায় দেখেছি, এইই হল মুনাফার হারকে পড়তে না দেওয়ার কেরামতি। এই প্রক্রিয়ায় খুব স্বাভাবিক, মনুষ্য শ্রমের অনুপাত কমতে কমতে একেবারে শূন্যের গোড়ায় এসে ঠেকবে তাই অবশ্যম্ভাবী ছিল, মনুষ্য-শ্রমকেই বিলোপ করে দিয়ে যন্ত্রের মাধ্যমেই প্রায় সমস্ত কর্ম সম্পন্ন করা। অন্য ভাবে বললে, মুনাফার হারের উর্ধ্বগতি বজায় রাখার লক্ষ্যে শ্রমের মজুরিকে ছাঁটতে ছাঁটতে প্রায়-শূন্যের কোটায় পৌঁছে দেওয়াটাই ছিল অবধারিত। মজুরি প্রায়-শূন্যে পৌঁছে গেল মানে তো প্রকারান্তরে শ্রমিক বলেই আর কিছু রইল না। তাহলে কাজ করবে কে? উদ্বৃত্ত মূল্যের যোগান দেবে কে? যন্ত্র। কিন্তু যন্ত্র চালাতে তো মানুষ দরকার। না, এই যন্ত্র মনুষ্য-তুল্য। একবার নির্মিত হয়ে গেলে সে মানুষের মতোই কাজ করবে। তার নিজস্ব বুদ্ধিমত্তা ও কর্মক্ষমতা থাকবে। অথচ তার কোনও মজুরি নেই। সে অনন্ত কর্মযোগী। তার কাজেরও কোনও বাঁধাধরা সময় নেই। সে ২৪x৭ কাজ করতে সক্ষম যতক্ষণ না অকেজো হচ্ছে। বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদরা এই মানব-অনুরূপ সত্তার নাম দিলেন ‘আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স’- বাংলায় আমার ভাষান্তর ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা’।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা রাতারাতি এসে হাজির হয়ে পড়েনি আসরে সে একাও আসেনি দীর্ঘ সময় জুড়ে উৎপাদন ব্যবস্থাদিতে যান্ত্রিকীকরণের যে প্রক্রিয়া চলেছে, তারই অবধারিত ফলশ্রুতিতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এসেছে। সে তাই সঙ্গে বহন করে এনেছে আরও কিছু অনুষঙ্গ ও নির্মাণ করেছে নতুন এক ব্যবস্থাপনাতা শুধু প্রযুক্তিগত নয়, রাজনৈতিক-অর্থনীতিগতও।

খেয়াল করে দেখুন শিল্প বিপ্লবের সেই আদি যুগের কথা। হাতে বোনা তাঁতের যন্ত্রকে প্রতিস্থাপন করছে বিদ্যুৎ চালিত স্পিনিং যন্ত্র। যে কাপড় বুনতে তাঁতির মাস ফুরত, সে কাপড় অনেকে মিলে স্পিনিং মিলে তৈরি হচ্ছে অতি দ্রুত ও অধিক পরিমাণে। প্রাথমিক বদলটা ছিল, হাত-চালিত তাঁত থেকে যন্ত্র-চালিত কাপড় বোনায়। অষ্টাদশ, উনবিংশ ও বিংশ শতকের প্রথম অর্ধ জুড়ে ছিল ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্পে প্রযুক্তি-উদ্ভাসনের এই স্বর্ণযুগ। বড় বড় যন্ত্র বসে চলতি উৎপাদনের হারকে শুধু দ্বিগুণ নয়, দশ বা কুড়ি গুণ বাড়িয়ে দিচ্ছে। এইভাবে কাপড়, কাঠচেরাই, জুতো, খাবারদাবার, নির্মাণসামগ্রী, বই, কাগজের মতো সেই সময়ের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যাদি ও সেই সঙ্গে এইসব উৎপাদনের উপকরণের অনুষঙ্গগুলোর উৎপাদনের জন্য শুরু হয়ে গেছে এক মহা কর্মযজ্ঞ। ক্রেতামুখি পণ্য উৎপাদন করলেই শুধু চলে না, সেই উৎপাদনে প্রতিনিয়ত মুনাফার হারকে উর্ধ্বমুখি রাখতে উৎপাদনের উপকরণেও চাই গতি ও অধিক পরিমাণ উৎপাদন ক্ষমতার হার। তাই, শিল্পমুখি পণ্য উৎপাদনে থাকে গবেষণা-প্রসূত এমন যন্ত্র বানাবার তাগিদ যা ক্রেতামুখি পণ্য উৎপাদনকারীদের লভ্যাংশ বাড়াতে সাহায্য করতে পারে। আবার, শুধুমাত্র সেই সময়ের সামান্য চলতি পণ্যগুচ্ছের মধ্যে আটকে থাকলেও চলবে না! কারণ, উৎপাদনের উপকরণে আধুনিকতা ও পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পণ্যগুচ্ছেও আসে বদল; এছাড়াও বিবিধ পণ্যের উৎপাদনের মধ্য দিয়ে বাজারকে আরও প্রসারিত না করতে পারলে গড় মুনাফার হার পড়ে আসে। অতএব, নতুন নতুন উপযোগিতা সৃষ্টি করে পণ্যের বিবিধ রূপের মধ্য দিয়ে তাকে প্রকাশ করে এক ক্রমপ্রসারমান বাজার তৈরির প্রক্রিয়া চলতে থাকে। এক স্থির বলয় বা গুটিকয়েক পণ্য উৎপাদনের মধ্যে আটকে গেলে মুনাফার হারের অধোগতি হয়। নতুন উপযোগিতা কীভাবে তৈরি হয়? ধরুন, আপনি আগে নখ কেটে এসেছেন নরুণ বা ব্লেড দিয়ে, এবার এক নতুন পণ্য এল আপনার হাতে: নেইল-কাটার। এতে নখ কাটার অধিক সুবিধা ও বিপদের ঝুঁকিও কম। এইভাবে পণ্যের বাজার প্রসারিত হয়ে চলে। শুধুমাত্র প্রসাধনী ও অঙ্গসজ্জার জন্য এতসব পণ্য এসে পড়েছে, যার ব্যবহার আজ থেকে ৫০ বছর আগে অকল্পনীয় ছিল।

