কৃষক আন্দোলনের তৃতীয় ঢেউ
সোমনাথ গুহ
আন্দোলনের প্রথম পর্ব ছিল ২০২০'র ২৬ নভেম্বর থেকে প্রজাতন্ত্র দিবস অবধি, যেদিন কেন্দ্রীয় শাসক দলের ভাড়াটে গুণ্ডারা কৃষকদের মিছিলে ঢুকে পড়ে হিংসা ছড়ায় এবং শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদকে কলঙ্কিত করার চেষ্টা করে। আন্দোলন ধাক্কা খায়। পুলিশি দমনপীড়ন তীব্র হয়, সঙ্ঘীদের চোরাগোপ্তা আক্রমণে সন্ত্রাস সৃষ্টি হয়। কয়েক দিন বাদেই মুজাফরনগরের এক মহাপঞ্চায়েতে বিপুল জনসমাবেশ হয়, আন্দোলন পুনর্জীবিত হয় ও দ্বিতীয় ঢেউয়ের সূচনা ঘটে। এই পর্বে উল্লেখযোগ্য ঘটনা পশ্চিমবাংলার নির্বাচন। আন্দোলনের নেতারা বারবার এ রাজ্যে আসেন, বিজেপি-বিরোধী প্রচারে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন ও তাদের পরাজিত করতে সাহায্য করেন। আন্দোলনের ছয় মাস পূর্তিতে তাঁরা ২৬ মে কালা দিবস পালন করেন। গত ২৬-২৭ আগস্ট দেশব্যাপী এক কনভেনশনের মধ্যে দিয়ে আন্দোলনের তৃতীয় পর্ব শুরু হয়েছে যা ‘অপারেশন উত্তরপ্রদেশ’ দিয়েই শেষ হবে।
এই পর্বের শুরুতেই একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা ঘটে গেছে। উত্তরপ্রদেশের বিধানসভা নির্বাচন এই মুহূর্তে বিজেপির পাখির চোখ। সেই লক্ষ্যে তারা সারা উত্তর ভারত জুড়ে মেরুকরণ করা শুরু করে দিয়েছে। ইউপি, মধ্যপ্রদেশ, হরিয়ানায় প্রায় প্রতিদিন সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ হচ্ছে। চুড়ি-বিক্রেতা, বিস্কুট-বিক্রেতাদের মতো সাধারণ মেহনতি মানুষ তাদের হিংস্র আক্রমণের শিকার হচ্ছেন। খোদ দিল্লির দ্বারকা অঞ্চলে একটি হজ হাউস নির্মাণ করা নিয়ে সঙ্ঘীরা প্রবল গন্ডগোল সৃষ্টি করেছে। সবচেয়ে নৃশংস ঘটনা ঘটে হরিয়ানার নুহ জেলায়। সেখানে আসিফ এবং রসিদ নামে দুজন যুবককে হিংস্র জনতা ঘিরে ধরে, ‘জয় শ্রীরাম’ বলার জন্য জোরাজুরি করে। রসিদ পালিয়ে যায় কিন্তু জনতার প্রহারে আসিফের মৃত্যু হয়। পুলিশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করে। এরপর ঐ জেলার বিভিন্ন গ্রামে পঞ্চায়েত সভায় অভিযুক্তদের মুক্তির দাবি করা হয়। নুহ শহরে মহাপঞ্চায়েত হয় এবং মুসলিমদের কুৎসিত ভাষায় আক্রমণ করা হয়। নুহ মেওয়াত অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত যেখানে বিপুল সংখ্যক মায়ো মুসলিমদের বাস। তাঁরাও পালটা সভা করেন ও তাঁদের সম্প্রদায়ের প্রতি কটুক্তির বিরোধিতা করেন। গত প্রায় তিন মাস ধরে এই বাদানুবাদের কারণে এলাকার পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে।
