Tuesday, 8 March 2022

হারিয়ে যাওয়া গান

স্মৃতি বিস্মৃতি অন্ধকার

প্রবুদ্ধ বাগচী

 

বাংলায় লেখালিখির ক্ষেত্রে, চিরকাল না হলেও, একটা সময়ের পরে প্রকাশের দুটো সমান্তরাল স্রোত বয়ে চলেছেএকদল লেখক গোড়া থেকেই বাণিজ্যিক প্রকাশনা গোষ্ঠীর বড় পত্রিকায় লেখার সুযোগ পেয়ে এসেছেন। অন্য একদল শুরু করেছেন ছোট ছোট পত্রিকায় লিখে হাত পাকানোর, পরে একটা সময়ে বড় কাগজে লেখার সুযোগ পেয়েছেন, নাম করেছেন। এর বাইরে আরেকটা ছোট গোষ্ঠী আছে যারা মূলত ছোট পত্রিকারই লেখক। বড় পত্রিকায় যে তাঁরা একদম লেখেননি এমন নয়, তবে তাঁদের যে পরিচয় লেখালিখির জগতে সেটা ছোট পত্রিকার লেখক হিসেবেই।

এখন বড় কাগজ বলতে কী বুঝব, ছোট পত্রিকা বলতেই বা কী বোঝানো হবে- এইসব নিয়ে ঝড়ো বিতর্ক আছে। তার মধ্যে ঢুকে লাভ নেই। আর এই আলোচনায় ওই বিতর্কের কোনও পরিসর নেই। আমাদের প্রসঙ্গ ভিন্ন। 

এই দুই সমান্তরাল স্রোতের ফলে যেটা হয়, একদল লেখককে মানুষ সব সময় তাঁদের চোখের ওপর প্রকাশিত হতে দেখতেই থাকেন। তাঁদের লেখা নিয়ত প্রকাশ হতে থাকে বেশি প্রচারিত পত্রিকায়, এমনকি, প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলিতেও তাঁদের বই প্রকাশ হতে থাকে তাঁদের প্রয়াণের পরেও। সন্দেহ নেই, তাঁদের লেখার কৌলীন্য অনেক বেশি। কিন্তু তার মানে এই নয় যে এর বাইরে যারা, তাঁরা গুণে মানে সকলেই কমতি। উদয়ন ঘোষের মতো গল্পকার মূলত ছোট কাগজেই লিখেছেন, তার একটি মাত্র সংকলন ‘প্রতিক্ষণ’ প্রকাশ করেছিল, সেটি আজ অমিল। রতন ভট্টাচার্য গল্প লিখেছেন ছোট-বড় সব কাগজেই কিন্তু তাঁর লেখা আজ কোথাও খুঁজে পাওয়ার উপায় নেই। এইরকম আরেকটা উদাহরণ গুণময় মান্না, যার লেখা প্রায় হারিয়ে গেছে। উদাহরণ বাড়িয়ে যাওয়া যেতেই পারে, তাতে বেদনা গাঢ় হওয়ার সম্ভাবনাই ষোলোআনা।

আমাদের মনে আছে, কবীর সুমন তাঁর অতিখ্যাত ‘আমাদের জন্য’ গানে লিখেছিলেন, ‘সুনীল গাঙ্গুলির দিস্তে দিস্তে লেখা/ কত কবি মরে গেল চুপি চুপি একা একা’- এই উচ্চারণে একরকমের স্বীকৃতি ছিল ওই চুপি চুপি হারিয়ে যাওয়া কবি বা আরেকটু বড় অর্থে ধরলে লেখকদের। কিন্তু বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে যেটা সত্যি, তার আর্থ-সামাজিক কারণ প্রকাশনার দুই সমান্তরাল উচ্চাবচ ধারা। বাংলা গানের ক্ষেত্রে এমন কোনও সমান্তরাল ধারার অস্তিত্ব কোনওদিন ছিল না, অন্তত যতদিন না ক্যাসেট তৈরির প্রযুক্তি এসেছে। বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথের গান গাইতে ও প্রকাশিত হতে গেলে বেশ আঁটোসাটো একটা পদ্ধতির মধ্যে দিয়েই যেতে হত। হয় আকাশবাণীর অডিশনে পাশ করে গ্রেড পাওয়া দরকার, নয় নামী সঙ্গীত প্রযোজকের চোখে পড়া প্রয়োজন, নয়তো বা বিশ্বভারতীর ঝকঝকে প্রশিক্ষণে প্রোজ্জ্বলিত হওয়া দরকার। অবশ্য পরে বিশ্বভারতী সংগীত ভবনের বাইরেও কলকাতায় অনেক নামী সংগীত শিক্ষাসত্র তৈরি হয়, সেখানকার ছাত্র-ছাত্রীরাও আস্তে আস্তে গ্রামোফোন রেকর্ডে গান প্রকাশ করার সুযোগ পেতে থাকেন। 

