The most popular blog of our bi-monthly magazine (একক মাত্রা) in Bangla on contemporary socio-economic and cultural issues.. মগজে দিন শান/ নয়তো মিলিয়ে যান...
Also visit our online version: https://www.ekakmatra.in
আজ (৩০ অগস্ট ২০১৭) রিজার্ভ ব্যাঙ্কের প্রকাশিত একটি
রিপোর্ট থেকে জানা গেল যে, বিমুদ্রাকরণের ফলে কালো টাকা উদ্ধারের যে ঘোষণা মোদি
সরকার দিয়েছিল তা গুড়ে বালি! রিপোর্টে প্রকাশ, বাতিল হওয়া ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোটের প্রায়
৯৯ শতাংশ টাকাই রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ঘরে ফেরত এসেছে। তাহলে ‘কালো টাকা’গুলি সব গেল
কোথায়? হিসাব মোতাবেক, ১৫ হাজার কোটি টাকা ফেরত আসেনি। ধরে নেওয়া যাক, এইগুলি সব কালো টাকা। এদিকে নোট ছাপানোর খরচ পড়েছে ২১
হাজার কোটি টাকা। তাহলে দাঁড়াল এই, ১৫ হাজার কোটি টাকার কালো টাকা উদ্ধার করতে নেট লোকসান ৬ হাজার কোটি টাকা। অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি শাক দিয়ে
মাছ ঢাকার মতো করে সাংবাদিকদের আজ জানিয়েছেন, আসলে সরকারের উদ্দেশ্য ছিল নগদ
লেনদেন কমিয়ে ডিজিটাল লেনদেন বাড়ানো। ‘কালো টাকা’ উদ্ধারের বাহানায় এটাই যে আসল
উদ্দেশ্য, তা ‘একক মাত্রা’র মার্চ সংখ্যায় ‘অর্থনীতির সাতপাঁচ’ কলামে স্পষ্টতই
লিখেছিলাম। আর কেন, তাও পরিষ্কার ভাবে বলেছিলাম। তাহলে মশা মারতে কামান দাগা কেন?
সে কথাও এই ব্লগেই বিমুদ্রাকরণ অভিযান শুরুর দ্বিতীয় রাতেই লিখেছিলাম। ভেবে ভাল
লাগছে যে সেই আশঙ্কা ও অনুমানগুলি মিথ্যা হয়নি।
এই ব্লগেই ‘কালো টাকার রহস্য’ শীর্ষক প্রতিবেদনে ও তারও আগে
আরেকটি লেখায় পরিষ্কার জানিয়েছিলাম, অর্থনীতিতে ‘কালো টাকা’ বলে কিছু হয় না। আসলে ‘কালো
টাকা’ বলতে যে টাকাগুলির দিকে ইঙ্গিত করা হয় তা হল, বেআইনি পথে টাকা আদায়, যার
কোনও হিসাব আইনি ভাবে এই টাকার মজুতদারেরা রাখে না, সরকারের কাছেও থাকে না। কীভাবে
এই বেআইনি টাকা আদায় করা হয়? মূলত, ঘুষ মারফত, তোলাবাজি, ডাকাতি ও স্মাগলিং করে,
কমিশন খেয়ে, বেআইনি ব্যবসা ও লেনদেন চালিয়ে, ধর্মীয় বাবা ও রাজনৈতিক নেতাদের কাছে
বেআইনি পথে আদায় করা টাকা গচ্ছিত রেখে ইত্যাদি ইত্যাদি। অর্থাৎ, টাকা টাকাই থাকে,
কিন্তু বেআইনি পথে সমান্তরাল অর্থনীতি তৈরি করে সে টাকা বহাল তবিয়তে ঘোরে এবং পেশি
ও রাজনৈতিক ক্ষমতার জোরে তা মুষ্টিমেয় এক শ্রেণির মানুষের হাতে কেন্দ্রীভূত হয়। এই
বেআইনি পথে টাকা লুঠ রুখতে সরকারের নানান নজরদারি ও আইনি সংস্থা আছে – যেমন, ইডি,
সেবি, সিবিআই ইত্যাদি ইত্যাদি। সবাই জানেন, এদের রাজনৈতিক ভাবে অকেজো করে রেখেই
সমান্তরাল অর্থনীতির ধারা প্রবহমান।
তাহলে, বিমুদ্রাকরণ করে তথাকথিত কালো টাকা উদ্ধারের ফন্দিটা
কোন ভূতের মাথা থেকে গজালো? সে কথাগুলোও আমার আগের লেখাটায় গুছিয়ে বলা আছে। আবারও
অল্প করে বলি, বিমুদ্রাকরণের সঙ্গে কালো টাকা উদ্ধারের কোনও সম্পর্কই ছিল না।
কারণ, কালো টাকা বলে কিছু নেই; বেআইনি পথে বিপুল টাকা মুষ্টিমেয় ও তার বশংবদদের
হাতে কেন্দ্রীভূত করার পথ ও উপায়গুলিকে যদি রুদ্ধ করা যায় তবেই তথাকথিত ‘কালো টাকা’
আর তৈরি হতে পারে না। কিন্তু, এতদিনকার সঞ্চিত যে ‘কালো টাকা’গুলি, সেগুলির কী
হবে? মোদি সাহেব তো সেগুলোকেই উদ্ধার করতে গিয়েছিলেন নাকি! ‘কোথায় বা কী ভূতের
ফাঁকি মিলিয়ে গেল চট করে’। আসলে, ছিল রুমাল হয়ে গেল বেড়াল, এ তো হামেশাই হচ্ছে!!
সব টাকাই তো দেখা গেল সাদা! মাদারি-কা-খেলটা কী? তা হল, সঞ্চিত কালো টাকাগুলিকে
নানান খাতে নানান উপায়ে বিমুদ্রাকরণের নীতি ঘোষণার বহু আগে থেকেই, আইনি মোড়কে বিশ্বব্যাপী
সাজিয়ে ফেল। যারা আগাম খবর পেলেন না, তাদের একটু ল্যাজেগোবরে অবস্থা হল বটে,
কিন্তু কুছ পরোয়া নেই। কারণ, ‘কালে কো সফেদ ঔউর সফেদ কো কালে’ করতে নগদ টাকা এদিক
ওদিক পাচার করার কোনও দরকার পড়ে না। ভুবনায়িত পুঁজির জোরে তা কাগজপত্র বানিয়ে,
ডিজিটাল লেনদেনেই করে ফেলা সম্ভব। কোনও লেনদেন ব্যাকডেটে করতে হলে সফটওয়ার
নির্মাতা ও দেখভাল করা সংস্থারা ব্যাক-এন্ড থেকে অনায়াসে তা করে দেয়। এরজন্য আলাদা
রফা করা থাকে। মোদ্দা ব্যাপারটাই হল, মেলাবেন তিনি মেলাবেন। তাই, সঞ্চিত নগদ
টাকাগুলি বস্তায় বেঁধে ফেলে দিলে বা পুড়িয়ে ফেললেও কিছু যায় আসে না। যেটা ঘটল, 'কালো টাকা'গুলি 'সাদা' হয়েই ব্যাঙ্কে জমা পড়ল।
তাহলে মোদি সাহেব বিমুদ্রাকরণের পথে গেলেন কেন? এত হাঙ্গামার কী দরকার ছিল? পুরনো
কথাগুলো আবার বলব, নাকি আমার আগের লেখাগুলি এই ব্লগেই আরেকবার পড়ে নেবেন? খুব ছোট
করে আরেকবার যদি বলি, তাহলে - এক, উত্তরপ্রদেশের নির্বাচনে বিরোধীদের তাৎক্ষণিক
বোকা বানিয়ে সাময়িক ‘ক্যাশ অ্যাডভান্টেজ’এ থাকা; দুই, অর্থনীতির প্রায় ৯০ শতাংশ
জুড়ে ছড়িয়ে থাকা অসংগঠিত ক্ষেত্র ও ছোট শিল্পগুলিকে শায়েস্তা করতে ডিজিটাল
লেনদেনকে বাধ্যত চালু করা, যাতে কর্পোরেটরা ব্যবসাপত্রে দেশের সিংহভাগে চড়ে বেড়াতে
পারে।
উত্তরপ্রদেশের নির্বাচনে উনি সাফল্য পেয়েছেন (তার অবশ্য আরও
নানা কারণ আছে আর এই ব্যাপক সাফল্য উনি আশাও করেননি) কিন্তু ভারতীয় অর্থনীতিকে সম্পূর্ণত
কর্পোরেটের লেজুড় বানাতে এই সস্তা চালে হবে না, ওনাকে গৃহযুদ্ধের পথে এগোতে হবে।
তবে কথায় বলে, অতি চালাকের গলায় দড়ি!
Somebody may say it was so near, yet so far. But the comment just illustrates a criminally bare story. Indian women's performance in the world cup last month was
breathtakingly brilliant. They missed the world cup by a whisker in
the final against a dynamic, contemporary and an extremely well-equipped
England.
Captain Mithali Raj bats like a magnificent painter. Surely,
Mithali Raj's sheer strength of will power was palpable throughout
this global competition. Veda Krishnamurthy uses her willow as if she is
a jazz pianist... playing each and every shot with creative yet surgical
precision. Then came the wild, uninhibited poet who writes free verse
for Team India, Harmanpreet Kaur. Kaur's era defining, magnum opus 171
not out off 115 balls against the mighty Australians in the semi-final
has redefined the women's approach towards the game. Such was the
powerful innings by Harmanpreet Kaur that it has lifted not only Indian
women's performance in the world cup but also catapults this global
silverware to unimaginable dizzy heights. Even you may say that at times
she batted like a poet, at times she responded with the strongest gun
powder. Just rethink about her monstrously hit sixes against a high
quality bowling lineup. And there is the quintessential Bengali Express
from Chakdah, Jhulan Goswami. Jhulan bowled with passion as well as fire
throughout the world cup. Her rousing bowling effort in the final
against England virtually turned the game on its head. Jhulan has
given us the impression that she is an ageless bowler. In another words,
Jhulan is a Titan/ dignified rock star in Indian cricket. And there is
one Deepti Sharma. While bowling as well as fielding, she has put
everything on display - grit, passion, hunger, anticipation and above
all, the unqualified statement of enormous self -belief. To me, along
with Veda Krishnamurthy and Harmanpreet Kaur, Deepti Sharma will serve
Indian cricket for a long, long time.
