Thursday, 3 July 2025

যুদ্ধ যখন এক উত্তেজক নেশা

শত্রু কেবল অস্ত্রধারী বহিঃশত্রু নয়

শ্রীপর্ণা চক্রবর্তী



এ লেখা যখন লিখছি, তন্মধ্যে ঘটে গেছে পাহেলগাঁও'এর নৃশংস উপাখ্যানকে কেন্দ্র করে দু' দেশের মধ্যে সম্যক উত্তেজনা। ঘটমান বিশ্ব চর্চিত ইজরায়েল কর্তৃক গাজার হত্যালীলা ছাপিয়ে তাতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষে যুক্ত হয়েছে একে একে ইরান, লেবানন ইত্যাদি মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্ৰিকার দেশগুলি এবং বঙ্গ-তথা দেশব্যাপী চিরপরিচিত 'পাকি-মুসলিম' ঘৃণার সঙ্গেই জন্ম নিয়েছে এক নব্য ইজরায়েল প্রেমীর দল। পরিবেশকর্মী গ্রেটা ও তাঁর সহচররা ত্রাণভর্তি (তাদের ভাষ্যে 'প্রতীকী') ম্যাডেলিন জাহাজটিকে নিয়ে গাজা অভিমুখে রওনা দিয়ে ভূমধ্যসাগরের আন্তর্জাতিক জলসীমায় খানিক অবধারিত ভাবেই ইজরায়েলি সেনার হাতে আটক হয়ে অবশেষে তিনি ও আরও তিন সমাজকর্মী অতি দ্রুত সুইডিশ সরকারের কোনওরকম হস্তক্ষেপ ছাড়াই দেশে দেশে প্রত্যার্পিত হয়েছেন।

অধুনা আধুনিকতার মঞ্চে সুশীলতার ধ্বজাধারী বাদবাকি বিশ্বকে ন্যায়-অন্যায়ের পাঠ দেওয়া ইউরোপ ধর্মপ্রচার ও ব্যবসায়ে মুনাফা করার ধান্দায় স্রেফ গায়ের জোরে আমেরিকা, আফ্রিকা ও এশিয়ায় উপনিবেশ স্থাপন করে আর নিজেদের দ্বারা নির্যাতিত ও নিজভূমে অবাঞ্ছিত ইহুদিদের প্যালেস্টাইনের 'পুণ্যভূমি'তে বসিয়ে দিয়ে একদিকে ভেদনীতি ও যুদ্ধব্যবসাকে ধূমায়িত করে, অন্যদিকে ইহুদি-মুসলিমের শান্তিস্থাপনের নাটক করে চলেছে সুদীর্ঘকাল ধরে। প্রকৃতপক্ষে এই সাম্রাজ্যবাদী ও ভোগবাদী ইঙ্গ-মার্কিন তথা পশ্চিমা বিশ্বের মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক (তেল ও বিশ্ব-বাণিজ্য) ঘাঁটি হিসাবেই ইজরায়েল রাষ্ট্রটি গঠিত হয়, যা তাদের মধ্যপ্রাচ্যে ক্ষমতা প্রদর্শন ও অর্থনৈতিক প্রভুত্বের প্রতীক।

