Friday 10 September 2021

ফোর্ড কোম্পানিও বন্ধ হল

পরিবর্তিত দুনিয়ায় কর্মহীন মানুষ

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য

 

সানন্দ ও চেন্নাইয়ে অবস্থিত ফোর্ড ইন্ডিয়া গাড়ি নির্মাতা কোম্পানির কারখানা বন্ধ হয়ে গেল। কোম্পানি জানিয়েছে, তাদের সঞ্চিত লোকসানের পরিমাণ ২ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি। এই দুটি কারখানায় ৪০০০’এর মতো স্থায়ী শ্রমিক-কর্মচারী কাজ করতেন। এছাড়াও গোটা দেশ জুড়ে ফোর্ড কোম্পানির রিটেল ও অন্যান্য নানান কর্মসূত্রে জড়িত ছিলেন প্রায় ৪০,০০০ মানুষ। কোম্পানি বন্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই সমস্ত মানুষের কাজও চলে গেল। গত কয়েক বছরে এই নিয়ে পাঁচটি গাড়ি নির্মাতা কোম্পানি লোকসানের কারণে ভারত ছেড়ে বিদায় নিয়েছে। এমনতর ঘটনা যে কোভিডের কারণেই হয়েছে, তা কিন্তু নয়। বোঝাই যাচ্ছে, পড়তি মুনাফার হারের জন্যই তাদের বিদায়।

ফোর্ড ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রেসিডেন্ট অনুরাগ মেহরোত্রা স্পষ্টতই জানিয়েছেন যে, বহু কসরত করেও তারা আগামী দিনে লাভালাভের কোনও উপায় খুঁজে পাচ্ছেন না। দিনের আলোর মতো স্পষ্ট, ম্যানুফ্যাকচারিং সেক্টরে পুঁজি তার যথেষ্ট মুনাফা অর্জনের উপায় আর সত্যিই খুঁজে পাচ্ছে না। পুঁজি এখন তাই সরে যাচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চালিত ডিজিটাল অর্থনীতির ভুবনে, যেখানে মুনাফার হার অবিশ্বাস্যরকম ভাবে উর্ধ্বমুখি। তার অন্যতম কারণ, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-চালিত এমন এক স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রব্যবস্থা সেখানে গড়ে উঠেছে, যেখানে মনুষ্য-শ্রমের আপেক্ষিক ব্যবহার এতটাই কম যে মজুরি-খরচ নিম্নমুখি হওয়ার ফলে মুনাফার হার সেখানে বাড়তে পেরেছে। আর পুঁজি তো সেখানেই দৌড়বে যেখানে মজুরি-খরচ কম ও ফলত মুনাফার হার অত্যধিক।

কেউ বলতেই পারেন, অন্যান্য গাড়ি কোম্পানিগুলি (যেমন, মারুতি, হুন্ডাই ইত্যাদি) কীভাবে তাহলে চলছে? কয়েকটি গাড়ি কোম্পানি বন্ধ হয়ে যাওয়া মানে যেমন গাড়ি উৎপাদনই বন্ধ হয়ে যাওয়া নয়, একই ভাবে ম্যানুফ্যাকচারিং ক্ষেত্র সংকুচিত হয়ে আসা মানে এই ক্ষেত্রটিই উবে যাবে তা মোটে নয়। ঠিক যেভাবে শিল্প বিপ্লবের কালে ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্পের দ্রুত বিকাশের এই অর্থ ছিল না যে কৃষি ক্ষেত্রটি আর থাকবে না। মূল কথাটি হল, পুঁজির বহমানতা কোনদিকে এবং কোন ক্ষেত্রটি আপেক্ষিক ভাবে বেশি কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা তৈরি করছে এবং মুনাফার হার কোথায় বাড়ছে। সে অর্থে, ম্যানুফ্যাকচারিং ক্ষেত্রের অংশভাক হিসেবে গাড়ি শিল্পেরও সংকোচন হওয়ার কথা এবং সেই মোতাবেক কিছু গাড়ি কোম্পানির পাততাড়ি গুটিয়ে নেওয়াটা রাজনৈতিক অর্থনীতির বাস্তবতা। যদি ফোর্ড ইন্ডিয়া’র কারখানা দুটি পশ্চিমবঙ্গে অবস্থিত হত তাহলে না হয় চোখ বুজেই শ্রমিকদের ঘাড়ে ‘কাজ না করা’ ও ‘ট্রেড ইউনিয়নবাজী’র দোষ দেওয়া যেত। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সে কথাটি বলা যাচ্ছে না এবং পুঁজির নিয়মে কর্পোরেট কোম্পানির মুনাফার তাড়নাতেই যে উৎপাদন বন্ধ হয় বা চলে, তা আরও একবার স্পষ্ট দিবালোকে ধরা দিল। এ প্রসঙ্গে স্মরণে নেওয়া যেতে পারে সত্যজিৎ রায়ের ‘সীমাবদ্ধ’ ছবিটিকেও, যেখানে তিনি ম্যানেজমেন্টের বেয়াদপিতে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে কারখানা বন্ধের আসল রহস্যটি ফাঁস করে দিয়েছিলেন।