এগুলো এক ধরনের পরিবর্তন। এই পরিবর্তনে মিশেলগুলি হল: নতুন উপযোগিতার সৃষ্টি, সেই মোতাবেক নতুন পণ্যের উৎপাদন ও সম্ভার, পণ্যের রূপ ও ব্যবহার রীতির পরিবর্তন, পণ্যগুলির উৎপাদনে প্রয়োজনীয় যন্ত্রাদি-উপকরণের প্রযুক্তিগত উন্নতি এবং সর্বোপরি ক্রেতা-সংলগ্ন হওয়ার অভিলাষে বেশি পরিমাণে উৎপাদন ও বিক্রির পরিকল্পনা। আর এর অন্দরে চলতে থাকে, শ্রমের সঙ্গে পুঁজির নিখাদ দ্বন্দ্ব। পুঁজি চায়, মনুষ্য-শ্রমকে প্রতিস্থাপিত করে উৎপাদনের উপকরণের আরও আধুনিকীকরণ, বিশেষত যে কাজগুলি পুনরাবৃত্তিমূলক, তাকে যন্ত্র দিয়ে অধিক গতিসম্পন্ন ও নিখুঁত ভাবে চালাতে। শ্রম ভীত তার কাজ চলে যাওয়ার আশঙ্কায়; কাজ গেলে শ্রমের মালিক শ্রমিক অসহায়, বিপন্ন। আবার নতুন উপযোগিতা সৃষ্টিতে নতুন শ্রমেরও প্রয়োজন দেখা দেয়। কেইনস যেমন বলেছিলেন, প্রযুক্তির নতুন উদ্ভাবনে একদিকে যেমন কর্মসংকোচন হয়, আবার অন্যদিকে নতুন কর্মেরও উদয় হয়। কিন্তু বাস্তবিক, কোন দিকটা ভারী থাকে, মূল প্রশ্নটি সম্ভবত সেখানেই। আজ ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্পের অস্তমিত যুগে বহু পুরনো, একসময়ের জমজমাট কারখানা ও শিল্প বন্ধ হয়ে গেছে। এ নিয়ে আন্দোলনও কম হয়নি ও বন্ধ কল-কারখানা খোলার দাবি আজও নির্বাচনের জ্বলন্ত ইস্যু। কিন্তু বাস্তবে কারখানাগুলি কেন বন্ধ হয়েছে আর এত চেষ্টাতেও খোলে নাই বা কেন, এ নিয়ে সামগ্রিক ভাবে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও প্রাযুক্তিক আলোচনা না করলে আলেয়ার পিছনে ছোটার অবস্থা হবে। তা হচ্ছেও। আগে যেমন বলেছি, শিল্প বিপ্লবের গোড়া থেকেই আজ পর্যন্ত শিল্পের নানা রূপের যে অভিসার, তার পেছনে মোদ্দা কথাটাই হল, প্রতিস্থাপন। অদক্ষ শ্রমিককে দক্ষ শ্রমিক প্রতিস্থাপন করছে, মনুষ্য-শ্রমকে যন্ত্র, পুরনো যন্ত্রকে নতুন যন্ত্র, পুরনো উপযোগিতাকে নতুন উপযোগিতা ও অন্তিমে পুরনো পণ্যকে নতুন পণ্য। যেমন, আজ কেউ বাজারে রেডিও বা গ্রামাফোন রেকর্ড কিনতে যান না, ফাউন্টেন পেন কেনার চল উঠে গেছে, ক্যামেরার রিল কেনারও কোনও অর্থ নেই, বা পোস্টকার্ড, ইনল্যান্ড এসবের কার্যত আর কোনও প্রয়োজনীয়তাই নেই। এইসব পুরনো পণ্যগুলির বিকল্প বেশ জোরালো ভাবে হাজির, আর তা প্রযুক্তির হাত ধরেই।

