বিস্মৃতির পাঠ্যক্রম
প্রবুদ্ধ বাগচী
জালিয়ানওয়ালাবাগ। ১৩ এপ্রিল ১৯১৯
স্মৃতি যদি নিতান্ত প্রতারণা না করে তবে একশো দুই বছর পেরিয়ে আসা পুরনো একটা ঘটনা একটু নতুন করে মনে করতে চাই। ১৯১৯-এর এপ্রিল পঞ্জাবের জালিয়ানওয়ালাবাগে ঘটেছিল সেই নৃশংস হত্যালীলা। এই ঘটনার অভিঘাতে রবীন্দ্রনাথের ‘নাইটহুড’ বর্জনের কথাও আমাদের অজানা নয়। যেটা আমরা অতটা খেয়াল করি না তা হল, এই হত্যালীলার অল্প পরেই তৎকালীন কংগ্রেস নেতৃত্ব জালিয়ানওয়ালাবাগে একটি শহিদ-স্মারক নির্মাণের উদ্যোগ নেন। রবীন্দ্রনাথ আন্তরিকভাবে এই প্রচেষ্টা সমর্থন করতে পারেননি। তাঁর মনে হয়েছিল, শহিদ-স্মারকের নির্মাণ মানবসভ্যতার এই কলঙ্ক আর অপমানকে আরও প্রকাশ্য করবে- প্রজন্মের পর প্রজন্ম এই স্মারক দেখে মানসিকভাবে আহত হতে থাকবে। তাঁর বিবেচনা ছিল, লজ্জার স্থানকে প্রকাশ্যে আলাদা করে চিহ্নিত না করাই বিধেয়।
তথ্যগত ভাবে এটা অনেকেই জানেন, ১৯১৯-এর শেষে কংগ্রেসের যে জাতীয় অধিবেশন হয়, সেখানে কংগ্রেস দলের একাংশ রবীন্দ্রনাথের ‘নাইটহুড’ প্রত্যাখানের সিদ্ধান্ত সমর্থন করেননি, তারা সম্মেলনে এই নিয়ে প্রস্তাব নিয়ে এলেও তা সভায় অনুমোদন করানো যায়নি। কিন্তু শহিদ-স্মারক নির্মাণের প্রস্তাব পরিত্যক্ত হয়নি। ওই অকুস্থলের শহিদ-স্মারক পরবর্তীকালে পর্যটকদের গন্তব্য হয়ে ওঠে। সম্প্রতি আমাদের ‘অম্রুত মহোৎসব’-এ মাতোয়ারা কেন্দ্রীয় সরকার সেই শহিদ-স্মারকের খোলনলচে বদলে ফেলে সেটাকে একটা সেলফি তোলার ‘বিউটি স্পট’ করে তুলেছেন— বাহারী আলো, রঙিন দেওয়াল, ঝকমকে পরিবেশসজ্জা এসবের ছবি দেখে মনে হয় হত্যালীলা নয় ওখানে অন্য কোনও ‘লীলাখেলা’ অনায়াসেই সংগঠিত হতে পারে- 'বাঁধো ঝুলনা, তমাল বনে' ইত্যাদি ইত্যাদি! সে অবশ্য ভিন্ন প্রসঙ্গ।
কিন্তু এটা ভেবে বেশ অবাকই লাগে, জালিয়ানওয়ালাবাগের প্রকাণ্ড মাপের নিষ্ঠুরতার স্মারক নিয়ে রবীন্দ্রনাথ যেভাবে ভাবতে চেয়েছিলেন, পরবর্তী একশো বছরের ইতিহাসে সেই ভাবনাটুকুর কোনও গ্রাহ্যতাই তৈরি হয়নি। পরিবর্তে, আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে যেন খাপে খাপে বসে গেছে শহিদ-স্মারক নির্মাণের এক গত বাঁধা প্রবণতা, তার উপলক্ষ যাই হোক না কেন। যদিও খেয়াল রাখা দরকার, স্বাধীনতার আগে ও পরে সমস্ত রাজনৈতিক অভিমুখেরই প্রেক্ষিত বদল হয়ে গেছে স্বাভাবিক নিয়মে। প্রাক-স্বাধীনতার আমলে শাসকের বিরোধিতাই ছিল দেশপ্রেম, স্বাধীনতার চৌকাঠ পেরিয়ে তারই ডাকনাম দেশদ্রোহিতা। কিন্তু শহিদ-বেদি তৈরি হওয়া বা তৈরি করার অভিমুখ কি তেমন একটা পাল্টেছে কোথাও? বড় জোর, স্বাধীনতা-পূর্ব সময়ে তৈরি শহিদ-বেদি যদি