এমন এক আবহে যদি প্রশ্ন করা হয়, আমাদের দেশে সব থেকে বেশি মুনাফা অর্জনকারী সংস্থাটির নাম কী- তাহলে এক নম্বরে আসবে টাটা কনসালটেন্সি সার্ভিসেস (টিসিএস)। গত আর্থিক বছরের শেষে (৩১ মার্চ ২০২০) তাদের নেট মুনাফা ছিল ৩৩,২৬০ কোটি টাকা, যা তার আগের পাঁচ বছর ধরে ক্রমাগত উর্ধ্বগতি পেয়েছে। নিচের ছবি দ্রষ্টব্য:


একই সময়ে দ্বিতীয় স্থানে ছিল রিলায়েন্স কোম্পানি, যাদের মুনাফার ৫৭.৫ শতাংশ এসেছিল ডিজিটাল পরিষেবা ও পেট্রোকেম’এর ব্যবসা থেকে। তৃতীয় ও চতুর্থ স্থানে ছিল যথাক্রমে এইচডিএফসি ও ইনফোসিস। অর্থাৎ, দেখাই যাচ্ছে, মুনাফার সিংহভাগ যাচ্ছে ডিজিটাল ও ডিজিটাল-ভিত্তিক পরিষেবার ঘরে। এবারে বিশ্ব জুড়ে প্রথম কয়েকটি মুনাফা অর্জনকারী সংস্থার নাম করতে হলে আসবে যথাক্রমে অ্যাপেল, মাইক্রোসফট, ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড কমার্শিয়াল ব্যাঙ্ক অফ চায়না, চায়না কনস্ট্রাকশন ব্যাঙ্ক কর্পোরেশন এবং অ্যালফাবেট’এর নাম সমূহ। এখানেও পরিলক্ষিত যে, ডিজিটাল পরিষেবা ও আর্থিক পরিষেবার সংস্থাগুলিই মুনাফার সর্বোচ্চ শিখরে আরোহন করে বসে আছে। আর যদি বিচার করি, ২০২০’র গোড়া থেকে ২০২১’এর গোড়ায় (এক বছরে) কোন সংস্থার মুনাফা কী হারে বেড়েছে, তাহলে প্রথমেই দেখব অ্যামাজন’এর নাম যাদের এই এক বছরে মুনাফা বৃদ্ধির হার ছিল ২২০ শতাংশ, এরপর অ্যালফাবেট যাদের বৃদ্ধির হার ১৬২ শতাংশ। এই তুমুল মুনাফার বৃদ্ধির হার থেকে বোঝাই যাচ্ছে, অর্থনীতির অভিঘাত এখন কোন পানে।