অন্যদিকে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পূর্ব পর্বে, প্রধানত ইউরোপ ও পশ্চিম এশিয়ায় উৎসারিত রেসিজম ও অ্যান্টি-সেমিটিসমের নির্মম বলি হয় ইহুদি জনগোষ্ঠী। পশ্চিমা শক্তিসমূহের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় তারা তথাকথিত ‘পিতৃভূমি’র পুনরাধিকার লাভ করে। ফলস্বরূপ, সহস্রাব্দব্যাপী সেই ভূখণ্ডে বাসকারী আরব জনজাতির সঙ্গে তাদের এক অনিবার্য সাংঘর্ষিক সম্পর্কের সূচনা ঘটে। ইসলামের প্রারম্ভ থেকেই আরব ভূখণ্ডে ইহুদিরা আরব জাতির অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে বর্তমান ছিল এবং আসমানী কিতাবে ইহুদিদের সৃষ্টির অন্তিমকাল পর্যন্ত একপ্রকার চিরশত্রু রূপেই উপস্থাপন করা হয়েছে। ফলত, এই দ্বন্দ্ব এক পর্যায়ে অবশ্যম্ভাবীভাবে ধর্ম-সংঘর্ষের অবয়ব গ্রহণ করে। এই প্রেক্ষাপটে ভূ-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আঙ্গিককে আস্তিনে লুকিয়ে, পশ্চিমা পরাশক্তি সমূহ এই সংঘর্ষকে ধর্মযুদ্ধ তথা ‘গণতন্ত্র বনাম ধর্মীয় মৌলবাদ’— এই মোড়কে উপস্থাপন করতে থাকে; সম্ভবত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, হলোকাস্ট, গণহত্যার মতো তাদের নিজস্ব কলঙ্কময় ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে একপ্রকার প্রতিসাম্য বা নৈতিক পরিশুদ্ধির আকাঙ্ক্ষাও এর অন্তর্লিখিত অভিসন্ধি ছিল।

ইজরায়েল রাষ্ট্রের জন্মলগ্ন থেকেই যুদ্ধ যেন তার ওপর আরোপিত বাস্তবতা হয়ে ওঠে, বিশেষত, আরব রাষ্ট্রসমূহের সম্মিলিত আক্রমণের মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যের জটিল সংঘাতের সূচনায়। পরবর্তীকালে ইজরায়েল-মার্কিন জোটের ভূকৌশলগত স্বার্থরক্ষার প্রয়োজনে ‘চিরস্থায়ী প্রতিরোধের’ ধারণা প্রতিষ্ঠা পায়। যদিও এই রক্তক্ষয়ী সংঘাতের অন্তঃস্থ চালিকাশক্তি ধর্ম নয়, বরং অর্থনৈতিক, বিশেষত খনিজ ও জ্বালানি সম্পদ নিয়ন্ত্রণের প্রতিযোগিতা। উদাহরণস্বরূপ, জর্ডনের যুদ্ধ থেকে দূরে থাকার অন্যতম কারণ তার ভৌগোলিকভাবে অনুর্বরতা ও সম্পদহীনতা। এর বিপরীতে তেলসমৃদ্ধ রাষ্ট্রসমূহ— সিরিয়া, লেবানন, ইজরায়েল-প্যালেস্টাইন, ইরাক, ইরান দীর্ঘকাল ধরে সংঘাতে জর্জরিত। 

আশ্চর্যজনকভাবে, কেবলমাত্র ইজরায়েল পরিচালিত নিধনযজ্ঞকে কেন্দ্র করেই (আমাদের দেশেও বটে) তিনটি স্বতন্ত্র সমর্থক শ্রেণির স্পষ্ট উত্থান পরিলক্ষণ করি। প্রথম গোষ্ঠীটি আন্তর্জাতিক পর্যায়ের-- তারা দেশকাল এবং কিয়দংশে মনুষ্যত্বেরও ঊর্ধ্বে উঠে নিজেদের ধর্মীয় সত্তাতেই একমেবাদ্বিতীয়ম পরিচয়ে পরিচিত হতে চায় এবং বিশেষ কিতাবানুসারে তারা ইহুদীদের ধ্বংসের এক অনৈতিক ও বর্ণবৈষম্যমূলক স্বপ্ন বুনে চলে প্রজন্মান্তরে। এই গোষ্ঠীর একাংশ তথাকথিত ‘ঐশী নির্দেশ’, অর্থাৎ, ধর্মরক্ষার দোহাই দিয়ে কোনও 'একের' আদেশপ্রাপ্তির দাবি তুলে মরণোত্তর পুরস্কার লাভের আশায় বোমা হয়ে ফেটে উঠে ফুটে যায় এ ধরাধামের কোনও না কোনও অংশে প্রায় নিত্যদিনই, অকাল বা ‘উপযুক্ত’ কালেই। অজ্ঞাত কারণে গোষ্ঠীটির অপরাংশ, সরাসরি হত্যাযজ্ঞের অংশ না হলেও, কদাপি এই নৃশংসতার বিরুদ্ধেও অবস্থান নেয় না। বরং তারা পরম্পরাগত নিপীড়নের ইতিহাস থেকে ‘সমভাবে’ স্বধর্মী অথবা বিধর্মীদের দ্বারা সংখ্যাগুরু বা সংখ্যালঘুর দেশে নিগৃহীত হবার অজুহাতে নিজেদের অবস্থানকে ন্যায্যতায় পরিণত করার প্রয়াসে আত্মরত। ক্ষমাপ্রার্থী না হয়ে করুণাপ্রার্থী হওয়ার এই প্রবণতাই তাদের নৈতিক দৈন্যকে উন্মোচিত করে। 