কিন্তু এতদিন পর্যন্ত যা কিছু হয়েছে তা মানুষের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে যন্ত্রের হাত ধরে যান্ত্রিক ছন্দেই। যন্ত্র উৎপাদনে গতি এনেছে, পুনরাবৃত্তিমুলক কাজগুলিকে সূক্ষ্মতার সঙ্গে নিপুণ ভাবে সমাধা করেছে, পণ্যের রূপে, বর্ণে, আকৃতিতে দৃশ্যগত পূর্ণতা ও নতুন নান্দনিকতা এনেছে এবং ভুলের মাত্রাকে প্রায় নির্মূল করেছে। আর তা করতে গিয়ে যন্ত্র বারবার মনুষ্য-শ্রমকে প্রতিস্থাপন করেছে। ম্যানুফ্যাকচারিং যুগ থেকে পরিষেবা যুগে বিবর্তনে তা স্পষ্ট করে বোঝাও গেছে, আর তারই জেরে পরিষেবা ক্ষেত্র অর্থনীতির মূল প্রাঙ্গণেও চলে এসেছে। কিন্তু এরপর যেন এক ধাপ উল্লম্ফন হল। আমরা ক্রমশ প্রবেশ করলাম কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বলয়ে যেখানে মানুষকে প্রতিস্থাপন করছে শুধুমাত্র কিছু বোবা যন্ত্র নয়, প্রায়-মনুষ্য অনুরূপ এমন কিছু যান্ত্রিক সত্তা যার বুদ্ধি, বিবেচনা ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা আছে। এ সম্পূর্ণত নতুন এক স্তরে উল্লম্ফন।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা হল যন্ত্রের মধ্যে এমন এক ব্যবস্থাপনা যা অবস্থা ও অন্তর্জাত নির্দেশ বিশেষে প্রায়-এক মানুষের মতোই কাজ করতে সক্ষম এবং তা অতি দ্রুত ও নিপুণ ভাবে। শুধু তাই নয়, সে ২৪ ঘন্টাই কাজ করতে পারদর্শী এবং কাজের বোঝা তার কাছে কোনও সমস্যা নয়। কী ধরনের কাজ সে করতে পারবে? বলা যেতেই পারে, জুতো সেলাই থেকে চণ্ডী পাঠ। সে শুধু এক ব্যক্তি মানুষের সহযোগী বা নিপুণ চাকর মাত্র নয়, একটা গোটা শপিং স্টোর চালাতে পারে, ব্যাঙ্কের শাখায় দৈনন্দিন লেনদেনের সমস্ত ভার নিতে পারে, একটা অফিসের যাবতীয় রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করে দিতে পারে। এছাড়াও আরও অগুনতি তার কাজের এলাকা। সে গাড়ি চালাতে সক্ষম, প্রাথমিক চিকিৎসার পরামর্শ দেওয়াও তার এক্তিয়ারে পড়ে, সে একইসঙ্গে দশের অধিক ভাষায় কথা বলতে চোস্ত, আস্ত শহরের দেখভালও সে নিতে জানে। তার কাজের কোনও সীমা-পরিসীমা নেই। তাই ভবিষ্যতে সে আর কী করতে পারে তা নিয়ে মানুষের শঙ্কা ও স্বস্তিরও শেষ নেই। এ হেন বিশ্বকর্মার আগমনে, খুব স্বাভাবিক, রাজনীতি, অর্থনীতির মৌলিক অঙ্কগুলিই যাবে গুলিয়ে। এ তো নিছক যন্ত্র মাত্র নয়, যে নির্দিষ্ট কার্যকালের সময়টুকুর মধ্যেই তার দক্ষতা ও কারিকুরির যাবতীয় প্রদর্শন। এ হল মানুষের মতোই সদা জাগ্রত এক যান্ত্রিক চৈতন্য, যা অবস্থা বিশেষে যখন যেমন তখন তেমন কাজের পালন করতে পারে। কখন কী করবে, সে তার প্রোগ্রামে ঠাসা জটিল অঙ্ক থেকেই সূত্র নিয়ে নিজ সিদ্ধান্তেই যা করার তাই করবে। এমনটা নয় যে বোবা যন্ত্রের মতো তার সুইচ টিপে দিলে যতটুকু যা করার তাই পুনরাবৃত্তিমূলক ভাবে সে করে যাবে। সে কার্যত এক প্রায়-স্বাধীন সত্তা। তবে তার এক অধিকারী আছেন, যিনি তাকে পূর্ণত চেনেন, এবং প্রয়োজন বোধ করলে একমাত্র তিনিই তাকে নিষ্ক্রিয় করে দিতে পারেন। মনুষ্য শ্রমের জগতে যন্ত্ররূপী এই দ্বিতীয় প্রায়-মানুষের পা ফেলা এক অমোঘ পরিবর্তনের বার্তা নিয়ে আসে। আর তা হল, প্রায়-অধিকাংশ মানুষের হাত থেকে এ তাবৎ থাকা কাজগুলি চলে যাওয়ার সম্ভাবনাশুধু কাজ করবেন তাঁরাই যারা এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার গড়নে, চলনে, বলনে প্রাণ প্রদান করেন। বাকী কাজগুলির প্রায় সবই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অধিকারী যান্ত্রিক মানুষগুলির পক্ষে সম্ভব। আমরা এগিয়ে চলেছি এমনই এক বিশ্বব্যবস্থার দিকে যেখানে মানুষের হাতে কাজ আসবে কমে (তবে কাজের নিত্যনতুন পরিধিও বাড়বে, বরং মানুষের কাজগুলি অনেক বেশি ব্যক্তিক হয়ে উঠবে), কাজের সমস্ত ভার গিয়ে পড়বে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ধারক ও বাহকদের হাতে। নিঃসন্দেহে এ এক যুগান্তকারী দিক বদল। অনেকটা স্টিম ইঞ্জিন আবিষ্কারের মতো বিস্ময়কর কিন্তু প্রভাব ও প্রতিপত্তির দিকে থেকে ঐতিহাসিক ভাবে অতুলনীয়।