It is already noted that
mainstream media does not give the necessary coverage to women's game
on a regular basis. But in a cricketing world dominated by the
billionaires like Virat Kohli, MS Dhoni, Shikhar Dhawan - to name a few,
these women cricketers had to go through enormous difficulties and then
only they have got a chance to represent for the national side. The
list of difficulties is quite a long one- lack of infrastructure, lack
of money/sponsorship, dyspeptic attitude of mainstream media towards
women's cricket et al. India is such a country where parents expect their
daughters to be competent engineers, doctors, school /college teachers
or even business managers. But cricketers? Where there is hardly any
financial security! The answer is obvious. We all have to admit that
these women have achieved something unique. I would like to say, they
have fought in this world cup like the indomitable Laxmi Bai of Jhansi.
They deserve rich praise.
The eventual champions England, the six time world cup winners
Australia are already blessed with proper infrastructure. If Indian
women get proper guidance from the competent authorities, I have no
doubt in my mind that for these women, sky is the limit.
তালাক-ই-বিদ্দাতকে শীর্ষ আদালত অসাংবিধানিক ও বেআইনি ঘোষণা করেছে। চোখের পলকে তিন তালাক উচ্চারণ করে যে কোনও বিবাহিত মুসলমান মহিলাকে ঘরছাড়া করার প্রায় ১৪০০ বছরের রীতি এই রায়ে নিকেশ হল। সারা দেশ জুড়ে এই প্রথার বিরুদ্ধে যেভাবে মুসলমান মহিলারা গর্জে উঠেছেন ও সুপ্রিম কোর্টে যারা মামলা চালিয়েছেন শত হুমকি, ধমকানি ও চোখ রাঙানি এড়িয়ে, তা দেশবাসী মনে রাখবে। গত শতকের ৮০'র দশকে শাহবানু কিছুটা এমন ধরনেরই এক মামলা চালিয়ে শীর্ষ আদালতে জিতলেও, তৎকালীন কংগ্রেস সরকারের নির্মম সংখ্যাগরিষ্ঠতা ও 'ধর্ম নিরপেক্ষতার' জোরে সংসদে নতুন আইন পাশ করে রাষ্ট্র অসহায় এক নারীর বিরুদ্ধে তার দোর্দণ্ড প্রতাপ দেখায়। তারপরেই বাবরি মসজিদের তালা খোলা আর কার হাত ধরে ধর্মীয় বিভাজনের কোন উদ্দেশ্যে দেশকে ঠেলে দেওয়া হয়, তাও আবার এক তথাকথিত ধর্ম নিরপেক্ষ পার্টির তরফে, তা আজ অবশ্য অনেকের কাছেই পরিষ্কার। ধর্ম নিয়ে কংগ্রেসের ছলচাতুরীও আজ ধরা পড়ে গেছে এবং এখন তাদের অবস্থা হয়েছে ধ্বংসস্তূপের মতো। ধর্ম নিরপেক্ষতার অর্থ যে সব ধর্মকে তা দেওয়া নয়, বরং ধর্ম থেকে রাষ্ট্রকে দূরে রাখা - এই প্রতিপাদ্যটিকেই কৌশল করে এতদিন আড়াল করা ছিল। যারা ধর্মীয় রাজনীতি করে তারা তো ধর্মের নামেই তাদের এজেন্ডা ঠিক করবে, তারা চিহ্নিত, কিন্তু যারা তথাকথিত ধর্ম নিরপেক্ষ বলে নিজেদের প্রতিপন্ন করে তাদের ধর্মীয় রাজনীতিটা আরও গোলমেলে।
দেশের স্বাধীনতার পর পরই প্রস্তাব উঠেছিল ইউনিফর্ম সিভিল কোড বা অভিন্ন দেওয়ানি নীতি চালু কর। প্রধানমন্ত্রী নেহেরু বলেছিলেন, এখনও উপযুক্ত সময় আসেনি। অর্থাৎ, তিনি এই ধরনের নীতির বিরোধী ছিলেন না, দাঙ্গাদীর্ণ দেশের সংখ্যালঘু মুসলমানদের আস্থা ফেরাতে তিনি তাদের ধর্মীয় আইনগুলিতে তখুনি হস্তক্ষেপ করতে চাননি, আরও কিছুটা সময় চেয়েছিলেন। তা মানা যায়। কিন্তু ৭০ বছর পরেও অভিন্ন দেওয়ানি বিধি লাগু করার ব্যাপারে যদি কারও আপত্তি থাকে তাহলে বুঝতে হবে ধর্ম নিরপেক্ষতা নয়, কোনও নির্দিষ্ট ধর্মকে তা' দেওয়া হচ্ছে। ধর্ম থাকবে ব্যক্তিগত বিশ্বাস ও অনুশীলনের জায়গায়। তার সঙ্গে দেওয়ানি অভিন্ন বিধি থাকলে সমস্যা কোথায়? ফৌজদারি বিধির ক্ষেত্রে তো আছে! কোনও ধর্মই একমাত্রিক বা একবগগা নয় যে তার মধ্যে কোনও মতান্তর বা ভিন্ন ধারার স্থান নেই। কীভাবে ধরে নেওয়া হচ্ছে যে অভিন্ন বিধির ব্যাপারে কোনও ধর্মীয় গোষ্ঠীর মধ্যে একমত একসুর বাজে? যেমন, ভোপালের প্রাচীন শরিয়তি আদালত দার-উল-কাজা দীর্ঘদিন ধরেই তালাক-ই-বিদ্দাতকে মান্যতা দেয়নি। পরন্তু, তারা 'খুলা' প্রথা বজায় রেখেছে যেখানে মহিলারা ডিভোর্স চাইতে পারেন। পাকিস্তান ও বাংলাদেশেও তালাক-ই-বিদ্দাতকে মানা হয় না। এমত বহু ধারা ও প্রথা একেক জায়গায় একেকরকম ভাবে বহমান অথচ স্বঘোষিত ধর্ম নিরপেক্ষবাদীরা একটি একমাত্রিক, হোমোজেনাস ধর্মীয় গোষ্ঠীর কল্পনা করে নিয়ে কিছু ধর্মীয় মাতব্বরদের সঙ্গে রাজনৈতিক আঁতাত গড়ে পরিস্থিতিকে বিষাক্ত করেছেন। এই কাজ উগ্র ধর্মীয় কারবারীদের আরও মদত যুগিয়েছে।
আম্বেদকার গণ পরিষদে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি গ্রহণ করার জন্য মত দিয়েছিলেন। তা যখন গ্রহণ হল না তখন তিনি সংবিধানের ৪৪ ধারায় নির্দেশক নীতিতে অভিন্ন দেওয়ানি নীতি গ্রহণ করার প্রস্তাবকে সঙ্কল্প হিসেবে রাখলেন। কোনও ধর্মীয় বা জাতি গোষ্ঠীকেই ভেড়ার পাল হিসেবে ভাবার কারণ নেই যে তাদের মাতব্বররা যা বলবে সেটাই তারা অন্ধের মতো অনুসরণ করবে। এই ভাবনা তথাকথিত আধুনিকতার জনকদের, যারা 'অপর'কে এইরকম ভেড়ার পাল হিসেবে দেখে বলেই, তাদের মাতব্বরদের সঙ্গে আঁতাত করে রাজনীতির ফায়দা লোটে। আশ্চর্য লাগছে, যখন মুসলিম সম্প্রদায়ের এক ব্যাপক সংখ্যক মানুষ, বিশেষত মহিলারা, দু হাত তুলে শীর্ষ আদালতের এই রায়কে স্বাগত জানাচ্ছেন তখন এ রাজ্যের শাসক দল এক অদ্ভুত নীরবতা অবলম্বন করে সন্দেহজনক অবস্থান নিয়েছে। উপরন্তু, তাদেরই এক মন্ত্রী সিদ্দিকুল্লা চৌধুরী তিন তালাকের পক্ষে মত দিয়ে ও শীর্ষ আদালতের রায়কে সমালোচনা করে নেতিবাচক ভূমিকা রেখেছেন। এইসব বার্তা ধর্মীয় বাতাবরণকে আরও বিষাক্ত করে তুলছে। কারা আসলে প্রকারান্তরে বিজেপি'র অবস্থানকে শক্তিশালী করছেন একটু ভাবতে পারেন। খেয়াল রাখা উচিত, উওরপ্রদেশের নির্বাচনে এই তিন তালাকের প্রশ্নটিকে ধরেই বিজেপি কিন্তু বহু মুসলমান মহিলাদের ভোট অর্জন করেছেন। তাই ভাবার কোনও কারণ নেই যে কিছু ধর্মীয় মুসলমান নেতা কী বললেন সেটাই সমগ্র মুসলমান সমাজের বক্তব্য।এমনটা হিন্দু সমাজের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তাই সর্বতোভাবে, ধর্মকে রাজনৈতিক অনুশীলন থেকে দূরে না রাখলে রাজনৈতিক দলগুলির বিপদ আরও বাড়বে। সে যে দলই হোক না কেন! আজ যার সুদিন তার দুর্দিন আসতে ক'দিন? অন্ততপক্ষে ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে এই দৃষ্টান্ত যেখানে যথেষ্ট!