মুদ্রণ শিল্পের সঙ্গে গ্রামোফোন রেকর্ডের প্রযুক্তির কোনও তুলনাই হয় না। কয়েকজন বন্ধু মিলে চাঁদা তুলে একটা ছোটখাটো বা মাঝারি পত্রিকা প্রকাশ করা যদি বা সম্ভব, ওরকমভাবে কোনও রেকর্ড প্রকাশ করা ছিল অসম্ভব। ফলে, নামী প্রতিষ্ঠান গ্রামোফোন কোম্পানি বা মেগাফোন, হিন্দুস্থান, ইনরেকো, কলম্বিয়া এইসব জায়গা থেকেই একমাত্র রেকর্ড প্রকাশ করা যেত, তাঁদের ছিল নিপুণ বিপণন কাঠামো ও নিবিড় পুঁজি।

ইতিহাসের ফ্রেমে ধরলে গত শতকের গোড়ার দিকে বছর দশেক বাদ দিলে আশির দশক অবধি এই প্রায় সাড়ে সাত দশক রেকর্ড কোম্পানিগুলিই রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পীদের প্রচারিত করে এসেছে, এর পাশাপাশি ছিল আকাশবাণীর প্রচার। সবাক ফিল্ম ও প্লে ব্যাক চালু হওয়ার পরে আরেকটি মাধ্যম হিসেবে ফিল্ম এলেও সেখানে সাধারণভাবে রবীন্দ্রনাথের গানের বদলে গল্পের উপযোগী ফিল্মের গান ব্যবহার হয়েছে বেশি, তুলনায় রবীন্দ্রনাথের গান কম। আর ব্যবহার হলেও তাতে সুযোগ পেয়েছেন রেকর্ডে গান গেয়ে খ্যাত হওয়া শিল্পীরাই। এখন এই সত্তর/ পচাত্তর বছরের গ্রামোফোন রেকর্ডের ইতিহাসে বিভিন্ন নামী সংস্থায় গান রেকর্ড করেছেন এমন শিল্পীর সংখ্যা বড় কম নয়। কারণ, বাণিজ্যের স্বার্থেই কোম্পানিগুলির প্রয়োজন ছিল নানা ধরনের কন্ঠ, সেই কণ্ঠের মালিক (বা মালিকানী)’কে কোম্পানিগুলি নিজেদের মতো করে খুঁজে নিয়ে এসে রেকর্ড করিয়েছেন, বাণিজ্য সফল হয়েছে। মনে থাকতে পারে, পঙ্কজ কুমার মল্লিক একদিন এমনভাবেই রেকর্ড করার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছিলেন অনুজ হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে, আর বন্ধুকে নানাভাবে উস্কিয়ে তাঁকে আকাশবাণীর দোরগোড়ায় নিয়ে এসেছিলেন হেমন্ত’র অকৃত্রিম সুহৃদ সুভাষ মুখোপাধ্যায়।

ক্যাসেট যুগে এই ঘরানা আর রইল না। কারণ, গ্রামোফোন রেকর্ড ছাপার থেকে ক্যাসেট প্রকাশ অনেক কম খরচে নিতান্ত ব্যক্তিগত উদ্যোগে করে ফেলা সম্ভব হল। আর রবীন্দ্রনাথের গানের কপিরাইট উঠে যাওয়ার পরে প্রকাশককে নিজে টাকা দিয়ে নিজের কবিতার বই ছাপানোর মতো নিজের বিনিয়োগে ক্যাসেট কোম্পানি থেকে নিজের গানের ক্যাসেট বের করে বন্ধুবৃত্তে তা বিতরণ বা বিক্রি পুরো ব্যবস্থাটাকেই ওলটপালট করে দেয়। সেটা একটা অন্য গল্প।