আমাদের প্রস্তুত হতে হবে, এই প্রায়-মনুষ্যরূপী কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যান্ত্রিক অবয়বগুলিকে স্বাধীন মূল্য সৃষ্টিকারী ‘শ্রমিক’ হিসেবে মেনে নিতে। ম্যানুফ্যাকচারিং হোক কি পরিষেবা, কাজের দক্ষতা হোক কি সিদ্ধান্ত গ্রহণ, উৎপাদিত পণ্যের পরিমাণ হোক কি গুণ- সর্বক্ষেত্রেই এরা মনুষ্য-শ্রমের থেকে অধিক অর্থে যুগপৎ পারদর্শী ও নিপুণ। অথচ এদের কোনও নিত্য মজুরি নেই অতএব মজুরি নিয়ে দরকষাকষিরও প্রশ্ন নেই। হতে পারে, এদের যে প্রথম ক্রয়মূল্য, তাকে কেউ কেউ বলতে পারেন ‘আগাম মজুরি’। কিন্তু সেই মনুষ্যরূপী কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যদি বহু শ্রমিক বা কর্মীকে প্রতিস্থাপন করতে পারে আর তার উৎপাদনশীলতা যদি পূর্বের হারকে যথেষ্ট ভাবে ছাপিয়ে যায় তবে সে ‘আগাম মজুরি’র মূল্যও নেহাতই তুচ্ছ। আর তার সঙ্গে সে যদি কাজের এক বড় ব্যাপ্তিকে ধারণ করতে পারে যেখানে অনেকটা প্রক্রিয়া জুড়ে বহু ধরনের কাজ ও সিদ্ধান্তকে সে সম্পাদন করতে সক্ষম, তাহলে অন্তিম নির্মিত পণ্যটিতে সে অতি পরিমাণে উদ্বৃত্ত মূল্য যোগ করতে পারে। এখানে এসেই তাই মোড়টি ঘুরে যাচ্ছে। শুধু যান্ত্রিক ভাবে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করেই (যা যন্ত্র বসিয়ে হত) এ থেমে যাচ্ছে না, সঙ্গে নিচ্ছে তাৎক্ষণিক বহু সিদ্ধান্ত ও প্রয়োজনে নিয়ন্ত্রণ করছে কর্মপ্রক্রিয়ার গোটা আঙ্গিকটিকেই। এ যেন বাঘের ঘরে ঘোগের বাসা!