সাম্রাজ্যবাদী হিংসার বিপরীতে দাঁড়িয়ে থাকে, তবে উত্তর-সাতচল্লিশে তাই হয়ে ওঠে বিরোধী রাজনীতির সম্বল। আসলে শাসক ও বিরোধীর চেনা দ্বৈরথের মধ্যে শহিদ-বেদি সব সময়েই বিরোধী রাজনীতির অহংকার ও আয়ুধ, তার রাজনৈতিক উত্তাপ বাড়ানোর বারুদ। বিরোধী মানে বিশেষ কোনও রাজনৈতিক দল নয়, বিরোধী মানে একটা পক্ষ- অনেকটা চন্দ্রকলার দুটি পক্ষের মতোই অনিবার্য। সময়ের সার্কাস বা গণতন্ত্র যাই বলি না কেন, সেখানে এই দুই পক্ষের অবস্থান বদল ঘটে, ঘটতেই পারে। কিন্তু এই সার্কাসের অ্যারেনায় শহিদ-বেদি খুঁজে পাওয়া যাবে না।
মনে করে দেখা যেতে পারে, স্বাধীনতার মাত্র তিন মাসের মধ্যে ( নভেম্বর ১৯৪৭) ‘আজাদ হিন্দ দিবস’ স্মরণ অনুষ্ঠানে বামপন্থী ছাত্র যুবদের মিছিলে পুলিশ লাঠি চালায়। বছর খানেকের মধ্যেই বন্দর শ্রমিকদের ওপর পুলিশের গুলি (সেপ্টেম্বর ১৯৪৮) আর ‘স্বাধীন’ ভারতের দু' বছরের মধ্যেই কলকাতার রাজপথে বামপন্থী মহিলা সংগঠনের মিছিলে পুলিশের গুলি চালনায় মৃত্যু হয় চারজন নারীর (২৭ এপ্রিল ১৯৪৯)- এঁদের স্মরণে কলেজ স্ট্রিট-বউবাজার স্ট্রিটের সংযোগস্থলে তৈরি হয়েছিল একটি শহিদ-বেদি। তার অল্প আগে তেভাগা আন্দোলন-পর্বে বা তার পরে খাদ্য আন্দোলনের অভিঘাতে প্রশাসনিক নিষ্ঠুরতা ঘটেছে বারবার- কলকাতা সহ সারা রাজ্য জুড়ে তৈরি হয়েছে অগুনতি শহিদ-বেদি। তৈরি হয়েছে, কারণ পুলিশি বর্বরতা ও মৃত্যুও ঘটেছে সমানতালে যার অনুষঙ্গ ছিল প্রতিবাদ ও গণআন্দোলন।
ষাটের দশকের শেষ থেকে নকশালবাড়ির কৃষি অভ্যুত্থান নতুন করে শহিদ-বেদি তৈরির উপলক্ষ তৈরি করে দিতে থাকে। সেই উত্তাল রাজনীতির সুতীব্র অভিঘাতে শহিদ-বেদি শব্দটির গায়ে জড়িয়ে যেতে থাকে অন্য এক মাত্রা। পাশাপাশি পুলিশবাহিনীর সন্ত্রাসের সঙ্গে যোগ হতে থাকে আন্তঃপার্টি সংঘর্ষ ও হত্যা। যে হননপর্বকে আরও সংক্রামিত হতে দেখা যাবে সত্তর দশকের প্রথম অধ্যায়ে। সেইসব শহিদ-বেদির গায়ে উৎকীর্ণ থাকবে ‘কংগ্রেসি ঘাতকবাহিনীর হাতে নিহত’ বা ‘শোধনবাদী প্রতিক্রিয়াশীলদের সন্ত্রাসের বলি’ অথবা ‘প্রতিবিপ্লবীদের নিষ্ঠুর আক্রমণে হত’ এইরকম সব বিশেষণ। তারপর ক্রমশ পাড়ায় পাড়ায় ছড়িয়ে পড়বে অবিশ্বাস আর সংশয়-লালিত দিশাহীন খুনোখুনি। ধারাবাহিকতার পথ বেয়ে কখনও তার নাম হবে ‘শ্রেণিশত্রু খতম’, কখনও ‘সমাজবিরোধীদের বিরুদ্ধে জনরোষ’ ইত্যাদি। এরপরেই পশ্চিমবাংলার রাজনীতিতে ঘনিয়ে উঠবে 'কংশাল' নামক এক আশ্চর্য ফিউশন, তারপর জরুরি অবস্থার পদধ্বনিতে শেষ হয়ে আসবে বঙ্গ-রাজনীতির এক বিশেষ পর্ব। পাড়ায় পাড়ায়, অখ্যাত মফস্বলের মোড়ে মোড়ে তৈরি হতেই থাকবে শহিদ-বেদি। বুকে হাত রেখে বলা যায়, তবু শহিদের সংখ্যা শহিদ-বেদির থেকে অনেক বেশি।