কিন্তু রেকর্ডের যুগে যারা রবীন্দ্রনাথের গান রেকর্ড করেছিলেন তাঁদের সবাইকে কি আজ আমরা শুনছি? শোনার সুযোগ পাচ্ছি? বাংলার সাহিত্য জগৎ ছোট বড় মাঝারি সবরকম প্রকাশনা নিয়ে এখনও প্রবলভাবে টিকে আছে। তাই সেই পুরনো ছোট পত্রিকা, বড় পত্রিকা ইত্যাদির আধারে বিভিন্ন লেখকের প্রকাশ এখনও সমানভাবে সক্রিয়। কিন্তু গানের ইন্ডাস্ট্রি আজ এক ধূসর অতীত। ক্যাসেট পেরিয়ে সিডি যুগ এসেছিল, তাও আজ অস্তমিত। সমস্ত গান বিপণি আজ বন্ধ। স্মার্ট ফোন আর ইন্টারনেট বাহিত ইউটিউব বা অন্যান্য গান শোনার ব্যবস্থা গানের বিনিময় মূল্যটাকেই আজ শূন্যে নিয়ে এসেছে। চাইলেই আমরা বিনি পয়সায়, কেবলমাত্র কিছুটা ডাটা খরচ করে গান শুনে নিতে পারি। যখন যা চাই, যা ইচ্ছে।

কিন্তু সত্যিই কি যা চাই তাই শুনতে পাই? এই জিজ্ঞাসার সামনে আমাদের আজ দাঁড়াতেই হবে, অন্তত আমি রবীন্দ্রনাথের গানের ক্ষেত্রটাই বিবেচনা করছি। হিমঘ্ন রায়চৌধুরী নামক কোনও যশস্বী রবীন্দ্রনাথের গানের শিল্পীকে আমরা কি চাইলেই শুনতে পাই আজ, যেমন ইচ্ছে করলেও রমেন্দ্রকুমার আচার্য চৌধুরীর কবিতাও কি পড়তে পারি? একটু ঝুঁকি নিয়েও বলি, রমেন্দ্রকুমারের কবিতা তবু খুঁজে পাওয়া সম্ভব, তার এক-আধটা বই কষ্ট করে জোগাড় করা যায় হয়তো- কিন্তু ইচ্ছে করলেই শোনা যাবে না রীতা ঘোষ বা শ্যামাশ্রী দাশগুপ্তের রবীন্দ্রগান, অথচ এই দুজন এককালে যথেষ্ট পরিচিতা ছিলেন, সেই রেকর্ড যুগের তালিকায়। আমরা ভুলতে বসেছি, তন্ময় চট্টোপাধ্যায় বা রিনি চৌধুরীর মতো দুজন সুগায়ক সুগায়িকার কথা। রবীন্দ্রগানের প্রশিক্ষক হিসেবে সুবিনয় রায়কে আমরা সকলে জানি, কিন্তু আরও দুই খ্যাত প্রশিক্ষক ও শিল্পী তড়িৎ চৌধুরী ও অরবিন্দ বিশ্বাস, এক নিঃশ্বাসে নাম করা যাবে প্রসাদ সেন ও শৈলেন দাসের- এদের মধ্যে শৈলেন দাস যুক্ত ছিলেন বাম রাজনীতির সঙ্গে, একটা সময় দক্ষিণ দমদম পুরসভার চেয়ারম্যান পদে ছিলেন তিনি। দুর্ভাগ্য, স্থানীয় প্রোমোটার বাহিনীর বিরাগভাজন হয়ে সেই বাম আমলেই তিনি প্রকাশ্যে খুন হন। শৈলেন দাসের অল্প কিছু গান তবু ইউটিউবে পাওয়া যায় কিন্তু কলকাতা দূরদর্শনের একদা নিয়মিত শিল্পী (শুক্রবার সাতটায় রবীন্দ্রনাথের গানের অনুষ্ঠান) কবীর মজুমদার বা সুশীল চট্টোপাধ্যায়ের গানের কোনও অস্তিত্ব আজ আর কোথাও নেই। এক সময়ের প্রতিভাশালী পারফর্মার বনানী ঘোষ, যাকে কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুসারী বলে বিবেচিত করা হত, তিনি একটি গ্রামোফোন রেকর্ডে ‘তুমি ছেড়ে ছিলে ভুলে ছিলে বলে’ কী অসীম মমতায় রেকর্ড করেছিলেন- হায়, সেই গান আজ আর আমাদের শোনার কোনও উপায় নেই। আরেক সম্ভাবনাময় গৌতম মিত্র যাকে হেমন্তের উত্তরসূরি ভাবা হত এবং এক সময় প্রচুর জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন তিনি আজ আমাদের স্মৃতি থেকে উধাও। 

