Thursday 30 September 2021

কংগ্রেস’এর ইতি!

‘কংগ্রেসি ডায়াসপোরা’র খোঁজে?

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য

 

গোয়ার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ও কংগ্রেস নেতা ফেলেইরো কলকাতায় তৃণমূল দলে যোগদান করে সাংবাদিকদের সামনে এক গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেছেন, দেশের সব থেকে পুরনো দল কংগ্রেস আজ নানা শিবিরে বিভক্ত, যেমন, তৃণমূল, ওয়াইএসআর, এনসিপি, ইন্দিরা কংগ্রেস এমনতর আরও বিবিধ; বিজেপি’কে মোকাবিলা করতে হলে এই ভাঙ্গা কংগ্রেস পরিবারের একতা জরুরি। উল্লেখ্য, ঠিক তার আগের দিন কানহাইয়া কুমার কংগ্রেসে যোগদান করতে গিয়ে বলেছেন যে, কংগ্রেস যদি না থাকে তাহলে দেশ থাকবে না।

উপরের দুই নেতার বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিত আলাদা হলেও অন্তঃসার এক: নতুন করে কংগ্রেস মতাদর্শের পুনর্জাগরণ। কিন্তু এটা স্পষ্ট, দু’ বছরেরও বেশি সময় ধরে সভাপতিহীন একটি দল, যা একের পর এক নির্বাচনে পর্যুদস্ত হয়ে চলেছে, জাতীয় স্তরে বিজেপি’র দুর্দমনীয় শক্তির কাছে যাকে নেহাতই দুর্বল ও বিভ্রান্তিকর বলে সাব্যস্ত হয়, সেই দলের যদি সত্যি সত্যি উঠে দাঁড়ানোর কোনও আবহ তৈরি হয়, তবে তা দলের বর্তমান শীর্ষ নেতৃত্বের দ্বারা একেবারেই সম্ভব নয়। তাহলে কি কংগ্রেসের ইতি সমাগত? এখানেই বোধ হচ্ছে, ১২৫ বছরেরও বেশি পুরনো একটি বৈচিত্র্যময় দলের ‘ডায়াসপোরা’ বলে যদি কোনও পরিসর থেকে থাকে অথবা আজকের পরিস্থিতিতে তা নতুন আলোকে নির্মিত হয়, সে ক্ষেত্রে হয়তো এক নতুন অভিযোজন অসম্ভব কিছু নয়; যা টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়া সাংগঠনিক অস্তিত্বকে এক খোলামেলা মঞ্চে এনে মেলাতে পারে। যাকে আমরা আজকের পরিপ্রেক্ষিতে, পশ্চিমি বর্গ ধার করে বলতে পারি ‘সমাজ-গণতন্ত্রী’ সংহতি। এই সংহতি কি গান্ধী পরিবারের নেতৃত্বের অপরিহার্যতাকে নাকচ করেই নতুন এক কংগ্রেস দলের জন্ম দেবে, নাকি অন্য কোনও নতুনতর মঞ্চ, জোট অথবা দলে এর উত্তরণ ঘটবে, তা এখুনি বলা সম্ভব নয়।

২০২২’এর ফেব্রুয়ারিতে উত্তরপ্রদেশের বিধানসভা এবং তারপর ২০২৪’এর লোকসভা নির্বাচন- এই দুটিকে আপাতত ধরা যেতে পারে ভারতীয় গণতন্ত্র তথা রাজনীতি ও অর্থনীতির এক নির্ধারক মাইলফলক। আগামী দিনে দেশ ও দশের ভাগ্যনিয়ন্তা কে হবে- চরম বিভাজনকামী, একরোখা কর্পোরেট-স্বার্থ সম্বলিত, ধর্মীয় মৌলবাদী ও উগ্র রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা সম্পন্ন একটি দল, নাকি, এক আপেক্ষিক উদার সমাজ-গণতান্ত্রিক এমন এক জোট যা সর্ব অর্থে অন্তত কিছুটা হলেও মানুষের গণতন্ত্র ও রুটি-রুজির সমস্যাকে অগ্রাধিকারে রাখবে। বলাই বাহুল্য, দ্বিতীয় পথটিকে গড়ে তুলতে হলে ‘কংগ্রেসি ডায়াসপোরা’র (কংগ্রেস দল বলছি না) সমাজ-গণতন্ত্রী হয়ে ওঠাটা যেমন জরুরি, তেমনই বাম মতাদর্শের আরও বাস্তবানুগ ও প্রকৃত অর্থে গণতন্ত্রপ্রিয় হয়ে ওঠাটাও সমান প্রাসঙ্গিক