নতুন যে ক্ষেত্রে পুঁজি এখন সমবেত হচ্ছে ও উচ্চ হারে মুনাফা অর্জন করছে, সেই ক্ষেত্র কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চালিত এমন এক স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা যা পুরনো অর্থনীতির বয়ান থেকে বহু অর্থে ভিন্ন। কর্মের এখানে স্থায়ী চরিত্র নেই, গিগ অর্থনীতির অভিষেকে সমস্ত কাজই প্রায় অস্থায়ী চরিত্রের ও পরিবর্তনশীল, অধিক পরিমাণে ভার্চুয়াল-নির্ভর এবং সর্বোপরি এমন এক অ্যালগরিদম’এর কোঠরে বাঁধা পড়া যে খুড়োর কল সামনে ঝুলিয়ে জীবনভর দৌড়ে মরা। এক বিচিত্র, কঠিন ও লোভনীয় জগতে আমাদের প্রবেশ।

তাই, ধীরে ধীরে আরও বহু ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানির জীবনকাল অস্তমিত হয়ে আসবে। পুঁজি এই কম লাভজনক ক্ষেত্র থেকে সরে যাবে ডিজিটাল দুনিয়ার অধিক মুনাফার ক্ষেত্রে। বহু কর্মরত হাত স্তব্ধ হবে কাজের অভাবে। আবার নতুন নতুন কাজের ক্ষেত্রও প্রস্তুত হবে, কিন্তু সে কাজের জন্য লাগবে নতুনতর দক্ষতা ও পরিচয়। হয়তো ৪০ কি ৪৫ বছর বয়সেই বন্ধ হয়ে যাওয়া সংস্থার শ্রমিক-কর্মচারী ভিআরএস নিয়ে নিজ ঘরে বসেই বদ্ধ জীবন কাটাবেন, অথবা নিজেকে তৈরি করে নেবেন নতুন কর্মের রীতি ও আঙ্গিকে। কিন্তু কোনও কাজেরই কোনও স্থায়ী ঠিকানা থাকবে না আর। অতএব, নিজেকে বদলে নেবার, সময়পোযোগী হয়ে ওঠার নিরন্তর প্রচেষ্টাই হবে নতুন জীবনের স্মারক। যন্ত্রের অ্যালগরিদমের সঙ্গে নতুন লড়াইয়ে কেমন করে ব্যক্তিগত ও যূথবদ্ধ স্তরে যুঝতে হয়- সেই হবে নবতর রূপে গড়ে উঠতে থাকা শ্রমিক-কর্মচারী ঐক্যের প্রথম পাঠ। তারপর, পুরনোকালের ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের জোর আবার ফিরে আসবে কিনা, নাকি নতুন রাজনৈতিক-অর্থনীতির ভুবনে নানান অভিনব মাত্রার আলোকে এক নবতর উত্তরণ ঘটবে- সে সব সম্ভাবনা এখনও কালের গর্ভে। তবে এই মুহূর্তে আগত সময়কে বোঝাটা সব থেকে জরুরি।