দ্বিতীয় গোষ্ঠীটি উল্লিখিত প্রথম দলের এই উগ্রতা ও সহিংসতার দ্বারা ভীত-ফোবিয়াক ও মৌলিকভাবে বিরোধী। ফলত, ‘শত্রুর  শত্রু  আমার  বন্ধু’ এই তত্ত্বে উদ্বুদ্ধ তারা ইজরায়েল তথা ইহুদী সমর্থনে নিজেদের রাজনৈতিক ও নৈতিক অবস্থান সংহত করতে নিরন্তর সচেষ্ট এবং অতি সক্রিয়, বোধহয় প্রাণপাতেও আগ্রহী! যদিও  ইজরায়েল, বিশেষত ইজরায়েলবাসী ইহুদীরা তাদের এই অবস্থান সম্পর্কে খুব একটা ওয়াকিবহাল নয়।

তৃতীয় তথা সর্বাধিক চিত্তাকর্ষক গোষ্ঠীটি মার্কিন ও ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতায় প্রত্যয়ী এবং কোনও কোনও ক্ষেত্রে সমাজ পরিবর্তনের অলীক স্বপ্নে বিভোর। ফলে, পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী বলয়ের একমাত্র ভূ-রাজনৈতিক প্রতিস্পর্ধারূপে তারা প্রথম গোষ্ঠীর প্রতি একনিষ্ঠ সমর্থন প্রদানে অঙ্গীকারবদ্ধ। ঘোষিতভাবে ধর্মনিরপেক্ষ তথা ধর্মবিরোধী হওয়ায় প্রথম গোষ্ঠী যদিও তাদের এ আত্মীয়তা স্বীকার করে না, তবু প্রথম গোষ্ঠীর অনুগামীরা তাদের মধ্যেই বিপুল ভাবে সমাদৃত! কালান্তরে বাংলার ভূখণ্ডে এই দুই গোষ্ঠীর রাজনৈতিক সহাবস্থানও ঘটেছে বৃহত্তর (দলীয়) স্বার্থে! উক্ত গোষ্ঠীটির যারপরনাই মিছিল প্রেমে ইত্যবসরে কলিকাতাবাসী বেশ কিছু যুদ্ধবিরোধী মিছিলে পা মেলাবার পুণ্যার্জন করেছে, যার স্লোগানে স্লোগানে ঢেকেছে সমাজ মাধ্যমের দেওয়াল, আর এভাবেই তারা সমাজ মাধ্যমকেই ব্রিগেড জ্ঞানে আপন মনের বাৎসল্যে জিতে ফেলেছে শত শত নির্বাচন। ভারতীয় এই সর্ব-(গণ)হারার দলের রাজনৈতিক অবস্থান হয় অন্তর্লীন ব্রাহ্মণ্যবাদে আস্থাশীলতা, অথবা প্রকাশ্যেই প্রথম গোষ্ঠীর ধর্মতত্ত্ব ও আচরণের প্রতি সমর্থন।