গত ৯ জুলাই রবিবার
কয়েকজন দুষ্কৃতী আগ্নেয়াস্ত্র দেখিয়ে দুই নাবালিকা, এক যুবতী, এক শিক্ষিকা সহ চার আদিবাসী মহিলাকে গণধর্ষণ করে রায়গঞ্জ পৌর বাসস্ট্যান্ডের
বিশ্রামাগারে এবং পাশের এক হোটেলে।এই নারকীয়
ঘটনার প্রতিবাদে উত্তর দিনাজপুর ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের আদিবাসীরা ১৪
জুলাই সশস্ত্র বিক্ষোভ মিছিল করে।তাতে রণক্ষেত্র
হয়ে ওঠে রায়গঞ্জ শহর।আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি হয় শহর জুড়ে।যদিও সে আতঙ্ক প্রধানত ছিল দুষ্কৃতিদের মধ্যে।আদিবাসীদের
অবদমিত ক্ষোভের মিছিলে কিছু কিছু ভাংচুরের ঘটনা ঘটলেও, যাতে ছোট ব্যবসায়ীরাই মূলত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, প্রায়
ব্যতিক্রমহীনভাবে আপামর মানুষ এই সাহসী প্রতিবাদকে সমর্থন জানিয়েছেন, কেউ কেউ প্রকাশ্যে কুর্ণিশও।ব্যবসায়ী
সমাজ সহ সমস্ত রায়গঞ্জবাসী সেদিন দেখেছিলেন প্রায় ২০,০০০
আদিবাসীর প্রতিবাদী মিছিলের সময় পরিপূর্ণ প্রশাসনিক ব্যর্থতা।প্রশাসনিক ব্যর্থতার প্রতিবাদে দুটি ব্যবসায়ী সংগঠন পরপর দুদিন রায়গঞ্জ
বনধ ডাকে।সব মিলিয়ে এক নৈরাজ্যের পরিস্থিতি সৃষ্টি
হয়,
জনজীবনে ভীতি চেপে বসে।সম্ভবত এতাবৎ
কালে রায়গঞ্জের মতো political society-তে (যেখানে কলকাতা
বা দক্ষিণবঙ্গের অনেক অঞ্চলের মতো সিভিল সোসাইটি গড়ে ওঠেনি) বিভাজিত
শহরে প্রথমবারের মতো স্বতস্ফুর্তভাবে 'We Want Justice' শ্লোগান
দিয়ে রাজনীতিকে অতিক্রম করেযুবসমাজের এক সুসজ্জিত মিছিল হয় ১৭ জুলাই।
এরকম এক পরিস্থিতিতে
প্রতিবাদে সামিল হল রায়গঞ্জ নাগরিক সমাজ।পুলিশ সুপার
এবং পরবর্তীতে রায়গঞ্জ থানার ওসি-কে সরিয়ে দেওয়া হলেও যে নাগরিক
সমাজের রোষ বিন্দুমাত্র প্রশমিত হয়নি তার প্রমাণ মিলল ২০ জুলাইয়ের বিক্ষোভ মিছিলে।নাগরিক সমাজের দাবি তিনটি – (১) নাবালিকা
ও আদিবাসী ধর্ষণকান্ডে যুক্ত সমস্ত দোষীদের ধরতে হবে ও উপযুক্ত বিচারের ব্যবস্থা করতে
হবে, (২) পৌরসভা ও পুলিশ প্রশাসনকে দায়িত্ব
নিতে হবে রায়গঞ্জকে দুষ্কৃতিমুক্ত করার ক্ষেত্রেএবং
(৩) জাগ্রত হোক নাগরিক সমাজ, জাগ্রত হোক প্রতিবাদী নাগরিক বিবেক।এই শহর শিল্পী, সংষ্কৃতিপ্রেমী মানুষের।এই শহরে
অবাধে মেয়েরা ঘোরাফেরা করে থাকে, তাদের শহর।খুনিদের শহর নয়, সম্প্রীতির শহর।রাজনৈতিক, ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক বা যে কোনও গোষ্ঠীগত পরিচয়কে অতিক্রম
করে জন্ম নেওয়া এই সুবৃহৎ মিছিলে আওয়াজ উঠল – মানুষের শহরে ক্রিমিনালদের
দৌরাত্ম্য বন্ধ করতেই হবে।
মিছিলের
পুরোভাগে ছিলাম আমি,বণিক সমাজের
নেতা শংকর কুন্ডু, আইনজীবী নাট্যকর্মী অশোক ব্যনার্জী,
রায়গঞ্জ করোনেশন স্কুলের প্রধান শিক্ষক শুভেন্দু মুখার্জী ও অন্যান্য
স্কুলের শিক্ষকেরা, ডঃ সুদেব সাহা, রায়গঞ্জ
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা, বিভিন্ন মহিলা ও নারী সংগঠনের কর্মী
সহ বহুল সংখ্যক ছাত্র-যুবক-যুবতী এবং বিভিন্ন
পেশার সাথে যুক্ত কয়েক হাজার মানুষ।পরের দিন সন্ধ্যার পর থেকেই ছন্দে ফিরতে শুরু করে
রায়গঞ্জ শহর।
এরপরে ৩০ জুলাই
নাবালিকা আদিবাসী ধর্ষণে জড়িতদের শাস্তি ও সমাজকে দুর্বৃত্তায়ন ও দুষ্কৃতিমুক্ত করে
তোলার লক্ষ্যে নাগরিক কনভেনশন হয়।চোখে পড়ার মতো, প্রত্যাশাছাপিয়ে
উপস্থিতি ছিল কনভেনশনে।ছাত্র-যুবক-শিক্ষক-চিকিৎসক সহ উপস্থিত ছিলেন নাট্যকার-কবি-চিত্রশিল্পী-আইনজীবী সহ বিশিষ্ট
নাগরিকরা।এই কনভেনশনে তাৎক্ষনিক আবেদনে প্রায় ৬,৫০০
টাকা সংগৃহীত হয় আক্রান্ত আদিবাসীদের হাতে তুলে দেবার জন্য।কয়েক’শ মানুষের কথা আগামীতে নিশ্চিতভাবেই গর্জনের রূপ নেবে এ
বিষয়ে আশাবাদী 'রায়গঞ্জ নাগরিক সমাজ'।
পল ফারমার
তাঁর
Pathologies of Power গ্রন্থে হাইতিতে ভূমিসন্তান যুবতী অ্যাসেফি-র ভূমি থেকে উৎখাত হওয়া এবং পরবর্তীতে বিভিন্ন করুণ ও বিপজ্জনক অভিজ্ঞতার মধ্যে
দিয়ে গিয়ে AIDS আক্রান্ত হবার কাহিনি বিবৃত করেছেন।ক্ষমতা কীভাবে প্যাথলজিকাল হয়ে ওঠে তার নিখুঁত বিবরণ দিয়েছেন, বিশেষ করে স্বাস্থ্যের জগতে।নারীহবার জন্য হাইতির অ্যাসেফি এবং রায়গঞ্জের আদিবাসী ক্যারোলাইনারা বারেবারে আক্রান্ত
হয়।স্বাস্থ্যের গবাক্ষ দিয়ে দেখলে হাইতিতে
হয় এইডস,
রায়গঞ্জের কিশোরী post-traumatic syndrome-এর শিকার।স্তরায়িত সমাজে (stratified
society) প্রান্তের স্বর, প্রান্তের আর্তনাদ এমনকি
রায়গঞ্জের মতো প্রান্তিক শহরের কানে কিংবা মননে প্রবেশ করে না।আমরা এভাবেই নির্মিত হই, এটাই আমাদের স্বাভাবিকতা।এখানে একটি রাজনীতি-ধর্ম-নিজস্ব
সংস্কৃতি ও কৌম পরিচয়কে অতিক্রম করে একটি সক্রিয় নাগরিক সমাজের উপস্থিতি ঐতিহাসিকভাবে
প্রয়োজনীয়।আমলাতন্ত্র, প্রশাসন ও রাষ্ট্রের যৌগ্যপদ্যেযে সামাজিক কাঠামো গড়ে ওঠে সেখানে আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক
ক্ষমতা একজন নাগরিককে (বেশিরভাগ ক্ষমতার সম্পর্কে নিতান্ত দুর্বল) মুছে ফেলতে পারে।এর সাথে যুক্ত হবে একজন ব্যক্তির শ্রেণিগতঅবস্থান যেখানে এমনকি মূল
নাগরিক সমাজের সঙ্গেও সম্পর্কের ধরণ অনেক ক্ষেত্রে নির্ধারিত হয়।নাগরিক সমাজ তো বৃহত্তর সমাজের একটি রেপ্লিকা, আবার রেপ্লিকা নয়ও।রায়গঞ্জের বর্তমান নাগরিক আন্দোলনে এ
বিষয়গুলো নজর থেকে হারিয়ে যায়নি।
'পত্রদ্বারা
নিমন্ত্রণের ত্রূটি মার্জনীয়' -- এক সময় পারিবারিক অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণপত্রের শেষ লাইনে এই কটি কথা লেখার চল ছিল। কিন্তু মনে করুন শ্রাবণ মাসের
বর্ষনসিক্ত দিনে সকালবেলায় প্রাতরাশ, মধ্যাহ্নে ইলিশ সহযোগে ভরপেট ভোজন
এবং অপরাহ্নে লিট্ল ম্যাগাজিনের উপর তথ্যচিত্র ও শ্রদ্ধেয় প্রতুল
মুখোপাধ্যায়ের গান সহযোগে নির্ভেজাল আড্ডার বন্দোবস্ত যদি পুরোটাই
হোয়াট্সঅ্যাপে ঠিক হয়, যদি তার নিমন্ত্রণ ও নাম নথিভূক্তিকরণও ঐ
হোয়াট্সঅ্যাপেই হয়, তাহলে এই বিশেষ গণমাধ্যমটির প্রতি দুর্বলতা জন্মায়
না কি? আসলে 'একক মাত্রা'র হোয়াট্সঅ্যাপ গ্রূপটি শুধু সক্রিয়ই নয় তা
বহুবর্ণী, বহুধা বিস্তৃত এবং বৈচিত্র্যময়ও বটে। এই গ্ৰুপেই রাজনৈতিক বা
আর্থ-সামাজিক বিষয় নিয়ে সদস্যদের মধ্যে প্রায়শই ঘটে চলা
বিবাদ-বিসম্বাদের পরেও কেবল মুখোমুখি হওয়ার বাসনায় যুযুধান তার্কিকরা
নিজেদের মধ্যেকার ইগো-সর্বস্বতা ত্যাগ করে খোলামনে আড্ডা দিতে জড়ো