Sunday, 25 August 2019

নির্বাচনী সংস্কারের গপ্পো

আশা আশঙ্কার দোলাচল
 সঞ্জয় মজুমদার

পৃথিবীর যে কোনও রাজনৈতিক দল প্রাথমিকভাবে কোনও না কোনও সামাজিক-রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সংকটকে সামনে রেখে আন্দোলন সংগঠিত করে। সংগঠিত আন্দোলনের ঝাঁজ ক্ষমতাসীন সরকারের দ্বারা তথাকথিত নিপীড়িত জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হলে এবং শেষমেশ ভোটের বাজারে প্রয়োজনীয় 'ভোট আদায় বা লুট করতে পারলে' ক্ষমতায় যাওয়া নিশ্চিত হয়। আমাদের দেশও এর ব্যতিক্রম নয়। শয়ে শয়ে বছর ধরে গণতন্ত্রের নামে ঔপনিবেশিক একনায়কত্বকে সহ্য করা ভারতবর্ষ স্বাধীনতার পর থেকেই 'মারি তো গণ্ডার লুটি তো ভান্ডার' নীতিতেই চলছে। নেহেরু-গান্ধী পরিবার, সংঘ পরিবার, দলিত পরিবার, বামপন্থী পরিবার- প্রায় প্রত্যেকেই সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রথম অধ্যায়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোট পেয়েছে, তারপর ভোট আদায় করেছে এবং শেষমেশ লুট করেছে। সমস্যার শুরু দ্বিতীয় এবং তৃতীয় পদ্ধতিতে। ভোট আদায় এবং লুট করতে গেলে নীতি বহির্ভূতভাবে অপর্যাপ্ত অর্থের যোগান একমাত্র শর্ত।

কীভাবে অর্থ আসে?

স্বেচ্ছাকৃত দান, ক্রাউড ফান্ডিং, কুপন আর পার্টি পত্র-পত্রিকা বিক্রি, সদস্য সংগ্রহ, স্থানীয় ব্যবসায়ী এবং ঠিকাদারের কাছ থেকে টাকা নিয়ে অথবা সরাসরি প্রার্থীর হাতে ইন-কাইন্ড সুযোগ-সুবিধা এবং কর্পোরেট অনুদান।

অর্থ খরচ হয় কী করে?

দলীয় সংগঠন বিস্তার করার জন্য পরিকাঠামোগত যা কিছু করা দরকার- নির্বাচনী প্রচার মিছিল, খাবার-দাবার, যাতায়াত-ঘোরাঘুরি ও থাকার জায়গা, দলীয় কর্মীদের মাইনে-পত্তর, মুদ্রণ, ডিজিটাল ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে পাবলিসিটি, নির্বাচন চলাকালীন প্রার্থীদের হাতে নগদ, সোনা, মদের বোতল, এবং অন্যান্য সব বিনামূল্যের জিনিসপত্তর যেমন মোবাইল ফোন, টিভি, রেফ্রিজারেটর, কম্বল, সেলাই মেশিন ইত্যাদি দিয়ে। এছাড়া নির্বাচন কমিশনের হাত থেকে বাঁচার জন্য অনৈতিক খরচের নানা উদ্ভাবনীশক্তিও রাজনৈতিক দলগুলো বের করে ফেলেছে। যেমন, প্রার্থীরা পাবলিক ইউটিলিটি বিলের নাম করে কুপন বিলি করে জনগণের মধ্যে। কুপন নিয়ে আনন্দে আত্মহারা হওয়ার কিছু নেই। যদি ভোট দিয়ে ওই প্রার্থীকে জিতিয়ে আনা যায় তবেই কিন্তু কুপন ভাঙ্গিয়ে টাকা পাওয়া যাবে।