জার্মান রাজনৈতিক দার্শনিক Carl Schmitt একদা বলেছিলেন, 'The specific political distinction to which political actions and motives can be reduced is that between friend and enemy.'। অর্থাৎ, রাজনীতির মৌলিক ধারণা হল ‘মিত্র-শত্রু বিভাজন’। এ এমন এক ক্ষেত্র যেখানে সমাজ নিজেকে চিত্রায়িত করে 'আমরা' বনাম 'ওরা' রূপে। শত্রু এখানে ব্যক্তিগত নয়, বরং রাজনৈতিকভাবে সংজ্ঞায়িত— যে আমাদের অস্তিত্বের বিপরীতে দাঁড়ায়। আদতে রাজনীতির জমিই প্রস্তুত হয় না অপর পক্ষটিকে চিহ্নিত করতে না পারার প্রাক-মুহূর্ত পর্যন্ত। আবার নীৎশে বলছেন, 'He who despises himself still respects himself as one who despises.'। তিনি শত্রুকে আত্ম-উৎপাদনশীল এক অবলম্বনরূপে চিহ্নিত করছেন। তাঁর মতে, আমাদের নৈতিকতাবোধের এক বৃহৎ অংশই শত্রুর উপস্থিতি ও তাকে ঘৃণা করার মাধ্যমে নির্মিত। যেমন, নৈতিকতার আঙ্গিকে তৃতীয় গোষ্ঠীটি ধর্মবাদকে বাদ দিতে চাইলেও, রাজনৈতিকভাবে তা করতে অপারগ, কারণ, তাদের লাল পুস্তিকা কোনও এক সুদূর অতীতে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার যে ‘সুরা’ গ্রাহ্য করতে বলেছিল, তা অনুসরণ করতে গিয়েই তারা প্রথম গোষ্ঠীকে মিত্ররূপে বিবেচনা করেছে। এবং সেই নির্দিষ্ট ধর্মতত্ত্বের ‘আফিম’ তারা গিলতে বিন্দুমাত্র কসুর করে না তথাকথিত 'পুঁজিবাদী' বলয়ের বিরুদ্ধতায় প্রথম গোষ্ঠীটিকে এক বলিষ্ঠ প্রতিপক্ষ রূপে বিবেচনা করে। 

এরই বিপরীতে অবস্থিত দ্বিতীয় গোষ্ঠী যারা প্রথম গোষ্ঠীর বিরোধী, প্রতিস্পর্ধী ধর্মীয় মৌলবাদেই বিশ্বাসী—জন্মলগ্ন থেকেই এই তাদের পরিচয়। ফলত তারা দেখতে কিংবা দেখাতে চায় না কীভাবে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতেও ভারতীয়দের হাফিয়া নামক শহরের বাঙ্কারে প্রবেশেই বাধা দেওয়া হয়েছে স্থানটি শুধুমাত্র ইহুদীদের জন্য সংরক্ষিত দাবিতে। অনুরূপে, তৃতীয় গোষ্ঠীর অনুসারীরা জানতে চায় না, যেভাবে গ্রেটা'রা বাধাপ্রাপ্ত হয়েছিল ত্রাণ সামগ্রী পৌঁছতে ইজরায়েলের আগ্রাসনের কাছে, ঠিক সেভাবেই স্থলপথ রুদ্ধ করে ত্রাণকার্য প্রতিহত করেছিল লিবিয়া ও ইজিপ্ট (দুই ইসলামিক রিপাবলিক); কিংবা, জাফর পানাহি, নোবেলজয়ী শিরিন এবাদি সহ প্রায় জনা ত্রিশেক বিশিষ্টজন ইরান সরকারের উদ্দেশ্যে এক প্রকাশ্য পত্রে লেখেন, 'Iran and its people should not be sacrificed for uranium enrichment and the ambitions of the Islamic Republic.'। 