আজকের প্রজন্মের সামনে আবছায়া হয়ে গেছেন প্রতিমা মুখোপাধ্যায়, সুধা মুখোপাধ্যায়, মঞ্জু গুপ্ত, সুপ্রীতি ঘোষ, গীতা সেন, সুনীল রায়, সাবিত্রী দেবী কৃষ্ণাণ, রেণুকা দাশগুপ্ত প্রমুখ। গীতা সেন ‘তাসের দেশ’এর গান প্রথম সংস্করণ অনুযায়ী ‘তোমার মন বলে চাই চাই চাই গো’ রেকর্ড করেছিলেন যা পরে আর কেউ করেননি। রেণুকা দাশগুপ্ত তাঁর গুরু শৈলজারঞ্জন মজুমদারের করা ‘বসন্তে বসন্তে তোমার কবিরে দাও ডাক’এর স্বরলিপি মেনে ওই গান রেকর্ড করেছিলেন যা প্রচলিত গানের সুরের থেকে কিছু আলাদা (প্রচলিত স্বরলিপি অনাদি কুমার দস্তিদারের করা)। হতাশার কথা, এইসব সুর সুরান্তর কিছুই আর আজ শোনার অবস্থা নেই।

ভাবলে অবাক লাগে, একসময় শ্যামল মিত্র ও সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় কিছু রবীন্দ্রনাথের গান রেকর্ড করেছিলেন যাঁদের পরিচিতি ছিল একেবারে আলাদা জগতে। কিন্তু সেই গায়ন ছিল এতটাই জোরালো, শোনা যায়, তৎকালীন শুধু রবীন্দ্রগানের এক শিল্পী নাকি শ্যামল মিত্রকে অনুরোধ করেন তিনি যেন আর রবীন্দ্রনাথের গান রেকর্ড না করেন, নচেৎ বাকিদের ভাতে মরতে হবে। শ্যামল কথা রেখেছিলেন। কিন্তু এইসব কাহিনিকে আস্বাদ করতে গেলে সেইসব দৃষ্টান্ত কানের কাছে থাকা দরকার। পরিস্থিতির চাপে ও বিপর্যয়ে তা আজ অসম্ভব।

হারিয়ে যাওয়া এই বিপুল সম্পদের কথা ভেবে একটা চিন্তা উঠে আসে- তাহলে কি গানের ইন্ডাস্ট্রিতে আমরা এক ধরনের আধিপত্যবাদের শিকার হলাম? মুদ্রণ সাহিত্যের জগতে সেইভাবে সংগঠিত বিনিয়োগ খুব কম, তাই তার মঞ্চটা যেন অনেক খোলামেলা- তাতে উত্তম অধম মধ্যম সব একসাথে সহাবস্থান করতে পারে। কিন্তু মিউজিক ইন্ডাস্ট্রি গোড়া থেকেই পুঁজি নিবিড়, তার পরিণতিতে আমরা যা পেলাম তা একরকমের হেজিমনি- আমরা গান শুনতে পাই কিন্তু কী শুনব কতটা শুনব তার ওপর আমাদের আর কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই! তাই সবাই আমরা রবীন্দ্রনাথের গান শুনছি ঠিকই- তবু কত শিল্পী চুপি চুপি একা একা হারিয়ে গেলেন বিস্মৃতির প্রান্তরে তার খবর কে রাখে?

 

No comments:

Post a Comment