এর পরের তিন দশকে বাংলার রাজনীতি রঙ পাল্টাবে কিন্তু শহিদ-বেদির ঢং পাল্টাবে না। অগত্যা আবারও তৈরি হতে থাকবে শহিদ-বেদি– এমনকি কোথাও কোনও শহিদের অনুষঙ্গ না থাকলেও ঐতিহাসিক অক্টারলোনি মনুমেন্ট নাম পাল্টে হয়ে যাবে ‘শহিদ-মিনার’! শুধু শহিদের নামের পাশে কতকগুলো অক্ষরের অদলবদল জানিয়ে দেবে বিশেষণের মাত্রা সরে যাওয়ার বার্তা। আমার আপনার মতো পথচলতি সাধারণ মানুষ হঠাৎই চমকে উঠে খেয়াল করব ঘাতকের নামের আগে বসে গেছে ‘বামপন্থী সমাজবিরোধী’ অথবা কোনও বিশেষ দলের ‘হার্মাদবাহিনী’ কিংবা ‘জল্লাদবাহিনী’ এমন সব সরাসরি উচ্চারণ। এমনকি জমি আন্দোলনের সূত্রে ধর্ষিতা ও হত কিশোরীর স্মরণেও গড়ে উঠবে শহিদ-বেদি- একেকটি বর্বরতাকে ইট-বালি-সিমেন্ট-মার্বেল ফলক দিয়ে স্থায়ী করে তাকে লোহার রেলিং দিয়ে ঘিরে দেওয়া হবে চিরকালের মতো। যাতে আমরা শিউরে উঠি, স্তব্ধ হয়ে যাই ক্ষণিকের মতো।
কিন্তু ইট-বালি-সিমেন্টের তো কোনও চেতনা থাকে না- অথচ প্রতিটি শহিদ-বেদির পেছনে আছে এক বা একাধিক প্রাণ, নানা বিভঙ্গের চেতনা, বর্ণিল স্বপ্ন। খুব বেশি পিছিয়ে না গেলেও অন্তত গত পঞ্চাশ-ষাট বছরের পুরনো শহিদ- পরিবারগুলি কে কেমন আছে তা আমরা খুব বেশি জানতে পারি না। হয়তো প্রথমত, দ্বিতীয়ত, তৃতীয়ত ও শেষ পর্যন্ত তাঁরা শহিদ হন তাঁদের নামে শহিদ-বেদি তৈরি হবে বলেই! কিন্তু তুমি কেমন আছো শহিদ-বেদি?
এইখানে এসে মন খারাপ। ঘোরলাগা বিষণ্ণতা। সারা রাজ্যের কথা বলার স্পর্ধা নেই। তবে ওই যে বউবাজারের মোড়ে বামপন্থী বীরাঙ্গনাদের শহিদ-স্মারক- ইতিহাসের তথ্য না জানলে ফুটপাথের আবাসিকদের কাপড় শুকোনোর নির্ভরযোগ্য বিকল্প পেরিয়ে ওটাকে খুঁজে বের করা বড় কঠিন। কলেজ স্ট্রিট আর ভবানী দত্ত লেনের সংযোগস্থলের শহিদ-বেদি এই মাত্র কয়েকদিন আগেও ছিল অযত্নে ঢেকে যাওয়া- সম্প্রতি কিছু সংবেদী মানুষ তা সংস্কারে হাত দিয়েছেন। একই দৃশ্য দেখেছি তালতলায়, হাওড়ায়। ঠিক যেমন সিঁথি সার্কাস ময়দানের প্রান্ত ঘেঁষে গড়ে ওঠা বরানগর হত্যাকাণ্ডের শহিদ-বেদি ঢেকে রেখেছে উদ্ধত টিনের পাত, বেআইনি চায়ের দোকান ও অটোস্ট্যান্ডের ইউনিয়ন অফিসের গুমটি। অনেক এলাকায় দেখা গেছে শহিদ-বেদির গা ঘেঁষে জাঁকিয়ে বসেছে পথবাসী শনি ঠাকুরের থান- স্বাভাবিকভাবেই জৌলুশে সেগুলো শহিদের প্রাণের থেকেও বেয়াড়া রকমের প্রোজ্জ্বল। কিছুকাল আগে টিভির পর্দায় দেখা গিয়েছিল বানতলার শহিদ স্মরণে নির্মিত বেদির প্রস্তরফলক উধাও আর অনতিউচ্চ স্তম্ভ ঢেকে গেছে ঝোপঝাড়ে। তালিকা বাড়াতে থাকলে বেড়ে যাবে বিষণ্ণতার উচ্চতা। প্রধান শহরের উল্লেখ্য মোড়ে মোড়েই যখন এই হতশ্রী বাস্তবতা, অনুমান করতে অসুবিধে হয় না উদাসীনতার অসুখ কখন বা মহামারীর আদল নিয়েছে। হয়তো জেলা বা মহকুমার যে সব আনাচ-কানাচ ছেয়ে আছে শহিদ-বেদির সাড়ে তিন হাত জমি সেখানেও বেরঙিন উপেক্ষার দগদগে ক্ষত।