আর এই যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলার বিভীষিকাময় প্রেক্ষাপটে গাজা পরিণত হয়েছে এক চলমান উপাখ্যানে— কখনও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের পরিসংখ্যানপত্রে, কখনও গবেষকের তথ্য ভাণ্ডারে, আবার কখনও তথাকথিত মানবতাবাদীদের সমাজ ও ছায়া-সমাজের খণ্ডচিত্রে বিন্যস্ত বেদনায়। আমরা 'মানুষ' নামক জীবেরা তাতে প্রয়োজনানুসারে প্রতিক্রিয়া জ্ঞাপন করেছি, করছি, তবে আদতে মনুষ্যত্ব রক্ষা করতে পারিনি, পারি না। যদিও আল্লাহ-উপাসকদের একাংশের কাছে গাজা এমন এক চিত্রপট যা অশ্রু ও  অভিশাপ বর্ষণের পাশাপাশি ধিক্কার ও প্রতিবাদেরও। এমনটা গোটা ইসলামী দুনিয়ায় বিরল, সেখানে বিধর্মী এমনকি স্বধর্মী নিধনের ফরমান সর্বদা শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের চেয়ে অগ্রাধিকার পেয়েছে। তাই সিরিয়া, লিবিয়া, ইয়েমেন কিংবা কুর্দ অঞ্চলে আরবীয় আগ্রাসন হোক অথবা আফগানিস্তানের অভ্যন্তরে নিত্যনতুন দানবিক নীতিমন্ত্রের উদ্ভাবন ও প্রয়োগ, প্রতিক্রিয়ার পরিবর্তে ঘোর নৈঃশব্দ্যই দেখেছে সমগ্র বিশ্ব।

যুদ্ধ সর্বদাই অবধারিত বিপর্যয় ও মৃত্যু, গর্ভস্থ জীবনের অপূর্ণতা, আশ্রয়চ্যুত নাগরিক সমাজ, ধ্বংসস্তূপে পরিণত আবাস এবং ক্ষতবিক্ষত উত্তর-প্রজন্মের অস্তিত্ব সংকট। তথাপি এই সর্বজনীন যুদ্ধ বিরোধিতার নৈতিক স্তম্ভে উপবিষ্ট হয়ে আমরা প্রত্যক্ষ করি, ইজরায়েল যখন ইরানের ওপর আঘাত হানে কিংবা ভারত পাকিস্তানের ওপর, তখন ভারতীয়দের একাংশ উল্লাসধ্বনিতে মুখরিত হয়, অপরপক্ষ নিস্পন্দ স্তব্ধতায় নতজানু থাকে। ন্যায়চিন্তার মধ্যে বিপর্যয় আরও তীব্র হয়, যখন দেখা যায় তথাকথিত প্রগতিশীল বা মানবিক চেতনায় উজ্জীবিত বুদ্ধিজীবী সমাজ ইজরায়েলের ধ্বংসস্তূপ বা রক্তস্নাত শিশু-দেহাবশেষে সেই একই পৈশাচিক পরিতোষ অনুভব করে। যেভাবে বামপন্থীরা প্রত্যেক ইজরায়েলিকে 'জায়নাবাদী' রূপে চিহ্নিতকরণ করছে, তা নেতানিয়াহুর সেই সর্বজনীনিকরণকেই স্মরণ করায়, যেখানে সমগ্র ফিলিস্তিন জাতিই হামাসের সহচর বলে প্রতিপন্ন হয়। এক জাতির মৃত্যুকে অপর জাতির ন্যায় বিজয়ের এই উদ্‌যাপন যেন মনুষ্যত্ব বর্জিত কোনও যুদ্ধদেবতার আরাধনায় অর্পিত নৈবেদ্যমাত্র।