প্রসঙ্গত হরিয়ানার এই অঞ্চলে, যা আদপে দক্ষিণ হরিয়ানা, কৃষক আন্দোলন অপেক্ষাকৃত ভাবে দুর্বল। রাজ্যের সর্বত্র বিজেপি নেতারা প্রবল বিক্ষোভের সম্মুখীন হয়েছেন কিন্তু এই অঞ্চলে তার আঁচ খুব বেশি পড়েনি। তবুও কনভেনশনের দু' দিন বাদে সংযুক্ত কিষাণ মোর্চার (এসকেএম) আহ্বায়ক দর্শন পাল, রাকেশ টিকায়েত, যোগেন্দ্র যাদব সহ নেতারা নুহতে মহাপঞ্চায়েত সংগঠিত করেন। তাঁরা কিন্তু এলাকার সাম্প্রদায়িক সমস্যা নিয়ে কোনও উচ্চবাচ্য করেননি। তাঁরা কৃষকদের আরও সংঘবদ্ধ হওয়ার ওপর জোর দেন এবং তাঁদের আরও দলে দলে বিভিন্ন সমাবেশে উপস্থিত হতে বলেন। তাঁরা এই অঞ্চল দিয়ে দিল্লিতে প্রবেশ পথের রাস্তা রুদ্ধ করার আওয়াজ তোলেন। কৃষকদের বিপুল সমাবেশ ধর্মীয় ভেদাভেদ মুছে দেয়। এই ভাবে শাসক দল যখন মুসলিম-বিদ্বেষ ছড়ানোর চেষ্টা করছে, তখন এই আন্দোলন ধর্ম, সম্প্রদায় নির্বিশেষে মানুষকে সংঘটিত করছে। ঠিক এই কারণেই এসকেএম ৫ সেপ্টেম্বর মুজাফরনগরে বিপুল জমায়েতের ডাক দিয়েছে।
পাঠকদের নিশ্চয় স্মরণে আছে, ২০১৩ সালে এই অঞ্চলের দাঙ্গায় হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কে ফাটল ধরেছিল এবং তখন কিছু কৃষক নেতা হিন্দুদের প্ররোচিত করার কারণে মহেন্দ্র সিং টিকায়েতের ঘনিষ্ঠ কমরেড মুসলমান জাঠ নেতা গুলাম মহম্মদ জোলা নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে এই নেতারা অনুতপ্ত হন এবং তারপর থেকে আন্দোলনের তরফে ধর্মীয় সম্পর্ককে মেরামত করার জন্য তাঁরা লাগাতার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। ৫ তারিখের মহাসমাবেশ সেই লক্ষ্যে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রচেষ্টা। উত্তর ভারতের উগ্র সাম্প্রদায়িক আবহের মধ্যে আজ তাই কৃষক আন্দোলনের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
নুহ মহাপঞ্চায়েত হয় ২৯ আগস্ট। মনে রাখতে হবে, তার আগের দিনই কিন্তু কার্নালে কৃষকদের ওপর খাট্টার সরকারের পুলিশ বর্বরোচিত আক্রমণ করেছে। প্রবীণ কৃষকরা রক্তাক্ত হন, একজন মারা যান, বহু আহত হয়ে এখনও হাসপাতালে চিকিৎসায় আছেন। প্রতিবাদকারীদের মাথা ফাটিয়ে দেওয়ার যে আদেশ এসডিএম আয়ুষ সিনহা দিয়েছিলেন, তা এক কথায় বিজেপি আমলে প্রশাসন পরিচালনায় এক অভূতপূর্ব নজির সৃষ্টি করেছে। আরও ন্যাক্কারজনক, মুখ্যমন্ত্রী ও উপ-মুখ্যমন্ত্রী দুজনেই সিনহার এই আচরণকে সমর্থন করেছেন। এসকেএম নেতৃত্ব সিনহাকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়ার দাবি করেছেন। কিন্তু শুধুমাত্র বদলি করেই তাঁকে ছাড় দেওয়া হয়েছে।
বিজেপি এখন ক্ষিপ্ত, যেন তেন প্রকারে তারা এই আন্দোলনকে বরবাদ করতে চায়। এর মূল কারণ হচ্ছে আন্দোলন সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ তৈরির ক্ষেত্রে প্রবল বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। খাট্টার সরকারের এই স্বৈরাচারী আক্রমণ কিন্তু কৃষকদের দমিয়ে দিতে পারেনি। তাঁরা পরের দিনই নুহ, যে অঞ্চল সাম্প্রদায়িক বিস্ফোরণের ওপর অবস্থান করছে, সেখানে কৃষক নেতারা সভা করেছেন। এছাড়া পুরো হরিয়ানা জুড়ে সর্বত্র তাঁরা বিজেপি-জেজেপি নেতাদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন, অবরোধ হচ্ছে, কালো পতাকা দেখাচ্ছেন। কৃষকদের রুদ্র মূর্তি দেখে অনেক নেতা তাঁদের অনুষ্ঠান বাতিল করে দিচ্ছেন।