হয়েছিলেন সল্টলেকের দিশারী ভবনে। তারিখটা ছিল ২৩ জুলাই'১৭ এবং
আড্ডার আহ্বায়ক তথা আয়োজক ছিলেন ভাস্কর সিংহরায় মহাশয় যাঁর সদাহাস্যময়
অতিথিবাৎসল্যের জন্য কোনও প্রশংসাই যথেষ্ট নয়। শোনা যায়, ইংরেজ কবি
কীট্স নাকি তাঁর ভাইকে এক চিঠিতে লিখেছিলেন যে তিনি প্রায়শই রাস্তাঘাটে
লোকের ঝগড়া দেখতে দাঁড়িয়ে যান কারণ হঠাৎ বাধা ঝগড়ায় দুপক্ষের জীবনীশক্তির
বিচ্ছুরণ তাকে অনুপ্রাণিত করে। যাই হোক 'একক মাত্রা'র হোয়াট্সঅ্যাপ
গ্ৰুপের ঝগড়া যে শেষমেশ এরকম একটি আড্ডাভোজের জন্ম দিতে পারে তা জানলে
ঝগড়ার ভালো দিক নিয়ে কীট্স নিশ্চয়ই ভাইকে দ্বিতীয় আরেকটি চিঠি লিখতেন।
শুরুর কথা
আড্ডার
শুরুতেই 'একক মাত্রা'র সম্পাদক অনিন্দ্য ভট্টাচার্য পত্রিকার গোড়ার
ইতিহাস উপস্থিত পাঠক বন্ধুদের সামনে তুলে ধরেন। পূর্ব ইউরোপ তথা সাবেক
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর নয়ের দশকের শেষ ভাগে পরিবর্তিত বিশ্বের নতুন
আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতিতে পাশ্চাত্যের অ্যাকাডেমিক বা প্রাতিষ্ঠানিক
বিদ্যাচর্চা তথা মননচর্চার জগতে শূন্যতার সৃষ্টি হয়। সমাজতন্ত্র কমিউনিজম
ঠাণ্ডা-লড়াই ইত্যাদি শব্দবন্ধের প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে যেমন প্রশ্ন উঠতে
থাকে, তেমনি উদার-অর্থনীতি বিশ্বায়ন মুক্ত-বাণিজ্যের মতো ধারণাগুলি
জনমানসে প্রভাব ফেলতে শুরু করে। ভারতের প্রেক্ষাপটে বিচার করলে উদ্ভূত এই
পরিস্থিতিকে পোস্ট-স্ট্রাক্চারালিজম পোস্ট-কলোনিয়ালিজম বা
পোস্ট-মডার্নিজমের মতো বাঁধাধরা কিছু পশ্চিমী ছক দ্বারা পর্যালোচনা করা
দুরূহ হয়ে ওঠে। এই খামতির জায়গাটি জনাকয়েক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষিত সমাজমনস্ক
তরুণদের ভাবিয়ে তোলে। এই ভাবনারই ফসল ১৯৯৮ সালে প্রকাশিত 'একক' নামক
পত্রিকা যার লক্ষ্য স্থির হয় গল্প কবিতা উপন্যাস ব্যতিরেকে শুধুমাত্র
প্রবন্ধ ছাপিয়ে সমসাময়িক রাজনীতি অর্থনীতি সমাজনীতি
শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি ধর্ম শিক্ষা ইত্যাদি ক্ষেত্রের জাতীয় বা
আন্তর্জাতিক স্তরের ঘটনাপ্রবাহকে পর্যালোচনা করা। যদিও পরে আড্ডার ফাঁকে
উত্তান বন্দ্যোপাধ্যায় জানান শুরুর দিকে পত্রিকার অভিলক্ষ্য এতটা
গোছানো ছিল না। যাই হোক, অনিবার্য কারণবশত ২০০০ সালে পত্রিকার
রেজিস্ট্রেশনের সময় ঐ নামটি পরিবর্তিত হয়ে বহুমাত্রিক এই পত্রিকাটি বর্তমান
'একক মাত্রা' নামে প্রতি দুই মাস অন্তর নিরবচ্ছিন্ন ভাবে প্রকাশিত হতে
থাকে। বিগত ১৮ বছর যাবৎ বিষয়ের বৈচিত্র্যে এই পত্রিকা পাঠককে মুগ্ধ করে
এসেছে। এই প্রসঙ্গে অনিন্দ্যবাবু বহুদিন আগে পত্রিকায় প্রকাশিত
'চ্যাটালাপ' নামক একটি প্রবন্ধের উল্লেখ করেন যেখানে লেখক শিবাজী
বন্দ্যোপাধ্যায় আজকের ফেসবুক হোয়াট্সঅ্যাপের দুনিয়ার হালহকিকত সম্পর্কে
পূর্বাভাস করেছিলেন। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম আন্দোলনের সময়েও শাসকের রক্তচক্ষু
উপেক্ষা করে পত্রিকা তার নিজের রাজনৈতিক অবস্থানটি সুস্পষ্ট রেখেছিল।
অর্থাৎ, সমসাময়িক জটিলতা হোক বা ভবিষ্যৎ সমাজের প্রতিরূপ নির্মাণ - দুটি
ক্ষেত্রেই পত্রিকা তার স্বকীয়তা বজায় রেখে চলেছে। অন্যদিকে সম্পাদক জানান
লেখা বা লেখক নির্বাচনের ক্ষেত্রেও কোনও জাতবিচার বা নামবিচার করা হয় না।
সাধারণ পাঠকের বোধগম্যতার সুবিধার্থে পশ্চিমি অ্যাকাডেমিক্সের -ism_ও -tion_ নির্ভর jargonগুলি যতটা সম্ভব বর্জন করে একটি উন্মুক্ত
প্ল্যাটফর্ম তৈরি করাই এই পত্রিকার সাফল্য বলে মনে করেন অনিন্দ্যবাবু।
এরপর তিনি পত্রিকাটি সম্পর্কে তাঁদের অভিমত শোনানোর জন্য সমবেত
আড্ডাধারীদের অনুরোধ করেন।
পাঠকবন্ধুদের অভিমত
'একক
মাত্রা'র পুরোনো পাঠক কাঞ্চন মণ্ডল লেখাপড়ার জগতে নাকউঁচু মনোভাবের
সমালোচনা করে বলেন আজকাল মননচর্চার জগতে স্বল্প কিছু লোকই শুধু বলেন
বাকিরা শোনেন। কিন্তু তাঁর মতে 'একক মাত্রা' এমন একটি পত্রিকা যা সাধারণ
মানুষের চিন্তাভাবনা ধ্যানধারণা থেকে বিচ্ছিন্ন তো নয়ই বরং সাধারণ
মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সাধারণ মানুষের মতো করেই সমসাময়িক প্রেক্ষাপটকে
পর্যালোচনা করে থাকে। এই কাজ করতে গিয়ে একদিকে যেমন পত্রিকাটি সমাজের
প্রকৃত প্রতিফলক রূপে ভূমিকা নেয়, তেমনি কোনও বিশেষ প্রকার দলীয় রাজনৈতিক
মতাদর্শের প্রতি পক্ষপাতও করে না। বিধান বিশ্বাস লিট্ল ম্যাগাজিনের
প্রতি তাঁর ব্যক্তিগত ভালোবাসা ব্যক্ত করে বলেন যে 'একক মাত্রা'র মতো
একটি সজীব পত্রিকা 'কৌশিকি'র মতো লোকসংস্কৃতি চর্চার আকর হয়ে উঠতে পারে।
তিনি তাঁর নিজ সংগ্ৰহের বিপুল লিট্ল ম্যাগাজিন ও লোকশিল্পের নানা
নিদর্শনের যথাযথ সংরক্ষণের অসুবিধার কথাও ব্যক্ত করেন। ছাত্রজীবনে গ্ৰাম
থেকে শহরে এসে তাঁর ভালো লাগার নতুন জিনিসের মধ্যে একটি ছিল লিট্ল
ম্যাগাজিন।
বাংলাদেশের
নিহত বুদ্ধিজীবী অভিজিৎ রায়ের 'মুক্তমনা' ব্লগের নিয়মিত লেখক বিপ্লব পাল
জানান তিনি 'একক মাত্রা'র পুরনো সংখ্যা পড়ে আকৃষ্ট হন। প্রবাসে থাকাকালীন
পত্রিকার অনলাইন সংস্করণ পেতে চাইলে পেমেন্টের সময় অসুবিধার কথা বলেন।
'একক মাত্রা' প্রসঙ্গে তিনি বলেন স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীদের কাছেও
পত্রিকাকে গ্রহণযোগ্য করতে হবে এবং এই লক্ষ্যপূরণে অ্যাকাডেমিক গাম্ভীর্য
বর্জন করে গল্পের মাধ্যমে বিষয়বস্তুকে পরিস্ফূট করতে হবে। তাঁর মতে ,
বর্তমানে যেখানে মানুষের জ্ঞানার্জনের জনপ্রিয়তম হাতিয়ার উইকিপিডিয়া সেখানে
মানুষ সহজে গল্প গিলতে ভালোবাসে। এই পরিস্থিতিতে মিডিয়া থেকে রাজনৈতিক দল
বা কর্পোরেট থেকে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান সকলেই গল্প ছড়িয়ে সাধারণ মানুষকে
প্রভাবিত করে রেখেছে। এই প্রসঙ্গে এই প্রতিবেদকের মনে হয়েছে এর সার্থক
উদাহরণ হলো শ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত।বিপ্লববাবুর মতে এ কারণেই সমাজমনস্ক
মুক্তমনা শিক্ষিত মানুষজনের উচিত পাল্টা গল্পের মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে
সচেতন করা। অ্যাকাডেমিক পরিভাষার কচকচানি পরিহার করে প্রাঞ্জল ভাষায়
গল্পচ্ছলে লেখালিখি করতে গেলে অবশ্য গভীরতার প্রয়োজন আছে বলে বিপ্লববাবু