বিতর্ক উঠতেই পারে, যাদের নামে শহিদ-বেদি তাঁরা সকলেই কি শহিদ? ঠিকই। কিন্তু আরও অনেক কিছুর মতো শহিদ কাদের বলা হবে তারও তো কোনও অ্যাবসলিউট সংজ্ঞা দেওয়া মুশকিল। আর যদি-বা কোনও সংজ্ঞা দেওয়াও হয়, তার মধ্যেও কি এসে পড়ে না সমসময়ের রাজনীতির ছাপ ও প্রেক্ষিত? বাঘাযতীনকে আমরা বিপ্লবী শহিদ হিসেবে মেনে নিই কিন্তু তার মৃত্যুর পরে স্টেটসম্যান পত্রিকা তাঁকে ‘টেররিস্ট’ বলে পরিচয় দিয়েছিল! তবে এ পক্ষের ও পক্ষের শহিদ-বেদিতে যাদের নাম প্রকীর্ণ তাঁরা যে কোথাও না কোথাও এক ধরনের হিংসা বা নিষ্ঠুরতার শিকার এ নিয়ে কোনও সঙ্গত বিবাদের অবকাশ নেই। আর, আমরা তো আসলে সেই নিষ্ঠুরতার প্রতিবাদেই বানিয়েছিলাম ওই স্মারক- আর, এই প্রতিকারহীন ঔদাসীন্য কি আমাদের মনে করিয়ে দেয় না বিপরীত এক নিষ্ঠুরতারই ইতিকথা? রবীন্দ্রনাথের কথায় আমরা কান দিইনি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কি ঠিকঠাক আমরা মনে রাখতে পারলাম শহিদদেরও?
এরই মধ্যে একটা বেপরোয়া প্রশ্নের উঁকিঝুঁকি। রাজভবনের দক্ষিণ-পূব কোণে যেখানে নেতাজি সুভাষের মর্মর মূর্তি ‘দিল্লি চলো’র আহ্বানে স্থবির, তার থেকে অল্প দূরেই বিগত বাম সরকারের আমলে স্থাপিত হয়েছে আরক্ষাবাহিনীর শহিদদের এক স্মারক-স্তম্ভ। যেহেতু প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী দ্বারা উদ্বোধিত ও সরকারি উদ্যোগে নির্মিত, ফলে সুসজ্জিত নিটোল স্থাপত্যের কেরামতিও কম নয়। তাছাড়া, রাজধানীর প্রাণকেন্দ্র তথা হাই-সিকিউরিটি জোনে অবস্থিত হওয়ায় ভবঘুরে বা ফুটপাথবাসীদের হাতে বেদখল হওয়া বা ফলক চুরি যাওয়ার সম্ভাবনা শূন্য। অমৃতসরে আগত পর্যটকদের কন্ডাক্টেড ট্যুরে যেমন ইতিমধ্যেই ঢুকে পড়েছে জালিয়ানওয়ালাবাগ- কে জানে, রাজভবন-ইডেন উদ্যান-হাইকোর্ট-ভিক্টোরিয়া স্মৃতিসৌধের সমান্তরালে এই স্মারক-স্তম্ভও হালের কলকাতায় আগত পর্যটকদের দ্রষ্টব্যের তালিকায় ঢুকে পড়েছে কিনা! আরক্ষাবাহিনীর শহিদ-স্মারক দেখতে দেখতে ভ্রমণ পিপাসুরা জানতেও পারবেন না এই বাহিনীর হাতে আক্রান্ত কত শত শহিদ বেদি ডুবে রয়েছে স্রেফ নাগরিক বিস্মৃতির অন্তরালে! এইখানে এসে আড়ষ্ট হয়ে যেতে হয়। ক্ষমতার বিরুদ্ধে মানুষের যে লড়াই আসলে কি তা বিস্মৃতির বিরুদ্ধে স্মৃতিরই যুদ্ধ নয়?
ভাববার মতো লেখা, একেবারে আলাদা । 🤔👌🏼👌🏼👌🏼👌🏼
ReplyDeleteThanks
ReplyDelete