২৬ ও ২৭ অগস্ট'এর কনভেনশন নানান দিক থেকেই ব্যতিক্রমী ও পথ-নির্দেশকারী। প্রথমত, এই সমাবেশে বাইশটি রাজ্যের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন যা আন্দোলনের সর্বভারতীয় চরিত্রকে প্রতিফলিত করেছে। দ্বিতীয়ত, সমাবেশে কৃষক ও ক্ষেতমজুর সংগঠন ছাড়াও বহু ট্রেড ইউনিয়ন, মহিলা সংগঠন ও ছাত্র-যুব সংগঠন অংশগ্রহণ করেছে। এর থেকে প্রমাণিত যে আন্দোলন শুধু কৃষিজীবীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। তৃতীয়ত, শ্রমিক, আদিবাসী, গ্রামীণ দরিদ্র মানুষদের সমস্যা নিয়েও আলোচনা হয়েছে। চতুর্থত, কৃষি আইন, বিদ্যুৎ বিল ইত্যাদি বাতিল করার দাবির পাশাপাশি শ্রমিক-বিরোধী চারটি শ্রম বিধি বাতিল করার দাবি তোলা হয়েছে। পঞ্চমত, অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে সংখ্যালঘুদের ওপর ক্রমবর্ধমান আক্রমণের তীব্র বিরোধিতা করা হয়েছে। দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ ও বীমা, ব্যাংক, রেল, বিমানবন্দর, টেলিকম'এর মতো রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলিকে কর্পোরেটদের কাছে বেচে দেওয়ার চক্রান্ত করার জন্য মোদী সরকারের তীব্র সমালোচনা করা হয়েছে। ষষ্ঠত, এসকেএম দেশের সব রাজ্যে জেলা স্তরে ইউনিট গড়ে তুলে আন্দোলনকে তৃণমূল স্তর অবধি বিস্তার করার জন্য আহ্বান জানিয়েছে। লক্ষণীয়, কৃষক নেতৃত্ব দেশের বিভিন্ন রাজ্যের সমস্ত শ্রেণি ও সম্প্রদায়কে তাঁদের আন্দোলনে শামিল করে তাকে আরও বৃহত্তর রূপ দেওয়ার চেষ্টা করছেন।
এর পাশাপাশি তাঁরা কিন্তু এও বলছেন যে যদি সরকারের সুবুদ্ধি হয় তাহলে তাঁরা সব সময় আলোচনায় বসবার জন্য রাজী। তাঁরা একটা ‘মিডিল গ্রাউন্ড’ খুঁজতেও রাজি আছেন, যদি সরকার তিন কালা কানুন ও বিদ্যুৎ বিল বাতিল করে, ফসলের গোড়া পোড়ানোর জন্য চাষিদের জরিমানা না করে এবং এমএসপি বহাল রাখার আইনি ব্যবস্থা করে। তাঁদের আশু লক্ষ্য ৫ সেপ্টেম্বর মুজাফরনগর মহাপঞ্চায়েত সফল করা। সেখান থেকে তাঁরা ‘মিশন উত্তরপ্রদেশ’ ঘোষণা করবেন। মূল লক্ষ্য তো, বলাই বাহুল্য, বিজেপিকে উত্তরপ্রদেশ থেকে ঝেঁটিয়ে বিদেয় করা।
👌🏼👌🏼👌🏼👌🏼👌🏼🌹
ReplyDeleteবিজেপি যত তাড়াতাড়ি উত্তরপ্রদেশ থেকে এবং সমগ্র দেশ থেকে ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যাবে ততই দেশের মানুষের মঙ্গল । বর্বরদের দল নিপাত যাক । 🤛🏼
• কৃষক আন্দোলন দীর্ঘজীবী হোক এবং কৃষকরা আমাদের সবাইকে মুক্তির পথ দেখাক । ♥️🌾