মনে করেন।
বিপ্লববাবুর বক্তব্যকে সমর্থন করে সুমিত ঘোষ বলেন সেমিনার
পেপারের চর্বিতচর্বন নয়, বরং চালু ধারণার বাইরের চিন্তাভাবনাকে উস্কে
দেওয়াই হল 'একক মাত্রা'র লক্ষ্য। তবে আপামর জনসাধারণের কথা ভেবে এর প্রচার
ও প্রসার ঘটাতে গেলে কৃষিজীবী বা শ্রমজীবী প্রান্তিক মানুষের কাছে আদৌ
ধারাবাহিক ও নিরবচ্ছিন্ন ভাবে পত্রিকা পৌঁছে দেওয়া যাবে কিনা সে বিষয়ে সংশয়
প্রকাশ করেন। অন্যদিকে 'নিবিড়' পত্রিকার সম্পাদক শ্রেয়ণের মতে মননচর্চার
জগতে অ্যাকাডেমিক্সকে পুরোপুরি নস্যাৎ করা যায় না। এই প্রসঙ্গে নীরদ
মজুমদার জানতে চান ঠিক কোন শর্তে কোনও শব্দকে অ্যাকাডেমিক বলা যায়। তাঁর
মতে শব্দের প্রাতিস্বিকতা বলে কিছু হয় না। তাছাড়া পরিভাষা যদি ব্যবহার না
করা যায় তাহলে বিশ্বায়ন উদারনীতি ইত্যাদি বিষয়গুলিকে কীভাবেই বা উল্লেখ করা
হবে। প্রসঙ্গান্তরে শ্রেয়ণ ক্ষোভ প্রকাশ করেন যে কোনও কোনও লিট্ল
ম্যাগাজিন প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পর প্রাতিষ্ঠানিকতাকে এড়াতে তো পারছেই না,
উপরন্তু নিজেদের 'লিট্ল' বলতে যেন তাদের কুণ্ঠা।
আড্ডায়
অ্যাকাডেমিক্স-নন্অ্যাকাডেমিক্স দ্বন্দ্বটি ক্রমশ দানা বাঁধতে থাকে। কবি
ঋত্বিক ঠাকুর মনে করিয়ে দেন সাধারণ মানুষের পাঠাভ্যাসকে হেয় করা উচিত নয়।
সাধারণ মানুষের গল্প শুধু যে জীবন রসে জারিত হয় তা নয়, জীবনকে তারা যে চোখে
দেখে তার ভিতরেও আরেকটা দেখা থাকে যেটা তাদের উপলব্ধির জগতে নিয়ে যায়।
ঋত্বিকবাবুর মতে, পত্রিকায় লেখালিখি যেন ঐ জগতটাকে ছোঁয় এবং এজন্য লেখকদের
উচিত সাধারণ মানুষের সাথে নিবিড় মেলামেশা বজায় রাখা। এই প্রসঙ্গে তিনি
ঘটকপুকুর অঞ্চলে একটি চা-দোকানে সৈইফুল্লা নামক এক জনমজুরের কথা বলেন যিনি
সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের 'প্রিয় ফুল খেলবার দিন নয় অদ্'" মুখস্থ বলে এবং
নিজের কবিতা লেখার কথা উল্লেখ করে ঋত্বিকবাবুকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন।
বিজ্ঞানী তুষার চক্রবর্তী দুটি বিখ্যাত বিজ্ঞান পত্রিকার ইতিহাস তুলে ধরে
আলোচ্য দ্বন্দ্বটিকে অন্য মাত্রা দেন। তিনি মনে করিয়ে দেন সাধারণ মানুষের
পাঠাভ্যাসকে মাথায় রেখে একসময় 'উৎস মানুষ' পত্রিকাটি বার হয়েছিল যা আজও
কোনওমতে টিকে আছে। অন্যদিকে অ্যাকাডেমিক চাহিদাকে মাথায় রেখে অধুনালুপ্ত
'অণ্বেষা' পত্রিকাটি বার হয়েছিল। অর্থাৎ তুষারবাবুর মতে দুয়েরই প্রয়োজন
আছে। এই দুটি পত্রিকার লক্ষ্য ছিল public understanding of science বা
জনমানসে বিজ্ঞানমনস্কতার স্ফূরণ এবং popularization of science বা
বিজ্ঞানের জনপ্রিয়করণ। স্পষ্টতই ঐ পত্রিকা দুটির উদ্দীষ্ট পাঠক ছিল শিক্ষিত
অবিশেষজ্ঞ বাঙালি। কাজেই পত্রিকার লেখায় সামান্য ভারিক্কি চাল আসতেই পারে
বলে তুষারবাবু অভিমত প্রকাশ করেন এবং 'একক মাত্রা'ও এর ব্যতিক্রম নয়।
তাঁর মতে সার্বিক গ্ৰহণযোগ্যতার প্রশ্নে সাধারণ মানুষের ভাষা অবলম্বন
করাটা যেমন বাঞ্ছনীয় তেমনি পাল্টা বলার প্রতিস্পর্ধা, essentialismকে
প্রশ্রয় না দেওয়া এবং organized scepticism বা সুসংহত যুক্তিবাদকে আশ্রয়
দেওয়াও লিট্ল ম্যাগাজিনের কর্তব্য। আর এই কর্তব্য পালনে ভাষা বা শৈলী
অ্যাকাডেমিক্সের সাহায্য কখনও কখনও নিতেই পারে। সম্পাদক অনিন্দ্যবাবুও
সহমত জানিয়ে বলেন 'একক মাত্রা'য় হয়তো অ্যাকাডেমিক লেখাজোখা ছাপানো হয়,
কিন্তু বেশি জোর দেওয়া হয় মাটির কাছাকাছি থাকা লেখার উপরেই।
আড্ডার
অনুষঙ্গে অনুপম দাস অধিকারী নিজের পাঠ অভিজ্ঞতা শোনাতে গিয়ে বলেন 'একক
মাত্রা'র যে অল্প কিছু লেখা তিনি কোনওদিন ভুলবেন না সেগুলির একটিও
অ্যাকাডেমিক লেখা নয়, বরং সেগুলি হয় সমসাময়িক ঘটনাপ্রবাহের তাৎক্ষণিক
বিশ্লষণ, না হয় অন্যান্য পত্রপত্রিকায় একেবারে অনালোচিত কোনো বিষয়, আর না
হয় গল্পচ্ছলে লেখা বা আখ্যানধর্মী কোনও লেখা। এর সাথে অনুপমবাবু এ কথাও
বলেন যে অ্যাকাডেমিক লেখালিখি করেন যাঁরা তাঁদের এরকম মানসিকতা থাকে যে
তাঁরা লিখবেন আর সাধারণ পাঠক সেই লেখা পড়বেন এবং মেনে নেবেন। কিন্তু যে
শর্তে সাধারণ পাঠকেরা তাঁদের সেইসব লেখার বক্তব্যকে আত্তীকরণ করবেন সেটাই
তাঁরা ভুলে যান। এই প্রসঙ্গে একটানা ১৮ বছর ধরে উচ্চমান বা standard বজায়
রাখা 'একক মাত্রা'র পক্ষে যথেষ্ট শ্লাঘার বিষয় বলে উত্তানবাবু যে মন্তব্য
করেন তার রেশ ধরে সুজিত চট্টোপাধ্যায় একটি মজার গল্প শোনান। শরৎচন্দ্রের
কাছে কোনও এক ভক্ত পাঠক খেদ প্রকাশ করে বলেন রবীন্দ্রনাথের লেখা তাকে
আকর্ষণ করে না কারণ তিনি সে সব বুঝতে পারেন না। অথচ শরৎচন্দ্রের উপন্যাসের
ক্ষেত্রে তার এই অসুবিধা হয় না। এর উত্তরে শরৎচন্দ্র তাকে জানান যে তিনি
লেখেন তার ভক্ত পাঠকদের জন্য আর রবিবাবু লেখেন তাঁদের মতো লেখকদের জন্য।
তুষারবাবু এর আগে 'একক মাত্রা'র ক্যাচলাইন ('মগজে দিন শান, নয়তো মিলিয়ে
যান')-এর প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। সুজিতবাবুও মগজে শান দেওয়ার
প্রশ্নে অ্যাকাডেমিক্সকে পুরোপুরি নস্যাৎ না করার পক্ষেই সওয়াল করেন।
আড্ডার
এই পর্বের শেষ দিকে উদ্যোক্তা ভাস্কর সিংহরায় সার্বিক ভাবে লিট্ল
ম্যাগজিনের দুনিয়া নিয়ে কিছু মন্তব্য করেন। তাঁর মতে অতীতকে নিয়ে
বিলাসিতা না করে লিট্ল ম্যাগাজিনগুলির উচিত বর্তমানকে বিশ্লেষণ করে
ভবিষ্যতের পথ নির্ধারণ করা। কোনও মালিকপক্ষ না থাকাটাকে তিনি লিট্ল
ম্যাগাজিনের জোরের জায়গা বলে মনে করেন। সে কারণে তর্ক-বিতর্কের পরিসর
হিসেবে লিট্ল ম্যাগাজিনের পাতা টেলিভিশনের পূর্ব-নির্ধারিত talkshow হয়ে
ওঠে না। তবে রাজনৈতিক বিষয়ের ক্ষেত্রে লিট্ল ম্যাগাজিনে সমালোচনামূলক
লেখালিখি থাকলেও সে সবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে কোনও সদর্থক বার্তা থাকে না। কবিতা
নিয়ে ভাস্করবাবু অনুযোগ করেন লিট্ল ম্যাগাজিনের বাংলা কবিতা ১৮ থেকে ৩০
বছর বয়সীদের আকৃষ্ট করতে পারছে না। উপরন্তু বাঁধাধরা কিছু বিষয় (যেমন কি
হারিয়ে গেছে, জীবনের কি অপ্রাপ্তি, কি অবশিষ্ট আছে, ইত্যাদি) ছাড়া বাংলা
কবিতায় বিষয়গত বৈচিত্র্য চোখে পড়ে না। এর উত্তরে ঋত্বিকবাবু ভিন্নমত পোষণ
করে বলেন ভালো কবিতা এখনও লেখা হচ্ছে তবে তা ফেসবুক, হোয়াট্সঅ্যাপ,