নির্বাচনের আগে টাকার উৎস ও খরচের খতিয়ান থেকে স্পষ্ট, স্থানীয় ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে কর্পোরেট দুনিয়া নির্বাচিত সরকারের কাছ থেকে সুযোগ-সুবিধা আদায় করেই ছাড়বে। এই আদায় করা ভোটের অধিকাংশ সুফল কারা ভোগ করবে সেটাও পরিষ্কার। দুর্নীতির প্রথম বীজ সংসদীয় গণতন্ত্রের গোড়াতেই পোঁতা হয়ে গেল। এরপর আসল গাছের গোড়ায় পরিকাঠামো আর পরিষেবার  নাম করে যতই সার দাও আর জল ঢালো, আগাছার গর্ভেই সে সব চলে যাবে। যাচ্ছে যে, সেটা প্রতিদিনের প্রকাশিত খবরে স্পষ্ট। নীতি নিয়ে আর কেউ বড়াই করে না। দুর্নীতি কতটা কমল বা বাড়ল, এর একটা তুলনামূলক আলোচনা চলতে থাকে।

গোদের উপর বিষফোঁড়া, বিগত দু-বছর ধরে চলতে থাকা মোদি সরকারের 'নির্বাচনী সংস্কার' যা আমাদের দেশে নির্বাচন ঘিরে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডকে আরও বেশি অসুস্থ ও অস্বচ্ছ করে তুলেছে।

কী আছে এতে?

প্রথমত, কর্পোরেট অনুদান। আগে ছিল বিগত তিনটি আর্থিক বছরের অর্জিত লভ্যাংশের (নেট প্রফিট্) ৭.৫ শতাংশ যে কোনও দেশিয় কোম্পানি নির্বাচনী খাতে স্বীকৃত রাজনৈতিক দলকে দিতে পারত। ২০১৭'র ফিনান্স অ্যাক্ট'এ এই ক্যাপটা তুলে দেওয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, কোম্পানির এ ক্ষেত্রে কোনও দায় থাকছে না এই ধরনের অনুদানকে প্রফিট্ অন্ড লস্ একাউন্ট'এ দেখানো। এমনকি কোম্পানির বোর্ড অফ ডিরেক্টরস্'এরও অনুমতির কোনও প্রয়োজন নেই। অতএব ভুতুড়ে কোম্পানি খুলে কালো টাকা খাওয়ানোর এক অভিনব পন্থা।

দ্বিতীয়ত, নাম-গোত্রহীন নগদ দান। যা ২০,০০০ থেকে নামিয়ে ২০০০  টাকায় আনা হয়েছে এবং এর জন্য কোনও রেকর্ড রাখার প্রয়োজন নেই। সিলিং ভ্যালুও হাপিস্। অতএব যত খুশি ২০০০'এর সমষ্টি করা যেতেই পারে। অদ্ভুত অর্থহীন এক পরিস্থিতি। নোটবন্দির ঘোষণা ভারতীয় রাজনীতিকে নেতা-ব্যবসায়ীর গোপন আঁতাত থেকে মুক্ত করতে পেরেছে এমন দাবি ক্ষমতাসীন সরকারও জোর গলায় করতে পারছে না। উত্তরপ্রদেশ বিধানসভা নির্বাচনেই তার প্রমাণ মিলেছিল। ২০১৬-১৭ অর্থবর্ষে আমাদের দেশের ছয়টি জাতীয় স্তরের রাজনৈতিক দলের সংগৃহীত আর্থিক অনুদানের ৪৬ শতাংশ এসেছে নাম-গোত্রহীন উৎস থেকে।

তৃতীয়ত, বিদেশি ফান্ডিং। এখনকার নিয়ম অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন স্বীকৃত রাজনৈতিক দলগুলো বিদেশি কোম্পানির কাছ থেকে নির্বাচনী খাতে অনুদান পেতেই পারে। বেশ ভয়ের ব্যাপার। ভারতের নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে বিদেশি শক্তি অনুদানের নামে যথেষ্ট প্রভাবিত করতে পারে। এবারের ফিনান্স বিলে গুরুত্বপূর্ণ একটি সংযুক্তিকরণ করা হয়েছে। তাতে বলা আছে, যত 'ফরেন ফান্ড' নির্বাচন কমিশন স্বীকৃত রাজনৈতিক দলগুলো ১৯৭৬ সাল থেকে নির্বাচনী খাতে পেয়ে এসেছে, সে সবের কোনওরকম তদন্ত করা যাবে না। বিজেপি এবং কংগ্রেস দুটি জাতীয় স্তরের রাজনৈতিক দল সহ অন্যদেরও মুখের হাসি এবং বুকের ছাতি দুটোই চওড়া হয়েছে। Foreign Contribution Regulation Act (FCRA), 1976'এর সূত্র ধরে নির্বাচন কমিশন নিজেই হৈচৈ শুরু করে দিয়েছে। লাভ হয়নি কিছুই।