বুঝতে হবে, স্বাধীনতা উত্তরকালে (গত শতকের ৯০’এর দশক অবধি) কংগ্রেসের নানা অনাচারের বিরুদ্ধে কার্যকরী বিরোধী শক্তি হিসেবে তিনটি ধারাকে আমরা দেখতে পেয়েছি: ১) বাম ধারা ২) দক্ষিণ ভারতের আঞ্চলিক শক্তি (প্রথমে তামিলনাড়ু ও পরে অন্ধ্রপ্রদেশ) এবং ৩) কংগ্রেসের সমাজতান্ত্রিক ধারা (যা জয়প্রকাশ নারায়ণের উদ্যোগে জনতা পার্টি গঠন ও পরে তার ভাঙনের মধ্য দিয়ে মূলত উত্তর ভারতে আঞ্চলিক দলে পরিণতি পেয়েছিল)। এছাড়াও স্বতন্ত্র পার্টি ও জনসঙ্ঘীদের একটা ধারা ছিল বটে কিন্তু তা কখনও শক্তিশালী হতে পারেনি ৯০’এর দশকের আগ পর্যন্ত। আজ এই পট সম্পূর্ণতই উল্টে গেছে। সারা ভারতে বিজেপি আজ মুখ্য রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে এবং কংগ্রেস সহ কংগ্রেস-বিরোধী দলগুলি বিরোধী অবস্থানে নিমজ্জিত হয়েছে। কিছু কিছু রাজ্যে কংগ্রেসের সঙ্গে তার অতীতের বিরোধীদের নির্বাচনী সমঝোতাও সম্ভবপর হয়েছে (যেমন বিহার, অসম, তামিলনাড়ু)। কিন্তু এই বিরোধী জোটগুলির ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য প্রবণতা হল, যেখানে যেখানে কংগ্রেস মুখ্য দল হিসেবে অবস্থান করছে সেখানে সেখানে বিরোধীদের মহাজোট কার্যকরী ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে। অন্যদিকে, আঞ্চলিক শক্তিগুলি যেখানে মুখ্য অবস্থানে আছে, সেখানে বরং বিরোধী জোট অনেক ভালো ফল করতে পারছে। অর্থাৎ, রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে কংগ্রেস দল বহুল পরিমাণে পরিত্যক্ত অথবা অবিশ্বাসযোগ্য হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। এর নানাবিধ কারণ আছে কিন্তু সবচেয়ে বড় কারণ সম্ভবত বর্তমান গান্ধী পরিবারের নেতৃত্বের অপরিণামদর্শিতা। তারা শুধুমাত্র মতাদর্শগত ভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছে তাই নয়, রাজনৈতিক কার্যক্রমেও তাদের তীব্র অনীহা এবং সোশ্যাল মিডিয়া নির্ভর এক দায়সারা গোছের দায়িত্ব পালন করা ছাড়া তারা আর বিশেষ কিছু করেও উঠতে পারছে না। যেটুকু যা সাফল্য তারা কিছু রাজ্যে পেয়েছে তা অনেকটাই সেই সব রাজ্যে কংগ্রেসের আঞ্চলিক নেতৃত্বের কৃতিত্বেই। আমার একেবারেই মনে হয় না, রাহুল গান্ধী বা প্রিয়াঙ্কা বঢড়া’র নেতৃত্বে কংগ্রেসের আদৌ কোনও ভবিষ্যৎ আছে। ইতিমধ্যে কংগ্রেসের অভ্যন্তরে কপিল সিবালের নেতৃত্বাধীন জি-২৩ গোষ্ঠী এ বিষয়ে যথেষ্ট সোচ্চার।

তাহলে প্রশ্ন হল, কংগ্রেসের আদৌ কি কোনও ভবিষ্যৎ নেই? এর উত্তর দেওয়ার সময় এখনও আসেনি। গোয়ার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ফেলেইরো ও প্রশান্ত কিশোরের নানান বক্তব্য ও কার্যকলাপে এমন একটা মালুম হচ্ছে যে ‘কংগ্রেসি ডায়াসপোরা’র যদি সত্যিই কোনও অস্তিত্ব থেকে থাকে, তাহলে তাকে হাতিয়ার করে কংগ্রেসের এক মহামঞ্চ হয়তো আগামী দিনে পুনর্গঠিত হতে পারে। সেই মঞ্চের নাম ‘জাতীয় কংগ্রেস’ হবে নাকি ‘তৃণমূল কংগ্রেস’ অথবা অন্য কোনও নতুন কিছু, তা এখনও ভবিষ্যতের গর্ভে, কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে এই ক্ষেত্রে অত্যন্ত এক উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করতে চলেছেন তা কতকটা স্পষ্ট।