অনলাইন পত্রিকা ইত্যাদি নানা মাধ্যমে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে।
ধর্মীয় বিভাজন ও মেরুকরণের রাজনীতি
উত্তানবাবু
আড্ডার দ্বিতীয় পর্বে প্রথমেই মৌলবাদী মননের স্বরূপটি ঠিক কী তা জানতে
চান। মৌলবাদীদের দৃষ্টিকোণটি বুঝতে চান। তিনি বলেন যারা
'মুক্তমনা' ব্লগের উপর আক্রমণ করে তারা অবশ্যই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায়
শিক্ষিত, না হলে তারা নেট খুলে ব্লগ পড়তে পারত না। কিন্তু এই শিক্ষা তাদের
অবলম্বন হয়ে উঠতে তো পারেনি, উপরন্তু জীবনযাপনের চরম উদ্দেশ্যহীনতাকে
প্রতীয়মান করে তুলে এক শূন্যতাবোধ এনে দিয়েছে। এই শূন্যতাকে ভরাট করছে
মৌলবাদী ভাবনাচিন্তা। কাজেই মৌলবাদের দিকে ঝুঁকে পড়া উদ্দেশ্যহীন এইসব
মানুষজনের মননকে অবহেলা বা underestimate করা উচিত নয় বলে উত্তানবাবু অভিমত
ব্যক্ত করেন। নীরদবাবু অবশ্য মৌলবাদ বা সাম্প্রদায়িকতার মতো শব্দকে
ক্লিশে আখ্যা দিয়ে বৃহত্তর প্রেক্ষিতে বিচার করতে বলেন। তাঁর মতে কিছু
মানুষ মৌলবাদী বা সাম্প্রদায়িক এভাবে না বলে বরং চিন্তাজগতের সার্বিক
অবনমনকে নির্দেশিত করা উচিত। এই দীনতার ফলেই আমরা কপালে তিলক ও পরনে মোড়ানো
ধুতি দেখলেই দক্ষিণ ভারতীয় বুঝি, গালে দাড়ি দেখলেই মুসলমান বুঝি বা ইংরেজি
বলতে দেখলেই শিক্ষিত বুঝি। অর্থাৎ, তথাকথিত প্রগতিশীল মানুষেরও অবচেতনে
stereotypical ধারণা থাকে যেগুলিকে নীরদবাবু মৌলবাদ বা সাম্প্রদায়িকতার উৎস
হিসেবে মনে করেন। এর সাথে ভারতবর্ষের সংসদীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থার
প্রেক্ষাপটে তিনি অন্য একটি প্রসঙ্গ উথ্থাপন করেন। তিনি বলেন বর্তমানে
সংসদে নিরঙ্কুশ ক্ষমতাধিকারী বিজেপি সরকারের আমলে গেরুয়াতন্ত্রের
বাড়বাড়ন্ত থেকে পিছতে থাকলে দেখা যাবে রাজীব গান্ধীর নিরঙ্কুশ কংগ্ৰেস
সরকারের আমলেও শাহবানু মামলা বা বাবরি মসজিদ খুলে দেওয়ার মতো ধর্মীয়
মেরুকরণের রাজনীতি প্রশ্রয় পেয়েছিল। সংসদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা ও
জাতীয় স্তরে ধর্মীয় বিভাজনের রাজনীতি, এ দুটির কোথাও একটা যোগাযোগ আছে বলে
তিনি মনে করেন।
পল্লবী
বন্দ্যোপাধ্যায় নেট দুনিয়ার বাসিন্দাদের একটি বিশেষ প্রবণতার প্রতি দৃষ্টি
আকর্ষণ করেন। YouTube videoগুলির নিচে viewer's comment লেখার জায়গায়
যেভাবে বিনা প্ররোচনায় বেছে বেছে মুসলিম এবং দক্ষিণ এশিয় জনগোষ্ঠীর
মানুষজনকে racist বা জাতিবিদ্বেষমূলক বিদ্রুপ বা গালিগালাজ করা হয় তাতে
তাঁদের সহজেই প্রতিক্রিয়াশীল করে তোলা হয়। সেই প্রতিক্রিয়া অনেক সময়েই
rational না হয়ে emotional হয়ে পড়ে। এর জন্য কিন্তু সবটা দোষ তাঁদের দেওয়া
চলে না। পল্লবীদি শিক্ষিত হিন্দু বাঙালিদের সামন্ততান্ত্রিক মানসিকতার
সমালোচনা করে বলেন যে তাঁরা মুসলিমদের বাঙালি বলতে তো চানই না, উল্টে একটা
আমরা-ওরা বিভাজন বা দূরত্ব বজায় রাখেন। বাঙালি মুসলিমদের মধ্যে
সাম্প্রতিক শিক্ষাদীক্ষায় উন্নতি, সরকারি চাকরিতে যোগদান, ব্যবসা-বাণিজ্যে
সাফল্য ইত্যাদি কারণে এই ধরণের মানসিকতার হিন্দু বাঙালিরা এক সঙ্কট বোধ করেন। পল্লবীদির মতে, 'ওরা' নামক জনগোষ্ঠীর 'আমরা' হয়ে ওঠাকে
এইভাবে মেনে না নেওয়াতে ধর্মীয় বিভাজন বা মেরুকরণ আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এই
প্রসঙ্গে কাঞ্চনবাবুও বলেন যে বিরুদ্ধ মত বা বিরুদ্ধ আচারের প্রেক্ষিতে
সংখ্যাগুরুরা ইদানীং তাদের মনের ভিতরের সুপ্ত ঘৃণাবোধকে দাবিয়ে রাখতে
পারছে না। কখনও কখনও তা বেআব্রু হয়ে পড়ছে। এই কারণেই তাঁর মতে মুসলিমদের
জমি-বাড়ি-ফ্ল্যাট ভাড়া পেতে বা কিনতে অসুবিধা হয়।
অনিন্দ্যদা বিভাজনের
রাজনীতির প্রসঙ্গে বলেন সমাজে সাম্য নেই কারণ তা অসাম্যে ভরা। এই অবস্থায়
কেউ কেউ অসাম্য অনুশীলন করলে বিভাজন স্পষ্ট হয়। তাঁর মতে এই বিভাজন
দুভাবে হিংসাত্মক হয়ে উঠতে পারে। একটি হলো দাঙ্গা। দাঙ্গা কোনও বিচ্ছিন্ন
ঘটনা নয়, সাধারণ মানুষের আবেগের স্বতস্ফূর্ত বহিঃপ্রকাশও নয়। বরং তা
গুজরাট আসাম বা শিখদাঙ্গার মতো সর্বদাই একপ্রকার সঙ্ঘটিত অপরাধ। দ্বিতীয়টি
হলো দৈনন্দিন জীবনের চাওয়া-পাওয়ার বৈষম্যজনিত ক্ষোভসঞ্জাত বিবাদ বা কলহ
যেগুলো বাদ দিয়ে আজকের এই কোথাও বঞ্চনা কোথাও প্রাচুর্য ভরা সমাজে আমাদের
শান্তিযাপন আর হয়তো সম্ভব নয়।
তুষারবাবু
দাঙ্গার স্বরূপ নির্ধারণে বলেন যে দাঙ্গায় সমাজের নিচুতলার মানুষরা সবথেকে
বেশি জড়িয়ে পড়েন এবং ক্ষতিগ্ৰস্থ হন। কিন্তু দাঙ্গার প্রবাহ সমাজের
নিচুতলা থেকে উপরতলায় পৌঁছয় না, বরং নিচুতলার মানুষজনের ওপর দাঙ্গা চাপিয়ে
দেওয়া হয়। দাঙ্গা প্রশমনের উপায় নিয়ে তিনি বলেন যে একদিকে যেমন দাঙ্গার
খবর সংবাদমাধ্যম চেপে গিয়ে সদর্থক ভূমিকা নেয় না, অন্যদিকে প্রশাসনকেও
নরমে-গরমে সক্রিয় হতে হয়। প্রশাসন কখনও কার্ফু জারির মতো কঠিন সিদ্ধান্ত
নেয়, আবার কখনও সরকারি আমলাদের বদলি, সর্বদলীয় বৈঠকের মতো ইতিবাচক বার্তা
দেয়। যেমন অসম গণহত্যার পর মুসলিম জনগোষ্ঠীর ক্ষোভ প্রশমনে ফক্রুদ্দিন
আলি আহ্মদকে রাষ্ট্রপতি করা হয়। এই প্রসঙ্গে তুষারবাবু ক্ষোভ প্রকাশ করেন
যে সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গের চন্দননগর ধুলাগড় নৈহাটি ইত্যাদি স্থানের দাঙ্গার
ক্ষেত্রে প্রশাসনের ভূমিকায় তিনটি অভূতপূর্ব ব্যাপার লক্ষ করা গেছে।
প্রথমত, প্রশাসন মোটের উপর নিশ্চল ও নিশ্চুপ ছিল। দ্বিতীয়ত, উপরতলার
নির্দেশ মতো অল্প কিছু ক্ষেত্রে স্থানীয় প্রশাসন কাজ করেছে, সব ক্ষেত্রে
নয়। তৃতীয়ত, প্রচলিত রীতি অনুযায়ী দাঙ্গাপীড়িত অঞ্চলে যে সর্বদলীয় পরিদর্শক
দল যায়, সেরকম কিছুকে এলাকায় যেতে অনুমতি দেওয়া হয়নি। নৈহাটিতে জনৈক
উচ্চপদস্থ পুলিশকর্তা প্রকাশ্যে একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের মিছিলকে মদত
জুগিয়ে তা সঙ্ঘটিত করাতে গিয়ে আরও বিপদ ডেকে আনেন। তিনি বদলি হন। নতুন
যিনি আসেন তিনি অন্য সম্প্রদায়ের নিরাপরাধ লোকজনকে গ্ৰেফতার করে
জনসাধারণের বিরাগভাজন হন। অর্থাৎ, প্রশাসনের অপরিণামদর্শীতায় ধর্মীয় বিভাজন
আর মেরুকরণ চলতেই থাকে। অন্যদিকে সুশীল সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে বোলান
গঙ্গোপাধ্যায় বিনায়ক সেনেদের মতো মানুষদের নিয়ে গড়া পরিদর্শক দলটিকে পুলিশ
