Wednesday, 11 December 2019

জীবনের পক্ষে

গ্রেট ওয়ার্ক গ্রেটা
ইন্দিরা ব্যানার্জী
'ওরে নবীন, ওরে আমার কাঁচা, ওরে সবুজ, ওরে অবুঝ, আধমরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা' - দূরদর্শী কবির কলমে তারুণ্যের জয়গান। যখনই অন্যায়-আক্রোশ-অসহিষ্ণুতা তখনই আগামী প্রজন্মের প্রতিরোধ। সে স্বাধীনতা-শিক্ষা-ভাষা বা পরিবেশ যে কোনও ক্ষেত্রেই সাবলীল। গরম রক্তের উর্জায় পরিবর্তিত হতে বাধ্য হয়েছে যা কিছু গতানুগতিক।

এমনই কোন বাধায় হার না মানা 'যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চল রে' মতে বিশ্বাসী এক উজ্জ্বল নক্ষত্র সুইডেনের স্টকহোম নিবাসী গ্রেটা থুনবার্গ। যে মাত্র ষোল বছর বয়সেই বিশ্বের কাছে পরিবেশ সচেতনতার উদাহরণ হয়ে উঠেছে আত্মদীপ্তিতে।

ইউরোপের সুইডেন নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ুর দেশ। যেখানে জুন-জুলাই মাসে ২০-২৫ সেন্টিগ্রেড এবং জানুয়ারি ফ্রেবুয়ারিতে মাইনাসে উষ্ণতা থাকে। কিন্তু ২০১৮ সালটি নাসার বিজ্ঞানীদের মতে, সুইডেনের উষ্ণতম বছর। সে বছরেই ক্রমাগত দাবানল, খরা, উষ্ণপ্রবাহ গড় তাপমাত্রাকে বাড়িয়েছে এবং এ রকম চলতেই থাকলে ২০৮০ সালের মধ্যে গড় উষ্ণতার সাত ডিগ্রি বৃদ্ধি নিশ্চিত। এমন সব ভবিষ্যৎবাণী ভিত নাড়িয়ে দিয়েছিল স্টকহোমের ক্লাস নাইনে পাঠরতা গ্রেটার। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সুস্থ পরিবেশের জন্য সে বেছে নিল 'স্ট্রাইক ফর ক্লাইমেট'এর মতো কর্মসূচি।

গ্রেটার চলার পথ মসৃণ ছিল না। ২০১৮ সালের আগস্ট মাসে একটানা তিন সপ্তাহ স্কুল বয়কট করে সুইডিশ পার্লামেন্টের সামনে জলবায়ুর ভারসাম্য রক্ষার আর্জি নিয়ে ঠায় বসে ছিল গ্রেটা। শুধু তাই নয়, জনমত জোগাতে লিফলেট বিলি করছিল ছোট ছোট হাত। প্রথমে তার স্কুলের সহপাঠীরাও তাকে সাথ দেয় নি কিন্তু কিছু দিনের মধ্যেই মিডিয়ার দৌলতে গ্রেটার আন্দোলন এবং প্রতিবাদের ভাষা জনপ্রিয়তা পায়।

এরপর ইউরোপের বিভিন্ন দেশ যেমন, জার্মানি-বেলজিয়াম-যুক্তরাজ্য-ফ্রান্স ছাড়াও অস্ট্রেলিয়া-জাপান-বাংলাদেশ সহ মোট ১০৫টি দেশের ১৬৫৯টি স্থানে পরিবেশ রক্ষার জন্য কমিউনিটি গড়ে ওঠে। যারা 'ফ্রাইডে ফর ফিউচার' কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করে।

এ প্রসঙ্গে খাইবার প্রদেশ নিবাসী মালালা প্রসঙ্গ মনে পড়ে যায়। মালালা যেমন সবার জন্য শিক্ষা প্রসঙ্গে বলে 'একটি শিশু, একজন শিক্ষক, একটি বই আর একটি কলম দুনিয়া বদলে দিতে পারে। শিক্ষাই একমাত্র সমাধান।' তেমনি গ্রেটা জলবায়ুর পরিবর্তন সংক্রান্ত বিষয়ে গ্রিন হাউস গ্যাস নিষ্কাষণ কমানোর পক্ষে নিজের মতামত দিতে গিয়ে বলে, 'আমি এখন জলবায়ুর ক্ষেত্রে ন্যায়বিচারের পক্ষে।'

২০১৫ সালে ১৯৫টি দেশের ঐক্যমতের ভিত্তিতে গ্রিন হাউস গ্যাসের উৎপাদন কমানোর জন্য প্যারিস চুক্তি হয় যা পরবর্তী সময়ে অর্থনৈতিক উন্নয়নের অজুহাতে ইউরোপের অনেক দেশ বাতিল করে। গ্রেটা এই চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য জোরালো যুক্তি উপস্থাপন করে। গ্রিন হাউস গ্যাস সংক্রান্ত বিষয়ে সে বলে, 'যদি নিষ্কাষণ থামাতে হয় তাহলে তা থামাতেই হবে। আমার কাছে বিষয়টা সাদা-কালো। টিঁকে থাকাই যখন বিষয়, তখন ধূসরতার কোনও জায়গা নেই।'

জলবায়ুর সাম্য রক্ষায় গ্রেটার এই আন্দোলন ও বিশ্ববাসীর কাছে এর গ্রহণযোগ্যতার জন্য ২০১৯-এর মে মাসে টাইম ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদ তাকে নিয়ে। শিরোনাম 'নেক্সট  জেনারেশন লিডার'। পরিবেশ বাঁচাতে গ্রেটার ভূমিকা ও তার প্রভাব 'গ্রেটা থুনবার্গ এফেক্ট' নামে পরিচিত।

'ছোট্ট ছোট্ট পায়ে চলতে চলতে ঠিক পৌঁছে যাব' - লক্ষ্যে অবিচল গ্রেটা ব্যক্তিগত জীবনে কার্বন ফুট প্রিন্ট কমানো, মাংস ভক্ষণ না করা, প্লেনে সফর বাতিল করে পরিবেশ রক্ষা বিষয়ে নিজের ভূমিকা পালন করেছে। জাতি সংঘে বিশ্ব নেতাদের উদ্দেশ্যে তার দৃঢ় ঘোষণা 'বাস্তুতন্ত্র ধ্বংস করে, পরিবেশকে না বাঁচিয়ে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি কেবল ফাঁকা রূপকথা'।'

সত্যিই স্থিতিশীল উন্নয়নে পা মেলাতে গ্রেটার মতো আবেগী কিন্তু সাহসী ব্যক্তিত্বের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকারের প্রশ্নই আসে না।

No comments:

Post a Comment