চতুর্থত, ইলেক্টোরাল বন্ড। উদারবাদের পরবর্তী যুগে জমি পাওয়াকে কেন্দ্র করে রিয়েল এস্টেট আর ম্যানুফ্যাকচারিং- এই দুটো ক্ষেত্র থেকেই নির্বাচনী খাতে রাজনৈতিক দলগুলোর ভাঁড়ারে সবচেয়ে বেশি টাকা আসছে। নির্বাচনের সময় টাকার বিনিময়ে জমি লেনদেনের ঢালাও অনুমতি রাজনৈতিক নেতারা বিল্ডারদের দিচ্ছেন। ভোটে জিতে এলে সুদে-আসলে ফেরত দেওয়ার পালা। ২০১২ থেকে ২০১৬'র মধ্যে আমাদের দেশের সমস্ত স্বীকৃত রাজনৈতিক দলের সর্বমোট ঘোষিত অর্থ ভাণ্ডারের ৯০ শতাংশ ছিল কর্পোরেট অনুদান। এর উপর ইলেক্টোরাল বন্ডের ধারণাটা নির্বাচনকে ঘিরে দুর্নীতি সংক্রান্ত সব উদ্বেগকে ছাপিয়ে গেছে। একজন ব্যক্তি, কিছু ব্যক্তিকে নিয়ে সমষ্টি অথবা কর্পোরেট স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার কিছু নির্দিষ্ট শাখা থেকে প্রতি মাসের প্রথম দশ দিনে ইলেক্টোরাল বন্ড কিনতে পারে। ১০০০, ১০০০০, ১০০০০০, ১০০০০০০ এবং এক কোটির গুণিতকে এই ইলেক্টোরাল বন্ডের মেয়াদ ১৫ দিন। টাকা দিয়ে কিন্তু কেনার অনুমতি নেই এবং ক্রেতাকে KYC ব্যাংকে জমা দিতেই হবে। নির্দিষ্ট SBI অ্যাকাউন্ট থেকে এরপর রাজনৈতিক দল এই বন্ড এনক্যাশ করে নেয়। আপাতদৃষ্টিতে বিষয়টার মধ্যে কোনও গণ্ডগোল নজরে পড়ে না। একদিকে দাতার নাম প্রকাশ করার কোনও প্রয়োজন নেই কোন রাজনৈতিক দলকে তিনি ইলেক্টোরাল বন্ডের মাধ্যমে টাকা দান করছেন এবং অন্যদিকে, রাজনৈতিক দলেরও কোনও বাধ্যবাধকতা থাকছে না কার কাছ থেকে এই পদ্ধতিতে টাকা পাচ্ছেন তা প্রকাশ করার। কিন্তু ডিজিটাল ট্রেইলের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল ঠিক টের পেয়ে যাবে কে কত টাকা দিচ্ছেন। অর্থাৎ, বিরোধী কোনও রাজনৈতিক দলকে আমি ইলেক্টোরাল বন্ডের মাধ্যমে নির্বাচনের সময় সাহায্য করতে চাইলেও পারব না। এই ধরনের code of secrecy নিশ্চিত করে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলেরই একমাত্র ইলেক্টোরাল বন্ড সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য জানার অধিকার থাকবে। কেউ চায় না ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলকে চটাতে। ব্যবসার ক্ষেত্রে সেটা আত্মহত্যা ছাড়া আর কিছু নয়। অতএব প্রথম থেকেই গণতন্ত্রের মৃত্যু অনিবার্য। আর, আদর্শ আর নীতি? অট্টহাসি।