চলচ্চিত্রের দার্শনিক-বিদূষক উডি অ্যালেনের এক প্রসঙ্গে বলেছিলেন, 'I'm not afraid of death; I just don't want to be there when it happens.'। অনুমেয়, এই অত্যুৎসাহীরা কস্মিনকালেও মৃত্যুর বাস্তবতার আবহ সম্মুখে প্রত্যক্ষ করেনি, কেবল যুদ্ধকে একপ্রকার উত্তেজক নেশা হিসেবে কল্পনা করেছে। একমাত্র আত্মবিস্মৃত, প্রতিহিংসায় মোহাবিষ্ট জনতা, যারা জাতীয়তাবাদে অন্ধ, যুক্তিবোধে শূন্য এবং কেবলমাত্র স্লোগানের উত্তেজনায় নিমগ্ন, তাদের পক্ষেই এ ধরনের ‘আনন্দ’ উদযাপন সম্ভবপর। যেমন, পাকিস্তান বিরোধী স্লোগান উচ্চারণ মাত্রেই অনেকে ভাবনাহীন, মননশূন্য দেশপ্রেমে আপ্লুত হয়ে ওঠেন।

জাঁ-পল সার্ত্র তাঁর 'The Look' তত্ত্বে ব্যাখ্যা করেছেন, অন্য মানুষ (l’Autre)-এর দৃষ্টির ভিতর দিয়েই আমি ‘বস্তু’তে রূপান্তরিত হই; সেই ‘অপর সত্তা’(other)'ই হয়ে ওঠে অস্তিত্বগত শত্রু, কারণ সে আমাকে অপর রূপে চিহ্নিত করে তার দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে। সেই চাহনিই হয়ে পড়ে আমার অস্তিত্বের অনতিক্রম্য সীমারেখা। অন্যদিকে বিষ্ণুপুরাণ ও গীতার বর্ণনায় 'শত্রু' বহির্দেশীয় নয় বরং অনেকাংশে অন্তরীণ— অহং, কাম, ক্রোধ, লোভ প্রভৃতি বিকার এ ক্ষেত্রে 'অন্তর্জাত শত্রু' হিসেবে চিহ্নিত। বৌদ্ধ দর্শনে ‘Māra’ সেই অন্তর্মুখী বিভ্রমের প্রতীক, যে নির্বাণের পথে বাধা সৃষ্টি করে। অতএব, শত্রু কেবল অস্ত্রধারী বহিঃশত্রু নয়, সে কখনও রাষ্ট্রীয়, কখনও নৈতিক, আবার কখনও অস্তিত্বগত ভ্রান্তি বা অপরের দৃষ্টিতেই নিহিত থাকে।

এই বৈপরীত্যের মধ্যস্থলে দাঁড়িয়ে, দ্বন্দ্বে জীর্ণ হওয়ার আগে আমাদের আত্মজিজ্ঞাসা করা প্রয়োজন—অসহিষ্ণুতার প্রতি সহিষ্ণুতা প্রদর্শন করব, নাকি অসহিষ্ণুতাকেই ধ্বংসের শাস্তি দেব? এবং এই অন্তঃসঙ্গাতে জীর্ণ হবার পূর্বেই স্মরণ করিয়ে দিতে হয় নীৎশের সেই অনিবার্য সতর্কবাণী, 'He who fights with monsters should see to it that in the process he does not become a monster. And if you gaze long enough into an abyss, the abyss will gaze back into you.'। আমরা যেন প্রতিহিংসার উন্মাদনায় অচেতন হয়ে নিজেরাই এক এক দানবে পরিণত না হই। মানবতার রক্ষাকবচ হিসেবে আমাদের প্রয়োজন, বোধ, ভাবনা ও আত্মসমালোচনার নিরলস অনুশীলন।


1 comment:

  1. ভালো পর্যবেক্ষণ।
    ব্যাকগ্রাউন্ড সাদা হলে পড়তে সুবিধা হয়। ফন্ট বড়ো করতে যায়? আর space between the lines needs to be increased.

    ReplyDelete