১৪৪ ধারার মিথ্যা দোহাই দিয়ে ঘন্টা দুয়েকের মধ্যেই উপদ্রুত এলাকা থেকে
বার করে আনে। তুষারবাবুর মতে পুলিশের এই ধরনের আচরণে আদতে হিতে বিপরীত হয়।
আসলে দাঙ্গাপীড়িত অঞ্চলের ত্রস্ত গরিবগুর্বো মানুষজন বাইরের শিক্ষিত
লোকজনকে পেয়ে একটু মানসিক বল পান। Counselor-এর কাছে আমরা যেমন মনের যত
রাগ-ক্ষোভ-দুঃখ-অভিমান উগরে দিয়ে হাল্কা বোধ করি অনেকটা সেইরকম আর কি। অথচ
এই সহজ ব্যাপারটা প্রশাসন উপেক্ষা করে এবং কঠোর ভাবে ১৪৪ ধারা দীর্ঘদিন
বজায় রেখে উত্তেজনাকে জিইয়ে রাখতে পরোক্ষে ভূমিকা রাখে। সর্বদলীয়
শান্তি মিছিলের পরিবর্তে শাসকের একদলীয় শান্তি মিছিল দেখলে নিপীড়িত মানুষজন
আসলে কোনো ভরসা যে পান না সেই বোধ রাজ্য প্রশাসন মনে হয় হারিয়ে
ফেলেছে।
পল্লবীদি এ রাজ্যে
সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে অন্তত দুটি জায়গায় হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার পিছনে
ধর্মীয় বিভাজন নয়, কিছু ধান্দাবাজ মানুষের কায়েমী স্বার্থ চরিতার্থ করার চালনাকে দায়ী করেন। নৈহাটির সাম্প্রতিক দাঙ্গা সম্পর্কে আমরা কমবেশী
অবহিত, কিন্তু পল্লবীদির মতে প্রকৃত সত্য অন্য কথা বলে। ঐ অঞ্চলে
গঙ্গাতীরবর্তী হুকুমচাঁদ জুটমিলটি এশিয়ার বৃহত্তম। এই জুটমিলটিকে কেন্দ্র
করে প্রধানত তিন ধরণের জনগোষ্ঠী বিদ্যমান -- (১) মিলের উচ্চপদস্থ
বাঙালিবাবুদের পরিবার, (২) মিলের তেলেগু শ্রমিক যাঁরা হিন্দু, (৩) মিলের
বিহারী শ্রমিক যাঁদের মধ্যে হিন্দু মুসলিম দুই-ই রয়েছে। ২০১৫ সালে সরস্বতী
পুজোর ভাসান কোনও এক পীরের মাজারের পাশ দিয়ে যাবে কিনা সে নিয়ে প্রথমে
ধর্মীয় বৈরিতা দানা বাধে। অন্যদিকে জুটমিলের মালিকপক্ষ অটোমেশন চালু করতে
চাওয়ায় সহস্রাধিক শ্রমিক ছাঁটাইয়ের সম্ভাবনা দেখা দিলে অসন্তোষ দানা বাধে।
শ্রমিক বিক্ষোভের ফলে মালিকপক্ষ পিছিয়ে এসে ধাপে ধাপে অটোমেশন বজায় রাখে।
এই অবস্থায় সরস্বতী পুজোর সময়কার পুরোনো বিবাদটি কোনোভাবে পুনরায় মাথা
চাড়া দেয় এবং দাঙ্গা শুরু হয়। কিছুদিন পর গোলমাল থিতিয়ে এলে দেখা যায়
সব কিছু আগের মতোই স্বাভাবিক রয়েছে, কেবল ভিনরাজ্য থেকে আগত শ্রমিকেরা ও
তাঁদের পরিবার প্রাণভয়ে দলে দলে মিল এলাকা থেকে নিজেদের রাজ্যে ফিরে গেছে।
অন্যদিকে শ্রমিক ছাঁটাইয়ের মতো অস্বস্তিকর দায় থেকেও মিলের মালিকপক্ষ
রেহাই পেয়ে যায়। পল্লবীদি প্রশ্ন তোলেন, এক বছরের পুরোনো দাঙ্গাকে খুঁচিয়ে
তোলা আর মিল মালিকদের এই পড়ে পাওয়া স্বস্তিলাভের মধ্যে কোনও কার্যকারণ
সম্পর্ক কি একেবারেই নেই! সাম্প্রতিক ধুলাগড়ের দাঙ্গার ক্ষেত্রেও
পল্লবীদির পর্যবেক্ষণ মোটামুটি একই। ঐ অঞ্চলে বিস্তীর্ণ জমি কর্পোরেট
সংস্থার হস্তগত হলে সংস্থাটি যখন নির্মাণ কার্য আরম্ভ করে তখন স্থানীয়
সিন্ডিকেটের তোলাবাজরা টাকা দাবি করে। এই তোলাবাজরা হিন্দু-মুসলিম
সম্প্রদায়গত দুটি দলে বিভক্ত ছিল যাদের মধ্যে একটি অন্যটির চেয়ে
তোলাবাজিতে আগে সাফল্য পায়। অন্যটি তখন তোলাবাজিতে পিছিয়ে পড়ার জ্বালা
মেটাতে দাঙ্গা শুরু করে। নৈহাটি হোক বা ধুলাগড় ধর্ম নিয়ে দাঙ্গার পিছনে
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ভিন্ন কোনও ক্রুর অভিসন্ধি কাজ করে বলে পল্লবীদি জোর
দিয়ে জানান। পল্লবীদির এই বক্তব্যের সূত্র ধরে বিপ্লববাবু বলেন সমাজজীবনের
অন্য সমস্ত ঘটনার মতোই দাঙ্গার অর্থনৈতিক কারণ বা প্রেক্ষিতটিকে কোনওমতেই
অস্বীকার করা যায় না। মিল এলাকা থেকে শ্রমিক বিতাড়ন হোক বা নবগঠিত
পাকিস্তান থেকে হিন্দু বিতাড়ন বা অনুপ্রবেশ হোক সব কিছুর পিছনেই অর্থনীতি
কাজ করে। দ্বিতীয় যে বিষয়টি বিপ্লববাবুর মতে লক্ষণীয় তা হল প্রশাসন ও
শাসক দলের ভূমিকা। এই প্রসঙ্গে বিপ্লববাবু তার ছোটবেলার স্মৃতি হাতড়ে বলেন
১৯৮৬ সালে নদীয়া জেলায় যখন তিনি থাকতেন তখন তাঁর হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার
প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা হয়। ঐ সময় দাঙ্গার উত্তেজনা প্রশমনে রাজ্য সরকার ও
প্রশাসন সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিল। শুধু তাই নয় শাসক দলের নেতারাও নৌকা করে
গঙ্গা পারাপার করে দুই তীরের দুই ধর্মের অন্তত দশ হাজার সশস্ত্র বা
উত্তেজিত জনতাকে দাঙ্গায় লিপ্ত হওয়া থেকে ক্ষান্ত করেছিলেন। বিপ্লববাবু
রাজনৈতিক নেতাদের এই রকম সদর্থক ভূমিকার প্রশংসা করেন।
অশোকেন্দু সেনগুপ্ত সম্পূর্ণ নতুন একটি বিষয়ে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এর আগে
তুষারবাবু কথা প্রসঙ্গে বলেছিলেন যে কোনও দাঙ্গার পক্ষ আর প্রতিপক্ষ থাকে।
একদিক আক্রমণ করে আরেক দিক আক্রান্ত হয়। সাধারণত এটি দ্বিমুখী। তবে একমুখী
হলে তা গণহত্যার চেহারা নেয়। এই প্রসঙ্গটিকে অশোকেন্দুবাবু আরেকটু বিস্তৃত করে
বলেন যে দাঙ্গার আরও একটি পক্ষ আছে যে পক্ষের লোকজন দাঙ্গাপীড়িত অঞ্চলের
কাছাকাছি থাকেন বা সেখান দিয়ে যাতায়াত করেন, কিন্তু দাঙ্গার আঁচ থেকে
নিজেদের দূরে রাখেন। এঁরা নিজেদের নিরপেক্ষ বলে তুলে ধরতে পছন্দ করেন, যদিও
তাঁদের এই নিরপেক্ষতা আসলে সমাজ-রাজনীতির যে কোনও অনুষঙ্গ থেকে নিজেদের
গা-বাঁচানো উদাসীনতা। অশোকেন্দুবাবু এই 'নিরপেক্ষ উদাসীনতা'কে কটাক্ষ করে বলেন
এতে কাজের কাজ কিছু হয় না। উপরন্তু দাঙ্গায় লিপ্ত মানুষেরা যেমন হিংস্রতার
ফাঁকা ময়দান পেয়ে যায় তেমনি দাঙ্গাপীড়িত মানুষেরা নিজেদের আরও বেশি
নিঃসঙ্গ ও বিপন্ন বোধ করে। অশোকেন্দুবাবুর মতে প্রকৃত সচেতন নাগরিকের উচিত এরকম
উদাসীন না থেকে পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যাওয়ার আগেই দাঙ্গাবাজ মানুষের
মন মনন মানসিকতাকে অনুধাবন করে ফেলা। এই প্রতিবেদকের মনে হয়েছে দাঙ্গার বীজ
একদিনে মহীরূহ হয় না। জনমানসে আগে ক্ষেত্র প্রস্তুত করা হয়, দু-একটি
উস্কানিমূলক তথ্য ছড়িয়ে দাঙ্গার বীজ বপন করা হয়, রাজনৈতিক দলগুলির ইন্ধনে
তার অঙ্কুরোদ্গম হয়, প্রশাসনের নীরবতায় তা ডালপালা মেলে। এই পুরো সময়টা
সুশীল সমাজের ঔদাসীন্য আবহাওয়াকে দাঙ্গার পক্ষে অনুকুল করে তোলে।
ইন্দ্রাণী রায় বর্তমান ভারতের প্রেক্ষাপটে সাধারণ মানুষের অসহায়তার কথা
তুলে ধরেন। আপামর ভারতবাসীকে সম্পূর্ণ অন্ধকারে রেখে যেভাবে ডিমানিটাইজেশন,
ডিজিটাল ইকোনমি, জিএসটি ইত্যাদি চালু করা হয়েছে তার সাথে আধার নামক মূলত