ইলেক্টোরাল ট্রাস্টের মাধ্যমে কর্পোরেট দান রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য আদায় করা ২০১৩ সালে তৎকালীন ইউপিএ সরকার চালু করেছিল। ট্রাস্টগুলোর ক্ষমতা ভালোই ছিল। বিভিন্ন দেশিয় কোম্পানির কাছ থেকে আর্থিক অনুদান নেওয়া এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে সংগৃহীত অর্থ বিতরণ করার দায়িত্ব এদেরই ছিল। তথ্য বলছে, ২০১৭-১৮'এ এইরকম ২২টি নথিভূক্ত ইলেক্টোরাল ট্রাস্টের মোট সংগৃহীত অর্থের ৮৬ শতাংশই ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের পকেটে গেছে। ২০১৬-১৭'এ দেখা গেল, বিজেপি পার্টি তহবিলে নির্বাচনী খাতে সংগৃহীত সর্বমোট আর্থিক অনুদানের পরিমাণ ওই একই সময় জাতীয় স্তরের অন্যান্য পাঁচটি প্রধান রাজনৈতিক দলের সর্বমোট সংগৃহীত অনুদানের থেকে নয় গুণ বেশি। এই তথ্যগুলো খুব স্বাভাবিকভাবেই প্রমাণ করে, কেন গেরুয়া শিবির নির্বাচনী খাতে আর্থিক অনুদান গ্রহণের সীমারেখা নির্ধারণে ভারতের নির্বাচন কমিশনের যাবতীয় প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে। করবে নাই বা কেন? ২০১৯'এর লোকসভা নির্বাচনে ৬০ থেকে ৬৫ হাজার কোটি টাকা নির্বাচনী খাতে খরচা হয়েছে, ২০১৪এ যা ছিল ৩৫ হাজার কোটি টাকা। নির্বাচনের সময় প্রার্থী পিছু নির্বাচন কমিশন যে পরিমাণ বৈধ অর্থ বরাদ্দ করে থাকে, বাস্তব বলছে তাতে কিছুই হয় না। শুধু একজন প্রার্থীর নিজের নির্বাচনী কেন্দ্রে খরচের হিসেব, গোয়েন্দাগিরি করে দেখা যাচ্ছে, আজকের বাজারে প্রায় ১০ কোটি টাকার মতো। অতএব, রীতিমতো বিত্তবান এবং লোকলস্কর সহ বলবান না হলে ভারতের নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করা দিবাস্বপ্নের মতোই শোনায়। সাধারণ সংসারী সৎ এবং খেটে খাওয়া প্রার্থীর পক্ষে আমাদের দেশে রাজনীতি করা এবং ভোটে জিতে আসা সোজাসাপ্টা ভাষায় অসম্ভব। স্বচ্ছতা বা অস্বচ্ছতার প্রশ্নগুলো পাশে সরিয়ে রাখলে, অন্যান্য স্বীকৃত রাজনৈতিক দলগুলোও এই ইস্যুতে একই অবস্থানে যে আছে তা মৌনং সম্মতির মাধ্যমে বুঝিয়ে দিয়েছ। নির্বাচনী বিধি লাগু হওয়ার আগে থেকেই পয়সা রোজগারের এই অভূতপূর্ব সুযোগ প্রায় সোনার কাঠি ছোঁয়ার মতো।

আশার আলো একেবারেই যে নেই তাও ঠিক নয়। নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে কলুষমুক্ত করতে 'স্টেট ফান্ডিং' একটা সমাধান হতে পারে। ইউরোপ আমেরিকা আফ্রিকা এবং এশিয়ার অন্যান্য দেশের নির্বাচনে এটা পরীক্ষিত সত্য। আমাদের প্রধানমন্ত্রী বারেবারেই এই প্রস্তাব বিভিন্ন মহলে রাখছেন। কিছু বিধিনিষেধ এবং পূর্ব শর্ত মেনে নিলে, নির্বাচন কমিশন থেকে শুরু করে বিভিন্ন সরকারি কমিটি এবং কমিশন এই প্রস্তাবে সাড়াও দিয়েছে, যার মধ্যে অন্যতম দুটি হল, প্রত্যেক রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরীণ গণতান্ত্রিক পরিকাঠামো যথাযথ রক্ষা করা এবং আর্থিক লেনদেনের ক্ষেত্রে পূর্ণ স্বচ্ছতা বজায় রাখা। ২০১৭'র জনগণনা অনুযায়ী, প্রায় ১৩৪ কোটির দেশ আমাদের ভারত। ২০১৯'এর লোকসভা নির্বাচনে ৯০ কোটি ভোটারের ১০ কোটিই ছিলেন ১৮ থেকে ১৯ বছর বয়সী, দেশ গড়ার মূল কারিগর হিসেবে যারা কিনা ভবিষ্যতে চিহ্নিত হবেন। ডিজিটাল প্রযুক্তির যুগে এঁরা সবাই আগের প্রজন্মের তুলনায় অনেক বেশি সচেতন এবং তথ্যও রাখেন অনেক বেশি। সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে সমস্ত রকম নির্বাচনী দুর্নীতির খবর এঁদের কাছে খুব সহজেই পৌঁছে যাচ্ছে বিচার-বিশ্লেষণ সহ। কাউকে বোকা ভাবার কোনও কারণ নেই। ভারতের নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে বর্তমান প্রজন্মের কাছে গণতন্ত্রের উৎসব বলব, নাকি হিসাববিহীন অর্থ রোজগারের উৎসব হিসেবে চিহ্নিত করব, জানা নেই।