এর পাশাপাশি, রাজ্য ভিত্তিক আঞ্চলিক, সমাজবাদী ও বাম দলগুলির ভূমিকাও অতীব গুরুত্বপূর্ণ। কংগ্রেসি ডায়াসপোরা যদি বহুল পরিমাণে সমাজ-গণতন্ত্রী হয়ে উঠতে পারে (অর্থাৎ, তাকে সমাজবাদ ও গণতন্ত্র- উভয় দিকেই সদর্থক দৃষ্টি ফেলতে হবে), তাহলে বিজেপি-আরএসএস’এর বিরুদ্ধে বাম ও অন্যান্য সমাজবাদী শক্তির সঙ্গে তার স্বাভাবিক সখ্য গড়ে ওঠায় কোনও বাধা থাকার কথা নয়। কারণ, গত দু’ দশকে বিজেপি-আরএসএস এ দেশে যে শক্তি সঞ্চয় করেছে তা একটা সুদৃঢ় মতাদর্শগত ভিত্তির ওপরে দাঁড়িয়েই, যা উগ্র হিন্দুয়ানার বনিয়াদের ওপর স্থিত। আর ইতিহাস বলে, এই ধরনের উগ্র মতাদর্শকে মোকাবিলা করতে পারে সক্ষম সমাজ-গণতন্ত্রী ও বাম মতাদর্শ। যদি বামেরা তাদের সংগঠন, প্রভাব ও মতাদর্শের জোরে এই কাজটা করতে সক্ষম থাকতেন, তাহলে তার চেয়ে বেশি মঙ্গলজনক আর কিছু হত না। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, বামেরা গত দু’ দশকে দেশ জুড়ে ক্রমেই দুর্বল হয়েছেন (কিছু ব্যতিক্রম ব্যতীত) এবং পশ্চিমবঙ্গের মতো অগ্রণী বাম রাজ্যে তাদের একটা বড় অংশ বিজেপি’কে বিপুল আকারে ভোট দিয়েছেন। শুধুমাত্র ভোট দেননি, বাম শক্তির বহু অংশ (নেতা-কর্মী সহ) বিজেপি দলে নামও লিখিয়েছেন এবং রাজ্য বাম শীর্ষ নেতৃত্বের পক্ষ থেকে বিজেপি’র বিপদকে হাল্কা ভাবেও নেওয়া হয়েছে (‘২১’এ রাম/ ২৬’এ বাম’ বলে)। এর পাশাপাশি, তৃণমূলেরও বহু নেতা-নেত্রী হেলায় বিজেপি দলে যোগ দিয়েছেন এবং তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ আবার পরবর্তীকালে নিজ দলে ফেরত এসেছেন। অর্থাৎ, ভাবটা এমন, সব দলই একইরকম, নিজের আখের গোছাতে সুবিধামতো কোনও এক দলে গেলেই হল। অতএব, মতাদর্শগত সমস্যাটা শুধুমাত্র বামেদের ক্ষেত্রে নয়, তৃণমূল সহ অন্যান্য বিজেপি বিরোধী দলগুলির ক্ষেত্রেও সমান সত্যি। ফলে, অ-বাম দলগুলির ক্ষেত্রে সমাজ-গণতন্ত্রী মতাদর্শকে শক্ত ভাবে আত্মস্থ করাটা যেমন একটি রাজনৈতিক কর্তব্য, অনুরূপ ভাবে, বামেদের ক্ষেত্রেও বাম মতাদর্শকে যথাযথ ভাবে আয়ত্ব করাটাও সমান জরুরি।

সবটা মিলিয়ে, আজ যদি বিজেপি-আরএসএস’এর উগ্র হানাহানি থেকে দেশকে উদ্ধার করতে হয়, তাহলে সম্ভাব্য সমাজ-গণতন্ত্রী শক্তির সঙ্গে বামেদের মোর্চা অবশ্যম্ভাবী ভাবে জরুরি। অবশ্য তার আগে সমাজ-গণতন্ত্রী পরিসর সত্যি সত্যি কতটা গড়ে উঠল এবং বাম মতাদর্শ কতটা বাস্তবিক শক্ত জমির ওপর দাঁড়াতে পারল ও শ্রমজীবী মানুষের আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হল, তার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে।

2 comments:


  1. এই বিশ্লেষণের গোড়ায় গলদ। যে তৃণমূল দলকে বিজেপি বিরোধী বলা হচ্ছে তা কি আদৌও সঠিক? যদি বিজেপি বিরোধীই হবে তবে একের পর এক জনবিরোধী বিল লোকসভা ও রাজ্য সভায় পাশ করামোর সময় তাদের কি ভূমিকা ছিল তা দেশবাসী দেখেছে তাই নয় কি? লেখাটায় বাজারী পেড মিডিয়া যে ভানে দলটিকে মুশকিল আাসন হিসেবে তুলে ধরে সেই একই কথা একটু ঘুরিয়ে তুলে ধরার চেষ্টা হয়েছে মাত্র। কংগ্রসের নেতৃত্বে যে প্রকৃত বিরোধী জোট তৈরীর চেষ্টা চলছে তাতে জল ঢালার প্রচেষ্টা নয় কি?

    ReplyDelete
  2. গান্ধি পরিবার ছাড়া কংগ্রেস এক্যবদ্ধ হবে না।
    আঞ্চলিক দল মিলিতভাবে একটা মঞ্চ তৈরি হতেই পারে। বাম অনৈক্য একটা বাধা।
    তবে বিকল্প সম্ভাবনা আছে।
    বিজেপি ২২পর ধরাশায়ী হবেই।

    ReplyDelete