নজরদারির আধুনিক এক প্রকরণকে যেভাবে বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে তাতে আপত্তি
জানান ইন্দ্রাণীদি। তাঁর মতে এসব থেকে নজর ঘোরাতেই হয়তো ভারত জুড়ে ধর্মীয়
অসহিষ্ণুতার এক বাতাবরণ সৃষ্টি করা হচ্ছে আর রাজনীতির দাবাখেলায় সাধারণ
মানুষ বোড়ের মতো ব্যবহৃত হয়ে চলেছেন।
অনুপমদা
ধর্মীয় মেরুকরণের রাজনীতি কাদের দ্বারা সঙ্ঘটিত হয় সে ব্যাপারে তিনটি
চালিকাশক্তিকে নির্দেশিত করেন। এটি মূলত (১) প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের সাথে
সম্পৃক্ত কিছু মোহগ্ৰস্ত মানুষ, (২) নিস্ক্রিয় প্রশাসন এবং (৩)
স্বার্থান্বেষী রাজনৈতিক নেতাদের দ্বারা পোষিত হয়। এর সাথে রয়েছে সোশাল
মিডিয়ায় কিছু অতি সচেতন মানুষের অবিমৃশ্যকারী কার্যকলাপ। যেকারণে
#NotInMyName এর মতো একটি গণপিটুনী বিরোধী (against the public lynching of
the Muslims and the dalits) সচেতনতা প্রচার কর্মসূচিকে চীনা পণ্য
বর্জনের মতো জাতীয়তাবাদের সুড়সুড়ি দেওয়া প্রচারাভিযান বা পশ্চিম এশিয়ার
সন্ত্রাসবাদীদের ক্রিয়াকলাপকে টেনে এনে মুসলিম বিদ্বেষ ছড়ানোর মাধ্যম
হিসেবেও ব্যবহার করার চেষ্টা হত না। অন্যদিকে সুশীল সমাজের কিছু অংশে
stereotypical ধারণাকে যেভাবে প্রশ্রয় দেওয়া হয় তারও সমালোচনা করেন
অনুপমদা। শ্রীরামপুরে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার্থে একটি মিছিলের
অগ্রভাগে মাথায় ফেজ টুপি গালে দাড়ি সম্বলিত কয়েকজন মুসলিম ব্যক্তিকে
সম্প্রীতির showpiece হিসেবে উপস্থিত করানোকে তিনি কটাক্ষ করেন এই বলে যে
এদের সাথে তাহলে নামাবলী গায়ে টিকিধারী ব্রাহ্মণদেরও রাখা উচিত ছিল। তাঁর
মতে, এই ধরনের আচরণ হাস্যকর এবং তা মেরুকরণকেই প্রশ্রয় দেয়। ঠিক একই ভাবে
অনুপমদা এই মর্মে খেদ ব্যক্ত করেন যে নরেন্দ্র দাভোলকর নিহত হলে
হত্যাকারীর ধর্মীয় পরিচয় যে ভাবে এ দেশের বুদ্ধিজীবী মহলে আলোচ্য বিষয় হয়ে
ওঠে, বাংলাদেশে অভিজিৎ রায় সহ একের পর এক ব্লগার হত্যার পর এ দেশের
বুদ্ধিজীবীরা ততটা সেভাবে বিচলিত হন না। তাঁর মতে দাঙ্গায় আক্রান্ত বা
ক্ষতিগ্ৰস্ত মানুষের রাগ দুঃখ ক্ষোভকে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা উচিত।
তাঁদের মন বা psycheকে সমবেদনা ও সহানুভূতির সাথে বোঝা উচিত। না হলে হয়তো
বারাসাতের জনৈক স্বপনবাবুর মতো কেউ কেউ দাঙ্গায় ক্ষতিগ্ৰস্ত হলেও শুধুমাত্র
মুসলিম হওয়ার কারণে বাল্যবন্ধুর দেওয়া অর্থ সাহায্য অভিমানের বশে হেলায়
ফেরাতে পারেন। অনুপমদার ভয় এই অভিমান ঘৃণায় পর্যবসিত হতে কতক্ষণ! তাঁর
আহ্বান গোটা ভারতবর্ষ গুজরাট হয়ে গেছে ভেবে নিয়ে অনর্থক হাহাকার না করে
দাঙ্গাকবলিত মানুষজনের কথা মন দিয়ে শোনাটা খুব জরুরি। সবশেষে ভাস্করবাবু
সুশীল সমাজের selective protestকে কটাক্ষ করে বলেন জুনেইদের হত্যা
অত্যন্ত নিন্দ্যনীয় এবং দুঃখজনক হলেও সে মূলত গণপিটুনির স্বীকার, দাঙ্গার
নয়। অথচ এই ঘটনাটি নিয়ে যে পরিমাণ হৈ চৈ হয় তার কণামাত্র বসিরহাট দাঙ্গার
বলি কার্তিক ঘোষকে নিয়ে হয় না। ভাস্করবাবু মোমবাতি মিছিলের এই একচোখামির
সমালোচনা করেন। সেই সাথে যোগী আদিত্যনাথের বচনে 'কবর খুঁড়ে ধর্ষণের
আহ্বানের' প্রেক্ষিতে শ্রীজাতর উস্কানিমূলক কবিতার প্রসঙ্গটিকে উল্লেখ করে
ভাস্করবাবু সাবধান করে দেন যে তথ্য বা ঘটনার সত্যাসত্য বিচার না করে
সোশাল মিডিয়ায় তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দেওয়া থেকে আমাদের বিরত থাকতে হবে।
এইভাবে
সুদীর্ঘ খোলামেলা আদান-প্রদানের মাধ্যমে উপস্থিত বিভিন্ন জনের অভিমত
মতামত বক্তব্য সমালোচনা কটাক্ষ ইত্যাদি পেরিয়ে আড্ডা শেষভাগে উপনীত হয়।
বলা বাহুল্য, এরকম একটি মনোজ্ঞ আড্ডায় অপ্রাপ্তি বলতে কিছুই থাকে না।
ধর্মভিত্তিক রাজনীতি তথা মেরুকরণ, দাঙ্গার চরিত্র ও কারণ, প্রশাসনের
ভূমিকা, দাঙ্গাবাজ ও দাঙ্গাপীড়িতদের মন, প্রভৃতি নানা বিষয়ে আলোচনা করা
হয়েছে। তবু এই প্রতিবেদকের মনে হয়েছে দাঙ্গায় নারীদের অবস্থান ও অবস্থা,
অসহিষ্ণুতার নানান প্রকাশ, সোশাল মিডিয়ার সদর্থক ও নেতিবাচক ভূমিকা (বিশেষত
বাদুড়িয়ার ঘটনার প্রেক্ষিতে), কিশোর-যুবাদের দায়িত্ববোধ, ইত্যাদি কয়েকটি
বিষয়ে কেউ না কেউ বিস্তৃত আলোকপাত করলে আড্ডা পরিপূর্ণ হত।
আড্ডার শেষভাগ
শেক্সপিয়ার
বলেছিলেন 'সব ভালো যার শেষ ভালো'। দুপুরের রাজকীয় ভোজনের শেষপাতে
আইসক্রিমের মতোই আড্ডার শেষ ভাগে দু-দুটি মন ভালো করে দেওয়া উপাদান ছিল।
প্রথমে অভিজয় কার্লেকর ও উৎপল বসুর পরিচালনায় 'লিট্ল ম্যাগাজিনের কথা'
নামে একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্যচিত্র দেখানো হয়। সম্ভবত বাংলা লিট্ল
ম্যাগাজিনের উপর এটিই একমাত্র তথ্যচিত্র। এতে উপস্থিত দুজন -- 'একক
মাত্রা'র সম্পাদক অনিন্দ্য ভট্টাচার্য, লিট্ল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি ও
গবেষণা কেন্দ্রর প্রতিষ্ঠাতা সন্দীপ দত্ত -- আড্ডাধারীর সাক্ষাৎকার ছিল। দেড়
ঘন্টার এই তথ্যচিত্রে একাধিক লিট্ল ম্যগাজিনের সম্পাদক নেপথ্যকর্মী
কবি লেখক তথা পাঠকের আলাপ ও কাজ দেখানো হয়। এমনকী রাসবিহারি মোড়ের
কল্যাণদার স্টল, উল্টোডাঙ্গার সুনীলদার স্টল, কলেজ স্কোয়ারের ধ্যানবিন্দু
ইত্যাদি লিট্ল ম্যাগাজিন প্রাপ্তিস্থানগুলিরও ছবি দেখানো হয়। এরপর
শ্রদ্ধেয় ও বর্ষীয়ান গায়ক প্রতুল মুখোপাধ্যায় উপস্থিত সকলকে যন্ত্রানুসঙ্গ
ছাড়াই দুটি গান শোনান। প্রথম গান 'শুন শুন শুন সর্বজন শুন দিয়া মন" এই
আড্ডাতেই প্রতুলবাবু প্রথম কোথাও গেয়ে শোনান।
এরপর 'সাম্প্রদায়িকতা,
সাম্প্রদায়িকতা, সবচে' বড় শত্রু এখন সাম্প্রদায়িকতা" গানটি শোনান যেটি
সেদিনের আড্ডার বিষয়বস্তুর প্রেক্ষিতে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে।
এই বয়সেও আড্ডার লোভ এড়াতে না পেরে দুখানা গান শুনিয়ে যাওয়ায় প্রতুলবাবু
'একক মাত্রা'র পক্ষ থেকে অবশ্যই ধন্যবাদার্হ। সবশেষে বেশ কয়েকজন
পাঠকবন্ধু পত্রিকার পুরোনো সংখ্যা ও বইপত্র কেনেন। দু' একজন বার্ষিক বা
আজীবন গ্ৰাহক হন। 'একক মাত্রা'র ছত্রছায়ায় সহৃদয় পাঠকবন্ধুদের উদ্যোগে
এরকম আড্ডা বাংলার নানা জায়গায় ছড়িয়ে পড়ুক। রামপুরহাট আর মালদহের আড্ডার
দিনক্ষণ ক্রমশ এগিয়ে আসছে। পাঠকবন্ধুরা তৈরি হোন।