বলাই বাহুল্য, অস্তমিত ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্পের বিপ্রতীপে ডিজিটাল শিল্পের বিকাশে উন্নততর চিপ উৎপাদনের গুরুত্ব অসীম বৃদ্ধি পাবে। গত এপ্রিল ২০১৯ থেকে এই সময় পর্যন্ত চিপ বাণিজ্যের বৃদ্ধির রেখা বরাবরই উর্ধ্বমুখি ও তার সর্বমোট আয় আজ এসে প্রায় ২৫ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। ডিজিটাল দুনিয়া যত সম্প্রসারিত ও ব্যাপকতর হবে তত বেশি করে উন্নত চিপের দাবি আরও বাড়বে। অর্থাৎ, ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্পের মৌলিক কিছু উৎপাদন ব্যতিরেকে (যেমন, জামাকাপড়, নিত্য ব্যবহার্য, ঘরের আসবাবপত্র, নির্মাণদ্রব্য ইত্যাদি) আর যেটুকু উৎপাদন হবে তা ডিজিটাল শিল্পের প্রয়োজনীয়তা অনুযায়ী, যেমন, মোবাইল, চিপ, ল্যাপটপ, ট্যাবলেট, সার্ভার ইত্যাদি। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চালিত ডিজিটাল ও ভার্চুয়াল শিল্পই হবে আজকের আধুনিক অর্থনীতির ভিত্তিভূমি যার ওপর নির্ভর করে ম্যানুফ্যাকচারিং ও অন্যান্য শিল্প ক্ষেত্রগুলি অনেকাংশে আবর্তিত হবে। বলাই বাহুল্য, জিডিপি’র অনুপাতে এতদিন পরিষেবা ক্ষেত্র ধীরে ধীরে সিংহভাগ অংশীদার হয়ে উঠেছিল, আজ ডিজিটাল ভিত্তিক পরিষেবা ও ভার্চুয়াল জগতের ক্ষেত্রই অন্যতম ভাগীদারি নিয়ে উঠে আসছে।

বলার কথা এই, শুধু ফোর্ড ইন্ডিয়া নয়, হার্লে-ডেভিডসন, জেনারেল মোটর্স’এর মতো বড় বড় বিদেশি গাড়ি নির্মাতা কোম্পানিও গত কয়েক বছরে ভারত থেকে পাততাড়ি গুটিয়েছে। ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’র বাগাড়ম্বর কোনও কাজে আসেনি। যারা ‘শিল্প’ ‘শিল্প’ করে এখনও লাফালাফি করেন, তারা হয় মানুষকে বোকা বানাতে চান অথবা মূর্খের স্বর্গে বাস করেন। শ্রমিকশ্রেণির সেই পুরনো অবয়বও আজ দৃশ্যান্তরে। আজ নতুন ধরনের শিল্প ও নতুন শ্রমবাহিনীর উত্থান। পুঁজিবাদ বদলে ফেলেছে তার আঙ্গিক। হন্যে হয়ে ঘুরেও ফিরিয়ে আনা যাবে না পুরনো জমানাকে। তাই, নতুন বাস্তবতাকে স্বীকার করে ও সম্যক বুঝে নিয়েই আজকের কর্মরত শ্রমিক বাহিনীর ভিন্নতর অস্তিত্বকে উপলব্ধি করতে হবে। নতুন রাজনৈতিক অর্থনীতির পাঠ অতএব অতীব জরুরি।

 

 

2 comments:

  1. মিহির সেন।11 September 2021 at 21:22

    দেশের তথা সারা বিশ্বের আর্থ সামাজিক অবস্থান, প্রযুক্তি ও রাজনৈতিক বিবর্তন এবং সর্বপরি সাধারন মানুষের জীবন ও জীবিকা নির্বাহের সম্পর্কে অনিন্দ‍্যবাবু দীর্ঘ দিন যাবদ তাঁর সুচিন্তিত বিশ্লেষণ প্রকাশ করে চলছেন আর প্রতিটি অবস্থার অবধারিত পরিনতির কথা আগাম জানিয়ে দিয়েছেন।
    ওনার বিশ্লেষণ গুলি মূলত মূল‍্যতত্ত্ব ও পুঁজীর গতি-প্রকৃতির কার্য-কারন ভিত্তিক। তাই আজ যা খবর হয়ে প্রকাশ পাচ্ছে তার সম্ভবনা আমরা অনিন্দ‍্যবাবুর লেখাতে আগেই উপলব্ধি করতে পেরেছি।
    এই রকম আগাম ধারাবিবরনী পেতে হলে অনিন্দ‍্যবাবুর সব লেখা পড়া ও আলোচনা শোনা খুব জরুরী।

    ReplyDelete
  2. ভাল, তথ্যবহুল ও সহজকরে লেখা । শেয়ার করছি । 👌🏼👌🏼👌🏼👌🏼👌🏼🤙

    ReplyDelete