কলকাতার ভেঙ্গে পড়া নিকাশি
সুপ্রতিম কর্মকার
বৃষ্টি পড়ল আকাশ থেকে। জল জমল শহরে। এই শহরটার নাম কলকাতা। নিজেই সে তিলোত্তমা। তার পরে নোংরা জমা জল খাল পেরিয়ে রাজপথে আসল। আর রাজপথ পেরিয়ে ঘরে ঢুকল। বৃষ্টির জলের তো এটা জায়গা ছিল না! তার ঘর ছিল পুকুর খাল বিল আর নদীরা। অল্প সময়ের জন্য জল জমা শহর কলকাতাকে দেখতেই আমরা মোটামুটি অভ্যস্ত ছিলাম। গঙ্গার বুকের জলে সাগর থেকে জোয়ারের জল ঢুকলে সেই সময় কলকাতার নিকাশি ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ত। ভাটার টান আসলেই জল নেমে যেত খুব তাড়াতাড়ি।
ফি বছরগুলোতে এই চেনা ব্যাপারটা কেমন যেন ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। মেলানো যাচ্ছে না কলকাতার জল ছবি। প্রাকৃতিক বিপর্যয় যে আসবে সে কথা আমরা জেনেছি আগেই। আইপিসিসি সেই সতর্ক বার্তা আমাদের আগেই দিয়েছে। তারপরেও নিকাশি সমস্যা নিয়ে আমাদের এত কেন গা-সওয়া ভাব? প্রশ্নটা চটপট করে ফেলতে পারলেও উত্তরটা কিন্তু এত সহজে পাওয়া যাবে না। তার থেকে বড় প্রশ্ন হল, উত্তরটা দেবে কে?
কলকাতার নিকাশি পরিকাঠামোর ভেঙ্গে পড়া চেহারাটা কিছুদিন হল খুব বেশি করে সামনে উঠে আসছে। কারণ, কলকাতার বুক থেকে নিকাশি পথগুলো নষ্ট হয়ে গেছে। না, নষ্ট হয়ে যায়নি। বলা ভালো, নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। কেন করে দেওয়া হল? একটু তলিয়ে দেখুন- স্বাভাবিক নিকাশি ব্যবস্থাটাকে নষ্ট করতে না পারলে ড্রেনেজ ডেভলপমেটের নামে অর্থ ঢালা যাবে না। বড় বড় ডেভলপমেন্ট ব্যাংকগুলো টাকা ঢালার জন্য লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
কলকাতা শহরের এই জলবন্দী অবস্থাটাকে দেখে চেন্নাই'এর বন্যার কথা খুব মনে হচ্ছিল। চেন্নাই শহরের পুরো নিকাশিটা আডিয়ার আর কুভম নামে দুটো নদী করত। সাথে থাকত শহরের বুকে থাকা বড় বড় সব মন্দিরের পুকুরগুলো। নদী আর পুকুরগুলোকে নষ্ট করে দেবার পর হাতেনাতে প্রমাণ পেল চেন্নাই। কলকাতাতেও তাই হল। শহরের বুকে ছিল দুটো নদী। এক দিকে বিদ্যাধরী অন্য দিকে গঙ্গা। আর ছিল একের সাথে আরেকজন জুড়ে থাকা খালেরা আর ছোট বড় পুকুরের দল। সবার প্রথমে কলকাতা শহরের মাজা ভাঙ্গা হল খালগুলোর। সেটা সংখ্যায় কতগুলো? সরকারি হিসেব বলছে ২৭টি। এমন ঘটনাও সংবাদ মাধ্যমে এসেছে, যেখানে বেহালা অঞ্চলের একটা পুরো খালকে মাটির তলা দিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সহজ ভাবেই প্রাত্যহিক জীবনের অভিজ্ঞতা থেকেই বোঝা যায়, খালের বিকল্প কোনওদিন পাইপলাইন হতে পারে না।
সাহেবরা যখন কলকাতা শহরে বসতি স্থাপন করেছিলেন, সেই সময় পুরো নিকাশি ব্যবস্থাটার দুটো ভাগ ছিল। একটা ছিল স্ট্রম ওয়াটার ফ্লো আর দ্বিতীয়টি ছিল ড্রাই ওয়েদার ফ্লো। সহজ ভাবে বুঝতে গেলে, বৃষ্টির জল আর নোংরা জলকে আলাদা করে ভাবা। এ কথা অস্বীকার করা যাবে না, স্বাধীনতার পর থেকে যে ভাবে জনসংখ্যার চাপ বেড়েছে কলকাতায়, তাতে নোংরা জল উৎপাদনের পরিমাণ অনেক বেড়েছে। পুরনো আমলের পরিকাঠামো দিয়ে সেই জল ম্যানেজমেন্ট সম্ভব হচ্ছিল না। কাজেই সম্পূর্ণ নিকাশি সিস্টেমটাকে তৈরি করা হল হিউম পাইপের ভেতর দিয়ে। এটা করে আরও বিপদ বেড়ে গেল। বাড়ল কেন? ছোট ছোট ড্রেনগুলোকে আগে ঢাল বরাবর যুক্ত করে দেওয়া যেত। এখন সেটা সম্ভব হল না। এখান থেকে একটা জল জমার অবস্থা তৈরি হওয়া শুরু হল।
এখানে একটি খাল ছিল- চুরি গিয়াছেসাহেবেরা কলকাতার নিকাশি সমস্যাটাকে বুঝেছিলেন। কাজেই যেটা দরকার ছিল তা হল, সাহেবদের তৈরি পরিকাঠামোর ক্যাপাসিটি বা ধারণ ক্ষমতাকে বাড়ানো। আর তার সাথে কলকাতার ওয়াটার পকেটগুলোকে ঠিক করা। কলকাতার ক্ষেত্রে একটা বড় সমস্যা হল জবরদখল। বাগজোলা, চড়িয়াল, সুতিখাল, সব খালগুলো আজ সংস্কারের অভাবে বিপন্ন। কোথাও কোথাও ৩০ ফুটের খাল দখল হয়ে ৫ ফুটে চলে এসেছে। আবার কোথাও সরকারি নথিতে খালের নাম আছে কিন্তু বাস্তবে সেখানে হাউজিং কমপ্লেক্স গড়ে উঠেছে। কাজেই প্রশাসনের প্রথম দ্বায়িত্ব হওয়া উচিত খালগুলোকে দখল মুক্ত করা।
তাহলে কী করণীয়? প্রথমে দরকার স্বচ্ছ ম্যাপিং'এর। যেখান থেকে ধারণা স্পষ্ট হবে, কোথায়, কেন, কী কারণে ও কতক্ষণ ধরে জল জমে থাকছে। আর ম্যাপিং'টা ঠিক ভাবে করতে পারলেই খুঁজে পাওয়া যাবে কারণ। এতে সমাধানের পথ বের করা সহজেই সম্ভব। দ্বিতীয় কাজে কলকাতার পুকুরগুলোর দিকে গুরুত্ব বাড়াতে হবে। বর্ষার জল ধরে রাখতে এদের কোনও দ্বিতীয় বিকল্প হয় না। আর প্লাস্টিকের ব্যবহার কলকাতায় নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
No comments:
Post a Comment