Tuesday, 14 April 2020

নববর্ষের কথা

হন্তারক দৈত্যকে বোতলবন্দি 
করার রক্ষাকবচ প্রকৃতির হাতেই
অনিরুদ্ধ মুখোপাধ্যায়
 
ভাবি, আজ অন্তত আমরা একসাথে ভাবি।
 
যে নির্জন দ্বীপে আজ আমরা সবাই বসে আছি- কেন এখানে এলাম? কী এমন হল যার জন্য আমাদের এই বাধ্যতা? বরং চোখে দূরবীন লাগাই। দুর থেকে, হ্যাঁ, আমাদের রেখে আসা অতীতকে দেখি। আর চারপাশের আমাদের ক্রিয়াকলাপে চোখ রাখি। 

আমরা সুন্দর সুন্দর কথা বলি বিস্তর। মুখে লেগে থাকে হিসেবি হাসি। উন্নয়নের জোয়ারে আমরা গা ভাসাই। বাড়িতে আমি পাখির ছবি টাঙাই। নদীর পাড়ের হোটেলে আমি দিনযাপন করি। সমুদ্রতীরে গাড়ি ছোটাই। জলাভূমিকে মুহূর্তে উধাও করি। আমাদের রচিত শিল্পে বাতাসে জলে অন্ধকার নেমে আসে। প্রিয় সুর কখন উৎকট চীৎকার হয়ে যায়। স্বাভাবিক খাদ্য অস্বাভাবিক হয়ে যায় রাসায়নিক সখ্যের চক্রান্তে। বলি বটে জঙ্গলের রূপে আমরা মুগ্ধ- সে আমাদের কথার কথা। বরং যুগ যুগ ধরে যা কিছু স্বাভাবিক নিয়মে বাঁধা- এই আমরা আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে- তার ওপর আগ্রাসন চালিয়েছি। নিন্দুকরা তো হন্তারকও বলেন। ঐ নিন্দুকরা আসলে না-মানুষের দল। আমরা আমাদেরই তৈরি করা  শব্দবন্ধে উত্তর-আধুনিক সভ্যতার সীমা বাড়িয়ে চলেছি। ম্যাজিক দেখিয়ে গিয়েছি অন্যদের। হাতিয়ার করেছি অর্থ ও প্রযুক্তিকে। অবাক হয়ে সহনাগরিকেরা বুঝে না বুঝে যত হাততালি দিয়েছে, আমরা উচ্চকিত হয়েছি। আরও ম্যাজিক আরও। আমরা ভাব দেখিয়েছি আমরা আরোপিত ঈশ্বর- সব পারি, সব জানি, গতিবিধি আমার সর্বত্র। এভাবেই চলেছে যুগের পর যুগ, শতাব্দীর পর শতাব্দী। আমাদের মতো করে আমরা আমাদের মনের ভূগোল ইতিহাস তৈরি করেছি। আমরাই স্থির করেছি প্রথম বিশ্ব-দ্বিতীয় বিশ্ব, সাদা-কালো, উন্নত-অনুন্নত কত না বিভাজন।

অতঃপর এই নির্জন দ্বীপে আজ
আমরা সবাই। সব পাওয়া আর সবহারারা এখন একই শৃঙখলে। একে অপরের প্রাণরক্ষার খাতিরে দ্বীপান্তরে। হানা দিয়েছে দৈত্য। অজানা দৈত্য প্রাণ নিতে এসেছে। অপ্রস্তুত পৃথিবী জুড়ে ত্রাস। আত্মকেন্দ্রিক ভোগক্লান্ত বৃহত্তর সমাজ তৈরি ছিল না এসবের তরে। আর তৈরি থাকবেই বা কীভাবে? আমরাই তো অনেকে বলে আসছিলাম, জলবায়ু পরিবর্তন- ওসব আবার কী? অ্যামাজন পুড়েছে? পুড়ুক না! অস্ট্রেলিয়ার আগুন লাগা অরণ্য থেকে বেরিয়ে পড়েছে মা কোয়ালা? কী এমন হয়েছে যদি মেষভালুক বা বাঘেরা হেঁটে বেড়ায় জাতীয় সড়কে? শত শত বছরের গাছেদের প্রকাশ্য নিধনও যেন তাদের প্রাপ্য- অনেকদিন তো বেঁচেছ। তোমরা মনুষ্যেতর- অনেক হয়েছে। আমরা বাড়তে বাড়তে দেখ প্রায় সাড়ে সাতশো কোটি গোটা বিশ্বে। আমাদের জায়গা দাও। পথ ছাড়ো তোমরা। আমরা চাঁদে গিয়েছি, গ্রহান্তরে যাওয়ার স্বপ্ন দেখি। আমরা বাজার জানি। বাজারও তার সেরা বিনোদনের বস্তুটিকে চিহ্নিত করে ফেলেছে। হঠাৎ কী যে হল! বলছিলাম না, অচেনা দৈত্য এসে পড়েছে। নিজেকে সে পরিবর্তন করে দ্রুত। সে শ্বাসঘাতী অত্যাচার করে। মৃত্যুর আগে ডুবে মরার অনুভূতি জোগায়। সেও হন্তারক। সেও অদৃশ্য। সেও ম্যাজিক জানে। সেও লড়াইয়ের কৌশল শিখে ফেলেছে। পালিয়ে বেড়াচ্ছি আমরা দ্বীপ থেকে দ্বীপান্তরে। কী পরিহাস এই বসন্তের। আপনি নির্বাক। বরং সবাক হয়েছে না-মানুষেরা।

যদি আমাদের আর্তি, আমাদের বোধ প্রকৃতির মায়াজালকে টলাতে পারে সেটাই হবে শেষ সুযোগ। সেই সুযোগ কাজে লাগানোর জন্য এখনও পড়ে আছে সামান্য কিছু প্রকৃতি ও তার সন্তানেরা। আসুন, আমরা সবাই এই অন্যরকম নতুন বছরের শুরুতে তাদের দিকে স্নেহ ভালোবাসার হাত বাড়িয়ে দিই। আজ আমাদের দুর্দিনের এই দ্বীপান্তরে প্রকৃতিরও যে মনখারাপ। প্রকৃতির সন্তানেরা তো আমাদের ভালবাসতেই চেয়েছিল। ভুললে চলবে না, এই হন্তারক দৈত্যকে বোতলবন্দি করার রক্ষাকবচও কিন্তু প্রকৃতির হাতেই।
 নব আনন্দে জেগে ওঠার সুযোগ বিশ্বপ্রকৃতি মানবসভ্যতাকে নিশ্চয়ই আরেকবার দেবে।

No comments:

Post a Comment